দিনে দিনে শুকিয়ে চ্যালা কাঠ আল হযরত। নড়াচড়াই করতে পারে না ঠিকমত। কোনোমতে আধপেটা খেয়ে দিন কাটাতে লাগল।
শুরু থেকেই দামেস্ক শহরের দক্ষিণে কাফ্র সোসা বস্তিতে একটা মাটির ঘর ভাড়া নিয়েছিল আল হযরত। শেয়ার করে থাকত এক একচোখ কানা পঙ্গু ভিখিরির সাথে। নাম—কালান্দার। ভাগ্য ভালো যে কালান্দার তার কাছে কখনও ভাড়া চায়নি! নিজের ওপর বিতৃষ্ণা এসে গেল হযরতের। মেজাজ বিগড়ে গেল তার। ভাবল এমনিতেও মরতে হবে, অমনিতেও মরতে হবে। মরলেও ভালো কিছু হবে না। নরকে বাস করতে হবে অনন্তকাল। তার চেয়ে বরং পটাকে একহাত দেখে নেই। যা কিছু গোপন করার শপথ নিয়েছি, ফাঁস করে দেই সেসব। হ্যাঁ, ঠিক তাই। জীবনের সব অদ্ভুত অভিজ্ঞতা আর মন্ত্র-তন্ত্রের কথা একটা বইয়ে লিখে প্রকাশ করতে হবে জন সমক্ষে। অযুত বছর ধরে লুকিয়ে রাখা সব গুহ্যতত্ত্ব জানতে পারবে আমজনতা!
মুচির কাজ করার কারণে পাতলা কিছু ভেড়ার চামড়া ছিল তার কাছে। ওই চামড়ার টুকরোগুলোতেই বিজবিজে আরবি হরফে প্রাচীন আর নিষিদ্ধ সব দেব-দেবী, মন্ত্র-তন্ত্র নিয়ে লেখা শুরু করল আল হযরত। নাম দিলো—আল আযিফ। সেই সাথে বেজায় যত্ন নিয়ে আঁকলো সিজিল বা যন্ত্রের নকশা-ও। ব্যবহার করল ভুষো কালি আর খাগের কলম। তিন ভাগের দুই ভাগ লেখা শেষ হয়েছে, এমন সময় ঘটলো অঘটন। হঠাৎ করেই উধাও হয়ে গেল পঙ্গু ভিখিরি!
এমনিতে ভিখিরি বাড়িতে এলো না গেল—সেইটে নিয়ে খুব একটা মাথা ব্যথা ছিল না হযরতের। কালান্দার বরং ঘরে না থাকলেই খুশি হতো সে। তবে এবারের ব্যাপার ভিন্ন। সেই যে গেল কালান্দার ফিরে আর এলো না। হাতে লেখা কাগজের পাতাগুলো বিছানার তোষকের তলায় রেখে দিত আল হযরত। একদিন সবগুলো পাতা বের করে সিরিয়াল মেলাচ্ছে, এমন সময় আবিষ্কার করল খোয়া গেছে পাণ্ডুলিপির আদ্দেকটা। পুরো তোষক, বালিশ, কম্বল—সব উলটেপালটে দেখল, কিন্তু কোথাও পাওয়া গেল না হারিয়ে যাওয়া পাতাগুলো।
গভীর রাতে মেঝের ওপর মোম জ্বেলে, সিজিল এঁকে, মন্ত্ৰ পড়ে অভিচারক্রিয়া শুরু করল আল হযরত। ডেকে আনল প্ৰেত নারগালকে। এক তাল কুয়াশার মতো কামরার বাতাসে ভেসে রইল নারগাল। মানুষের যত গোপন খবর, ঘাঁত-ঘোঁত সব এর জানা। হযরত তাকে জিজ্ঞস করল: কোথায় গিয়েছে পাণ্ডুলিপির পাতা। নিচু গলায় প্রেত তাকে জানাল, বাগদাদের বিখ্যাত বারমাকি বংশের ছেলে এই কালান্দার ভিখারি। কুসঙ্গে পড়ে নেশা-ভাং, চুরি-চামারি করা শুরু করে। শেষমেশ বংশচ্যুত করা হয় তাকে। কুঁড়ের ধাড়ি। কাজ-কর্মও জানে না। পথে পথে ভিক্ষে করে খায়। এরই চাচাতো ভাই সিকান্দার বারমাকি দামেস্কের নামকরা গুণিন। হস্তরেখা পড়ে মানুষের ভূত-ভবিষ্যত বলে দেয়। বিনিময়ে মোটা টাকা সম্মানি দিতে হয় তাকে। মাঝে মাঝে নিজ বংশের শুধুমাত্র এই গুণিনের সাথে দেখা করত কালান্দার। আল হযরতের কথা এর কাছ থেকেই জানতে পারে সিকান্দার। পেশায় গুণিন হওয়ায় মনে সন্দেহ দেখা দেয়। আল হযরতের লেখা পুঁথির একটা পাতা দেখাতে বলে কালান্দারকে। কালান্দার ভাবল একটা- দুটো পাতা নিয়ে কাজ কী? আদ্দেকটা নিলেই তো হয়। সিকান্দারের পছন্দ না হলে রাস্তার ধারে ফেলে দিলেই হলো। এসব জঞ্জাল থাকলেই কী, আর না থাকলেই বা কী!
লেখা দেখে চোখ কপালে ওঠে সিকান্দারের। তাকে সোনার একটা মোহর দিয়ে বলে বাকি পাতাগুলো তক্ষুণি নিয়ে যাওয়ার জন্যে। যদি আনতে পারে, তাহলে আরও একটা সোনার মোহর পাবে।
আস্ত একটা মোহর দেখে হতবাক হয়ে যায় কালান্দর। তৎক্ষণাৎ সিকান্দারের ওখান থেকে নিজ বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয় কালান্দার। পথে তিন রাস্তার মোড়ে বিশাল বাজার। মূল রাস্তা ধরে গেলে ঘুরতে হবে মেলা। সে সিদ্ধান্ত নিলো চোরাগলি দিয়ে শর্টকট নেবে। কিন্তু কপাল মন্দ। বাজারের ভেতরে ঢুকে ঝামেলায় পড়ে গেল কালান্দার। কী, নাহ, ভর দুপুরে চারজনের একটা দল বিখ্যাত জহুরি আবু ঘানিমের সোনার দোকান লুট করে পালিয়েছে। পুরো বাজার ঘেরাও করেছে নগর রক্ষীরা। জিজ্ঞাসাবাদ করছে প্রত্যেককে, দেহ তল্লাশি চালাচ্ছে। রক্ষীদের হাতে ধরা পড়ল কালান্দার। দেহতল্লাশি করার পর মোহর পাওয়া গেল তার কাছে। ভিখিরির কাছে সোনার মোহর এলো কোত্থেকে? এ নিশ্চয় ডাকাতদের চর। জয়তুনের মোটা লাঠি দিয়ে বেদম পিটুনি দেওয়া হলো তাকে। স্বীকারোক্তি আদায় না করে দেহরক্ষীরা কোনোভাবেই ছাড়বে না। মারের চোটে জ্ঞান হারালো কালান্দর। পুরোপুরি সংজ্ঞাহীন অবস্থায় হাতে-পায়ে দড়ি বেঁধে বস্তার মতো গাধের পিঠে চাপিয়ে জিন্দানখানায় নেওয়া হলো তাকে।
দুদিন পর কয়েদখানার পাথুরে মেঝেতে মরে পড়ে থাকল কালান্দার। ওদিকে নিজ গৃহে কালান্দরের পথ চেয়ে বসে আছে সিকান্দার। পরপর তিন দিন কেটে গেল। দেখা নেই কালান্দারের। আরও তিন দিন অপেক্ষা করার পর পুঁথির পাতাগুলো নিয়ে বগদাদের পথে রওনা হলো গুণিন। ওখানে তার গুরু হামাদ হাঞ্জর থাকেন। এ পুঁথির বিষয়ে পরবর্তী করণীয় তিনিই ঠিক করবেন।
আল হযরতের কাছে কোনো টাকা-পয়সা নেই, বাড়ি থেকে বারও হয় না। ওই ভিখিরিই তাকে দুবেলা, এক বেলা রুটি আর মধু দিয়ে উটের দুধ খেতে দিত। সেই রেস্তও বন্ধ হয়ে গেছে এখন। কী করা? কী করা? দুদিন নিরম্বু উপোস দেওয়ার পর কুঁজোর পানিটুকুও ফুরিয়ে গেল। হামা দিয়ে হলেও বাইরে বেরুতে হবে এবার। না বেরুলে মৃত্যু অনিবার্য।
আল হযরত জানত—বাইরে বেরুলে জীবনের ঝুঁকি আছে। মন্ত্রবলে নিজের ঘর বন্ধন করতে পারলেও, পুরো দামেস্ক শহর নিয়ন্ত্রণ করা তার পক্ষে অসম্ভব। সে কখন বাইরে বেরুবে আর অরক্ষিত হবে, সেদিকেই ধূর্ত শেয়ালের মতো পথ চেয়ে বসে আছে পটারে পাঠানো প্রেতাত্মা আর অদৃশ্য দানবের দল। মুরগি কখন ডেরা ছেড়ে বেরোই সেই অপেক্ষা।
তবে এ ব্যাপারে নিশ্চিত-ও হওয়া যাচ্ছে না। বাইরে বেরিয়ে দেখা যাবে কিছুই হয়নি! সব দুর্বল মনের অলীক কল্পনা! নাহ, ঝুঁকি একটা নিতেই হচ্ছে। কিছু করার নেই। মুচির কাজ করার সরঞ্জাম বাজারে বেচতে পারলে কিছু পয়সা পাওয়া যাবে। ওটা দিয়েই কিনে আনা যাবে খাবার, পানীয় জল।
সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে শেষমেশ ঠিক দুপুরবেলা সূর্য যখন মাথার ওপর, তখন বাড়ি থেকে বার হলো আল হযরত। বাতাসে হিউমিডিটি নেই এক ফোঁটাও। সূর্যের কিরণে ঊষর দামেস্ক শহর যেন ধিকিধিকি জ্বলছে। তীব্র আলোর ছটায় দুচোখ ধাঁধিয়ে গেল হযরতের। মুচির বাক্স হাতে ধপ করে বসে পড়ল হাজার বছরের পুরনো মেজেহ রাজপথের মাঝখানে। আলোর হাত থেকে আড়াল করার চেষ্টা করছে দুই চোখ।
আর ঠিক তখনই ঘটলো এক অদ্ভুত ঘটনা। অসংখ্য পথচারী দেখল সূর্য-কিরণের থেকেও তীব্র আলোর ঝলক ছুটে এলো আল হযরতের দিকে। যেন প্রচণ্ড রোদ্রে সমতল রাস্তার ওপর আলোর শিখা কিম্বা ঢেউ নাচছে। তবে ওই আলোর ঝলকের আকার অতিকায়। যেন ঝঞ্ঝার মতো ছুটে আসছে বিশাল এক অদৃশ্য দানব। মুহূর্তের ভেতর আল হযরতকে গ্রাস করল সেই ঝলক। আর তারপরেই সব ফাঁকা। কোথাও কেউ নেই। না আল হযরত, না আলোর বলয়। রাস্তার মাঝখানে পড়ে আছে শুধু আল হযরতের মুচির বাক্স আর তালিমারা নাগরাই।
১৮২৩ সাল। বাহালা দুর্গ, নিযওয়াহ, ইয়েমেন। আমীর সাইদ বিন সুলতানের অনুমতি নিয়ে ওমান থেকে মরুপথ ধরে পশ্চিমে যাত্রা করলেন মেজর নেল্যান্ড কোলাম। উদ্দেশ্য জলপথ ছাড়া রাব আল খালির ভেতর দিয়ে লোহিত সাগরের পুব পাড়ে পৌঁছানো যায় কি না। যদি যায়, তাহলে সেই পথ চিহ্নিত করা। আফ্রিকার জাঞ্জিবার তখন সাইদ বিন সুলতানের অধীনে। জলপথে যেতে গেল নানান সমস্যা। বাজে আবহাওয়া, বোম্বেটের হামলা, ভিন দেশের সরকারী কর, বন্দরের ভাড়া—এসব মিলিয়ে খাজনার চেয়ে বাজনাই বেশি। সুলতানকে তার সেনাবাহিনীর ইংরেজ মেজর নেল্যান্ড কোলাম বোঝাল: কেবলমাত্র জলপথের ওপর ভরসা করে জাঞ্জিবার দখলে রাখা কঠিন। বিকল্প পথ বের করা অতি আবশ্যক। মেজরের প্রস্তাবে রাজি হলেন সুলতান। জনা বিশেক সৈন্য, উট, ঘোড়া, রসদ, সহিস, আর কুলি-মজুর দিয়ে পথ খুঁজে বের করতে পাঠালেন তাকে। এমনিতে একাজে অন্য কেউ যেতে চাইবে না কস্মিনকালেও। পথে রাব আল খালি পড়বে। ওই বাজ পড়া মরুভূমিতে গেলে, ফিরে আসা প্রায় অসম্ভব। এ যখন নিজ ইচ্ছেই যেতে চাচ্ছে, তো যাক। পথ বার করতে পারলে ভালো, না পারলে ফিরে এলো কী গেল, কার কী যাই আসে!
এ অভিযানের পেছনে কোলামেরও ভিন্ন উদ্দেশ্য আছে। ইংল্যান্ডে ইটন কলেজের প্রফেসর তার বড়ো মামা। এই মামা তার আমেরিকান বন্ধু প্রফেসর লাবান শ্রুশবারিকে পাঠিয়েছেন তার কাছে। এ ভদ্রলোক প্রত্নতত্ত্ব পড়ান। আরবিসহ নানান ধরনের নতুন, পুরনো ভাষা তার জানা। গবেষণা করেন হারিয়ে যাওয়া নগরী আর পুঁথিপত্র নিয়ে। গাদা গাদা বই পড়ে ইনি নিশ্চিত হয়েছেন, রাব আল খালিতে আদ্যিকালে এক পেল্লায় নগরী ছিল। অতুল তার বৈভব। এই নগরীর ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পাওয়া যায় কি না—দেখতে চান তিনি। এ কাজে সময় লাগবে। প্রয়োজন হবে লোক-লস্কর, রসদ, ভারবাহী পশুর। এছাড়াও বেদুইন ডাকাতের হাত থেকে বাঁচার জন্যে সসস্ত্র লোকবলও চাই। এক ঢিলে দুই পাখি মারার ইচ্ছে মেজর কোলামের। পথও খোঁজা হলো, নগরীরও অনুসন্ধান করা গেল।
উইন উইন সিচুয়েশন।
কনভয় নিয়ে ওমানের সালালাহ থেকে যাত্র শুরু করলেন লাবান শ্রুশবারি আর মেজর নেল্যান্ড কোলাম। ইয়েমেন বর্ডারের কাছে এক অজানা মরু অঞ্চলে এসে পড়লেন তারা। এই মরুভূমিই রোবা আল ইহালিয়ে বা রোবা আল খালিয়েহ ওরফে রাব আল খালি। এখানেই একদিন চল্লিশ ফিট উঁচু এক বালিয়াড়ির পাশে তাঁবু গাড়লেন তাঁরা। ভাগ্যই বলতে হবে। তাঁবুর খুঁটি পুঁততে গিয়ে খুঁজে পেলেন প্রকাণ্ড পাথরের স্তম্ভ। বালি পরিষ্কার করে দেখা গেল ওটা অতিকায় এক তোরণের অংশ। আরে ওয়াহ! এ যে প্রাচীন নগরীর ধ্বংসাবশেষ। এই তো খুঁজছিলেন অধ্যাপক মশাই! এ যে কলা গাছে না উঠতেই এক কাঁদি!
অভিযান বাদ দিয়ে শুরু হলো খোঁড়াখুঁড়ি। দিনের পর দিন নানান রকমের আর্টিফ্যাক্ট স্টাডি করে শ্রুশবারি বুঝতে পারলেন- দেবতা হাস্তরের উপাসনা করা হতো এই সুপ্রাচীন নগরীতে। একদিন বিকেল বেলা শ্রুশবারি আর কোলাম প্রচীন নগরীর তোরণ পেরিয়ে আরও ভেতরে ঢুকে পড়লেন। কাছেই একটা ধচাপচা গোরস্থান চোখে পড়ল তাদের। সেখানে পুরনো সব কবরের ভেতর তুলনামূলক কমবয়সের এক বারিয়াল চেম্বার দেখতে পেলেন তারা। গোরটার কাছে যেতেই তাদের চোখে পড়ল আঁকাবাঁকা অক্ষরে পাথরের স্ল্যাবে খোদাই করা আল হযরতের নাম।
এ লোকের বিষয়ে শ্রুশবারির আগে থেকে জানাশোনা ছিল। কোলামকে সব জানালেন তিনি। তারা ধারণা করলেন দামেস্ক থেকে উড়িয়ে এখানে আনা হয় হযরতকে। গোপন সব তথ্য ফাঁস করে দেওয়ায় নারকীয় শাস্তি ভোগ করতে হয় তাকে। প্রথমে একটা একটা করে ভেঙে ফেলা হয় হাত পায়ের সবকটা হাড়। এরপর উপড়ে নেওয়া হয় তার দুচোখ, লোহার সাঁড়াশি দিয়ে টেনে ছিঁড়ে ফেলা হয় জিভ। তারপর দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয় মাথা। আল হযরতের নামের নিচে লেখা ছিল: চির অভিশপ্ত এ কবর। এখানে অনুপ্রবেশকারীর জন্যে অপেক্ষা করছে যন্ত্রণাময় মৃত্যু।
তবে এসব সাবধান বাণী কানেও তুললেন না শ্রুশবারি। ভেতরে ঢুকে খুলে ফেললেন শবাধারের ঢাকনা। ইয়া বড়ো পাথুরে শবাধারের তলায় পড়ে আছে ছিঁড়ে ত্যানা হওয়া কাপড়, হাড়ের টুকরো, আর রাজ্যের ধুলো। কাপড়ে পেঁচানো চামড়ায় লেখা একটা পুঁথিও দেখতে পেলেন শ্রুশবারি। আল হযরতের নিজের লেখা আল আযিফ। হাতে নিয়ে দেখলেন। আরবিতে লেখা অসম্পূর্ণ এক পাণ্ডুলিপি। তবে প্রথম খণ্ড নয়, ওটা দ্বিতীয় খণ্ড। পাণ্ডুলিপি পড়ে হোমের আগুন জ্বেলে অভিচারক্রিয়া করে আল হযরতের আত্মাকে ডেকে আনেন শ্রুশবারি। তাকে দিয়ে একটি মানচিত্র আঁকিয়ে নেন। সেই মানচিত্রে নির্দেশিত হয় কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়া দুনিয়ার যত রহস্যময় নগরী আর সভ্যতা।
শ্রুশবরির হাতে লেখা নোট আর পাণ্ডুলিপি রক্ষা পেলেও হারিয়ে যায় সেই মানচিত্রখানা। আল হযরতের আত্মার সাথে যোগাযোগের তিন দিনের ভেতর পীত জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মারা যান শ্রুশবারি। ঊষর মরুর বুকে তাকে দাফন করে আল আযিফের পাণ্ডুলিপি নিয়ে সানার পথে রওনা দেয় কোলাম। সবচেয়ে কাছের বড়ো নগরী বলতে ওই একটাই।
সানায় আসার পথে ভ্যালি ফিভারে আক্রান্ত হলো নেল্যান্ড কোলাম। যাত্রাপথে কোথায় ডাক্তার, আর কোথায়-ই বা ওষুধ- পথ্য! ধুঁকতে ধুঁকতে কোনোমতে সানায় পৌঁছাল সে। বুঝল: ফুরিয়ে এসেছে আয়ু। মারা যাবে যেকোনো সময়। তবে মারা যাওয়ার আগে অমূল্য এই বইটির একটা হেস্তনেস্ত করে যেতে হবে। তার মনে হলো অসমান্য এই কিতাব আল আযিফের রক্ষণাবেক্ষণ একমাত্র ইংরেজ সরকারই করতে পারে। কেবলমাত্র ব্রিটিশ মিউজিয়ামের ভল্টেই যুগের পর যুগ অক্ষত থাকবে এ বই।
তখন ১৮২৩ সাল। অটোমান সাম্রজ্যের অধীন ইয়েমেনের ইংরেজ কনসাল জেনারেল লর্ড উইলিয়াম অ্যামহার্স্ট। মাটির তৈরি বারো শতকের প্রাচীন এক দুর্গে দুইশো ইংরেজ নৌসেনা নিয়ে দূতাবাস সামলান তিনি। এই অ্যামহার্স্টের কাছেই হত্যে দিয়ে পড়ল কোলাম। যতটুকু জানে ভেঙেচুরে বলে এগিয়ে দিলো পাণ্ডুলিপিটা। হাতে নিয়ে নেড়ে-চেড়ে দেখে ওটা টেবিলের ড্রয়ারে ঢুকিয়ে রাখলেন লর্ড। মুখে বললেন, “এটা নিয়ে চিন্তা করবেন না। এখান থেকে প্রতি মাসে লন্ডনে দুবার এক্সপ্রেস ডাক পাঠানো হয় ডিপ্লোম্যাটিক পাউচে। মাত্র গতকালই ডাক গেছে। পরেরটা যাবে আর পনেরো দিন পর। ওই ডাকে লন্ডনে যাবে এই পাণ্ডুলিপি। প্রথমে ফরেন অফিসে, তারপর ব্রিটিশ মিউজিয়ামের কিউরেটরের কাছে। ঠিক আছে?”
হতাশ হয়ে এদিক-ওদিক মাথা নাড়ল নেল্যান্ড। বলল, “স্যার, আমি চাচ্ছি আপনি নিজে ওটা হাতে হাতে পৌঁছে দেবেন ব্রিটিশ মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষের কাছে। এক অতি রহস্যময় অমূল্য জিনিস ওই পাণ্ডুলিপি। এর দ্বিতীয় কোনো অনুলিপি নেই। কোনো কারণে যদি বিনষ্ট হয় কিম্বা লোভী লোকের হাতে পড়ে, তাহলে আর কোনোদিন খুঁজে পাওয়া যাবে না। ওটা খুঁজে পাওয়ার পর মারা পড়েছেন আমার বন্ধু প্রফেসর শ্রুশবারি। আর এখন মরতে চলেছি আমি নিজেও। ভেবে দেখুন, একজন আমেরিকান অধ্যাপক আর একজন ইংরেজ আর্মি অফিসারের জীবনের বিনিময়ে হস্তগত হয়েছে ওই কিতাব। এটাকে হেলাফেলা করার কোনো সুযোগ নেই।”
অ্যামহার্স্ট বললেন, “বেশ। আপনি এত করে যখন বলছেন, তখন আমি নিজেই নাহয় পৌঁছে দেবো ওটা। তবে তার জন্যে অপেক্ষা করতে হবে। এক বছর পর ইংল্যান্ডে যাওয়ার কথা আছে। তখন সাথে করে নিয়ে যাবো এখন। ঠিক আছে?”
“জি, ঠিক আছে,” বলে ফুস করে চেপে রাখা দম ছাড়ল নেল্যান্ড। এরই ভেতর ফ্রান্সের বোরডো এলাকার কনিয়াক পরিবেশন করেছে অ্যামহার্স্টের বেয়ারা। এক পেয়ালা কনিয়াক খেয়ে দূতাবাস থেকে টলতে টলতে বেরিয়ে এলো নেল্যান্ড। কোনোমতে ওয়াদি আস সাইলা সড়কের সরাইখানায় গিয়ে নিজ কামরার বিছানায় ওপর এলিয়ে পড়ল।
ব্যস, আর উঠল না কোনোদিন।
এ ঘটনার দুমাস পর হঠাৎ করেই ফরেন অফিস থেকে রাজা চতুর্থ জর্জের সই আর সিল মোহর করা একটা ইম্পেরিয়াল অফিস অর্ডার এলো লর্ড অ্যামহার্স্টের নামে। কী? নাহ, তাকে ভারতবর্ষের গভর্নর জেনারেল করা হয়েছে। তিনি সেখানে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হয়ে দায়িত্ব পালন করবেন। ওখানে লর্ড হেস্টিংসের পর, বর্তমানে ভারপ্রাপ্ত গভর্নর জেনারেল হিসেবে কাজ করছেন জন অ্যাডাম। চিঠি পাওয়ার বাহাত্তর ঘণ্টার ভেতর ভারতবর্ষের উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তাকে। তার পরিবর্তে ইয়েমেনে ব্রিটিশ কনসাল জেনারেলের দায়িত্ব পালন করবেন লর্ড হেনরি হাডসন। এরই ভেতর লন্ডন থেকে সানার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছেন তিনি।
চিঠি পাওয়ার পর অত্যন্ত তাড়াহুড়ো করে রয়্যাল নেভির জাহাজে কোলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন লর্ড অ্যামহার্স্ট। সাথে করে নিয়ে চললেন আল আযিফের পাণ্ডুলিপি। বার্মা, আরাকান, আসাম আর মারাঠিদের সাথে লড়তে গিয়ে ভুলেই গিয়েছিলেন আল আযিফের কথা। একদিন পুরনো কাগজ-পত্রের ট্রাঙ্ক খুলতেই ওটা তার চোখে পড়ল। ভারী কৌতূহল হলো। কী লেখা আছে ওতে?
মানতেই হবে ওই পাণ্ডুলিপি হাতে আসার পর শনৈ শনৈ উন্নতি হয়েছে তার। তা না হলে, ইয়েমেনের মতো অখ্যাত এক আরব দেশের কনসাল জেনারেল ভারতবর্ষের গভর্নর জেনারেল হন কীভাবে! নাহ, দেখতেই হচ্ছে কী লেখা আছে এই পার্চমেন্ট কাগজের বান্ডিলে।
কিছুটা আরবি অ্যামহার্স্ট জানতেন। তবে আল আযিফ পড়ে বোঝার ক্ষমতা তার ছিল না। ভাবলেন কাকে দিয়ে পাঠ উদ্ধার করবেন এখন? রাজা রামমোহনের পাণ্ডিত্যে মুগ্ধ ছিলেন লর্ড। তাকে সাথে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছেন কলিকাতা সংস্কৃত কলেজ। আরে যোগ্য লোক তো কাছেই আছে! মনে মনে উৎফুল্ল হয়ে ভাবলেন তিনি। ওখানে কী লেখা আছে সেইটে জানার মতো জ্ঞান রাজা রামমোহন রায়েরই তো বিলক্ষণ রয়েছে! নেল্যান্ডের কথা থেকে বোঝা গেছে এ বই অতি গোপনীয় আর রহস্যময়। ভালো আরবি জানা মাওলানা কোলকাতায় বহু আছে। তবে তাদেরকে কতখানি বিশ্বাস করা যায়—সেটাও ভেবে দেখতে হবে।
.
একদিন শনিবার সকালে অ্যামহার্স্ট নিজের বাস ভবনে ডেকে পাঠালেন রাজা রামমোহনকে। তার হাতে তুলে দিলেন পাণ্ডুলিপির আদ্দেকটা। বাকিটা নিজের কাছে রেখে বললেন, “রাজা, এটা পড়ে দেখুন। তারপর আরবি থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করে আমার কাছে নিয়ে আসুন। বিষয়টা খুবই কনফিডেন্সিয়াল। দুজন উচ্চ-শিক্ষিত শেতাঙ্গ প্রাণ দিয়েছেন এটা সংগ্রহ করতে গিয়ে। পড়া আর অনুবাদের কাজ আমার ভবনের গেস্ট হাউসে বসে করতে হবে। কোনো অবস্থাতেই এ পাণ্ডুলিপি গভর্নর জেনারেলের বাস ভবনের বাইরে নিতে পারবেন না। আশা করি এর সঠিক গুরুত্ব বুঝতে পেরেছেন?”
পরবর্তী একমাস পাণ্ডুলিপির ওপর কাজ করলেন রাজা রামমোহন। ইংরেজিতে অনুবাদ করলেন একটু একটু করে। প্রথমে আদ্দেকটা, পরে বাকি বাকি অংশ। তবে পুরোপুরি এড়িয়ে গেলেন তন্ত্র-মন্ত্রের বিষয়গুলো। এ এক ভয়ঙ্কর জিনিস। দুষ্টু লোকের হাতে পড়লে বিরাট সমস্যা দেখা দিতে পারে সাধারণ মানুষের জীবনে। রাজা রামমোহনের স্মরণশক্তি ছিল অস্বাভাবিক। একেবারে ফটোগ্রাফিক মেমোরি। দিনে যা পড়তেন সেইটে সন্ধের সময় বাসায় গিয়ে কাগজে লিখে ফেলতেন। এ লেখাগুলোই পরে নিজ প্রেসে কম্পোজ করে শাহনামার একটা চ্যাপ্টার হিসেবে ১৮২৫ সালে ছেপে ছিলেন। খুব সম্ভব তার ঘনিষ্ঠ সঙ্গীদের জন্যে।
রামমোহনের চারজন প্রধান সহচর ছিলেন: উইলিয়াম কেরি, টমাস উড্রফ, জন ডিগবি, আর রবি ঠাকুরের বাবা দেবেন ঠাকুর। এরা সবাই হরিহর আত্মা। অসীম জ্ঞান পিপাসা ছিল তাদের। জাগতিক জ্ঞানের বাইরেও অতিপ্রাকৃত বিষয়েও আগ্রহের খামতি ছিল না। ওই বিশেষ চ্যাপ্টারঅলা শাহনামা মোট পাঁচ কপি ছাপা হয়েছিল এই মনীষীদের জন্যেই।
১৭০৪ সাল, মুর্শিদাবাদ। সতেরেশো সালের গোড়ার দিকে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার রাজধানী যখন মুর্শিদাবাদ, সেই সময় বহরমপুর ছিল ভাগিরথীর তীরে ছোটো একটা গ্রাম। নাম সাতপুকুরিয়- ব্রহ্মপুর। বড়ো বড়ো পুকুর আর সাতশো ঘর ব্রাহ্মণ বাস করার কারণে এই নাম। পলাশির যুদ্ধের সময় এখানে ছোটো একটা ক্যাম্প করেছিল লর্ড ক্লাইভ। যুদ্ধের পর লর্ডকে খুশি করার জন্যে এই মৌজায় কোম্পানিকে এক ধাক্কায় চারশো বিঘে জমি দান করে মীর জাফর। কালের পরিক্রমায় ওই ক্যাম্প থেকে ক্যান্টনমেন্ট। আর সেই ক্যান্টমেন্টের হাত ধরেই ব্রহ্মপুর হয়ে যায় আজকের বহরমপুর।
বহরমপুর বাস স্ট্যান্ডের পুবদিকে চৌদ্দ নম্বর সড়কের পাশে স্টেট সেরিকালচারের উত্তরে বাবুলবোনা রেসিডেন্সি সেমেটারি। এক্কেবারে শুরুতে এর নাম ছিল স্টেশন বারিয়াল গ্রাউন্ড। সতেরোশো সালের শেষদিকে ক্যাপ্টেন স্কিানরের লাশ দাফন করা হয় এখানে। সেই থেকে ওখানে গোর দেওয়া শুরু। শেষ কবরটা দেওয়া হয় আরও একশো বছর পরে, আঠারোশো সালের শেষদিকে। রেসিডেন্সি সেমেটারিতে আইরিশ সেনাপতি জর্জ টমাসকে গোর দেওয়ার চার বছর পরে একই সাথে দাফন করা হয় মালদার চাঁদনী গাঁয়ের নীল কুঠিয়াল উইলিয়াম গ্র্যান্ট আর তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু হেনরি ক্রাইটনকে। এই ক্রাইটন খুব নাম করেছিল, টাকা পয়সাও বানিয়েছিল মেলা। এ-ও কুঠিয়াল। ক্রাইটনের নীলের প্ল্যান্টগুলো ছিল গৌড় আর মালদায়। এর ব্যাপারে জানার আগে জর্জ টমাসের ব্যাপারে জানা জরুরি।
এই টমাস ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভাড়াটে নৌ-সেনা হিসেবে সতেরোশো সালের শেষদিকে ইংল্যান্ড থেকে প্রথমে মাদ্রাজে পৌঁছয়। এর জন্ম আয়ারল্যান্ডের এক হতদরিদ্র কৃষক পরিবারে।
ছোটোবেলাতেই বাপকে খুইয়ে দিনমজুরের কাজ নেয় ইউগাল বন্দরে। পড়ালেখা করার কোনো সুযোগই পায়নি। তো এই বন্দরেই একদিন ইংরেজ নৌবাহিনীর খপ্পরে পড়ল বেচারা। তাকে বাধ্য করা হলো যুদ্ধ জাহাজে কাজ করতে। নৌবাহিনীর জাহাজে করেই একদিন ভারতে এসে পৌঁছাল সে। মুখোমুখী হলো বিচিত্র অভিজ্ঞতার। একদিকে কোম্পানির শাসন, অন্যদিকে স্বায়ত্বশাসিত ছোটো ছোটো প্রিন্সলি স্টেট।
টমাস দেখল: কোম্পানির গোলাম হিসেবে যুদ্ধ করার চেয়ে দেশীয় রাজ-রাজড়াদের হয়ে দাদাগিরি করলে ঢের বেশি পয়সা পাওয়া যায়। তাছাড়া, কোম্পানির সেনাবাহিনীতে তার তেমন কোনো র্যাঙ্ক-ও নেই। দেশীয় বাহিনীতে যোগ দিলে সরাসরি সেনাপতির পদ! ব্রিটেনের রয়্যাল নেভি থেকে ভাগলপুর হলো টমাস। চলে এলো কোলকাতা হয়ে মুর্শিদাবাদ। সেখান থেকে সাতঘাটের জল খেয়ে পৌঁছাল সারধানায়। সেনা প্রধান হিসেবে যোগ দিল বেগম সামরুর সেনা বাহিনীতে। সাধারণ পদাতিক সৈনিকের পদ থেকে একটানে কমান্ডার-ইন-চিফ!
বেগম সামরু ছিল সারধানা-এর মহারানি। সারধানা শহর দিল্লীর শ-খানেক কিলোমিটার উত্তরে, মেরুত জেলায়। বেগম সামরুর আসল নাম ফারজানা জেবুন্নেসা। বাড়ি কাশ্মিরে। চোদ্দো বছর বয়সে সারধানা নগরীতে এসে বাইজিবাড়িতে আশ্রয় নেয় সে। নাচ-গান শিখে বড়োলোকদের মনরঞ্জন করতে শুরু করে। সারধানা তখন ওয়াল্টার রাইনহার্ড সামারের দখলে। বাইজিবাড়ি গিয়ে ফূর্তি করা ছিল রাইনহার্ডের এক বিরাট নেশা। প্রতি রাতে তার নতুন মেয়েলোক চাই। একদিন জেবুন্নেসার কোঠায় গিয়ে হাজির হলো রাইনহার্ড। কোঠিওয়ালিকে বলল, “শোন মওসি। তোমার মেয়েদের ভেতর থেকে সেরা চার জনকে জলসাঘরে হাজির করো। নাচগানের পর যাকে মনে ধরবে, তার সাথে রাত কাটাবো। যাও জলদি করো।”
ছোটোখাটো আর আঁটসাঁট গড়নের জেবুন্নেসার ঘূর্ণি নাচ দেখে আর মিষ্টি গলার গান শুনে এক ঘোরের ভেতর চলে গেল রাইনহার্ড। এ তো দেখছি মেঘ সাগরের নেমাদিয়া দ্বীপের পরিদের থেকেও বেশি সুন্দরী! মনে মনে ভাবল সে। রাতের পর রাত কাটাতে লাগল জেবুন্নেসার কোঠিতে। শেষমেশ রাইনহার্ড তাকে খ্রিষ্টান ধর্মে দীক্ষা দিয়ে বিয়ে করে ফেলল। বেগমের নতুন নাম হয়: জোয়ানা নোবিলিস সম্বার।
হঠাৎ করেই মারা গেলে রাইনহার্ড। তবে ততদিনে সারধানার দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হয়ে উঠেছে জেবুন্নেসা। পেশায় বাইজি হলেও জেবুন্নেসা ছিল তুখোড় বুদ্ধিমতী আর দুর্দান্ত সাহসী। রাইনহার্ডের মতো ঘাগু লোককে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরানো সহজ নয় মোটেও! পঞ্চাশটা কামান, ছয় হাজার পদাতিক, আর এক হাজার অশ্বারোহী সৈন্যের বিশাল বাহিনীর নেতৃত্ব গিয়ে পড়ল জেবুন্নেসার কাঁধে। ভারতে তখন কোম্পানির শাসন কেবল শেঁকড় গাড়তে শুরু করেছে। চারদিকে বিশৃঙ্খলা আর অরাজকতা। কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ বলে কিছু নেই। নিজের তখত নিজেই রক্ষা করো। হন্যে হয়ে দক্ষ একজন সেনাপতি খুঁজতে লাগল জেবুন্নেসা। ইউরোপীয় সাদা- চামড়া হলে ভালো হয়। এদের শৃঙ্খলা, প্রশিক্ষণ, আর নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা ও সাহস সম্পূর্ণ ভিন্ন মাত্রার। এই ক্রান্তিলগ্নে বেগমের সাথে দেখা হলো জর্জ টমাসের। এক সাক্ষাতেই সেপাই থেকে সরাসরি সেনাপতি!
যা হোক, জেবুন্নেসার হয়ে যুদ্ধ করতে গিয়ে টমাস হরিয়ানার হাঁসি নগরী দখল করল। এখানে আমতি হ্রদের পাশে বহু পুরনো এক পাথুরে কেল্লা আছে। নাম আশিগড়।
এই দুর্গে প্রায়ই আসত রাইনহার্ড। সম্পূর্ণ একা ও সঙ্গোপনে। এমন গোপনীয় যে তার অতি প্রিয় স্ত্রী জেবুন্নেসা অব্দি কিছু জানতে পারেনি। টমাসের মালকিন জেবুন্নেসার ঐকান্তিক ইচ্ছে, ওখানে কী এমন গোপনীয় বিষয় আছে সেইটে জানার। ভাঙা- চোরা কেল্লা, তবে এক সময় একে বলা হতো উত্তর ভারতের সবথেকে দুর্ভেদ্য দুর্গ। তিরিশ একরের মতো জায়গা বায়ান্ন ফুট উঁচু আর সাঁইত্রিশ ফুট চওড়া দেওয়াল দিয়ে ঘেরা। দুহাজার বছরেরও পুরনো এর ইতিহাস।
মালকিনের কথা শুনে বিস্তর খোঁজাখুঁজি করল টমাস। আদ্যিকালের পুরনো দুর্গ। শতশত টানেল আর অগুনতি গলিঘুপচি। ধারণা করা হয়, মাটির নিচেই তিনতলা অব্দি আছে। নানান জায়গায় ধাপে ধাপে সিঁড়ি নেমে গেছে সুড়ঙ্গ বেয়ে। ভেতরে ঘুটঘুটে অন্ধকার, ঝুলকালি, সোঁদা গন্ধ। ভয়ে কেউ নামতে চায় না।
টমাস দেখল—এক স্ট্রাটেজিক অবস্থানে দাঁড়িয়ে রয়েছে দুহাজার বছরের পুরনো এই দুর্গ। এখান থেকে শুধু যে সহজেই শত্রুর মোকাবেলা করা যায় তা না, বরং এখান থেকে এলাকার শাসন নিয়ন্ত্রণ করাও সহজসাধ্য। তবে হ্যাঁ, কিছু মেরামতির কাজ করাতে হবে দুর্গটাতে। প্রথমেই যেটা দরকার সেটা হলো দক্ষিণ দিকে বড়ো একটা গেট বানানো। যাতে সেনাবাহিনীর যাতায়াতে সুবিধা হয়। সহজেই আনা-নেওয়া করা যায় গোলা-বারুদ, হাতি- ঘোড়া, রসদপত্র। ওখানে ছোট্ট একটা একতলা দালান ছিল। দালানটার সাথে দুর্গ থেকে বাইরে বেরোবার সরু গেট। এ ধরনের গেট ব্যবহার হয় গোপনে দুর্গ থেকে বের হওয়া কিম্বা ঢোকার জন্যে। বড়ো গেট বানাতে হলে ভাঙতে হবে একতলা ভবনসহ চিপা গেট। দালান ভাঙতেই মেঝেতে পেল্লায় চৌকো গর্ত চোখে পড়ল। গর্তের মুখ থেকে ধাপে ধাপে সিঁড়ি নেমে গেছে নিচে। গিয়ে শেষ হয়েছে বড়োসড়ো গোলাকার এক কামরায়।
তৎক্ষণাৎ খবর দেওয়া হলো জর্জ টমাসকে। দলবল আর মশাল-হ্যারিকেন নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামলো টমাস। দেখল এক অদ্ভুত দৃশ্য। কামরার গোলাকার দেওয়াল ধূসর রঙের পুরু মার্বেল পাথরে মোড়া। আর এই মার্বেল খোদাই করে বানানো হয়েছে আদ্যিকালের দেব-দেবীর প্রতিকৃতি। মাঝখানে চারকোনা বেদির ওপর কালো কষ্টি পাথরে তৈরি দুমানুষ লম্বা প্রাগৈতিহাসিক এক দেবতার মূর্তি। লম্বা-চওড়া কঙ্কালসার দেহ আর হাত-পা, পিঠের পেছন থেকে বেরিয়ে এসেছে অসংখ্য শুঁড়। লাট খাচ্ছে পায়ের কাছে। কাপড়ের ঘোমটায় ঢাকা ঘাড় আর মাথা। চোখ আর মুখের জায়গায় কালো গর্ত। নাম কী এ দেবতার? আর দেখতে এত বীভৎসই বা কেন? মনে মনে নিজেকেই শুধালো টমাস। বেদির ওপর অসংখ্য মোমবাতি জ্বালানোর চিহ্ন, গাঁদা আর জবা ফুলের শুকনো পাপড়ি, শুকিয়ে যাওয়া চাপ চাপ রক্তের দাগ। তবে বলি হয়ে যাওয়া পশু বা মানুষের হাড়গোড় পড়ে নেই কোথাও। পচে দুর্গন্ধ হওয়ার ভয়ে পুরোপুরি সাফ করে ফেলা হয়েছে সবকিছু। সত্যি কথা বলতে কী, দারুণ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন জায়গাটা!
হঠাৎ করেই টমাসের মনে হলো এখনও নৈবেদ্য দেওয়া হয় এই বেদিতে।
কিন্তু কাজটা করছে কে?
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন