নারী দিবস

তসলিমা নাসরিন

১.

নারী দিবসের সকালে কিছু ফোন পেলাম। সকলে বললো, ‘হ্যাপি উইমেন’স ডে’। ঠিক যেমন করে তারা বলে ‘হ্যাপি ভ্যালেনটাইন’স ডে’ অথবা ‘হ্যাপি মাদারস ডে’। ভ্যালেনটাইন’স ডে বা মাদারস ডে-তে হ্যাপিনেসের বা সুখের ব্যাপার থাকে। প্রেমিক-প্রেমিকা বা মায়েদের আনন্দ উৎসব করার জন্য মূলত ওই দুটো দিন। কিন্তু নারী দিবসের তো একই উদ্দেশ্য নয়। নারী দিবস শুরুই হয়েছিল নারীর বিরুদ্ধে বৈষম্যগুলো দূর করার আন্দোলনের জন্য। এখনও একই কারণে নারী দিবস পালন করা হয়। এই দিবস নারীর আনন্দ উৎসবের দিবস নয়। এই দিবসের উপস্থিতি প্রমাণ করে নারী আজও অত্যাচারিত, অসম্মানিত, নারী আজও বঞ্চিত, লাঞ্ছিত। সে কারণেই এই দিবসে আজও নারীরা প্রাপ্য অধিকারের জন্য দাবি জানায়।

‘নারী দিবস’ জিনিসটি আমাকে কখনও আনন্দ দেয় না। আনন্দ দেয় না কারণ দিনটি আমার কাছে অত্যন্ত দুঃখের দিন। দুঃখের দিন কারণ মৌলিক অধিকার পাওয়ার জন্য আজও আমাদের কাঁদতে হচ্ছে, চিৎকার করতে হচ্ছে, সভা-সেমিনার করতে হচ্ছে, রাস্তায় নামতে হচ্ছে, মিছিলে যেতে হচ্ছে।

সেই কতকাল আগে, সম্ভবত ১০৫ বছর আগে, নির্যাতিত, নিপীড়িত, অত্যাচারিত ও অসম্মানিত না হওয়ার অধিকার চেয়েছিল নারী। সেই থেকে আজও বছর বছর এই দিনটিতে একই অধিকার চাওয়া হয়, চাওয়া হয় কারণ আজও নারীরা নারী হয়ে জন্ম নেওয়ার অপরাধে নির্যাতিত, নিপীড়িত অত্যাচারিত, অসম্মানিত। আজও আমরা নারীরা বঞ্চিত, লাঞ্ছিত। যেদিন সমানাধিকার পেয়ে যাবো, সেদিন থেকে এই দিবসটির অস্তিত্ব আর থাকবে না। সর্বান্তকরণে দিবসটির বিলুপ্তি চাই আমি।

২.

আমি তো সবসময় বলি, বছরের ৩৬৪ দিন পুরুষ দিবস, ১ দিন নারী দিবস। নারী আর পুরুষের মধ্যে যে হাজারো বৈষম্য, সেগুলো হটিয়ে দিলেই নারী দিবস করার প্রয়োজন পড়বে না। নারীবিদ্বেষী কিছু পুরুষ যে ‘পুরুষ দিবস’ পালন করার আয়োজন করছে, সেটিও রোধ করতে হবে। নারী পুরুষ উভয়ে যেন ঘটা করে ‘মানব দিবস’ উত্যাপন করতে পারি।

৩.

নারী দিবসে কি ধর্ষণ ঘটেনি? নারীর ওপর অত্যাচার বন্ধ ছিল একদিনের জন্যও? মেয়েশিশু পাচার হয়নি, শিশু কিশোরীদের যৌনদাসী বানাবার জন্য পতিতালয়ে বিক্রি করা হয়নি? নারী দিবসে নারী-হত্যা বন্ধ ছিল? নারীকে কি পুড়িয়ে মারা হয়নি নারী দিবসে? সত্যি কথাটা খুলেই বলি, বিশ্বজুড়ে নারী-নির্যাতন চলেছে নারী দিবসে।

১টি দিনের জন্যও নারীকে রেহাই দেওয়া হয় না। জানি না বছরের ৩৬৫ দিন কী করে রেহাই পাবে নারী। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ আমাদের, এ সমাজে পুরুষের গায়ে ফুলের টোকা পড়ে না তা নয়। পুরুষও এই সমাজে অত্যাচারিত, তবে পুরুষরা পুরুষ হয়ে জন্ম নেওয়ার কারণে অত্যাচারিত নয়। যেসব কারণে পুরুষ ভোগে, সেসব কারণে নারীও ভোগে। দারিদ্র্য নারী পুরুষ উভয়কেই ভোগায়। কিন্তু নারী হওয়ার কারণে নারীকে বাড়তি ভুগতে হয়। পুরুষ হওয়ার কারণে পুরুষকে ভুগতে হয় না। বরং যেসব আরাম আয়েশ, আর বাড়তি সুবিধে পুরুষ পায়, সে পুরুষ হওয়ার কারণেই পায়।

৪.

আমার নারী দিবসটা কেটেছে অন্য সাধারণ দিনের মতোই। এই দিন আমি কোনও আনন্দ উৎসবে যোগ দিই নি। কোনও বক্তৃতা বিতর্কও করি নি। মনে অর্ধেক দিন কষ্ট দিচ্ছিল বড় একটি পত্রিকায় ছাপা হওয়া খবর। খবরের শিরোনাম : ‘মহিলাদের গোপনাঙ্গের দুর্গন্ধের ৮টি কারণ’। নারী দিবসে নারীদের জন্য পুরুষের প্রতিষ্ঠান থেকে চমৎকার এক উপহার বটে!

নারীকেই চিহ্নিত করা হয় ডাইনি বলে, অপয়া বলে, অমঙ্গল বলে, নরকের দ্বার বলে, নোংরা আর দুর্গন্ধের আধার বলে। যেন নারীরা লজ্জায় সংকুচিত হয়, ভয়ে সিটিয়ে থাকে, যেন আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে, যেন নিজেকে ঘৃণা করতে শেখে।

এ তো গেল অর্ধেক দিনের কথা। আমার মন খারাপের কথা। বাকি অর্ধেক দিন নিজেকে লজ্জা আর ভয় থেকে মুক্ত করেছি, আত্মবিশ্বাস যতটুকু হারিয়েছিল, ততটুকু ফেরত এনেছি, নিজেকে ঘৃণা করার বদলে নিজেকে ভালোবেসেছি। বাকি অর্ধেক দিন আমি ভালো ছিলাম। যে মেয়েরা নিজেকে ঘৃণা করছে, যেহেতু সমাজ শিখিয়েছে মেয়েদের ঘৃণা করতে, তাদের বলছি ঘৃণা বন্ধ করতে। ঘৃণা করলে সামনে যেতে নিজেরাই নিজেদের বাধা দেয়। ঘৃণা করলে পিছু হঠতে থাকে মানুষ। ষড়যন্ত্র করে মেয়েদের পেছনে রাখা হয়েছে, তারপরও মেয়েদের আরও পেছনে যাওয়ার ঝোঁক। অনেক আগেই দেয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছে তাদের।   দেয়ালে পিঠ ঠেকলে মানুষ সামনে যায়। সামনে যা কিছু থাক, ভেঙেচুরে আরও সামনে যায়। নিরাপদ দূরত্বে যায়। মেয়েরা কবে মানুষ হবে?

সোর্স : বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১০ মার্চ, ২০১৬

সকল অধ্যায়

১. লিঙ্গসূত্র
২. যৌবনে ছেলেরা ডেয়ারিং
৩. পতিতা প্রথা বন্ধ হোক
৪. অপ্রত্যাশিত
৫. বিয়ের প্রয়োজনীয়তা আদৌ আছে কি?
৬. পুরুষ নিয়ে মেয়েদের কাড়াকাড়ি বাড়াবাড়ি
৭. নারীর যৌন কামনা থাকতে নেই
৮. দেশ আর দেশ নেই
৯. আমার গৌরব, আমি স্বেচ্ছাচারী
১০. ধর্মে নেই, উৎসবে আছি
১১. বেলা যায় মেলা যায়
১২. তোমাকে অভিবাদন, এলফ্রিডা
১৩. যাই বল নইপল
১৪. আমার দেহ নিয়ে আমি যা খুশি করব
১৫. বাবা
১৬. সেক্সবয় (গল্প)
১৭. সকল গৃহ হারালো যার
১৮. অন্ধকার আমাকে গ্রাস করতে থাকে
১৯. মেয়েদের শরীর পুরুষের চোখে
২০. পৃথিবীর প্রাচীনতম নির্যাতন
২১. পেছনের দিনগুলো ধুসর ধুসর
২২. খারাপ মেয়ের গল্প (গল্প)
২৩. হুমায়ূন : পুরুষতন্ত্রের সম্রাট
২৪. তুই নিষিদ্ধ তুই কথা কইস না
২৫. অনুমতি না নিয়ে আমার শরীর স্পর্শ করেছিলেন সুনীল
২৬. পৃথিবীর পথে
২৭. পৃথিবীর পথে ২
২৮. মিডিয়া এবং মানুষ
২৯. নারীবিদ্বেষের কারণ পুরুষতন্ত্র
৩০. সন্ত্রাস
৩১. বিহারি সমস্যা
৩২. রঘু রাই এবং শরণার্থী
৩৩. এ লড়াই প্রাচ্যের সঙ্গে পাশ্চাত্যের নয়
৩৪. বেড়ালের গল্প
৩৫. ফিলিস্তিন এক টুকরো মাটির নাম
৩৬. পর্নোগ্রাফি
৩৭. সেইসব ঈদ
৩৮. কামড়ে খামচে মেয়েদের ‘আদর’ করছে পুরুষেরা
৩৯. সুন্দরী
৪০. ধর্ম থাকবে, নারীর অধিকারও থাকবে, এটা হয় না
৪১. সানেরার মতো মেয়ে চাই- আছে?
৪২. প্রতিবেশি দেশ
৪৩. বামপন্থীদের ভুল
৪৪. বাঙালির বোরখা
৪৫. শাড়ি ব্লাউজ
৪৬. বিয়ের বয়স
৪৭. সেইসব ঈদ
৪৮. ন্যাড়া কি বেলতলা যায়
৪৯. লতিফ সিদ্দিকী এবং মানুষের ধর্মানুভূতি
৫০. বাকস্বাধীনতার অর্থ কি এতটাই কঠিন?
৫১. কেন পারি না
৫২. নাবালিকা ধর্ষণ
৫৩. রেলমন্ত্রীর বয়স এবং বিয়ে
৫৪. চুমু চুমু চুমু চুমু
৫৫. এত ঘৃণা করে ওরা মেয়েদের!
৫৬. সুমন চট্টোপাধ্যায় থেকে কবির সুমন
৫৭. তারপর কী হলো
৫৮. কিছু প্রশ্ন। কিছু উত্তর।
৫৯. দূর থেকে হয় না
৬০. আরীব মজিদরা জেলের বাইরে থাকলে আমরা অনেকেই নিরাপদ নই
৬১. এতদিনে ভারতে সভ্য আইন
৬২. বোয়াল মাছের গল্প
৬৩. মেয়ে বলে ‘কম মানুষ’ নই
৬৪. উপন্যাস : ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে
৬৫. প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটি ব্যক্তিগত চিঠি
৬৬. ধর্মান্তরণ
৬৭. গণধর্ষণ
৬৮. নির্বাসিত একটি ছবির নাম
৬৯. শার্লি আবদো
৭০. কল্পনার রাজ্য
৭১. কোকো, খালেদা আর দেশের দগ্ধ সন্তানেরা
৭২. গরিবের গ্রেনেড
৭৩. বাংলা একাডেমির অসভ্যতা
৭৪. অভিজিৎকে যেভাবে চিনি
৭৫. নারী দিবস
৭৬. বাঘ আর বেড়াল
৭৭. বাংলাদেশিদের দেশপ্রেম
৭৮. বাক স্বাধীনতা
৭৯. স্যানিটারি প্যাডে প্রতিবাদ
৮০. বাংলাদেশের কী কী করা উচিত ছিল এবং ছিল না
৮১. বাংলা সংস্কৃতি চলবে কী চলবে না
৮২. ঢাকাও কমাতে পারে জ্যাম আর দূষণ
৮৩. গ্যালিলিও এবং তার ‘জারজ মেয়ে’
৮৪. লজ্জাহীনতা
৮৫. প্রচলিত নারীবিদ্বেষী শব্দ ও প্রবাদ
৮৬. নিজের গোলা শূন্য
৮৭. শৃংখল ভেঙেছি আমি
৮৮. দেশপ্রেম না থাকাও মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার
৮৯. ঢাকার বইমেলা ও একটি প্রেমের গল্প
৯০. খুব কাছে ওত পেতে আছে আততায়ী
৯১. নারী দিবস
৯২. ভারত এবং গরু
৯৩. আমার প্রথম সংসার
৯৪. খাজুরাহোর অভিজ্ঞতা
৯৫. চীনের অভিজ্ঞতা
৯৬. আমার জন্য কথা বলার কেউ নেই…
৯৭. সমাজ কি থেমে আছে?
৯৮. পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ
৯৯. কিছু প্রশ্ন, কিছু আশা
১০০. এই বাংলাদেশ আমার অচেনা
১০১. দেশের ভবিষ্যৎ
১০২. রোজা রাখার স্বাধীনতা
১০৩. চারদিকে প্রচুর ওমর মতিন
১০৪. আমার চোখের জলের ঈদ
১০৫. যদি পুরুষ হতাম
১০৬. জাকির নায়েকের বাকস্বাধীনতা
১০৭. কিছু সেলিব্রিটি মেয়ে তো ফাটাফাটি
১০৮. বিরুদ্ধ স্রোত
১০৯. মেয়েরা সেরা
১১০. মেয়েদের কাপড় চোপড়
১১১. মেয়েদের কাপড় চোপড়
১১২. সত্য বললে বিপদ
১১৩. আমরা আর তারা
১১৪. এরা কি মানুষ!
১১৫. লজ্জা বইটি এখনও নিষিদ্ধ কেন?
১১৬. বায়ু দূষণ
১১৭. সাঁওতালদের কথা
১১৮. হাতে টাকা নেই
১১৯. শিশুদের জন্য লোভের জিভ
১২০. যৌনকর্ম নাম দিয়ে পতিতাবৃত্তিকে বৈধ করার ষড়যন্ত্র
১২১. বুদ্ধিজীবী দিবস
১২২. সন্ত্রাস কোনো সমস্যার সমাধান নয়
১২৩. বাংলা একাডেমির হয়েছেটা কী
১২৪. যে বই তোমায় দেখায় ভয়, সে বইও পড়া উচিত
১২৫. পাঠ্যপুস্তকের পরিবর্তন
১২৬. দঙ্গলের মেয়ে
১২৭. নিষিদ্ধের তো একটা সীমা আছে
১২৮. ভারতে অসহিষ্ণুতা
১২৯. মেয়েদের পোশাক নিয়ে লোকের এত মাথাব্যথা কেন?
১৩০. ভ্যালেন্টাইন ডে’র ভাবনা
১৩১. উদারতার চেয়ে মহান কিছু নেই
১৩২. নারীবাদী হওয়া সহজ নয়
১৩৩. নেপাল থেকে বলছি
১৩৪. বাংলাদেশ বদলে গেছে
১৩৫. কেন আত্মঘাতী বোমারু হতে ইচ্ছে করে
১৩৬. অপুরা যেন হেরে না যায়
১৩৭. শেখ হাসিনার জন্য দুশ্চিন্তা
১৩৮. ওরা কেন আমাদের চেয়েও ভালো
১৩৯. ধর্ষকদের পৃথিবীতে বেঁচে যে আছি, এই তো অনেক
১৪০. চাই ধর্ষণহীন দিন
১৪১. আমার গ্রিন কার্ড, আমেরিকার ট্রাম্প কার্ড

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন