নজ্জুমি কিতাব – ৫

অনেক চেষ্টা করেও জমির সরদারকে কোনো টাকা দিতে পারল না অর্জুনেরা। বুড়োর নাতনির হাতে পঞ্চাশ টাকার নোট ধরিয়ে দিয়ে দীন বলল, “মিষ্টি কিনে খেয়ো।”

মুড়ি-মুড়কি আর ডাবের পানি খেয়ে ফিরতি পথ ধরল সবাই। আবারও পাড়ি দিতে হবে বিস্তর পথ। টমটমে চড়ার ঠিক আগে মাওলানা ঘুঘুরকে জিজ্ঞেস করলেন, “বাবা ঘুঘুর, কুষ্টিয়া শহরে যাওয়ার অন্য কোনো সহজ রাস্তা আছে কি না বলতে পারবে?”

“আছে, হুজুর। আপনারা হরিপুর হয়ে কুষ্টিয়া না গিয়ে বরং কয়া দিয়ে চড়ুইকোল যান। ওখানে ট্রেন পাবেন। না পেলেও সমস্য হবে না। ঘাটে নৌকো সব সময় থাকে। গড়াই পেরুলেই ওপারে লাহিনি পাড়া, মীর মোশাররফ হোসেনের বাড়ি। এরপর ছেঁওড়িয়ায় লালন শাহের আখড়া। তারপর মোহিনী মিল! এখান থেকে চড়ুইকোল অব্দি টমটম, ঘাট পার হয়ে রিক্সা। হাঁটতে হবে না এক পা-ও। আর যদি ট্রেন পেয়ে যান তাহলে তো কথাই নেই।”

“আরে বাপ্স। তুমি তো দেখি ভারী বুদ্ধিমান ছেলে! কোনো কবি-সাহিত্যিকই বাদ দিচ্ছ না। রবি ঠাকুরের বাড়িটার কথা তো বললে না। পথে পড়বে না ওটা?” হাসতে হাসতে বলল দীন।

“পড়বে, বাবু। কয়া রোডে উঠে হাতের ডানে না গিয়ে বামে মাইলটাক গেলেই শিলাইদহ কুঠিবাড়ি। কিছুটা উলটা ঘুরতে হবে আপনাদের।”

“তুমি তো মনে হচ্ছে বেজায় ঘোরাঘুরি করো!”

“ঠিকই ধরেছেন, বাবু। সেই ছোটো বেলা থেকেই এই স্বভাব। বাড়ি থেকে পালিয়ে ঘুরে ঘুরে বেড়াতাম। ঘরের থেকে বেশি টানত বার। এখনও তা-ই। শেষমেশ আমার নামই হয়ে গেল ঘুরঘুর সেখান থেকে ঘুঘুর!”

.

চড়ুইকোল রেল স্টেশনের কাছে অর্জুনদের নামিয়ে টমটমঅলা আর ঘুঘুর হরিপুর ফিরে গেল। গ্রাউন্ড লেভেল থেকে পঞ্চাশ ফুট উঁচুতে স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে কালঘাম ছুটে যায়। বাংলাদেশের সব থেকে ছোটো স্টেশন বোধ হয় এটাই। ঝকঝকে তকতকে। হু হু হাওয়ার মাতম। ডানে-বাঁয়ে আদিগন্ত ফকফকে বালু ঘেঁষে নীল জল, সামনে লাল টকটকে গড়াই ব্রিজ। এখানে স্টেশন হওয়ার কথা না। সম্ভবত রবি ঠাকুরের জন্যে হয়েছিল। নিজ বাড়ি যেতে হলে ঠাকুরের জন্যে এ স্টেশনে নামাই সর্বোত্তম। স্টেশনের নামকরণেও তার ভূমিকা অসীম। পুরো স্টেশনে দুজন মাত্র লোক। স্টেশন মাস্টার আর সিগন্যাল ম্যান। প্ল্যাটফর্মে বেঞ্চ একটাই। বারোআনা দিয়ে তিনটে টিকেট কিনে হাত-পা ছড়িয়ে বসল সবাই। ভাগ্য ভালো রাজবাড়ি থেকে ছেড়ে আসা দর্শনা লোকাল দেড় ঘণ্টা লেট। কুমারখালি পাস করেছে, এসে যাবে যেকোনো সময়। বিকেলের পড়ন্ত আলোয় অলসভাবে বইটার পাতা ওলটাচ্ছেন মাওলানা। হঠাৎ শেষের দিকের একটা চ্যাপ্টার দেখিয়ে বললেন, “এইখানে একটা অদ্ভুত ব্যাপার আছে। কাহিনি পরম্পরার সাথে এই অধ্যায়টার কোনো মিল নেই। ছাপাও হয়েছে কিছুটা মোটা হরফে। ভাষাও ফারসি না, আরবি। যদি অনুমতি দেন তো বাসায় নিয়ে পড়ে দেখতে চাই। কী নেব?”

দীন বলল, “নেন না। কে মানা করছে? আমাদের ভেতর আপনিই শুধু ফারসি পড়তে পারেন। পড়ে দেখে তারপর জানান কী লেখা আছে ওখানে।”

দীনবন্ধু আর মাওলানা নেমে গেল কুষ্টিয়া বড়ো স্টেশনে। ওরা যাবে আড়ুয়া পাড়া। দীনমণি বালিকা বিদ্যালয় ওখানেই। স্কুলেরই একটা ঘরে মাওলানা থাকেন। দীনমণির বাড়িও ও পাড়াতেই, রাজার পুকুরের পাশে। এর ঠিক তিন মিনিট পর অর্জুন নেমে গেল কুষ্টিয়া কোর্ট স্টেশনে। বাংলাদেশের আর কোনো শহরে এত ঘন ঘন স্টেশন আছে বলে মনে হয় না।

পরদিন সকালে উঠে মোটর সাইকেল মেরে অর্জুন প্রথমে গেল আল্লাহর দরগা, তারপর মথুরাপুর। একেবারে বর্ডারের কাছের এই হাটগুলোয় চৈতালী ফসলের প্রচুর আমদানি। দেখে-শুনে কিনতে পারলে ভালো লাভ। ডালে মেলা ভেজাল থাকে। অড়হরের ভেতর মটর, মাষকলাইয়ের মধ্যে কালিকলাই, মসুরিতে গুটিদানা, খেসারি! কোনোমতে মাল বেচার জন্যে ব্যাপক হুড়োহুড়ি করবে ব্যাপারি। তবে ব্যাপারির তাড়াহুড়োকে পাত্তা দেওয়া যাবে না। তীর্যক মন্তব্য শুনেও বরফের মতো ঠান্ডা রাখতে হবে মাথা। ধৈর্য ধরে খুঁটিয়ে দেখে তারপর দরদাম। ভেজাল মেশানো ডালও কেনা যায়। তবে দাম কম হতে হবে। মহিলা লেবার দিয়ে ভেজাল বেছে বের করারও খরচা আছে। মাল কিনে কাঁটা করে বস্তায় ভরো। ছোটো ট্রাকে লোড দিয়ে ভালো করে ত্রেপল দিয়ে ঢাকো। বৃষ্টিতে যেন না ভেজে। গাড়ির পিছে পিছে বাইক নিয়ে ফলো করো। বস্তায় বোমা (লোহার তৈরি এক ধরনের ফাঁপা সুই জাতীয় যন্ত্র) মেরে কয়েক কেজি সরিয়ে ফেললে, লাভের কুঁড়ি অঙ্কুরেই বিনাশ। এন্তার দৌড়া-দৌড়ি।

আল্লাহর দরগা-মথুরাপুর হাট শেষ হলে অর্জুনকে যেতে হলো গাঙনি-বামুন্দি হাটে। সারাদিন হাটে হাটে ঘুরে সন্ধেয় ট্রাক বোঝায় মাল এনে বাড়িতেই স্ট্যাক করল সে। সুযোগ পেল না মোকামে যাওয়ার।

তিনদিনের দিন মালের সব বস্তা নিয়ে দোকানে গেল সে। সর্টিং, কাঁটা করা, গোডাউনে ভরা—এইসব হবে। অনেক সময়ের ব্যাপার বস্তা খুলে মাল আগে ঢালতে হবে দোকানের ভেতর মেঝের ওপর। বস্তা-খোলা, মাল-ঢালা চলছে, এমন সময় দীনবন্ধুর বাবা এলেন। কপালে চন্দনের তিলক, গলায় রুদ্রাক্ষের সরু মালা, পরনে ধুতি, পায়ে কাঁঠাল কাঠের খড়ম। প্রচণ্ড রাশভারী লোক। কোনোদিন অর্জুনের দোকানে আসেননি। চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠে তাকে প্রণাম করল সে। বলল, “আমার চেয়ারে বসেন, খুড়ো। আমাকে ডেকে পাঠালেই পারতেন। কষ্ট করে আসার কী দরকার ছিল?”

দাঁড়িয়েই রইলেন তারিণী মিত্র। বললেন, “দুদিন হলো দীন নিখোঁজ। তুমি জানো কিছু, অর্জুন?”

“না তো! গত তিন দিন শহরেই ছিলাম না। আজই মোকামে এসেছি। একেবারে কী কিছুই জানায়নি?”

“চিঠি লিখে রেখে গেছে, দুদিনের জন্যে নাকি ঢাকা যাচ্ছে।”

“তাহলে ঢাকাতেই গেছে।”

“উঁহু। ঢাকা গেলে টিকটুলিতে ওর ভাবনা মাসির ওখানে ওঠে। কাল ভাবনা বেড়াতে এসেছিল আমাদের বাসায়। এই ছেলে বাবার সাথে মিথ্যাচার করছে, ভাবতেও কষ্ট হয়।”

“মিথ্যাই বা বলবে কেন? আর যাবেই বা কোথায়? ঘোরাঘুরি কোনোকালেই দীনের পছন্দ না।”

“আমার ধারণা ও গেছে কোলকাতায়। আজ রাজার হাটের সামনে বিশু মেড়োর সঙ্গে দেখা। বিশু হুন্ডির কারবারি। কোলাকাতায় লোকও পাঠায়। বিশু বলছে তার লোকের সাথে দীনবন্ধু বর্ডার পার হয়েছে দুদিন আগে! বিশুকে দীন বলেছে ‘কোলকাতায় যেতে হবে, দর্জি পাড়ায় পিসেমশাই ভবতারিণীর ওখানে। বিশেষ প্রয়োজন।”

“কিন্তু এমন আচরণ কেন করবে দীন? সারা জীবন চিনি ওকে। ধীর-স্থির, গম্ভীর, অতি দায়িত্ববান।”

“ও হ্যাঁ। আরেকটা কথা। তোমরা মাওলানাকে সাথে নিয়ে কোথায় যেন গিয়েছিলে। সেই মাওলানা মারা গেছেন।”

“কী বলছেন আপনি, খুড়ো! কবে মারা গেছেন?”

“স্কুল-অফিসের পাশেই এক কামরায় থাকতেন মাওলানা। ভোরে উঠে নামাজ পড়ে নিজেই রান্না-বান্না করতেন। সোমবার বেলা দশটা বেজে যাচ্ছে, মাওলানার ওঠার নাম নেই। স্কুলের চাপরাশি-দারোয়ান দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকে দেখে: মেঝের ওপর ঘাড় উলটে পড়ে আছেন মাওলানা। ওদের সাথে দীনবন্ধুও ছিল। সে-ই দারোয়ানকে বলে ডাক্তার ডাকতে, পুলিশে খবর দিতে। জানোই তো, মেয়েদের স্কুলের ব্যাপার। অপমৃত্যু হলেও ডিসি সাহেবের নির্দেশে স্বাভাবিক দেখাতে হয়েছে। মাওলানা ছিলেন মালদা জেলার লোক। এখানে ঢাকায় নাকি আত্মীয় আছে। তবে কেউ সেই আত্মীয়ের ঠিকানা জানে না। লাশ দাফন করা হয়েছে কুষ্টিয়া পৌর গোরস্থানে!”

“খুড়ো, দীনের কোনো খোঁজ যদি পাই, অবশ্যই জানাবো আপনাকে।”

.

সন্ধে ঘনাতেই দোকান বন্ধ করে দীনমণি বালিকা বিদ্যালয়ে গেল অর্জুন। গেটের সামনেই দারোয়াকে পেল সে। রাস্তার উলটোদিকে দোকানে বসে চা খাচ্ছে। সোজা দারোয়ানের কাছে গিয়ে বলল, “এই। এদিকে এস।”

চায়ের কাপ বেঞ্চির ওপর রেখে উঠে এলো দারয়োন। অর্জুন জিজ্ঞেস করল, “মাওলানার ঘরের দরজা ভেঙেছিলে তুমি?”

“জি।”

“সাথে দীনবন্ধু ছিল?”

“জি।’

“ভেতরে কী দেখতে পেয়েছিলে? কোনো কিছু লুকোবে না। পুরোটা বলো।”

“চকির পাশে ঘাড় ভেঙে চিত হয়ে পড়ে ছিলেন মাওলানা সাহেব, গায়ে কাপড় নেই। বিছানার ওপর লাট খাচ্ছে লুঙ্গি, গেঞ্জি। কণ্ঠার হাড় বেরিয়ে এসেছিল। মাথা প্রায় কাঁধের নিচে। আধপোড়া মোমবাতি, খাসির কাটা মাথা, মেঝের ওপর চক দিয়ে কী সব হাবিজাবি আঁকা!”

“কী রঙের মাথা?”

“কালো রঙের।”

“মাওলানা সাহেব রাত দুপুরে খাসি পেলেন কোথায়? রাজার হাটের কসাইরা রোববার সন্ধের পর চলে যায়। মিউনিসিপ্যালিটি বাজারের অবস্থাও ওই একই।”

“মাওলানা সাহেবের নিজের খাসি ওটা। ফি বছর বাচ্চা খাসি পেলে বড়ো করে কুরবানি দিতেন। স্কুলের মাঠের এক কোনায় খাসির ঘর আছে।”

“লাশ দেখতে পাওয়ার পর দীনবন্ধু ঠিক কী বলেছিল?”

“স্যার বলেছিলেন, ‘তোমরা দুজন বাইরে গিয়ে খবর দাও। ডাক্তার ডাকতে হবে, থানাতেও জানাতে হবে। হেড মিস্ট্রেসকে গিয়ে আগে বলবে সবকিছু। এদিকটা আমি দেখছি। ম্যাডামকে বলবে লাশের অবস্থা খারাপ। উনার না দেখাই ভালো। বুঝেছ? নাও, ঘরের বাইরে যাও এখন’–ব্যস, এই টুকুই। আর কিছু না।”

“মেঝের ওপর আর কিছু পড়ে থাকতে দেখোনি। কোনো বই- টই?”

“আঁকিবুকির ভেতর একটা কালো বইয়ের মতো কী যেন দেখেছিলাম। পাতা খোলা ছিল।”

“এ কথা প্রথমেই বলোনি কেন?”

“ভুলে গিয়েছিলাম। পরের বার ঘরে ঢুকে ওটা আর দেখতে পাইনি কি না!”

তিনদিন পর সকালে দোকান খুলে বসেছে অর্জুন। মাল সর্টিং হচ্ছে, এমন সময় মতলব ধাড়ি ঢুকল। লোকটাকে দেখেই পিত্তি জ্বলে গেল তার। বলল, “দিন শুরু হতে না হতেই বেচা-কেনা শেষ! আপনি তো ভাই চরম ব্যাবসা করছেন। দেন, খেরো-খাতা দেন। কী লিখতে হবে লিখে দেই। সর্টিং চলছে, ব্যস্ত আছি।”

অর্জুনের কথা গায়েই মাখল না ধাড়ি। রাজ্যের শব্দ করে চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলল, “সরি ভাই, ওই দিন সময় দিতে পারিনি আপনাদের। কী আর করব বলেন, শ্বশুরের মৃত্যু বলে কথা। গতকাল রাতে ফিরেছি। আপনার ভাবী এখনও বাপের বাড়ি কুমারখালিতে। কেঁদেই যাচ্ছে। আরে বাবা, বাপ-মা কী চিরকাল বেঁচে থাকে!”

“হুম। খুবই ঠিক কথা।”

“আমরা মূর্খ মানুষ। ঠিক কথা আর কীভাবে বলবো? ঠিক কথা বলবে আপনাদের মতো শিক্ষিতেরা। যাক গে এসব। ঘুঘুর বলল, বইটা চেয়ে এনেছেন। কী, ঠিক বলেছিলাম না?”

“না। ঠিক বলেননি। ওটা একটা মহাকাব্য, ফেরদৌসির শাহনামা। বয়স দেড়শো বছর।”

“অ। তা-ই? তা আপনার বন্ধু কোথায়? উনার মুখ থেকেই না হয় শুনতাম।

“তার মুখ থেকে কী শুনতেন?”

“এই যা বললেন আর কী—মহাকাব্য, দেড়শো বছর এইসব। আজকে আসবে নাকি আপনার বন্ধু?”

“আসতে দেরি হবে। ও এখন শহরের বাইরে।”

“বেশ তো অপেক্ষায় থাকলাম। যদি আদৌ কোনোদিন ফিরে আসে, তো খবর দেবেন। নজুমি কিতাব বড়ো ভয়ানক জিনিস ভাই। এর পায়ে পায়ে মৃত্যু। একবার কেউ ওটা খুলেছে তো মরেছে। এ হলো মতলব মূর্খের জ্ঞান!”

কথা শেষ করে খল খল করে হাসতে লাগল মতলব ধাড়ি। বলল, “এখনও নাস্তা হয়নি। লেডুয়া বিস্কুট আর চায়ের অর্ডার দেন না। চা-বিস্কুট খেতে খেতে দুটো জ্ঞানের কথা হোক!”

৭১০ খৃস্টাব্দ। ঘামদান প্যালেস, সানা। নতুন করে তৈরি হয়েছে বিখ্যাত জামে মসজিদের পুব তোরণের কাছে গড়ে তোলা এই প্রাসাদ। তবে এর ইতিহাস পুরনো। এটা বানানো শুরু করেন নূহ (আ.) নবির ছেলে শাম, মহা প্লাবনের পরে। সেই যে শুরু, শেষ আর হয় না। পেরিয়ে গেল হাজার হাজার বছর। এর ভেতর কত নবি-রাসুল যে এলেন আর গেলেন! শেষমেশ নির্মাণ শেষ হলো খ্রিষ্টের জন্মের সাতশো বছর আগে, স্যাবিয়ান রাজা শারহা ইয়াদিবের হাতে। পুরাকালে বিশতলা উঁচু এই স্কাইস্ক্র্যাপার এক দেখার জিনিস ছিল। প্রকাণ্ড ইমারতটাকে ঘিরে গড়ে ওঠে অসংখ্য হাইরাইজ ভবন। মরুভূমির ম্যানহাটান। বিশতলা উঁচু হামদান প্রাসাদের এক-একটা তলা ছিল পনেরো ফুট উঁচু। ভবনের চার দেওয়াল চার-রঙা পাথরে তৈরি: সাদা, কালো, সবুজ, আর লাল। এক্কেবারে ওপরের তলায় প্রকাণ্ড এক বর্গাকৃতির হলঘর। এই ঘরকে বলা হতো বিলকিসের কামরা। দশফুট চওড়া জানালাগুলোর ধপধপে সাদা মার্বেল পাথরের গোবরাট কালো আবলুস কাঠে তৈরি। জানালার ওপারে খিলান দেওয়া চওড়া, টানা বারান্দা। বিছানায় শুয়ে রাজপুরুষেরা যেন আকাশে ওড়া পাখি দেখতে পান—এই কারণে এর ছাদ ছিল স্বচ্ছ সবুজ মার্বেলের। এমনই স্বচ্ছ সেই শ্বেতপাথর, ভেতর দিয়ে তাকালে দূর আকাশে উড়ে যাওয়া পাখিদের ভেতর কোনটা কাক আর কোনটি চিল—তা বোঝা যেত অতি সহজেই। হলঘরের ছাদের ওপর চারকোনায় চারটে পেতলের পেল্লায় সিংহ-মূর্তি। দুর্দান্ত প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছিল এই সিংহগুলোর পেটের ভেতর। এগুলোর হাঁ করা মুখ দিয়ে হাওয়া ঢুকে পেছন দিক দিয়ে বয়ে গেলে প্রলয়ংকরী সিংহনাদ ছড়িয়ে পড়ত প্রাসাদ চত্বর থেকে তিনশো ফুট ওপরে আকাশের বুক অব্দি। তবে এটাই শেষ আশ্চর্য না, অদ্ভুত ধরনের এক সময়-বলা ঘড়ি ছিল প্রাসাদটাতে।

হযরত ওসমান (র.) অযুত বছর ধরে তিলতিল করে গড়ে ওঠা এই প্রাসাদটি ভেঙে গুঁড়িয়ে দেন। এর কারণও আছে। সানা ছিল ইহুদি আর খ্রিষ্টানে ভরতি এক পরিচ্ছন্ন, ব্যস্ত নগরী। চোখ ধাঁধানো এর রূপ। খলিফা ওসমান (র.) ইয়েমেনি খ্রিষ্টান আর ইহুদিদের বিশ্বাস করতেন না এক ফোঁটাও। তার ধারণা ছিল, এই দুই জাতি বিদ্রোহ করবে যে কোনোদিন। তিনি ভেবে দেখলেন ইহুদি-খ্রিষ্টানরা যদি বিদ্রোহ করে আর এই অতিকায় ভবন দখলে নেয়, তাহলে ওই গন্ধমাদনের ভীম মোটা দেওয়াল গুঁড়িয়ে বিদ্রোহ দমন করা হবে বিরাট মুশকিল। তার চেয়ে বরং পুরনোটা ভেঙে ওরই মাল-সামান দিয়ে হালকা-ফুলকো ধরনের নতুন একটা বানানো যাক। নাম বদলে আর কী হবে, বরং ঘামদান-ই থাক।

তো এই ঘামদান প্রাসাদের রজকীয় শোবার ঘরে মখমলে মোড়া আরবি ডিভানে গন্ডারের মতো মোটা সাটিনে মোড়া তাকিয়ায় হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে আছেন গভর্নর, আব্বাদ আল রুইয়ানি। জামে মসজিদে জুম্মার নামাজ পড়ে কেবলই খাওয়া- দাওয়া সেরেছেন। মাথার ওপর সোনালি ঝালরঅলা বহুমূল্য চামরি দোলাচ্ছে হাবশি দাসিরা। চামরিতে মেশকে আম্বর ছিটিয়ে রাখার কারণে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে অপার্থিব খুশবু। সরু ঠোঁট টিপে গভীর ভাবনায় ডুবে আছেন রুইয়ানি। কামরার জানালা দিয়ে লম্বা হলওয়ে দেখা যায়। মাঝে-মাঝে মুখ তুলে ওদিকে চাইছেন তিনি। নজর পড়ছে হলওয়ের শেষ মাথায় হেরেমের সোনার পানি দিয়ে ধোয়া খিলানঅলা পেল্লায় দরজার ওপর। দেখেই বোঝা যাচ্ছে কারও জন্যে অপেক্ষা করছেন রুইয়ানি

হঠাৎ দড়াম করে খুলে গেল হেরেমের দরজার পাল্লা। আসমানি রঙের নেকাব, সাদা কাঁচুলি, আর বেগুনি ঘাগরা পরা এক যুবতীর মাথার চুল ধরে হিড়হিড় করে টানতে টানতে ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো সাদা ধপধপে কাফতান পরা খোজা দারফুর। ঘোড়ার মতো লম্বা মুখ, ধ্যবড়ানো নাক, ইয়া মোটা ঠোঁট, ষাঁড়ের কাঁধ, বাইন মাছের মতো কিলবিলে পেশি। মিশমিশে কালো সাতফুট লম্বা এই দারফুর জাতে সুদানি কাস্ত্রাতি। তিন শ্রেণির খোজার ভেতর এক নম্বরে আছে এই কাস্ত্ৰাতি গোত্র। একেবারে গোড়া থেকে কেটে ফেলা হয় এই স্তরের খোজাদের পুরুষাঙ্গ আর অণ্ডকোষ। ভয়ঙ্কর সে অস্ত্রোপচার। অপারশেনের পর টিকে থাকে কেবল প্রতি তিনজনে একজন। হেরেমের সর্দার এই দরাফুর দৌর্দণ্ডপ্রতাপ। একমাত্র গভর্নর রুইয়ানি ছাড়া আর কাউকে পরোয়া করে না।

দারফুরের জন্ম এক সুদানি ক্রীতদাসীর পেটে, মিশরের তান্তা নগরীতে। দারফুরের কোনো মালিক ছিল না, ছিল এক অসুস্থ মালকিন। রাতদিন বিছানাতেই পড়ে থাকত। ছোটোবেলাতেই দারফুরের কাজ ছল তান্তার রাস্তায় রাস্তায় ঘোরা আর ছিঁচকে চুরি-চামারি করা’ দশ বছর বয়সেই গায়ে-গতরে বেশ বেড়ে উঠেছিল। একদিন ই কটে রেশমি কাপড়ের টুকরো চুরি করে পালাতে গিয়ে কায়রার এক বড়োলোক বণিক আবু সালেবের চোখে পড়ে যায় রিফুর। আবু সালেব জাতিতে কপটিক খ্রিষ্টান। বেপরোয়া আর শক্ত-পোক্ত দারফুরকে দেখে পছন্দ হলো তার, ভেবে দেখ না ভবিষ্যতে গুন্ডা-গার্দি সামলাতে হলে কাজে আসবে এ ছেলে। কিনের কাছ থেকে দারফুরকে কিনে নেয় সে। বারো বছর বয়সেই বেপরোয়া হয়ে ওঠে দারফুর। তার চেয়ে বয়সে চার বছরের “ড়া আবু সালেবের মেয়ের সাথে শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। আগেই বলেছি, ভয়ানক বেপোরোয়া এই দারফুর। ভর দুপুরে হাভেলির পেছনে ডালিম গাছের নিচে এক মার্বেল পাথরে মোড়া ঝরনার পাশে শীতল পরিবেশে ঘনিষ্ঠ হওয়ার সময় হাতেনাতে ধরা পড়ল সে। মালিকের বউ মেয়ের হাবভাব দেখে আগেই সন্দেহ করেছিল। মেয়েটা ইদানিং দারফুরকে দেখলেই গলে পড়ে। গোপনে রসুইঘর থেকে রুপোর থালা ভরতি দুম্বার পেছনের মাংসের কাবাব আর ভাঁড়ার থেকে ভিনদেশি মদিরার বোতল বের করে দারফুরকে মুখে তুলে খাওয়াতে দেখেছে তার মেয়েকে। মেয়ের পেছনে বুড়ি মায়মুনা বাঁদিকে লাগিয়ে রেখেছিল মা। তক্কেতক্কে ছিল মায়মুনা। সে-ই খবরটা দেয়।

হাবশি গোলাম হয়ে কপটিক খ্রিষ্টান মালিকের মেয়ের সাথে লদকালদকি! এত বড়ো স্পর্ধা! ধবধবে ফর্সা কপটিক খ্রিষ্টানদের জাত্যাভিমান ইহুদিদের থেকে ঢের বেশি। তড়িৎ সিদ্ধান্ত নিলো মালিক। একে পিটিয়ে মারলে বিরাট ক্ষতি। খোজা হিসেবে বিক্রি করে দিলে মেলা লাভ। হরিণও মিলবে, তিরও খরচ হবে না। খোঁজ-খবর নিয়ে দারফুরের মালিক জানলো বাজারে তিন ধরনের খোজা আছে। এক জাতের নাম কাস্ত্রাতি। একেবারে গোড়া থেকে অণ্ডকোষ, পুরুষাঙ্গ স-ব কেটে ফেলা হয় এদের। এক রকম পঙ্গু করে ফেলাই বলা চলে। দ্বিতীয় শ্রেণির খোজাদের শুধু অণ্ডকোষ সরিয়ে ফেলা হয়। এই জাতের খোজাদের বলে স্পাদোনি। তিন নম্বরের খোজাদের অণ্ডকোষ লোহার মুগুর দিয়ে ছেঁচে বা থেঁতলে দেওয়া হয়। এরা হলো লাইবিয়ে। কাস্ত্রাতি জাতের খোজাদের সাংঘাতিক দাম। কারণ, এই অস্ত্রপোচারে বেকায়দা ঝুঁকি রয়েছে। সার্জারির পর টিকে যাওয়ার হার মাত্র তিরিশ শতাংশ! এদের সাথে মেয়েরা ঘনিষ্ঠ হবে, সে সম্ভাবনা তিলমাত্র নেই। এই নিশ্চয়তার কারণেই এত দাম এদের।

দারফুরের ওপর মালিকের মারাত্মক রাগ। কষ্ট পেয়ে মরলে, দেখেও শান্তি! আর বাঁচলে তো কথাই নেই। খোজা করা হলো দারফুরকে। একেবারে গোড়া থেকে কেটে ফেলা হলো সবকিছু। এরপর খোজা দাসের দালাল তাকে নিয়ে এলো অ্যালেকজান্দ্রিয়ায়। সেখান থেকে আম্মানের উমাইয়া প্রাসাদের নফরে কবির বা গুরফত নওম[১] বিন হিসাব কিনে নেয় দারফুরকে। এরপর আজলুন বরুজের কাছেই সরকারি মাসউল রাফি[২]য়ের এক হাভেলিতে নিবিড় প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় তাকে। কঠোর পরীক্ষা দিতে হয় বিশ্বাসযোগ্যতার। এরও অনেকপরে সালা[৩] হয়ে শেষমেশ সানায় গভর্নর রুইয়ানির প্রাসাদে এসে পৌঁছেছে সে। হারেমের যত সুন্দরী যুবতী দাসী-বাঁদি আর আশিকা আছে তাদের চোখে চোখে রাখাই দারফুরের কাজ। মুহাফিজ হাকিম রুইয়ানি বয়স্ক মানুষ। এত এত রূপসীদের সন্তুষ্ট রাখা তার পক্ষে অসম্ভব। কিন্তু তাই বলে মুহাফিজ হাকিম বেঁচে থাকতে তার আশিকা অন্যের গলায় মালা দেবে—সেইটে কোনোভাবেই বরদাশত করা যায় না। এ নিয়ম ভাঙলে শাস্তি একটাই। মৃত্যুদণ্ড!

অনিন্দ্যসুন্দরী দাসি রাইদার গায়ের রং দুধে-আলতা। জাতে মরোক্কান। রুইয়ানির বড়ো মেয়ে সুলতানা রুখসানার খাস বাঁদি সে। দারফুর গভর্নরকে খবর দিয়েছে—বেশ কিছুদিন ধরে এই রাইদার চাল-চলন একটু অদ্ভুত ঠেকছে। প্রায়ই দুপুরে কাঠফাটা রোদে প্রাসাদ থেকে বের হয়ে যায় সে। জামে মসজিদের পেছন দিকে খেজুর গাছে ভরা আল-জওফ মরুদ্যানে কার সাথে যেন দেখা করে। বিষয় কী জানার জন্যে তার পেছনে গুপ্তচর লাগিয়েছিল দারফুর। সেই গুপ্তচর দেখেছে: রেশমের টুকরো আদান-প্রদান হচ্ছে রাইদা আর এক আগন্তুকের ভেতর। নাহ আগন্তুকের চেহারা দূর থেকে দেখা যায়নি। কুফিয়া পরে থাকার কারণে ঘাড়-মাথা ঢাকা ছিল তার।

বিষয়টা রুইয়ানের কানে তোলার পরই বর্তমান ঘটনার অবতারণা।

১. প্রধান বেডরুম নফর

২. উচ্চ পদস্থকর্মকর্তা

৩. বর্তমানে রাবাত

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন