নজ্জুমি কিতাব – ৫৫

পরদিন সকালে ম্যাডাম জুইয়ের সাইকিক সেন্টারে গিয়ে হাজির হলো শরৎ বাবু, দীনবন্ধু, আর আব্দুল খান। আগের চেয়ে অনেক ফ্রেশ দেখাচ্ছে ম্যাডামকে আজ। খানিকটা উত্তেজিতও। সোফায় বসতে না বসতেই আব্দুল খান ম্যাডাম জুইকে লক্ষ করে বলল, “এ জায়গা আপনার?”

“আজ্ঞে, হ্যাঁ।”

“ভারী অদ্ভুত জায়গা তো!”

“সাইকিক সেন্টার এমনই হয়। এখানে অদ্ভুতের কী দেখলেন?”

“না, এমনিই বললাম।”

“আগে কখনও কোনো সাইকিক আড্ডায় ঢোকেননি বোধ হয়,” ম্যাডাম জুইয়ের কণ্ঠে কৌতুক।

চা পরিবেশন করল কোমর অব্দি বিনুনিকরা চুলের ফর্সা টুকটুকে এক চীনে তরুণী। আগে একে কখনও দেখা যায়নি। নতুন আমদানি। “নিন চা খান,” নিজের কাপে চুমুক দিয়ে বলল ম্যাডাম জুই। “বুঝলেন শরৎ বাবু, হেনরির কবর থেকে যে ক্লু পাওয়া গেছে সেটা আবারও আমাদের টং অ্যাচিউয়ের সামনে খাড়া করেছে।”

“ওরে বাবা তাই নাকি! এ তো দেখি গঁদের আঠা! ছাড়তেই চায় না,” জবাব দিলেন শরৎ বাবু।

“টং অ্যাচিউ আবার কে?” ফস করে প্রশ্ন করল আব্দুল খান। “গাইড সাহেব, প্লিজ কোনো প্রশ্ন করবেন না। শুধু শুনে যান। যাহোক, এই টং অ্যাচিউয়ের আসল নাম ইয়াং দা ঝাউ। চীনের ফুজিয়াং প্রদেশে জন্ম। ছোটোবেলাতেই ভাগ্যান্বষণে হংকং চলে আসে। তারপর জাহাজের খালসি হয়ে রটারডাম, অ্যান্টিওয়ার্প, হমবুর্গ, লন্ডন, অ্যালেজেসিরাস, মার্সেই—এইসব বড়ো বড়ো বন্দরে ঘুরতে থাকে। কোথাও তেমন কোনো সুবিধে করতে পারেনি। শেষমেশ কোলকাতায় পাড়ি জমায়।”

“এখানে তখন ওয়ারেন হেসটিংক্স গভর্নর জেনারেল। ইউরোপে সাত ঘাট মেরে এসে টং বুঝতে পারে, একেবারে ওপরতলার আর্শীবাদ ছাড়া দ্রুত উন্নতি করা অসম্ভব। তখন কেবল শুরু হয়েছে কোম্পানির শাসনামল। বড়ো কর্তাদের ইশারাতেই রাতারাতি রাজা থেকে ফকির আর ফকির থেকে রাজা হচ্ছে এখানকার কিছুকিছু লোক। টং ভাবল, যে করেই হোক ম্যানেজ করতে হবে একেবারে চুড়োর লোকটাকে। কিন্তু ভাবলেই তো আর হবে না। সেকালে চীনেম্যান কোলকাতায় ছিল না বললেই চলে। দামি পোশাক-আশাক পরে ফুলবাবু হয়ে সাহেবদের অফিসে ধরনা দিতে লাগল টং। সাথে হংকং থেকে আনা নানান ধরনের উপহার। সবাইকে বলল, ‘চীনে ব্যাবসা- বাণিজ্যের মেলা সুযোগ। একবার যদি গভর্নর জেনারেল তাকে সাক্ষাৎ দেন, তাহলে বুঝিয়ে বলতে পারবে।’

“দিনের পর দিন যায়, সাহেবরা উপহার নেয়, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না। এদিকে টাকা-পয়সা শেষ হয়ে আসছে টংয়ের। উপহার সামগ্রীও কাছে আর নেই তেমন। আশার আলো যখন প্রায় নিভে এসেছে, সেই সময় কোলাকাতা সেইলর্স ক্লাবে এক সন্ধেয় তার দেখা হলো জেমস ফ্লিন্টের সাথে। হংকংয়ে ভদ্রলোকের শিপিং বিজনেস ছিল। এর জাহাজেই প্রথম খালাসির চাকরে নেয় টং।

“এইবার ছিঁড়ল তার ভাগ্যের শিকে। ফ্লিন্ট তাকে নিয়ে গেল গভর্নর জেনারেলের বাস ভবনে। কিন্তু দুঃখের বিষয় ওয়ারেন হেসটিংক্সের সাথে দেখা হলো না। সাহেব নাকি অদ্ভুত এক অবসাদে ভুগছেন। সারারাত মড়ার মতো ঘুমোলেও সকালে উঠে নাস্তা করার পর ভীষণ ক্লান্তি লাগে। শুধুমাত্র জরুরি কাজগুলোই করেন। দেখা-সাক্ষাত… সে-ও যেগুলো না করলেই নয়। গত একমাস ধরে চিকিৎসা চলছে। অ্যালোপ্যাথি, কবিরাজি, আয়ুর্বেদিক সবই হয়েছে, কিন্তু অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি।

“এমন একটা সুযোগই খুঁজছিল টং। ওয়ারেন হেসটিংক্সের একান্ত সচিবকে সে বোঝাল: তার কাছে লং ঝিং নামে এক চীনে দাওয়াই আছে, এ রোগের ধন্বন্তরি ওষুধ। চীনের ঝেজিয়াং প্রদেশের হ্যাংঝাওয়ে পশ্চিম হ্রদ বলে একটা সরোবর আছে। অতি দুর্গম আর পবিত্র জয়গা। ওখানে একধরনের চারা গাছ জন্মে। এর পাতাকে বলা হয় লং ঝিং বা নাগের কুয়ো। ওই পাতা চায়ের মতো করে গরম জলে ডুবিয়ে তার রস খেলেই হবে। তবে হ্যাঁ, সকালে উঠে খালি পেটে খেতে হবে। মনে রাখতে হবে এ জিনিস খুব পবিত্র আর ভীষণ দুষ্প্রাপ্য। এক ফোঁটাও নষ্ট করা যাবে না। তার কাছে ছোট্ট একটা কাঠের বাক্সে মাত্র আধ ছটাক লং ঝিং আছে।

“ওটা খেয়ে ভালো হয়ে উঠলেন ওয়ারেন হেসটিংক্স। খুশি হয়ে টংকে ডেকে বললেন তার কিছু আর্জি আছে কি না। টং জানাল, চিনির কারবার করতে চায় সে। ও জিনিসের ভীষণ চাহিদা কোলকাতায়। কিন্তু জমি পাচ্ছে না। কেনার মতো পর্যাপ্ত পয়সাও নেই। গভর্নর জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় কতটুকু জমি চাই। জবাবে টং বলল, ‘স্পট কোলকাতার কাছাকাছি হতে হবে। তবে কারখানা আর চাষের জমি মিলিয়ে ঠিক কতটুকু জমি দরকার সরেজমিনে না দেখে বলা কঠিন।’

“একথা শুনে মুচকি হাসলেন হেসটিংক্স। বললেন, ‘এক কাজ করুন, আপনি হুগলি নদী ধরে ভাটির দিকে চলে যান। অর্থাৎ দক্ষিণ-পশ্চিমে। যেখানে পছন্দমতো জায়গা পাবেন সেখানে সকাল নটা থেকে বারোটা অব্দি এই তিন ঘণ্টা সময়ের ভেতর যতটুকু জমিতে আপনি হেঁটে বা দৌড়ে সীমানা নির্ধারণ করতে পারবেন, ততটুকুই দেওয়া হবে আপনাকে। মনে রাখবেন যেখান থেকে শুরু করবেন, শেষ করতে হবে সেখানেই। স্টার্টিং পয়েন্টে এসে শেষ না করতে পারলে, দ্বিতীয়বার কোনো সুযোগ আপনি পাবেন না। কোনো জমা কিম্বা দাদন দেওয়া লাগবে না। বছরে মাত্র পঁয়তাল্লিশ টাকা খাজনা দিলেই হবে। তবে হ্যাঁ, যেসব জমিতে স্থাপনা ইতিমধ্যে তৈরি হয়ে গেছে, সেসব জমি বাদ দিতে হবে। জানেনই তো অনেক জায়গায় নীলকর সাহেবেরা নীলকুঠি তৈরি করেছে।’

“এরকম আর্শীবাদই তো চেয়েছিল টং। হুগলী নদী ধরে ভাটিতে তেত্রিশ কিলো দূরে চলে গেল সে। নদীর পাড়ে চমৎকার খোলামেলা উর্বর জায়গা। মেঠো রাস্তার ধারে আদ্যিকালের একটা ভাঙা দেউলও আছে। জলপথে কোলাকাতায় যাতায়াত খুবই সহজ। তো একদিন ভূমি অফিসের ছোটো সাহেব নিকলসন আর বিপীণ সার্ভেয়ারের সামনে সকাল নটায় নদীর পাড় থেকে পুব দিকে দৌড় শুরু করল টং। পেছনে অসংখ্য চিকন চিকন বাঁশের কাঠির ডগায় তিনকোনা সাদা পতাকা হাতে লাই কং নামের এক বালক সহকারী। কিছু দূর পরপর পতাকাঅলা কাঠি পুঁতে সীমানা নির্ধারণের করতে লাগল লাই। এক ঘণ্টা পুব বরাবর দৌড়ে দক্ষিণে মোড় নিলো টং। টের পেল আগের থেকে অনেক কমে গেছে দৌড়ের গতি। বুঝতে পারল এই রাফতারে দৌড়ালে ফুরিয়ে যাবে সব দম। শেষে আর হাঁটতেই পারবে না। দৌড়ানো বাদ দিয়ে হনহন করে হাঁটা আরম্ভ করল সে। আরও এক ঘণ্টা পর পশ্চিমে মোড় নিলো। শেষে দেহের সবটুকু জোর একসাথে করে নদীর পাড় ধরে দৌড়ে যেখান থেকে শুরু করেছিল আবার সেখানে এসে হুড়মুড় করে জমিনে পড়ে গেল টং। লোকজন নিয়ে জমি মেপে সার্ভেয়ার ছোটো সাহেবকে জানাল: মোট সাড়ে ছশো বিঘে জমির সীমানা নির্ধারণ করতে পেরেছে সে।

“ওখানেই তার সুগার ফ্যাক্টরি বানাল টং। নাম—থং গিয়েং পাকুং। হংকং আর সিঙ্গাপুর থেকে চীনেদের নিয়ে এসে ফ্যাক্টরির কাজ আর আখ চাষে লাগাল। সেই সাথে ওপর মহলে রাখল ব্যাপাক দহরম মহরম। তার নাম অ্যাচিউ থেকে ওই জায়গার নাম হলো অছিপুর। এক মুসলমান মেয়েকে বিয়ে করেছিল অ্যাচিউ। নাম তেলি বিবি। পরমা সুন্দরী একটা মেয়ে জন্মেছিল এই তেলি বিবির গর্ভে। ছোটোবেলা থেকেই ও মেয়ের পিছে পড়ে লাই কং। হঠাৎ করে মারা যায় টং। টং মারা গেলে পর ওই মেয়েকে ভজিয়ে-ভাজিয়ে বিয়ে করল লাই। টং মারা যাওয়ার আগে একটা কাঠের বাক্স রেখে গিয়েছিল। প্রচুর ধন-সম্পদের হদিশ নাকি ছিল ওই বাক্সে। পরে টংয়ের মেয়ে, লাই, কিম্বা বাক্স—কোনোটারই আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। এদিকে ভয়ানক অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে যায় তেলি বিবি। মালিকবিহীন হয়ে পড়ে থং গিয়ে পাকুং। কোলকাতায় তখন চামড়ার রমরমা ব্যাবসা। চীনে শ্রমিকদের ব্যাপক চাহিদা। চিনি কল ছেড়ে দলেদলে চীনে শ্রমিকেরা চলে এলো কোলকাতায়। বকেয়া খাজনার দায়ে নিলামে উঠল টংয়ের থং গিয়েং পাকুং।

“টং কে এখানকার চীনেরা গড মনে করে। কারণ, তাকে ঘিরে গড়ে উঠেছে নানান অলৌকিক কহিনি। সেই দুশো বছর আগে থেকেই। পুরনো যে দেউলটা ওই স্পটে ছিল সেটাকে ঘিরে একটা মন্দির কমপ্লেক্স বানিয়েছিল টং। আগের মন্দিরটা ছিল দক্ষিণ রায়ের। দক্ষিণ রায়ের পুজো করে বাদা এলাকার লোকেরা। হিংস্র পশু আর পিশাচের দেবতা এই দক্ষিণ রায়। ওটার উলটোদিকে রাস্তার এপারে বনবিবির মন্দির। এও বন-জঙ্গলের দেবী। এসবই হয়েছে টংয়ের পৃষ্ঠপোষকতায়। তবে দক্ষিণ রায়ের পাশে টং তার নিজের দেব-দেবী প্রতিষ্ঠা করেছিল। নাম তুদিগং। ওখানকার লোকেরা ওই দেব-দেবীকে বলে খোদাখুদি।”

“এই রাম-কাহানি শুনিয়ে আপনি আমাদের আসলে কী বোঝাতে চাইছেন?” ধৈর্য হারিয়ে জিজ্ঞেস করলেন শরৎ বাবু।

“হেনরির সমধিতে আমরা কী পেয়েছি দয়া করে মনে করে দেখুন।

একটা রুপোর পয়সা পেয়েছি। ওতে চীনে হরফে একটা পুরনো সংগঠনের নাম লেখা ছিল।”

“টং কে ছিল? ওই সংগঠনেরই একজন নয় কি?”

“কিন্তু আপনি বলেছেন টং তার সংগঠনকে জানিয়ে গেছে যে জিনিস সে খুঁজছিল সেইটে তার হাতে আসার আগেই যার কাছে ছিল অর্থাৎ হেনরি মারা যায়। সেই সাথে নিখোঁজ হয় ওই জিনিসও।”

“কিন্তু হেনরির কবর থেকে যা পাওয়া গেছে তাতে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে: টং পেয়েছিল ওই জিনিস। হেনরির কবর থেকে সেই সময়েই সংগ্রহ করে ওটা।”

“বেশ তারপর কী হলো? কাউকে কিছু না জানিয়ে নিজের কাছে রেখে দিলো?”

“ঠিক তাই। অনেকেই মনে করে অলৌকিক ক্ষমতা ছিল টংয়ের। সে বেঁচে থাকা অবস্থাতেই অনেকে তাকে দেবতা জ্ঞান করত। এখনও দেশ-বিদেশ থেকে হাজার হাজার চীনেরা এসে অর্ঘ্য নিবেদন করে তার কবরে। এই ক্ষমতা সে পেল কোথায়?”

“ধরে নিলাম, সে সমাধি থেকে সংগ্রহ করেছিল ওই জিনিস। তারপার ট্রায়াডকে মিথ্যে কথা বলে নিজের কাছেই রেখে দেয়। কিন্তু তাই যদি হবে, তাহলে ওখানে ক্লু রেখে আসার কারণ কী? চুরি গোপন রাখাই তো বুদ্ধিমানের কাজ, নাকি?”

“এখন যেমন, দুশো বছর আগে চীনের বাইরে ততটা শক্তিশালী ছিল না ট্রায়াড। দারুণ দূরদৃষ্টি ছিল টংয়ের। সে জানতো কোনো না কোনো দিন ওই জিনিসের খোঁজে কেউ না কেউ আসবে। আর যে আসবে সে যেন খুঁজে পায়, সে ব্যবস্থা করে রেখে গেছে চিনির রাজা।”

“তখন থেকে আপনারা ওই জিনিস, ওই জিনিস করছেন। ‘ওই জিনিস আসলে কোনো জিনিস?” কৌতূহল চেপে না রাখতে পেরে জিজ্ঞেস করেই ফেলল আব্দুল খান।

“আহ, আপনি তো জ্বালিয়ে মারলেন, মশাই!” রাগে গরগর করতে করতে বলল ম্যাডাম জুই। “বারবার বলছি গোপন থাক ওটা, কিন্তু তারপরও ঘ্যানঘ্যান করেই যাচ্ছেন। ঠিক আছে জানতে যখন চাইছেন তো বলি। আমরা কোনো সোনাদানা, হিরেপান্না, গুপ্তধনের নকশা খুঁজছি না। আমরা যা খুঁজছি সেটা দুখণ্ডে ভাগ গয়ে যাওয়া একটা পাণ্ডুলিপি।”

“পুরনো পাণ্ডুলিপি?”

“আজ্ঞে, হ্যাঁ।”

“কত পুরনো?”

“অনেক। হাজার বছরেরও বেশি।”

“ইন্টারন্যাশনাল মার্কেটে ওটার দাম কত?”

“বলতে পারবো না।”

“এখনও কি চারভাগের একভাগ দাবি করবেন, না ওটার বিনিময়ে টাকা-পয়সা নিয়ে সন্তুষ্ট হবেন?”

পাণ্ডুলিপির কথা শুনে কিছুটা দমে গেল আব্দুল খান। বলল, “আপনি কি সত্যি বলছেন?”

“আমার কথা বিশ্বাস না হলে, এই যে এই দুজন আছে শরৎ বাবু আর দীনবন্ধু—এদেরকে জিজ্ঞেস করুন।

“ওর কথা বাদ দিন। আগের প্রসঙ্গে ফিরে আসি,” বলল দীনবন্ধু। ব্যাপারটায় আগ্রহ পেতে শুরু করেছে সে। “টংয়ের কাছে ছিল ওই পাণ্ডুলিপি। কিন্তু টং সগঠনকে সেটা জানায়নি। কেন জানায়নি?”

“হয়তো ভেবেছিল কিছুদিন নিজের কাছে রেখে তারপর জানাবে। কিন্তু বাধ সেধেছিল তার ওপর ওটার প্রভাব। নিজেই দেবতা হয়ে উঠেছিল সে।”

“কিন্তু তারপর তো দুম করে মরেই গেল। তাই না?”

“আজ্ঞে, হ্যাঁ।”

“আপনি বলেছেন: লোকে বলত তার কাছে এক অদ্ভুত বাক্স আছে। ওই বাক্স শেষমেশ তার মেয়ের হাতে পড়ে। টংয়ের সহকারী লাই কং এই বাক্স হাতানোর জন্যেই তার মেয়ের পেছনে লাগে। তারপর কী হলো?”

“এরপর যে কী হয়েছিল জানা যায়নি,” ম্যাডাম জুইয়ের মুখে স্পষ্ট বিরক্তি। লুকোনোর চেষ্টাও করছে না। ঝাঁঝের সাথে বলল, “আপনাদের সমস্যা কী জানেন, দীনবন্ধু বাবু? আপনারা ‘শুধু তারপর কী হলো?’ ‘এরপর কী ঘটলো?’ ‘এখন কী করা?’- এইসব প্রশ্ন করা ছাড়া অন্য কিছুই পারেন না। একই টিমে কাজ করছি আমরা। বকবক করতে করতে কলিজা কানা হয়ে গেল। তবুও আপনাদের কাছ থেকে না পেলাম কোনো পরামর্শ, না কোনো ফিডব্যাক। আপনারা তো শিক্ষিত মানুষ। ভেবেচিন্তে একটা পথ দেখান।”

ম্যাডাম জুইয়ের কথা শুনে খ্যা খ্যা করে হাসতে লাগল আব্দুল খান। অবস্থা দেখে কান লাল হয়ে গেল শরৎ বাবু আর দীনবন্ধুর।

নড়ে-চড়ে বসলেন শরৎ বাবু। এখন কিছু না বললেই নয়। বললেন, “অছিপুর এখান থেকে তেত্রিশ কিলো দূরে, বজবজে। প্রথমে খিদিরপুর ফ্লাই ওভার, তারপর তারাতলা হয়ে সম্প্রীতি ফ্লাইওভার পার করে বজবজ ট্রাঙ্ক রোড ধরে যেতে হবে। বজবজ ট্রাঙ্ক রোড থেকে এ টি রোড ধরে এগুলেই বড়ো শিবতলা। ওখান থেকে দশ মিনিটের হাঁটা পথ চীনেমনতলা। টংয়ের মন্দির ওই চীনেমনতলাতেই।”

“আর তার সমাধিটা কোথায়?” জিজ্ঞেস করল ম্যাডাম জুই।

“ওই মন্দির কমপ্লেক্স থেকে আরও দুকিলো পশ্চিমে, হুগলী নদীর ধারে।”

“কিছুটা হলেও আগে থেকেই তথ্য সংগ্রহ করেছেন দেখছি। যাক, ধীরে হলেও উন্নতি হচ্ছে। এসব তথ্য কখন সংগ্রহ করলেন আর কেনই বা করলেন?”

“যখন দেখলাম হেনিরর সমাধির ক্লু টংয়ের দিকে আঙুল তুলছে, তখনই সিদ্ধান্ত নেই লোকটার শেষ জীবনে কী ঘটেছিল সেটা জানতে হবে। আর তা জানতে হলে ওর কারখানা, সমাধি এসব কোথায় ছিল খুঁজে দেখতে হবে। আপনার নিজস্ব সিস্টেম। কাল সন্ধের সময় এসপ্ল্যানেডে গিয়ে সব জেনে এসেছি। অছিপুরের বাস ছাড়ে ওখান থেকে।”

“এখন আমাদের পরের স্টেপটা কী হবে?”

“চীনেমনতলা গিয়ে টংয়ের সমাধি ছানবিন করতে হবে, “ তৎক্ষণাৎ উত্তর দিলো আব্দুল খান।

“টংয়ের সমাধি ঘাঁটলেই কিছু একটা পাওয়া যাবে—এ ধারণা কেন করছেন?”

“আপনার কাছ থেকেই শিখেছি। দেখা যাচ্ছে শুরু থেকেই কারও না কারও সাথে সমাধিস্থ হচ্ছে ওই রহস্যময় পাণ্ডুলিপি। তা-ই যদি হয়, তাহলে শেষ যার হাতে ওটা পড়েছিল তার কবর খুঁড়লেই কিছু একটা পেয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা।”

“খুবই সরল ধরনের চিন্তা। বিষয়টা এমন ফরম্যুলাইক না-ও হতে পারে। তারপরেও কোথাও না কোথাও থেকে শুরু করতে হবে। বজবজ যাওয়ার ব্যবস্থা করুন।

“এখান থেকে মেরেকেটে এক ঘণ্টার পথ। আজই যাওয়া যেতে পারে,” বললেন শরৎ বাবু। “কিসমত পাঠানকে এত্তেলা দিলে এখনই চলে আসবে।”

“তাকে ডাকলেই কি পাওয়া যাবে? অন্য কারও ভাড়া ধরে কোথায় আছে কে জানে?”

“উঁহু। আমাদের কাজ ধরার পর সারাদিন নিজেকে ফ্রি রাখে সে। কোথায় কখন আবার যেতে হয় আমাদের!”

“ঠিক আছে, রেডি হয়ে নিচ্ছি আমি। কিসমত পাঠানকে নিয়ে এসে আমাকে পিক করুন। এখন তাহলে আসুন আপনারা। কি বলেন?”

“আজ্ঞে, হ্যাঁ। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে ফিরে আসবো আমরা,” উত্তর দিলেন শরৎ বাবু।

৫৬

চীনেমনতলায় খোদাখুদির মন্দিরের সামনে যখন নামলো সবাই, তখন বেলা বারোটা। দুর্গের মতো ফটক। মিন্ট সুবজ রং করা ইঁটের স্ট্রাকচারের ওপর লাল টালির ছাদ। মাঝখানে লাল রঙের লোহার গ্রিলের গেট। ভেতরে ঘাসে মোড়া গোল চত্বর। ঘেসো কম্পাউন্ডের উলটোদিকে হলদে রঙা দেওয়ালের গায়ে গাঢ় লাল, খাটো দরজা। মন্দিরে ঢুকতে হলে মাথা নিচু করে ঢুকতে হবে। লোহার গ্রিলঅলা গেটের সামনে থেকেই দেখা যাচ্ছে ভেতরের কম্পাউন্ড। মন্দিরের প্রধান ফটকে তালা দেওয়া। ভেতরে ঢোকার কোনো সুযোগ নেই।

“গেটে তো তালা মারা। মন্দিরে ঢোকার উপায় কী?” জিজ্ঞেস করল আব্দুল খান।

“এ মন্দির ভিজিটরদের জন্যে খোলা হয় শুধু ফেব্রুয়ারি মাসে। চাইনিজ নিউ ইয়ারের সময়। বাকি এগারো মাস পুরোহিত একাই তার সহকারীদের নিয়ে নৈবেদ্য দেন,” উত্তর দিলো ম্যাডাম জুই।

“একথা আপনি আগে থেকেই জানতেন?”

“আজ্ঞে, হ্যাঁ। আমি আগেও একবার এসছি এখানে। সব নিয়মকানুন জানি।”

“তাহলে আমাদের এখানে টেনে খামোখা হয়রানি করার মানে কী?”

“এখানে আসার আইডিয়া তো আপনিই দিয়েছেন। তাছাড়া, আমি না থাকলে কী করতেন?”

“আচ্ছা এক কাজ করা যাক। মন্দির থাক এখন। চলুন আমরা টংয়ের কবরটা বরং দেখি গিয়ে, কী বলেন?”

“বেশ। চলুন তাহলে।”

হুগলী নদীর একেবারে পাড় ঘেঁষে টংয়ের কবর। অদ্ভুত ডিজাইন। দুনিয়ার কোনো সমাধির সাথে এর মিল নেই। লাল টকটকে সিমেন্টে বাঁধানো কবরটা দেখতে ঘোড়ার নালের মতো। সামনের দিকটা নিচু, পেছনের সাইড উঁচু, যেন সাভারের জাতীয় স্মৃতি সৌধ। অর্ধবৃত্তাকার পেছনের দেওয়ালের ঠিক মাঝখানে শীর্ষবিন্দু থেকে গণ্ডারের শিংয়ের মতো বাঁকা একটা দণ্ড উঠে গেছে। শিংয়ের গলায় শুকনো ফুলের মালা। শিংয়ের নিচে সমাধির জমিনের ওপর আধ খাওয়া চাঁদের মতো দুটো ধাপ। নিচেরটা বড়ো, ওপরেরটা ছোটো। সিঁড়ি যেখানে শেষ হয়েছে সেই জায়গা থেকে ছয় ইঞ্চি ওপরে সাদা মার্বেল পাথরের ফলকে চীনে হরফ লেখা নাম ফলক। পেছেনের দেওয়ালের দশ ফিট দূরে একপাশে ইয়া বড়ো আকাশিয়া অন্য পাশে ঝুরিনামা আদ্যিকালের এক খেজুর গাছ।। একেবারে ঝকঝকে তকতকে সমাধি। কোথাও একটা পাতা অব্দি পড়ে নেই।

“কবর দেখে মনে হচ্ছে খুব বেশি পুরনো নয় এটা,” মন্তব্য করল আব্দুল খান।

“দুশো বছরের কম না। টং মারা যাওয়ার পর থেকেই আছে। আগেই বলেছি টংকে দেবতা মানে অনেকেই। নিয়মিত পুজো- আচ্চা হয় এখানে। সেই সাথে কবরের মেন্টেন্যান্সও। ফি বছর সিনথেটিক লাল রঙের প্রলেপ দেওয়া হয়। এ কারণেই নতুন মনে হচ্ছে।”

“আমার মনে হয় টংয়ের কবর খুঁড়ে দেখা উচিত। আপনাদের কী মত?” দীনবন্ধু আর শরৎ বাবুর দিকে চেয়ে প্রশ্ন করল আব্দুল খান।

“দেখতে ক্ষতি নেই। যদি কিছু পাওয়া যায় তো ভালো, না গেলে তখন ভিন্ন পথ দেখতে হবে। আপনি কী বলেন, ম্যাডাম জুই?”

“আপনারা যদি কবর খুঁড়ে দেখতে চান, তো দেখুন। তবে একটা কথা মনে রাখতে হবে, এ জায়গা বাবুলবোনা সেমেটারির মতো নির্জন, পোড়ো কোনো গোরস্থান না। চারদিকে গিজগিজ করছে লোক। হররোজ কেউ না কেউ পুজো দিতে কিম্বা মানত করতে আসছে। সেই সাথে আছে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন কর্মীর আনাগোনা। সময়ের আবর্তে হারিয়ে যাওয়া নীলকর সাহেব হেনরির কবর না এটা, বরং এক কিংবদন্তি চীনে ব্যবসায়ী আধা মানুষ আধা দেবতার নিয়মিত অর্ঘ্য পাওয়া সমাধি! ইচ্ছে হলো আর, ঝপাঝড় কোদাল চালিয়ে খুঁড়তে শুরু করলাম, বিষয়টা এত সহজ না।

“তাহলে এখন কী করা? যারা বাবুলবোনতে আমাদের সাহায্য করেছিল তাদের পাওয়া যাবে না?” প্রশ্ন করলেন শরৎ বাবু।

“আমি বলে দেখতে পারি। তবে একাজে ঝুঁকি মেলা। যদি নিশ্চিত হন আপনারা কবর খুঁড়লেই যা খুঁজছি তা পাওয়া যাবে, তাহলে চেষ্টা করবো তাদেরকে আনার। প্রশ্ন হলো—আপনারা কি নিশ্চিত।”

“আমি নিশ্চিত,” তৎক্ষণাৎ উত্তর দিলো ট্যুরিস্ট গাইড।

“বেশ। শরৎ বাবু, দীনবন্ধু বাবু আপনাদের কী মত?”

“আমাদের আরও একটা দিন সময় দিতে হবে,” জানালেন শরৎ বাবু।

“আপনার সিদ্ধান্ত যদি ‘হ্যাঁ’ হয়, তাহলে আমাদের লোকদের জানাবো আমি। তবে দুটো শর্ত আছে। এক, গোরখোঁড়ার সময় এখানে উপস্থিত থাকবেন আপনারা তিনজন। কোনো সমস্যা হলে সেটা সামাল দেওয়ার দায়িত্ব আপনাদের। দুই, যদি কিছু না পাওয়া যায়, তাহলে ওই পাণ্ডুলিপি খুঁজে বের না করা অব্দি আপনারা কেউ ঘরে ফিরতে পারবেন না। যতি শর্ত মেনে নেন, তো বলেন।

“আমরা শর্ত মেনে নিচ্ছি,” আবারও কেউ কিছু বলার আগেই ফট করে বলে বসল আব্দুল খান।

৫৭

একদিন পর সকাল দশটায় সাইকিক সেন্টারে মিটিংয়ে জড় হলো সবাই। কালো রঙের গাউন পরে আছে ম্যাডাম জুই। মাথায় কালো ব্যান্ডেনা। অস্বাভাবিক গম্ভীর লাগছে তাকে। এদিনও চায়ের সরঞ্জাম নিয়ে এলো আগের সেই চীনে তরুণী। চা খেতে খেতে শরৎ বাবু বললেন, “গোর খোঁড়ার একটা উপায় বের করেছি আমি। রাতের আঁধারে না, দিনের বেলাতেই খোঁড়া হবে কবর। তবে সামান্য চালাকির আশ্রয় নিতে হবে।”

“ব্যাপারটা খুলে বলুন,” কাটাকাটা গলায় বলল ম্যাডাম জুই।

“গতকাল আবারও স্পটে গিয়েছিলাম আমি।”

“একা?”

“আজ্ঞে, হ্যাঁ। দলবল নিয়ে যাইনি।”

“কারণ?”

“লোকে সন্দেহ করতে পারে।”

“বেশ বলে যান।”

“ওখানে গিয়ে দেখলাম টংয়ের কবর থেকে পৌনে এক কিলো দূরে হুগলী নদীর ধারে পশ্চিম বঙ্গের জল সম্পদ অনুসন্ধান ও উন্নয়ন বিভাগ কাজ করছে। সেন্ট্রাল গ্রাউন্ড ওয়াটার বোর্ডের অধীনে কাজ করে এরা। মাটির নিচে কোথায় জলের স্তর আর কতটুকু জল মজুদ আছে সেইটে নির্ধারণ করে। সাইটেই তাঁবু খাটিয়ে থাকে এরা। বন-জঙ্গল, বিরাণ মাঠ, চাষের জমি— সবখানে ঘুরে বেড়ায়…”  

এরা কোথায় কীভাবে থাকে সেটা নিয়ে আমার মাথা-ব্যথা নেই। ভূমিকা বাদ দিয়ে আসল কথায় আসুন,” ম্যাডামের কণ্ঠে স্পষ্ট বিরক্তি।

“অবতরণিকার প্রয়োজন আছে, ম্যাডাম। আমাকে বলতে দিন আগে, তারপর মন্তব্য করুন। তো এরা জলের স্তর খুঁজতে গিয়ে বড়ো বড়ো গর্ত খোঁড়ে মাটিতে। তারপর ডাইনামাইট চার্জ করে সাইজমিক এনার্জি তৈরি করে। এই সাইজমিক এনার্জি তখন শক ওয়েভের মতো মাটির অনেক গভীরে ছড়িয়ে পড়ে। এই শক ওয়েভ জল অথবা শিলাস্তরে বাড়ি খেয়ে বা বাউন্স করে আবারও ফিরে আসে। ওই ফিরে আসা তরঙ্গ তখন সাইজমিক সেন্সর বা হাইড্রোফোনে ধরা পড়ে। সেন্সরে ধরা পড়া কম্পন গ্রাফ আকারে প্রিন্ট হয়। এই গ্রাফ দেখে বোঝা যায় কত নিচে জলের স্তর আর কতটুকুই বা তার পরিমাণ। শুকিয়ে যাচ্ছে হুগলী নদী। এজন্যে ওই এলাকায় চাষবাসের জন্যে মাটির কত গভীরে ডিপ টিউবওয়েল বসানো হবে, সেই সার্ভেটাই করছে তারা। কাকতালই বলতে হবে, ওদের ওখানে গিয়ে দেখি সার্ভেয়ার আমার এক প্রাক্তন ছাত্র। নাম বীরেণ। তার সাথে কথা বলে সব ব্যবস্থা পাকা করে এসেছি।”

“মাস্টার মানুষ আপনি। লেকচার দেওয়ার অভ্যেসটা রপ্ত হয়ে গেছে। সবাইকে ছাত্র মনে করেন। যাহোক, কী ব্যবস্থা পাকা করে এসেছেন?”

“টংয়ের কবরের কাছে শিফট করবে ডব্লিউআরআইডিডি-এর ওয়াটার ইনভেস্টিগেশন টিম। গর্ত খুঁড়ে অনুসন্ধান চালাবে। যেহেতু ওরা করোগেটেড টিন দিয়ে জায়গা ঘিরে নিয়ে গর্ত খোঁড়ে, তাঁবু খাটিয়ে থাকে—সাধারণ কারও পক্ষে জানা সম্ভব না গর্ত খুঁড়ে কী করছে তারা। কবরের কাছে গর্ত খুঁড়বে টিমের লোকেরা, টানেলেরও বেশিরভাগ তারাই কাটবে। কবরের এক্কেবার কাছে গিয়ে থামবে। বাকি কাজটুকু বীরেণ আর আমরা করবো। মাটির তিন ফিট নিচ দিয়ে কবরে ঢুকবো। ওপর থেকে বোঝার কোনো উপায় নেই। তবে আসল কাজটা যখন হবে, তখন টিমের অন্যান্য লোকদের সরিয়ে দিয়ে কেবল সার্ভেয়ার বীরেণ থাকবে ওখানে। মাটি খোঁড়ার আধুনিক যন্ত্রপাতি আছে ওই সরকারি টিমের কাছে।”

“এসব কেন করছেন জিজ্ঞেস করেনি আপনার ছাত্র? পুজো দেওয়া হয় এমন সমাধি খুঁড়ে ভেতরে ঢুকবেন তার তো একটা সন্তোষজনক ব্যাখ্যা থাকতে হবে?”

“জিজ্ঞেস করেছে। বলেছি, ‘বাবা বিষয়টা গোপনীয় আর খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অনেকের বাঁচামরা নির্ভর করছে এটার ওপর। এ নিয়ে আর কোনো প্রশ্ন করো না। যদি মনে করো গুরুদক্ষিণা দেবে তো কোরো, আর না দিলে নেই। আর একটা কথা তোমার উত্তর ‘হাঁ’ কিম্বা ‘না’ যাই হোক, দয়া করে এ বিষয়ে কাউকে কিছু বলো না। আশা করি বুড়ো মাস্টার মশাইয়ের এটুকু অনুরোধ অন্তত রাখবে।”

“হুঁ বুঝেছি। তা এর জন্যে কোনো টাকা লাগবে না?”

“লাগবে। তবে ওটা আমিই দিতে পারবো।”

“হুম, প্ল্যান তো ভালোই মনে হচ্ছে।”

“আজ্ঞে, হ্যাঁ। খোঁড়াখুঁড়ি যা করার সব ওরাই করবে। শুধু কবরে ঢোকার কাজটা আমরা তিনজন করবো রোববার দিনের বেলা। টিমের লোকেরা ওই দিন সকালে কোলকাতায় ছুটি কাটাতে আসে। সারাদিন শহরেই কাটায়। যদি কেউ থাকতেও চায়, বীরেণ নিশ্চিত করবে সে যেন না থাকে।”

“এতদিন পর মাথা খোলতাই হয়েছে আপনার,” বেশ খুশিখুশি গলা ম্যাডাম জুইয়ের। “আজাকে শনিবার। আমরা কি ধরে নিতে পারি, আট দিন পর আগামি রোববার কাজটা করবেন আপনারা?”

“সেইমতো কথা বলেছি। তবে বীরেণ বলছিল তাঁবু গুটিয়ে ওখানে শিফট করতেই দু-তিন দিন লেগে যাবে। তা-ও যদি সোমবার থেকে শুরু করে। এরপর খোঁড়াখুঁড়ি, তাছাড়া সিজিডব্লিইবি অফিস থেকে পারমিশন আনার ব্যাপার আছে। সেই পারমিশন আবার লোকাল থানা আর কালেক্টরের অফিসে জমা দিতে হয়। আমলাতান্ত্রিক দেশে পারমিশন আসতে কতদিন লাগবে কে জানে?”

“আমি বলি কী, ওদের আশায় বসে না থেকে বীরেণকে বলেন অফিসারদের সাথে দেখা করে হাতেহাতে পারমিশন বের করে আনতে আর যেখানে যা পাঠাতে হয় তা পাঠাতে। সেই সাথে তার টিমের লোকদেরকেউ যেন ওই স্পটে ইন অ্যাডভান্স শিফট করতে বলে দেয়। এ কাজের জন্য বীরেণকে আমরা পঞ্চাশ হাজার টাকা দেবো। কোথায় কাকে কত দিতে হবে সেটা তার সিদ্ধান্ত। আমরা চাই আগামি রোববার ওই সমাধিতে ঢুকতে।। যে যা চায় তার থেকে দুইগুণ বেশি যেন দেয়।”

“ঠিক আছে, আমি ওকে বলে দেখবো এখন।”

“আর তারপর কী সিদ্ধান্ত হয় আমাকে জানাবেন। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করুন এখানে। টাকাটা আনিয়ে দিচ্ছি আমি।”

৫৮

আট দিনের দিন সকাল বেলা চারজনের টিম গিয়ে হাজির হলো টংয়ের সমাধির কাছে সার্ভে টিমের অস্থায়ী ক্যাম্পে। প্রায় দুবিঘের মতো জায়গা টিন দিয়ে চারকোনা করে ঘেরা। চারজনই আলাদা আলাদাভাবে ঘুর পথে হুগলী নদীর ধার ঘেঁষে হেঁটে এসেছে। দল বেঁধে আসলে, সন্দেহ করতে পারে স্থানীয় বাসিন্দারা। ঢিলে ম্যাক্সির নিচে টাইটস আর টি শার্ট পরে এসেছে ম্যাডাম জুই। পায়ে টেনিস শ্য। পোনি-টেল করে মাথার পেছনে বাঁধা চুল। এ ধরনের কাজের জন্যে উপযুক্ত পোশাক।

পাঁচ ফিট ডায়ামিটারের ঝাড়া দশ ফিট গভীর গর্ত থেকে পুব দিকে টানেল বেরিয়েছে। টানেলের ব্যস তিন ফিট। হামাগুড়ি দিয়ে এগুতে হবে টানেলের ভেতর। বীরেণ বলল, “মাস্টার মশাই, আমরা চেষ্টা করেছি টানেলটা যতখানি সম্ভব চওড়া করার। কিন্তু এর থেকে বেশি আর সম্ভব হয়নি। কারণ, সেক্ষেত্রে টানেলের ভেতর ওভারহেড সাপোর্টের প্রয়োজন হবে। ব্যবহার করতে হবে কংক্রিট কিম্বা স্টিল শিট। সে এক বিরাট ভ্যাজাল। অত সময়, অর্থ কোনোটাই নেই। কষ্ট করে হামাগুড়ি দিয়ে যেতে হবে। প্রথমে আমি গিয়ে কবরে ঢোকার পথ বানিয়ে দেবো। সামান্য খোঁড়াখুঁড়ি, মেরেকেটে এক ঘণ্টার কাজ। এরপর আমি বেরিয়ে এলে আপনারা যারা ঢুকতে চান, ঢুকবেন। তবে দেখতেই পাচ্ছেন বেজায় ধুলোমাটি গর্ত আর টানেলে। আপনাদের পোশাক খুলে এখানকার শ্রমিকদের ওভারঅল পরে নিন। চারটে ওভারঅল আমি আগে থেকেই রেডি করে রেখেছি। সেই সাথে হেড গিয়ার, গাম বুট, সেফটি গগলস, আর হেভি ডিউটি রাবার গ্লাভস।”

“যে রকম ভুসভুসে মাটি। টানেল ধসে পড়বে না তো আবার?” জিজ্ঞেস করলেন শরৎ বাবু।

“তেমন কোনো সম্ভাবনা নেই, যদি না ভূমিকম্প হয়। তাছাড়া, খুব একটা ডিপ নয় এ টানেল। দশ ফিট গভীরে শুরু হয়ে ক্রমশ ওপর দিকে উঠেছে। থেমেছে মাটি থেকে তিন ফিট নিচে। সাধারণ কবরের গভীরতা ছয় ফিট। এই টানেল শেষ হয়েছে কবরের ঠিক মাঝামাঝি, পেটের কাছে। যদি ইঁটের দেওয়াল কিম্বা কফিন থাকে তাহলে সহজেই কেটে দেখতে পারবেন। মাথার ওপর হলে কফিন কিম্বা ইঁটের ফ্লোর কাটা মারাত্মক ঝামেলা হবে। কারণ, এক তো সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারবেন না, দুই নম্বর, চিত হয়ে শুয়েও যদি কাটেন, তবুও ইঁট-কাঠ যা-ই কাটুন না কেন, কাটা অংশগুলো সব মুখের ওপর পড়বে। চোখে ধুলোবালি, কাঠের গুঁড়ো পড়লে তখন দেখা-ই অসম্ভব হয়ে পড়বে।”

“ওরে বাবা তুমি তো দেখছি একেবারে আঁটঘাট বেঁধে নেমেছ! এতকিছু ভাবলে কখন? ছাত্র জীবনে খুব মেধাবী ছিলে বোধহয়। ক্লাসে টেনে পড়ার সময় রোল কত ছিল?”

“তেত্রিশ রোল, স্যার। এটাকে যদি মেধাবী বলেন, তাহলে মেধাবী! হা হা হা।”

“পড়ালেখায় মাঝারি হলেও চাকরিতে অনেকেই খুব ভালো করে। তুমি মনে হয় ওই গোত্রের।”

“এখন থাক ওসব। স্যার, আপনি কি নাববেন নিচে?”

“না, বাপু। ও আমি পারবো না।”

“তাহলে কে কে যাবে?”

“আমি যাবো,” সাথে সাথে উত্তর দিলো আব্দুল খান।

“আমিও,” দীনবন্ধুর জবাব।

ম্যাডাম জুইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে সবাই। তার রেসপন্স জানতে হবে এখন।

“আমিও যেতে চাই ওখানে। তবে আমার মনে হচ্ছে একজন একজন করে যেতে হবে। কারণ হামা দিয়ে সামনে এগুনোর সময় হাত আর মাথা আগে থাকবে। কিন্তু ফিরে আসার সময় আগে এক হাঁটুর ওপর ভর করে হিপ আগে দিয়ে পিছিয়ে আসতে হবে। টানেলের ভেতর ইউ-টার্ন নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। পেছনে কেউ থাকলে তাকে দেখা যাবে না। পরের জনের মাথায় আগের জনের হিপ ধাক্কা খেয়ে জড়ামড়া লেগে যাবে।”

“একেবারে খাঁটি কথা বলেছেন, দিদি,” স্পষ্ট প্রশংসা বীরেণের গলায়। ম্যাডাম জুইকে চেনে না সে। সে কারণেই দিদি বলে সম্বোধন। “টানেলের মাথায় হ্যান্ড-হেল্ড ইলেকট্রিক এক্সকাভেটর রাখা আছে। সেই সঙ্গে ব্যাটারি চার্জড হেভি হ্যামার। তাছাড়া, নরম ভুসভুসে মাটি। করোশন বা ইম্প্যাক্টের শব্দ একেবারেই কম। নিচে কী হচ্ছে বাইরে থেকে বোঝা যাবে না। আমি যেয়ে পথ ক্লেয়ার করে দিয়ে আসবো এখন। এরপর আপনারা যাবেন। প্রথমে কে যেতে চান?”

“আমি যাবো,” কেউ কিছু বলার আগেই প্রস্তাব দিলো ম্যাডাম জুই।

“বেশ। আমি গিয়ে কবরে ঢোকার পথ ক্লেয়ার করে দিয়ে আসি আগে। তারপর আপনি যাবেন। ওভারঅল, হেডগিয়ার, গামবুট, গ্লাভস, আর সেফটি গগলস পরে রেডি হয়ে থাকুন। যাতে আমি ফিরে আসা মাত্র ঢুকতে পারেন আপনি।”

“পথ ক্লেয়ার করতে কতক্ষণ সময় লাগবে আপনার?”

“এক ঘণ্টা তো বটেই। বাকি টানেল কাটতে সময় লাগবে না। সুড়ঙ্গ কাটার পর ডেব্রি বা মাটিচুটি সরাতে দেরি হয়। টানেলের ফ্লোরে যদি জায়গা না হয়, তাহলে ভেতরের ডেব্রি এনে এই গর্তে ডাম্প করতে হবে। যাহোক ভগবানের কাছে প্রার্থনা করুন ওই কাজ যেন করতে না হয়। করতে হলে আগুপিছু করতে করতে কালঘাম ছুটে যাবে। সময়ের কথা না হয় বাদই দিলাম।”

ভেতরে অন্ধকার না?”

“অবশ্যই। ওই যে ওয়্যার দেখছেন, গর্তের গা থেকে টানেলের ভেতরে ঢুকে গেছে, ওটা ইলেকট্রিক কানেকশন। ভেতরে কিছুদূর পরপর টানেলের সিলিংয়ে কেসিংয়ের ভেতর বাল্ব লাগানো আছে। এক্সকাভেটরে ওই লাইনের মাধ্যমেই অপারেট করে।”

“কারেন্ট চলে গেলে তখন কী হবে?”

“আপনাদের মাথায় হেডগিয়ার অর্থাৎ হেলমেটের সাথে টর্চ লাগানো আছে। ওটা জ্বালবেন। তবে সমস্য হলো, খোঁড়াখুঁড়ির সময় কারেন্ট গেলে এক্সকাভেটর চালানো যাবে না। প্রর্থনা করছি কারেন্ট যেন থাকে। ওকে, নামছি তাহলে।”  

খুব দ্রুত অভারঅল, গ্লাভস, হেডগিয়ার—এইসব পরে মই বেয়ে গর্তের ভেতর নেমে গেল বীরেণ। তারপর হামা দিয়ে ঢুকল পুবমুখী টানেলে। ভেতর থেকে ভেসে এলো মাটি খোঁড়ার মৃদু আওয়াজ। শেষ দিকে মৃদু আওয়াজ পালটে হালকা গুমগুম শব্দ হতে লাগল। ঘণ্টাখানেক পর বেরিয়ে এলো বীরেণ। ধুলোমাটিতে সারা গা মাখামাখি। বলল, “পথ ক্লেয়ার। কবরের নিচটা চারদিকে পাঁচ ইঞ্চি পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। চৌবাচ্চার মতো। হ্যামার দিয়ে খসিয়ে দিতে হয়েছে পাঁচিলের ইঁট। ভেতরে কফিন দেখতে পেয়েছি। দাঁড়ানোর মতো জায়াগও আছে। ম্যাডাম, আপনি যদি চান তো নাবতে পারেন এখন। আর হ্যাঁ, এই ক্রো-বারটা নিয়ে যান। চাঁড় মেরে কফিনের ঢাকনা খুলতে হতে পারে। এই যন্ত্র ছাড়া ওকাজ সম্ভব না।”

মই বেয়ে গটগট নেমে গেল ম্যাডাম জুই। ঢুকে গেল টানেলের ভেতর। মানতেই হবে সাহস আছে মহিলার। সমাধির ভেতর ঢুকে সোজা হয়ে দাঁড়াল ম্যাডাম জুই। এক সময় কালো ছিল কফিনের রঙ। এখন শ্যাতলা পড়ে কাঠের ধূসর রং বেরিয়ে গেছে। কফিনের ঢাকনা বা লিডটা ধরে উঁচু করার চেষ্টা করল সে। উঁহু, বেজায় ভারী, একচুল নড়লো না ওটা। এইবার লিডের ফাঁকে ক্রো বারের পাতলা মাথাটা ঢুকিয়ে চাঁড় দিলো। নড়ে উঠল ঢাকনা। মনেমনে বীরেণকে ধন্যবাদ দিলো ম্যাডাম জুই। কী জিনিসের প্রয়োজন পড়তে পারে আগে থেকেই ভেবে রেখেছে স্মার্ট ছেলেটা! দুহাত দিয়ে ঢাকনা ঠেলে উলটোদিকে ফেলে দিলো সে। জ্বালানোই ছিল হেড গিয়ারের লাইট। দিনের মতো ফকফকে হয়ে আছে কফিনের ভেতরটা।

সাটিনের ছেঁড়াফাটা শ্রাউড। এককালে সাদা ছিল, ফাঙ্গাস পড়ে কালচে হয়ে গেছে এখন। হাত দিয়ে শ্রাউডের এক মাথা ধরতেই ছিঁড়ে উঠে এলো বেশ খানিকটা। নিচে টুটাফাটা ফোর্ক কোটপরা অবিকৃত লাশ! এও কী সম্ভব! এতদিনে হেজেমজে যায়নি কেন! কফিনের মতোই ধূসর রং। কেমন যেন অদ্ভুত আর অস্বাভাবিক। একজন মানুষের শরীর তো এমন হয় না! লাশের গায়ে হাত দিলো ম্যাডাম জুই। লোহার মতো শক্ত, তবে তেমন ঠান্ডা না। কাঠের ডামি! রক্ত-মাংসের জীবন্ত কোনো শরীর না।

টংয়ের দেহ নেই এখানে!

মানুষকে ধোঁকা দেওয়ার জন্যে কাঠের লাশ রাখা হয়েছে কফিনে। ডামি উলটে ভালো করে কফিনের ভেতরটা দেখল। কিছুই পাওয়া গেল না। কোথায় পাণ্ডুলিপি আর কোথায় কী! খুব বেশি অবাক হলো না সে। এখানে পাণ্ডুলিপি পাওয়া যাবে, এমন কোনো স্ট্রং হাঞ্চ তার কখনই ছিল না। তবে আশা ছিল কোনো সূত্র মিলতে পারে। এখন দেখা যাচ্ছে পুরোটাই ফক্কা!

.

আধঘণ্টা পর বেরিয়ে এলো ম্যাডাম জুই। সবার নজর তার হাতের দিকে। দুই হাত সম্পূর্ণ খালি! থমথম করছে মুখ। “কিছু পেলেন?” বাঁশির মতো তীক্ষ্ণ গরায় জিজ্ঞেস করল ট্যুরিস্ট গাইড।

“না। কিছু পাইনি। একদম খালি কফিনের ভেতরটা। লাশ, কংকাল কিচ্ছু নেই। টংকে ওখানে সমাহিত করা হয়নি।”

“তাহলে কী আছে ওখানে?”

“গিয়ে দেখে আসেন,” গ্লাভস খুলতে খুলতে বলল ম্যাডাম জুই।

ট্যুরিস্ট গাইড সমাধি দেখে আসার পর দীনবন্ধু গেল। কিছুক্ষণ পর ফিরে এলো সে-ও। তবে তার হাতে ছয় বাই তিন ইঞ্চি মাপের কাঠের ছোটো একটা টুকরো। উপরে উঠতেই আব্দুল খান বলল, “আপনার হাতে ওটা কী?”

“এই একটা কাঠের টুকরো। ভাবলাম খালি হাতে যাবো, সাথে করে নিয়ে যাই বরং।”

“কোথায় পেলেন ওটা?”

“ডামি লাশের মাথার নিচে ছিল। কফিনের সাথে প্রায় মিশেই গিয়েছিল। ভালো করে দেখতেই মনে হলো আলগা কাঠের টুকরো ওটা। সাদা রং করা ছিল এক সময়, লাল কালিতে এক পিঠে চীনে ভাষায় কী যেন খোদাই করা রয়েছে।”

একটা চেয়ারে বসে ছিল ম্যাডাম জুই। তার দিকে কাঠের টুকরোটা এগিয়ে দিয়ে দীন বলল, “ম্যাডাম, একটু পড়ে দেখুন তো কী লেখা আছে এখানে।

টুকরোটা হাতে নিয়ে এক পলক তাকিয়ে দেখল ম্যাডাম জুই তারপর নিরাসক্তভাবে বলল, “তুদিগং।

“তুদিগং কী?”

“চীনেরা বিশ্বাস করত আমাদের যে প্রকৃতি তার দুজন দেব- দেবী রয়েছে। এ দুজনকে একসাথে তুদিগং বলে।”

“অর্থাৎ ওই যে চীনেমনতলার খোদাখুদির মন্দির ওটা আসলে এই তুদিগংয়ের মন্দির?”

দীনবন্ধুর কথা শুনে একটু চমকে উঠল ম্যাডাম জুই। ডুবে গেল গভীর চিন্তায়। এদিকে প্রশ্নের কোনো জবাব না পেয়ে তার দিকে তাকাল সে। বলল, “কী ধারণা আপনার, ম্যাডাম?”

“ও হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন আপনি। ওটা আসলে তা-ই। তবে এর ভেতর আরও গভীর একটা বিষয় আছে মনে হচ্ছে। টংয়ের কাজকর্ম যতটুকু বুঝতে পেরেছি তাতে মনে হচ্ছে ওই তুদিগং একটা ব্লু। প্রশ্ন হলো ওটা কী নির্দেশ করছে?”

“আমার ধারণা ওটা ওই মন্দিরের কথা বলছে,” অনেক্ষণ পর এইবার কথা বলল শরৎ বাবু।

আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন তিনি কিন্তু তার আগেই বীরেণ এগিয়ে এলো। বলল, “মাস্টার মশাই, যদি অনুমতি দেন তো সিল করে দিই টানেলের মুখ। ওটা যে কবর অব্দি গিয়েছে সেইটে কাউকে জানতে দেওয়া যাবে না। পুরো সুড়ঙ্গ বুজাতে গেলে মেলা সময় লাগবে। ওটা আমাদের লোকদের দিয়ে করিয়ে নেবো। কি, যাবো এখন?”

“নিশ্চয়। যাও, যা করার করে এসো।

বীরেণ চলে যাওয়ার পর আবার আগের কথার খেই ধরলেন শরৎ বাবু। বললেন, “আমার মনে হয় মন্দিরে গিয়ে খোঁজ নেওয়া দরকার একবার। কোনো না কোনো সূত্র ওখানে নিশ্চয় আছে।”

“কীসের সূত্র আছে ওখানে?”

“টংয়ের সমাধির। বোঝায় যাচ্ছে টংকে অন্য কোথাও দাফন করা হয়েছে। একটা জলজ্যান্ত লাশ তো আর বাতাসে উবে যাবে না। যতদূর ধারণা করতে পারি, মৃত্যুর আগেই কী করতে হবে আর কোথায় তাকে কবর দিতে হবে সেইটে সে তার বিশ্বস্ত লোকদের বলে গিয়েছিল। বিশেষ করে তার বউ আর মেয়েকে।”

“আর তার কবর কোথায় হয়েছে সেই সূত্র রেখে দেওয়া হয়েছে ওই মন্দিরে?”

“আজ্ঞে, হ্যাঁ।”

“কিন্তু মন্দিরে ওই ধরনের ক্লু রেখে কী লাভ?”

“টংয়ের লাভ-লোকসানের হিসেব তো আর আমি দিতে পারবো না। কী ভেবে কী করেছে সেটা শুধু সে-ই বলতে পারবে। আমি কেবল আমার ইন্ট্যুইশনের কথা বলছি।”

“তা না হয় বুঝলাম, কিন্তু আপনার হাইপোথেসিস কী বলে?”

“হাইপোথেসিসের কথা যদি বলেন তাহলে বলবো টং জানত—হাজার বছরেরও ঢের বেশি সময় ধরে টিকে আছে এ অভিশপ্ত পাণ্ডুলিপি। ভবিষ্যতেও থাকবে। কেউ না কেউ কোনো না কোনোভাবে একে খুঁজে বের করবেই। এবং সেইটে যেন তার স্বজাতীয়রা করে সে ব্যবস্থা করে রেখে গেছে সে। তবে এটা দুর্বল যুক্তি, একান্তই আমার ব্যক্তিগত অভিমত।”

“দুর্বল হোক আর যাই হোক ওই যুক্তি ধরেই এগুতে হবে আমাদের। মন্দিরে ঢুকে দেখতে হবে কী আছে ওখানে।”

“আপনি মন্দিরও খুঁড়তে চান নাকি? এই খোঁড়াখুঁড়ি আর কতদিন চলবে রে বাবা!” ফোড়ন কাটল আব্দুল খান। “তবে একটা কথা কী জানেন, চোরের দশ দিন আর গেরস্তের একদিন। ধরা পড়লে সর্বনাশের মাথায় বাড়ি পড়বে, এই বলে রাখলাম হ্যাঁ।”

“মন্দির খোঁড়া সম্ভব না। খোঁড়ার প্রয়োজনও নেই। চীনা মন্দির দেব-দেবী আর ভগবানের আবাস। ওখানে মর্ত্যের কারও কবর হয় না।”

“তাহলে ওখানে গিয়ে খুঁজবোটা কী?”

“আমি জানি না। কিন্তু গিয়ে দেখতে ক্ষতি কী? হারাবার তো কিছু নেই। আছে?”

“আজ্ঞে, না। চাইছেন যখন তো চলুন। কিন্তু আপনিই বলেছেন, শুধু ফেব্রুয়ারি মাসে খোলে ওটা। এখন এপ্রিল মাস। মন্দিরে ঢুকতে হলে অপেক্ষা করতে হবে আরও দশ মাস!”

“পরশু মন্দিরে ঢুকবো আমরা। কীভাবে ঢুকবো আমার ওপর ছেড়ে দিন। আমি বলি কী, আজ যে যার মতো নিজ নিজ ডেরায় ফিরে যাই আমরা। পরশুদিন আমার ওখানে গাড়ি নিয়ে সকাল নটায় চলে আসুন আপনারা। তারপর সোজা এখানে। ঠিক আছে?”

“আজ্ঞে, হ্যাঁ, উত্তর দিলেন শরৎ বাবু।”

৫৯

মঙ্গলবার দিন সকালে চীনেমনতলা আসতে আসতে সোয়া এগারোটা বাজলো। গেটের সামনে সহকারীকে নিয়ে মন্দিরের অধিকারী দাঁড়িয়ে আছেন। পরনে দাওয়িস্টদের পোশাক। চীনে আলখাল্লার ওপর ঈদের জামাতে ইমাম সাহেবদের পোশাকের মতো লাল রঙের তোয়াব। চকচকে, কামানো মাথা। চোখে কালো ফ্রেমের মোষের শিং চশমা। মুখে থুতনির কাছ থেকে লম্বা দাড়ি। তার সাথে যোগ হয়েছে ঠোঁটের ওপর থেকে ঝুলে পড়া বেজির লেজের মতো গোঁফ। পায়ে কাঠের জুতো। আলখল্লার হাতার ঘের দেখলে হতবাক হতে হয়। পুরোহিতকে মাথা নুইয়ে বাউ করল ম্যাডাম জুই। উত্তরে ছোটো করে মাথা নামালেন অধিকারী, সেই সাথে তার সহকারী। সহকারীর পরনে সাদা রঙের হানফু। এরও জামার হাতা দেখবার মতো বড়ো। পায়ে ক্যাম্বিস কাপড়ের সাদা জুতো।

“আমার শ্রদ্ধা গ্রহণ করুন, মাননীয় লাউ মিন সান,” বলল ম্যাডাম জুই।

“মহান তুদিগং আপনার মঙ্গল করুন,” জলদ গম্ভীর গলায় উত্তর দিলো পুরোহিত।

তারপর চীনে ভাষায় কী সব বলল ম্যাডাম জুই। ঘুরে দাঁড়ালেন পুরোহিত। বললেন, “অনুগ্রহ করে আপনারা আমাকে অনুসরণ করুন।”

ঘেসো চত্বর পেরিয়ে হলদে রঙের পাঁচিলের ভেতর মাথা নিচু করে কাঠের তৈরি খাটো লাল রঙের দরজা পেরিয়ে মন্দিরে ঢুকল চারজন। বেঁটে দরজার ওপরে আর দুপাশের চৌকাঠের পাশে সাদা মার্বেল স্ল্যাবের ওপর লাল রঙের চীনে হরফ লেখা। গেট পেরিয়ে আড়াআড়ি লম্বা করিডোরে পেল্লাই সাইজের লম্বা লাল ডাইনিং টেবিল। পালাপার্বনে এখানে খাওয়া-দাওয়া করে ভক্তরা। কিছুদূর গেলেই প্রকাণ্ড হলঘরের মতো জায়গা। ভীম মোটা কাঠের কড়িবর্গা দেওয়া নিচু ছাদ। হলদে রঙের দেওয়াল, লাল রঙের কড়ি-বর্গা। পুরো মেঝে জুড়ে কাঠের তৈরি মাঝারি আকারের দোলনার মতো এক ধরনের ফ্রেম। ফ্রেমের রেলিংয়ে আড়আড়ি লাল রঙা লোহার পাতি লাগানো। চীনেদের আরধনার জিনিসের অভিনবত্ব এক অনন্য ব্যাপার! কাঠামোগুলোর রেলিংয়ের ওপর লাল রঙের ডজন ডজন মোমবাতি জ্বলছে। ফ্রেমের চার মাথায় চারটে পাঁচ ফুট উঁচু কাঠের স্ট্যান্ডের ওপর মোটামোটা লম্বাপানা মোমবাতি। এগুলোও লাল। হল ঘরে কোনো মূর্তি কিম্বা ছবি নেই। লাউ মিন সান বললেন, “এটা সাধারণ মানুষের পুজোর নৈবেদ্য দেওয়ার স্থান।”

“ও আচ্ছা,” বলল ম্যাডাম জুই।

শরৎ বাবু জিজ্ঞেস করলেন, “কোনো প্রতিমা দেখছি না যে। আপনাদের মন্দিরের গর্ভগৃহ কয়টা আর কোথায় ওগুলো?”

“এখানে গর্ভগৃহ মোট দুটো। সবগুলোই হলরুমের পাশে। এখান থেকে বেরিয়ে করিডোরে গেলে হাতের বাঁদিকে পড়বে, “ জবাব দিলো ম্যাডম জুই।

“তাহলে ওখানে যাওয়া যাক, নাকি?”

“ওখানে সাবইকে যেতে দেওয়া হয় না,” এবার কথা বললেন লাউ মিন সান।

“দাওশি, আমাদের বলা হয়েছে অন্তত দুজনকে ওখানে ঢুকতে দেওয়া হবে।”

“সে আমি জানি। সাধারণ নিয়মের কথা বলছি। আপনাদের ভেতর কোনো কোনো দুজন ঢুকবেন, চলুন। আমি নিয়ে যাচ্ছি আপনাদের।”

শরৎ বাবু বললেন, “দীনবন্ধু, তুমি ম্যাডামের সাথে যাও।”

“আমি না গিয়ে আপনিই বরং যান, দাদা।”

“উঁহু। কফিনের ভেতর ওই কাঠের টুকরোটা তুমিই খুঁজে পেয়েছ। কে জানে এখানে যদি কোনো ক্লু থাকে, তাহলে হয়তো তোমার চোখেই পড়বে। যাও, আর কথা বাড়িয়ো না।”

আব্দুল খান কথা বলার জন্যে হাত উঁচু করেছিল কিন্তু কোনো পাত্তাই দিলেন না শরৎ বাবু।

ছোটো একটা ঘরের তিন দেওয়াল কটকটে হলুদ। দরজার উলটো দিক অর্থাৎ পেছনের দেওয়াল খয়েরি রঙের মার্বেল পাথরে মোড়া। দেওয়াল ঘেঁষে কোনো বেদি নেই। রয়েছে একই রকম পাথরে মোড়া চওড়া আর মোটা একটা তাক। তাকের ঠিক মাঝ বরাবর একটুখানি একটা বেদির ওপর দেওয়ালের গায়ে কাচে বাঁধানো এক চীনে লোকের রঙিন ছবি। জমকালো কাপড় পরে সোনালি রঙের একটা কারুকাজ করা ডিভানের মতো চেয়ারে বসে আছে সে। বেদির দুপাশে ধুপদানি। ছবির দুধারে রজনীগন্ধার ডাঁটির গোছা। লাল বর্ডারঅলা ছবির ফ্রেমের চারদিক মালার মতো পেঁচিয়ে আছে লাল আর সবুজ রঙের দুসারি ডেকোরেশন লাইট। এটা যে টংয়ের ছবি, সেটি আর কাউকে বলে দেওয়ার দরকার নেই। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সবকিছু দেখল ম্যাডাম জুই আর দীনবন্ধু। নাহ, তেমন কোনো ক্লু নেই কোথাও। খুবই সিম্পল গর্ভগৃহ। এখানে দেখার তেমন কিছু নেই আর।

পুরোহিতের পেছন পেছন দ্বিতীয় গর্ভগৃহে এলো দীনবন্ধুরা। কটা রঙের মার্বেল পাথরে মোড়া দুনম্বর গর্ভগৃহে হলুদ বেদির ওপর নুড়ি পাথর বিছানো। পাথরের ওপর বিরাট এক পেতলের জালা। জালা ভরতি ছোটো ছোটো কাঁকর। কাঁকরের ভেতর লাল টকটকে ফুলদানির মধ্যে থেকে লাল রঙের চ্যাপ্টা কাঠির মতো জিনিস উঠে এসেছে। জালার ওপারের দেওয়ালে মাঝারি সাইজের একটা অ্যালকোভ বা কুলুঙ্গি। কুলুঙ্গির ওপরে লাল ভেলভেটের ঝালর ঝুলছে। ঝালরে সোনালি রঙের তিনটে চীনে হরফ এমব্রয়ডারি করে লেখা। লেখার নিচে আর পাশে ফুলপাতার নকশা। কুলুঙ্গির দুদিকে গোলাপি রঙের ফিনফিনে পর্দা। কুলুঙ্গির ভেতর মাথায় সোনলি রঙের পাগড়ি পরা ঘোর কৃষ্ণবর্ণের দেব- দেবীর গলায় সাদা ফুলের মালা। হলুদ বেদির সামনের প্যাডেস্টালে লাল সিমেন্টের বর্ডারে অক্টাগ্রাম আঁকা। অক্টাগ্রামের মাঝখানে সবুজ জমিনঅলা হেক্সাগ্রাম। হেক্সাগ্রামের সবুজ জমিনে বালু ঘাড়ির ওপর ডেঞ্জার সাইন। অর্থাৎ গুণ চিহ্নের মতো আড়াআড়ি দুটো হাড়ের ওপর মানুষের করোটি। চিহ্নগুলো আঁকা হয়েছে কালো রঙের বর্ডার দিয়ে। ভারী অদ্ভুত এক চিত্র। আশেপাশে কোনোকিছুর সাথে এর কোনো মিলই নেই।

সবকিছু খুঁটিয়ে দেখে হতাশ গলায় ম্যাডাম জুই বলল, “আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ, দাওশি। আমাদের দেখা শেষ। চলুন, বাইরে যাই এখন।”

পুরোহিতকে নিয়ে বইরে বেরিয়ে যাচ্ছে ম্যাডাম জুই কিন্তু তখনও বেদির দিকে তাকিয়ে আছে দীনবন্ধু। দরজার কাছে গিয়ে তাকে ডাকলো ম্যাডাম জুই। বলল, “কী হলো দীন বাবু, ওখানে দাঁড়িয়ে আছেন যে বড়ো। কিছু বলবেন?”

“না, এই আরকি। কী যেন চেনা চেনা লাগছে, অথচ মনে পড়ছে না।”

“আরও কিছুক্ষণ এখানে থাকতে চান আপনি?”

“নাহ, ঠিক আছে। চলুন যাই।”

মন্দির থেকে বেরিয়ে এলো সবাই। পুরোহিতকে ধন্যবাদ জানিয়ে রওনা হলো কোলকাতার উদ্দেশ্যে। চিংড়িপোঁতা পেরিয়ে মহেশতলায় আসতেই ম্যাডাম জুই বলল, “ড্রাইভার, ভালো কোনো রেস্তোরাঁ দেখে গাড়ি থামান। দুপুরের খাওয়া-দাওয়া সেরে নেই এখন।”

কিসমত পাঠান বলল, “এখানকার কোনো ভালো রেস্তোরাঁ আমি চিনি না। তবে চমৎকার একটা ধাবা আছে—বিক্ৰমজিৎ ধাবা। খোলামেলা, পরিষ্কার। খাবারের দামও খুব বেশি না। যদি অনুমতি দেন তো ওখানে গাড়ি রুখতে পারি।”

“বেশ, ওখানেই থামুন তাহলে।”

বিক্রমজিৎ ধাবায় নেমে হাতমুখ ধুয়ে চারজনের একটা টেবিলে বসল শরৎ বাবুদের টিম। বেশ খানিকটা দূরে কিসমত। শরৎ বাবু, দীনবন্ধু, আর ম্যাডাম জুই খেলেন লুচি, আলুর দম, পনির বাটার মাসালা, আর চিকেন টিক্কা। আব্দুল খান বিরানি অর্ডার করল।

খেতে খেতে ম্যাডাম জুই জিজ্ঞেস করল, “শরৎ বাবু, আপনার ইন্টুইশন অনুসারে মন্দিরে গিয়েছিলাম। মেলা টাকা ডোনেশন দিয়ে, প্রভাব খাটিয়ে ওখানে ঢোকার ব্যবস্থা হয়েছে। অথচ যে কারণে মন্দিরে যাওয়া সেইটেই সফল হয়নি। কী করবেন এখন?”

“আপনি আর দীন তো গর্ভগৃহে ঢুকেছিলেন। কোনো ক্লু কিম্বা সূত্র চোখে পড়েনি ওখানে?” নান রুটির সাথে পনির বাটার মাসালা মাখিয়ে খেতে খেতে জবাব দিলেন ভেজিটারিয়ান শরৎ বাবু।

“অন্তত আমার চোখে পড়েনি। দীনবন্ধু কিছু দেখেছে কি না, সে-ই ভালো বলতে পারবে।”

“তুমি কিছু দেখেছ দীন?” প্রশ্ন করলেন শরৎ বাবু।

“তেমন কিছু চোখে পড়েনি, তবে ছোটো একটা খোদাই করা চিত্র দেখে কেমন যেন খটকা লেগেছে।”

“কী ধরনের চিত্র?”

“একটা বালুঘড়ির ওপর ডেঞ্জার সাইনের চিত্র।”

“তো?”

“আগে কোথায় যেন দেখেছি।”

“ব্যস, এই!”

“আজ্ঞে, হ্যাঁ, ওইটুকুই।”

ম্যাডাম জুই বলল, “শরৎ বাবু, আপনাকে আগেই বলেছিলাম গর্ভগৃহে আপনি আসুন। কিন্তু সে পথ মাড়ালেন না আপনি। পাঠালেন দীনবন্ধুকে। কেন যে অমন করলেন, কে জানে!”

“আমি একজন জ্যোতিষী। প্রবল ইন্টুইটিভ পাওয়ার না থাকলে জ্যোতিষ শাস্ত্র চর্চা করা যায় না। আমার স্বজ্ঞা আমাকে যা বলেছে আমি সেই পথে এগিয়েছি। আমি এখনও আশাবাদী কিছু একটা হবে।”

“কিছু একটা কী হবে?”

“বলতে পারবো না। তবে হবে। দীনের মাধ্যমেই হবে। হয়তো একটু ধৈর্য করতে হবে আমাদের।”

“ঠিক আছে, যা ভালো বোঝেন করুন। তবে কী ঘটবে সেই আশায় অনন্তকাল অপেক্ষা করতে পারবো না। আমাদের টাইম কন্সট্রেন্ট আছে। আপনি নিশ্চয় জানেন সেটা।”

খাওয়া শেষ করে আবারও গাড়িতে উঠল সবাই। চায়না টাউনে যাওয়ার আগে ময়দান এরিয়ায় ঢুকল কিসমত। গাড়ি চালাল কুইন্স ওয়ে দিয়ে। চোখে পড়ল ধপধপে সাদা মার্বেল পাথরের দৃষ্টিনন্দন ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল। গাড়ির সবাই ওই নয়নাভিরাম ভবনটা তাকিয়ে দেখছে এমন সময় দীনবন্ধু প্রশ্ন করল, “শরৎদা, ওই ভবনটা কীসের?”

“ওহ, ওটা? ওটা ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল। ১৯০৬ সালে শুরু পনেরো বছর পর শেষ। রানি ভিক্টোরিয়া মারা যান বিশ শতকের গোড়াতেই। তার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তৈরি হয়েছে ওই দালান। আদতে মুসোলিয়াম বা সমাধি সৌধ হলেও, ওটা আসলে মিউজিয়াম। কেন তুমি আগে কখনও দেখোনি ওটা?”

“আজ্ঞে, না। এ পথে আসা হয়নি। অবশ্য নাম শুনেছি অনেক। সমাধি? ওহ হো . . .!”

হঠাৎ কথা থামিয়ে ‘ওহ হো’ বলে আচমকা থেমে যাওয়াতে অবাক হলো সবাই। শরৎ বাবু জিজ্ঞেস করলেন, “ওহ হো বললে যে বড়ো, কোনো সমস্যা হয়েছে?”

“মনে পড়েছে। এইবার মনে পড়েছে।”

“কী মনে পড়েছে?”

“ওই বালুঘড়ি আর ডেঞ্জার সাইন কোথায় দেখেছি।”

“কোথায়?”

“বাবুলবোনা সেমেটারিতে।”

“অ্যাঁ, বাবুলবোনা রেসিডেন্সি সেমেটারিতে!”

“আজ্ঞে, হ্যাঁ। একটা সমধির ওপর।”

“ওখানে তো আমারও গিয়েছি। কই এমন কিছু তো আমাদের চোখে পড়েনি!” আব্দুল খানের গলার স্বরে স্পষ্ট অবিশ্বাস।

“আপনারা দেখেননি কারণ প্রথম বাইলেন ধরে ডান দিকে এগুলে বেশ কিছুটা ভেতরে ওই কবরের অবস্থান। বেশ বড়ো স্ট্রাকচার। আর খুবই অন্য রকম।”

“তাই নাকি! তো তখন বললেন না কেন?”

“বলে কী হবে? আমরা যে সমাধি খুঁজছি তার সাথে তো ওটার কোনো সম্বন্ধ নেই। হঠাৎ করেই চোখে পড়েছিল, তাই দেখেছি।”

“ঠিক আছে এ নিয়ে এখন আর কোনো কথা নয়। কাল সকাল দশটায় সাইকিক সেন্টারে আসুন আপনারা। তখন ডিটেল আলোচনা করবো। যত্রতত্র এসব নিয়ে কথা না বলাই ভালো,” কিসমতের দিকে চোখের ইশারা করে বলল ম্যাডাম জুই।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন