কাজী আনোয়ার হোসেন
সতেরো-আঠারো বছরের বাচ্চা ছেলে একটা। দাড়ি গোঁফ ওঠেনি এখনও। মেয়েলী চেহারা। লম্বায় পাঁচ ফুট চার ইঞ্চি হবে। এত অল্প বয়সী ছেলের ওপর কমোডোর এত গুরুত্বপূর্ণ কাজের ভার দিয়েছেন দেখে বিস্মিত না হয়ে পারল না রানা। কালো একটা রেইনকোট পরনে, পায়ে গাম বুট। বাম হাতের কব্জিতে বড় সাইজের বেমানান ঘড়ি। মাথার হুডটা চিবুকের নিচে বেল্ট দিয়ে বাঁধা। একটা ক্যানভাসের ব্যাগ ঝুলছে কাঁধ থেকে। আঙুলের নখগুলো বড় বড়!
জ্ঞানহীন দেহটা উপুড় করে বগলের তলা দিয়ে হাত দিয়ে ঢুকিয়ে টেনে দাঁড় করাল রানা। তারপর নিয়ে এল রাস্তার ওপর। একটা সাঙ্কেতিক শিস দিতেই ছুটে এল মিশ্ৰী খান।
মিনিট দু’য়েক পর নড়ে-চড়ে উঠল লেফটেন্যান্ট আরীফের দেহটা। চোখের পাপড়ি কেঁপে উঠল প্রথমে, তারপর পূর্ণ দৃষ্টিতে চাইল সে। চোখের ওপর টর্চের আলো পড়ায় চোখ ছোট করল ভুরু কুঁচকে।
‘ওস্তাদ, এ যে দুধের বাচ্চা! এই ছোকরার কাছেই যাচ্ছিলাম আমরা?’
‘কে তোমরা?’ মেয়েলী কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল লেফটেন্যান্ট আরীফ।
‘তুমি যাদের খুঁজতে বেরিয়েছ আমরা সেই লোক, লেফটেন্যান্ট আরীফ। কিন্তু আমাদেরই তোমার সঙ্গে দেখা করবার কথা- তুমি চলেছিলে কোথায়?’
‘তোমাদের গ্রুপের কোড সিগন্যাল বলো আগে।’
‘ডেলায়লা।’
‘আপনি কি মেজর মাসুদ রানা?’ উঠে বসল আরীফ।
‘হ্যাঁ, তাই। আমার প্রশ্নের জবাব দাও, আরীফ।’
‘গোলাগুলির আওয়াজ শুনে বুঝতে পেরেছিলাম আপনারা পৌঁছে গেছেন। অথচ সকাল থেকে অপেক্ষা করছি, কারও দেখা নেই। তাই যাচ্ছিলাম আপনাদের বর্তমান অবস্থা জানবার জন্যে। আপনি বড় জোরে মেরেছেন আমাকে।’
‘আমাদের খুঁজে পেতে কি করে?
‘এখানকার প্রতিটা পাহাড়, প্রতিটা গুহা আমার নখদর্পণে।’ ডান পা-টা ভাঁজ করে সোজা করল একবার। ‘হাঁটুটা ব্যথা করছে কেন?
স্পড়ে গিয়েছিলে বেকায়দা মত,’ অম্লান বদনে মিথ্যে কথা বলল রানা। ‘গুলি কোরো না, নাজির। এরা আমাদের লোক,’ হঠাৎ বলে উঠল আরীফ।
বিদ্যুৎগতিতে ঘুরে দাঁড়াল রানা। দেখল পেছনে মিশমিশে কালো একটা ছায়া মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে। টর্চের আলো পড়তেই চক্চক্ করে উঠল ওর হাতের রিভলভারটা।
‘এই লোক কে?’
‘ওর নাম নাজির বেগ, আমার সহকারী। কমোডোর জুলফিকার পাঠিয়েছেন ওকে বছর খানেক আগে। ওর সামনে সব কথা বলতে পারেন। যাক্,’ উঠে দাঁড়িয়ে বার কয়েক পা-ঝাড়া দিল আরীফ। ‘এখন কি প্ল্যান? আর দু’জন কোথায়?’
‘প্রথম দরকার এখন খাবার। কাল দুপুরের পর থেকে আমরা কেউ কিছু খাইনি।’
‘খাবার আমার সঙ্গে আছে।’ ক্যানভাসের ব্যাগটা দেখাল আরীফ। ‘তারপর দরকার ওষুধ, ব্যাণ্ডেজ আর শুকনো কাপড়।’
‘ওষুধ, ব্যাণ্ডেজ কেন?’
‘আমাদের মধ্যে একজন সাংঘাতিক রকম জখম হয়েছে। খুব সম্ভব বাঁচবে না।’
‘নাজির!’ হুকুম করল আরীফ। ‘গ্রামে ফিরে যেতে হবে তোমাকে যেখান থেকে পারো ওষুধ, ব্যাণ্ডেজ আর শুকনো কাপড় জোগাড় করে আনো।
গুহাটা চিনিয়ে দিল রানা। কি ভেবে আরীফ জিজ্ঞেস করল, ‘আপনারা ঠিক পথ চিনে ফিরতে পারবেন তো?’
‘আশা তো করি। কেন?
‘সন্দেহ যখন আছে তখন আমাকে যেতে হবে আপনাদের সঙ্গে ভাবছিলাম নাজিরের সঙ্গে একজন থাকলে জিনিসগুলো জোগাড় করতে সুবিধে হত ওর।’
‘আমি যাচ্ছি ওর সঙ্গে,’ বলল মিশ্রী খান। ‘সেই সাথে খানিকটা ব্যায়াম-ও হয়ে যাবে।’
নাজির বেগ আপত্তি করল। বলল একাই পারবে সে। কিন্তু মিশ্ৰী খান ছাড়ল না। বলল, ‘দশে মিলি করি কাজ, হারি জিতি নাহি লাজ।
মিশ্রী খান আর নাজির বেগ রওনা হয়ে যেতেই রানারাও এগোল। রানাদের আকস্মিক ভাবে পেয়ে গিয়ে মানসিক উদ্বেগের অবসান হয়েছে আরীফের। খুশি মনে চলল সে বকর বকর করতে করতে। শত্রু এলাকার মধ্যে সর্বক্ষণ কতখানি অনিশ্চয়তা আর বিপদের ভেতর ভয়ে ভয়ে সাবধান থাকতে হয়, সেই গল্প। একবার প্রায় ধরা পড়ে গিয়েছিল- নাজিরকে তো নিয়েই গিয়েছিল। দু’জন সৈন্যকে খালি হাতে খুন করে প্রাণ নিয়ে ফিরেছে নাজির বেগ। লুকিয়ে দুই-দুইবার ঢুকেছে সে দ্বারোকা দুর্গের মধ্যে। প্রতিটা জিনিস ওর মুখস্থ। কোথায় কন্ট্রোল রূম, কোথায় ব্যারাক, কোথায় অফিসারস কোয়ার্টার, সেন্ট্রি পোস্ট, সবকিছু দেখে এসেছে। একবার তো পুরো একটা রাত ছিল সে দুর্গের মধ্যে।
খুশি হয়ে উঠল রানার মন। খুবই কাজে আসবে তাহলে লোকটা।
‘তোমার সহকারীটা একটি রত্ন দেখতে পাচ্ছি!’
‘আশ্চর্য রত্ন। কিন্তু ভারতীয়দের প্রতি এতখানি বিতৃষ্ণ লোককে বোধহয় এখানে পাঠানো ঠিক হয়নি। ভারতীয় সৈন্যরা জুনাগড়ে নাকি ওর পরিবারের ওপর অমানুষিক অত্যাচার করেছিল, ওর চোখের সামনে হত্যা করেছিল ওর স্ত্রীকে, ওকে বেঁধে নিয়ে গিয়ে চাবুক মেরে সারাদেহ জর্জরিত, করেছিল। ফেলে রেখে দিয়েছিল শকুনে ছিঁড়ে খাবার অপেক্ষায়। আশ্চর্য ভাবে বেঁচে গেছে ও। তারপর থেকে প্রতিশোধ নিয়ে চলেছে সুযোগ মত। আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না, কী ভয়ঙ্কর সে প্রতিশোধ। ভারতীয় সৈন্য দেখলেই মাথায় খুন চেপে যায় ওর। অন্ধকারে ঘুরে বেড়ায় ও, নিঃশে পেছনে গিয়ে দাঁড়ায়, পিঠের ওপর বসিয়ে দেয় চুরি। টু শব্দ করার আগেই শেষ। অসংখ্য খুন করেছে ও। জীবনের কোনও আনন্দ ওর কাছে এর চেয়ে বড় নয়।’
শিউরে উঠল একবার লেফটেন্যান্ট আরীফ নিজেই নাজির বেগের কথা ভেবে।
‘আমাকে ও খুব মানে। আমার বাবা ছিলেন জুনাগড়ের মস্ত বড় জমিদার। সব লুটে-পুটে নিয়েছে হিন্দুরা রায়টের সময়। আমি বাবার একমাত্র সন্তান। ও নাকি আমাদেরই প্রজা ছিল। আমি অবশ্য দেখিনি ওকে কোনদিন।’
‘তুমি কলেজ ছেড়েছ কবে?’
‘বি. এস. সি. পাস করে আর পড়িনি, এই চাকরিতে ঢুকে পড়েছি। দেখতে কম মনে হলেও আসলে বয়স আছে আমার।’
খানিকক্ষণ নীরবে হাঁটল রানা। খাড়াই উতরাই ভেঙে অন্ধকার রাতে চলতে খুবই অসুবিধা হচ্ছে।
‘আমি কিছুই চিনতে পারছি না, আরীফ। কোনদিকে চলেছি আমরা? আর কতদূর?
হেসে উঠল আরীফ।
‘আর মাত্র দু’শ গজ আছে। অন্য রাস্তায় নিয়ে এসেছি!’ আবার হাসল। ‘আপনাকে আপনারই আস্তানায় নিয়ে চলেছি আমি, অথচ আপনার চেহারাটা একবারও দেখিনি। এখন পর্যন্ত আপনার গলার স্বর ছাড়া কিছুই চিনি না আশ্চর্য লাগছে ভাবতে। কয়েকটা কোড ওয়ার্ড মানুষের মধ্যে কি অদ্ভুত বাঁধন সৃষ্টি করে দেয়! কিন্তু আমাকে চিনলেন কি করে আপনি?’
‘তোমার ছবি আর ডোশিয়ে দেখেছি আমি করাচিতে।’
‘ও।’ কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে বলল, ‘আপনার গলার স্বর শুনে আপনার চেহারাটা মনে মনে কল্পনা করে রেখেছি আমি। গুহায় পৌঁছে মিলিয়ে দেখব মেলে কিনা। আমার মনে হয় ঠিক মিলে যাবে।
এই ছেলেমানুষী খেলায় মজা পেল রানাও। একঘেয়ে হাঁটার চেয়ে মনে মনে এইসব খেলায় দোষের কিছু নেই।
‘মিলল কিনা আমি বুঝব কি করে? বলো শুনি, কেমন দেখতে আমি?’
‘বয়স পঞ্চান্ন। গাল দুটো বসা, কপালে ভাঁজ, ভুরু জোড়া কাঁচাপাকা! এক মুঠো দাড়ি আছে চিবুকে।’ আবার খানিক ভেবে বলল, ‘টুপির নিচে মাথা ভর্তি চকচকে টাক আছে।’
নিজের চেহারার এই বর্ণনা শুনে খুশি হতে পারল না রানা। চুপ করে রইল সে।
‘কি, মিলেছে না?’ জিজ্ঞেস করল আরীফ উৎসাহিত কণ্ঠে।
‘ঠিক মিলে গেছে!’ তৃতীয় এক ব্যক্তি কথা বলে উঠল। থমকে দাঁড়াল ওরা দু’জনেই। হো-হো করে হেসে উঠল আলতাফ। কাঁধে রাইফেল ঝুলানো।
‘আলতাফ! তুমি…তুমি ফিরলে কখন?’ বিস্মিত রানা জিজ্ঞেস করল।
‘ব্যাটাদের পুব দিকে ভাগিয়ে দিয়ে আধঘণ্টা আগে ফিরে এসে পাহারা দিচ্ছি। ইনি নিশ্চয়ই লেফটেন্যান্ট আরীফ? মিশ্রী কোথায়?’
‘ও গেছে ওর রোগীর জন্যে ওষুধপত্র আর শুকনো কাপড় জোগাড় করতে।’
‘ফিরবে কি করে? ওর তো অসম্ভব ভূতের ভয়।’
‘সাথে লোক আছে।’
সাবধানে ক্যানভাস সরিয়ে গুহায় ঢুকে পড়ল তিনজন। আলো জ্বলছে ভেতরে। গুহায় ঢুকে মোমবাতির আলোয় রানাকে আপাদমস্তক একবার দেখেই ভয়ানক লজ্জা পেয়ে গেল আরীফ।
‘মাফ করবেন, মেজর রানা। কণ্ঠস্বর শুনে আমি ভাবতেও পারিনি যে আপনি আমার চেয়ে মাত্র চার-পাঁচ বছরের বড়। দাড়িও নেই, টাকও নেই। হেরে গেছি আমি।
কোনও জবাব না দিয়ে প্রথমেই মাহবুবের পাশে হাঁটু গেড়ে বসল রানা। জেগেই আছে সে। খুব দ্রুত শ্বাস নিচ্ছে। চোখ দুটো লাল। বলল, পায়ে আর কোনও বোধ নেই, ব্যথাও নেই। রানা বুঝল লক্ষণটা খুবই খারাপ। মিশ্রী খান এখন তাড়াতাড়ি ফিরে এলে বাঁচা যায়। মাহবুবের গায়ে প্রবল জ্বর, কপালে হাত রাখা যাচ্ছে না। প্রমাদ গুণল রানা। ওকে এখান থেকে সরানোই একটা মস্তবড় সমস্যা হয়ে যাবে।
অনেক অনুরোধ সত্ত্বেও কিছুই খেলো না মাহবুব। পাশ ফিরে ভাঙা ভাঙা অস্বস্তিকর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল। মিশ্রী এবং মাহবুবের ভাগ আলাদা করে রেখে নিল খেয়ে রানা আর আলতাফ। খাবার শেষে ফ্লাস্কে করে আনা চা-টুকু মনে হলো যেন অমৃত। তৃপ্তির সঙ্গে কাপ শেষ করে উঠে দাঁড়াল রানা। রাত দশটা বাজতে পাঁচ মিনিট। মাহবুবের রেডিয়ো ট্র্যান্সমিটার তুলে নিয়ে বলল, ‘ওই পাহাড়ের মাথায় উঠে চেষ্টা করে দেখি স্যামসনকে পাওয়া যায় কিনা। আমার সাথে যে-কোনও একজন আসতে পারো। উঁচুতে উঠলে রিসেপশন ভাল পাওয়া যাবে।’
আলতাফ আর আরীফ দু’জনেই উঠে দাঁড়াল।
‘একজন যেতে পারো, অপর জন থাকবে মাহবুবের কাছে।’
‘ঘুমিয়ে পড়েছে মাহবুব। এই অল্পক্ষণের মধ্যে কিছুই হবে না ওর।’
‘সেকথা ভাবছি না। কিন্তু কোন রকম ঝুঁকি নেয়া যাবে না। আমি চাই না ও ভারতীয় সৈন্যদের হাতে ধরা পড় ক। যে করেই হোক ওকে দিয়ে কথা বলাবে ওরা। সর্বনাশ হয়ে যাবে তাহলে।
‘তুমি মিছেই ভাবছ, মেজর রানা,’ বলল আলতাফ। ‘আশেপাশে এক মাইলের মধ্যে ওদের একটি প্রাণীরও চিহ্ন নেই।’
একটু ইতস্তত করে রাজি হয়ে গেল রানা। আস্তে করে ঝাঁকি দিতেই চোখ মেলে চাইল মাহবুব।
‘আমরা একটু বাইরে যাচ্ছি। দশ মিনিটেই ফিরে আসব। কোনও অসুবিধে হবে না তো তোমার?’
‘কি অসুবিধে? কিছু না। একটা রাইফেল রেখে যান আমার পাশে, আর বাতিটা নিভিয়ে দিয়ে যান।’ ট্র্যান্সমিটারের দিকে চেয়ে হাসল মাহবুব। ‘ফিরে এসে ঢোকার সময় ডাক দিয়ে ঢুকবেন।
আলো নিভিয়ে বেরিয়ে গেল ওরা তিনজন। তিনজন একসাথে না থাকলে পাহাড়টায় ওঠা মুশকিল হয়ে পড়ত। পরিষ্কার পাওয়া গেল করাচি খবর শুনে চমকে উঠল সবাই। যুদ্ধের অবস্থা ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছে। দ্বারোকা ঘাঁটি শেষ করতে না পারলে সমূহ বিপদ। সর্বশেষ সংবাদ, রওনা হয়ে গেছে পাকিস্তানী নৌবাহিনী।
ফিরে এসে আস্তে ডাকল রানা মাহবুবের নাম ধরে গুহামুখে। সাড়া নেই কোনও। আবার ডাকল। এবারও সাড়া নেই। ট্র্যান্সমিটারটা আলতাফের হাতে দিয়ে পিস্তল বের করল রানা।
বাম হাতে টর্চ। ঝট্ করে পর্দা সরিয়েই সেফটিক্যাচ্ আর টর্চের বোতাম একসাথে টিপল রানা।
চারদিকে ঘুরে এল আলোটা একবার। এবার ধীরে ধীরে প্রতিটা কোণা পরীক্ষা করল রানা। মেঝেটা পরীক্ষা করল।
এলোমেলো বিছানা পড়ে আছে। মাহবুব নেই।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন