তারপর কী হলো

তসলিমা নাসরিন

সেদিন, এ মাসের ন’ তারিখে, একটা পুরস্কার পেলাম। সুইডেনের মানববাদী সংস্থা থেকে হেডেনিউস পুরস্কার। পুরস্কারটি সুইডেনের দার্শনিক ইঙ্গমার হেডেনিউসের নামে। হেডেনিউস ছিলেন সুইডেনের প্রখ্যাত উপসালা বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শনের অধ্যাপক। তিনি ক্রিশ্চান ধর্মের বিরুদ্ধে লড়াই করছেন। ধর্ম আর বিজ্ঞানের মধ্যে যে কোনও সুস্থ তর্ক সম্ভব নয়, এই বিষয়ে বইও লিখেছেন। হেডেনিউস পুরস্কার তাঁদের দেওয়া হয় যারা ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার ইত্যাদির বিরুদ্ধে আপোসহীনভাবে লড়েছেন। ইওরোপ, আমেরিকা থেকে মানবাধিকার পুরস্কার বেশকিছু পেয়েছি। এতকাল মানবতন্ত্র ও মানবাধিকারের পক্ষে লেখালেখি করে, এই যে স্বীকৃতিটুকু পাই, এ আমার নির্বাসনের কষ্ট অনেকটাই দূর করে। মাঝে মাঝে ভাবি এই যে এত এত পুরস্কার রয়ে গেলো, এগুলো কোথায় থাকবে আমি মরে গেলে! আমার তো কোনও ঘর নেই, দেশ নেই! হারিয়ে যাবে সম্ভবত। এর মধ্যেই অনেক হারিয়েছি। যাযাবর জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছি আজ কুড়ি বছর। নিজের মতো করে নিজের একটা বাড়ি সাজানোর ইচ্ছে সেই ছোটবেলা থেকে। সে আর হলো কই! এখন আর আগের মতো কোথাও স্থির হওয়ার স্বপ্ন দেখি না। বয়স যত বাড়তে থাকে, তত কমে যেতে থাকে বাড়ি-ঘর, সহায় সম্পদের স্বপ্ন। সব ফেলে যে শীঘ্র চলে যেতে হবে, সেই ভাবনাটি আসে, জীবনের সবকিছু এমনকী জীবনটাই যে ক্ষণস্থায়ী সেটিও ঘন ঘন মনে পড়ে।

হেডেনিউস পুরস্কারটি শুধু যে সুইডিশরাই পেতে পারে। আমি যেহেতু সুইডিশ নাগরিক, এটি পেতে কোনও অসুবিধে হয়নি। একজন কালো চুলের বাদামি রঙের মেয়ে সুইডিশ!এ আমিও বিশ্বাস করি না। সুইডিশ বলতেই আমরা বুঝি সোনালী চুলের লম্বা চওড়া সাদা নারী পুরুষ। আমি আপাদমস্তক বাঙ্গালি। কিন্তু যেহেতু নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও আমার পাসপোর্ট পুণরায় নবায়নকরণ করে না বাংলাদেশ, সে কারণে বাধ্য হয়ে নিতে হয়েছে সুইডিশ পাসপোর্ট। পাসপোর্ট এলে নাগরিকত্ব আসে। আর নাগরিকত্ব এসেছে বলেই হেডেনিউস পুরস্কার এলো। মাঝে মাঝে মনে হয়, বাংলা ভাষায় না লিখে ইংরেজি বা ফরাসি ভাষায় যদি লিখতে পারতাম, তাহলে অনেক পাঠকের কাছে পৌঁছাতে পারতাম সরাসরি। সেটি কি আর এই পঞ্চাশোত্তর বয়সে সম্ভব! এসব এখন স্বপ্নেরও ঊর্ধ্বে।

সুইডেনের সঙ্গে আমার একটা লাভ এন্ড হেইট এর সম্পর্ক আছে। দেশটিকে ভালোবাসি, আবার ভালোও বাসি না। অনেকটা বাংলাদেশের মতো। অনেকটা ফ্রান্সের মতো।

তারপর কী হলো, সে রাতে আরও একজন মানববাদী এবং হেডেনিউস পুরস্কারপ্রাপ্ত একজন বিখ্যাত লোকের সঙ্গে দেখা হল, তিনি বিওর্ন উলভায়াস। সুইডেনের বিখ্যাত গানের দল আবা’র গায়ক, চারজনের একজন। ১৯৭২ থেকে ১৯৮২- মাত্র দশ বছর টিকে ছিলো আবা, অথচ বিশ্বব্যাপী কী ভীষণই না জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। আবা ভেঙে যাওয়ার বিওন আর বেনি এণ্ডারসন, দলের আরেক গায়ক, গান টান গাইতেন। ভালই করতেন, কিন্তু আবার জনপ্রিয়তার সামনে ও কিছুই না। আবা আবার নতুন করে জেগে উঠেছে, মিউরিয়ালস ওয়েডিং, দ্য কুইন অব দ্য ডেসার্ট, অ্যাডভেঞ্চার অব প্রিসিলা, মামা মিয়া- এসব চলচ্চিত্র নির্মাণ হওয়ার পর। এসবে আবা’র গানগুলো আবার নতুন করে শুনছে মানুষ। বিওর্নের সঙ্গে জাপানিজ খাবার খেলাম সে রাতে। আমাদের সঙ্গে ছিলেন আমেরিকার মানববাদী লেখক রেবেকা গোল্ডস্টাইন। আরও দুতিনজন মানববাদী ব্রিটিশ এবং সুইডিশ। ডিনার খেতে খেতেই বিওর্নের সঙ্গে অনেক কথা হয়। আবা’র কথা একটিও নয়, যা বলেছি সবই মানববাদের কথা। তিনি মুক্তচিন্তার মানুষ, ধর্মে তার বিশ্বাস নেই। ফ্রিতাংকে নামে তাঁর একটা মুক্তচিন্তার প্রকাশনী সংস্থা আছে। ওখান থেকে এর মধ্যেই সুইডিশ ভাষায় প্রচুর মুক্তচিন্তকের বই বেরিয়েছে। বলবো না প্রকাশনীটি খুব লাভজনক। নাস্তিকতা, মানববাদ, বিজ্ঞানের ওপর লেখা বেশি লোকে পড়ে না। একটা দেশে যদি পঁচাশি ভাগ লোক নাস্তিক হয়, তবে বিজ্ঞানের বই পাঠ করার সংখ্যা কম হলেও কিন্তু খুব কম নয়। বিওর্নের সঙ্গে যখন কথা বলছিলাম, ভাবছিলাম, এই ভয়ংকর জনপ্রিয় মানুষটা কোনও দ্বিধা করেননি জানাতে যে তিনি নাস্তিক। সাধারণত জনপ্রিয়রা বা উঁচুতলার নামী লোকেরা সমাজের কাঠামো ধরে নাড়া দিতে চান না। তাঁরা ধর্ম আর পিতৃতন্ত্রের অনুরাগী সেবক হিসেবেই চিহ্নিত হতে চান সারা জীবন। বিতর্ক এড়িয়ে চলতে চান। সবাই কি আর জন লেনন বা মন্টি পাইথন হতে পারে! সবাই কি আর বিওর্ন উলভায়াস?

মানবাধিকারের আর নারীর অধিকারের জন্য পৃথিবীর সর্বোত্তম দেশ সুইডেন। এ দেশে নারী বলুন, নাস্তিক বলুন, সমকামী বলুন, লিঙ্গান্তরিত বলুন, কালো বলুন,বাদামী বলুন- দেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতায় আসায় কোনও বাধা নেই। অন্য অনেক দেশে যত ছুৎমার্গ আছে, তত ছুৎমার্গ সুইডেনে নেই। সুইডেনে আমি থাকি না বটে, তবে সুইডেন নিয়ে আমার গৌরব হয়। আমার দেশটি কি কখনও সুইডেনের মতো হতে পারবে? হয়তো, তবে জানি, আমি আপনি কেউ বেঁচে থাকতে নয়। হাজার বছর পর হলেও দেশটি সভ্য হয়েছে — আমি এই স্বপ্নটি দেখি।

সকল অধ্যায়

১. লিঙ্গসূত্র
২. যৌবনে ছেলেরা ডেয়ারিং
৩. পতিতা প্রথা বন্ধ হোক
৪. অপ্রত্যাশিত
৫. বিয়ের প্রয়োজনীয়তা আদৌ আছে কি?
৬. পুরুষ নিয়ে মেয়েদের কাড়াকাড়ি বাড়াবাড়ি
৭. নারীর যৌন কামনা থাকতে নেই
৮. দেশ আর দেশ নেই
৯. আমার গৌরব, আমি স্বেচ্ছাচারী
১০. ধর্মে নেই, উৎসবে আছি
১১. বেলা যায় মেলা যায়
১২. তোমাকে অভিবাদন, এলফ্রিডা
১৩. যাই বল নইপল
১৪. আমার দেহ নিয়ে আমি যা খুশি করব
১৫. বাবা
১৬. সেক্সবয় (গল্প)
১৭. সকল গৃহ হারালো যার
১৮. অন্ধকার আমাকে গ্রাস করতে থাকে
১৯. মেয়েদের শরীর পুরুষের চোখে
২০. পৃথিবীর প্রাচীনতম নির্যাতন
২১. পেছনের দিনগুলো ধুসর ধুসর
২২. খারাপ মেয়ের গল্প (গল্প)
২৩. হুমায়ূন : পুরুষতন্ত্রের সম্রাট
২৪. তুই নিষিদ্ধ তুই কথা কইস না
২৫. অনুমতি না নিয়ে আমার শরীর স্পর্শ করেছিলেন সুনীল
২৬. পৃথিবীর পথে
২৭. পৃথিবীর পথে ২
২৮. মিডিয়া এবং মানুষ
২৯. নারীবিদ্বেষের কারণ পুরুষতন্ত্র
৩০. সন্ত্রাস
৩১. বিহারি সমস্যা
৩২. রঘু রাই এবং শরণার্থী
৩৩. এ লড়াই প্রাচ্যের সঙ্গে পাশ্চাত্যের নয়
৩৪. বেড়ালের গল্প
৩৫. ফিলিস্তিন এক টুকরো মাটির নাম
৩৬. পর্নোগ্রাফি
৩৭. সেইসব ঈদ
৩৮. কামড়ে খামচে মেয়েদের ‘আদর’ করছে পুরুষেরা
৩৯. সুন্দরী
৪০. ধর্ম থাকবে, নারীর অধিকারও থাকবে, এটা হয় না
৪১. সানেরার মতো মেয়ে চাই- আছে?
৪২. প্রতিবেশি দেশ
৪৩. বামপন্থীদের ভুল
৪৪. বাঙালির বোরখা
৪৫. শাড়ি ব্লাউজ
৪৬. বিয়ের বয়স
৪৭. সেইসব ঈদ
৪৮. ন্যাড়া কি বেলতলা যায়
৪৯. লতিফ সিদ্দিকী এবং মানুষের ধর্মানুভূতি
৫০. বাকস্বাধীনতার অর্থ কি এতটাই কঠিন?
৫১. কেন পারি না
৫২. নাবালিকা ধর্ষণ
৫৩. রেলমন্ত্রীর বয়স এবং বিয়ে
৫৪. চুমু চুমু চুমু চুমু
৫৫. এত ঘৃণা করে ওরা মেয়েদের!
৫৬. সুমন চট্টোপাধ্যায় থেকে কবির সুমন
৫৭. তারপর কী হলো
৫৮. কিছু প্রশ্ন। কিছু উত্তর।
৫৯. দূর থেকে হয় না
৬০. আরীব মজিদরা জেলের বাইরে থাকলে আমরা অনেকেই নিরাপদ নই
৬১. এতদিনে ভারতে সভ্য আইন
৬২. বোয়াল মাছের গল্প
৬৩. মেয়ে বলে ‘কম মানুষ’ নই
৬৪. উপন্যাস : ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে
৬৫. প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটি ব্যক্তিগত চিঠি
৬৬. ধর্মান্তরণ
৬৭. গণধর্ষণ
৬৮. নির্বাসিত একটি ছবির নাম
৬৯. শার্লি আবদো
৭০. কল্পনার রাজ্য
৭১. কোকো, খালেদা আর দেশের দগ্ধ সন্তানেরা
৭২. গরিবের গ্রেনেড
৭৩. বাংলা একাডেমির অসভ্যতা
৭৪. অভিজিৎকে যেভাবে চিনি
৭৫. নারী দিবস
৭৬. বাঘ আর বেড়াল
৭৭. বাংলাদেশিদের দেশপ্রেম
৭৮. বাক স্বাধীনতা
৭৯. স্যানিটারি প্যাডে প্রতিবাদ
৮০. বাংলাদেশের কী কী করা উচিত ছিল এবং ছিল না
৮১. বাংলা সংস্কৃতি চলবে কী চলবে না
৮২. ঢাকাও কমাতে পারে জ্যাম আর দূষণ
৮৩. গ্যালিলিও এবং তার ‘জারজ মেয়ে’
৮৪. লজ্জাহীনতা
৮৫. প্রচলিত নারীবিদ্বেষী শব্দ ও প্রবাদ
৮৬. নিজের গোলা শূন্য
৮৭. শৃংখল ভেঙেছি আমি
৮৮. দেশপ্রেম না থাকাও মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার
৮৯. ঢাকার বইমেলা ও একটি প্রেমের গল্প
৯০. খুব কাছে ওত পেতে আছে আততায়ী
৯১. নারী দিবস
৯২. ভারত এবং গরু
৯৩. আমার প্রথম সংসার
৯৪. খাজুরাহোর অভিজ্ঞতা
৯৫. চীনের অভিজ্ঞতা
৯৬. আমার জন্য কথা বলার কেউ নেই…
৯৭. সমাজ কি থেমে আছে?
৯৮. পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ
৯৯. কিছু প্রশ্ন, কিছু আশা
১০০. এই বাংলাদেশ আমার অচেনা
১০১. দেশের ভবিষ্যৎ
১০২. রোজা রাখার স্বাধীনতা
১০৩. চারদিকে প্রচুর ওমর মতিন
১০৪. আমার চোখের জলের ঈদ
১০৫. যদি পুরুষ হতাম
১০৬. জাকির নায়েকের বাকস্বাধীনতা
১০৭. কিছু সেলিব্রিটি মেয়ে তো ফাটাফাটি
১০৮. বিরুদ্ধ স্রোত
১০৯. মেয়েরা সেরা
১১০. মেয়েদের কাপড় চোপড়
১১১. মেয়েদের কাপড় চোপড়
১১২. সত্য বললে বিপদ
১১৩. আমরা আর তারা
১১৪. এরা কি মানুষ!
১১৫. লজ্জা বইটি এখনও নিষিদ্ধ কেন?
১১৬. বায়ু দূষণ
১১৭. সাঁওতালদের কথা
১১৮. হাতে টাকা নেই
১১৯. শিশুদের জন্য লোভের জিভ
১২০. যৌনকর্ম নাম দিয়ে পতিতাবৃত্তিকে বৈধ করার ষড়যন্ত্র
১২১. বুদ্ধিজীবী দিবস
১২২. সন্ত্রাস কোনো সমস্যার সমাধান নয়
১২৩. বাংলা একাডেমির হয়েছেটা কী
১২৪. যে বই তোমায় দেখায় ভয়, সে বইও পড়া উচিত
১২৫. পাঠ্যপুস্তকের পরিবর্তন
১২৬. দঙ্গলের মেয়ে
১২৭. নিষিদ্ধের তো একটা সীমা আছে
১২৮. ভারতে অসহিষ্ণুতা
১২৯. মেয়েদের পোশাক নিয়ে লোকের এত মাথাব্যথা কেন?
১৩০. ভ্যালেন্টাইন ডে’র ভাবনা
১৩১. উদারতার চেয়ে মহান কিছু নেই
১৩২. নারীবাদী হওয়া সহজ নয়
১৩৩. নেপাল থেকে বলছি
১৩৪. বাংলাদেশ বদলে গেছে
১৩৫. কেন আত্মঘাতী বোমারু হতে ইচ্ছে করে
১৩৬. অপুরা যেন হেরে না যায়
১৩৭. শেখ হাসিনার জন্য দুশ্চিন্তা
১৩৮. ওরা কেন আমাদের চেয়েও ভালো
১৩৯. ধর্ষকদের পৃথিবীতে বেঁচে যে আছি, এই তো অনেক
১৪০. চাই ধর্ষণহীন দিন
১৪১. আমার গ্রিন কার্ড, আমেরিকার ট্রাম্প কার্ড

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন