চুমু চুমু চুমু চুমু

তসলিমা নাসরিন

চুমুর মতো চমৎকার জিনিস আর হয় না। দিন দুপুরে চুমু খাব, প্রকাশ্যে খাব, একশ লোককে দেখিয়ে খাব — এরকম একটি ‘আমার চুমু আমি খাবো, যেথায় খুশি সেথায় খাবো’ আন্দোলন চলছে এখন ভারতে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছাত্রীরা স্লোগান দিচ্ছে ‘চুমু চুমু চুমু চাই, চুমু খেয়ে বাঁচতে চাই’, ‘আমার শরীর আমার মন, দূর হঠো রাজশাসন’। কেরালার রাস্তায় চুমু খেয়েছিল বলে পুলিশ ধরে নিয়ে গেল তরুণ তরুণীকে, মিনিস্কার্ট পরেছিল বলে কলকাতার স্টার থিয়েটারে এক মেয়েকে ঢুকতে দিল না। মূলত নীতিপুলিশির প্রতিবাদেই ছেলেমেয়েরা চুমু খাচ্ছে। এরকম ঘটনা প্রায়ই ঘটছে রাজ্যে রাজ্যে। রাস্তায়-নদীর পাড়ে-লেকের ধারে-পার্কে তরুণ তরুণীদের ঘনিষ্ঠ হতে দেখলেই নাকি পুলিশ এসে ঝামেলা করে। প্রেম করা যেন অন্যায়। জনসমক্ষে হাত ধরে হাঁটা, আলিঙ্গণ করা, চুমু খাওয়া–এসব নাকি অশ্লীল। যৌনতাও নাকি অশ্লীল! ভায়োলেন্স কি অশ্লীল? আমার মনে হয় না কেউ সিরিয়াসলি বিশ্বাস করে ভায়োলেন্স অশ্লীল।
রাস্তা ঘাটে মানুষকে অসম্মান করো, অকথ্য ভাষায় গালি দাও, যৌন হেনস্থা কর, মারো, গরিব পকেটমারকে সবাই মিলে পিটিয়ে মেরে ফেলো, কোন‌ও দৃশ্যই কারো কাছে খুব একটা অশ্লীল ঠেকে না। রাস্তায় মানুষ পানের পিক ফেলছে, কফ সর্দি ফেলছে, মলমুত্র ত্যাগ করছে –এসবে কেউ আপত্তি করছে না। মানুষ না খেতে পেয়ে, চিকিৎসার অভাবে মরে পরে আছে রাস্তায়–সেসব দৃশ্য কারও কাছে আপত্তিকর নয়। কিন্তু আপত্তিকর দৃশ্য যখন তুমি ভালোবেসে কারো হাত স্পর্শ করছো, ভালোবেসে কারো ঠোঁটে চুমু খাচ্ছো। ভালবাসাটা অপরাধ। ভালোবাসাটা অপরাধ বলেই চারদিকে আজ ঘৃণার জয়জয়কার।
মনে আছে বীটল্সের জন লেনন কী করে ভিয়েতনাম যুদ্ধের প্রতিবাদ করেছিলেন? বউ ইয়োকো ওনোকে নিয়ে সম্পূর্ণ উলঙ্গ হয়ে পুরো জগতকে দেখিয়ে ঘোষনা দিয়েছিলেন: যৌন সঙ্গম করো, যুদ্ধ করো না, মেইক লাভ, নো ওয়ার। হিংসে আর ঘৃণার রাজনীতিতে যারা বিশ্বাস করে, তারা যৌন সঙ্গমের চেয়ে যুদ্ধকেই পছন্দ করে বেশি। অবাক লাগে ভাবতে যে বাংলার লেখক সাহিত্যিকরা এই একবিংশ শতাব্দিতে বিশ্বাস করেন চুমুটা ঘরের বাইরে খাওয়া উচিত নয়। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় বলেছেন, ‘এটা কোনো প্রতিবাদ এর ভাষা হতে পারে না। কুরুচির পরিচয় ছাড়া আর কিছু নয়। কেরালায় চুম্বন করে প্রতিবাদ হয়েছে বলে কলকাতায় করতে হবে তার মানে নেই…’। পশ্চিমবঙ্গের মন্ত্রী বিশিষ্ট নাট্য ব্যক্তিত্ব ব্রাত্য বসু বলেছেন, ‘তাদের অভিভাবকেরা যদি চুমু খেতে চান, ছাত্র ছাত্রীরা মানবে তো?’ নীতি পুলিশ সর্বত্র। এমনকী বুদ্ধিজীবি মহলেও।
আমি তো মাঝে মাঝেই বলি, যৌনসঙ্গম কেবল চারদেওয়ালের বন্ধ ঘরে হতে হবে কেন! প্রকৃতির কাছে যাও, পূর্ণিমার রাতগুলোয় নির্জন বনে চলে যাও, নীরব সৈকতে চলে যাও, ভালোবেসে চুমু খাও, শরীরে শরীর মেলাও। আমরা তো প্রকৃতির সন্তান। জগত দেখুক, আমরা ভালবাসছি। আকাশ দেখুক, জুঁইফুল দেখুক। আমার পাশ্চাত্যের বন্ধুরা এসবে অভ্যস্ত হলেও প্রাচ্যের বন্ধুরা নয়। তাদের কাছে এখনও শরীর–বিশেষ করে মেয়েদের শরীর– অশ্লীল, এখনও যৌনতা অশ্লীল। প্রথম যখন ইওরোপে গেছি, অবাক হয়ে সম্পূর্ণ বা প্রায়-উলঙ্গ নারীপুরুষকে দেখেছি সমুদ্রের ধারে শুয়ে সূর্যস্নান করতে, শরীর যে সুন্দর, শরীর যে অশ্লীল নয়, তা সম্ভবত তখনই আমি আবিস্কার করি। যখন দেখি দুজন মানুষ গভীর চুম্বনে মগ্ন, বুঝি যে চুমুর জন্য চারদেওয়ালের প্রয়োজন নেই। চুমু খোলা আকাশের নিচেও বড় সুন্দর, বড় সুস্বাদু। চুমুর স্বাদ ঘরে বাইরে আসলে একই। তবে ইচ্ছে হচ্ছে চুমু খেতে, লোকে কী বলবে বলে চুমু খেতে পারছি না, এই অবদমনের কষ্ট বড় সাংঘাতিক। আমার জীবনে প্রেমিক খুব বেশি কেউ ছিল না। তবে প্যারিস শহরের বাগানে, রাস্তায়, গাড়িতে, সিনেমায়, ক্যাফেতে যখন খুশি চুমু খেয়েছি আমার এক প্রেমিককে। গালে গালে শুকনো চুমুর কথা বলছি না। বলছি ঠোঁটের জিভের মুখগহবরের গভীর দীর্ঘ চুম্বনের কথা। চুমু ছাড়া জীবনকে আমার খুব শুকনো শুকনো লাগতো।
খুব ভালো লাগে যখন দেখি মানুষ মানুষকে ভালোবাসছে। হিংসুকরা সহ্য করতে পারে না অন্যের ভালোবাসা। হিংসুকেরা মানুষে মানুষে ঘৃণা দেখে আরাম বোধ করে। যারা প্রকাশ্যে চুমু খাওয়ার বিরোধী, এবং যারা পক্ষপাতী, লক্ষ করেছি, দু’পক্ষই পুরুষতন্ত্রকে দোষ দিচ্ছে। প্রকাশ্যে চুমু খাওয়া মানে নারীকে পণ্য করা, এ পুরুষতন্ত্রের কারসাজি। আবার প্রকাশ্যে চুমু খেতে বাধা দেওয়ার উদ্দেশ্য নারীকে ঘরবন্দী রাখা, নারীর স্বাধীনতার বিরুদ্ধে যাওয়া, এও পুরুষতন্ত্রের কারসাজি। আমি পুরুষতন্ত্রের আলোচনায় যাচ্ছি না। আমি নিতান্তই শরীরের পক্ষে যাচ্ছি। প্রেমের পক্ষে যাচ্ছি। নারী পুরুষের প্রেম, বা নারী নারীর প্রেম, বা পুরুষ পুরুষের প্রেম— সব প্রেমকেই মেনে নিয়ে, সব প্রেমের প্রকাশকে আমি অভিনন্দন জানাচ্ছি। আমি রাস্তা ঘাটে দেখতে চাই না কেউ মরে পড়ে আছে, কেউ ধুকছে, কেউ মার খাচ্ছে, কেউ মারছে কাউকে, অপমান করছে, জ্বালাচ্ছে, হেনস্থা করছে, ধর্ষণ করছে। আমি দেখতে চাই মানুষ মানুষকে ভালোবাসছে। মানুষ মানুষকে চুমু খাচ্ছে। এমনকী আমি দেখলে খুশি হবো যে মানুষ ভালোবেসে যৌন সঙ্গম করছে। যৌন সঙ্গম যুদ্ধের চেয়ে, দুর্ভিক্ষের চেয়ে, মৃত্যুর চেয়ে, দৃশ্য হিসেবে অনেক সুন্দর, অনেক পবিত্র।

সকল অধ্যায়

১. লিঙ্গসূত্র
২. যৌবনে ছেলেরা ডেয়ারিং
৩. পতিতা প্রথা বন্ধ হোক
৪. অপ্রত্যাশিত
৫. বিয়ের প্রয়োজনীয়তা আদৌ আছে কি?
৬. পুরুষ নিয়ে মেয়েদের কাড়াকাড়ি বাড়াবাড়ি
৭. নারীর যৌন কামনা থাকতে নেই
৮. দেশ আর দেশ নেই
৯. আমার গৌরব, আমি স্বেচ্ছাচারী
১০. ধর্মে নেই, উৎসবে আছি
১১. বেলা যায় মেলা যায়
১২. তোমাকে অভিবাদন, এলফ্রিডা
১৩. যাই বল নইপল
১৪. আমার দেহ নিয়ে আমি যা খুশি করব
১৫. বাবা
১৬. সেক্সবয় (গল্প)
১৭. সকল গৃহ হারালো যার
১৮. অন্ধকার আমাকে গ্রাস করতে থাকে
১৯. মেয়েদের শরীর পুরুষের চোখে
২০. পৃথিবীর প্রাচীনতম নির্যাতন
২১. পেছনের দিনগুলো ধুসর ধুসর
২২. খারাপ মেয়ের গল্প (গল্প)
২৩. হুমায়ূন : পুরুষতন্ত্রের সম্রাট
২৪. তুই নিষিদ্ধ তুই কথা কইস না
২৫. অনুমতি না নিয়ে আমার শরীর স্পর্শ করেছিলেন সুনীল
২৬. পৃথিবীর পথে
২৭. পৃথিবীর পথে ২
২৮. মিডিয়া এবং মানুষ
২৯. নারীবিদ্বেষের কারণ পুরুষতন্ত্র
৩০. সন্ত্রাস
৩১. বিহারি সমস্যা
৩২. রঘু রাই এবং শরণার্থী
৩৩. এ লড়াই প্রাচ্যের সঙ্গে পাশ্চাত্যের নয়
৩৪. বেড়ালের গল্প
৩৫. ফিলিস্তিন এক টুকরো মাটির নাম
৩৬. পর্নোগ্রাফি
৩৭. সেইসব ঈদ
৩৮. কামড়ে খামচে মেয়েদের ‘আদর’ করছে পুরুষেরা
৩৯. সুন্দরী
৪০. ধর্ম থাকবে, নারীর অধিকারও থাকবে, এটা হয় না
৪১. সানেরার মতো মেয়ে চাই- আছে?
৪২. প্রতিবেশি দেশ
৪৩. বামপন্থীদের ভুল
৪৪. বাঙালির বোরখা
৪৫. শাড়ি ব্লাউজ
৪৬. বিয়ের বয়স
৪৭. সেইসব ঈদ
৪৮. ন্যাড়া কি বেলতলা যায়
৪৯. লতিফ সিদ্দিকী এবং মানুষের ধর্মানুভূতি
৫০. বাকস্বাধীনতার অর্থ কি এতটাই কঠিন?
৫১. কেন পারি না
৫২. নাবালিকা ধর্ষণ
৫৩. রেলমন্ত্রীর বয়স এবং বিয়ে
৫৪. চুমু চুমু চুমু চুমু
৫৫. এত ঘৃণা করে ওরা মেয়েদের!
৫৬. সুমন চট্টোপাধ্যায় থেকে কবির সুমন
৫৭. তারপর কী হলো
৫৮. কিছু প্রশ্ন। কিছু উত্তর।
৫৯. দূর থেকে হয় না
৬০. আরীব মজিদরা জেলের বাইরে থাকলে আমরা অনেকেই নিরাপদ নই
৬১. এতদিনে ভারতে সভ্য আইন
৬২. বোয়াল মাছের গল্প
৬৩. মেয়ে বলে ‘কম মানুষ’ নই
৬৪. উপন্যাস : ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে
৬৫. প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটি ব্যক্তিগত চিঠি
৬৬. ধর্মান্তরণ
৬৭. গণধর্ষণ
৬৮. নির্বাসিত একটি ছবির নাম
৬৯. শার্লি আবদো
৭০. কল্পনার রাজ্য
৭১. কোকো, খালেদা আর দেশের দগ্ধ সন্তানেরা
৭২. গরিবের গ্রেনেড
৭৩. বাংলা একাডেমির অসভ্যতা
৭৪. অভিজিৎকে যেভাবে চিনি
৭৫. নারী দিবস
৭৬. বাঘ আর বেড়াল
৭৭. বাংলাদেশিদের দেশপ্রেম
৭৮. বাক স্বাধীনতা
৭৯. স্যানিটারি প্যাডে প্রতিবাদ
৮০. বাংলাদেশের কী কী করা উচিত ছিল এবং ছিল না
৮১. বাংলা সংস্কৃতি চলবে কী চলবে না
৮২. ঢাকাও কমাতে পারে জ্যাম আর দূষণ
৮৩. গ্যালিলিও এবং তার ‘জারজ মেয়ে’
৮৪. লজ্জাহীনতা
৮৫. প্রচলিত নারীবিদ্বেষী শব্দ ও প্রবাদ
৮৬. নিজের গোলা শূন্য
৮৭. শৃংখল ভেঙেছি আমি
৮৮. দেশপ্রেম না থাকাও মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার
৮৯. ঢাকার বইমেলা ও একটি প্রেমের গল্প
৯০. খুব কাছে ওত পেতে আছে আততায়ী
৯১. নারী দিবস
৯২. ভারত এবং গরু
৯৩. আমার প্রথম সংসার
৯৪. খাজুরাহোর অভিজ্ঞতা
৯৫. চীনের অভিজ্ঞতা
৯৬. আমার জন্য কথা বলার কেউ নেই…
৯৭. সমাজ কি থেমে আছে?
৯৮. পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ
৯৯. কিছু প্রশ্ন, কিছু আশা
১০০. এই বাংলাদেশ আমার অচেনা
১০১. দেশের ভবিষ্যৎ
১০২. রোজা রাখার স্বাধীনতা
১০৩. চারদিকে প্রচুর ওমর মতিন
১০৪. আমার চোখের জলের ঈদ
১০৫. যদি পুরুষ হতাম
১০৬. জাকির নায়েকের বাকস্বাধীনতা
১০৭. কিছু সেলিব্রিটি মেয়ে তো ফাটাফাটি
১০৮. বিরুদ্ধ স্রোত
১০৯. মেয়েরা সেরা
১১০. মেয়েদের কাপড় চোপড়
১১১. মেয়েদের কাপড় চোপড়
১১২. সত্য বললে বিপদ
১১৩. আমরা আর তারা
১১৪. এরা কি মানুষ!
১১৫. লজ্জা বইটি এখনও নিষিদ্ধ কেন?
১১৬. বায়ু দূষণ
১১৭. সাঁওতালদের কথা
১১৮. হাতে টাকা নেই
১১৯. শিশুদের জন্য লোভের জিভ
১২০. যৌনকর্ম নাম দিয়ে পতিতাবৃত্তিকে বৈধ করার ষড়যন্ত্র
১২১. বুদ্ধিজীবী দিবস
১২২. সন্ত্রাস কোনো সমস্যার সমাধান নয়
১২৩. বাংলা একাডেমির হয়েছেটা কী
১২৪. যে বই তোমায় দেখায় ভয়, সে বইও পড়া উচিত
১২৫. পাঠ্যপুস্তকের পরিবর্তন
১২৬. দঙ্গলের মেয়ে
১২৭. নিষিদ্ধের তো একটা সীমা আছে
১২৮. ভারতে অসহিষ্ণুতা
১২৯. মেয়েদের পোশাক নিয়ে লোকের এত মাথাব্যথা কেন?
১৩০. ভ্যালেন্টাইন ডে’র ভাবনা
১৩১. উদারতার চেয়ে মহান কিছু নেই
১৩২. নারীবাদী হওয়া সহজ নয়
১৩৩. নেপাল থেকে বলছি
১৩৪. বাংলাদেশ বদলে গেছে
১৩৫. কেন আত্মঘাতী বোমারু হতে ইচ্ছে করে
১৩৬. অপুরা যেন হেরে না যায়
১৩৭. শেখ হাসিনার জন্য দুশ্চিন্তা
১৩৮. ওরা কেন আমাদের চেয়েও ভালো
১৩৯. ধর্ষকদের পৃথিবীতে বেঁচে যে আছি, এই তো অনেক
১৪০. চাই ধর্ষণহীন দিন
১৪১. আমার গ্রিন কার্ড, আমেরিকার ট্রাম্প কার্ড

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন