ওরা কেন আমাদের চেয়েও ভালো

তসলিমা নাসরিন

পাকিস্তান তো আছেই, মালদ্বীপও বাংলাদেশ দ্বারা সংক্রামিত। ওখানেও মুক্তচিন্তক ব্লগারদের হত্যা করা হয়। পাকিস্তানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মাশাল খানকে খুন করেছে একপাল ধর্মান্ধ। মালদ্বীপেও একই ঘটনা, ব্লগার ইয়ামিন রশিদকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে।

তবে বাংলাদেশের যে বদ হাওয়াটা এখনো পাকিস্তানে আর মালদ্বীপে পৌঁছায়নি, তা হলো চুপ করে থাকা, মেনে নেওয়া, ব্লগারদের মৃত্যুর জন্য ব্লগারদের দোষ দেওয়া। মালদ্বীপেও ব্লগার হত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয়েছে, পাকিস্তানেও হয়েছে। প্রতিবাদ শুধু বুদ্ধিজীবীরাই করেননি, রাজনীতিকরাও করেছেন।

মাশাল খানের হত্যাকাণ্ড ভিডিওতে দেখার পর হাজারো মানুষ পথে নেমে প্রতিবাদ করেছেন। এমনকি দেশের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফও প্রতিবাদে মুখর হয়েছেন। দু’দিনের মধ্যেই ৮ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে, ১২ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। হাজারো মানুষ মালদ্বীপেও প্রতিবাদ করেছেন। ইয়ামিন রশিদকে হত্যার বিরুদ্ধে প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ নাশিদ লিখেছেন, ‘একটা সাহসী কণ্ঠস্বরকে নৃশংসভাবে স্তব্ধ করে দেওয়া হলো। আন্তর্জাতিক দক্ষদের উপস্থিতিতে কোনরকম পক্ষপাতহীন নিরপেক্ষ তদন্তই একমাত্র ইয়ামিনের সুবিচার পাওয়ার ব্যবস্থা করতে পারে। ’ মুসলিম হয়েও  ইসলামি সন্ত্রাসী বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে কারও অসুবিধে হয়নি মালদ্বীপে।

কিন্তু বাংলাদেশে অভিজিৎ রায় থেকে শুরু করে জুলহাজ মান্নানসহ প্রতিভাবান লেখক সাহিত্যিক ব্লগার অ্যাক্টিভিস্টদের যে কুপিয়ে মারা হলো, এর বিরুদ্ধে পাকিস্তান বা মালদ্বীপের মতো হাজারো মানুষকে পথে নামতে কিন্তু দেখিনি। বরং ওঁরা কোথায় কী লিখেছেন, তা খতিয়ে দেখা হবে বলে সরকার শাসিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী হাসিনাও ব্লগারদের পাশে দাঁড়াননি। তিনি বলেছেন, তিনিও মুসলমান, ইসলামের বিরুদ্ধে লিখলে তার অনুভূতিতেও আঘাত লাগে। এরকম কথা পাকিস্তানের বা মালদ্বীপের কোনও প্রধানমন্ত্রী বা প্রেসিডেন্ট বলেননি। দেখে শুনে তো মনে হয় বাংলাদেশ ওসব দেশ থেকে অনেক বেশি পিছিয়ে আছে। ওসব দেশে দেশজুড়ে খুনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয়, বাংলাদেশে হয় না। বাংলাদেশে প্রতিবাদ না হওয়ার কারণ দুটো, এক দল ভয় পায়, মৌলবাদীদের হাতে যদি হেনস্থা হতে হয়, আরেক দল বিশ্বাস করে, কোনো মুসলমানের অধিকার নেই  ইসলামের সমালোচনা করার, সুতরাং মরেছে বেশ হয়েছে।

পাকিস্তান একটি মৌলবাদী দেশ হিসেবে চিহ্নিত। মালদ্বীপও শরিয়া আইনে বিশ্বাস করা খাঁটি মুসলমানের দেশ। ওই দুটো দেশের সরকারপ্রধান থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষও যদি গণতন্ত্রে এবং বাক স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে, তবে বাংলাদেশের মানুষের এ দুটোয় বিশ্বাস করতে অসুবিধে হচ্ছে কেন? বাংলাদেশ তো জন্মেছেই ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হিসেবে। পাকিস্তানের মতো মৌলবাদী দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে জয়ী হয়েছে। বাংলাদেশ কি এমনই একটি মৌলবাদী দেশ হিসেবে এখন চিহ্নিত হতে চাইছে, যে দেশ পাকিস্তানের চেয়েও বেশি মৌলবাদী? মালদ্বীপের চেয়েও বেশি অনাধুনিক?

এই কি আমার ফেলে আসা বাংলাদেশ? যে বাংলাদেশে নিজের চোখে দেখেছি ’৬৯-এর গণ আন্দোলন, একাত্তরের যুদ্ধ? একটি সেকুলার বাংলাদেশ গড়বো বলে মৌলবাদী পাকিস্তান থেকে আমরা নিজেদের সরিয়ে নিয়েছি, সেই পাকিস্তানের চেয়েও বেশি ধর্মান্ধ হয়েছি মাত্র কয়েক দশকে। আজ মানুষকে ধর্ম সম্পর্কে শুধু ভিন্নমত থাকার অপরাধে খুন হয়ে যেতে হচ্ছে। আজ ধর্মই বড় পরিচয় হয়ে উঠেছে সবার, শিক্ষা আর সংস্কৃতি হয়ে উঠেছে গৌণ।

সন্ত্রাসী, মৌলবাদী অনেক দেশেই আছে। ধর্ম থাকলে মৌলবাদ থাকেই। মৌলবাদ থাকলে সন্ত্রাসের জন্ম হতেই পারে। কিন্তু বাক স্বাধীনতার জন্য বা মত প্রকাশের অধিকারের জন্য সরকারকে সরব হতে হয়। দেশের রাজনীতিকদের, শিল্পী সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবীদেরও সরব হতে হয়, যেহেতু গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন তারা। মৌলবাদী বা সন্ত্রাসীদের উপস্থিতি সমাজে থাকলে সমাজ নষ্ট হয় না। সমাজ নষ্ট হয়েছে তখনই বুঝবো, যখন মানুষকে তার ভিন্নমতের জন্য সন্ত্রাসীরা কুপিয়ে মারলেও সরকার চুপ থাকে, বুদ্ধিজীবীরা চুপ থাকে, কবি সাহিত্যিকরা চুপ থাকে। বাংলাদেশের শিক্ষা নেওয়া উচিত পাকিস্তানের কাছ থেকে। পাকিস্তানের সরকার, বিরোধী দল, বুদ্ধিজীবী সকলে প্রতিবাদে ফেটে পড়েছেন মাশাল খানের হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে। মাশাল খান  ধর্মের সমালোচনা করতেন, এ কথা জানার পরও কিন্তু সন্ত্রাসী ছাড়া আর কেউ মনে করেননি তাকে খুন করা মোটেও উচিত হয়েছে।

আজ যদি বাংলাদেশ না হয়ে দেশটি পূর্ব পাকিস্তান থাকতো, তাহলে আমি নিশ্চিত দেশজুড়ে ব্লগার  হত্যার প্রতিবাদ হতো। ধর্মান্ধতাকে সরিয়ে আমরা আসলে দ্বিগুণ ধর্মান্ধ হয়েছি। অত্যাচারী  বৃটিশদের তাড়িয়ে নিজেরাই যেমন নিজেদের শোষণ করছি, নিজেরাই নিজেদের বিরুদ্ধে আরো বড় অত্যাচারী হয়েছি।

জুলহাজ মান্নান আর তার বন্ধুর মৃত্যুর এক বছর পূর্ণ হলো, অথচ সারা দেশ চুপ। যেন কিছুই ঘটেনি এক বছর আগে। মৌলবাদ এবং সন্ত্রাসবিরোধী মানুষ যদি এখনও একজোট না হয়, তবে দেশ ছেয়ে যাবে সন্ত্রাসীতে। দেশ ছেয়ে যাবে আপসকামীতে। দেশকে বাঁচাতে হলে এখনও সময় আছে দেশের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ যেন দেশের শত্রুদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। দেশের শত্রু এখন দেশের বাইরে থেকে আসে না, দেশের ভেতরেই তাদের বসবাস। এখনও সময় আছে দেশটিকে যেন সবচেয়ে নিকৃষ্ট ব্লগার হত্যার দেশ হিসেবে চিহ্নিত না হতে দিয়ে, সবচেয়ে উত্কৃষ্ট প্রতিবাদের দেশ হিসেবে চিহ্নিত করতে পারি। সেই প্রতিবাদী বাংলাদেশ নিয়ে আমি গর্ব করতে চাই।

সোর্স : বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২৭ এপ্রিল, ২০১৭

সকল অধ্যায়

১. লিঙ্গসূত্র
২. যৌবনে ছেলেরা ডেয়ারিং
৩. পতিতা প্রথা বন্ধ হোক
৪. অপ্রত্যাশিত
৫. বিয়ের প্রয়োজনীয়তা আদৌ আছে কি?
৬. পুরুষ নিয়ে মেয়েদের কাড়াকাড়ি বাড়াবাড়ি
৭. নারীর যৌন কামনা থাকতে নেই
৮. দেশ আর দেশ নেই
৯. আমার গৌরব, আমি স্বেচ্ছাচারী
১০. ধর্মে নেই, উৎসবে আছি
১১. বেলা যায় মেলা যায়
১২. তোমাকে অভিবাদন, এলফ্রিডা
১৩. যাই বল নইপল
১৪. আমার দেহ নিয়ে আমি যা খুশি করব
১৫. বাবা
১৬. সেক্সবয় (গল্প)
১৭. সকল গৃহ হারালো যার
১৮. অন্ধকার আমাকে গ্রাস করতে থাকে
১৯. মেয়েদের শরীর পুরুষের চোখে
২০. পৃথিবীর প্রাচীনতম নির্যাতন
২১. পেছনের দিনগুলো ধুসর ধুসর
২২. খারাপ মেয়ের গল্প (গল্প)
২৩. হুমায়ূন : পুরুষতন্ত্রের সম্রাট
২৪. তুই নিষিদ্ধ তুই কথা কইস না
২৫. অনুমতি না নিয়ে আমার শরীর স্পর্শ করেছিলেন সুনীল
২৬. পৃথিবীর পথে
২৭. পৃথিবীর পথে ২
২৮. মিডিয়া এবং মানুষ
২৯. নারীবিদ্বেষের কারণ পুরুষতন্ত্র
৩০. সন্ত্রাস
৩১. বিহারি সমস্যা
৩২. রঘু রাই এবং শরণার্থী
৩৩. এ লড়াই প্রাচ্যের সঙ্গে পাশ্চাত্যের নয়
৩৪. বেড়ালের গল্প
৩৫. ফিলিস্তিন এক টুকরো মাটির নাম
৩৬. পর্নোগ্রাফি
৩৭. সেইসব ঈদ
৩৮. কামড়ে খামচে মেয়েদের ‘আদর’ করছে পুরুষেরা
৩৯. সুন্দরী
৪০. ধর্ম থাকবে, নারীর অধিকারও থাকবে, এটা হয় না
৪১. সানেরার মতো মেয়ে চাই- আছে?
৪২. প্রতিবেশি দেশ
৪৩. বামপন্থীদের ভুল
৪৪. বাঙালির বোরখা
৪৫. শাড়ি ব্লাউজ
৪৬. বিয়ের বয়স
৪৭. সেইসব ঈদ
৪৮. ন্যাড়া কি বেলতলা যায়
৪৯. লতিফ সিদ্দিকী এবং মানুষের ধর্মানুভূতি
৫০. বাকস্বাধীনতার অর্থ কি এতটাই কঠিন?
৫১. কেন পারি না
৫২. নাবালিকা ধর্ষণ
৫৩. রেলমন্ত্রীর বয়স এবং বিয়ে
৫৪. চুমু চুমু চুমু চুমু
৫৫. এত ঘৃণা করে ওরা মেয়েদের!
৫৬. সুমন চট্টোপাধ্যায় থেকে কবির সুমন
৫৭. তারপর কী হলো
৫৮. কিছু প্রশ্ন। কিছু উত্তর।
৫৯. দূর থেকে হয় না
৬০. আরীব মজিদরা জেলের বাইরে থাকলে আমরা অনেকেই নিরাপদ নই
৬১. এতদিনে ভারতে সভ্য আইন
৬২. বোয়াল মাছের গল্প
৬৩. মেয়ে বলে ‘কম মানুষ’ নই
৬৪. উপন্যাস : ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে
৬৫. প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটি ব্যক্তিগত চিঠি
৬৬. ধর্মান্তরণ
৬৭. গণধর্ষণ
৬৮. নির্বাসিত একটি ছবির নাম
৬৯. শার্লি আবদো
৭০. কল্পনার রাজ্য
৭১. কোকো, খালেদা আর দেশের দগ্ধ সন্তানেরা
৭২. গরিবের গ্রেনেড
৭৩. বাংলা একাডেমির অসভ্যতা
৭৪. অভিজিৎকে যেভাবে চিনি
৭৫. নারী দিবস
৭৬. বাঘ আর বেড়াল
৭৭. বাংলাদেশিদের দেশপ্রেম
৭৮. বাক স্বাধীনতা
৭৯. স্যানিটারি প্যাডে প্রতিবাদ
৮০. বাংলাদেশের কী কী করা উচিত ছিল এবং ছিল না
৮১. বাংলা সংস্কৃতি চলবে কী চলবে না
৮২. ঢাকাও কমাতে পারে জ্যাম আর দূষণ
৮৩. গ্যালিলিও এবং তার ‘জারজ মেয়ে’
৮৪. লজ্জাহীনতা
৮৫. প্রচলিত নারীবিদ্বেষী শব্দ ও প্রবাদ
৮৬. নিজের গোলা শূন্য
৮৭. শৃংখল ভেঙেছি আমি
৮৮. দেশপ্রেম না থাকাও মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার
৮৯. ঢাকার বইমেলা ও একটি প্রেমের গল্প
৯০. খুব কাছে ওত পেতে আছে আততায়ী
৯১. নারী দিবস
৯২. ভারত এবং গরু
৯৩. আমার প্রথম সংসার
৯৪. খাজুরাহোর অভিজ্ঞতা
৯৫. চীনের অভিজ্ঞতা
৯৬. আমার জন্য কথা বলার কেউ নেই…
৯৭. সমাজ কি থেমে আছে?
৯৮. পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ
৯৯. কিছু প্রশ্ন, কিছু আশা
১০০. এই বাংলাদেশ আমার অচেনা
১০১. দেশের ভবিষ্যৎ
১০২. রোজা রাখার স্বাধীনতা
১০৩. চারদিকে প্রচুর ওমর মতিন
১০৪. আমার চোখের জলের ঈদ
১০৫. যদি পুরুষ হতাম
১০৬. জাকির নায়েকের বাকস্বাধীনতা
১০৭. কিছু সেলিব্রিটি মেয়ে তো ফাটাফাটি
১০৮. বিরুদ্ধ স্রোত
১০৯. মেয়েরা সেরা
১১০. মেয়েদের কাপড় চোপড়
১১১. মেয়েদের কাপড় চোপড়
১১২. সত্য বললে বিপদ
১১৩. আমরা আর তারা
১১৪. এরা কি মানুষ!
১১৫. লজ্জা বইটি এখনও নিষিদ্ধ কেন?
১১৬. বায়ু দূষণ
১১৭. সাঁওতালদের কথা
১১৮. হাতে টাকা নেই
১১৯. শিশুদের জন্য লোভের জিভ
১২০. যৌনকর্ম নাম দিয়ে পতিতাবৃত্তিকে বৈধ করার ষড়যন্ত্র
১২১. বুদ্ধিজীবী দিবস
১২২. সন্ত্রাস কোনো সমস্যার সমাধান নয়
১২৩. বাংলা একাডেমির হয়েছেটা কী
১২৪. যে বই তোমায় দেখায় ভয়, সে বইও পড়া উচিত
১২৫. পাঠ্যপুস্তকের পরিবর্তন
১২৬. দঙ্গলের মেয়ে
১২৭. নিষিদ্ধের তো একটা সীমা আছে
১২৮. ভারতে অসহিষ্ণুতা
১২৯. মেয়েদের পোশাক নিয়ে লোকের এত মাথাব্যথা কেন?
১৩০. ভ্যালেন্টাইন ডে’র ভাবনা
১৩১. উদারতার চেয়ে মহান কিছু নেই
১৩২. নারীবাদী হওয়া সহজ নয়
১৩৩. নেপাল থেকে বলছি
১৩৪. বাংলাদেশ বদলে গেছে
১৩৫. কেন আত্মঘাতী বোমারু হতে ইচ্ছে করে
১৩৬. অপুরা যেন হেরে না যায়
১৩৭. শেখ হাসিনার জন্য দুশ্চিন্তা
১৩৮. ওরা কেন আমাদের চেয়েও ভালো
১৩৯. ধর্ষকদের পৃথিবীতে বেঁচে যে আছি, এই তো অনেক
১৪০. চাই ধর্ষণহীন দিন
১৪১. আমার গ্রিন কার্ড, আমেরিকার ট্রাম্প কার্ড

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন