শুভঙ্কর বাঁধ রোডের মালদা জাদুঘরে পৌঁছতে পৌঁছতে দুপুর গড়িয়ে গেল। ১৯৩৭ সালে তৈরি এই মিউজিয়ামের কিউরেটর সাধন বাবু তখন লাঞ্চ করতে গেছেন। দীনবন্ধু আর ম্যডাম জুইকে কিসমত পাঠানের সাথে লাঞ্চ করতে পাঠিয়ে শরৎ বাবু আর আব্দুল খান অপেক্ষা করতে লাগল। ঘণ্টাখানেক পর অফিসে ফিরলেন কিউরেটর। ধুতি-পাঞ্জাবিপরা, সিড়িঙ্গে চেহারার লোক। বছর পঞ্চাশ বয়স, কলপকরা চুল।
শরৎ বাবুকে তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল আব্দুল খান। বলল, “স্যার, ইনি কুঠিয়াল হেনরি ক্রাইটন সাহেবের বাসভবন খুঁজছেন। জানতে চাইছেন ওটা কোথায় ছিল। উনি বলছেন, গৌমালতিতে নাকি তার বাসভবন ছিল। কিন্তু গৌমালতি বলতে গৌড়ের কোনো জায়গাটাকে বোঝায় সেইটে জানা নেই আমার। এ কারণেই আপনার কাছে আসা।”
“হুম। কিন্তু এত স্থাপনা বাদ দিয়ে আলাদা করে হেনরি ক্রাইটনের বাসভবন কেন খুঁজছেন উনি?”
“পেশায় স্কুল শিক্ষক ইনি। বাংলায় নীল চাষের ইতিহাস পড়ান। উনি বলছেন ক্রাইটনের হাত ধরেই এ দেশে নীল চাষের শুরু। এজন্যেই এত আগ্রহ।”
“সে নাহয় বুঝলাম। কিন্তু ওই ভদ্রলোকের বাসভবন খুঁজে বের করে জ্ঞানের কী এমন বৃদ্ধি হবে? এতদিন ধরে চাকরি করছি এখানে এমন আব্দার কখনও শুনিনি। গুপ্তধন-টুপ্তধন খুঁজছেন নাকি, মশাই?” শরৎ বাবুর দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করলেন সাধন বাবু।
হেসে ফেললেন শরৎ বাবুও। বললেন, “ওসব কিছু না। স্রেফ কৌতূহল। এতদূর যখন এলাম-ই, স্থাপনাটা দেখেই যাই। তাছাড়া, আমার এই সফর নিয়ে একটা আর্টিকেল লেখারও ইচ্ছে আছে। খুব যদি অসুবিধে হয়, তাহলে বাদ দেন।”
“আরে না না। অসুবিধে কিছুই না। আগ্রহী গবেষকদের সাধ্যমতো সহযোগিতা করা আমাদের কর্তব্য। বিখ্যাত লোক ছিল হেনরি ক্রাইটন। দ্য রুইনস অভ গৌড় শিরোনামে একটা বই লিখেছিল। আঠারোশো সালের গোড়ার দিকে ছাপা হয়। জলরঙে আঁকা সেই সময়কার গৌড় ধ্বংসাবশেষের আঠারোটা চমৎকার ছবিও ছিল ওটাতে। তবে বইটার সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস হলো দুশো বছর আগের গৌড়ের একটা মানচিত্র। খুবই ডিটেইলড। আমাদের সংগ্রহে আছে ওই বই। একটু অপেক্ষা করুন। দেখাচ্ছি আপনাদের।”
বইয়ের প্রথম দিকেই হাতে আঁকা বেশ বড়ো একটা রঙিন মানচিত্রের ছবি। আড়াআড়ি করে আঁকা ম্যাপটাতে সাগর দিঘির উত্তরে ত্রিভুজাকৃতির একটি জয়গাকে গৌমালতি হিসেবে দেখানো হয়েছে। মানচিত্রের পুবপাশ ঘেঁষে বয়ে গেছে ভাগিরথী নদী। দুই নম্বর নীলকুঠির পাশে যে চওড়া শুকনো খালটা দেখা গিয়েছিল ওটাই দুশো বছর আগে ভাগিরথী নদী ছিল। আর নীল কারখানাটা ছিল সাদুল্লাপুর ঘাটের সাথে লাগোয়া। সাধন বাবু বললেন, “ত্রিভুজের এই হলদে রঙের যে রেখাগুলো দেখছেন ওগুলো ছিল রাস্তা। ত্রিভুজের জমিনে ছোটো-বড়ো পুকুর আর নানান স্থাপনা। স্থাপানর চিহ্নগুলো দেখে যা বোঝা যাচ্ছে তাতে ধরে নেওয়া যেতে পারে হেনরির বাসভবন ছিল ত্রিভুজের শীর্ষ বিন্দুতে। ওই এলাকার বর্তমান নকশার ওপর এই ম্যাপ প্রতিস্থাপন করলে, সহজেই বের করতে পারবেন হেনরির বাসভবনের লোকেশন। আব্দুল খানকে এর একটা কপি দেওয়ার ব্যবস্থা করছি। আশা করি যা খুঁজছেন পেয়ে যাবেন।”
মিউজিয়াম থেকে বেরুতেই গেটের সামনে দীনবন্ধু আর ম্যাডাম জুইয়ের সাথে দেখা হলো শরৎ বাবুর। কী ঘটেছে তাদের সব জানালেন। তারপর আব্দুল খানকে বললেন ম্যাপ স্টাডি করে লোকেশন বের করতে। আগামীকাল টিয়াকাটি থেকে তাকে তুলে নিয়ে স্পটে যাওয়া হবে। আপাতত সার্কিট হাউসে ফিরে রেস্ট নেওয়া যাক।
পরদিন সকালে আব্দুল খান গাড়ি নিয়ে সরাসরি পুরাতন সাদুল্লাপুর ঘাটে চলে এলো। এখানেই দ্বিতীয় নীলকুঠি বা কারখানা। সবাই গাড়ি থেকে নামলে পর হেনরির আঁকা ম্যাপ বের করে গাড়ির হুডের ওপর মেলে ধরে বলল, “এখান দিয়ে উত্তর-দক্ষিণে বয়ে যেত ভাগিরথী। ওই যে দূরে লম্বা মতন পাকা পাটাতন আর লোহা-লক্কড়ের জঞ্জাল। ওখানে জেটি ছিল। ম্যাপে ভাগিরথী নদীর ধার ঘেঁষে উত্তর-দক্ষিণে যে মোটা লাইন চলে গেছে ওটা রাস্তা। পুরো গৌড়ের সীমানা বেষ্টন করে আছে ওই সড়ক। সাগর দিঘির উত্তর পশ্চিম কোণ থেকে শুরু হওয়া ত্রিভুজের ভূমি রেখা শেষ হয়েছে এই সাদুল্লাপুর ঘাটে এসে। এ বাহুর দৈর্ঘ্য দুই কিলোর মতো। এরপর সাগর দিঘির ওপ্রান্ত থেকে আর সাদুল্লাপুরের এ ঘাট থেকে কোনাকুনি ঝাড়া সাড়ে তিন কিলো উঠে গেছে দুই বাহু। কিছুটা সমকোণী ত্রিভুজের মতো। খাড়া বাহুটা এগিয়েছে নদীর কিনারা ধরে। বর্তমানে এর পশ্চিমে রতনটি কালী মন্দির, পুবে বিএসফ ক্যাম্প। তবে ওদুটো ত্রিভুজের শীর্ষবিন্দু থেকে যথেষ্ট দূরে, ত্রিভুজের মাজা বরাবর। এই ম্যাপ দেখে আমার যে ধারণা হয়েছে সাধন বাবুরও সেই একই অভিমত। হেনরি ক্রাইটনের বসভবন ছিল ত্রিভুজের শীর্ষ বিন্দুর কাছে ভাগিরথীর তীর থেকে আধা কিলো মিটার পশ্চিমে। এই নীলকুঠি আর নদীর মাঝের অংশটুকু ছিল দোয়াব এলাকা। নাম গঙ্গাপথ। ভীষণ উর্বর তবে তলিয়ে যেত বর্ষাকালে।”
“আপনি বলছেন নদী আর দুশো বছর আগের বেষ্টনী রাস্তা প্যারালাল এগিয়েছে। ওই পুরনো রাস্তার কোনো অস্তিত্বই এখন আর নেই। তবে নদীর শুকনো খাল এখনও রয়ে গেছে। আমরা যদি এই শুকনো নালা ধরে উত্তরে সাড়ে তিন কিলো যাই, তাহলে নকশায় দেখানো ত্রিভুজের শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছানো যাবে। কী বলেন, খান সাহেব?” জিজ্ঞেস করল দীনবন্ধু।
“সরলভাবে চিন্তা করলে ওমনটাই হওয়ার কথা। সমস্যা হলো শীর্ষ বিন্দুর কাছে ম্যাপে দেখানো পুরনো রাস্তা থেকে পুব দিকে নদীর দুরত্ব প্রায় আধা কিলো। সুতরাং নদী ধরে সাড়ে তিন কিলো উত্তরে এগিয়ে বামে মোড় নিয়ে আধ কিলো পশ্চিমে যেতে হবে। তবেই পাওয়া যাবে শীর্ষ বিন্দু। ওটা খুঁজে পাওয়ার পর সীমানা বরাবর সামান্য দক্ষিণে গেলেই হেনরি ক্রাইটনের রেসিডেন্স পাওয়ার কথা। তবে চিন্তার বিষয় হলো, ওদিকে পুকুর, দিঘি, আর আম বাগানের ছড়াছড়ি। ওই রেসিডেন্স ভবন এখনও টিকে আছে কি না, সে বিষয়ে বিস্তর সন্দেহ আছে। আমার জন্ম এ এলাকায়। ছোটো বেলা থেকেই সাইকেল নিয়ে চষে বেড়িয়েছি সব কোনাকাঞ্চি। তেমন কোনো স্থাপনা থাকলে চোখে পড়ার কথা ছিল।”
“তারপরেও খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে আমাদের। এতদূর এসে ওই রেসিডেন্স না দেখে ফিরে যাবো, সেটি হয় না,” জোর দিয়ে বললেন শরৎ বাবু।
“নিশ্চয়। প্রথমে পুব দিকে দুকিলো যেতে হবে। তারপর উত্তরে সাড়ে তিন কিলো। এরপর গাড়ি নিয়ে যাওয়ার কোনো পথ নেই। বর্তমান কালের নকশা ধরে খেতের আল, দিঘির পাড় দিয়ে হেঁটে যেতে হবে। ঠিক আছে?”
“আজ্ঞে, ঠিক আছে। চলুন রওনা হওয়া যাক।”
ডজন ডজন দিঘি, জলাশয়, পুকুর, আম বাগান পেরিয়ে এক জায়গায় এসে আব্দুল খান থামালো কিসমত পাঠানকে। তারপর বলল, “আমাদের নামতে হবে এখন। এখান থেকে হাঁটা পথ। আপনারা আমার পেছন পেছন আসুন।”
আধ ঘণ্টা পর আব্দুল খান দীনবন্ধুদের যে জায়গায় নিয়ে এলো সেখানে প্রায় দেড় একর এলাকাজুড়ে ছোটো বড়ো লাল ইঁটের ঢিবি। এই ঢিবিগুলোর আশেপাশে সমতল মাটিতে আমের বাগান করা হয়েছে। কুঠিয়ালদের দালান যথেষ্ট মজবুত করে বানানো হয়েছিল। প্রায় সব দালানেরই কিছু না কিছু অবশিষ্ট আছে। কিন্তু হেনরির ভবনের এমন দুরাবস্থা হলো কেমন করে? স্থাপনার লে আউট অব্দি ঠিকমতো বোঝা যাচ্ছে না। ঢিবিগুলোর পশ্চিমে প্রকাণ্ড এক শান করা চাতাল। চাতালের দক্ষিণ পশ্চিম কোনে নিখুঁতভাবে বাঁধানো একটা কুয়ো। কুয়োর গায়ে ফুলপাতা দিয়ে নকশা করা চারকোনা খোপের ভেতর ইংরেজিতে লেখা: ফ্রান্সিস স্লপার্ট, ১৭৯৮।
অবস্থা দেখে মুষঢ়ে পড়ল শরৎ বাবুর টিমের সব সদস্য। এত দৌড়াদৌড়ি করে শেষমেশ এই জিনিস! শুধু একজন খুশি। আব্দুল খান। বিজয় গর্বে বুকের ছাতি চওড়া হয়ে গেছে তার। হেনরি ক্রাইটনের বাসভবন খুঁজে বার করতে পেরেছে সে। এই কুয়োই তার অকাট্য প্রমাণ। ফ্রান্সিস স্লপার্ট হেনরির স্ত্রীর নাম! গাইডরা সাধারণত তোতা পাখির মতো মুখস্ত তথ্য বলে। আব্দুল খান এদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। সে একজন ইতিহাসবিদ, রিসার্চার! আত্মতৃপ্তির আবেশ থেকে বাস্তবে ফিরল শরৎ বাবুর কথা শুনে। “আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ, আব্দুল খান। যা খুঁজছিলাম পেয়েছি। মালদা ফিরবো এখন। যাওয়ার পথে আপনাকে নামিয়ে দিয়ে যাই, কী বলেন?”
কিছুটা মনোক্ষুণ্ন হয়ে আব্দুল খান বলল, “আর কিছু দেখবেন না? গৌড়ের মূল আকর্ষণ একটাও দেখা হয়নি। এত কষ্ট করে এখানে আসলেনই যখন, দুয়েকটা দেখে যেতেন। এখনও বেলা পড়তে ঢের বাকি।”
“আজ আর না। যথেষ্ট হয়েছে। কাল সকালে সার্কিট হাউসে একবার আসেন। যদি আরও দুচার দিন এখানে থাকার সিদ্ধান্ত নেই আমরা, তাহলে আপনাকে জানাতে পারবো। এখন চলুন গাড়ির কাছে ফেরা যাক। কিসমত পাঠান অপেক্ষায় আছে ওখানে।”
ওই দিন বিকেল বেলা চা, নাস্তা খেয়ে মিটিংয়ে বসল শরৎ বাবুর টিম। আলোচনার বিষয়: কী হবে পরবর্তী পদক্ষেপ? শরৎ বাবু বললেন, “ম্যাডাম জুই, আপনার পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করেছি আমরা। হেনরির ভিটে খুঁজে বের করেছি। সেই সঙ্গে দুটো নীলকুঠি। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো এক চুলও আগে বাড়তে পারিনি। যে তিমিরে ছিলাম, রয়ে গেছি সেই অমাবস্যাতেই। যা হবার হয়েছে। এখন নতুন করে ভাবতে হবে। মালদায় যদি আর কিছু খুঁজে দেখার না থাকে, তাহলে এখান থেকে চলে যাওয়াই ভালো। কি বলেন আপনারা?”
“আপনাকে একটা প্রশ্ন করতে পারি?” জিজ্ঞেস করল ম্যাডাম জুই।
“অবশ্যই।”
“এখানে যেসব নীলকর সাহেব ছিল তাদের কারও কবর দেখলাম না। এদের কোনো সমাধি নেই?”
ওকথা তো ভেবে দেখিনি। হয়তো ছিল, বিল্ডিংয়ের সাথে হেজে-মজে গেছে ওগুলোও।”
“এ হলো আন্দাজের কথা। নিশ্চিতভাবে কি জানেন আপনি? অন্য দুটো স্পটেও কোনো কবর চোখে পড়েনি। খেয়াল করেছেন নিশ্চয়?”
“না, লক্ষ করিনি। যাহোক, কাল আব্দুল খান আসলে তাকে জিজ্ঞেস করে জেনে নেওয়া যাবে।”
পরদিন সকালে সার্কিট হাউসে আব্দুল খানকে নিয়ে বসেছে দীনবন্ধুরা। ম্যাডাম জুই তাকে জিজ্ঞেস করল, “গাইড সাহেব, হেনরি ক্রাইটন কিম্বা তার পরিবারের কারও সমাধি কি আছে গৌমালতিতে?”
“না, নেই। কুঠিয়াল সাহেবদের কারও কবরই নীলকুঠির দৌহদ্দিতে হয়নি। সাহেবদের সমাধিক্ষেত্র বহরমপুর বাবুলবোনা সেমিটারি।”
“ও আচ্ছা। কিন্তু সেটা তো এখান থেকে অনেক দূর।”
“একশো ষাট কিলোর কম না।”
“আপনি বলতে চাচ্ছেন ওই যুগে সাহেবদের লাশ এই মালদা থেকে অতদূর বয়ে নিয়ে যাওয়া হতো! ঘোড়াগাড়ি করে গেলে তিন দিনের রাস্তা।”
“এর পেছনে দুটো কারণ ছিল। প্রথম কারণ, সাহেবদের মৃত্যু নিশ্চিত করত বহরমপুর মিলিটারি ক্যাম্পের এমও। দ্বিতীয় কারণ, সঠিক ধর্মীয় রীতি মেনে খ্রিষ্টান সেমিটারিতে দাফন করতে হলে বাবুলবোনা ছাড়া গত্যন্তর ছিল না।”
“তাহলে আপনি বলতে চাচ্ছেন হেনরির সমাধি বহরমপুরের বাবুলবোনা সেমিটারিতে হয়েছে?”
“আজ্ঞে, হ্যাঁ।”
“আপনি কি নিশ্চিত?”
“ওই দিন মিউজিয়াম থেকে আপনারা চলে আসার পর সাধন বাবু আমাকে দ্য রুইনস অভ গৌড় বইটি পড়তে দেন। সেই সঙ্গে হেনরির জীবনীও। হেনরি ক্রাইটন মারা যান ১৮০৭ সালে চুয়াল্লিশ বছর বয়সে। পেছনে রেখে যান স্ত্রী আর সাতটি সন্তান। বাবুলবোনাতে ক্রাইটনের দাফন হওয়ার কিছুদিন পর ক্রাইটনের পিসিও মারা যান। ওই একই জায়গায় সমাধিস্থ হন এই মহিলাও এরপরই ফ্রান্সিস স্লপার্ট অর্থাৎ ক্রাইটনের স্ত্রী তার ছেলেমেয়েদের নিয়ে ডারহ্যামে ফিরে যান।”
“ও আচ্ছা। বুঝতে পেরেছি।”
এইবার ম্যাডাম জুইয়ের দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে শরৎ বাবুর দিকে তাকাল আব্দুল খান। বলল, “কী সিদ্ধান্ত নিলেন আপনারা? আরও দু-এক দিন থাকবেন, না ফিরে যাবেন?”
“আমরা ফিরে যাবো,” শরৎ বাবু কিছু বলার আগেই জবাব দিলো ম্যাডাম জুই। “তবে আমার একটা প্রস্তাব আছে।”
“কী প্রস্তাব?”
“বহরমপুরে বাবুলবোনা সেমিটারি অব্দি আমাদের সাথে যাবেন আপনি। হেনরি ক্রাইটনের কবরটা আমাদের দেখিয়ে দেবেন। কি, পারবেন না? পারিশ্রমিক নিয়ে ভাববেন না। ওটা আমাদের ওপর ছেড়ে দিন।”
“পারিশ্রমিক কোনো বিষয় না। আপনারা নরমালের চেয়েও ঢের বেশি সম্মানি দেন। সমস্যা হলো, বহরমপুরে একবারই মাত্র গেছি, তাও ছাত্র জীবনে। ওখানে গিয়ে বাবুলবোনা খুঁজে বের করতে হবে আগে। তারপর হেনরি ক্রাইটনের কবর। সময় লাগবে।”
“সময় লাগলে নিন। কিন্তু কবরটা দেখিয়ে দিন।”
“এককাজ করি বরং। ট্রেন পাওয়া গেলে ভালো। না গেলে, বাসে করে আজই রওনা হয়ে যাই আমি। আড়াই-তিন ঘণ্টা লাগবে। আপনারা ধীরে সুস্থে গাড়ি নিয়ে বহরমপুর আসুন। ওখানেও সার্কিট হাউস আছে। কাল দুপুরে বহরমপুর সার্কিট হাউসে আপনাদের সাথে দেখা করবো আমি। আশা করছি এরই ভেতর বাবুলবোনা গিয়ে হেনরির কবর খুঁজে বের করতে পারবো। আপনারা এলে সাথে করে নিয়ে যাবো কবরটার কাছে। ঠিক আছে?”
“একদম ঠিক আছে,” বলল ম্যাডাম জুই। “আপনি তাহলে এখনই রওনা হয়ে যান।” এরপর শরৎ বাবুর দিকে তাকিয়ে বলল, “শরৎ বাবু। গাইড সাহেবকে কিছু টাকা দিয়ে দিন। এই ধরুন হাজার দুয়েক। অতদূর যাওয়া, থাকা-খাওয়া, ঘোরাঘুরি—খরচা আছে।”
“হেনরির বাসভবনে গিয়ে তো দেখলাম আমরা। কিছুই পাওয়া গেল না। এখন আবার একশো ষাট কিলো দূরে বহরমপুরের সমাধিক্ষেত্রে। ওখানে গিয়ে কী পাবেন বলে আশা করছেন?” আব্দুল খান বিদেয় হলে ম্যাডাম জুইকে জিজ্ঞেস করলেন শরৎ বাবু।
“পথেই পড়বে ওটা। একবার দেখে গেলে ক্ষতি কী?”
“শুধু চোখের দেখা, না এর ভেতর অন্য কোনো হেতু আছে? যদি থাকে তো বলেন আমাদের। একই টিমে কাজ করছি আমরা। কে কী ভাবছে জানা দরকার। ওতে একসাথে মিলে পরামর্শ করে কাজ করা যায়।”
“জানতে যখন চাইছেন তো বলি: হেনরি মারা যাওয়ার পর ওর কুঠিতে সিঁদেল চোর ঢুকিয়ে পাণ্ডুলিপি চুরি করতে চেয়েছিল টং। আপনাকে একবার বলেছি। মনে পড়ে একথা?”
“ও হ্যাঁ, মনে পড়েছে। কিছুই খুঁজে পায়নি চোরেরা।”
“ঠিক তাই। কিন্তু এমন কি হতে পারে, হেনরির সাথেই কবর দেওয়া হয়েছিল পাণ্ডুলিপিগুলো? হয়তো বউকে এমনই নির্দেশ দিয়ে রেখেছিল কুঠিয়াল সাহেব। লাশের সাথে মৃত ব্যক্তির ছোটোখাটো প্রিয় জিনিস দাফন করা বহু কালের পুরনো রীতি।”
“এ ক্ষেত্রেও ওমনটা হয়েছে বলে মনে হয় আপনার?”
“এটা একটা সম্ভাবনা। খতিয়ে দেখতে ক্ষতি কী? এমন তো না যে বিপদ সংকুল পরিবেশে হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে যেতে হচ্ছে। আপনার যদি বেটার কোনো আইডিয়া থাকে তো বলেন। আছে আইডিয়া?”
“না নেই।”
“তাহলে ওখানে যাচ্ছি আমরা। ঠিক আছে?”
“আজ্ঞে।”
পরদিন দুপুরে বহরমপুরের গোরা বাজার সার্কিট হাউসে কেবল মাত্র লাঞ্চ শেষ করেছে শরৎ বাবুর টিম, এমন সময় তাদের সাথে দেখা করতে এলো আব্দুল খান। ঘেমেনেয়ে একাকার। সে যে প্রচুর ঘোরাঘুরি করেছে, সেটা তার বডি ল্যাংগুয়েজই বলে দিচ্ছে। খানকে নিয়ে লাউঞ্জে বসে চায়ের অর্ডার দিলেন শরৎ বাবু। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, “কোনো আপাডেট আছে, আব্দুল খান সাহেব?”
“আজ্ঞে, আছে। আবার নেই-ও।”
“তার মানে?”
“বাবুলবোনা রেসিডেন্সি সেমেটারি খুঁজে পেতে তেমন কোনো অসুবিধে হয়নি। গোরস্থানটা বহরমপুর বাস স্ট্যান্ডের পুব দিকে ন্যাশনাল হাইওয়ের পাশে স্টেট সেরিকালচার অফিসের উত্তরে। বহু পুরনো, তবে কবরগুলো এখনও প্রায় ঠিকঠাকই আছে।”
“তাহলে সমস্যা কোথায়?”
“সমস্যা হলো ওগুলোর প্রায় নব্বই শতাংশের কোনো নাম ফলক নেই। ধাতুর তৈরি ভারী নাম ফলকগুলো চোরের দল সাফ করে দিয়েছে বহু আগে। কোনটা যে কার কবর সেইটে নির্ধারণ করা খুব কঠিন। পৌর আপিসের রেকর্ডরুমে খোঁজ নিয়েছি, তাদের কাছে লে আউট আর প্লটসহ রেকর্ড আছে বটে, তবে সেগুলো ১৮৭৬ সালের পরের।”
“১৮৭৬ সালের পরে! আগে নয় কেন?”
“কারণ ওই সনেই স্থাপিত হয় বহরমপুর মিউনিসিপ্যালিটি। হেনরিকে দাফন করা হয় এর-ও সত্তর বছর আগে!”
“তাহলে, এখন উপায়?”
“অন্য কোনো সোর্স পাওয়া যায় কি না দেখতে হবে।”
“সেটাই বা কীভাবে দেখা হবে?”
“আমি একটা সোর্সের কথা বলতে পারি,” ফস করে মন্তব্য করল ম্যাডাম জুই।
“কোন সোর্স ম্যাডাম?” হড়বড় করে জিজ্ঞেস করল আব্দুল খান। উত্তেজনায় চকচক করছে তার চোখ
“এই এলাকায় চার্চ আছে কয়টা?”
“মোট চারটে। আজ সকালেই খোঁজ নিয়েছি।”
“এর ভেতর সবচেয়ে পুরনো চার্চ কোনোটা বলতে পারবেন?”
“আর্মেনিয়ান চার্চ। এ শহরেরই আর্মানিগঞ্জ বা সায়েদাবাদ এলাকায় পড়েছে ওটা। পলাশীর যুদ্ধ যে সালে হয়, অর্থাৎ ১৭৫৭- এ তৈরি।”
“বাবুলবোনা রেসিডেন্সি সেমেটারি থেকে কতদূরে ওটা?”
“তা প্রায় কিলো চারেক।”
“ওখানে গিয়ে ঢুঁ মারেন একবার। ওদের পারিশ রেজিস্টার খুলে দেখেন। অনেক চার্চে একে প্যারোকিয়াল রেজিস্টারও বলে।”
“প্রায় দুশো বছর আগের রেকর্ড, খুঁজে পাওয়া মুশকিল হবে।”
“মিউনিসিপ্যালিটির রেকর্ড যখন পেয়েছেন, এটাও পাবেন। এখনই যান। ওটা কোনো লাইব্রেরি না যে জনগণের পড়ার জন্যে সবকিছু সাজিয়ে বসে আছে। তাছাড়া, গেলেন আর অমনি পারিশ রেজিস্টার বের করে তারা আপনার সামনে মেলে ধরল ব্যাপারটা ওরকম নাও হতে পারে। ওখানে গেলে বোঝা যাবে কত ধানে কত চাল। আর হ্যাঁ, আমার মনে হয় দীনবন্ধুকে সাথে নিলে ভালো করবেন। একা একা সবদিক সামাল দিতে পারবেন না। আমরা চারজনই যেতে পারতাম, তবে তাতে গ্যাঞ্জাম হবে বেশি। আরেকটা কথা, বাবুলবোনা সেমিটারিটা কোথায় কিসমত পাঠানকে ভালোমত বুঝিয়ে দিয়ে যান। আপনারা বের হয়ে যাওয়ার পর আমি আর শরৎ বাবু ওখানে একবার যেতে চাই।”
দেড় মানুষ সমান উঁচু সাদা রঙের দেওয়ালের গায়ে কাঠের তৈরি গাঢ় লাল দুপাল্লার ভারী দরজা। উলটোদিকে বিশাল আকৃতির ভাগিরথীর পুরনো খাদ। ভেতরে আঙিনা জুড়ে এদিক-ওদিক চলে গেছে ইঁট বিছানো সরু হেরিং বোন রাস্তা। রাস্তার দুপাশে ফুল বাগান। উঁচু বাউন্ডারি ওয়াল ঘেঁষে বহু পুরনো লম্বা লম্বা শিরিষ গাছ। ইটে তৈরি খিলানঅলা চওড়া বারান্দা ঘেরা চমৎকার একটা ভবন। পুরো ছাদজুড়ে সাদা রঙের বালুস্ট্রেডের রেলিং। বিল্ডিংয়ে ঢোকার মুখে ইয়া উঁচু আর্চওয়ের ওপর খিলানঅলা টাওয়ারের মাথায় ছোট্ট গম্বুজের নিচে বিশাল ঘণ্টা। গম্বুজের চুড়োয় সাদা ক্রস। আর্চওয়ে দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই এগিয়ে এলো এক লোক।
যাকে পাওয়া গেল, সে চার্চ দেখাশুনা করে। গায়ে খাঁকি রঙের ইউনিফর্ম, পায়ে ক্যাম্বিসের জুতো। বেঁটেখাটো গোলগাল চেহারা, কদম ছাঁট চুল, বাটারফ্লাই গোঁফ। ওই লোক জানাল কী এক কাজে কোলকাতা গেছে কাহানা[১২[, আগামিকাল ফিরবে। গলায় মধু ঢেলে আব্দুল খান বলল, “ভাই, এ গির্জা দেখার জন্যে সেই মালদা থেকে আসছি। আমাদের যদি একটু ঘুরিয়ে দেখান, তো বড়ো উপকার হয়।”
[১২. আর্মেনিয়ান চার্চের ফাদার]
“কাহানা না থাকলে চার্চ ঘুরিয়ে দেখানোর নিয়ম নাই,” কাটাকাটা কথায় জবাব দিলো বাটারফ্লাই গোঁফ।
পকেট একশো টাকার দুটো নোট বের করে তার সামনে মেলে ধরল আব্দুল খান। “ভাই, আপাতত এই আছে। যদি থাকত, তবে এর থেকে দশগুণ বেশি দিতাম।’
সরু হয়ে এলো কদম ছাঁটের চোখ। কিছু একটা সন্দেহ করেছে লোকটা। ছোটোখাটো এই ভবন ঘুরিয়ে দেখাতে দুশো টাকা! খুব ধনী লোক কিম্বা বিদেশী হলেও একটা কথা ছিল। এ দুজনকে দেখে মনে হচ্ছে নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণির ছাপোষা লোক। সে বলল, “আগামীকাল সকালে নিশ্চিতভাবে ফাদারকে পাবেন আপনরা। সে পর্যন্ত না হয় একটু অপেক্ষায় করলেন। বোঝেনই তো পরের অধীনে কাজ করি। হুকুমের চাকর।”
“ভাই, অপেক্ষা করতে পারলে তো করতামই। এত সাধাসাধি কী করতাম? আমরা অফিসের একটা কাজে বহরমপুর এসেছিলাম। কাল সকালেই মালদা ফিরে যাবে। এ কারণেই এত চাপাচাপি। কোনো সন্দেহ নেই আপনি খুব সৎ আর ভালো মানুষ। টাকাটা তো ছুঁয়েও দেখলেন না। আমি বলি কী, আরেকবার ভেবে দেখেন। বেশি সময় নেবো না। এক দিকে দিয়ে ঢুকবো আরেক দিক দিয়ে বেরিয়ে যাবো।”
হাঁ করে তার দিকে তাকিয়ে আছে দীনবন্ধু। ট্যুরিস্ট গাইডরা বানিয়ে বানিয়ে এত মিথ্যে কথাও বলতে পারে! করুণ চোখে কদম ছাঁটের দিকে চেয়ে আছে আব্দুল খান। মুখের পেশি নরম হলো কদম ছাঁটের। একটু ভেবে বলল, “ঠিক আছে। এত করে যখন বলছেন, চলুন তাহলে। আপনারা দুজন আমার পেছন পেছন আসুন।”
আর্চওয়ে দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই বেশ খানিকটা ফাঁকা জায়গা। কদম ছাঁট বলল, “এই খালি জায়গাটাকে বলে অমগ্যাং।” এরপর সারিসারি গদিমোড়া কাঠের কালো রঙের বেঞ্চ। ভারী সুন্দর দেখতে। “এ হলো আপনার মিডট্রম,” বলে চলেছে বাটারফ্লাই। এরপর উঁচু প্ল্যাটফর্মের ওপর চমৎকার কারুকাজ করা কাঠের পালপিট। “পাদরি সাহেব এখানে দাঁড়িয়ে ভক্তদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য দেন, প্রার্থনা করেন। এর পেছনের জায়গাটাকে বলে চ্যান্সেল বা কর। সবশেষে বেদি বা অ্যাপসিস। আপনারা হয়তো লক্ষ্য করেছেন এই হলের পুরো দেওয়াল লাল কাঠের প্যানেলিং দিয়ে মোড়া। পালপিট আর বেঞ্চও ওই একই কাঠের। একে বলে রক্ত শাল। টকটকে লাল এ কাঠের রং। দুশো বছর আগেই ফুরিয়ে গেছে রক্ত শালের গাছ। লোকে বলে দুহাজার বছরেও নষ্ট হয় না এ কাঠ।”
“কিছু যদি মনে না করেন তাহলে একটা প্রশ্ন করতে পারি?” ফট করে জিজ্ঞেস করল আব্দুল খান।
“কী প্রশ্ন বলেন?” কদম ছাঁটের মুখে স্পষ্ট বিরক্তির ছাপ।
“এ গির্জা দেখে প্রায় নতুন বলে মনে হচ্ছে। এটা কি আগের সেই পুরনো বিল্ডিং?”
“না, এটা আগের পুরনো বিল্ডিং না। ওটা ভেঙে নতুন করে বানানো হয়েছে। তবে হুবহু একই রকম। কাঠের প্যানেলিং, আসবাবপত্র আগের গুলোই আছে।”
“ও আচ্ছা।”
এরপর পালপিটের ডান দিকের দেওয়ালের দরজা দিয়ে হলঘরে বেরিয়ে এলো বাটারফ্লাই। ঝাঁঝরিকাটা দেওয়াল ঘেরা ছোটো একটা করিডোর পেরিয়ে ডানে টানা বারান্দা। বারান্দার ওপারে কামরার সারি। প্রথমেই বাটারফ্লাই যে কামরায় ঢুকল সেটা আকারে মাঝারি। মেঝের ওপর পড়ার টেবিল, চেয়ার, দেওয়ালে শেলফভরতি চমাড়া বাঁধানো বই, ছাদ থেকে ঝুলছে আদ্যিকালের প্রকাণ্ড ঝাড়বাতি। “এ হলো গিয়ে আপনার চার্চের লাইব্রেরি। সতেরোশো সালের বইও আছে এখানে,” ধারাভাষ্য দিয়েই চলেছে বাটারফ্লাই।
লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে ছোটো একটা ঘরে ঢুকল সবাই। কালো টেবিলের সামনে দুটো চেয়ার। উলটোদিকে পিঠ উঁচু হাতলঅলা বড়ো আরেকটা চেয়ার। বাটারফ্লাই বলল, “এখানে কাহানা পারিশের বাসিন্দাদের ব্যক্তিগত সমস্যার কথা শোনেন।”
এই কামরার পর আরও একটা ঘর। আকারে ছোটো। ঘরটায় সূক্ষ্ম কারুকাজকরা কাঠের একটা জানালা। জানালার পাশে গদিআঁটা চেয়ার। জানালায় কোনো পাল্লা নেই। কাঠের জালি বা নেট দেওয়া পুরো জানালা জুড়ে। বাটারফ্লাই বলল, “এই হচ্ছে কনফেশন রুম। জানালার এধারে ওই গদিআঁটা চেয়ারে পাদরি সাহেব বসেন। জানালার ওপাশে কনফেসর। জালি বা নেট থাকার কারণে কেউ কারো চেহারা দেখতে পায় না।”
ওখানে থেকে বেরিয়ে হলরুমে ফিরে পালপিটের বাঁ পাশের আরেকটা দরজা দিয়ে ঢুকে পরপর আরও দুটো কামরা দেখাল বাটারফ্লাই। বারান্দাঅলা একেকটা কামরায় দুটো করে সিঙ্গেল খাট, বিছানা, বালিশ, ইজি চেয়ার, বড়ো বড়ো জানালা, প্রচুর আলো-বাতাস। বলল, “এখানে ক্যাথোলিকোই অর্থাৎ পাদরি সাহেবেরা রেস্ট নেন।”
আবারও হলরুমে ফিরে এলো সে। বলল, “এই মোটামুটি যা আছে দেখবার মতন।”
“ও আচ্ছা। কিন্তু আমার মনে হয় একটা জিনিস এখনও দেখা বাকি রয়ে গেছে।”
“কী জিনিস?”
“পাদরি সাহেবদের অফিস। চার্চে অনেক লেনদেন হয়—এই ধরেন চাঁদা কালেকশন, মাইনে দেওয়া, নির্মাণ কাজ, নানান ধরনের অনুষ্ঠান আয়োজন করা। পারিশের সবার নাম-ঠিকানা, হিসেব নিকেশ এগুলো লেখার জন্যে চাই খাতা-পাত্র, ফাইল— এইসব। বলছি কী ওই অফিসটা এখনও দেখা হয়নি। ওটা দেখলেই ট্যুর শেষ। কী বলেন?”
গম্ভীর হয়ে গেল বাটারফ্লাইয়ের মুখ। বলল, “অফিসে বাইরের কারও যাওয়া সম্পূর্ণ নিষেধ। তবুও এত করে যখন বলছেন, চলুন তাহলে। দেখে যান ওটাও।”
হাঁটতে হাঁটতে অ্যাপসেসের পেছনে চলে এলো বাটারফ্লাই। দেওয়ালের প্যানেলে মিশে থাকা একটা দরজা খুলল। আগে থেকে না জানা থাকলে এখানে যে দরজা আছে বোঝা প্রায় অসম্ভব। নিখুঁত অর্ধবৃত্তাকার একটা কামরা। গম্বুজের মতো ছাদ, দেওয়াল—সব কালো কাঠের প্যানেলিংয়ে ঢাকা। দেওয়াল জুড়ে সারসার ওয়াল আলমিরা। প্রতিটা আলমিরার কবাটে দশ বছরের গ্যাপ দিয়ে সাল লেখা। কামরার মাঝখানে চারটে রোস্ট্রামের মতো বড়ো আকারের টেবিল। টেবিলের সাথে বার কাউন্টারের চেয়ারের আদলের উঁচু চেয়ার। বাটারফ্লাই বলল, “এইসব টেবিলে বসেই অফিসের খাতাপত্র লেখেন ফাদাররা। আর ওই আলমারিগুলোতে খাতাপত্র রাখা হয়।”
দীনবন্ধু লক্ষ করল: বাঁদিকের প্রথম আলমিরার কবাটে লেখা ১৭৫৫-১৭৬৫। হঠাৎই তার পাশ থেকে ফিসফিস করে আব্দুল খান বলল, “খেয়াল করেছেন ওখানে কী লেখা?
“হুম। এখন এসব নিয়ে কথা বলার দরকার নেই। যা দেখার তা তো দেখেছেন।”
“কিছু জানতে চাইছেন, বাবুরা?” জিজ্ঞেস করল বাটারফ্লাই। থমথম করছে মুখ। অপরাধবোধে ভুগছে। কেন যে এ হুজ্জত করতে গেল? মানুষকে খুশি করা এক বিরাট ভ্যাজাল।
“ও কিছু না।”
“তাহলে চলুন বাইরে যাই এখন। কী বলেন?”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ নিশ্চয়,” উত্তর দিলো আব্দুল খান।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন