নজ্জুমি কিতাব – ১৫

আল হযরতকে সরাসরি নিয়ে যাওয়া হলো জিন্দানখানার এক আন্ডারগ্রাউন্ড সেলারে। পাথুরে দেওয়ালের গায়ে লটকে থাকা আঙটার শেকল পেঁচিয়ে বাঁধা হলো তার কোমরে। এরপর শুরু হলো বেদম মার। গায়ের ছাল-চামড়া আর রইল না কিছু। মাথায় হামুলু অর্থাৎ অঙ্কুশের বাড়ি খেয়ে বার কয়েক জ্ঞান হারাল আল হযরত। শক্ত কাঠের রুলারের আঘাতে চুরচুর হয়ে গেল শরীরের সবকটা হাড়। শতছিন্ন হলো গায়ের জোব্বা। হাঁটু আর পিঠের ব্যথায় সোজা হয়ে দাঁড়াতেই পারে না।

আল হযরত এক বুদ্ধিজীবী যুবক, দাগী আসামী না। এ ধরনের রামডলা তার সহ্য হবে কীভাবে? আধমরা হয়ে কোমরে বাঁধা লোহার শেকলে আটার বস্তার মতো ঝুলতে লাগল। মৃত্যু এখন কেবল সময়ের ব্যাপার। চিন্তায় পড়ে গেল নগর কোতোয়াল ফাদুল ঘালি। তাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, উচিত শিক্ষা দাও এই ডেঁপো ছোঁড়াটাকে। এখন অবস্থা যা দাঁড়িয়েছে, ঢেঁসে যাবে যেকোনো সময়। এ যে লঘু পাপে গুরুদণ্ড! ভারী ঝামেলা হলো দেখছি!

দারফুরকে ডেকে এনে আল হযরতের বিষয়ে ফয়সালা চাইল ঘালি। বলল, “যেকোনো সময় ওপারে পাড়ি দেবে এই নাদান। মশা মেরে হাত গন্ধ করতে চাই না। এখন কী করতে হবে সেইটে বলেন?”

“কী করলে ভালো হয় বলে মনে করো?” উলটে তাকেই প্রশ্ন করল হেরেমের সর্দার।

“আমি বলি কী, দূরে কোথাও ফেলে আসা যাক একে। এমন এক জায়গায় যেখান থেকে ফিরে আসা অসম্ভব। আর যদি ফিরে আসেও, তবে তার শাস্তি হবে মারাত্মক। নির্বাসনে পাঠানো আসামীর দেশে ফেরা বিরাট অপরাধ। এর সাজা তাৎক্ষণিক মৃত্যুদণ্ড। এখান থেকে একেবারে পুবে শেষ বসতি নুহাইইল। তিনদিনের পথ। ভয়ানক দুর্গম জায়গা। নুহাইইলের একশো ক্রোশের মধ্যে কোনো জনপ্রাণী নেই, নেই কোনো পানির উৎস কিম্বা গাছপালা। ওখান থেকে আরও কিছুটা পুবে রাব আল খালির সীমানা। রাব আল খালিতে যে কী আছে কেউ জানে না। কারণ ওই জায়গায় গিয়ে আজ অব্দি ফিরে আসেনি কেউ। ওখানে ফেলে আসাই ভালো, কী বলেন?”

“দেখো, যা ভালো বোঝো করো। তবে যাই করো, রাতের আঁধারে গোপনে করবে। বিনা বিচারে মাদ্রাসার তালেবে এলেম গুম করা হচ্ছে, এইটে সাধারণ জনতা ভালো চোখে দেখবে না।”

.

খচ্চরের পিঠে আড়াআড়িভাবে উপুড় করে শুইয়ে জিনের সাথে শক্ত করে বাঁধা হলো আল হযরতকে। পাঁচজন ঘোড়সওয়ারের ছোটো একটা দল রওনা হলো তাকে নিয়ে। চলল তিনদিন তিনরাত। সারারাত পথ চলে, সারাদিন কোনো সরাইখানা কিম্বা মরুদ্যানে খেজুর গাছের ছায়ায় ঘুমায়। শুরুতে মরা লাশের মতো ঘোড়ার পিঠে পড়ে থাকলেও পরের দিকে বেশ কিছুটা জোর এলো আল হযরতের গায়ে। তার সঙ্গে যাওয়া সৈনিকেরাও যথেষ্ট দয়া- দাক্ষিণ্য দেখাল। আসলে তো বেচারার কোনো দোষ নেই। গরীব বলেই না এই দণ্ড! পয়সাঅলা বংশীয় ঘরের ছেলে হলে, রুইয়ানির জামাই হয়ে ঘামদান প্রাসাদে মখমলে মোড়া ইয়া মোটা তাকিয়ায় হেলান দিয়ে বরফকুচি মেশানো পেস্তার শরবত খেত এখন!

শেষমেশ আল হযরতকে ফেলে আসা হলো রাব আল খালির দুর্গম মরুভূমিতে। এ এক ভয়ানক জায়গা। চারদিকে কেবল লালচে বালি আর বালি। এমন ঊষর, একটা কাঁটাঝাড় অব্দি গজায় না। ধারণা করা হয় হাজার হাজার বছর আগে এখানে শয়তান দেবতা হাস্তুর-এর উপাসনা করা হতো। সংঘটিত হতো যত ধরনের পাপাচার আর নির্যাতন। খোদার গজব পড়ে চিরকালের জন্যে অভিশপ্ত হয়েছে এ জায়গা। এখনও হু হু বাতাসে ভেসে বেড়ায় প্রেতাত্মার ফিসফিসানি, মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে দেহত্যাগ করা অসংখ্য বিদেহী মানুষের হাহাকার। পুরোপুরি বন্ধ্যা এই মরু পরিণত হয়েছে শয়তানের চিরস্থায়ী আবাসস্থলে।

১৬

চাঁদের আলোয় সারারাত ঘোড়া ছুটিয়ে ভোর বেলা আল হযরতকে ফেলে রেখে চলে গেল সিপাহীরা। ফেলে যাওয়ার সময় কমবয়সি এক সিপাহী দুটো রুটি আর আধ মশক পানি রেখে গিয়েছিল, খুব সম্ভব আল হযরতের গানের ভক্ত। রুটি আর পানি সঙ্গে নিয়ে অতি কষ্টে চার হাত-পায়ে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াল আল হযরত। তারপর কুঁজো হয়ে কষ্টে-সৃষ্টে হাঁটা শুরু করল। অবশ্য একে যদি আদৌ হাঁটা বলা চলে! সে যেভাবে চলতে শুরু করল, তাকে বলে ছ্যাঁচড়ানো। চারদিকে আদিগন্ত মরুভূমি। সম্পূর্ণ অচেনা জায়গা। মাথার ওপর ঝকঝকে নীল আকাশ। এক টুকরো মেঘও নেই কোথাও। আস্তে আস্তে বাড়ছে তাপমাত্রা। ক্রমেই তেতে উঠছে পায়ের নিচের কিচকিচে বালি। যেভাবেই হোক খুঁজে বের করতে হবে মাথার ওপর ছাউনি আছে এমন একটা জায়গা। খোলা মরুতে যদি শুয়েও থাকে, তাহলেও প্রচণ্ড গরমে বেরিয়ে যাবে শরীরের সব পানি। চলে যাবে এক ঘোরের ভেতর। দেহজুড়ে খিঁচুনি শুরু হবে। সেই সাথে দেখা দেবে অসহ্য যন্ত্রণা। তারপর জ্ঞান হারাবে।

সেই জ্ঞান আর ফিরবে না কোনোদিন

ছায়ার তলে বসে কোনোমতে দিনটা পার করতে পারলে চাঁদের আলোয় রাতে পথ চলা যাবে, মনে মনে ভাবল আল হযরত। যেটুকু রুটি আর পানি আছে তাতে পুরো একটা দিন পার করা যাবে। সমস্যা হলো যাত্রা করবে কোনদিকে? বিন্দুমাত্র ধারণা নেই যে কোনদিকে গেলে মাথার ওপর একটু ছায়া পাওয়া যাবে। এমন অসহায় অবস্থায় জীবনে কোনোদিন পড়েনি সে। ভেবে দেখল, নিজ চেষ্টায় বাঁচবে, এমন আশা করা স্রেফ পাগলামি। একমাত্র কপালের জোরই তাকে উদ্ধার করতে পারে এই শনির দশা থেকে। আর তা-ই যদি সত্যি হয় তাহলে এত চিন্তা-ভাবনা, ফন্দি-ফিকির করে কী লাভ? যেদিকে দুচোখ যায় সেদিকে গেলেই তো হলো।

খুব ধীরে ধীরে নাক বরাবর হাঁটতে শুরু করল আল হযরত। মরুভূমি যদি কাঁসার থালার মতো সমতল হতো, তাহলেও কথা ছিল। কিছুক্ষণ পরপর টিলার মতো উঁচু বালিয়াড়ি। ওইসব বালিয়াড়ির চড়াই-উৎরাই পেরুতে গেলে দম বেরিয়ে যাবে। এ সমস্যার সরল সমাধান হলো বালিয়াড়ি যেখানে সমতল ভূমিতে মিশেছে সেই জায়গা খুঁজে বের করা। তারপর সামনে এগিয়ে যাওয়া। একাজ করতে হলে বালিয়াড়ি ঘেঁষে ডানে কিম্বা বাঁয়ে চলতে হয়। বালিয়াড়ি শেষ হলে পর পাওয়া যায় সরু বা ন্যারো পাস। সেই পাস ধরে আবারও সামনে চলা। আবারও বালিয়াড়ি, ফের ডান-বাম। তারপর সমতল জমিন ধরে আগে বাড়া।

দুপুর অব্দি এভাবেই চলল আল হযরত। সহ্যের বাইরে চলে গেছে মরুভূমির উত্তাপ। ভোঁ ভোঁ করছে দুকানের ভেতর। আগুনের শিখার মতো বালুর ওপর হিলহিল করে নাচছে সূর্যের আলো। চোখ মেলে তাকানোই দায়। এরই ভেতর অর্ধেক হয়ে এসেছে মশকের পানি। কোথাও বসে যে একটু জিরোবে, সে উপায় নেই। আগুন-গরম বালুর ওপর বসা অসম্ভব। ফোসকা যদি না-ও পড়ে, গাঢ় লাল রঙের র‍্যাশে ভরে যাবে নিতম্ব আর ঊরু। শুরু হবে অসহনীয় জ্বালা-পোড়া। আরও দুঘণ্টা চলার পর এক ঘোরলাগা অবস্থা হলো আল হযরতের। টলতে টলতে সামনে এগুতে লাগল সে। মাথা ঘুরে পড়ে যাবে যেকোনো সময়। মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো সামনে পড়ল ঘন, কটা রঙের এক পেল্লায় বালিয়াড়ি। চীনের দেওয়ালের মতো পথ আগলে দাঁড়িয়ে আছে। ওটা না ডিঙোলে আগে বাড়া যাবে না এক পা-ও।

কোনো চিন্তা-ভাবনা না করেই বাঁয়ে মোড় নিলো আল হযরত। প্রায় আধ ঘণ্টা চলার পর আবিষ্কার করল, আগের মতোই মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বালিয়াড়ি। কোথায় তার শুরু আর কোথায়ই বা শেষ, সেইটে বোঝার কোনো উপায় নেই। এখন অব্দি পাশ কাটিয়ে এসেছে বহু বালির টিলা। আর একাজ করতে গিয়ে হাঁটাই হয়েছে শুধু, আগে বাড়া যায়নি খুব একটা।

জেদ চেপে গেল আল হযরতের। বালিয়াড়ি ডিঙিয়ে ওপারে যাবে, যা থাকে কপালে। এভাবে টিলা-টক্কর পাশ কাটিয়ে যাওয়া গাধার খাটুনি ছাড়া অন্য কিছু না। কিন্তু ইচ্ছে করলেই তো আর সবকিছু করা যায় না। কথায় বলে: ইজিয়ার সেইড দ্যান ডান!

যা হোক, বালিয়াড়ির চড়াই বেয়ে উঠতে শুরু করল সে। চার কদম ওপরে ওঠে তো দুকদম নিচে নামে, যেন তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে দুষ্টু বানর উঠছে। ভুসভুসে বালিতে হড়কে যাচ্ছে পা। কতক্ষণ হয় চড়াই ঠেলে ওপরে ওঠার চেষ্টা করছে, সেকথা আর মনে রইল না তার। অবশেষে যখন বালিয়াড়ির চ্যাপ্টা মাথায় উঠে এলো, ততক্ষণে শরীরের সর্বশেষ শক্তিবিন্দুটুকু খরচ করে ফেলেছে। আর এক ইঞ্চিও এগোনোর ক্ষমতা নেই। এমনকি তাকত নেই দুপায়ের ওপর দাঁড়িয়ে থাকারও। আপনা থেকেই হাঁটু ভেঙে ধপ করে কালচে বালুস্তরের ওপর বসে পড়ল আল হযরত।

আর ঠিক তখনই ঘটলো এক অদ্ভুত ঘটনা। হুড়মুড় করে আছড়ে পড়ল প্রায় তিরিশ হাত নিচে। ভাগ্য ভালো নিচে নরম বালি ছিল। শক্ত পাথর হলে চুরচুর হয়ে যেত হাড়-গোড়। কিন্তু পড়ল কীভবে আর কোথায়ই বা পড়ল? বালিয়াড়ির চাঁদি চ্যাপ্টা আর প্রায় সমতল। উৎরাই অর্থাৎ নিচে নামার ঢাল শুরু হয়েছে নাক বরাবর আর প্রায় পঞ্চাশ হাত দূরে গিয়ে

চারপাশে তাকিয়ে আল হযরত দেখল—সে পড়েছে পাথরের তৈরি তিনকোনা একটা কুয়োর ভেতর। মাথার অনেক ওপরে গর্ত চুঁইয়ে সূর্যের আলো আসছে। শুরুতেই যে ব্যাপারটা তাকে স্বস্তি দিলো সেটা হলো কুয়োর ভেতরের তাপমাত্রা। বাইরের তুলনায় ঢের বেশি ঠান্ডা এ জায়গা। সেই সাথে দুশ্চিন্তায় ফেলল যেটা, সেইটে হলো—সাময়িক আশ্রয় হিসেবে চমৎকার হলেও এখান থেকে বেরুতে না পারলে, না খেতে পেয়ে তিলে তিলে মৃত্যু অনিবার্য! যা হয় হোক, আগে রুটি-জল খেয়ে আরামদায়ক পরিবেশে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেওয়া যাক। শরীরে তাকত ফিরলে, মনেও বিশ্বাস জন্মাবে, মনে মনে ভাবল আল হযরত। কপালে যদি লেখা থাকে এখানে মৃত্যু হবে, তো কেউ ঠেকাতে পারবে না। আর তা না হলে, বাঁচার কিছু একটা উপায় বেরুবে। রাখে আল্লাহ তো মারে কে!

একটা রুটি আর পানি খেয়ে পাথরের দেওয়ালে হেলান দিয়ে পা ছড়িয়ে বসে জিরোতে লাগল সে। কখন যে দুচোখের পাতা নেমে এসেছে বুঝতেই পারেনি।

১৭

ঘুম যখন ভাঙল, তখন মাথার ওপরের ফাঁক গলে ভেতরে ঢুকছে পড়ন্ত বিকেলের মরা আলো। ছ্যাঁত করে উঠল আল হযরতের বুকের ভেতর। সর্বনাশ! এই গহ্বর থেকে অন্ধকারে বেরুবে কীভাবে? তারপরেই মনে পড়ল: আলো থাকলেও বা বেরুতো কেমন করে? তিনকোনা পাথুরে দেওয়াল পরষ্পরের এত কাছাকাছি না যে এক দেওয়ালে পিঠ আর অন্য দেওয়ালে পায়ের পাতা ঠেকিয়ে নিজেকে ঠেলে ঠেলে ওপর দিকে তুলবে। অবশ্য আরও একটা উপায় আছে। দেওয়ালে যদি খাঁজকাটা থাকে, তাহলে সেইটে ব্যবহার করেও এখান থেকে বেরুনো যায়।

সমস্যা হলো: নিকষ অন্ধকারে সেইসব খাঁজ-ভাঁজ চোখে পড়ার কোনো সম্ভাবনাই নেই। তবে হ্যাঁ, মরুভূমিতে খোলা আকাশের নিচে সারারাত পড়ে থাকলে ঠান্ডায় দফা শেষ হয়ে যেত। রাব আল খালিতে রাতভর হু হু করে হাওয়া বয়। নৈশকালীন তাপমাত্রা হিমাঙ্কের কাছে। এজন্যেই পথিককে এখানে রাতে চলতে হয়। হাঁটার মধ্যে থাকলে ঠান্ডা কম লাগে। বসলেই জমে হিম। আল হযরতের পক্ষে অবশ্য রাতে হাঁটা প্রায় অসম্ভব হতো। মার-ধোর খাওয়া শরীর নিয়ে ঊষর মরুতে সারারাত- সারাদিন হাঁটা এক অলীক আকাঙ্ক্ষা! এই গর্তের ভেতর অনন্ত ওই ভয়ানক শীতের হাত থেকে বাঁচা যাবে। এরই ভেতর আবারও খিদে চাগাড় দিচ্ছে। রুটি খেলে তার সাথে পানিও খেতে হবে। অথচ একটা পুরো দিনও পার হয়নি এখনও। আজ রাতেই যদি সব শেষ হয়ে যায়, তাহলে কাল থেকে কী খাবে? এরপরেও আধখানা রুটি আর দুঢোক পানি খেলো আল হযরত। এরপর চোখ মেলে তাকিয়ে থাকল অন্ধকারে। এক সময় ঘুমিয়েও পড়ল।

.

মাঝরাতের দিকে হঠাৎ করে আল হযরতের ঘুম ভেঙে গেল। কোথায় যেন হাজার হাজার মানুষ হাহাকার করছে! জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে চূড়ান্ত আশাহতের সকরুণ বিলাপ। সড়সড় করে তার গায়ের সবকটা লোম দাঁড়িয়ে গেল। ভয়ানক অশুভ কিছু একটা যেন আছে ওই সম্মিলিত আর্তচিৎকারের ভেতর। কিছুক্ষণ পর থেমে গেল আওয়াজটা। চারদিক শুনশান। কিন্তু একটু পরেই আবার ধ্বনিত হতে লাগল সেই অপার্থিব অন্তিম আর্তনাদ। নিৰ্দিষ্ট বিরতিতে এরকম হতেই থাকল। শেষমেশ গা-সওয়া হয়ে গেল ব্যাপারটা।

তার মনে হলো সামনের দেওয়ালের ওপাশ থেকে ভেসে আসছে আওয়াজটা। হঠাৎ করেই তার মাথায় এলো এমনকি হতে পারে যে দেওয়ালের ওপাশে ফাঁকা কোনো জায়গা আছে? সুড়ঙ্গও থাকতে পারে। এ তিনকোনা কুয়ো যে মানুষের তৈরি সেইটে তো বোঝাই যাচ্ছে। তার মনে পড়ল দিনের আলো যখন ছিল, সেই সময় কুয়োর দেওয়ালের পাথরগুলো অতিরিক্ত কালচে মনে হয়েছে। এমনকি হতে পারে এই তিনকোনা দেওয়াল আসলে বিরাট কোনো চুলোর চিমনি?

যা হোক, সামনের দেওয়াল যেহেতু নিরেট, এর নিচের দিকটা খুঁড়ে দেখা যেতে পারে। ভুসভুসে বালি, হাত দিয়েই সরানো যাবে। কিন্তু এই ঘুটঘুটে আঁধারে সেটা করবে কীভাবে? ভোর হওয়া অব্দি অপেক্ষা করবে? বিকেল থেকে দুবার ঘুমানো হয়ে গেছে। এখন আবারও চট করে ঘুম আসবে না। খামোখা শুয়ে থেকে কী হবে? তারচেয়ে বরং অন্ধকারেই দেওয়ালের নিচে হাতড়ে হাতড়ে বালি সরানো যায়। যথা ভাবনা তথা কাজ। সামনের দেওয়ালের নিচটা বেছে নিয়ে দুহাত দিয়ে বালি সরাতে শুরু করল আল হযরত। কোনো তাড়াহুড়ো নেই।

.

খোঁড়াখুঁড়ির কাজ চলল ধীরে-সুস্থে। পেছন দিকে আস্তে আস্তে উঁচু হতে লাগল বালির স্তূপ। ভাগ্য ভালো যে তিনকোনা চিমনির মতো জায়গাটা বেশ চওড়া। ঘণ্টাখানেক খোঁড়ার পর একটা খালি মতন জায়গা পাওয়া গেল। মনে হলো পাথরের দেওয়াল যেন শেষ হয়ে এসেছে এখানে। খালিমতো জায়গাটা কোণকাটা খিলানের মাথার মতো চোখা। মনেমনে আশাবাদী হয়ে উঠল সে। জোর বেড়ে গেল খোঁড়াখুঁড়ির।

আস্তে আস্তে চওড়া হতে শুরু করল চোখা খিলানের তিনকোনা মাথা। এরই ভেতর মাথার ওপরের গর্ত থেকে চুঁইয়ে এলো ভোরের আলো। এবার নিজের কাজ দেখতে পেল আল হযরত। বুঝল, কোনো এক খিলানের নিচে খালি অংশ বের করেছে সে। এই খালি জায়গা দিয়ে বেরুনোর সুযোগ পাওয়া যেতে পারে। তবে বেরিয়ে কোথায় গিয়ে পড়বে, সেটা বোঝার কোনো উপায় নেই। ধীরে ধীরে একজন মানুষ হামা দিয়ে ঢুকে যাওয়ার মতো বড়ো হলো খিলানের মাথার মতো জায়গাটাতে। বেঁচে যাওয়া রুটি আর বাকি পানিটুকু সাবাড় করে গর্তের ভেতর হামা দিয়ে ঢুকে পড়ল আল হযরত। যা থাকে কপালে। তিনকোনো গহ্বরের ভেতর থাকলেও মরতে হবে। বরং এর ওপারে কী আছে সেইটে দেখা যাক।

খিলান পেরিয়ে এসে তিন ফুট নিচে পাথরের মেঝে চোখে পড়ল আল হযরতের। বুঝতে পারল—চার হাত-পায়ে সে ভর দিয়ে আছে একটা পাথরের লেজ বা ধারির ওপর। এই তিনকোনা পাথরের স্তম্ভ আসলেই চিমনি জাতীয় কিছু একটা। সে যেখানে বানরের মতো ঘাড় গুঁজে বসে আছে, সেখান থেকে তিন হাত নিচে প্রকাণ্ড এক কামরার পাথুরে মেঝে। ওপর দিকে তাকিয়ে বৃত্তাকার ছাত চোখে পড়ল। কমরার ভেতরটা পুরোপুরো আঁধার না। দূরে কোথাও আলোর উৎস আছে। এটা কি হতে পারে ওই আলোর উৎস আসলে সূর্য! আর তা-ই যদি সত্যি হয়, তাহলে বাইরের মুক্ত আলো-হাওয়ায় ফিরে যেতে আর বেশি দেরি নেই!

হুড়মুড় করে পেল্লায় কুলুঙ্গির মতো খাঁজটা থেকে নিচে নেমে এলো আল হযরত। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বুক ভরে শ্বাস নিলো। গুমোট বাতাসে বহুকালের পুরনো হয়ে যাওয়া পরিত্যক্ত ভবনের সোঁদা গন্ধ। ঘরের আঁধারটা ফিকে হয়েছে প্রায় পঞ্চাশ হাত দূরে দুমানুষ সমান একটা দরজার কাছে। দরজা বলতে দেওয়ালের গায়ে কাটা একটা চৌকো জায়গা। চৌকাঠ-পাল্লা এসবের কোনো বালাই নেই। গোলাকার ঘরটার মেঝেয় দাঁড়িয়ে চারদিকে তাকাল আল হযরত। দেওয়ালজুড়ে সারি সারি তাক। দুই তাকে মধ্যেকার ব্যবধান দেড় হাতের মতো। তাকের ওপর লাইন দিয়ে সাজানো অগুণতি সরু সরাইয়ের মতো জিনিস। কতকটা গায়ে নকশাকাটা ফুলদানির মতো দেখতে।

আর বাপস্, এ যে দেখছি আলকানজুল খাফিউ! আদ্যিকালের কোনো বাদশাহর খাজাঞ্চিখানায় চলে আসিনি তো! ভাবল আল হযরত।

অবশ্য এর পরপরই মনেমনে ধমক লাগাল নিজেকে। বিড়বিড় করে বলল, বাঁচি না মরি তার নেই ঠিক, এখন আবার গুপ্ত খাজানার চিন্তা! তবুও কৌতূহল যায় না। দেখাই যাক না, ওই কলসির মতো জিনিসগুলোতে কী আছে? পায়ে পায়ে নাক বরাবর এগিয়ে গেল সে। কোমর হাইটের একটা শেলফ থেকে তুলে নিলো একটা বর্তুলাকার পাত্র। খুব বেশি ভারী না ওটা। মেরেকেটে দেড় সের হবে। এ কলসি পাথর কিম্বা পোড়ামাটির না। হলে, আরও ভারী হতো। একটু ঘষা দিতেই উজ্জ্বল হলদে রং ঝিলিক দিয়ে উঠল ছায়ছায়া অন্ধকারে। ও বাবা, এ দেখছি নিরেট সোনার তৈরি আধার! কারুকাজকরা কলসির সরু গলার ওপর সরাইয়ের মতো চওড়া মুখে দস্তার সিলমোহর করা। সিলমোহরের ওপর প্রাচীনকালের হারিয়ে যাওয়া হরফে কীসব যেন লেখা। কী আছে এই একহাত উঁচু খাঁটি সোনার তৈরি কলসির ভেতর? জানতে হলে পাথুরে মেঝেতে আছাড় মেরে ভাঙতে হবে কলসের সিলমোহর।

আর সেকাজটাই করল আল হযরত। আছাড় দিয়ে সিলমোহর ভেঙে মেঝের ওপর উপুড় করে ধরল সোনার কলসি। কিন্তু এ কী! ভেতর থেকে মেঝের ওপর ঝুপঝুপ করে ঝরে পড়ল একগাদা ছাই। প্রায় আধ সেরের মতো। কাঠপোড়া ছাই এত যত্ন করে রাখা হয়েছে সোনার কলসিতে! ছাইগাদায় রাখলে কী সমস্যা হতো! ছাই থাকবে ছাইগাদায়, সেটাই স্বাভাবিক। তা না এত হুজ্জত করে বিস্তর ব্যয় মিটিয়ে একে রাখা হয়েছে তাকের ওপর সোনার কলসিতে! উঁহু, কী যেন মিলছে না।

আল হযরত যখন হতভম্ব হয়ে ছায়াছায়া অন্ধকারে ছোটো ছাইগাদাটার দিকে তাকিয়ে একমনে ভাবছে, ঠিক তখনই তার মনে হলো কামরার ভেতর দিয়ে যেন হালকা এক ঝলক হাওয়া বয়ে গেলে। আর সেইসাথে ঠান্ডায় তার কলজে অব্দি জমে গেলে। কানেকানে কে যেন মিনিয়ান ভাষায় ফিসফিস করে বলল, ‘এসব ধুল কাফফানের উদ্দেশ্যে বলি দেওয়া মানুষের লাশ পোড়ানো ছাই। যেখান থেকে পেয়েছ, সেখানেই আবার রেখে দাও ও জিনিস। ছাইগুলো উঠিয়ে ভস্মাধারে ভরে মুখ আটকাতে ভুলো না।’

আচ্ছা, আদ্যিকালের মিনিয়ান ভাষা শেখা শেষমেশ কাজে লাগল তাহলে! একথা ভেবে মনেমনে খুশি হয়ে উঠল আল হযরত। সোনার কলসি তাকের ওপর রেখে সিদ্ধান্ত নিলো— ভবনের বাইরে বেরুতে হবে এবার। গোলাকার কামরায় ঢোকার দুটো দরজা। একটা সরু আর খাটো, অন্যটা অনেক উঁচু আর চওড়া। সরু প্রবেশ দ্বারটা সম্ভবত এখানে যারা সহকারী ডোমের কাজ করত, তাদের এখানে ঢোকা আর বেরুনোর জন্যে। লম্বা- চওড়াটা রাজা-গজা আর পুরোহিতদের। চওড়াটা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো আল হযরত। এগিয়ে চলল আধো অন্ধকার করিডোর ধরে।

হেঁটে যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। করিডোরের দুপাশে অগুণতি দরজা। পাল্লা নেই একটিরও। কী আছে দরজাগুলোর ওপাশে? সবগুলোর ভেতরে ঢুকে খুঁটিয়ে দেখা অসম্ভব। তারচেয়ে বরং এগিয়ে দেখা যাক কী আছে সামনে। করিডোরের শেষ মাথায় চৌকোনা বিশাল দুপাল্লার কাঠের দরজা। দরজার গায়ে দড়ি দিয়ে বাঁধা ধাতব কড়া। বহুকালের পুরোনো দড়ি। ধুলোবালি আর ঝুলকালিতে বোঝায়। হাত দিয়ে ধরতেই ঝুরঝুর করে ভেঙে পড়ল। চাপ দিতেই ঘড়ঘড় আওয়াজ তুলে খুলে গেল দরজার পাল্লা। স্নিগ্ধ সবুজ মনোরম আলোয় ভরে আছে দরজার ওপাশে একটা ডিম্বাকৃতি মাঝারি মাপের ঘর। সবুজ পাথরের দেওয়ালজুড়ে সমান্তরাল দুসারি তাকের ওপর তিনফুট পরপর সোনার কারুকাজকরা সাদা কাপড়ে ঢাকা মৃতদেহ। স্বচ্ছ স্ফটিক দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে তাকগুলো, যেন কাচ দিয়ে ঘেরা। সবুজ আলোটা আসছে লাশের পাশে তাকের দেওয়াল থেকে। অতি দুষ্প্রাপ্য অসংখ্য পদ্মরাগমণি গেঁথে দেওয়া হয়েছে ওখানটায়। দিপদিপ করে ঠান্ডা সবুজ আলো ঠিকরে বেরুচ্ছে ওই অমূল্য মণিগুলো থেকে।

কামরার ঠিক মাঝখানে মাজা সমান উঁচু সাদা ধপধপে পাথরের বেদির ওপর স্ফটিকে তৈরি শবাধার। শবাধারে হালকা হলদে রঙের স্বচ্ছ তরলের ভেতর ডুবিয়ে রাখা হয়েছে এক মাঝারি আকৃতির মহিলার লাশ। পরনে হলদে রঙের রেশমি টিউনিকের মতো পোশাক। পুরো আভরণ জুড়ে লাল-সবুজ পাথর বসানো সোনা-রুপোর কারুকাজ। সোনার পাতে তৈরি মুকুটে ঢাকা মাথাভরতি সরুসরু বেণি করা কালো চুল। লাল টুকটুকে ঠোঁট, খাড়া নাক, বুজে থাকা পাতাঅলা টানাটানা চোখ, মাঝারি আকৃতির কমনীয় কপাল। চমৎকার গড়নের অপূর্ব সুন্দর এক মাঝবয়েসি মহিলা। বেদির দেওয়াল জুড়ে খোদাই করা মিনিয়ান লিপি। নরম সবুজ আলোয় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে সবকটা অক্ষর। এ কামরার সব লাশ পুরোহিতদের। এদের আরাধ্য দেবতার নাম: পটাহ্। কুহক ও জাদুবিদ্যার একচ্ছত্র অধিপতি। শবাধারে শুয়ে থাকা মহিলা দেবতা পটারে প্রধান পুরোহিত।

বেদির গায়ে লেখা কথাগুলো পড়তে শুরু করল আল হযরত। হঠাৎ করেই কমতে লাগল সবজেটে আলোর দ্যুতি। পড়া শেষ হতেই নিকষ কালো আঁধারে ঢেকে গেল পুরো ঘর। একদল ছায়া- ছায়া আকৃতি ঘিরে ধরল তাকে। এই অশুভ আত্মার দল প্রথমে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করল আল হযরতকে। মেরেই ফেলত, কিন্তু তা ঘটল না আল হযরতের বরাতের জোরে। তাকে বাঁচিয়ে দিলো মুসাফির আল ফকিহর দেওয়া সেই মাদুলিটা। ওটা দেখার পর প্রেতাত্মার দল ফের টুকরোগুলো জোড়া লাগিয়ে আগের আকার দিলো তাকে। আবারও প্রাণ সঞ্চার করলো আল হযরতের ধড়ে, এরপর তাকে দিয়ে স্বীকার করালো আঁধারের দেবতা পটারে আনুগত্য।

পটারে ক্ষমতা বিপুল। দুনিয়ার বুকে যত রকমের গুহ্যবিদ্যা আছে সেসবের একচ্ছত্র অধিপতি সে। এক আধিভৌতিক চির- বিধ্বংসী সত্তা। তবে হ্যাঁ, কাউকে দীক্ষা দেওয়ার আগে পটাহ নিশ্চিত হয়ে নেয় অনন্তকালের জন্যে তার বাঁধা গোলাম হয়ে থাকার। পটারে কাছে শপথ গ্রহণের পর প্রাচীন ব্যাবিলন নগরীর ধ্বংসস্তূপের কাছে নিয়ে যাওয়া হলো আল হযরতকে। শিক্ষা দেওয়া হলো ব্যাবলনিয় অপদেবী জাগানোর মন্ত্র।

এরপর তাকে পৌঁছে দেওয়া হলো আদ্যিকালের মেম্ফিস শহরে। এখানেই হাথোরের মন্দিরের নিচে মাটির তলায় এক গোলোকধাঁধাঁর মতো ঘুটঘুটে অন্ধকারাচ্ছন্ন পাথুরে প্রাসাদে শেখানো হলো শেসমু, বাবি, রেরেক, মেনহিত, আর মাহেসে উপাসনা। এরপর তাকে আল কাহিরা[১০] নগরীতে এনে ছেড়ে দেওয়া হলো। পই পই করে বলে দেওয়া হয় মহান পটারেঅনুগামী হয়ে থাকতে।

[১০. বর্তমানে কায়রো]

তবে ততদিনে ক্ষমতার লোভ পেয়ে বসেছে আল হযরতকে। ইচ্ছে করলেই যে কারও ভূত-ভবিষ্যত বলে দিতে পারে সে। সারিয়ে তুলতে পারে জটিল রোগে আক্রান্ত মুমূর্ষু রোগীকে। ঘন কালো মেঘে ঢেকে ফেলতে পারে আকাশ, ঘটাতে পারে ভারী বর্ষণ, তীব্র ভূমিকম্প, কিম্বা ডেকে আনতে পারে মরুঝড় সাইমুম। বশীকরণ করে বিছানায় তুলতে পারে এমনকি রাজকন্যাকে-ও!

১৮

কায়রোয় শুরু হলো আল হযরতের জীবনের সোনালি দিন। হাতে টাকা আসতে লাগল হু হু করে। আগামি ছমাসে কোনো মালের চাহিদা দ্বিগুণ হবে সেকথা ব্যবসায়ীদের বলে দিলেই হলো। মুনাফার বখরা আধাআধি। কে যায় ব্যাবসা-বাণিজ্যের ঝামেলায়! নীলনদের ধারে যামালেক এলাকার গেযিরায় বিশাল এক হাভেলি বানিয়ে এন্তার দাস-দাসি নিয়ে থিতু হলো সে। রাত কাটাতে লাগল কাহিরার প্রখ্যাত আলমি[১১] রুবাইয়াতকে নিয়ে। গভর্নর রুইয়ানের মেয়ে রুখসানাকে মনেই পড়ে না!

[১১. বেলি ড্যান্সার]

তবে ওই যে কথায় আছে: সুখে থাকতে ভূতে কিলায়। আল হযরতের চাই আরও বেশি ক্ষমতা। মেম্ফিসের ভূগর্ভস্থ ল্যাবারিন্থে শিক্ষানবিস থাকার সময় সে বুঝতে পেরেছিল: তন্ত্রের মাধ্যমে গোটা সেনা বাহিনী কিম্বা পুরো একটা জনগোষ্ঠি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। আর ওটাই হলো সবথেকে শক্তিশালী বিদ্যা। ওই গুহ্য তত্ত্ব তাকে আয়ত্ব করতেই হবে। কিন্তু চাইলেই তো আর হবে না। ও বিদ্যে শিখতে হলে তাকে যেতে হবে দাহনা নামের এক মরুভূমিতে। আরব উপদ্বীপের মাঝখানে ওটা। বালির রং টকটকে লাল। হাজার মাইলের ভেতর না আছে কোনো মরুদ্যান, না আছে জনপ্রাণী। এ এক অতি ভয়ঙ্কর বীভৎস এলাকা!

ধারণা করা হয় বহুকাল আগে লাল মরুর ঠিক মাঝখানে পটারে এক মন্দির ছিল। মন্দিরের গর্ভগৃহে শ্বেতপাথরের পেল্লায় এক বেদির ওপর বসে পূজারিদের নৈবেদ্য গ্রহণ করতেন পটাহ্ নিজে। ওই বীজমন্ত্র আয়ত্ত করতে হলে যেতে হবে প্রাগৈতিহাসিক সেই মন্দিরে। বেদির ওপর মাদি উট বলি দিয়ে অর্ঘ্য নিবেদন করতে হবে পটাকে। প্রভু যদি খুশি হন, তাহলেই কেবল কানে কানে বলে দেবেন মহাশক্তিশালী অতিলৌকিক সেই বীজমন্ত্র।

বলা হয়: দাহনা হলো সেই জায়গা যেখানে জনবসতি থেকে হাজার ক্রোশ দূরে অদ্ভুত সব প্রেতাত্মা আর যমদূতেরা ঘুরে বেড়ায়। জায়গাটার সম্বন্ধে যুগের পর যুগ ধরে বিধৃত হয়েছে অবিশ্বাস্য সব লোককাহিনি আর উপকথা। তবে কোনটা সত্যি আর কোনটা মিথ্যে সে ব্যাপারে নিশ্চিত করে কিছু বলা যায় না। কেউ আসলে সত্যিই ওখানে গিয়ে এসব দেখে এসেছে না বানিয়ে বলছে, কিম্বা অন্য কোথাও থেকে শুনে এসে শোনাচ্ছে—সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে বিস্তর। তবে এখানেই বড়ো ধরনের এক সমস্যায় জড়িয়ে পড়ে আল হযরত। বহু কষ্টে দাহনাতে গিয়ে পুরনো ধচাপচা এক মন্দিরও বার করল। তবে ওটা পটারে মন্দির আদৌ ছিল না! আগপিছ না ভেবেই পুজো দিলো। ভুল করে নৈবেদ্য দিয়ে ফেলল তৃতীয় শ্রেণির এক অপদেবী, আপাতিকে। এটাই কাল হয়ে দাঁড়াল তার জন্যে। পটাহ্ ত্যাগ করলনে তাকে। সব ক্ষমতা হারিয়ে ফুঁটো জগন্নাথ হলো ইয়েমেনি কবি আব্দুল আল হযরত।

এখানেই শেষ না। পটারে অভিশাপ নেমে এলো তার ওপর। রাতে ঘুমোতে পারে না সে। দুচোখের পাতা এক করলেই দেখতে পায়: হাড় জিরজিরে চারটে ঘোড়া তার দুহাত দুপা ধরে টনাছে। কাঁধের নিচে শরীর থেকে চড়চড় শব্দে আলাদা হয়ে যাছে দুই হাত। এরপর ধড়ের নিচ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে দুই পা। পেট থেকে বেরিয়ে মরুভূমির বালিতে লাট খাচ্ছে নাড়িভুঁড়ি। আরেকটা স্বপ্নে দেখতে পায়: বেদির ওপর কাঠের গুলিতে রেখে কুড়োল দিয়ে তার মাথা দুফাক করছে কঙ্কালসার চারজন লোক। বেদির পেছনে ধুল কাফফানের মূর্তি। হলদে চোখে অশুভ দৃষ্টি।

দুঃস্বপ্ন দেখে ধড়মড় করে জেগে উঠতে লাগল বেচারা। জেগে উঠলেই কুলকুল করে ঘাম ঝরে শরীর থেকে। গলা শুকিয়ে দক্ষিণ আরবের রাব আল খালি মরুভুমি। এখন কী করা? নাহ, সানাতে ফিরে যাওয়া যাবে না কিছুতেই। ওখানে তার চেহারা প্রকাশ পাওয়ামাত্র শিরশ্ছেদ অনিবার্য। কাহিরাতে ফিরে গেলে ওখানে সয়-সম্পত্তি যা আছে তা দিয়ে ভালোভাবে জীবন পার করা যায়। কিন্তু ও রাস্তাও বন্ধ। ওখানে গেলে প্রতিহিংসার দেবী এরিনিসই শেষ করবে তাকে। মেম্ফিসের মাটির তলার অদ্ভুতুড়ে মন্দিরে এ ব্যাপারে সাবধান করা হয়েছে শুরুতেই। একবার এরিনিসকে পুজো দিলে পটাহকে নৈবেদ্য দেয়া যাবে না কোনোভাবেই।

শেষমেশ দামেস্কে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো সে। বড়ো শহর। হাতে টাকা-পয়সা নেই একেবারেই, তবে কাজ একটা কিছু জুটে যাবে।

১৯

দামেস্কে গিয়ে এক রুটির দোকানে কাজ নিলো আল হযরত। ভোর চারটের সময় উঠে ময়দা খামির করতে হয়। হাজার দুয়েক রুটি বানানোর জন্যে লাগে বস্তা বস্তা ময়দা। চার হাতপায়ে নুন-জল দিয়ে ময়দা মাখতে কাল ঘাম ছুটে যায় তার। তার ওপর গনগনে তন্দুরির আগুনে শেঁকা। সারা জীবন কবিতা লিখে আর তন্ত্র-মন্ত্র করে কাটিয়েছে। কঠোর পরিশ্রমের অভ্যেস নেই। কোনো রকমে দাঁতে দাঁত চেপে দুহপ্তা কাজ করার পর ঢেঁসে গেল আল হযরত। না বাবা, আমাকে দিয়ে ওকাজ হবে না। তার চেয়ে বরং ভিস্তিঅলা হয়ে রাস্তায় রাস্তায় পানি বিক্রি করি।

করতে গিয়ে গিয়ে দেখল: ঝামেলা আছে একাজেও। কুয়ো থেকে পানি তুলে চামড়ার মশকে ভরতে হয় প্রথমে। তারপর রাস্তায় রাস্তায় ফেরি করা, দোকানে দোকানে সাপ্লাই। জল-ভরতি মশকের ওজন কম করে হলেও দেড় মণ! সারাদিন অন্তত তিনবার পানি ভরে ঘাড়ে করে টানতে হয় এই গন্ধমাদন। না করলে, দুবেলার বেলার আহার জোটে না। সারাদিন কাঁধে করে মশক বয়ে বেড়ানোর পর, ঘাড়ে আর পিঠে এমন ব্যথা হয়, বিছানায় পাশ ফিরে শোয়া অব্দি যায় না। সপ্তাহ খানেক না কাটতেই তাকে ইস্তফা দিতে হলো একাজেও!

ভেবে-চিন্তে আল হযরত দেখল: বাজারের সামনের রাস্তায় মুচির কাজ বেশ হালকা-ফুলকো। নাগরাই জুতো আর হিদা কিম্বা চপ্পল সেলাই করে দিব্যি পেট চালিয়ে নিচ্ছে বশির, হেলাল, আর বাহারের দল। মনে মনে ভাবল যাই ওকাজটাই করি গিয়ে। জুতো সেলাই করে কাটতে লাগল তার দিন। রাতে ঘুম হয় খুব কম। তাড়া করে ফেরে কলজে হিম করা আজগুবি সব দুঃস্বপ্ন। দুচোখের পাতা খুঁজে আসলেই দেখে, আলখাল্লাপরা ছায়া ছায়া কারা যেন গিলে খেতে আসছে তাকে। হাড়গিলে হাতে বাঁকানো নখ, একটুও মাংস নেই মুখে। চোখের খোঁড়লের ভেতর ধকধক করে জ্বলছে লাল টকটকে মণি। গালভরতি কালচে আর ঘিয়েরঙা দাঁতের সারি। ছায়ামূর্তিগুলোর কোনো পা নেই। স্রেফ হাওয়ায় ভাসছে তারা। হাড় বার হওয়া নাকের খোঁদলের নিচে রক্ত জল করা খলখলে হাসি।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন