দুর্গম দুর্গ – ৯

কাজী আনোয়ার হোসেন

নয়

ঘুমন্ত অবস্থায় ধরা পড়ল ওরা ভারতীয় সৈন্যদের হাতে। ভোর তখন সাড়ে চারটা। কোনও সুযোগ পেল না ওরা বাধা দেবার। সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত অবস্থায় অসমর্পণ করতে হলো ওদেরকে অতর্কিতে অনুপ্রবেশকারী সৈন্যদের কাছে।

রানাই প্রথম জাগল। রানার অচেতন মনের একটা অংশ সব সময় প্রস্তুত থাকে বিপদের জন্যে। এক মুহূর্তে পূর্ণ সজাগ রানা উঠে বসল গুহার মধ্যে কি একটা অস্পষ্ট শব্দ শুনে। ডান হাতটা চলে গেল ‘িপ্রং লোডেড শোলডার হোলস্টারের কাছে। কিন্তু দপ্ করে জ্বলে উঠল একটা টর্চের তীব্র আলো। মূর্তির মত স্থির হয়ে গেল রানা। চোখে কিছু দেখতে পাচ্ছে না সে। টর্চের পেছন থেকে একটা তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বর শোনা গেল।

‘কেউ নড়বে না। নড়লেই মারা পড়বে!’

এক, দুই করে আরও তিনটে টর্চ জ্বলে উঠল। সমস্ত গুহাটা আলোকিত হয়ে গেল উজ্জ্বল আলোয়। রানা চেয়ে দেখল কেবল টর্চ নয়; অটোমেটিক কারবাইনের চক্চকে নলও দেখা যাচ্ছে টর্চগুলোর পাশে।

‘মাথার ওপর হাত তোলো সবাই!’ আবার এল তীক্ষ্ণ আদেশ। ধীরে ধীরে মাথার ওপর হাত তুলল রানা। চেয়ে দেখল মাহবুব ছাড়া সবাই উঠে বসেছে এতক্ষণে। ওর দেখাদেখি সবাই হাত তুলল মাথার ওপর।

‘দেখেছ, শান্তা, একবিন্দু ভাব পরিবর্তন নেই ওদের মুখে, চোখের পাতাও কাঁপল না একবার। ভয়ঙ্কর লোক এরা, শান্তা। পাকিস্তান তার সেরা লোকদেরই পাঠিয়েছে।

তিক্ততায় ভরে গেল রানার মন। হেরে গেছে সে। এবার কপালে কি ঘটতে যাচ্ছে ভাবতে গিয়ে আঁৎকে উঠে দূর করে দিল সে চিন্তাটা মন থেকে। ভবিষ্যৎ ভেবে লাভ কি? প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতিটি কাজ, প্রতিটা চিন্তা এখন ব্যয় করা উচিত বর্তমানের পেছনে। ধরা পড়েছে বলে যে ধরা পড়েই থাকতে হবে তার কোনও মানে নেই। বিপদমুক্তির কোনও না কোনও পথ নিশ্চয়ই আছে। ভবিষ্যৎ ভাবতে গেলে হাত পা পেটের ভেতর সেঁধিয়ে যেতে চায়, ভবিষ্যৎ কল্পনা সব সময় সুখকর নয়।

নাজির বেগের কি হলো? ভোর রাতের পাহারায় ও-ই ছিল। ওকি পায়ের শব্দ শুনে লুকিয়ে পড়েছে কোথাও, নাকি ধরা পড়েছে? জিজ্ঞেস করতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিল রানা। যদি সে ধরা পড়ে না থাকে তাহলে এখনও সুযোগ আছে। একজন সেন্ট্রি দক্ষ হাতে হোলস্টার থেকে তুলে নিল রানার পিস্তলটা।

‘আমাদের খুঁজে পেলে কি করে?’ জিজ্ঞেস করল রানা শান্ত কণ্ঠে

‘কর্নেল রাম নারায়ণের কোয়ার্টার থেকে খাবার চুরি করে অত্যন্ত বীরত্বের পরিচয় দিয়েছ বলে ভাবছ তোমরা। আসলে কাজটা গর্দভের কাজ হয়েছে। দুটো ব্লাড হাউণ্ড এখানে নিয়ে এসেছে আমাদের- নিজেদের আর বিশেষ কষ্ট করতে হয়নি।’

‘কিন্তু এত বৃষ্টির মধ্যে…’ মিশ্ৰী খান কিছু বলতে যাচ্ছিল।

‘শাট আপ!’ ধমক দিয়ে ওকে থামিয়ে দিয়ে পাশ ফিরল অফিসার স্পর্দাটা ছিঁড়ে নামিয়ে দাও। আমার দুই ধারে দুইজন করে রাইফেল নিয়ে প্রস্তুত থাকো।’ আবার ফিরল সে রানাদের দিকে। ‘তোমরা চারজন বেরিয়ে এসো বাইরে। বিশ্বাস করো, তোমাদের কুকুরের মত গুলি করে মারবার ছুতো খুঁজছে আমার লোকেরা। কারও কোনও মতলব থাকলে চেষ্টা করে দেখতে পারো- ফল ভাল হবে না।

মাথার ওপর হাত তুলে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল চারজন। এক পা এগোতেই আবার আদেশ এল চাবুকের মত। থমকে থেমে গেল সবাই।

‘দাঁড়াও!’ টর্চের আলো ফেলল সে এবার মাহবুবের ওপর। আলতাফের উদ্দেশে বলল, ‘একপাশে সরে দাঁড়াও। কে লোকটা?’

‘ওকে ভয় পাবার কিছুই নেই,’ বলল রানা। ‘আমাদেরই লোক, কিন্তু ভয়ঙ্কর ভাবে জখম হয়েছে। ও এখন মৃত্যু শয্যায়।

‘আচ্ছা, দেখছি। পেছনে সরে যাওঁ সবাই। একেবারে ওই দেয়াল পর্যন্ত।’ মাহবুবকে ডিঙিয়ে সরে গেল ওরা দেয়ালের দিকে। চট্ করে বসে পড়ে মাটির ওপর কারবাইনটা রেখে পিস্তল বের করল অফিসার। ধীরে ধীরে এগোল মাহবুবের দিকে। রানা চেয়ে দেখল, চারটে রাইফেল প্রস্তুত আছে ওদের জন্যে। অফিসারের সাথে সাথে ওরাও এগিয়ে আসছে সামনে। রানা বুঝল, চমৎকার ট্রেনিং পেয়েছে এরা, রীতিমত দক্ষতা প্রকাশ পাচ্ছে এদের প্রতিটা কার্যকলাপে।

এক ঝটকায় মাহবুবের গায়ের চাদরটা উঠিয়ে ফেলল অফিসার। ঘুমের মধ্যেও ককিয়ে উঠল মাহবুব আহত পায়ে হঠাৎ ঝাঁকি খেয়ে। দ্রুত একবার চোখ বুলাল অফিসার মাহবুবের কুঁচকানো মুখ আর ব্যাণ্ডেজ বাঁধা পায়ের ওপর। গ্যাংগ্রিনের দুর্গন্ধ নাকে পৌঁছতেই খানিকটা পিছিয়ে গেল সে। তারপর যত্নের সঙ্গে ঢেকে দিল আবার মাহবুবের অসুস্থ দেহ।

‘সত্যি কথাই বলেছ। আমরা বর্বর নই। মুমূর্ষু লোকের সাথে আমাদের কোন ঝগড়া নেই। ও এখানেই থাক, বাকি সবাই বেরিয়ে এসো গুহা থেকে।’

উঠে দাঁড়িয়ে পায়ে পায়ে পিছিয়ে গেল অফিসার স্থির নিষ্কম্প হাতে টর্চ আর পিস্তল ধরে। পিস্তলটা হোলস্টারে রেখে কারবাইন তুলে নিল সে মাটি থেকে।

ধীরে ধীরে বেরিয়ে এল সবাই বাইরে।

বৃষ্টি থেমে গেছে। এখনও অন্ধকার চারদিকে- কিন্তু পুবের আকাশটায় ফর্সা হয়ে আসবার আভাস। উজ্জ্বল একটা ভোরের তারা টিপটিপ করে জ্বলছে। পবিত্র, শান্ত একটা ভাব।

চারদিকে চাইল রানা নিরুৎসুক দৃষ্টি মেলে। স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছে সে। নাজির বেগের কোন চিহ্নই নেই। লাফিয়ে উঠল রানার বুকের ভেতরটা আশার আলো দেখতে পেয়ে। দ্রুত চলতে আরম্ভ করল চিন্তা নাজিরের হাতে অটোমেটিক রাইফেল আছে একটা, এরা মোট আটজন এক্সট্রা ম্যাগাজিন কি নিয়েছিল সে সাথে? যদি লুকিয়ে গুলি ছুঁড়তে পারে তাহলে এই আটজনকে শেষ করে দিতে পারবে নাজির স্পেয়ার ম্যাগাজিন না থাকলেও।

‘তুমি হয়তো ভাবছ তোমাদের প্রহরীটা কোথায় গেল, তাই না?’ বিদ্রূপ ভরা কণ্ঠে প্রশ্ন করল অফিসার। জামার হাতায় চিহ্ন দেখে এতক্ষণে বুঝল রানা ওর র‍্যাঙ্ক হচ্ছে লেফটেন্যান্ট। ‘অত ভাবনার কিছু নেই। বেশি দূর নয়, কাছেই ঘুমিয়ে আছে। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন সে এখন।

‘তোমরা খুন করেছ ওকে?’ দুই হাত মুঠো করে নিজেকে সামলাবার চেষ্টা করল রানা। হাতের তালু ব্যথা হয়ে গেল আঙুলের চাপে।

মরে গেছে না বেঁচে আছে সঠিক করে বলতে পারব না। অতি সহজে আমাদের ফাঁদে পা দিয়েছে লোকটা। ওই পাথরের আড়ালে আমাদের একজন বসে মুখ দিয়ে একটা বিচিত্র শব্দ করেছে- ও গেছে শব্দের উৎস অনুসন্ধান করতে। দ্বিতীয়জনের রাইফেলের কুঁদো পড়েছে এসে মাথার ওপর। ব্যস, ফ্ল্যাট।

ধীরে ধীরে মুঠি দুটো ঢিল করল রানা। তাহলে নাজির বেগের আশাও শেষ।

‘যাক্। কোথায় চলেছি আমরা এখন?’

‘রাজগড়ে। কিন্তু একটা কথার আগে উত্তর দাও। এক্সপ্লোসিভগুলো কোথায়?’

সোজা টর্চটা ধরল লেফটেন্যান্ট রানার মুখের ওপর।

‘এক্সপ্লোসিভ!’ বিস্মিত হবার ভান করল রানা। ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, ‘কিসের এক্সপ্লোসিভ?’ কথাটা শেষ করবার আগেই দড়াম করে সাত ব্যাটারির টর্চটা এসে লাগল ওর মুখে প্রচণ্ড বেগে। পড়ে গেল রানা মাটিতে টলতে টলতে আবার উঠে দাঁড়াল সে। ঠোঁট কেটে রক্ত পড়ছে। জিভে নোনতা লাগল রক্তের স্বাদ

‘কোথায় টিএনটি-র বাক্স?’

‘গাঁজা খেয়েছ নাকি হে, ছোকরা! কি আবোল তাবোল…’

‘শাট্ আপ্!’

আবার চালাল সে টর্চ। মুখটা সরিয়ে নেবার চেষ্টা করল রানা। কিন্তু চোয়ালের হাড়ের ওপর এসে পড়ল সেটা ঠকাশ্ করে। ঠিক জুলফির নিচে। আঁধার হয়ে গেল রানার চোখ – টলমল করে দুলছে দুনিয়াটা। দরদর করে রক্ত পড়ছে গাল বেয়ে। মূর্ছার শেষ প্রান্ত থেকে নিজেকে ফিরিয়ে আনল সে অমানুষিক মানসিক বল প্রয়োগ করে। আবার পায়ের নিচের মাটিটা শক্ত মনে হলো ওর কাছে।

‘বন্দীদের প্রতি এই কি ভারতীয় ব্যবহার নাকি?’ বলল সে নিস্তেজ কণ্ঠে।

‘বন্দী যদি সৈনিক হত তাহলে সে অন্য ব্যবহার পেত। কিন্তু নরঘাতক স্পাইয়ের জন্যে…’ উত্তেজনায় কাঁপছে লেফটেন্যান্টের কণ্ঠস্বর।

‘আমরা স্পাই না,’ হাতের পৌঁছায় ঠোঁটের রক্ত মুছে বলল রানা ‘আমরা সৈনিক, যুদ্ধ করতে এসেছি শত্রুদেশের সঙ্গে।

‘তাহলে তোমাদের ইউনিফরম কোথায়? তোমরা নিশাচর স্পাই! রাতের অন্ধকারে মানুষের পিঠে ছুরি বসিয়ে দাও। তোমরা কসাই। সুযোগ পেলেই গলায় ছুরি চালাও।’ হঠাৎ থেমে গেল লেফটেন্যান্ট কিছু একটা জিনিসের ওপর চোখ পড়তেই। রানা ঘুরে দেখল নাজির বেগকে নিয়ে আসা হচ্ছে এদিকে। পেছন থেকে বেয়োনেটের খোঁচায় কাতরাতে কাতরাতে আসছে সে। কাছে আসতেই দেখা গেল বাম গালটায় এক থোকা রক্ত জমে আছে। মাথার কোনও একটা গুরুতর জখম থেকে রক্ত পড়েছে প্রচুর পরিমাণে।

‘সবাই বসে পড়ো মাটিতে,’ আদেশ দিল লেফটেন্যান্ট। নিজের লোকদের দিকে ফিরে বলল, ‘হাতগুলো বেঁধে ফেলো।’

‘আমাদের গুলি করে মেরে ফেলা হবে এখন, তাই না?’ শান্ত ভাবে জিজ্ঞেস করল রানা। তাই যদি হয় তাহলে যুদ্ধ করে মরবে, স্থির করল সে। হাতবাঁধা অবস্থায় মরার চেয়ে সম্মুখ যুদ্ধে প্রাণ দেয়া অনেক ভাল। কিন্তু যদি এই মুহূর্তে ওদেরকে হত্যা করবার ইচ্ছে লেফটেন্যান্টের না থাকে, তাহলে সুযোগের অপেক্ষা করাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।

‘আমি দুঃখিত। সেটা করতে পারলেই খুশি হতাম। কিন্তু আমাদের কর্নেল রাম নারায়ণজী আগে তোমাদের সাথে দু’চারটে কথা বলতে চান। তোমাদের পক্ষে অবশ্য ওঁর সাথে দেখা হওয়ার চাইতে এক্ষুণি গুলি খেয়ে মরে যাওয়া শতগুণে ভাল হত। লেফটেন্যান্ট হাসল একটু। ‘তারপর তোমাদের নিয়ে যাওয়া হবে দ্বারোকার অফিসার ইন কম্যাণ্ড বিগ্রেডিয়ার চৌধুরীর কাছে। আজ সূর্যাস্তের আগেই সব খতম হয়ে যাবে। স্পাইদের ব্যাপারে খুব তাড়াতাড়িই কাজ সেরে থাকি আমরা।’

‘কিন্তু, স্যার! ক্যাপ্টেন!’ দুই হাত তুলে যেন নালিশ জানাচ্ছে এইভাবে এক পা এগিয়ে এল আলতাফ। তারপর থমকে দাঁড়াল দুটো রাইফেলের মাথা বুকের ওপর ঠেকতেই 1

‘ক্যাপ্টেন না, আমি লেফটেন্যান্ট। শুদ্ধ করে দিল অফিসার। ‘আমি লেফটেন্যান্ট অলোক রায়। কি বলছ তুমি, মোটা গদৰ্ভ?’

‘আপনি স্পাইয়ের কথা বলছেন। আমি স্পাই না, হুজুর!’ তড়বড় করে বলতে গিয়ে বেধে যাচ্ছে মুখের কথা। কিরে কেটে বলছি, হুজুর, আমি স্পাই না। আমি ওদের লোক না! দুই চোখ বিস্ফারিত। কথার শেষে নিঃশব্দে ঠোঁট দুটো নড়ছে। ‘আমি কচ্ছের জেলে একজন। গরীব জেলে। এরা জোর করে ধরে এনেছে আমাকে কচ্ছ ভাষা হিন্দিতে অনুবাদ করবার জন্যে। গায়ের জোরে ধরে এনেছে। কিরে কেটে বলছি, হুজুর!’

‘ওরে শালা হারামজাদা!’ ঘুসি পাকিয়ে এগোচ্ছিল মিশ্ৰী খান, কিন্তু ‘উহ্’ বলেই বাঁকা হয়ে গেল ওর দেহটা পেছন দিকে। ভয়ঙ্কর জোরে শিরদাঁড়ার ওপর এসে পড়েছে একটা রাইফেলের বাঁট। হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল সে মাটিতে। মাটিতে পড়েও চিৎকার করে চলল মিশ্রী খান। ‘নিমকহারাম, দুইমুখো সাপ। ওরে শুয়োরের বাচ্চা, তোকে দেখে নেব আমি…’ ঠাস করে একটা শব্দ হলো। একটা বুটের লাথি এসে পড়ল মিশ্রীর মাথায়। ঢলে পড়ল সে জ্ঞান হারিয়ে।

পাথরের মত ঠায় দাঁড়িয়ে রইল রানা। মিশ্রীর দিকে ফিরে চাইল না একবারও। হাত দুটো মুঠো করে দাঁতে দাঁত চেপে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে চেয়ে রইল সে আলতাফের দিকে। আলতাফের মাথায় কি প্ল্যান এসেছে জানে না সে, অনুমানও করতে পারল না; কিন্তু এটুকু বুঝল, ওর এই বানানো গল্পটাকেই সত্য বলে প্রমাণ করবার চেষ্টা করতে হবে।

‘অর্থাৎ?’ প্রশ্ন করল লেফটেন্যান্ট অলোক রায়, তারপর নিজেই উত্তর দিল। ‘গোদের ওপর বিষফোঁড়া। যাই হোক মটু সিং, তোমার কপাল মন্দ। জুয়ার আWডায় যাদের ধরা হবে- সব জুয়াড়ী; দর্শক বললে মাপ নেই। তোমার ভাগ্য এই খুনীগুলোর সাথে লেখা হয়ে গেছে।’

‘না, না, না, হুজুর!’ ভয়ে উত্তেজনায় গলার স্বর উঁচু পর্দায় উঠে গেছে আলতাফের। ‘আমি সত্যি কথা বলছি, হুজুর। আমি ওদের দলের লোক না। ভগবানের দোহাই দিয়ে বলছি…’ গলাটা ভেঙে গেল আলতাফের। একটু সামলে নিয়ে বলল, ‘আমার কোনও দোষ নেই, হুজুর, আমাকে কেন ওদের সাথে মারবেন? আমি আসতে চাইনি ওদের সাথে। আমি লড়াইয়ের লোক না, হুজুর, আমি একজন গরীব জেলে।

‘সে-তো দেখতেই পাচ্ছি,’ বলল লেফটেন্যান্ট অলোক রায়। ‘আর্মিতে থাকলে এত চর্বি জমত না ওই বেধড়ক শরীরে। প্রতি আউন্স চর্বি তোমার কাছে মহামূল্যবান। তোমাকে সাথে আনা ওদের ঠিক হয়নি।’

‘আমি সব কথা বলতে পারি, হুজুর। ওদের অনেক কথা জানি আমি সব কথা শুনলে হয়তো আমাকে…

‘তবে রে, শয়তান?’ বলেই ঝাঁপিয়ে পড়তে যাচ্ছিল রানা আলতাফের ওপর, দু’জন সেন্ট্রি ধরে ফেলল ওর দুই হাত, মুচড়ে টেনে রাখল পেছন থেকে। ঝাড়া দিয়ে ছুটবার ব্যর্থ চেষ্টা করল রানা, তারপর বলল, ‘যদি মুখ দিয়ে একটা কথাও বের করিস, কসম খোদার, তোকে…’

‘থামো!’ ধমকে উঠল তরুণ লেফটেন্যান্ট। তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল, ‘হয়েছে। আর একটি কথা উচ্চারণ করলে ওইখানে ওর পাশে শুয়ে থাকতে হবে।’ তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বুড়ো আঙুল দিয়ে মিশ্রী খানের জ্ঞানহীন দেহটা দেখাল অলোক রায়। তারপর আলতাফের দিকে ফিরে বলল, ‘কোনও কথা দিতে পারছি না, কিন্তু তোমার কিছু বলার থাকলে শুনতে পারি।’

‘সেটা আপনার দয়া। আমার কথা শুনলেই বুঝতে পারবেন, হুজুর।’ আলতাফের কণ্ঠে আশা এবং Cকান্তিকতার আভাস ফুটে উঠল। সাহসও ফিরে এল কিছুটা। নাটকীয় ভাবে রানা আর মিশ্রীর দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল আলতাফ, ‘এরা সাধারণ সৈনিক না, হুজুর- উঁচু উঁচু র‍্যাঙ্কের অফিসার পাকিস্তান নেভির অফিসার সব।’

‘যেটা আমরা জানি না সে-রকম কিছু তথ্য বলো, গর্দভ। এরা বহুদিন থেকেই পেছনে লেগেছে আমাদের। যদি তোমার এইটুকুই বলার থাকে…’

‘দাঁড়ান!’ হাত তুলে বাধা দিল আলতাফ। নানান জায়গা থেকে বেছে বেছে এদের একসাথে করা হয়েছে। গত রোববার বিকেল বেলা এসে পৌঁছেচে ওরা কেটি বন্দরে। সেইদিনই সন্ধ্যার সময় রওনা হয়েছে একটা নৌকায় চড়ে।

মাথা নাড়ল অলোক রায়। ‘এই পর্যন্ত আমরাও জানি। বলে যাও।’

‘আপনারাও জানেন? কি করে…’ বিস্মিত মুগ্ধ দৃষ্টিতে চাইল আলতাফ লেফটেন্যান্টের মুখের দিকে।

‘সেটা তোমার না জানলেও চলবে। বলে যাও।’

‘হঠাৎ ওদের এঞ্জিন খারাপ হয়ে যাওয়ায় পাল তুলে দিয়ে চলছিল ওরা, এমন সময় একটা পাহারাদার লঞ্চ আমার মাছ ধরার নৌকার পাশ দিয়ে গিয়ে ওদের নৌকার সাথে লাগল। সেটাকে ডুবিয়ে দিয়েছে ওরা।

‘এত বড় লঞ্চটাকে ডুবাল কি করে?’ ওটাকে যে ডুবানো হয়েছে তাতে অলোক রায়ের সন্দেহ নেই। কি করে ডুবানো হলো তাই জানতে চাইছে। অর্থাৎ ঠিকই সন্দেহ করেছিল রানা, খানসামা করিম আগেই খবর দিয়ে দিয়েছে এদেরকে। এরা প্রস্তুত হয়েই ছিল রানাদের জন্যে

‘ওরা আমার মত নিরীহ জেলের ভান করেছিল। লঞ্চটা নৌকার গায়ে গিয়ে লাগতেই গোলাগুলি ছুটতে আরম্ভ করল দুই পক্ষ থেকে। হঠাৎ দেখলাম দুইটা বাক্স উড়ে গিয়ে পড়ল লঞ্চের এঞ্জিন ঘরের মধ্যে। ব্যস, ভিড়িম! সব খতম!’ দুই হাত ছুঁড়ে অভিনয় করে দেখাল আলতাফ।

‘তাই ভাবছিলাম—যাক, তারপর?’

‘কি ভাবছিলেন, হুজুর?’ জিজ্ঞেস করেই লেফটেন্যান্টের কুঁচকানো ভুরু দেখে ভয় পেয়ে গেল আলতাফ। গড় গড় করে বলে চলল, ‘ওদের মধ্যে কচ্ছ ভাষা জানত যে লোকটা সে এই যুদ্ধে মারা গিয়েছিল, তাই আমাকে জোর করে নৌকায় উঠিয়ে নিয়েছে। আমার তিন ছেলেকে হুকুম দিয়েছে সোজা গ্রামে ফিরে যেতে, গিয়ে চুপচাপ থাকতে। যদি একটি কথাও প্রকাশ পায় তাহলে আমাকে খুন করে ফেলবে বলে শাসিয়েছে। কানতে কানতে চলে গেছে আমার বাচ্চা তিনটে। খানিক বাদেই ঝড় উঠল, আহারে… আমার ছেলে তিনটে নিরাপদে পৌঁছতে পারল কিনা….

‘তোমার ছেলের গল্প কে শুনতে চেয়েছে, মোটা গর্দভ?’ ধমকে উঠল অলোক রায়।

হচকিয়ে গিয়ে আবার আরম্ভ করল আলতাফ, ‘এই ঝড়ের মধ্যে একটা দ্বীপে নোঙর ফেলে অপেক্ষা করলাম আমরা। তারপর বললে বিশ্বাস করবেন না, হঠাৎ কোত্থেকে যেন একদল সৈন্য এসে উপস্থিত হলো সেই নির্জন দ্বীপে…আর তাই দেখেই আবার ছেড়ে দেয়া হলো নৌকা।’

‘ঠিক উল্টো। তোমার এই কথাটা আমি বিশ্বাস করছি।’ মাথা নাড়ল লেফটেন্যান্ট, যেন এই কথাগুলো নিজের কোনও গোপন জ্ঞানের সাথে মিলিয়ে দেখে মিল পাচ্ছে সে।

‘তারপর তুফানের মধ্যেই নৌকা ভিড়িয়ে ডাঙায় উঠেছি।’

‘নৌকাটার কি হলো?’

‘এমনিতেই ডুবে যাচ্ছিল জল খেয়ে, ঘাটে পৌঁছবার পরই ডুবে গেছে।’

‘তারপর?’

‘তারপর পাড়ের গায়ের শিকড় বেয়ে উঠে এসেছি আমরা ওপরে। ওপরে একজন গার্ড ছিল- ওই লোকটা ছুরি চালিয়ে খুন করেছে তাকে।’ রানার দিকে আঙুল দেখিয়ে নির্লজ্জের মত বলল আলতাফ। ‘সারা রাত হাঁটিয়ে মেরেছে আমাকে ব্যাটারা। ওই জখম হওয়া লোকটাকে আমার কাঁধে চাপিয়ে আমাকে দিয়ে মোট বইয়েছে। গতকাল ভোর রাতে পৌঁছেছি আমরা এই গুহায় ক্ষুধা তৃষ্ণায় আধমরা অবস্থায়। সেই থেকে এখানেই আছি।

‘তাহলে ওরা মোট ছয়জন এসেছে কেটি বন্দর থেকে?’

‘না, হুজুর। চারজন। একজন মারা গেছে লঞ্চ ডুবির সময়। ওই দু’জন জুটেছে কাল রাত থেকে

মৃদু হাসল অলোক রায়। রানা বুঝল, এ কথাটাও মিলে যাচ্ছে ওর জানা তথ্যের সঙ্গে।

‘ওদের কোনও কথাবার্তা শুনতে পাওনি তুমি?’

স্পাব না কেন? সারাক্ষণই তো শুনছি। ওরা এসেছে দ্বারোকার কামান আর রাডার ধ্বংস করতে।

‘হাওয়া খেতে যে আসেনি তা আমাদেরও জানা আছে,’ বলল লেফটেন্যান্ট।

‘দুর্গের প্ল্যান আছে ওই লোকটার পকেটে। এরা করাচির সাথে রেডিও দিয়ে কথাবার্তা বলছে চারঘণ্টা অন্তর অন্তর। পাকিস্তান নৌবাহিনী রওনা হয়ে গেছে দ্বারোকা বন্দর ধ্বংস করে দেবার জন্যে। এরা কামানগুলো ধ্বংস করতে পারলেই এগিয়ে এসে চুরমার করে দেবে সবকিছু। কী জানি না আমি…সব জানি।’

‘হয়েছে, হয়েছে। মস্ত খবর দিয়েছ তুমি, মন্টু সিং। এক্ষুণি জানাতে হবে সব কথা কর্নেলকে। চমৎকার!’ উজ্জ্বল হয়ে উঠল লেফটেন্যান্টের মুখ। উত্তেজনায় টগবগ করে ফুটছে ওর শরীরের রক্ত। ‘তাড়াতাড়ি করতে হবে আমাদের। কিন্তু একটা কথা, টিএনটি কোথায় রেখেছে?’

আলতাফ দুই হাতের তালু চিৎ করল। ‘হুজুর, সেটা আমি জানি না। গুহাতে রাখা নিরাপদ না ভেবে ওরা দু’জন বাক্স দুটো নিয়ে গিয়ে কোথায় যেন লুকিয়ে রেখেছে। রানা আর মিশ্রী খানের দিকে আঙুল দিয়ে দেখাল আলতাফ। ‘ওই দিকে নিয়ে গেছে খুব সম্ভব।’ সম্পূর্ণ উল্টো দিকে আঙুল নির্দেশ করল আলতাফ। আরীফের দুই চোখে নগ্ন বিস্ময় ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেল। ‘আমাকে দেখতে দেয়নি। কাউকে বিশ্বাস করে না ব্যাটারা!’

‘সেটা ওদের দোষের কিছু নয়। তোমাকে বিশ্বাস করলে ওদের কি অবস্থা হত বোঝাই যাচ্ছে। যাক্। ব্রিগেডিয়ার খুব সম্ভব তোমাকে মাফ করে দেবেন। ইনফরমারকে আমরা ভালমত পুরস্কৃত করি। কাজেই আরও লোকের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করার সুযোগ দেয়া হবে তোমাকে খুব সম্ভব।’

‘হুজুর মা-বাপ। আমি জানতাম, হুজুর…’

‘চোপ রাও!’ ধমকে উঠল তরুণ লেফটেন্যান্ট। ‘এখন নামগুলো বলো সবার এক এক করে।’

‘ওর নাম নাজির বেগ, ও আরীফ, আর গুহার মধ্যে পড়ে আছে যে সে হচ্ছে লেফটেন্যান্ট মাহবুব, এই মোচওয়ালা লোকটার নাম ক্যাপ্টেন মিশ্রী খান আর এদের লীডার হচ্ছে ওই গুণ্ডার মত লোকটা- মেজর মাসুদ রানা।’

‘মেজর—কি বললে?’ হঠাৎ পাঁই করে ঘুরে টর্চের আলো ফেলল লেফটেন্যান্ট রানার মুখের ওপর। ‘কি বললে? মাসুদ রানা? মাসুদ রানা!’ দুইবার দু’ভাবে উচ্চারণ করল সে নামটা। এগিয়ে এল কয়েক পা। ভাল করে পরীক্ষা করল রানার মুখ। আপন মনে বলল, ‘মাসুদ রানা! পাকিস্তান কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের মাসুদ রানা!’

এতক্ষণ হিন্দীতে কথা হচ্ছিল, হঠাৎ পরিষ্কার বাংলায় কথা বলে উঠল লেফটেন্যান্ট। চাপা উত্তেজনা ওর কণ্ঠস্বরে।

‘আমার বোনের মৃত্যু কিভাবে হয়েছিল, মাসুদ রানা?’

‘তোমার বোন!’ অবাক হলো রানা।

‘হ্যাঁ। আমার বোন, সুলতা রায়। কিভাবে মারা গেছিল সে?’

রানা লক্ষ করল থর থর করে কাঁপছে অলোক রায়ের টর্চ ধরা হাতটা। গলাটাও কেঁপে গেল শেষের দিকে। সুলতা। সেই সুলতা রায়ের ভাই এই অলোক রায়?

‘কবীর চৌধুরী বলে এক বৈজ্ঞানিকের গুলিতে,’ বলল রানা।

‘কাপ্তাই রিজারভয়েরে ওর আস্তানা থেকে পালাবার সময়?’

‘হ্যাঁ।’

‘তাহলে ওই বইটায় ঠিকই লিখেছিল?’

‘কোন বইটা?’

‘ওই যে আপনার এক বন্ধু কি যেন এক ছদ্মনামে কতগুলো বই লিখেছে। একটা বই কলকাতায় থাকতে হাতে এসেছিল- এক বর্ণও বিশ্বাস করিনি। কি যেন নাম- ও, ধ্বংস-পাহাড়। ওই বইয়ের সব কথা তাহলে সত্যি?’

‘তা কি করে বলব? আমি পড়ি না ওসব বই।’

‘সুলতা তাহলে সত্যিই মারা গেছে, বন্দী হয়ে নেই পাকিস্তানে?’ হঠাৎ রানার কাঁধের ওপর হাত রাখল অলোক রায়। করুণ আকুতি ওর কণ্ঠে। ‘দয়া করে মিথ্যে কথা বলবেন না, মেজর। আপনার মৃত্যু কেউ ঠেকাতে পারবে না, আমিও না। কিন্তু ইচ্ছে করলে আপনি আমাকে জ্যান্ত মরা থেকে বাঁচাতে পারেন।

রানা অনুভব করল একটি ভাইয়ের হৃদয়ে একমাত্র বোনের জন্যে সার্বক্ষণিক দুশ্চিন্তার যন্ত্রণা। কেন যেন মায়া হলো ওর ছেলেটির ওপর। সমস্ত ঘটনা গুছিয়ে বলল সে অল্প কথায়। মন দিয়ে শুনল অলোক রায়। প্রতিটি কথা বিশ্বাস করল।

‘আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ,’ সব শুনে ঘুরে দাঁড়াল অলোক রায়। ‘অনেক উপকার করলেন আপনি আমার। কিন্তু এই পরিবেশে আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে আমি সত্যিই দুঃখিত, মেজর রানা। অন্য কোনও অবস্থায় হলে হয়তো প্রতিদানে আপনার কোনও উপকার করতে পারতাম, কিন্তু এখন সেটা সম্ভব নয়।’

প্রত্যেকের হাত-পা বেঁধে ফেলা হলো।

‘ওই মোটাকেও বাঁধো। পরে খুলে দেয়া যাবে।

ওকে দিয়ে অসুস্থ লোকটাকে বইয়ে নিয়ে যাওয়া যাবে পোস্টে। সার্জেন্ট শান্তা, গার্ড থাকো। বাকি সবাই চলো আমার সাথে। এক্সপ্লোসিভের বাক্সগুলো খুঁজে বের করতেই হবে আমাদের।’

‘ওদের দিয়ে কথা বলাবার চেষ্টা করলে হয় না, স্যার?’ সার্জেন্ট শান্তা জিজ্ঞেস করল। নির্যাতনের ছুতো খুঁজছে সে।

‘যে লোকটাকে দিয়ে বলানো সম্ভব ছিল সে যা জানে সব বলে ফেলেছে। আর অন্যদের ব্যাপারে আমি মস্ত ভুল করতে যাচ্ছিলাম। এদের মুখ থেকে একটি শব্দও বের করা যাবে না। এরা ভেঙে যাবে, তবু বাঁকবে না। শুধু লক্ষ রাখবে এরা যেন পরস্পর কথা না বলে।

অ্যাবাউট টার্ন করে চলে গেল লেফটেন্যান্ট। ওর পেছনে গেল সাতজন সেন্ট্রি। তিন মিনিট পর সার্জেন্ট শান্তা ছাড়া ভারতীয় সৈনিকের চিহ্নও রইল না আর।

.

কয়েকবার চেষ্টা করল রানা। নাহ্। ভেজা দড়ি আরও শক্তভাবে বসে যাচ্ছে কব্জিতে। যে লোকটা বেঁধেছে সে সত্যিই বাঁধতে জানে। বাঁধন খুলবার কোনও উপায় নেই। আধঘণ্টা ধরে বসে বসে পিঠটা ব্যথা হয়ে গেল রানার। শুয়ে পড়ল মিশ্রী খানের পাশে।

আলতাফ একবারই চেষ্টা করেছিল দড়ি ছিঁড়বার। মাংসের ভেতর ঢুকে গেছে দড়িটা। সেই থেকে সেন্ট্রির কাছে বসে বার বার ঘুরেফিরে অনুযোগ করছে সে যে বেশি শক্ত করে বাঁধা হয়েছে ওর হাত। কেটে বসে যাচ্ছে বাঁধনটা। কারণ, একটু লক্ষ করলেই পরিষ্কার বুঝে ফেলবে অলোক রায় কী অসাধারণ শক্তি আছে ওর গায়ে। নিজের যে চরিত্র সৃষ্টি করেছে সে, তার সাথে খাপ খাবে না এই দানবিক শক্তি।

রানা ভাবছে, আলতাফ আজ মুডে আছে। স্বতঃস্ফূর্ত অভিনয় করে চলেছে সে। অনেক সত্যি কথা বলে ফেলেছে সে লেফটেন্যান্টের কাছে, কিন্তু এমন কিছুই বলেনি যা ওরা জানতে পারত না। পাকিস্তান নেভির আগমনের সংবাদ ওরা এখনও যদি না জেনে থাকে তাহলে আগামী দু’ঘণ্টার মধ্যেই জানতে পারবে। মিশ্রী খান, নাজির বেগ আর আরীফ বসে আছে পাথরে হেলান দিয়ে।

ব্যথায় টনটন করছে রানার চোয়াল। নাজির বেগের কেমন লাগছে ভাবার চেষ্টা করল সে। আর মাহবুবের? সেন্ট্রিকে ছাড়িয়ে দৃষ্টিটা চলে গেল রানার গুহা-মুখের দিকে। হঠাৎ চমকে উঠল রানা। হিম হয়ে গেল ওর বুকের ভেতরটা।

ধীরে চোখটা সরিয়ে আনল সে গুহা-মুখ থেকে, নিরাসক্ত ভাবে সেন্ট্রির ওপর নিবদ্ধ হলো ওর দৃষ্টি। একটা পাথরের ওপর বসে সতর্ক নজর রেখেছে শান্তা সবার ওপর। অটোমেটিক কারবাইনটা দুই হাঁটুর ওপর রাখা। ডান হাতের তর্জনী ট্রিগারের ওপর। গুহার দিকে পেছন ফিরে বসে আছে সে। রানা মনে মনে খোদার কাছে প্রার্থনা করল যেন লোকটা ঘুরে না তাকায়। যেন আর কিছুক্ষণ যেমন বসে আছে তেমনি বসে থাকে পেছন ফিরে। আর অল্প কিছুক্ষণ- খোদা! আবার দৃষ্টিটা চট করে ঘুরে এল গুহা-মুখ থেকে।

গুহার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে মাহবুব। বুক আর পেটের ওপর ভর দিয়ে এগোচ্ছে সে অল্প একটু, তারপর ভাঙা পা-টা টেনে আনছে। দুই হাতে ভর দিয়ে দেহের উপরের অংশটা উঁচু করছে সে, এগিয়ে আসছে ইঞ্চি ছ’য়েক, তারপর উপরের অংশটাকে মাটিতে নামিয়ে নিচের অংশটা টেনে আনছে। ব্যথায় আর অবসাদে ঝুলে পড়েছে মাথাটা। কুঁচকে যাচ্ছে গাল দুটো। সমস্ত মানসিক শক্তি একত্রিত করে আবার এগোচ্ছে। ওর ব্যথার কথা ভেবে দাঁতে দাঁত চেপে রানার নিজের মুখটাই বিকৃত হয়ে যাচ্ছিল- সতর্ক হয়ে নিজেকে স্বাভাবিক রাখল সে। এত জ্বর গায়েও মাথা ঠিক রেখেছে মাহবুব; একটা খয়েরী রঙের চাদর জড়িয়ে নিয়েছে দেহের ওপর, যাতে কিছুটা ক্যামোফ্লেজের কাজ হয়। ডান হাতে একটা ছুরি ধরা। নিশ্চয়ই সে অলোক রায়ের শেষের কথাগুলো শুনতে পেয়েছে। বুঝতে পেরেছে পিস্ত ল ছুঁড়লে লাভ নেই- ছুটে চলে আসবে লেফটেন্যান্ট দলবল সহ। তার আগে কারও হাত-পায়ের বাঁধন খুলতে পারবে না সে এতদূর এসে।

আর পাঁচ গজ, খোদা আর পাঁচটা গজ। সামান্য বাতাসের শব্দ ছাড়া কোথাও কোনও শব্দ নেই। মাহবুবের এগোনোর শব্দ কানে যাবে সেন্ট্রির আর একটু এগোলেই।

মাথা নিচু করে কাশতে আরম্ভ করল রানা। প্রথমে একটু অবাক হয়ে চাইল সার্জেট রানার দিকে, ক্রমাগত কেশেই যাচ্ছে দেখে বিরক্ত হয়ে উঠল সে।

‘অ্যাই, মেজর কা বাচ্চা। কাশি থামা!’ খ্যাক খ্যাক করে ধমকে উঠল সার্জেন্ট শান্তা।

‘থামতে পারছি না!’ কেশে উঠল রানা আবার। ‘আমার কি দোষ? খক্ খক্। তোমাদের লেফটেন্যান্টের খক্কর খক্ দোষ। গলার ভেতর রক্ত ঢুকে, খক্ খক্ খক্ হ্যাঁচ্চো, সড়কে গেছে।’

আর পাঁচ ফুট। কিন্তু শক্তি ফুরিয়ে গেছে মাহবুবের। এক ইঞ্চি দুই ইঞ্চি করে এগোচ্ছে সে এখন। বোধহয় জ্ঞান হারিয়েছে। আধ মিনিট পড়ে থাকল সে মাটিতে মুখ গুঁজে। না। শক্তি সঞ্চয় করছিল সে। এবার আবার দুই হাতে ভর দিয়ে ছয় ইঞ্চি এগিয়ে এল মাহবুব। কিন্তু হঠাৎ একটা হাত পিছলে গিয়ে ধড়াশ করে পড়ে গেল। কেশে উঠল রানা। কিন্তু দেরি হয়ে গেছে। একলাফে উঠে দাঁড়িয়েই পেছন ফিরল সার্জেন্ট। অটোমেটিক কারবাইনের মুখটা স্থির হলো মাহবুবের মাথার দিকে চেয়ে। মাহবুবকে চিনতে পেরে রাইফেলের মুখটা সরাল সে অন্য দিকে।

‘এরই জন্যে এত কাশি আসছিল মেজর বাহাদুরের!’

রাইফেলের বাঁটটা সাঁ করে নেমে আসছিল মাহবুবের মাথার ওপর। কিন্তু শেষ মুহূর্তে থেমে গেল। বোধহয় দয়া হলো ওর। মাহবুবের দুর্বল হাত থেকে ছুরিটা কেড়ে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল বহুদূরে। চাদরটা গায়ের ওপর থেকে তুলে নিয়ে দলা পাকিয়ে গোল করল, তারপর ওর অজ্ঞান মাথার নিচে গুঁজে দিল সেটা। মাথাটা নাড়ল এদিক-ওদিক বিষণ্ণভাবে। আবার গিয়ে বসল উঁচু পাথরের ওপর।

ফর্সা হয়ে গেছে চারদিক। দূরে কয়েকজনের পায়ের শব্দ পাওয়া গেল।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন