লিয়ং চাও আর চ্যাং লি নামের দুজন চীনে তরুণ নজর রাখা শুরু করল দীনবন্ধুর মেসের ওপর। তবে এরা সরাসরি রাস্তায় দাঁড়াল না। কাছেই একটা পড়ে থাকা খালি দোকান ভাড়া নিয়ে সবজি বেচতে লাগল। ওরা বাংলা ভাষা জানা হাকা চাইনিজ। কেউ কোনো রকম সন্দেহই করল না! সাথে নিলো ছোটো এক বাঙালি ছেলেকে।
সারারাত নজর রাখার দরকার নেই। সকাল আটটা থেকে রাত আটটা অব্দি মেসের মূল দরজার দিকে খেয়াল রাখলেই কাজ খতম। দীনবন্ধু আর শরৎ বাবু দেখতে কেমন, সেইটে জানা ছিল না চীনেদের। জুইকে এনে প্রথমে দীনবন্ধুকে শনাক্ত করালো তারা। তরপর শরৎ সিনহাকে। যখনই কেউ মেস থেকে বাইরে বেরোই তখনই দুজনের একজন পিছু নেয় তার। যদি পরপর দুজনেই বেরিয়ে যায়, তাহলে ছোটো বাঙালি ছেলেটার কাছে দোকান ছেড়ে দিয়ে বেরিয়ে যায় আরেকজনও। বুধবার অব্দি স্কুল আর মেস করলেন শরৎ বাবু। দিনে মাত্র একবার বেরুল দীন। একদিন গেল চিড়িয়াখানা দেখতে। পরের দুদিন গড়ের মাঠ আর কালীঘাট।
ঘটনা ঘটল বুধবার সকাল দশটার সময়। মেস থেকে বেরুলেন শরৎ সিনহা। গন্তব্য হুগলি জেলার বাঁশবেড়ে। চ্যাং লি পিছু নিলো তার। অনুসরণ করে চলে এলো রুদ্র ভৈরবের মঠ অব্দি। চায়ের দোকানে বসে দূর থেকে নজর রাখল মঠের গেটের ওপর। শরৎ বাবু বেরুলেই পিছু নেবে আবার।
.
রুদ্র ভৈরবকে আগের মতো বারান্দাতেই বসা অবস্থায় পেলেন শরৎ বাবু। কুশল বিনিময়ের পর সরাসরি প্রসঙ্গে এলেন ভৈরব মশাই। বললেন, “তোমার ওই নজুমি কিতাবের বিষয়ে কিছুটা জানতে পেরেছি। অনেকেই মনে করে আমি নিজ স্বার্থে পিশাচদের কাজে লাগাই। আমি পিশাচসিদ্ধ একথা ঠিক, তবে ওদেরকে দিয়ে কোনো উদ্দেশ্য আমি কখনই সাধন করি না।”
“কিছু মনে করবেন না গুরুদেব, আমার নিজেরও অমন ধারণাই ছিল। তাহলে কীভাবে তথ্য সংগ্রহ করেন আপনি?”
“সারাদিন উপোস থেকে সন্ধের মুখোমুখি দই-চিড়ে খেয়ে রাতের প্রথম প্রহরে মহাদেবের পুজো শুরু করি আমি। শেষ করি দ্বিতীয় প্রহরে। তারপর ঘুমোতে যাই। স্বপ্নের ভেতর আদেশ আসে। যে বিষয়ে জানতে চাই, অলৌকিক এক কণ্ঠস্বর আলোকপাত করে সে বিষয়ে। তবে সব সময় না। কোনো বিষয়ে কোনোকিছু জানানো হবে কি না—সেইটে নির্ভর করে দৈব সিদ্ধান্তের ওপর। এখানে আমার কোনো হাত নেই।”
“ধরুন দশ বার সাধনায় বসলেন। এর ভেতর কয়বার স্বপ্নে দৈব কণ্ঠস্বর শুনতে পাবেন?”
“এই ধরো গিয়ে ছয় বারের মতো।”
“আজ্ঞে, বুঝেছি গুরুদেব। সিক্সটি পার্সেন্ট সাকসেস রেট। এখন শোন যাক, কী দৈব নির্দেশনা পেলেন আপনি।”
“এই নজুমি কেতাবের আসল নাম আল আযিফ। বহু আগে উন্মাদ এক আরব কবি লিখেছিল চির অভিশপ্ত এ বই। যে-ই এর স্পর্শে আসে, সেই হয় উন্মাদ, না হয় অপঘাতে ভয়ঙ্কর মৃত্যুর মুখোমুখি হয়। সম্পূর্ণ অজানা আর বীভৎস এক অতিলৌকিক শক্তি বিচ্ছুরিত হয় বইটা থেকে। এর পরতে পরতে কালো জাদুর বর্ণনা ও প্রয়োগ কৌশল লেখা। আজ থেকে হাজার বছর আগেই এ বই সম্পর্কে জানতে পারে বেশ কিছু লোক। এর ওপর ভিত্তি করে চর্চাও শুরু করে দেয়। ভয়ানক সব কাণ্ড ঘটাতে শুরু করে। ঈসায়ি ধর্মগুরুরা খুব কঠোর হাতে দমন করেন এসব, পুড়িয়ে ফেলেন যেখানে যত পুঁথিপত্রের খোঁজ পেয়েছিলেন।”
“ওই লোক এ বই লিখল কীভাবে? এসব তন্ত্র-মন্ত্র জানলই বা কেমন করে? সে কি কোনো গুরুর কাছে দীক্ষা নিয়েছিল?”
এর কোনো গুরু নেই। দুর্গম মরু এলাকায় এই লোক খুঁজে পায় বালির নিচে তলিয়ে যাওয়া এক প্রগৈতিহাসিক অভিশপ্ত নগরী। মাটির নিচে অগুণতি সুড়ঙ্গ আর সারিসারি কক্ষ। ওখানেই একের পর এক গুপ্ত কক্ষের মেঝে, দেওয়ালে, আর কুলুঙ্গিতে এমন সব পুঁথি দেখতে পায় যা লেখা হয়েছে তা মানুষের সাধারণ আধ্যাত্মিক কিম্বা ধর্মীয় ধ্যান-ধারণা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। সৃষ্টির শুরুতেই জন্ম নেয় একদল ভয়ঙ্কর অতিপ্রাকৃত সত্তা। এক শ্রেণির সাধক এসব নির্মম অপদেবতাদের তুষ্ট করে দুনিয়ার বুকে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে রাখত। আমজনতাকে দিয়ে যা ইচ্ছে, তা-ই করিয়ে নিতো। সত্য ধর্মের প্রসার হওয়ার সাথে সাথে ধীরে ধীরে লোপ পায় এসব জঘন্য অপদেবতার পায়ে অর্ঘ্য নিবেদন। তবে পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে যায়নি এদেরকে ঘিরে অভিচারক্রিয়া। আড়ালে-আবাডালে কেউ না কেউ চালিয়েই গেছে এদের উপসনা। উদ্দেশ্য চট জলদি অঢেল টাকা-পয়সা বানানো আর ব্যাপক ক্ষমতা লাভ। যাহোক, মুসলমান হলেও ইসলাম ধর্মে এই কবির কোনো আগ্রহ ছিল না। এ উপসনা করত সম্পূর্ণ অচেনা এক দৈব সত্তাকে। সে তার এই ভগবানকে সম্বোধন করত ইয়গ সতফ বলে। তুমি আমাকে যে বইটি দিয়েছ ওটার একটা অধ্যায়ে ওইসব অভিশপ্ত দেবকূলকে ডেকে এনে কীভাবে তাদের পায়ে নৈবেদ্য দিতে হবে আর নিজের ইচ্ছে পূরণ করতে হবে, সে কথা লেখা আছে।”
“এটাই কী পুরো বই?”
“না। ওটা একটা অংশ মাত্র। বলতে গেলে তিনভাগের একভাগ।”
“বাকি দুভাগ কোথায়?”
“সেইটে বলতে পারবো না। আমি নির্দেশনা পাই স্বপ্নে। সেখানে প্রশ্ন করার কোনো সুযোগ নেই। করলেও দৈব শক্তি সেসব প্রশ্নের উত্তর দেন না। তবে আমি এটুকু বলতে পারি, ওই অধ্যায়ের নির্দেশ অনুযায়ী অভিচারক্রিয়া করলে, তা করতে হবে অতি সাবধানে। চির অন্ধকারের অশুভ শক্তি এ বইয়ের নিয়ামক। অল্প বিদ্যেঅলা মানুষকে সহজেই বিভ্রান্ত করে ধোঁকায় ফেলে দেবে এর ভেতরের লেখা। অনভিজ্ঞ সাধকের শুধু যে করুণ মৃত্যুই ঘটবে তা নয়, অনন্তকাল নরকের কীট হয়ে থাকবে তার আত্মা। অতএব, বাছা আমার, সাবধান হও এ পুস্তকের ব্যাপারে। যেখানে ছিল, সেখানেই রেখে আসতে বলো। এটাকে নিয়ে নাড়াচাড়া করা মানে নিজের বিনাশ ডেকে আনা।”
“গুরুদেব, এ বই থেকে জ্ঞান আহরণের কোনো সুযোগই কি নেই? হলাহলের ভেতরেই অমৃত থাকে, আঁধারের অপর পিঠে যেমন আলো। খারাপটা বাদ দিয়ে শুধু ভালোটাই নাহয় গ্ৰহণ করলাম আমরা।
“না, বাছা। তেমনটা ঘটার সুযোগ নেই এখানে। এ বিদ্যে তোমাকে অনেক কিছু দেবে ঠিকই, তবে শুরু থেকেই একটু একটু করে দূষিত করবে তোমার আত্মাকে। নিজের অজান্তেই অশুভ শক্তির মুঠোর ভেতর চলে যাবে তোমার সত্তা। এ অন্ধকারের শক্তি ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির সময়ের, শয়তানের জন্মেরও বহু আগে এর আবির্ভাব। আমি বলি কী, বইটা এখানেই থাক। কোলকাতায় বয়ে নিয়ে যাওয়ার কোনো দরকারই নেই। কারণ, ওটা কাছে থাকলে যে কারও মতিভ্রম ঘটতে পারে যেকোনো সময়। শনিবার দিন সকালে গঙ্গা স্নান করতে গিয়ে, ওখানেই বিসর্জন দিয়ে আসবোখন।”
“আপনার কাছে রেখে যেতে পারলে খুবই ভালো হতো। কিন্তু ওটা দীনবন্ধুর বই। আপনাকে দেখাবো বলে চেয়ে এনেছি। ওর কাছে এটা ফেরত দিতে হবে আগে। তারপর জানাবো ওটার বিষয়ে আপনার ফয়সালা। প্রয়োজন মনে করলে ওকে ওই বইসহ আপনার কাছে নিয়ে আসবো আমি। তারপর সে-ই ওটা তুলে দিয়ে যাবে আপনার হাতে।”
“দেখো যা ভালো মনে করো। তবে মনে রেখো এ এক তেজস্ক্রিয় পদার্থ। যতক্ষণ কাছে থাকবে, শুধু ক্ষতিই করবে। সুতরাং, যা করার তাড়াতাড়ি করো।”
.
মন্দিরের ভেতর থেকে বইটা এনে শরৎ বাবুর হাতে দিলেন রুদ্র ভৈরব। মঠের উলটোদিকে চায়ের দোকান থেকে সবই চোখে পড়ল চ্যাংয়ের। এখন করণীয় কী? মনেমনে ভাবল সে। ঘটনা নতুন দিকে মোড় নিয়েছে। এ লোকের সাথে ওই বইয়ের সম্পর্ক কী? ট্রায়াডের অফিসে চার এক পাঁচের সাথে যোগাযোগ করতে হবে। পাক যি সিন, যাকে বলা হয় সাদা কাগজের পাখা, কথা বলতে হবে তার সাথে। ট্রায়াডের লোকাল উপদেষ্টা এই লোক। অপারেশনের পরামর্শ আসে এর কাছ থেকে। এখন দরকার একটা ফোন। স্টেশনের কাছে ফোন-ফ্যাক্সের একটা দোকান চোখে পড়েছে। এসটিডি, লোকাল সব ধরনের কলই করা যায়। কোলকাতার পরবর্তী লোকাল ট্রেন আসতে আরও এক ঘণ্টা বাকি। যথেষ্ট সময় আছে হাতে। দেখা যাক কী নির্দেশ আসে ওপর থেকে।
শরৎ বাবু মন্দির চত্বর থেকে বেরুতেই দূর থেকে তার পিছু নিলো চ্যাং। স্টেশনে গিয়ে টিকেট কাউন্টার থেকে টিকেট কেটে প্ল্যাটফর্মে ফাঁকা একটা বেঞ্চিতে গিয়ে বসলেন শরৎ সিনহা। এবার চ্যাং নিজেও একটা টিকেট কিনে ফোন-ফ্যাক্সের দোকানে দিয়ে ঢুকল। আপডেট দিয়ে এখন কী করবে জানতে চাইল সেকথা। চার এক পাঁচ জানাল, পনেরো মিনিটের ভেতর কলব্যাক করে নির্দেশ দেওয়া হবে। দোকানের ফোন নম্বর জানিয়ে কল কেটে দিলো চ্যাং। তারপর ধপ করে বসে পড়ল একটা চেয়ারে। কখন ফোন আসে তারই অপক্ষা এখন।
তৎক্ষণাৎ ম্যাডাম জুইকে ফোন করল চার এক পাঁচ। শত শত অপারেশনে পরামর্শ দিয়ে দিয়ে পেকে ঝুনো নারকোল হয়ে গেছে এই সাদা কাগজের পাখা। একই সাথে ইন্টারকমে লিয়েজোন অধিকারীক খড়ের চটি বা চো হা অর্থাৎ চার তিন দুই-কে জানাল নিচ তলায় ফটিনাইনারদের ভেতর থেকে দুজনকে মোটর বাইক নিয়ে রেডি থাকার নির্দেশ দিতে। ফোনে যদি সাইকিক মহিলাকে পাওয়া না যায়, তাহলে বাইকে করে মেসেঞ্জার পাঠাতে হবে। যে কোনো অপারেশনে সময় অতি গুরুত্বপূর্ণ। ঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ না নিতে পারলে, ক্ষীণ হয়ে আসে লক্ষ্য হাসিল হওয়ার সম্ভাবনা। এসব ব্যাপারে অত্যন্ত স্পিসিফিক চারশো বছরের পুরনো এই মাফিয়া সংগঠন। বছরের পর বছর ট্রেনিং দিয়ে তারপর বানানো হয় সাদা কাগজের পাখা। পাক. যি সিনের সামান্য ভুলের কারণে ফসকে যেতে পারে কোটি ডলার। যাবজ্জীবন জেল হতে পারে ফর্টিনাইনারদের।
তিনবার রিং হতেই দোতলায় বেডরুম থেকে ফোন তুলল ম্যাডাম জুই। নিজের পরিচয় দিলো সাদা কাগজের পাখা, “চার এক পাঁচ বলছি। একটা বিষয়ে আপনার পরামর্শ চাই।”
“আমার এখানে একজন ক্লায়েন্ট আছে। কিছুক্ষণ পরে কল ব্যাক করি?”
ম্যাডাম জুইয়ের বিছানায় তখন পুরোপুরি দিগম্বর হয়ে শুয়ে আছে হ্যান জাও নামের বছর পঞ্চাশের এক হাড় জিরজিরে লোক। ডাক সাইটে চীনে রেস্তোরাঁর মালিক। জুইয়ের জন্যে ওয়ান্টন স্যুপ, কাইচাই, স্পেয়ার রিব, আর মিক্সড হাকা নুডল নিয়ে এসেছে। সাথে লাউশান পাহাড়ি ঝরনার পানি দিয়ে বানানো ৎজিংতাও বিয়ার। স্পাইসি চীনে ডিশের সাথে এ এক অনবদ্য পানীয়। মেইনল্যান্ড চায়না থেকে আসে। ভারতে দুষ্প্রাপ্য।
হ্যান জাও যতখানি ক্লায়েন্ট, তার থেকে বেশি ম্যাডামের অনুরাগী। যখনই আসে ভালোভালো খাবার নিয়ে আসে। সেই সাথে উপহার—পোশাক কিম্বা জুতো অথবা অলংকার। বিদেয় নেওয়ার সময় রেখে যায় এক, দুহাজার টাকা। তাছাড়া যেকোনো দরকারে, জলের কল ঠিক করা থেকে বিদ্যুত বিল দেওয়া অব্দি, হ্যানকে খবর দিলেই হলো। কোনো প্রশ্ন না করে দ্রুততম সময়ের ভেতর সেই কাজ সমাধা করবে হ্যান।
মাঝে মধ্যে অলস দুপুরে মুড ভালো থাকলে ম্যাডাম জুই তাকে ওপরের তলায় নিয়ে যায়। স্বপ্নের মতো এক দেড় ঘণ্টা সময় কাটে হ্যানের। গত একমাস আসতে পারেনি হ্যান। হংকংয়ে ছিল। গতকালই ফিরেছে। ম্যাডামের জন্যে নিয়ে এসেছে বোন চায়না টি-সেট, সোনালি সুতোর কারুকাজ করা সবুজ রঙের সিল্কের হানফু আর কিপাও। সেই সঙ্গে শানজিয়াহু পার্লের মালা। আজকে একান্তে কিছু সময় তো তাকে দিতেই হবে! সদর দরজার ওপর ক্লোজড সাইন ঝুলিয়ে দশ মিনিটও হয়নি নিজের বেডরুমে এসেছে জুই। মাত্রই শুরু হয়েছে ফোর প্লে। এ অবস্থায় তাকে বাইরে বের করা!
“ক্লায়েন্টকে বাইরে অপেক্ষা করতে বলেন,” জলদ গম্ভীর স্বরে বলল, সাদা কাগজের পাখা।
“একেবারে বাইরে বের না করে, অন্য কামরায় সরিয়ে দেই?”
“না। আমাদের কথাবার্তা ওভারহেয়ার করতে পারে। ওই ঝুঁকি কোনোভাবেই নেওয়া যাবে না। ক্লায়েন্টকে বাইরে বের করে, দরজা লক করে, সদর তারপর আবার ফোনে আসুন। তিরিশ সেকেন্ডের ভেতর শেষ করে ফোনে আসবেন।”
“ক্লায়েন্টকে কী বলে বোঝাবো? বহুদিনের পুরনো খদ্দের।”
“ফালতু কথা বলে বেহুদা সময় নষ্ট করছেন আপনি। যা বলছি তা যদি না করেন, তাহলে আপনার ওখানে ফর্টিনাইনার পাঠাবো আমি। আপনাকে তুলে নিয়ে আসবে তারা। এ অপারেশন শেষ না হওয়া অব্দি ট্রায়াডের বেজমেন্টে থাকবেন আপনি। মিশন সাকসেসফুল হলেই শুধু প্রাণে বাঁচবেন, তবে এ শহর ত্যাগ করতে হবে। অন্য কোথাও গিয়ে ডেরা বাঁধবেন। কোথায় যাবেন, কীভাবে কী করবেন– সেসব আপানর দায়িত্ব। মুক্তি পাবেন এই ঢের বেশি। তিরিশ সেকেন্ড সময় গণনা শুরু হবে এখন থেকে।”
হ্যানকে দিয়ে কাপড় পরানো সময় নেই এখন। এক হাত ধরে এক হ্যাঁচকা টান মেরে বিছানা থেকে উঠিয়ে মেঝের ওপর তাকে খাড়া করল জুই। হ্যানের দুপায়ের ফাঁকে ল্যাগব্যাগ করছে নীল শিরাওঠা মাঝারি পৌরুষ। হিংস্র নাগিনীর মতো ফোঁসফোঁস করে জুই বলল, “নিচে নামো, হ্যান। এই মুহূর্তে।”
“কিন্তু এই অবস্থায়! এভাবে বাইরে যাওয়া অসম্ভব! এখন তো কোনোভাবেই না। অনেক আশা করে এসছি। মেলা দিন দেখা হয় না।”
“শাট আপ! আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে চিৎকার করে উঠল জুই। যা বলছি সেটা কর, হারামজাদা। না করলে, লাথি মেরে নিচে ফেলে দেবো চিমসে শুয়োর কোথাকার।”
জুই বদ মেজাজি—একথা জানত হ্যান। কিন্তু এমন রণমূর্তি যে সে ধরতে পারে, তা স্বপ্নেও ভাবেনি। হুড়মুড় করে নিচে নামতে লাগল সে। সিঁড়ির বেয়ে আদ্দেকটা যখন নেমেছে সে, বিছানার চাদরটা তুলে নিয়ে তার দিকে ছুড়ে দিলো জুই। চেঁচিয়ে বলল, “চাদর গায়ে পেঁচিয়ে দরজার বাইরে গিয়ে দাঁড়াও।”
হ্যান বেরুতেই নিচে নেমে দরজায় ছিটকানি দিলো জুই। নিজের রিভলভিং চেয়ারে ধপ করে বসে প্যারালাল লাইনে কলটা ধরল আবার। কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, “জনাব চার এক পাঁচ। বিদেয় হয়েছে ক্লায়েন্ট। যদি অনুমতি দেন তো এখন কথা শুরু করতে পারি আমরা।”
“ভালো। আমাদের একজন ফরটিনাইনার টার্গেট যে লোকের সাথে থাকে তাকে লোকেট করেছে হুগলি জেলার বাঁশবেড়ের একটা মঠে। ওখানকার অধিকারীর সাথে অনেকক্ষণ কথা হয় ওই ব্যক্তির। এরপর তার হাতে একটা বই তুলে দেয় ব্রাহ্মণ মশাই। আমার প্রশ্ন হলো কোনো বইয়ের বিষয়ে আপনাকে কিছু বলেছে টার্গেট?”
“অবশ্যই, মাননীয় জনাব। ওই বই-ই তো আসল জিনিস! ওটার নাম আল আযিফ। অসম্ভব দুষ্প্রাপ্য আর মূল্যবান। যদিও আমি জানি না মঠে যে বই দেখেছে আপনার লোক সেইটেই আসল জিনিস কি না। তবুও এ লোক যেহেতু টার্গেটের সাথে থাকে। একে ধরে এনে বাজিয়ে দেখা যেতে পারে। আর ওই বই যদি সেই বই হয়, তাহলে তো বাজিমাৎ!”
“এই লোককে বইসহ ধরে এনে যদি দেখা যায় ওটা আমরা যা খুঁজছি তা না, তাহলে টার্গেট সাবধান হয়ে যাবে। তখন, এখন যা তার চেয়ে দ্বিগুণ কঠিন হবে কাজি হাসিল করা। আপনি তো সাইকিক। আপনিই বলুন এই ঝুঁকি নেওয়া ঠিক হবে কি না?”
আবারও বিপদে পড়ল ম্যাডাম জুই। কী বলবে এখন? ওই লোককে ধরে যদি দেখা যায়, ওটা ঋক বেদের বই, তাহলে আর দেখতে হবে না। সব দোষ পড়বে তার ঘাড়ে। এগুলেও নির্বংশের ব্যাটা, পেছালেও নির্বংশের ব্যাটা। যদিও দীনবন্ধু বলেছে এই নজ্জুমি কিতাবের জন্যেই তার কোলকাতায় আসা… তারপরেও, নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না—ওই বই-ই সেই বই কি না। ওর সঙ্গী ওটা নিয়ে মঠের অধিকারীর কাছেই বা যাবে কেন? আরবিতে লেখা গোপন বিদ্যে আছে ওখানে। হিন্দু মঠের ব্রাহ্মণ অধিকারী এসবের কী বুঝবে? কার মুখ দেখে যে ঘুম থেকে উঠেছিলাম আজকে! মনেমনে নিজেকে শাপ-শাপান্ত করতে শুরু করল জুই। তবে সাত ঘাটের পানি খাওয়া ঘাগু চিজ সে, তৎক্ষণাৎ জবাব দিলো, “আমি গণনা করি ক্লায়েন্টের সামনে বসে। দূর থেকে আমার বিদ্যে অতখানি ফলপ্রসূ হয় না। এ ব্যাপারে আপনার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। যা ভালো বোঝেন করেন। আপনি বইয়ের ব্যাপারে জানতে চেয়েছেন, বলেছি।”
“ঠিক আছে। যা করার আমরা করবো। তবে আপনাকে আবারও দরকার হতে পারে। ফোনের কাছে থাকবেন। আর যদি বাইরে যান, তাহলে কোথায় যাচ্ছেন, বলে যাবেন আমাদের।”
ফোন রেখে গায়ে নাইট গাউন চাপিয়ে তড়িঘড়ি করে নিচে নামলো ম্যাডাম জুই। সদর দরজা খুলে ডানে-বাঁয়ে চেয়ে দেখল হ্যান এখনও দাঁড়িয়ে আছে কি না। দুদিকে শূন্য ফুটপাথ। যেভাবেই হোক, নিজ ডেরায় ফিরে গেছে হ্যান। ভীষণ দমে গেল ম্যাডামের মন। এই ব্যাটা আদৌ ফিরে আসবে কি না কে জানে? অনেক দিনের পুরনো শাঁসালো গ্রাহক। সন্তুষ্ট করাও খুব সহজ। আরোহণের পর স্থিতিকালের সর্বোচ্চ সময় সীমা তিন মিনিট। চায়না টাউনে অভাব নেই মাঝবয়েসি বিধবা কিম্বা একা থাকে এমন ক্যান্টোনিজ মেয়েলোকের।
ভাত ছড়ালে কাকের অভাব কী আর হয়!
.
ম্যাডাম জুইয়ের সাথে কথা শেষ করে বাঁশবেড়ে স্টেশনের ফোন- ফ্যাক্সের দোকানে কল করল চার এক পাঁচ। চ্যাংকে সে বলল, “ওই লোককে ফলো করো। সুবিধে মতো জায়গায় মাথায় বাড়ি দিয়ে হোক আর কোমরে লাথি মেরে হোক, ওর কাছ থেকে ছিনিয়ে নেবে বইটা। লোকাল ট্রেনে বাঁশবেড়ে থেকে সোনাগাছি ফিরতে সন্ধে হয়ে যাবে। হাওড়া থেকে মেস অব্দি কোথাও না কোথাও নির্জন জায়গা পেয়ে যাওয়ার কথা। তবে এই পরিকল্পনার মূল সমস্যা হলো, ওই ব্যক্তিকে রওনা দিতে হবে পায়ে হেঁটে। যদি রিক্সা ভাড়া করে কিম্বা অন্য কোনো পরিবহন, তাহলে ওর কাছেও ঘেঁষতে পারবে না তুমি।
“দুনম্বর সমস্যা হলো নির্জন জায়গা পাওয়া। এসব কারণে আরেকটা বিকল্প ব্যবস্থাও রাখছি আমি। প্ল্যান বি। বাজাজ থ্রি হুইলার নিয়ে দুজন তোমাদের ফলো করবে স্টেশন থেকে। যদি তুমি একাই ম্যানেজ করতে পারো, তাহলে তো ভালোই। আর তা যদি না হয়, তাহলে ওই দুজন সুবিধে মতো জায়গায় থ্রি হুইলার দিয়ে প্রচণ্ড জোরে ধাক্কা দেবে ওই লোককে। তা সে হেঁটেই যাক, কিম্বা রিক্সায়। মাটিতে পড়ে যাওয়ার পর, তাকে সাহায্য করার ভান করে এগিয়ে যাবে তুমি। মাটি থেকে তোলার চেষ্টা করবে। আর এরই ভেতর থ্রি হুইলারঅলারা তুলে নেবে বইয়ের ব্যাগ।”
চ্যাং বলল, “মনানীয় জনাব, আপনি যে নির্দেশ দিয়েছে তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করা হবে।”
“ঠিক আছে। কাজে লেগে পড়ো এখন। ফিরে যাও ওই লোকের কাছে। খেয়াল রাখবে সে যেন বুঝতে না পারে ফেউ লেগেছে তার পেছনে।”
শরৎ বাবু যেদিকে বসল, তার উলটো সারির দুই সিট পেছনে বসল চ্যাং। সন্ধে হবো হবো করছে, হাওড়া আর বেশি দূরে না। হাওড়ার আগে শেষ স্টেশন লিলুয়া। এখানে এক মিনিটের জন্যে থেমে দাঁড়াল ট্রেন। সেই সাথে কথা নেই বার্তা নেই, উঠে দাঁড়ালেন শরৎ বাবুও। কম্পার্টমেন্টের যে দরজাটা কাছে সেইটে দিয়ে নেমে প্ল্যাটফর্মের ওপর গিয়ে থামলেন।
কাণ্ড দেখে হতভম্ব হয়ে গেল চ্যাং। এমন তো হওয়ার কথা না। কোনোকিছু না ভেবেই স্রেফ রিফ্লেক্সের কারণে ঝট করে সিট থেকে উঠে এক দৌড়ে দরজা পেরিয়ে প্ল্যাটফর্মে নামল সে। পাশেই দাঁড়ানো শরৎ বাবু। তাকিয়ে আছে তার দিকে। থমথম করছে মুখ, চোখে প্রশ্ন। ততক্ষণে চলতে শুরু করেছে ট্রেন। হাতের ইশারায় চ্যাংকে সাথে আসতে বলে ওয়েটিংরুমের সামনে একটা কক্রিটের বেঞ্চের দিকে এগিয়ে গেলেন শরৎ বাবু। চ্যাংকে নিয়ে বসলেন। সোজাসুজি জিজ্ঞেস করলেন, “আমারদের পাড়ায় সবজির দোকানে বসতে দেখেছি আপনাকে। সকাল থেকেই আমার পেছনে লেগে আছেন। ব্যাপার কী?”
চুপ করে বসে আছে চ্যাং। কী বলবে বুঝতে পারছে না। ভেস্তে গেছে পুরো প্ল্যান। তা যাক, সমস্যা হলো চার এক পাঁচের কাছে কীভাবে ব্যাখ্যা করবে এসব। পইপই করে তাকে বলা হয়েছে, পেছনে যে ফেউ লেগেছে তা যেন ঘুণাক্ষরেও বুঝতে না পারে সাবজেক্ট। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে গোড়া থেকেই সব জেনে বসে আছে এই হিন্দু মাস্টার!
“কী হলো কথা বলছেন না কেন? একজন সাধারণ স্কুল মাস্টার আমি। কোনো ঝগড়া-ঝাঁটি, মারামারি চাই না। আপনি কেন আমাকে ফলো করছেন জানতে পারলে আলোচনা করে একটা সমাধানে আসা যেতে পারে। বলি কী, যে বা যারা আপনাকে দিয়ে একাজ করাচ্ছে তার বা তাদের কাছে নিয়ে চলুন আমাকে। সরসরি কথা বলে সুরাহা করে ফেলি ব্যাপারটা। কী বলেন?”
কিছুক্ষণ থম ধরে বসে থেকে চ্যাং বলল, “ঠিক আছে। এই বেঞ্চেই অপেক্ষা করুন আপনি। একটা ফোন করে আমার বসকে বিষয়টা জানাই আগে। তারপর, বোঝা যাবে করণীয় কী? তবে আমাকে এই নিশ্চয়তা দিতে হবে আমি ফোন করে ফিরে না আসা অব্দি এখানেই অপেক্ষা করবেন। কোথাও চলে যাবেন না কিম্বা গা ঢাকা দেবেন না।”
“আমার ওপর ভরসা রাখেন। এখানে আছি আমি। তবে বেশি সময় নেবেন না। যা করার তাড়াতাড়ি করবেন।”
তবুও নড়ে না চ্যাং। কুতকুতে চোখে চেয়ে আছে শরৎ বাবুর দিকে। মনে সন্দেহের দোলাচল। পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছে না শরৎ বাবুকে। এইবার তাড়া লাগালেন শরৎ বাবু। বললেন, “আপনি যাবেন? না, উঠে বাসার দিকে রওনা দেবো আমি? তা যদি করি এখন, আপনি আটকাতে পারবেন আমাকে?”
কাজ হলো এবার। হনহন করে হেঁটে স্টেশনের গেট দিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল চ্যাং। আশেপাশে ফোন-ফ্যাক্সের দোকান খুঁজে বের করতে হবে এখন। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।
চার এক তিনকে পাওয়া গেল না ফোনে। স্ট্র স্যান্ডাল বা খড়ের চটি কথা বলল। সংক্ষেপে বিষয়টা তাকে জানাল চ্যাং। চার তিন দুই বলল, “ওই ভদ্রলোককে গুয়াংঝাউ রুমে নিয়ে এসো। ট্যাক্সি নিয়ে আসবে। এক ঘণ্টার ভেতর ওখানে দেখা করবো তার সাথে। আসার সময় হাওড়া হয়ে আসবে। যে টিমটা থ্রি হুইলার নিয়ে অপেক্ষা করছে, সেটা তোমাদের ট্যাক্সি ফলো করবে। আর কোনো উটকো ঝামেলা হোক—এটা চাই না আমরা।”
গুয়াংঝাউ চায়না টাউনের কাউলুন রেস্তোরাঁর একটা ডাইনিং রুমের নাম। কাউলুন রেস্তোরাঁ মূলত চীনে খদ্দেরদের জন্যে। আসল চীনে খাবার রান্না হয় এখানে। মোট তিনটে ডাইনিং রুম রাখা হয়েছে। একটা সাধারণ চীনে খদ্দের কিম্বা নাছোড়বান্দা ভারতীয় খদ্দেরদের জন্যে। আরেকটা মাস্তানদের জন্যে। অবৈধ জুয়ার আড্ডা, লোন শার্কিং, আর বেশ্যাদের নিয়ে কারবার করে এরা। তিন নম্বর রুম অর্থাৎ গুয়াংঝাউ শুধুমাত্র ট্রায়াডের মেম্বারদের জন্যে। অধিকাংশ সময় বন্ধ রাখা হয় এটা। কেবল ট্রায়াড সদস্যরা এলেই খোলা হয়। এই রুমে ঢোকা কিম্বা বেরুনোর জন্যে তিনটে দরজা আছে। একটা সবাই দেখতে পায়, আরেকটার খবর জানে ট্রায়াডের সাধারণ মেম্বররা। তিন নম্বর দরজার খোঁজ জানে শুধুমাত্র সংগঠনের অধিকারীকরা। তবে দুই আর তিন নম্বর দরজা ব্যবহার করা হয় না বললেই চলে। ওগুলো শুধু জরুরি বা অতি জরুরি অবস্থায় ব্যবহার্য। কেউ দেখিয়ে না দিলে খালি চোখে ওসব দরজা খুঁজে বের করা অসম্ভব।
এক ঘণ্টা পর শরৎ বাবুকে নিয়ে গুয়াংঝাউ ডাইনিং রুমে ঢুকল চ্যাং। পলিশ করা কাঠের প্যানেলিং দিয়ে ঢাকা দেওয়াল। ছাদ থেকে ঝুলছে অসংখ্য ডেংলং বা রঙিন কাগজে তৈরি চীনে লণ্ঠন। একটা দেওয়াল জুড়ে চীনে স্টাইলে প্রাকৃতিক দৃশ্য আঁকা। আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ, নিচে উত্তাল সমুদ্র, একপাশে গাছে ঘেরা পাহাড়ের সারি। একটা ছোট্ট ছেলে বেলাভূমিতে দাঁড়িয়ে চাঁদের দিকে তাকিয়ে আছে। দৃশ্যের নিচে প্রথমে চীনে অক্ষর তারপর ইংরেজিত লেখা—হং। সাদা ধপধপে টেবিল ক্লথ পাতা চারজনের বসার মতো তিনটে ছোটো টেবিল আর একপাশে বিশজন বসতে পারে এমন আরেকটা বড়ো টেবিল। সাদা কভার মোড়া গদি আঁটা চেয়ার। প্রত্যেকটা টেবিলে কালো পোর্সেলিনের ফুলদানিতে তাজা চীনে গোলাপ, কাচের মোমদানিতে মোমবাতি। ঠান্ডা পরিবেশ জুড়ে হালকা সুবাশ।
চারজন বসতে পারে এমন একটা ছোটো টেবিলে বসেছিল খড়ের চটি বা চার তিন দুই। ক্লিন শেভড, ক্রুকাট চুল, কালো স্যুট, সাদা শার্ট, লাল টাই, কালো জুতো। চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা। প্রথম দেখাতেই একে দূতাবাসের অফিসার কিম্বা বহুজাতিক কোম্পানির উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা বলে মনে হবে। চ্যাং শরৎ বাবুকে নিয়ে টেবিলের কাছে আসতেই চেয়ার ছেড়ে সটান উঠে দাঁড়াল খড়ের চটি। স্মিত হেসে হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করে চেয়ারে বসাল তাকে। তারপর চ্যাং এর দিকে তাকিয়ে বলল, “ধন্যবাদ। তুমি বাইরে অপেক্ষা করো। আর হ্যাঁ, ম্যানেজমেন্টকে বলো আমাদের সার্ভিস দিতে।
“জি আচ্ছা, মাননীয় জনাব,” উত্তর দিলো চ্যাং। তারপর মাথা ঝুঁকিয়ে বাউ করে বেরিয়ে গেল গুয়াংঝাউ ডাইনিং রুম থেকে।
“শরৎ বাবু, আপনি নিজ থেকে আমাদের সাথে যোগাযোগ করতে চেয়েছেন সেজন্যে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আপনি যেমন ঝামেলা এড়িয়ে যেতে চান, আমরাও তেমনি। ন্যুনতম সময়ে ঝই-ঝামেলা এড়িয়ে লক্ষ্যবস্তু হাসিল করাই আসল কথা। মারামারি-কাটাকাটি করে ক্ষতির পাল্লাই শুধু ভারী হয়।”
“আমার নামধাম জেনে বসে আছেন দেখে বুঝতে পারছি আমার সম্পর্কে ভালোই খোঁজখবর নিয়েছেন। আপনারা কারা? তাছাড়া, আপনার লোক আমাকে ফলো করছে কেন?” কাটকাট উত্তর দিলেন শরৎ বাবু।
এরই ভেতর হাতলছাড়া ছোটো ছোটো দুটো কাপ, পিরিচ আর টি পট ভরতি চা নিয়ে এগিয়ে এলো লাল টুকটুকে চীনে পোশাক পরা অপূর্ব সুন্দর এক তরুণী। সাথে ছোটো ছোটো বাটিতে শুকনো ডুমুর, অ্যাপ্রিকট, কিশমিশ, পেস্তা বাদাম, ভাজা কুমড়ো বিচি, চা পাতা দিয়ে সেদ্ধ করা ডিম, আর ছোটো ছোটো বনরুটি। কাপে চা ঢেলে শরৎ বাবুর দিকে এগিয়ে দিলো চার তিন দুই। বলল, “প্লিজ নিন। অন্যকিছু না খান, ডিম সেদ্ধটা অবশ্যই খাবেন। আমাদের দেশের খুবই জনপ্রিয় খাবার ওটা।”
চায়ে চুমুক দিয়ে শরৎ বাবু বললেন, “আমার প্রশ্নের উত্তর কিন্তু এখনও পাইনি। সারাদিন ধরে দৌড়ের ওপর আছি। বাসায় গিয়ে রেস্ট করবো। দয়া করে যদি একটু তাড়াতাড়ি করেন, তো ভাল হয়।”
“নিশ্চয়। তবে একটা বিষয় আগে পরিষ্কার করে নেই। আপনি যা জানতে চাইছেন তার সঠিক উত্তর আমি দেবো, তবে শর্ত আছে। এসব কথা কোনোভাবেই কাউকে বলতে পারবেন না।”
“যদি বলে দেই তো কী হবে?”
“আপনাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়া হবে। সেই সাথে আপনার নিকটতম দুজন আত্মীয়কেও। আপনি আমাদের সাথে নিজ থেকেই কোঅপারেট করতে চেয়েছেন। এর মূল্যয়ন আমরা অবশ্যই করবো। আপানার বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে হলে সত্যি কথা বলা বাঞ্ছনীয়। একথা নিশ্চয় জানেন ক্লাসিফায়েড তথ্য গোপন রাখা এক অতি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। ওই দায়িত্ব আপনাকে পালন করতে হবে। এখন বলেন আপনি কি আপনার প্রশ্নের সঠিক উত্তর চান? না, এসব তথ্য না জেনে এমনিতেই কাজ করবেন? একবার সবকিছু জানলে পেছানোর কোনো উপায় নেই।”
“সমস্যা নেই। আপনি আমার প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিন।”
“বেশ। বলছি শুনুন। আমরা যে সংগঠনে কাজ করি তাকে বলে ট্রায়াড। চীনে ভাষায় স্যান হি হুই, সংক্ষেপে হং। এর অর্থ মানুষের সাথে মহাকাশ আর পৃথিবীর ঐক্য স্থাপন। সাড়ে তিনশো বছরের পুরনো এই প্রতিষ্ঠানের শুরু চীনের গুয়াংঝাও-এ। অনেকেই একে দুনিয়ার সবথেকে শক্তিশালী মাফিয়া বলে, যদিও আমাদের ব্রত অনেক বেশি মহান। ষোলোশো সালের মাঝামাঝি উত্তরের মাঞ্চুরিয়া থেকে চিং রাজবংশ এসে মিং রাজাদের সরিয়ে পুরো চিনকে কব্জা করে ফেলে। এটা মিংয়ের অনুসারীরা অর্থাৎ দক্ষিণের লোকেরা একেবারেই মেনে নিতে পারেনি। চিংদের সরানোর জন্যে এক গোপন সংগঠন খাড়া করা হয়। উদ্দেশ্য যেকোনো মূল্যে চিংদের সরিয়ে মিং রাজবংশকে ফিরিয়ে আনা। ছোটো-বড়ো যে সংগঠনই হোক, তা চালাতে পয়সা লাগে। এর- তার কাছ থেকে চাঁদা তুলে আর কতই বা পাওয়া যাই। বাধ্য হয়ে দ্রুত পয়সা আসে এমন সব কারবারে নামতে হলো। মাদক, প্রটেকশন মানি, লোন শার্কিং, জুয়া, দেহ-ব্যাবসা, অস্ত্র বেচাকেনা—এইসব আরকি।
“পুরাকালের এক মহান জেনারেল গুয়ান ইউকে দেবতা মেনে তার বেদিতে শুয়োর কিম্বা ছাগল বলি দিয়ে আমৃত্যু সংগঠনের সেবা করার শপথ নিতে হয় প্রত্যেক সদস্যকে। আগে অনেক বেশি থাকলেও বর্তমানে সারা দুনিয়ায় মোট সদস্য ছাপান্ন হাজার। আমাদের সংগঠন যারা চালান তাদের অবস্থান নির্ধারিত হয় আই চিং পদ্ধতিতে, আড়াই হাজার বছরের পুরনো সংখ্যাতত্ত্ব মেনে। এ এক স্বর্গীয় দৈব চয়ন প্রক্রিয়া। এই কারণেই প্রত্যেক বড়ো শহরে যেখানে ট্রায়াড সক্রিয়, সেখাণে আই চিং প্রক্রিয়ায় দক্ষ সাইকিকদের সংগঠনে জায়গা দেওয়া হয়। স্থানীয় কাউকে না পাওয়া গেলে, হংকং থেকে আনিয়ে নেওয়া হয়। যাহোক, শতশত বছরে দুনিয়ার সব বড়ো শহরে শক্ত ঘাঁটি গেড়েছে ট্রায়াড। নিয়ন্ত্রণ করছে হাজার-কোটি ডলারের ব্যাবসা। এই প্রতিষ্ঠান চালান ক্ষমতাধর কোটিপতি চীনে ব্যবসায়ীরা যাদের প্রশাসনিক দক্ষতা প্রশ্নাতীত। এদের সবাই অগুণতি বৈধ ব্যাবসারও মালিক। সরকারের উঁচু পর্যায়ে রয়েছে বিস্তর যোগাযোগ। শুধু টাকা- পয়সাই না, ক্ষমতা কুক্ষিগত করার ব্যাপারেও ট্রায়াড খুব সক্রিয়। লেটেস্ট প্রযুক্তি, দুষ্প্রাপ্য ওষুধ, প্রলয়ঙ্কারী কাণ্ড ঘটায় এমন মারণাস্ত্রের কারাবারও আছে আমাদের। বিভিন্ন দেশের সরকারের কাছে সরবরাহ করা হয় ওগুলো। এতে এক ঢিলে দুই পাখি মরে। টাকাও পাওয়া যায়, সরকারি মহলে কানেকশনও তৈরি হয়।”
“সবই ঠিক আছে। কিন্তু এসবের সাথে আমার কী সম্পর্ক? আমি একজন ছাপোষা মাস্টার বই তো অন্যকিছু নই। আপনাদের দুনিয়া আর আমার জগৎ সম্পূর্ণ ভিন্ন।”
“সম্পর্ক থাকার কথা ছিল না, তবে এখন হয়েছে।”
“কীভাবে?”
“আপনার কাছে একটা বই আছে। বহু পুরনো। নাম আল আযিফ। ওটা আমাদের দরকার।”
মনেমনে ভয়ানক চমকে উঠলেন শরৎ বাবু। এ বইয়ের কথা এ চীনেগুলো জানলো কীভাবে? এরা অন্তর্যামী নাকি! মুখে বললেন, “কী করবেন ওই পুরনো বই দিয়ে? অ্যান্টিক হিসেবে বাজারে বেচবেন? ১৮২৫ সালে কোলকাতা থেকে ছাপা এ বই। এমন আহামরি কিছু না।”
“ও বই এক অনন্ত ক্ষমতার উৎস। শুরু থেকেই ট্রায়াড অতিপ্রাকৃত ক্ষমতায় বিশ্বাসী। বিগত সাড়ে তিনশো বছর ধরে অসংখ্য সাইকিক কাজ করেছে এই সংগঠনের হয়ে। এখনও করছে। আল আযিফ বিশেষ কোনো পথের সন্ধান দিতে পারে কিনা সেইটে আমরা যাচাই করে দেখতে চাই।”
“কিন্তু আমার কাছে যে এ বই আছে, তার খোঁজ আপনারা পেলেন কীভাবে?”
“অনেকটা কাকতালই বলতে পারেন। চায়না টাউনের এক সাইকিক আমাদের সংগঠনের সদস্য। আপনার বাংলাদেশী বন্ধু ওর ওখানে গিয়েছিল ভাগ্য গণনা করাতে। তার হাঁড়ির সব খবর ওই সাইকিকই বের করেছে।”
“এ ঘটনার পর থেকেই আমাদের মেসের ওপর নজর রাখছেন আপনারা?”
“আজ্ঞে, হ্যাঁ।”
“কিন্তু আমার কাছে যেটুকু আছে, সে তো খুবই সামান্য। একটা মাত্র অধ্যায়। আল আযিফ এর থেকে ঢের বেশি বড়ো বই। আমার তো ধারণা আপনি যতটুকু বলেছেন তা যথেষ্ট নয়। এর ভেতরে আরও বিষয় আছে যা আমাকে এখনও বলেননি। ঠিক কি না?”
“আজ্ঞে, ঠিক। আপনি হয়তো জানেন কোলকাতায় এসে প্ৰথম যে চীনেম্যান বড়ো অঙ্কের টাকা বিনিয়োগ করেছিল তার নাম টং অ্যাচিউ। তখন ওয়ারেন হেস্টিংস-এর আমল। ঢেলে সাজানো হচ্ছে কোলকাতাকে। রাতদিন কাজ করছে অসংখ্য বিদেশি। প্রয়োজন নিত্য-নতুন ভোগ্যপণ্যের। চিনির ব্যাপক চাহিদা। এই টং করল কী, এখন যেখানে চায়না টাউন সেখান থেকে তেত্রিশ কিলো দূরে অছিপুরে একরের পর একর জমি কিনে চিনিকল বসাল। দেখতে দেখতে আঙুল ফুলে কলাগাছ। সাহেব-সুবোদের সাথে বেজায় খাতির হলো তার। এই সাহেবদের ভেতর দুইজন ছিল ভারী অন্যরকমের। একজনের নাম জর্জ টমাস আরকেজন হেনরি ক্রাইটন।
“টং শিগ্রি বুঝতে পারল: অন্য যত ইংরেজ সাহেব আছে তাদের থেকে এদুজন একেবারেই আলাদা। শুধু যে জিরো থেকে হিরো হয়েছে, তাই-ই না, কেমন যেন অদ্ভুত এদের চাল-চলন। সব সময় কী যেন গোপন করার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। যদিও হেনরির সাথে তার দেখা হয়েছিল জর্জ মারা যাওয়ার পর। জর্জের মদ খাওয়ার খুব বাতিক ছিল। অনেক চিনিকলে কেইন মোলাসেস অর্থাৎ চিটেগুড় থেকে রাম তৈরির একটা রিফাইনারি থাকে। চিনিকল চলে এক সিজন। রাম তৈরি হয় পুরো বছর জুড়ে। ক্ষেত্ৰ বিশেষে ওই রামই চিনির থেকে বেশি দামে বিকোয়।
“যাহোক, জর্জকে ঢালাওভাবে দাওয়াত দিতে লাগল টং। পরিবেশন করতে লাগল সবথেকে সেরা রাম। সেই সাথে মনোরঞ্জনের জন্যে থাকল সুন্দর, চীনে তরুণী। জর্জ কোলকাতায় না আসতে পারলে, টং-ই সুরা-নারী নিয়ে তার ওখানে গিয়ে দেখা করে। হলায়-গলায় ভাব হলো দুজনের। বেহেড মাতাল অবস্থায় তার কাছ থেকে একদিন এক অদ্ভুত দেবতা আর বইয়ের কথা জানতে পারল টং। জর্জ কথা দিয়েছিল কোলকাতায় গিয়ে বইটা তাকে দেখাবে। কিন্তু বিধি বাম। বহরমপুরে মারা যাওয়ার পর জর্জের কাছে থাকা পাণ্ডুলিপিটা পড়ল হেনরি ক্রাইটনের হাতে। বইটা দেখামাত্র ওটা কী জিনিস চিনতে পারে হেনরি। কারণ, ওরকমই একটা জিনিস সে খুঁজে পেয়েছিল ফিরোজ মিনার ঠিকঠাক করতে গিয়ে।”
“এত কথা এতদিন পর আপনারা জানলেন কীভাবে? টংয়ের আত্মাকে কি আপনাদের সাইকিক ডেকে এনেছিল!”
“আজ্ঞে, না। টং ছিল ট্রায়াডের তৃতীয় স্তরের নির্বাহী। হং কোয়ান বা লাল খুঁটি। এসবের পুঙ্খানুঙ্খ রিপোর্ট সে হংকংয়ের সেরেমনি মাস্টার হিয়ং চুয়ের কাছে পাঠিয়েছিল। ওই তথ্য ওখানকার সাইকিকদের জানানো হয়। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকে তারা। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো: টং এই পাণ্ডুলিপি দেখতে পাওয়ার আগেই হঠাৎ করেই মারা যায় হেনরি ক্রাইটন। ট্রায়াডের কর্মীরা শতশত বছর ধরে যেখানে যত আধিভৌতিক ঘটনা বা অমিনাস আর্টিফ্যাক্টসের মুখোমুখি হয়েছে তার সব রির্পোট হংকংয়ে পাঠিয়েছে। আর ওখানকার প্রধান সাইকিক ওই সমস্ত রিপোর্ট সযত্নে আর্কাইভে সংরক্ষণ করেছে। নতুন যত সাইকিক ট্রায়াডে জয়েন করে তাদের সবার জন্যে এসব তথ্য জানা বাধ্যতামূলক। এ কারণেই আমরা যখন হংকংয়ে আমাদের প্রধান সাইকিক মাক লিং লিং-কে এ বিষয়ে বলি, এক দিনের ভেতর এসব কথা আমাদের জানিয়ে দেয় সে।”
“তাহলে আপনারা চাইছেন, আল আযিফের পাণ্ডুলিপি যাতে আপনাদের হাতে আসে সেই ব্যবস্থা করতে।”
“একদম ঠিক।”
“আপনারাই বলছেন টং না ফং বহুত চেষ্টা করেও হাতে পায়নি ওটা। আমি এ বিষয়ে কী করতে পারি? হারিয়ে যাওয়া ওই পাণ্ডুলিপি কোথায় খুঁজবো এখন? আর খুঁজে যদি পাই-ও, তবুও লাভ কী? যতটুকু বুঝতে পারছি ওটা হাতে আসা মাত্র তুলে দিতে হবে আপনাদের হেফাজতে।”
“আমাদের হাতে তুলে দেবেন একথা ঠিক। তবে তার বিনিময়ে সম্মানিও পাবেন। বাড়তি পাওনা হিসেবে, যদি চান, ওই বই নিয়ে এক কিম্বা দুদিন এক্সপেরিমেন্ট করেও দেখতে পারেন। আপনি নিজেই তো একজন জ্যোতিষী। এ ধরনের বই ভবিতব্য জানার ব্যাপারে কীভাবে কাজ করে সেইটে জানতে চান না?”
“আপনি বলছেন সম্মানি দেবেন।”
“ঠিক তাই।”
“কত টাকা?”
“পঞ্চাশ লাখ।”
সে তো মেলা টাকা! সারা মাস খেটে বেতন পাই মাত্ৰ নয়শো! এ যে স্বপ্নের অতীত। কিন্তু দীনবন্ধুর কী হবে? সে কিছু পাবে না?”
“তাকে নিয়ে যদি কাজ করেন, তাহলে আরও তিরিশ লাখ বরাদ্দ থাকবে।”
“তার মানে আমি পঞ্চাশ লাখ আর দীন তিরিশ?”
“ঠিক।”
“এত টাকা কী আপনারা সত্যিই দেবেন?”
“অবশ্যই। কোনো চুক্তির বরফেলাপ করে না ট্রায়াড। অর্ধেক আগেই পাবেন, বাকিটা পাণ্ডুলিপি আমাদের হাতে তুলে দেওয়ার পর।”
“আচ্ছা অ্যাডভান্স-ট্যাডভান্স আপাতত থাক। পরে চেয়ে নেবো খন। মেসে থাকি। অতটাকা ওখানে রাখা নিরাপদ নয় মোটেও। এখন বলুন আমাদেরকে দিয়েই এ কাজ করাচ্ছেন কেন?”
“কারণ, আমরা মনে করি আপনি আর আপনার ওই বাংলাদেশী বন্ধু এই বিষয়ে জানতে আগ্রহী। তাছাড়া ট্রায়াডের সদস্যরা অধিকাংশ চীনেম্যান। যদিও তারা বাংলা জানে, তবুও ওই পাণ্ডুলিপি খুঁজে বের করতে হলে এ বিষয়ে জ্ঞান আছে এমন ভারতীয় লোক লাগবে। কোথায়, কার কাছে যেতে হবে কে জানে? পুরনো সূত্র ধরে এক পা এক পা করে এগুতে হবে। এন্তার গবেষণার ব্যাপার। আমাদের সংগঠনের লোক দিয়ে ওকাজ সম্ভব না। তবে হ্যাঁ, আপনাদের যাতে কাজে কোনো অসুবিধা না হয়, সেজন্যে অর্থ, লোকবল, পরিবহন—এসব দিয়ে সাহায্য করবো আমরা।”
“আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে ওই পাণ্ডুলিপি এদেশেই কোথাও আছে।”
“ঠিকই ধরেছেন। আমাদের ধারণা এদেশ অর্থাৎ পুরো ভারতবর্ষ নয়, পশ্চিমবঙ্গেরই কোনো এক জায়গায় ওটা আছে।”
“এত নিশ্চিত হচ্ছেন কীভাবে?”
“দুশো বছর আগে টং যে রিপোর্ট হংকংয়ে পাঠিয়েছিল, সেই রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে।”
“চাইলে পাওয়া যাবে ওই রিপোর্ট?”
“না। ট্রায়াডের সদস্য নয় এমন কাউকে সংগঠনের কোনো রিপোর্ট পড়তে দেওয়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। তবে হ্যাঁ, ওটার ব্যাপারে যেন জানতে পারেন, সেই ব্যবস্থা করা যাবে।”
“কী ব্যবস্থা?”
“এখানকার সাইকিক ম্যাডাম জুইকে সাথে নিয়ে কাজ করবেন আপনারা। যা কিছু প্রশ্ন আছে সরাসরি তাকে করবেন। আশা করি কাজ হবে এতে।”
“আপনার প্রস্তাবে যদি রাজি হই, তাহলে আমাদের করণীয় কী?”
“আমি পরামর্শ দেবো তিনজনের একটা টিম বানাতে। আপনি নিজে, আপনার ওই বাংলাদেশী বন্ধু, আর ম্যাডাম জুই। আপনারা বসে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিন কীভাবে এগুবেন। লক্ষ্যবস্তু হলো আল আযিফের পাণ্ডুলিপি খুঁজে বের করে আমাদের হাতে তুলে দেওয়া। এ কাজের বিনিময়ে কী পাবেন সে তো আগেই বলেছি।”
“ঠিক আছে। এখন তাহলে মেসে ফিরে যাই, কি বলেন?”
“অবশ্যই। আমাদের লোকেরা আপানকে পৌঁছে দিয়ে আসবে।”
শরৎ বাবু উঠে দাঁড়াতে যাবেন, এমন সময় খড়ের চটি বলল, “আপনার কাছে যে বইটা আছে ওটা রেখে যেতে হবে এখানে। আশা করি কিছু মনে করবেন না। কেবল মুখের কথার ওপর তো পুরোপুরি ভরসা করা যায় না, জামানত হিসেবেও কিছু থাকার দরকার।”
“কিন্তু পাণ্ডুলিপি খোঁজাখুঁজি করতে গেলে যদি ওটার প্রয়োজন পড়ে?”
“চাওয়া মাত্র পাবেন। ম্যাডাম জুইয়ের কাছে থাকবে। যখন ইচ্ছে চেয়ে নিয়ে ব্যবহার করবেন।”
“আচ্ছা মেনে নিলাম আপনার কথা,” কাঁধের ঝোলা ব্যাগ থেকে শাহনামা বের করে টেবিলের ওপর রেখে বললেন শরৎ বাবু। “কিন্তু আপনাদের সাথে যোগাযোগ করবো কেমন করে?”
“আপনার যে পিছু নিয়েছিল তার নাম চ্যাং। ওকে তো চেনেনই। আপনাদের পাড়ায় ওর সাথে থেকে আরও একজন যে সবজির দোকান চালাচ্ছে সে ছেলেটাকেও নিশ্চয় দেখেছেন। মিশন শেষ না হওয়া অব্দি এরা ওখানেই থাকবে। যে কোনো প্রয়োজনে এদের একজনকে খবর দিলেই হবে। আর হ্যাঁ, এখনই আপনাকে এক লাখ টাকা দিচ্ছি আমরা। এখানে-ওখানে যেতে হবে, থাকতে হবে—এসবের খরচা আছে। চাওয়া মাত্র আপনার বাসায় অ্যাডভান্সের চল্লিশ লাখ টাকা পৌঁছে দেওয়া হবে। আপনার বন্ধুর সাথে আলোচনা করে অ্যাকশন প্ল্যান রেডি করুন। পরশু ম্যাডাম জুইয়ের কাছে আপনাদের নিয়ে যাবে চ্যাং। কোনো প্রশ্ন?”
“আপাতত নেই।”
“গুড। এই নিন টাকা, একথা বলে শরৎ বাবুর দিকে এক বান্ডিল নোট এগিয়ে দিলো খড়ের চটি। “এখানে এক লাখ আছে। ইচ্ছে হলে গুনে দেখতে পারেন।”
মেসে ফিরে রাতে কিছু খেলেন না শরৎ বাবু। দীনবন্ধুর সাথেও তেমন কোনো কথা বললেন না। বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন। পরদিন স্কুল থেকে এক মাসের ছুটি নিলেন শরৎ বাবু। বিকেলের চা-নাস্তা খেয়ে দীনবন্ধুকে সাথে নিয়ে নিজের ঘরে চৌকির ওপর বসলেন। যা যা ঘটেছে সেসব জানালেন তাকে। বললেন, “আল আযিফ আদৌ খুঁজে পাওয়া যাবে কি না তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। পাওয়া গেলেও ওটা আসলেও কোনো কাজে আসবে কি না, কে জানে?”
“যদি পাওয়া যায় তাহলে কী ওটা ট্রায়াডের হাতে তুলে দেবেন?”
“কী করবো তা আমি জানি না। ট্রায়াড দুনিয়ার সবথেকে শক্তিশালী মাফিয়া। এদের হাত থেকে রেহাই পাওয়া দুষ্কর। যা চাইছে, তা তুলে না দিয়ে পার পাওয়া যাবে না।”
“এসব বাদ দিলে হয় না?”
“এখন আর পিছিয়ে আসার উপায় নেই। যদি বলি এ কাজ আমরা করবো না, তাহলে জান নিয়ে টানাটানি পড়বে। তবে একটা পথ হয়তো এখনও খোলা আছে। চাইলে তুমি বাংলাদেশে ফেরতে যেতে পারো। ওদেরকে বলতে হবে আমি আর ম্যাডাম জুই মিলে কাজটা করবো, কিন্তু তোমাকে এই দায় থেকে মুক্তি দিতে হবে। কী বলো?”
“না, দাদা। ভুলেও করতে যাবেন না ওকাজ। আপনার মতো আমিও একজন টিচার। জানার আগ্রহ আমারও কম না। এই বইয়ের কারণেই আমার কলিগ মারা গেছে। মিথ্যে বলতে হয়েছে দেবতুল্য বাবার কাছে। বর্ডার ডিঙিয়ে কোলকাতায় আসার হেতুও এ বই। আমি এর শেষ দেখতে চাই।”
“বিলক্ষণ বুঝতে পারছি তোমার মনের অবস্থা। কিন্তু শুধু আবেগ দিয়ে তো কাজ চলে না। বাস্তবতাও দেখতে হয়। একাজে মৃত্যু ঝুঁকি আছে। ট্রায়াড এক অতি নিষ্ঠুর, খুনি সংগঠন। এদের কাছে মায়া-দয়া বলে কিছু নেই। স্বার্থের বাইরে কোনোকিছুকেই প্রশ্রয় দেয় না এরা। যদি পাণ্ডুলিপি খুঁজে বের করতে না পারি, তাহলে কী হবে ভগবান জানেন! আর ওটা যদি খুঁজেও পাই, তাহলেও পরিস্থিতি এমন দাঁড়াতে পারে, ও বই নিয়ে পরীক্ষা- নীরিক্ষা করতে গিয়ে আমরাই মারা পড়লাম। তুমি কি ধরতে পারছ আমার কথা?”
“অবশ্যই। কিন্তু ওসব আমি পরোয়া করি না। আগেই বলেছি—এর শেষ দেখতে চাই। আমার যদি ভালোমন্দ কিছু হয়েও যাই, সেজন্যে আপনি দায়ী হবেন না। সত্যি বলতে কী, এসব কথা বলে সময় নষ্ট না করে আসুন, আমাদের পরবর্তী কার্যক্রম কী হবে সেইটে নিয়ে আলোচনা করি। কী বলেন?”
“বেশ, তবে তাই হোক। কালকে সকালে আমাদের প্রথম কাজ হলো ম্যাডাম জুইয়ের সাথে দেখা করা। আর সেজন্যে এই বেলাতেই চ্যাংকে খবরটা জানিয়ে রাখতে হবে। এই সাইকিক কোথায় থাকে জানা নেই। ওই চীনে ব্যাটাই আমাদের ওর কাছে নিয়ে যাবে। ও হ্যাঁ, আরেকটা কথা—তুমি যে আমার এখানে এসে উঠেছ সেটা একবার আমি গিয়ে জানিয়ে এসেছি। কিন্তু তুমি নিজে একবারও যাওনি। দর্জি পাড়ায় তোমার পিসেমশাই ভতারিণীর ওখানে গিয়ে আজই খবরটা দিয়ে আসবে। বাংলাদেশে তোমার বাবাকে যেন জানিয়ে দেন তুমি কুশলেই আছ। কোনো সন্দেহ নেই ওপারে তোমার মা-বাবা দুঃশ্চিন্তায় আছেন।”
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন