উদারতার চেয়ে মহান কিছু নেই

তসলিমা নাসরিন

সেদিন বলেছিলাম, হিন্দুরা হিন্দুদের পক্ষে কথা বলছে, মুসলমানরা মুসলমানদের পক্ষে কথা বলছে। কত ভালোই না হতো যদি হিন্দুরা মুসলমানদের পক্ষে কথা বলতো, আর মুসলমান হিন্দুদের পক্ষে কথা বলতো।

নুরিত পেলেড-এলহানান একজন ইহুদি।   জেরুজালেমের হিব্রু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষা-শিক্ষার শিক্ষক। আমার মতোই তিনি ইউরোপীয় সংসদ থেকে মুক্তচিন্তার জন্য সাখারভ পুরস্কার পেয়েছেন। নুরিত পেলেডের সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ কথা হয়েছে। তিনি তাঁর সংগ্রামের কথা যখন বলেছেন, আমি বিস্ময়ে বিমূঢ় বসেছিলাম। নুরিতের মেয়ে স্মাদার ১৩ বছর বয়সে ১৯৯৭ সালে ফিলিস্তিনি আত্মঘাতী বোমায় জেরুজালেমের রাস্তায় নিহত হয়। নুরিত ইজরাইলি হয়েও, ইহুদি হয়েও, ফিলিস্তিনিদের মানবাধিকারের জন্য লড়ছেন। তিনি এক জিওনিস্ট পরিবারের মেয়ে। তাঁর ঠাকুরদা ইজরাইলের স্বাধীনতা ঘোষণায় অংশগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর বাবা মাটিনিয়াহু পেলেড ছিলেন ইজরাইলের মেজর জেনারেল। নুরিতের মতো নুরিতের ভাই মিকো পেলেডও ফিলিস্তিনিদের মানবাধিকারের জন্য লড়ছেন।

নুরিত তাঁর ‘Palestine in Israeli Books : Ideology and Propaganda in Education’ বইটিতে লিখেছেন ইজরাইলের ইস্কুল-বইয়ে আরবদের সম্পর্কে লেখা হয় তারা বর্ণবাদী। লেখা হয়, ‘আরবরা মূলত শরণার্থী, সন্ত্রাসী আর আদ্দিকালের কৃষক’। অনেকে অবশ্য নুরিতের এই দাবি মানেন না। ইজরাইলি লেখক এবি ইয়েহোশুয়া বলেছিলেন আরব আর ইহুদিদের মধ্যে সাংস্কৃতিক দূরত্ব এত বেশি যে ওরা কখনও একসঙ্গে বাস করতে পারবে না। নুরিত এ কথা মানেননি। ইউরোপীয় সংসদে দেওয়া নুরিতের বক্তৃতা আমি শুনেছি, ইজরাইলের মাটিতে ফিলিস্তিনি শরণার্থী আর ফিলিস্তিনি বন্দিদের ওপর যে কী পরিমাণ নির্যাতন হয়— তা বর্ণনা করেছেন। প্রতিকার চেয়েছেন। ইজরাইলি বর্বরতার বিরুদ্ধে সকলকে রুখে দাঁড়াতে বলেছেন। নুরিতকে আমি বলেছি, ‘ফিলিস্তিনি আত্মঘাতী হামলায় নিহত হয়েছে তোমার মেয়ে, তারপরও তুমি ফিলিস্তিনিদের মানবাধিকারের জন্য দিনরাত খেটে চলেছ, ইজরাইলি শাসকের বর্বরতার বিরুদ্ধে তুমি। তোমাকে নমস্কার’। নুরিত সস্নেহে বলেছিলেন, ‘সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের মানুষ হয়েও সংখ্যালঘুদের পাশে তুমিও তো দাঁড়িয়েছো। তুমিও তো লিখেছো ‘লজ্জা’ নামের বই। আমরা আসলে একই কাজ করছি, যে কাজ পৃথিবীকে আমাদের সবার বাসযোগ্য করার জন্য খুব জরুরি।

কিছু দিন আগে ভারতের গুরমেহার কাউর নামে ২০ বছর বয়সী এক মেয়ে তার এক ভিডিও প্রকাশ করেছে সোশাল মিডিয়ায়। এটি নিয়ে ভারত এখন উত্তাল। মেয়েটির বাবা মানদীপ সিং ১৯৯৯ সালে কাশ্মীরের মিলিটারি ক্যাম্পে পাকিস্তানি সন্ত্রাসী হামলায় নিহত হন। গুরমেহারের তখন ২ বছর বয়স। গুরমেহার বলছে, তার বাবাকে পাকিস্তান মারেনি, মেরেছে যুদ্ধ। বলেছে যদি ভারত আর পাকিস্তানের মধ্যে কোনও যুদ্ধ না থাকতো, তাহলে তার বাবাকে মরতে হতো না। গুরমেহার যুদ্ধ চায় না, শান্তি চায়। চায়, পাকিস্তান আর ভারতের মধ্যে যত কলহ কোন্দল আছে, সব ঘুচে যাক, প্রতিষ্ঠা হোক শান্তি। গুরমেহার এরপর তার কলেজের উগ্র জাতীয়তাবাদী ছাত্রদের কাছ থেকে অকথ্য ভাষায় গালাগালি তো আছেই, ধর্ষণের হুমকিও পেয়েছে। গুরমেহারকে সবাই আশা করেছিল ভীষণ পাকিস্তান-বিরোধী এক মেয়ে হবে সে। পাকিস্তানকে ঘৃণা করবে। উল্টে মেয়ে হয়ে উঠেছে উদার এবং সহিষ্ণু। যে পাকিস্তান সন্ত্রাসী পাঠিয়ে তার বাবাকে হত্যা করেছে, সেই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তার কোনও ক্ষোভ নেই। হত্যার প্রতিশোধ সকলে নিতে চায়। প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য চারদিক থেকে প্রেরণা আসে। সমাজে হিংসে, ঘৃণা এসব খুব সহজ এবং স্বাভাবিক। প্রতিশোধ না নিয়ে, ঘৃণা না ছড়িয়ে, হিংসেয় উন্মত্ত না হয়ে আমি যদি সভ্য উপায়ে সমস্যা সমাধানের জন্য বলি, আমি যদি শান্তির কথা বলি, আমি যদি সহনশীলতা আর সহমর্মিতার কথা বলি— তাহলে আমি কোনও না কোনওভাবে জাতীয়তাবাদবিরোধী, দেশদ্রোহী! এমনিতো হচ্ছে। গুরমেহারকেও ভারতবিরোধী বলা হয়েছে, নুরিতকেও বলা হয় দেশদ্রোহী, আমাকে তো বলাই হয়। দেশের ভালো যারাই করতে যায়, তাদেরই দেশদ্রোহী বলে আখ্যা দেওয়া হয়। আখ্যা দেয় তারাই, যারা ভায়োলেন্সে বিশ্বাস করে, যারা রক্তপাতে আর মৃত্যুতে বিশ্বাস করে।

কত যে অমসৃণ পথে হাঁটতে হয় আমাদের। কত কিছু থেকে যে বঞ্চিত হতে হয়।   কিন্তু তারপরও আমরা যেখানে আছি, সেখানে থাকবো বলে ঠিক করেছি। ঘৃণা কখনও কোনও সমস্যার সমাধান হতে পারে না। ভালোবাসাই দিতে পারে মুক্তি, উদারতাই আনতে পারে শান্তি।

সোর্স : বাংলাদেশ প্রতিদিন, ০২ মার্চ, ২০১৭

সকল অধ্যায়

১. লিঙ্গসূত্র
২. যৌবনে ছেলেরা ডেয়ারিং
৩. পতিতা প্রথা বন্ধ হোক
৪. অপ্রত্যাশিত
৫. বিয়ের প্রয়োজনীয়তা আদৌ আছে কি?
৬. পুরুষ নিয়ে মেয়েদের কাড়াকাড়ি বাড়াবাড়ি
৭. নারীর যৌন কামনা থাকতে নেই
৮. দেশ আর দেশ নেই
৯. আমার গৌরব, আমি স্বেচ্ছাচারী
১০. ধর্মে নেই, উৎসবে আছি
১১. বেলা যায় মেলা যায়
১২. তোমাকে অভিবাদন, এলফ্রিডা
১৩. যাই বল নইপল
১৪. আমার দেহ নিয়ে আমি যা খুশি করব
১৫. বাবা
১৬. সেক্সবয় (গল্প)
১৭. সকল গৃহ হারালো যার
১৮. অন্ধকার আমাকে গ্রাস করতে থাকে
১৯. মেয়েদের শরীর পুরুষের চোখে
২০. পৃথিবীর প্রাচীনতম নির্যাতন
২১. পেছনের দিনগুলো ধুসর ধুসর
২২. খারাপ মেয়ের গল্প (গল্প)
২৩. হুমায়ূন : পুরুষতন্ত্রের সম্রাট
২৪. তুই নিষিদ্ধ তুই কথা কইস না
২৫. অনুমতি না নিয়ে আমার শরীর স্পর্শ করেছিলেন সুনীল
২৬. পৃথিবীর পথে
২৭. পৃথিবীর পথে ২
২৮. মিডিয়া এবং মানুষ
২৯. নারীবিদ্বেষের কারণ পুরুষতন্ত্র
৩০. সন্ত্রাস
৩১. বিহারি সমস্যা
৩২. রঘু রাই এবং শরণার্থী
৩৩. এ লড়াই প্রাচ্যের সঙ্গে পাশ্চাত্যের নয়
৩৪. বেড়ালের গল্প
৩৫. ফিলিস্তিন এক টুকরো মাটির নাম
৩৬. পর্নোগ্রাফি
৩৭. সেইসব ঈদ
৩৮. কামড়ে খামচে মেয়েদের ‘আদর’ করছে পুরুষেরা
৩৯. সুন্দরী
৪০. ধর্ম থাকবে, নারীর অধিকারও থাকবে, এটা হয় না
৪১. সানেরার মতো মেয়ে চাই- আছে?
৪২. প্রতিবেশি দেশ
৪৩. বামপন্থীদের ভুল
৪৪. বাঙালির বোরখা
৪৫. শাড়ি ব্লাউজ
৪৬. বিয়ের বয়স
৪৭. সেইসব ঈদ
৪৮. ন্যাড়া কি বেলতলা যায়
৪৯. লতিফ সিদ্দিকী এবং মানুষের ধর্মানুভূতি
৫০. বাকস্বাধীনতার অর্থ কি এতটাই কঠিন?
৫১. কেন পারি না
৫২. নাবালিকা ধর্ষণ
৫৩. রেলমন্ত্রীর বয়স এবং বিয়ে
৫৪. চুমু চুমু চুমু চুমু
৫৫. এত ঘৃণা করে ওরা মেয়েদের!
৫৬. সুমন চট্টোপাধ্যায় থেকে কবির সুমন
৫৭. তারপর কী হলো
৫৮. কিছু প্রশ্ন। কিছু উত্তর।
৫৯. দূর থেকে হয় না
৬০. আরীব মজিদরা জেলের বাইরে থাকলে আমরা অনেকেই নিরাপদ নই
৬১. এতদিনে ভারতে সভ্য আইন
৬২. বোয়াল মাছের গল্প
৬৩. মেয়ে বলে ‘কম মানুষ’ নই
৬৪. উপন্যাস : ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে
৬৫. প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটি ব্যক্তিগত চিঠি
৬৬. ধর্মান্তরণ
৬৭. গণধর্ষণ
৬৮. নির্বাসিত একটি ছবির নাম
৬৯. শার্লি আবদো
৭০. কল্পনার রাজ্য
৭১. কোকো, খালেদা আর দেশের দগ্ধ সন্তানেরা
৭২. গরিবের গ্রেনেড
৭৩. বাংলা একাডেমির অসভ্যতা
৭৪. অভিজিৎকে যেভাবে চিনি
৭৫. নারী দিবস
৭৬. বাঘ আর বেড়াল
৭৭. বাংলাদেশিদের দেশপ্রেম
৭৮. বাক স্বাধীনতা
৭৯. স্যানিটারি প্যাডে প্রতিবাদ
৮০. বাংলাদেশের কী কী করা উচিত ছিল এবং ছিল না
৮১. বাংলা সংস্কৃতি চলবে কী চলবে না
৮২. ঢাকাও কমাতে পারে জ্যাম আর দূষণ
৮৩. গ্যালিলিও এবং তার ‘জারজ মেয়ে’
৮৪. লজ্জাহীনতা
৮৫. প্রচলিত নারীবিদ্বেষী শব্দ ও প্রবাদ
৮৬. নিজের গোলা শূন্য
৮৭. শৃংখল ভেঙেছি আমি
৮৮. দেশপ্রেম না থাকাও মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার
৮৯. ঢাকার বইমেলা ও একটি প্রেমের গল্প
৯০. খুব কাছে ওত পেতে আছে আততায়ী
৯১. নারী দিবস
৯২. ভারত এবং গরু
৯৩. আমার প্রথম সংসার
৯৪. খাজুরাহোর অভিজ্ঞতা
৯৫. চীনের অভিজ্ঞতা
৯৬. আমার জন্য কথা বলার কেউ নেই…
৯৭. সমাজ কি থেমে আছে?
৯৮. পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ
৯৯. কিছু প্রশ্ন, কিছু আশা
১০০. এই বাংলাদেশ আমার অচেনা
১০১. দেশের ভবিষ্যৎ
১০২. রোজা রাখার স্বাধীনতা
১০৩. চারদিকে প্রচুর ওমর মতিন
১০৪. আমার চোখের জলের ঈদ
১০৫. যদি পুরুষ হতাম
১০৬. জাকির নায়েকের বাকস্বাধীনতা
১০৭. কিছু সেলিব্রিটি মেয়ে তো ফাটাফাটি
১০৮. বিরুদ্ধ স্রোত
১০৯. মেয়েরা সেরা
১১০. মেয়েদের কাপড় চোপড়
১১১. মেয়েদের কাপড় চোপড়
১১২. সত্য বললে বিপদ
১১৩. আমরা আর তারা
১১৪. এরা কি মানুষ!
১১৫. লজ্জা বইটি এখনও নিষিদ্ধ কেন?
১১৬. বায়ু দূষণ
১১৭. সাঁওতালদের কথা
১১৮. হাতে টাকা নেই
১১৯. শিশুদের জন্য লোভের জিভ
১২০. যৌনকর্ম নাম দিয়ে পতিতাবৃত্তিকে বৈধ করার ষড়যন্ত্র
১২১. বুদ্ধিজীবী দিবস
১২২. সন্ত্রাস কোনো সমস্যার সমাধান নয়
১২৩. বাংলা একাডেমির হয়েছেটা কী
১২৪. যে বই তোমায় দেখায় ভয়, সে বইও পড়া উচিত
১২৫. পাঠ্যপুস্তকের পরিবর্তন
১২৬. দঙ্গলের মেয়ে
১২৭. নিষিদ্ধের তো একটা সীমা আছে
১২৮. ভারতে অসহিষ্ণুতা
১২৯. মেয়েদের পোশাক নিয়ে লোকের এত মাথাব্যথা কেন?
১৩০. ভ্যালেন্টাইন ডে’র ভাবনা
১৩১. উদারতার চেয়ে মহান কিছু নেই
১৩২. নারীবাদী হওয়া সহজ নয়
১৩৩. নেপাল থেকে বলছি
১৩৪. বাংলাদেশ বদলে গেছে
১৩৫. কেন আত্মঘাতী বোমারু হতে ইচ্ছে করে
১৩৬. অপুরা যেন হেরে না যায়
১৩৭. শেখ হাসিনার জন্য দুশ্চিন্তা
১৩৮. ওরা কেন আমাদের চেয়েও ভালো
১৩৯. ধর্ষকদের পৃথিবীতে বেঁচে যে আছি, এই তো অনেক
১৪০. চাই ধর্ষণহীন দিন
১৪১. আমার গ্রিন কার্ড, আমেরিকার ট্রাম্প কার্ড

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন