কাজী আনোয়ার হোসেন
খেত-খামার ডিঙিয়ে চলছে ওরা তিনজন সোমনাথের মন্দিরের দিকে। রাস্তা থেকে বেশ খানিকটা তফাতে ঝোপ ঝাড়ের আড়ালে আড়ালে এগোচ্ছে ‘ওরা। পিচ্ছিল ভেজা মাটির ওপর দিয়ে চলতে গিয়ে পতন থেকে বাঁচবার জন্যেই বেশি মনোযোগ ব্যয় হচ্ছে। মন্দিরের চুড়ো দেখা যাচ্ছে এখন। হঠাৎ একটা মাটির তৈরি পোড়ো ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল মিশ্ৰী খান কথা বলে উঠল সে এতক্ষণ পর।
‘আর পারছি না, ওস্তাদ। একটু বিশ্রাম না নিলে নির্ঘাত মারা পড়ব। এই ঘরের মধ্যে মিনিট কয়েক বিশ্রাম নিয়ে নিলে কেমন হয়? বেশিক্ষণ না, এই একটা সিগারেট খেতে যতক্ষণ লাগে।’
অবাক হলো রানা। এত সহজে কাহিল হবার মানুষ তো মিশ্ৰী খান নয়। কিন্তু অনিচ্ছাসত্ত্বেও রাজি হয়ে গেল রানা। সে নিজেও অত্যন্ত ক্লান্তি বোধ করছে।
‘ঠিক আছে, মিশ্রী। চলো, ঢুকে পড়ি।’
ঢুকে পড়ল ওরা তিনজন ছোট্ট ঘরটার মধ্যে। ফসল পাকলে মাঠ পাহারা দেয় কৃষকরা এই ঘরে শুয়ে-বসে। একটা বাঁশের মাদুর পাতা আছে ঘরের এক কোণে। মাদুরে বসে পড়ল রানা। চোখ তুলেই অবাক হয়ে গেল সে। সারা ঘরে দেয়াল ধরে ধরে কি যেন পরীক্ষা করছে মিশ্ৰী খান।
‘কি হে, কি করছ? এই কি বিশ্রাম নেয়ার নমুনা?’
‘না, ওস্তাদ। বিশ্রাম নিতে আসলে আসিনি। এই ঘরের মধ্যে ঢুকবার জন্যে ওই ছুতো ধরেছিলাম। আসলে আমি আপনাকে তিনটে অদ্ভুত জিনিস দেখাতে চাই।’
‘অদ্ভুত জিনিস! কি অদ্ভুত জিনিস দেখাবে তুমি আমাকে?’
‘একটু ধৈর্য ধরুন, ওস্তাদ। আপনার সময় আমি শুধু শুধু নষ্ট করব না। মাত্র কয়েক মিনিটের ব্যাপার।’
রানা অবাক হলো ঠিকই, কিন্তু মিশ্রী খানের ওপর থেকে ওর আস্থা টলল না একবিন্দুও। বলল, ঠিক আছে। কিন্তু বেশি দেরি করিয়ে দিয়ো না আবার।’
‘দেরি হবে না। জানালা নেই এ ঘরে একটাও। নির্বিঘ্নে আলো জ্বালা যাবে। কিন্তু তাও আগে বাইরে থেকে একবার দেখা দরকার আলো দেখা যাচ্ছে কিনা।’
‘আমি বাইরে গিয়ে দেখছি,’ বলল নাজির বেগ।
‘না না। আপনি খোঁড়া মানুষ, বসুন। আমি টর্চ জ্বালাচ্ছি, ওস্তাদ বাইরে থেকে ঘরটা একপাক ঘুরে দেখে আসবেন?’ বলল মিশ্ৰী খান।
রানা নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল বাইরে। মিশ্রী খানের ব্যবহারটা রহস্যজনক মনে হচ্ছে। মতলব কিচ্ছু বোঝা যাচ্ছে না। কি দেখাতে চায় সে ওকে? বাইরে দিয়ে একপাক ঘুরে ফিরে গেল রানা ঘরের মধ্যে।
‘এক বিন্দু আলোও যাচ্ছে না বাইরে।
‘বেশ,’ কাঁধ থেকে ব্যাগটা মাটিতে নামিয়ে রাখল মিশ্রী খান। কিন্তু বসল না। নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল কয়েক সেকেণ্ড। বোধহয় মনে মনে গুছিয়ে নিল কথাগুলো।
একবার ঘড়ির দিকে চেয়ে মিশ্রীর দিকে চাইল রানা আবার। ‘কি দেখাবে বলে আমাকে, মিশ্রী?’ তাড়া দিল রানা।
‘ঠিক। তিনটে জিনিস।’ পকেট থেকে ম্যাচ বাক্সের সমান একটা ছোট্ট কালো বাক্স মত কি যেন বের করল মিশ্রী খান। বলল, ‘প্রথম এইটে দেখুন, ওস্তাদ।’
‘কি ওটা?’ জিজ্ঞেস করল বিস্মিত রানা।
‘ক্লকওয়ার্ক ফিউজ। পেঁচিয়ে বাক্সটার পেছন দিকটা খুলতে আরম্ভ করল মিশ্রী খান। বিশ্রী জিনিস। কিন্তু টিএনটি-র জন্যে অত্যন্ত দরকারী।’ বাক্সটা খোলা হয়ে গেছে ততক্ষণে। টর্চের আলোর সামনে ধরল সেটা। ‘কিন্তু এটা দিয়ে আর কোন কাজ হবে না। ঘড়ি ঠিকই আছে, কিন্তু কন্ট্যাক্ট আর্ম বাঁকিয়ে তুলে দেয়া হয়েছে ওপরে। টিক্ টিক্ বাজতে থাকবে ঠিকই, কিন্তু ম্যাচ বাতিও জ্বলবে না এটা দিয়ে।’
‘আশ্চর্য! কিন্তু কিভাবে…’
‘দুই নম্বর জিনিস, মিশ্রী খান যেন রানার কথাটা শুনতেই পায়নি এমনভাবে নিজের কথাই বকে যেতে থাকল। ডিটোনেটার বক্স খুলল সে। ফেল্ট আর তুলোর ওপর থেকে আলতো করে দুই আঙুলে তুলল একটা ফিউজ। এটাও পরীক্ষা করল টর্চের আলোয়। তারপর সোজাসুজি রানার দিকে চেয়ে বলল, ‘মারকারির ফালমিনেট, ওস্তাদ। মাত্র সেভেন্টি সেভেন গ্রেন, কিন্তু কারও আঙুল ক’টা উড়িয়ে দেবার পক্ষে যথেষ্ট। খুবই নাজুক জিনিস। সামান্য একটু টোকা লেগেছে কি ফাঁৎ করে জ্বলে উঠবে।’ মাটিতে ফেলে দিল ওটাকে সে, তারপর বুটসুদ্ধ একটা পা তুলে জোরে ফেলল ওটার ওপর। নিজের অজান্তেই চোখ বুজল রানা আধ সেকেণ্ডের জন্যে। কিন্তু কোনও বিস্ফোরণ হলো না।
‘এটাও ঠিক কাজ করছে বলে মনে হচ্ছে না, তাই না, ওস্তাদ?’ এতক্ষণে একটা বক সিগারেট বের করে ঠোঁটে লাগাল মিশ্ৰী খান। আগুন ধরিয়ে কিছুক্ষণ টানল চুপচাপ। রানার কাছে অনেক কিছু পরিষ্কার হয়ে আসছে এবার।
‘তৃতীয় আরেকটা কি দেখাতে চেয়েছিলে?’ শান্ত ঠাণ্ডা গলায় বলল রানা।
‘হ্যাঁ। আরেকটা জিনিস দেখাব আপনাকে। আমি আপনাকে একটা বিশ্বাসঘাতক, নীচ, বিষাক্ত, দুই-মুখো সাপ দেখাব।’ কথাটা বলতে গিয়ে চাপা উত্তেজনা ফুটে উঠল মিশ্রী খানের কণ্ঠে। বিস্মিত রানা দেখল চক্ চক্ করছে মিশ্রী খানের হাতে ওর সাইলেন্সার লাগানো পিস্তলটা। লোলুপ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে সেটা নাজির বেগের বুকের দিকে। ‘জামাটা খুলে ফেলো, নাজির বেগ।
‘কি করছ, মিশ্রী? মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি তোমার?’ এগিয়ে যাচ্ছিল রানা। থেমে গেল মিশ্রী খানের ইঙ্গিতে। বলল, ‘কি গোলমাল শুরু করলে তুমি?’
‘গোলমাল অনেক আগেই শুরু হয়ে গেছে, ওস্তাদ। রাজগড়ের কাছে গুহার মধ্যে আমরা ধরা পড়লাম কি করে? তুমুল বৃষ্টির মধ্যে ব্লাড হাউণ্ডের বাপ এলেও তো গন্ধ শুঁকে আমাদের বের করতে পারত না। যদি ব্লাড হাউণ্ডই ওদের পথ চিনিয়ে নিয়ে আসবে, তাহলে সেগুলো গেল কোথায়- আমরা বেরিয়ে তো ব্লাড হাউণ্ডের ছায়াও দেখতে পাইনি? চিন্তা করে দেখুন, ওস্তাদ, আমাদের ঘুমন্ত অবস্থায় কে ছিল গার্ড? নাজির বেগ। ওই নেড়ি কুত্তার বাচ্চাই পথ চিনিয়ে এনেছিল লেফটেন্যান্ট অলোক রায়ের দলকে। কি, বুঝতে পারছেন, ওস্তাদ? কাপড় খুলে ফেলো। তিন সেকেণ্ড সময় দিলাম, নইলে গুলি করব কব্জিতে।’
মিশ্রী খানকে নিরস্ত করবার জন্যে এগোতে যাচ্ছিল রানা। হঠাৎ চোখ পড়ল ওর নাজির বেগের ওপর। শ্বাপদের মত জ্বলছে তার চোখ জোড়া। দাঁত বেরিয়ে পড়েছে। বন্য একটা হিংস্রতা ফুটে উঠেছে তার মিশকালো মুখে। পরমুহূর্তেই বিকৃত হয়ে গেল ওর মুখটা। ‘দুপ্’ করে একটা মৃদু শব্দ তুলে ওর বাম হাতের কব্জিতে প্রবেশ করল একটা পয়েন্ট থ্রী-টু ক্যালিবারের বুলেট। দুই চোখে ওর অবিশ্বাস।
‘আরও তিন সেকেণ্ড সময় দিলাম। এবারে যাবে ডান হাতের কব্জি।’ স্থির দৃষ্টিতে ওর দিকে চেয়ে বলল মিশ্রী খান। পিস্তলটা তেমনি লোলুপ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে ইঙ্গিতের অপেক্ষায়। দ্রুত খুলে ফেলল নাজির বেগ গায়ের জামা। ওর চোখ জোড়া যেন বিষোÇগার করছে মিশ্রীর চোখের দিকে চেয়ে।
‘ঘুরে দাঁড়াও।’
ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াল নাজির বেগ।
‘বাহ্! চমৎকার! দেখুন, ওস্তাদ। চাবুক মেরে মেরে এই লোকটারই পিঠের চামড়া তুলে নিয়েছিল ভারতীয় সৈন্যরা। কি বীভৎস সাদা সাদা দাগ পড়ে গেছে- চাওয়া যায় না! এই না ছিল ওর বানানো গল্প? এরই জন্যে না সুযোগ পেলেই সে পাগলের মত খুন করে বেড়াচ্ছে ভারতীয় সৈন্যদের? দাউ দাউ করে জ্বলছে ওর মনের মধ্যে প্রতিহিংসার আগুন?’
রানার মাথার মধ্যে সব গোলমাল পাকিয়ে গেল। চক্চকে কালো মসৃণ পিঠে একটা দাগও নেই।
‘প্যান্টের পা’টা ওপর দিকে তোল, নিমকহারাম। তিন সেকেণ্ড সময় দিলাম।
কথা মত কাজ করল নাজির বেগ। প্যান্টের পা গুটিয়ে তুলে ফেলল হাঁটুর ওপর।
‘আরও একটু। হ্যাঁ। চমৎকার! এবার ব্যাণ্ডেজ খুলে ফেলো। জলদি!’ কয়েক সেকেণ্ড পার হয়ে গেল। উল্লসিত কণ্ঠে বলল মিশ্ৰী খান, ‘আহা-হা। কি সা’ঘাতিক জখম, তাই না, ওস্তাদ?’
কোনও রকম ক্ষতচিহ্ন নেই নাজিরের পায়ে।
‘বুঝলাম, মিশ্রী খান। এবার বুঝতে পেরেছি।’ চিন্তিত রানা বলল মৃদুস্বরে। ‘কিন্তু বুঝতে পারছি না কেন…’
‘সহজ ব্যাপার। ব্যাটা অসম্ভব ধূর্ত আর হারামী। অসম্মান-জ্ঞান সম্পন্ন কোনও জাত-গোক্ষুর সাপও ওর আধমাইলের মধ্যে আসবে না। এই জখম- পায়ের দোহাই দিয়ে পড়ে থাকল ভাতিজা একটা গুহার মধ্যে আমরা যখন প্রথম গুলি চালালাম ভারতীয় সৈন্যদের ওপর। আমাদের অনুপস্থিতির সুযোগে চিঠি লিখে ফেলল। আমাদের সাথে চলবার সময় খোঁড়াতে খোঁড়াতে পিছিয়ে পড়ে চিঠিটা ফেলে দিল চোখে পড়বার মত কোনও জায়গায়। তাতে খুব সম্ভব লেখা ছিল আমরা অমুক সময়ের দিকে অমুক জায়গায় আসছি, আমাদের অভ্যর্থনার যেন সুবন্দোবস্ত থাকে। অভ্যর্থনা কমিটি তৈরিই ছিল- আমরা গুহা-মুখ থেকে বেরিয়ে প্রায় ধরা পড়তে যাচ্ছিলাম, খেয়াল নেই? ওদের ট্রাক নিয়েই ঢুকেছি আমরা শহরে। তখনই প্রথম সন্দেহটা হলো আমার। বুঝলাম, গুহা মুখে ওকে ফেলে রেখে আসবার জন্যে যে করুণ মিনতি জানিয়েছিল ভাতিজা, সেটা আসলে পেছনের সৈন্যদের ঠিক গুহাটা চিনিয়ে দেবার জন্যেই- মহান আত্যাগ নয়। তাই উপত্যকায় বেরিয়েই সৈন্য দেখে মাথার পেছনে টোকা মেরে অজ্ঞান করে ফেলেছিলাম ওকে, যাতে নতুন কোনও বিপদ ঘটাতে না পারে।
‘সব পরিষ্কার হয়ে আসছে আমার কাছে। কিন্তু আরও আগে আমাকে জানানো উচিত ছিল তোমার। এভাবে চেপে গিয়ে…’
‘আমি বলতে চেষ্টা করেছি, ওস্তাদ, কিন্তু সুযোগ পাইনি। ও কিছুতেই সঙ্গ ছাড়েনি। সব সময় সাথে লেগে ছিল আঠার মত। ছাতের ওপর তখন বলতে যাচ্ছিলাম, অমনি গোলাগুলি আরম্ভ হয়ে গেল।’
‘এখন বুঝতে পারছি, হঠাৎ কথা নেই বার্তা নেই বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত আমাদের ওপর বোমা ফেলতে আরম্ভ করেছিল কেন প্লেনগুলো আজ দুপুরে।’
‘হ্যাঁ। আয়না দেখিয়ে আমাদের পজিশন জানিয়েছিল ও এই দুর্গকে। এবং সময় থাকতে নিজে সরে গিয়েছিল নিরাপদ দূরত্বে। তার আগেই সে আরীফের ব্যাগ থেকে বের করে ক্লক ফিউজ, পো বার্নিং ফিউজ আর ডিটোনেটার নষ্ট করে দিয়েছে ওর ঘুমন্ত অবস্থায়। শুধু দুঃখ, ভাতিজা শেষ রক্ষা করতে পারল না।’
‘নিজেকে রক্ষা করতে পারল না, কিন্তু আরীফকে শেষ করে দিয়ে গেল,’ বলল রানা।
‘আমার মনে হয় আরীফ ঠিকই আছে। নিজে রয়ে গিয়ে আরীফকে ও- ই পাঠিয়েছে আলতাফের সঙ্গে আহত পায়ের ছুতো দেখিয়ে। ওরা বেরিয়ে যেতেই খবর দিয়েছে দুর্গের গেটে যেন সোমনাথের মন্দিরে ডজন খানেক সৈন্য পাঠানো হয়, এবং যাবার সময় যেন গোটা কয়েক ফাঁকা আওয়াজ করে মেশিনগানের। আমাদের দু’জনকে ধরিয়ে দেয়ার জন্যেই আসলে ছাতে উঠেছিল ও। ওর পকেট সার্চ করলেই সিগন্যাল টর্চ বেরিয়ে পড়বে আমার যতদূর বিশ্বাস।’
প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে একটা টর্চ বের করে আনল রানা।
‘মৃত্যুর আগের মুহূর্তে কেমন লাগছে, নাজির বেগ? জানতে ইচ্ছে করছে আমার। নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছ তোমাকে খুন করব আমি, এবং এক্ষুণি। কিছু বলবার আছে তোমার?’
আহত হাতটা অন্য হাতে চেপে ধরে আছে নাজির বেগ। কোনও কথা বলল না। তীব্র ঘৃণা ফুটে উঠল ওর দৃষ্টিতে, তেমনি চেয়ে রইল সে মিশ্রীর চোখে চোখে।
‘ভাতিজা বুঝেছে, কিছু বলে কোনও লাভ নেই। তাই চুপ করে আছে। ওস্তাদ, আপনার মূল্যবান সময় আর নষ্ট করতে চাই না। কি বলেন? দোষী?’ মাথা ঝাঁকাল রানা। সিগারেটটা মাটিতে ফেলে বুট দিয়ে পিষে ফেলল মিশ্রী খান। তারপর যত্নের সাথে পর পর দুটো গুলি করল নাজির বেগের হৃৎপিণ্ড লক্ষ্য করে। মৃতদেহটা মাটির ওপর আছড়ে পড়বার আগেই ব্যাগ দুটো কাঁধে তুলে নিয়ে টর্চ নিভিয়ে দরজার কাছে পৌঁছে গেল ওরা।
.
‘পারছি না, ক্যাপ্টেন আলতাফ, গিঁঠগুলো খুব শক্ত,’ হতাশ কণ্ঠে বলল ইশরাত।
‘তাতে কি হয়েছে? ভেজা রশি দিয়ে বেঁধেছে তো, না কেটে খোলা মুশকিল। দেখা যাক অন্য কোনও বুদ্ধি বের করা যায় কিনা।’ আশ্বস্ত করল আলতাফ ইশরাতকে। দুই মিনিট আগে যে সে হাত-বাঁধা অবস্থাতেই লোহার মত শক্ত আঙুল দিয়ে ইশরাতের হাতের বাঁধন খুলে দিয়েছে কয়েক টানে, সে-কথা বেমালুম চেপে গেল আলতাফ।
ঘরের চারপাশে একবার চোখ বুলাল আলতাফ। একটা হারিকেন জ্বলছে মিটমিট করে। মন্দিরের শান বাঁধানো মেঝেতে পড়ে আছে ওরা দু’জন। নিজেদের দুরবস্থার কথা চিন্তা করে হাসি পেল আলতাফের। একই দিনে দ্বিতীয়বার বন্দী হয়েছে ওরা। ভাগ্যের কি নিষ্ঠুর পরিহাস! এবারও বিনা বাধায় আসমর্পণ করতে হয়েছে ওদের। সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ভাবে এসে পৌঁছেচে ভারতীয় সৈন্য। অনায়াসে বন্দী করেছে ওদের। ক্যাপ্টেনের মুখেই শুনেছে ওরা নাজির বেগের ভূমিকা। বিশ্বাস করেনি। কিন্তু অবিশ্বাসই বা করবে কোন্ ভরসায়? সব ব্যাপার যে মিলে যাচ্ছে। ক্যাপ্টেনের কথা যদি সত্য হয়, তাহলে এতক্ষণে রানা আর মিশ্রী খানও ধরা পড়ে গেছে। তবে কি এখানেই সব আশা সব ভরসা শেষ? পরাজিত হলো ওরা? কথাটা কিছুতেই স্বীকার করে নিতে পারল না সে মনে মনে।
হঠাৎ একটা কথা মনে হতেই ঝট্ করে ফিরল সে ইশরাতের দিকে। কাছেই জ্বলছে হারিকেনটা।
‘আরীফ!’ ডাকল সে মৃদুস্বরে।
‘বলুন।’ ইশরাত ফিরল ওর দিকে।
‘হাতে একটা কাপড় জড়িয়ে হারিকেনের কাঁচটা খুলে ফেলো। মেঝেতে একটা টোকা দিয়ে ভেঙে ফেলো কাঁচটা। ওটা দিয়ে অনায়াসে কেটে দিতে পারবে আমার হাতের বাঁধন।’
অবাক হয়ে ওর দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে ধীরে ধীরে মাথা ঝাঁকাল ইশরাত। এই ভয়ঙ্কর বিপদের মধ্যেও বুদ্ধি হারায়নি লোকটা। একটা না একটা ফন্দী ফিকির বের করবার চেষ্টায় আছে। আশ্চর্য এই দলের প্রত্যেকটি লোক!
মেঝের ওপর দিয়ে গড়িয়ে চলে গেল ইশরাত হারিকেনের কাছে। পা দুটো এখনও বাঁধাই আছে ওর। হারিকেনের দিকে হাত বাড়িয়ে হঠাৎ কি একটা শব্দ কানে যেতেই থমকে গেল ও। মাথাটা তুলে দেখল দরজার শিকের ফাঁক দিয়ে এগিয়ে এসেছে একটা রাইফেলের ব্যারেল। আবার ব্যারেল দিয়ে খটাখট বাড়ি মারল অসহিষ্ণু প্রহরী শিকের ওপর
‘আর এক ইঞ্চি হাত বাড়িয়েছ কি ছাতু করে দেব কব্জিটা।’
‘থাক, আরীফ, ফিরে এসো এখানে,’ বলল আলতাফ।
ফিরে এল ইশরাত। কিন্তু প্রহরীকে অত্যন্ত চঞ্চল হয়ে উঠতে দেখা গেল। রাইফেলটা বের করে নিল সে শিকের ফাঁক থেকে। একজোড়া বুটের শব্দ দ্রুত চলে গেল ডান দিকে।
এমনি সময় একটা শব্দ কানে এল ওদের। গজ বিশেক দূরে যেন কেউ কপাট বন্ধ করল একটা। এবার একাধিক পায়ের শব্দ শোনা গেল। দ্রুত এগিয়ে আসছে এই ঘরের দিকে। বোধহয় প্রহরী ইশরাতের হাত বাঁধন-মুক্ত দেখে আরেকজনকে সঙ্গে নিয়ে ফিরছে। চাবি ঘুরিয়ে ক্লিক করে তালা খোলার শব্দ এল। বিচিত্র ক্যাচকুঁচ শব্দ করে খুলে গেল দরজা। দু’জন সৈন্য এসে ঢুকেছে মন্দিরে। প্রথমেই ইশরাতের চোখ পড়ল দু’জোড়া কাদা মাখা ভেজা বুটের ওপর। পরমুহূর্তে ভেসে এল একটা পরিচিত কণ্ঠস্বর।
‘ছাগলের মত বেঁধে রেখেছে, ওস্তাদ! কোরবানির খাসী! ইয়া আল্লা, দুই ভাতিজারই অবস্থা কাহিল!’
ঘটনার আকস্মিকতায় স্তম্ভিত হয়ে গেল ইশরাত ও আলতাফ। কয়েক সেকেণ্ড কেউ কোনও কথা বলতে পারল না। ইশরাতই প্রথম সামলে নিল
‘ওই বিশ্রী গোঁফ-ওয়ালা লোকটা বেঁচে আছে তাহলে? আর কোনদিন দেখা হবে বলে ভাবতে পারিনি।
‘ঠিক বলেছ, আরীফ,’ বলল আলতাফ। ‘ব্যাপার কি, রানা? দিব্যি বহাল তবিয়তেই আছ দেখছি!’
‘হ্যাঁ, আছি। এর জন্যে সবটুকু কৃতিত্ব মিশ্ৰী খানের সন্দেহপ্রবণ বিশ্রী মনের। আমরা যখন নাজির বেগ বলতেই অজ্ঞান, ও তখন ভেতর ভেতর প্যাঁচ কষছে।’
‘কোথায় নাজির বেগ?’ জিজ্ঞেস করল ইশরাত।
‘নাজির বেগ?’ জবাব দিল মিশ্ৰী খান। ‘ওকে রেখে এসেছি মাঠের মধ্যে একটা ঘরে। হঠাৎ একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে বেচারার।
মনের আনন্দে বেসুরো শিস দিতে দিতে বাঁধন কাটতে থাকল সে একটা ছুরি দিয়ে। রানা নিজেদের ঘটনাগুলো সংক্ষেপে বলল ওদের এবং ওদের সব কথাও শুনল মন দিয়ে। উঠে দাঁড়াল প্রকাণ্ডদেহী আলতাফ ব্রোহী। হাতের কব্জি দুটো ঘষল অল্পক্ষণ, তারপর বলল, ‘শিসটা বড় বিশ্রী লাগছে মিশ্ৰী খান। একে তো বেসুরো, তার ওপর অত্যন্ত তীক্ষ্ণ। বাইরে গার্ড…’
‘ওসব তোমার চিন্তা করতে হবে না, ভাতিজা। ওরা কল্পনাও করতে পারেনি যে আমরা এসে উপস্থিত হব। মাত্র দু’জন দুর্বল চরিত্রের গার্ড রেখেই নিশ্চিন্তে ফিরে গেছে দ্বারোকায়।
‘তোমরা করাচিকে পেয়েছিলে, আলতাফ?’ রানা কাজের কথায় এল।
‘হ্যাঁ। খবর অত্যন্ত গরম। চমৎকার রিসেপশন। খোদ কমোডোর জুলফিকার ছিলেন সেটের সামনে। উত্তেজনায় তোতলাচ্ছিলেন তিনি সারাদিন আমাদের সংবাদ না পেয়ে ভয়ঙ্কর উৎকণ্ঠার মধ্যে কেটেছে ওঁর। জিজ্ঞেস করলেন আমাদের অবস্থা। বললাম, এখনও দুর্গে ঢুকতে পারিনি, তবে ঘণ্টা খানেকের মধ্যে ঢুকতে পারব আশা করছি।’ দম নেয়ার জন্যে থামল আলতাফ।
‘তারপর?’
‘উনি বললেন আমাদের জাহাজ আজ রাত বারোটায় আক্রমণ করবে দ্বারোকা দুর্গ। তার আগেই শেষ করতে হবে দুর্গের চারটে কামান। নইলে মস্ত ক্ষতি হয়ে যাবে পাকিস্তানের। বললাম, কিছু একটা তো এখনও গোলমাল হয়ে যেতে পারে। উনি বললেন, মেজর মাসুদ রানা আর ক্যাপ্টেন মিশ্রী খান থাকতে উনি সেসব নিয়ে ভয় পান না। বারোটার আগে সব কাজ শেষ করা চাই।’
‘সবাই রেডি?’ রানা জিজ্ঞেস করল। ‘আমাদের সরে পড়তে হবে এখান থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। নাজির বেগের সিগন্যাল না পেয়ে ওরা বুঝতে পারবে, হয় নাজির আমাদের খুঁজে পায়নি, নয় ওকে শেষ করে দিয়েছি আমরা। কিন্তু যে-কোনও অবস্থাতেই আমরা যে সোমনাথের মন্দিরের দিকেই এসেছি তাতে ওদের নিশ্চয়ই কোনও সন্দেহ নেই। এতক্ষণে অর্ধেক পথ চলে এসেছে ওরা। দেরি করলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। যে করে হোক আজই রাত বারোটার মধ্যে কাজ সারতে হবে আমাদের। আজই দ্বারোকায় আমাদের শেষ রাত। পা চালাও সবাই।’
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন