নজ্জুমি কিতাব – ৬০

পরদিন সকালে সাইকিক সেন্টারে আবারও মিটিংয়ে বসল চারজন। আবারও সেই আগের চীনে মেয়েটা চা পরিবেশন করল। সাথে কাপ কেক। এ মেয়েটা সব সময় এখানে থাকে কেন? আগে তো কখনও দেখিনি। ম্যাডাম জুইয়ের সাথে এর তেমন কোনো সম্পর্ক আছে বলেও মনে হয় না। মনে মনে ভাবলেন শরৎ বাবু।

তৎক্ষণাৎ উত্তরও উদয় হলো তার মাথায়। এ মেয়ে আসলে ট্রায়াডের হয়ে কাজ করছে। এখানে কী হচ্ছে, না হচ্ছে সেসব পুঙ্খানুপুঙ্খ রিপোর্ট করে সে। কোনো সন্দেহ নেই, সবাইকে চোখে চোখে রাখে ট্রায়াড। এমনকি এই সাইকিক মহিলাও এর ব্যতিক্রম না। এবার ম্যাডাম জুইয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আগেই বলেছি আমার ইন্টুইশন বলছে কিছু একটা ঘটবে। এখন দেখলেন তো কোত্থেকে এলো সূত্রটা।”

“হুম। বুঝতে পেরেছি,” বলল ম্যাডাম জুই। “দুই আর দুই চার মেলালে যা হয় তা হলো: টং মন্দিরে ওই ক্লু রেখে গেছে এ জন্যে যে ওটা অনুসরণ করে আমরা আবারও বাবুলবোনা সেমেটারিতে যাই।”

“কিন্তু কেবল বাবুলবোনা সেমেটারিই কেন? অন্য কোথাও তো হতে পারে?” প্রশ্ন করল আব্দুল খান।

“না, পারে না,” বললেন শরৎ বাবু। “আমাদের মনে রাখতে হবে: প্রথম ব্লুটা অর্থাৎ চীনে হরফ খোদাই করা রুপোর ওই চাকতি আমরা বাবুলবোনাতেই হেনরির সমাধিতে পেয়েছিলাম। আর ওটা রেখেছে কে? টং নিজে। এরপর পাণ্ডুলিপি নিয়ে উধাও হয়ে গেছে টং। তারপর মারা গেছে সে। কবরে গিয়ে দেখলাম ডেডবডি উধাও। কাঠের ডামি লাশ শুয়ে আছে সেখানে। ডামির মাথার নিচে তুদিগং লেখা কাঠের ফলক। সেখান থেকে গেলাম মন্দিরের গর্ভগৃহে তুদিগংয়ের প্রতিমার কাছে। দেখা গেল—বেদির সামনের পেডেস্টালে খোদায় করা বালুঘড়ির ওপর ডেঞ্জার সাইন। ওদিকে এই একই সাইন খোদাই করা রয়েছে বাবুলবোনা সেমেটারির এক পেল্লায় কবরের ওপর। যতটুকু বুঝতে পেরেছি টংয়ের কাজ খুব গোছানো আর ফর্মুলাইক। আমাদের পরবর্তী গন্তব্য হবে বাবুলবোনা সেমেটারির ওই কবর যেটার কথা দীনবন্ধু বলেছে। এর থেকে আরও উত্তম কোনো ব্যাখ্যা আছে আপনাদের কারও কাছে?”

“দীনবন্ধু এত গুরুত্বপূর্ণ একটা জিনিস দেখেছে অথচ আমাকে বলেনি! ওই গোরস্থানে তো আমিই নিয়ে গিয়েছি ওকে! এটা কীভাবে করতে পারলেন আপনি, দীনবন্ধু বাবু?” দীনবন্ধুর দিকে অভিযোগের আঙুল তুলল আব্দুল খান।

“ওটা যে এত গুরুত্বপূর্ণ সেটা তো তখন বুঝিনি, আব্দুল খান ভাই। আর তাছাড়া আপনি ছিলেন তাড়ার ওপর। একবার ওদিকে নজর দিয়েছিলাম বলে কী বকুনিটাই না দিয়েছিলেন! ভাগ্য ভালো ওই চিহ্নটা খেয়াল করেছিলাম তখন।”

“এসব বাদ দেন এখন,” বিরক্ত হয়ে বলল ম্যাডাম জুই। “ফালতু বিষয় নিয়ে ঝগড়া-ঝাঁটি করার জায়গা নয় এটা ছেলেমানুষের মতো আচরণ যদি করতে চান, তো বাইরে গিয়ে করুন।”

“এর কথা বাদ দিন, ম্যাডাম। আপনার মতামতটা দিন এবার,” বললেন শরৎ বাবু।

“আমি বলি কী আবারও বহরমপুরে যাবো আমরা। দীনবন্ধু আমাদের ওই চিহ্নঅলা সমাধিটা দেখিয়ে দেবে। তারপর ওটা খুঁড়বো। এখন বলেন আপনারা একমত কিনা?”

“আমরা একমত, কারণ সব যুক্তি-সংকেত-ব্লু ওটাই নির্দেশ করছে। তাছাড়া, ওখানে যাওয়া ছাড়া অন্য দিকে এগুনোরও তো কিছু নেই। তাই না?” স্মিত হেসে বললেন শরৎ বাবু।

“ঠিক তাই। তাহলে কালই রওনা হচ্ছি আমরা। উঠবো গিয়ে আগে যেখানে উঠেছিলাম। ওই যে কী বলে, গোরা বাজারের সার্কিট হাউসে। কেমন তো?”

“আজ্ঞে, হ্যাঁ। কাল নটার সময় এখানে আমরা তিনজন চলে আসবো। আপনি যদি একটু কষ্ট করে রেডি হয়ে থাকেন তো খুব ভালো হয়।”

“ওসব নিয়ে ভাববেন না। আমাকে রেডি পাবেন। আপনারা এখন আসুন তাহলে।”

মেসে ফেরার সময় আব্দুল খান বলল, “আমি কিসমত ভাইয়ের সাথে একটু বেড়াতে বেরুবো। আপনারা মেসে নেমে যান এখন, আমি পরে আসছি।”

“বেশ, আপনার মর্জি। তবে কাল সকাল সকাল রেডি হয়ে থাকবেন। এখান থেকে ঠিক সাড়ে আটটায় বেরিয়ে যাবো আমরা,” বললেন শরৎ বাবু।

৬১

নিজ রুমের সামনে এসে দীনবন্ধু দেখল—বারান্দার ওপর চেয়ার পেতে তার পিসেমশাই ভবতারিণী আর অর্জুন বসে আছে। সর্বনাশ! এমন তো হওয়ার কথা ছিল না! অর্জুনকে বলা ছিল দুজনে মিলে দুহপ্তার জন্যে বেনারস বেড়াতে যাবে। এই সময়ে পিসেমশাই এখানে এলো কোত্থেকে? এ তো ভারী বিপদ হলো দেখছি। এক মিথ্যে ঢাকতে গিয়ে হাজারটা মিথ্যের জন্ম হয়!

পিসেকে দেখে তড়িঘড়ি করে প্রণাম করল দীন। তার পায়ের ধুলো মাথায় নিলো। বলল, “আরে পিসেমশাই যে, পেন্নাম হই। আমাকে একটি বার খবর দিলেই তো পারতেন। এখানে কষ্ট করে আসার দরকার কী?”

“আর খবর! কতদিন হলো এসেছ, সেই যে একবার গেলে তারপর আর পাত্তা নেই। ওদিকে কুষ্টিয়া থেকে ঘনঘন তাগাদা পাঠাচ্ছেন দিদি আর জামাই বাবু। কী নাহ, দীনের কী হলো দেখো। ওকে দেশে আসতে বলো। এখানে এসেই বা কী লাভ? তোমাকে কী পাওয়া যায়। সারাদিন কোথায় কোথায় টো টো করে ঘুরে বেড়াও! তাও ভালো অর্জুনকে পেয়েছি। যাহোক, এদিক দিয়েই যাচ্ছিলাম, ভাবলাম তোমরা কোথায় উঠেছ একবার দেখে যাই। ঢুকতেই মেস ম্যানেজারের সাথে দেখা। তোমাদের নাম বলতেই বিলক্ষণ চিনলেন। এরপর তোমাকে না পেয়ে ডেকে দিলেন অর্জুনকে। ওর কাছ থেকে জানলাম তুমি বাইরে কোথায় জানি গেছ। ভাবলাম আজ আর দেখা না করে ফিরছি না। তোমদের না বেনারস যাওয়ার কথা, তা ওখানে না গিয়ে এখানেই বসে আছ যে! বলি, ব্যাপার কী?”

“কী আর বলবো পিসেমশাই, হঠাৎ করেই শরীর খারাপ হলো। ডায়রিয়া আর সেই সাথে জ্বর।”

“আরে বাবা! তাই নাকি! তো আমাকে খবর পাঠালে না কেন? এই বিদেশ-বিভূঁইয়ে মেসে পড়ে থেকে কী ‘চিকিচ্ছে’ হয়, না পথ্য মেলে!”

“কাছে অর্জুন ছিল। আপনাদের মিছেমিছি দুশ্চিন্তায় ফেলতে চাইনি। অবস্থা বেশি খারাপ হলে তো ও আপনার কাছে যেতই। তিন দিনেই ভালো হয়ে গেছি।”

“তা বেশ, এখন তাহলে চলো আমার সাথে। আজ থেকে তোমরা দুজনে আমার ওখানেই থাকবে।”

ভালো ঝামেলা হলো দেখছি, মনেমনে ভাবল দীন। একে কীভাবে বোঝাই এখন? সে বলল, “পিসেমশাই, কাল এক জায়গায় যাওয়ার কথা আছে। ওখান থেকে ঘুরে এসে না হয় যাবো আপনার ওখানে।”

“আরে যাওয়া-টাওয়া বাদ দাও এখন। পরে এক সময় গেলেই হবে। তাছাড়া, কেবল অসুখ থেকে উঠেছ, এখনই এত ঘোরঘুরি কীসের? তোমার দরকার পূর্ণ বিশ্রাম। আমার সাথে চলো। তোমার বাবাকে জানিয়ে দিচ্ছি পিসির কাছে আছো তুমি। যাও ব্যাগে কাপড়-চোপড় সব গুছিয়ে নাও। একসাথেই রওনা হবো এখন।”

এবার কী বলবে ভেবে পেল না দীন। চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। কী করা? কী করা? ঠিক এই সময়ে স্পঞ্জের স্যান্ডেল ফটফটিয়ে এদিক পানে কারও এগিয়ে আসার শব্দ শুনতে পেল সে। তাকিয়ে দেখল শরৎ সিনহা আসছেন। ওহ, বাঁচা গেল বাবা। দেখা যাক ইনি কোনো উপায় বার করতে পারেন কি না—মনেমনে ভাবল সে।

“আরে, ভবতারিণী কাকা, আপনি এখানে?” দীনের পিসেমশাইকে দেখে প্রশ্ন করলেন শরৎ বাবু

“ওহ, শরৎ! তুমি যে এখন মেসে আছ তাতো জানতাম না। স্কুলে যাওনি আজি?”

“আজ্ঞে, স্কুল থেকে এক মাসের ছুটি নিয়েছি। কাকিমা ভালো আছেন তো, কাকা?”

“হ্যাঁ, ও ভালোই আছে। তবে গেঁটে বাতের ব্যথায় বেশ কষ্ট পায়। দীন যে কেন এখানে উঠেছে তা এখন বুঝতে পারছি না। ওকে আমার ওখানে নিয়ে যেতে চাচ্ছি। কিন্তু সহজে কী যেতে চায়! বলছে কাল কোথায় নাকি যেতে হবে। এই দেখো না কোথায় ঘরে ঢুকে কাপড়-চোপড় গোছাবে, তা না এখনও বারান্দাতেই দাঁড়িয়ে আছে।”

“কাল আমরা কয়েকজন মিলে মালদা যাবো। দুটো দিন থাকবো ওখানে তারপর ফিরে আসবো। যাওয়া-খাওয়া-থাকা এসবের ব্যবস্থা হয়ে গেছে। অ্যাডভান্স পেমেন্টও করতে হয়েছে। এখন দীন যদি না যায়, তাহলে বিরাট লস। পরে একা একা মালদা গিয়ে সুবিধা করতে পারবে না ও। আমাদের সাথে গেলেই বরং সব দিক থেকে ভালো। ওকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করবেন না, কাকা। আমি তো আছি।”

“ও আচ্ছা। কিন্তু অর্জুনের কী হবে? ও যাবে না?”

“না, খুড়ো, আমি যাবো না,” সাথেসাথে উত্তর দিলো অর্জুন। “এই প্রথম কোলকাতায় এসেছি। এখানেই ঘোরাফিরা করতে চাই। কত কী যে দেখার আছে এ শহরে!”

“বেশ যাবেই যখন যাও। তবে একটা কথা কী জানো, তোমার কাকিমা বলছিল মনের ভেতর কু ডাকছে তার। অনেকটা সে কারণেই ঢুঁ মেরেছি এই মেসে। যদিও জানতাম এখানে দীন কিম্বা ওর বন্ধু অর্জুন নেই, ওরা বেনারস গেছে, তবুও হানা দিয়েছি এই মেস বাড়িতে। ওপারে জামাই বাবু আর দিদিরও একই ধারণা। ভীষণ উৎকণ্ঠার ভেতর আছেন ওরাও। এর পেছনে সঙ্গত কারণও আছে। এক তো না বলেকয়ে চলে এসেছে এ ছেলে। তার ওপর ও-ই বলেছে ডায়রিয়া আর জ্বরে পড়েছিল। এ বিদেশ বিভূঁইয়ে ঠিকমত চিকিচ্ছে না হলে প্রাণাঘাতী হতে পারে এ রোগ! আবারও বলছি বাদ দাও ওসব মালদা-ফালদা। তারচেয়ে আমার বাসায় চলো, তারপর ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাও।”

“এখন আর তা হয় না, পিসেমশাই। টাকা-পয়সা দেওয়া হয়ে গেছে, সব প্ল্যান-প্রোগ্রাম করা শেষ। এখন পিছিয়ে যাওয়া মোটেও ভালো দেখায় না। মোটে দু-তিনদিনেরই তো ব্যাপার। কথা দিচ্ছি, ঘুরে এসেই ব্যাগ-ছ্যাগ গুছিয়ে আপনার ওখানে যাবো। তারপর সরাসরি কুষ্টিয়া।”

অনেক অনুরোধের পরেও দীনবন্ধুর ঘরে ঢুকলেন না ভবতারিণী বাবু। মুখ ভার করে ফিরে গেলেন। রাস্তা অব্দি তাকে এগিয়ে দিলো দীন আর অর্জুন। বিদেয় নেওয়ার সময় বললেন, “ছেলেটাকে দেখে রেখো, অর্জুন।”

.

ভবতারিণী বাবুর আচরণ স্পর্শ করল অর্জুনকে। ঘরে ফিরে এসে সে বলল, “দীন। তোর ওখানে না গেলেই কি নয়? এদিকে পিসেমশাই, ওদিকে তোর বাবা-মা সবাই তোকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছে। আমাদের মনে হয় যত দ্রুত সম্ভব দেশে ফিরে যাওয়ায় উচিত। কী বলিস তুই? তাছাড়া একটা জিনিস এখনও বুঝতে পরিনি। কাউকে কিছু না বলে হঠাৎ করে বাড়িঘর ছেড়ে ঢাকার কথা বলে তুই কোলাকাতায় কেন চলে এলি? এই মিথ্যে কথা বলার কারণে মনে কতখানি আঘাত পেয়েছেন তোর বাবা, তুই কি তা জানিস?”

“সত্যি কথা বলতে কী, আমি জানি না। হাটশ হরিপুর থেকে ওই বইটা নিয়ে ফেরার পর থেকে অঘটন ঘটেই যাচ্ছে। কেন যে কী করছি সেটা আমার নিজের কাছেও পরিষ্কার না। কেন যেন মনে হয়েছে অন্য কেউ বাস করছে আমার ভেতর। যা কিছু করছি সেটা কেবল তার সিদ্ধান্তে।”

“কিন্তু কে সেই অদৃশ্য শক্তি?”

“আমি জানি না রে, ভাই।”

“তুই এক কাজ কর। আমাকে যদি না-ও নিস, তবুও যেখানে যাচ্ছিস সেই জায়গার একটা ঠিকানা অন্তত রেখে যা।”

“ঠিকানা দিয়ে কী করবি? শরৎদা যাচ্ছে আমার সাথে। ওর সাথে যোগাযোগ করলেই তো আমার খবর পাবি।”

“বুঝেছি রে, বাবা। তবুও ঠিকানাটা দিতে তোর অসুবিধে কোথায়? ভয় পাসনে, তোদের পেছন পেছন গিয়ে হাজির হবো না ওখানে।

“বেশ। লেখালেখির দরকার নেই। শুধু মনে রাখ: বহরমপুরের গোরা বাজার সার্কিট হাউস আর বাবুলবোনা রেসিডেন্সি সেমেটারি।”

“ওই সেমেটারি আবার কোথায়?”

“বহরমপুরেই। সেরিকালচার অফিসের কাছে।”

৬২

এদিকে কিসমতকে নিয়ে সোজা খিদিরপুর চলে এলো আব্দুল খান। বলল, “কিসমত। আমাকে একবালপুর লেনের মাথায় নামিয়ে দাও।”

“ওখানে কী কাজ, আব্দুল ভাই?” জিজ্ঞেস করল কিসমত।

“এই তো পুরনো এক বন্ধুর সাথে দেখা করবো।”

“তা এতদিন এলেন না যে বড়ো?”

“এতদিন বাইরে ছিলেন ভদ্রলোক। কালই ফিরেছেন।”

“এটাই বা জানলেন কী করে?”

“ফোনে কথা হয়েছে,” সাথে সাথে বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যে কথা বলল আব্দুল খান। আসল ব্যাপার হলো—সে আগেই সন্দেহ করেছে চোখে চোখে রাখা হচ্ছে তাকে আর শরৎ বাবুদের। এতদিন মেসেই ঘাপটি মেরে বসেছিল ট্যুরিস্ট গাইড। যারা নজর রাখছে তারা দেখছে মেস থেকে মোটেই বেরোয় না সে। ভাবছে, বোধহয় কোলকাতায় তার পরিচিত কেউ নেই। অতএব গাইড সাহেব ধারণা করছে তার ওপর থেকে সার্ভেল্যান্স সরিয়ে নিয়েছে ম্যাডাম জুইয়ের লোকেরা। অন্তত গাড়ি থেকে যে সে নামেনি, এইটে অন্তত খেয়াল করবে না তারা।

“একবালপুর লেনে চলে এসেছি। এটাই গলির মাথা। আরও ভেতরে গেলে বলেন।”

“ঠিক আছে সিএমআরআই হাসপাতালের কাছে নামাও। তারপর চলে যাও।”

“কিন্তু আপনি ফিরবেন কীভাবে? তার চেয়ে বরং অপেক্ষা করি এখানে। কাজ সেরে আসুন। মেসে নামিয়ে দিয়ে আসবো খন।”

ভারী ঝামেলা হলো দেখছি, বিরক্ত হয়ে বিড়বিড় করে বলল আব্দুল। এ ব্যাটা তো চীনে-জোঁকের মতো গায়ের সাথে লেপটে আছে। মুখে বলল, “না, না। কতক্ষণ লাগে তার ঠিক নেই। তুমি বরং চলেই যাও।”

হাসপাতালের সামনে নেমে এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখল আব্দুল। নাহ, কেউ বোধ হয় ফলো করছে না। পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল হাশিম গ্যালারির দিকে। হাশিম গ্যালারির প্রতিষ্ঠাতা হাশিম খান মারা গেছে দশ বছর আগে। এখন এর মালিক মঞ্জিল খান। মেয়েদেরে হ্যান্ডব্যাগ, কসমেটিক্স, ঘর সাজানোর জিনিস, চীনে মাটির বাসনপত্র, কাচের গেলাস, আল্লাহু লেখা স্যুভেনির, জায়নামাজ এসব নানান পদের জিনিস বিক্রি হয় এখানে। পুরো দোকন জুড়ে অজস্র শেলফ, উপচে পড়ছে পণ্য। পঞ্চাশ পেরুনোর পর ক্যান্সারে ধরেছিল হাশিম খানকে। রোগের চিকিৎসা করাতে গিয়ে দেদারসে টাকা খরচ হলো। মঞ্জিল খান পাড়ারই ছেলে। দশ বছর মিডল ইস্টে ছিল। মেলা ক্যাশ টাকা তার হাতে। সুদে টাকা ধার দেয়। তবে দামি জিনিস গিরবি রেখে তারপর। হাশিমের তিন মেয়ে, কোনো ছেলে নেই। কী আর করা, দোকানটা তার হাতে ছেড়ে দিলো হাশিম। অসুস্থ মানুষ। হয় হাসপাতালে, নাহয় বাসায়। দোকানে আর বসবে কখন। মঞ্জিলই বরং চালাক ওটা। যখন যা লাগে ও-ই দেবে।

দুবছর ধরে চিকিৎসার পর মারা গেল বেচারা। জানাজা পড়ানোর সময় খাটিয়ায় তোলা হাশিমের লাশ সামনে রেখে ইমাম সাহেব বললেন, “মুর্দা যদি কারও কাছে কোনো ঋণ করে থাকেন তো বলেন।

মুসল্লিদের ভিড়ের ভেতর থেকে বেরিয়ে সামনে এলো মঞ্জিল। বলল, “জনাব। মৃত ব্যক্তির কাছে আমার দুলাখ টাকা পাওনা। ওর সই করা ঋণের কাগজ আছে আমার কাছে। মুর্দা দাফন হওয়ার আগে আমার পাওনা মেটাতে হবে। ঋণ পুরো শোধ না হওয়া পর্যন্ত দাবি ছাড়বো না আমি।”

হাশিমের বিধবা বউ মর্জিনাকে পাড়ার মুরুব্বিরা তৎক্ষণাৎ জানালেন একথা। ঋণ শোধ না করলে লাশ দাফন হবে না। কিন্তু কোথায় দুলাখ টাকা! দুশো টাকাও তখন নেই মর্জিনার কাছে। টাকা নেই। বিকল্প কোনো চাহিদা থাকলে বলো। সুন্দর তিনটে আইবুড়ো মেয়ে আছে হাশিমের। চাইলে যে কোনো একটাকে বিয়ে করে ঘরে তুলতে পারো। একটাকাও খরচা লাগবে না। মঞ্জিল বলল, ওই দোকান যদি তাকে দিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে আর কোনো দাবি নেই। তবে হ্যাঁ, পরমা সুন্দর মেজ মেয়েটাকে বিবি হিসেবে গ্রহণ করতে রাজি আছে সে। অগত্য সবার মধ্যস্থতায় রাজ্যসহ রাজকন্যা হাতিয়ে নিলো সে। বিয়ের পরপরই দুবাইয়ের বুড়ো এক শেখের কাছে পাঠিয়ে দিলো দুই শ্যালিকাকে। ওই শেখ তার ব্যাবসায়িক পার্টনার।

মঞ্জিলের আসল ব্যাবসা চোরাই অ্যান্টিক। নানান জয়গায় লোক সেট করা আছে। বলা আছে ট্যুরিস্ট গাইডদেরও। এরাই আর্টিফ্যাক্ট চুরি-চামারি করে এনে তুলে দেয় তার হাতে। বিনিময়ে ভালো ক্যাশ নিয়ে বিদেয় হয়। দুবছর আগে গৌড়ের আদিনা মসজিদের মেহরাব থেকে গ্র্যানিট পাথরে খোদাই করা কুফিক হরফে লেখা আরবি ক্যালিগ্রাফি চুরি করিয়েছিল আব্দুল খান। মঞ্জিল খানের হাতে ওটা তুলে দেওয়ার পর বিশ হাজার টাকা পেয়েছিল। আরও কিছু জিনিস সরিয়ে ফেলার কথা ভেবেছিল সে, কিন্তু ওই চুরি টের পাওয়ার পর কড়া করা হয়েছে মসজিদের সিকিউরিটি। ওখানে গোপনে ঢুকে ছেনি মেরে দেওয়াল থেকে পাথরের স্ল্যাব কেটে বের করে আনা প্রায় অসম্ভব। অন্য কোথাও থেকে কিছু খসানো যায় কিনা সেই ধান্ধায় আছে আব্দুল খান। তবে মওকা মেলেনি এখনও।

এরও এক বছর আগের ঘটনা। গৌড়ের কাছে ইংরাজ বাজারে বিকেলে সেদ্ধ ডিম বিক্রি করতে আসত এক বুড়ি। আব্দুল খান প্রায়ই ডিম কিনে খেতো তার কাছ থেকে। ডিমের খোসা ভাঙার এক অদ্ভুত কায়দা ছিল বুড়ির। ডিমের সাঁজির ভেতর সাদা ধপধপে কাপড়ের টুকরো দিয়ে ঢাকা ডিমের পাশে কীসের সাথে যেন ঠুক করে বাড়ি দিতো মহিলা। ব্যস, মাঝ বরাবর ফেটে যেত ডিমের খোলা। তারপর সুতো দিয়ে মাঝখান থেকে কেটে নুনঝাল দিয়ে এক টুকরো কাগজের ওপর পরিবেশন। দিন কয়েকের মধ্যেই ব্যাপারটা নজরে এলো আব্দুল খানের। বুড়িকে সে জিজ্ঞেস করল, “বুড়িমা ভারী চমৎকার তো তোমার ডিমের খোলা ভাঙার কায়দা কীসের সাথে বাড়ি দাও ডিম। বাঁশের চটা দিয়ে বানানো সাঁজি। এর গায়ে বাড়ি দিলো তো ডিমের খোসা অত চমৎকারভাবে ফাটবে না। ঘটনা কী?”

সাঁজির ভেতর থেকে ডিমে বাড়ি দেওয়ার জিনিসটা বের করে দেখাল বুড়ি। কেঁপে উঠল আব্দুল খান। ডান হাতের তালু থেকে মাটিতে পড়ল নুনঝাল মাখা পশ্চিম গোলার্ধের মতো ডিমের টুকরো। পেতলের তৈরি পাল যুগের হাস্যোজ্জ্বল চার ইঞ্চি লম্বা একটা বৌদ্ধ মূর্তি! লাফিং বুদ্ধা! এ শুধু চীন দেশে পাওয়া যায়। এদেশের প্রায় সব বৌদ্ধ মূর্তিতে গৌতম বুদ্ধ ধ্যানমগ্ন। তাছাড়া, ধাতুর তৈরি বৌদ্ধ মূর্তি এক দুষ্প্রাপ্য জিনিস। ধাতস্থ হয়ে আব্দুল খান আবার জিজ্ঞেস করল, “এ জিনিস কোথায় পেলে, বুড়ি মা?”

বুড়ি বলল, “এ আমাদের তিন পুরুষের পিতিমে। ঠাকুরদার কাছ থেকে পেয়েছি। ওই যে লখনাবতী, ওখানে গোরা সাহেবদের কাছে জন খাটতো ঠাকুরদা। উঁচু উঁচু মাটির ঢিবি খুঁড়ত। কত জিনিস বেরুেত ওইসব ঢিবির তলা থেকে! খোঁড়ার সময় ঠাকুরদা এটা পেয়ে রেখে দেয় নিজের কাছে। এর অনেক পরে বাবা আমাকে দেয় ওটা। বলে, ‘সাবধানে এটাকে রেখো গো মা, এ বড়ো লক্ষ্মী পিতিমে।’ কী, সুন্দর না দেখতে পিতিমেটা!”

ওই দিন ডিম বেচে সন্ধের সময় একাকী বাড়ি ফিরছে বুড়ি। নির্জন পথ। কোথাও কেউ নেই। পেছন থেকে প্রচণ্ড এক ধাক্কা খেলো সে। হুড়মুড় করে পড়ে গেল মাটিতে। হাত থেকে ছিটকে গেল ডিমের সাঁজি। হেরিং বোন রাস্তার দাঁত বেরুনো ইটে ঠুকে গেল কপাল। দুচোখে আঁধার দেখল বুড়িমা। সাঁজির ভেতর থেকে পেতলের তৈরি লাফিং বুদ্ধাটা তুলে নিয়ে উলটোদিকে হাঁটা ধরল আব্দুল খান।

মঞ্জিল খানের কাছ থেকে লাফিং বুদ্ধার জন্যে পঞ্চাশ হাজার টাকা পেয়েছিল আব্দুল। তবে এঘটনার পর ইংরাজ বাজারে বুড়িমাকে আর দেখা যায়নি। মাথায় প্রচণ্ড আঘাত পেয়ে জ্ঞান হারিয়েছিল। তিন দিন পর বমি করতে করতে হাসপাতালে মারা যায় বেচারি।

কাচের শোকেসের পেছনে দুজন সেলসম্যান। কাউন্টারের কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই এগিয়ে এলো চ্যাংড়া মতোন একজন। বলল, “কী জিনিস চান, জনাব?”

“মঞ্জিল সাহেবের সাথে দেখা করতে চাই। উনাকে বলুন মালদা থেকে আব্দুল খান এসেছে।”

পেছনের দেওয়ালে লাগানো দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে গেল সেলসম্যান। কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে জানাল, “সাহেব ভেতরে আছেন। সোজা চলে যান। করিডোরের শেষ মাথায় ডান দিকের দরজা।”

প্রায় অন্ধকার নোংরা প্যাসেজ। ছাত থেকে একটা মাত্র পঁচিশ ওয়াটের ল্যাংটা বাল্ব জ্বলছে। ওতে কোনো কাজই হচ্ছে না। দুদিকেই দেওয়াল। তিন-চার জায়গায় শাটার আছে বটে, তবে সেগুলো নামানো। সম্ভবত গোডাউন হিসেবে ব্যবহার হয় ঘরগুলো। এমন নীরব করিডোর, খুন করে ফেললেও কেউ জানবে না। দরজা নক করতেই ভেতর থেকে জলদ গম্ভীর গলা ভেসে এলো, “চলে এসো।”

বড়ো একটা সেক্রেটারিয়েট টেবিলের ওপাশে গদিমেড়া চেয়ারে বসে আছে প্রায় ছফিট লম্বা তাগড়া চেহারার এক মাঝবয়েসি লোক। খাড়া নাকের নিচে পাকানো গোঁফ, মাথায় আফগান টুপি, হাতে লোহার বালা। পরনে পাকিস্তানি ছেলেদের মতো সালোয়ার কামিজ আর কুর্তা। পা দেখা যাচ্ছে না, তবে আব্দুল খান নিশ্চিত জানে পেছনে ফিতে লাগানো চামড়ার স্যান্ডেল শ্য পরে আছে মঞ্জিল খান। খান সাহেবের সরু ঠোঁটে সব সময় তাচ্ছিল্যের একটা হাসি লেগে থাকে।

“খান সাহেব, আসসালামু আলাইকুম,” দরজা ঠেলে ঢুকতে ঢুকতে বলল আব্দুল খান।

“ওলাইকুমুস সালাম।”

“তা কী মনে করে এদিকে? আমার হাতে সময় খুব কম। একটা পার্টি আসার কথা। যা বলার তাড়াতাড়ি বলো।”

“ভাই, বড়ো একটা জিনিসের খোঁজ পেয়েছি।”

“কী জিনিস?”

“পাণ্ডুলিপি, মানে ম্যানুস্ক্রিপ্ট।”

“পাণ্ডুলিপি! ও দিয়ে কী করবো! বইটইয়ের কারবার আমি করি না। ওসবের ডিমান্ড কম।”

“এ যে সে পাণ্ডুলিপি নয়, ভাই। হাজার বছরের বেশি পুরনো। তার থেকেও বড়ো কথা সাংঘাতিক কোনো ব্যাপার আছে এর ভেতর। হন্যে হয়ে খুঁজছে একদল লোক। দেদারছে টাকা খরচ করছে। ও জিনিস দামি না হয়েই যায় না।”

“খুঁজছে মানে কী? তোমার হাতে নেই ওটা?”

“জি না, ভাই।”

“তাহলে দেখেছ নিশ্চয়?”

“না, তা-ও না।’

“কোথায় আছে তা জানো?”

“এখনও নিশ্চিত নই। তবে ধারণা আছে।”

“কোন ভাষায় লেখা?”

“বলতে পারবো না।”

রাগে গরগর করতে করতে মঞ্জিল বলল, “ভাই রে আমি বেচি অ্যান্টিক। পুরনো মূর্তি, সোন-রুপের গহনা, মোগল আমলের ঢাল-সড়কি-ছুরি-চাকু-তলোয়ার, বহু যুগ আগের কয়েন— এইসব। ক্লায়েন্টরা সবাই দুবাই, কাতারের শেখ। এদের কাছে বই, পাণ্ডুলিপি, পুঁথি—এ ধরনের জিনিস কোনোদিন বেচিনি। কিনবে কি না, তা-ও জানি না। কীসের পাণ্ডুলিপি, কোথায় আছে, কী ভাষায় লেখা তার কোনোটাই জানা নেই তোমার। তুমি আমার কাছে এসেছ কেন তাহলে?”

“বলছি কী, এ ধরনের একটা মূল্যবান জিনিস পাওয়া গেলে বিক্রি করা যাবে কি না? আর বিক্রি করলে কত দাম পাওয়া যাবে?”

“তার আগে বলো ওটা তোমার হেফাজতে আসবে কি না? তোমার কথা শুনে বুঝতে পারছি একদল লোক এরই ভেতর লেগে গেছে ওটার পেছনে। ওই জিনিস খুঁজে পেলে তারা তো আর এমনি এমনি তোমার হাতে তুলে দেবে না।”

“এমনিতে তো আর আসবে না। এদিক-সেদিক করে সংগ্রহ করতে হবে।”

“একাই পরবে, না সাথে লোক লাগবে?”

“প্রথমে একাই চেষ্টা করবো। যদি না পারি, তাহলে লোক হলে ভালো।”

“ঠিক আছে। কবে কোথায় লোক লাগবে আমাকে জানিও। রহমান আর গুঙ্গা বসেই আছে। ওদের পাঠিয়ে দেবো। এখন যাও। পার্টি এসে যাবে যেকোনো মুহূর্তে।”

হাশিম গ্যালারি থেকে বেরিয়ে এসে ট্যাক্সি ভাড়া করল আব্দুল খান। রওনা হলো মেসের দিকে। ভেতর ভেতর সন্তুষ্টি বোধ করছে। চোরাই মার্কেটে ওই পাণ্ডুলিপির দাম কম করে হলেও এক মিলিয়ন ডলার হবে। একবার যদি হাতানো যায়, তাহলে আর দেখতে হবে না। ট্যুরিস্ট গাইড হয়ে সারাজীবন কাটানো আব্দুল খানের মতো ধুরন্ধর লোকের পক্ষে অসম্ভব। গাড়ির জানালার ভেতর দিয়ে বামে তাকাল আব্দুল খান। দেখল সিআইআরএম হাসপাতালের গেটের সামনের ফুটপাথ দিয়ে কালো রঙের টি-শার্ট আর প্যান্টপরা এক চীনেম্যান হেঁটে যাচ্ছে। খুবই সাধারণ দৃশ্য। গা করল না ট্যুরিস্ট গাইড। একটু আগে তাকালে দেখত: তার দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে ওই চীনেম্যান।

.

বিকেলের দিকে খড়ের চটির কাছ থেকে ফোন পেল ম্যাডাম জুই।

“জুই গুওলিয়ং।”

“আজ্ঞে, হ্যাঁ, মাননীয় জনাব।”

“খিদিরপুরে একজনের সাথে দেখা করেছে মালদার ট্যুরিস্ট গাইড। নাম মঞ্জিল খান। চোরাই অ্যান্টিকের ব্যাবসা করে। আমরা ধারণা করছি এই গাইড আর্টিফ্যাক্ট সম্পর্কে জেনে ফেলেছে। অথচ আপনি আমাদের নিশ্চিত করেছিলেন সে এসবের কিছুই জানে না।”

“গুয়ানয়ের নামে শপথ নিয়ে বলছি মাননীয় চার তিন দুই, ওকে তেমন কিছুই বলা হয়নি। সম্ভবত নিজ থেকেই অনেক কিছু ভেবে নিয়েছে সে।”

“আপনি তো জানেন গোপনীয়তা রক্ষা আমাদের মূলমন্ত্রগুলোর একটা। এই লোক মঞ্জিল খানকে কী বলেছে জানতে হবে আমাদের। আপনার কী মনে হয়?”

“আমার ধারণা পাণ্ডুলিপি খুঁজে পাওয়া গেলে এই ট্যুরিস্ট গাইড আমাদের কাছ থেকে ওটা চুরি করতে অথবা ছিনিয়ে নিতে চেষ্টা করবে। তারপর তুলে দেবে মঞ্জিল খানের হাতে। বিনিময়ে মোটা টাকা দাবি করবে। সম্ভবত এই বিষয় নিয়েই আলোচনা হয়েছে।”

“হুম। মঞ্জিল খানকে আজই নিউট্রালাইজ করা হবে। কোনো ঝুঁকি নিতে চাই না আমরা। কিন্তু গাইডকে নিয়ে কী করা?”

“আর কটা দিন সময় দিন, মাননীয় জনাব।”

“ঠিক আছে। অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা। বুঝতে পেরেছেন?”

“আজ্ঞে, হ্যাঁ, মাননীয় জনাব।”

“ধন্যবাদ।”

ক্লিক করে কেটে গেল লাইন। ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল ম্যাডাম জুইয়ের। রাগে গা কাঁপতে লাগল তার।

নেমকহারাম আব্দুল খান, তোর উচিত শিক্ষা আমি দেবো! গুয়ানের শপথ, মনেমনে বলল চীনে সাইকিক।

৬৩

ওই দিনই রাত আটটার দিকে হাশিম গ্যালারি বন্ধ হওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে কালো মাফলারে মুখ ঢেকে দুজন লোক ঢুকল দোকানে। একজন ঢ্যাঙা আরেকজন বেঁটে। হাতে প্রায় এক কেজি ওজনের চায়না মেড টাইপ ফিফটিফোর টোয়েন্টিফাইভ এমএম নরিনকো ব্ল্যাক স্টার পিস্তল। দোকানে ঢুকেই ঝটপট ভেতর থেকে কাচের দরজার লক লাগিয়ে দিলো বেঁটে। তারপর ক্লোজড লেখা সাইনটা ঝোলাল। চোয়াড়ে চেহারার একজন মাত্র সেলসম্যান। বছর পঁচিশ বয়স। হাঁ করে দাঁড়িয়ে তাদের কাণ্ড দেখছে। তার মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে ঢ্যাঙা বলল, “কোনো কথা নয়। সোজা মঞ্জিল খানের কামরায় চল।”

ব্ল্যাক লেবেল, বরফ, আর সোডা সামনে নিয়ে বসেছিল খান সাহেব। বিকেল থেকেই মেজাজ খারাপ হয়ে আছে। অনেক ঝামেলা করে মোগল দরবারের একটা গোলাপ জলদানি সংগ্রহ করেছিল। সম্পূর্ণ রুপোর তৈরি গোলাপ জলদানিটার গায়ে জটিল কারুকাজের ভেতর ল্যাপিস লাজুলি আর পান্না বসানো। দুর্দান্ত জিনিস। মিডল ইস্টে এর বিরাট চাহিদা। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, হায়দ্রাবাদ থেকে কোলকাতায় আনার পথে শিয়ালদাহ স্টেশনে পুলিশের হাতে ধরা খেয়েছে এজেন্ট। এ লাইনে শত্রুর অভাবে নেই। কেউ একজন আগেই ইনফর্ম করে রেখেছিল তাদের। দরজায় টোকা পড়তেই বলল, “এখন বিরক্ত করিস না। দোকান বন্ধ করে বাড়ি যা।”

একথা শোনার সাথেসাথে সেলসম্যানের নিতম্বে প্রচণ্ড জোরে লাথি দিলো ঢ্যাঙা। দড়াম করে দরজায় বাড়ি খেয়ে হুড়মুড় করে ভেতর ঢুকল সেলসম্যান। উপুড় হয়ে পড়ল সেক্রেটারিয়েট টেবিলের সামনে মেঝের ওপর। কাণ্ড দেখে হতভম্ব হয়ে গেল খান সাহেব। চেয়ারের হাতলে দুই হাত রেখে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল সামনে। সেলসম্যানের পেছন পেছন ভেতরে ঢুকল ঢ্যাঙা আর বেঁটে। পেছনের জন লাথি মেরে বন্ধ করে দিল দরজা। এক মুহূর্তও দেরি না করে মঞ্জিল খানের বাঁ হাতের কবজি বরাবর গুলি করল ঢ্যাঙা। ডান হাত দিয়ে গুঁড়ো হয়ে যাওয়া কবজি চেপে ধরে ষাঁড়ের মতো চ্যাঁচাতে লাগল চোরাই অ্যান্টিক কারবারী। এবার তার মাথায় পিস্তলের নল ঠেকিয়ে চাপা গলায় ঢ্যাঙা বলল, “একদম চুপ। যা জিজ্ঞেস করবো ঠিকঠাক বলবি। আব্দুল খান তোর কাছে কেন এসেছিল?”

“কোন আব্দুল খান? মালদার ট্যুরিস্ট গাইড?”

“হ্যাঁ।”

“কোনো এক পুরনো পাণ্ডুলিপির নাকি খোঁজ পাওয়া গেছে। খুব দামি আর দুষ্প্রাপ্য। ওটা বেচার কথা বলছিল।”

“আর কী বলেছে?”

“ওটা এখনও হাতে পায়নি সে। যারা খুঁজছে তারা যদি পায়, তাহলে পাণ্ডুলিপিটা তাদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেওয়ার জন্যে লোক চেয়েছে।”

“যারা খুঁজছে তাদের নাম বলেছে?”

“না।”

“হুম। একথা আর কাউকে বলেছিস?”

“আজই দুপুরের দিকে এসেছিল ওই ব্যাটা। ও চলে যাওয়ার পর এ নিয়ে কারও সাথে কথা বলার সুযোগই পাইনি। তিনটের দিকে বাড়ি গিয়ে লাঞ্চ করে বিছানায় গড়িয়ে নিচ্ছি, এমন সময় ফোন পেলাম। লফড়া হয়েছে। তড়িঘড়ি দোকানে এসে সেই যে বসেছি একবারও বেরুইনি। শুধু ফোনে কথা বলেছি।”

“কী লফড়া?”

“চোরাই অ্যান্টিক সিজ হয়েছে।”

“কোথায়?”

“শেয়ালদা স্টেশনে,” হাত চেপে ধরে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে কোনোরকমে বলল মঞ্জিল খান। রক্তের সোঁত বয়ে যাচ্ছে গুলি খাওয়া কবজি থেকে। হারিয়ে যাচ্ছে মহামূল্যবান সময়। এভাবে রক্তক্ষরণ হতে থাকলে ফেঁসে যাবে খুব তাড়াতাড়ি।

যা জানার তা জানা হয়ে গেছে। খান সাহেবের মাথায় ঠেকানো পিস্তলের ট্রিগার টিপে দিলো ঢ্যাঙা। চারশো বিশ মাজল ভেলোসিটি বুলেটের আঘাতে উড়ে গেল রক্তের ছিটেসহ দুইঞ্চি সাইজের খুলির টুকরো। ওদিকে মেঝেতে উপুড় হয়ে পড়ে থাকা সেলসম্যানের ঘাড়ে পা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বেঁটে আততায়ী। পা উঠিয়ে কলার ধরে টেনে মেঝের ওপর তাকে দাঁড় করাল সে। বলল, “এখান থেকে বের হয়ে দোকান বন্ধ করে সোজা বাড়ি চলে যাবি। কী ঘটেছে কিচ্ছু জানিস না তুই। যদি ভুলেও মুখ খুলিস, তাহলে জানে বাঁচবি না। বোঝা গেছে?”

“আজ্ঞে, হ্যাঁ, হুজুর,” হাউমাউ করে কাঁদতে না পেরে হেঁচকি তুলতে তুলতে কোনো রকমে বলল সেলসম্যান।

“এখন নে হাত লাগা। ভেতর থেকে চটের বস্তা নিয়ে আয়। লাশ তুলে বস্তায় ভরতে হবে। তারপর এ ঘর সাফ-সুতরো করতে হবে। তুই নিজে দাঁড়িয়ে থেকে গাড়িতে লাশ তুলে দিবি। কেউ যদি জিজ্ঞেস করে, ‘বলবি দোকান থেকে মাল ডেলিভারি হচ্ছে।’ আর হ্যাঁ, কাল সকালে আবার দোকানে আসবি। ভাব দেখাবি যেন কিছুই হয়নি। যদি চাকরি ছেড়ে চলে যেতে চাস, সাত দিন পর যাবি। আরেকটা কথা, ওর বাড়ি থেকে যদি খোঁজ করে, বলবি— মালিক জরুরি কাজে দিল্লি গেছে। সাত দিন পর ফিরবে। ঠিক আছে?”

“আজ্ঞে, ঠিক আছে স্যার।”

“হুম। এখন যা, বস্তা নিয়ে আয়।”

.

রাত নটার দিকে ফোন পেল ম্যাডাম জুই। ফোন করেছে হং কোয়ান বা লাল খাম্বা। এ লোক ফাইটারদের প্রধান। লাল খাম্বা বলল, “চার দুই ছয় বলছি। অ্যান্টিক চোরাকারবারিকে নিউট্রালাইজ করা হয়েছে। যতদূর বোঝা গেছে, এখনও চাউর হয়নি পাণ্ডুলিপির খবর। বাকি রইল কেবল ওই ট্যুরিস্ট গাইড। ওর বিষয়ে আপনার সিদ্ধান্ত কী?”

“ওটা আমার ওপর ছেড়ে দিন, শ্রদ্ধেয় জনাব। ওই বিশ্বাসঘাতকের ব্যবস্থা আমি নিজে করবো।”

“আপনি শিয়োর?”

“অবশ্যই।”

“বেশ।”

ক্লিক করে কেটে গেল লাইন। ভুস করে চেপে রাখা দম ছাড়লো ম্যাডাম জুই। তিরতির করে ডান গালটা কাঁপছে তার।

৬৪

পরদিন দুপুরের পর বহরমপুর গোরা বাজার সার্কিট হাউসে পৌঁছলেন শরৎ বাবুরা। এইবার আব্দুল খানও উঠল ওখানে। সন্ধের পর হলরুমে চা খেতেখেতে আলোচনায় বসল সবাই।

“আমাদের প্ল্যান অভ অ্যাকশন ঠিক করে নেওয়া দরকার, মুখ খুলল ম্যাডাম জুই। “কারও কোনো মত থাকলে বলতে পারেন। বেশ, আপনিই বলুন প্রথমে,” আব্দুল খানকে হাত তুলতে দেখে বলল ম্যাডাম।

“আমার প্রথম প্রস্তাব, এই জাগা থেকে সরে যেতে হবে আমাদের। সার্কিট হাউস থেকে ওই সেমেটারি প্রায় চার কিলো দূরে। এ কাজে গোরস্থানে কতবার যেতে হবে—কারও জানা নেই। এখান থেকে ঘনঘন যাতায়াত করলে সন্দেহ করবে লোকে। আগেও ওখানে ঘোরাঘুরি করেছি আমরা। স্থানীয় লোকেরা দেখেছে আমাদের। স্পট যদি ওয়াকিং ডিসট্যান্সে হয়, তাহলে সবথেকে ভালো। রাতদিন, বাজে ওয়েদার—এইসব কোনো ব্যাপার না। তাই বলছিলাম কী, সেরিকালচার অফিসের আশপাশে কোনো বাসা ভাড়া নিয়ে আপাতত ওঠা যাক। তারপর ধীরে- -সুস্থে অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা। কী বলেন আপনারা?”

খানের প্রস্তাব শুনে মনেমনে হাসল ম্যাডাম জুই। এ ছেলে নিজের পছন্দমতো জায়গায় নিতে চাইছে তাদের, যাতে পাণ্ডুলিপি পাওয়া গেলে সেটা সরিয়ে ফেলতে সুবিধে হয়। এ বেচারা এখনও জানে না—গত রাতেই ফৌত হয়ে গেছে তার পেয়ারের মঞ্জিল ভাই। মুখে বলল, “বেশ তো, আপনারা যদি সবাই বলেন তো আমরা ওদিকেই বাসা নেবো। কিন্তু তেমন বাসা পেতেও তো হবে। তাছাড়া ফার্নিচার, খাওয়া-দাওয়া এসবেরও ব্যাপার আছে। আপনার কী মত, শরৎ বাবু?”

“আমি বলি কী, আশপাশে খালি বাসা যদি পাওয়া যায় নেওয়া যেতে পারে। সকালে ওখানে চলে গেলাম, বিকেলে ফিরে এলাম সার্কিট হাউসে। দুপুরের খাবার বাইরে থেকে কিনে খেলেই হলো। প্রয়োজন হলে রাতেও ওখানে থাকা যাবে। কিন্তু বাসাটা খুঁজবে কে? আর খুঁজে পেলেও বা কী, আমাদের কি তারা ভাড়া দেবে? কেউ তো আমাদের চেনে না এখানে।”

“ওসব আমার ওপর ছেড়ে দেন। খালি কালকের দিনটা সময় দিন আমাকে।”

“বেশ তো, নিন কালকের দিন। সকালে আমরা বাবুলবোনা যাবো। দীনবন্ধু বালুঘড়ির ওপর ডেঞ্জার সাইন খোদাইকরা কবরটা দেখিয়ে দেবে আমাদের। তারপর তো তেমন কোনো কাজ নেই। ঠিক না?”

.

পরদিন সকাল নটায় দীবন্ধুকে সাথে নিয়ে রেসিডেন্সি সেমেটারিতে পৌঁছাল সবাই। মূল রাস্তা ধরে এগিয়ে গিয়ে পঞ্চাশটা কবর পেরুলে ডানে-বাঁয়ে বাই লেন। ডানের বাইলেন ধরে বিশ গজ এগুলে চার ফিট উঁচু একটা টেবলটপ কবর। ওটার পর চারকোনা পেডেস্টালের ওপর ইজিপশিয়ান অবিলিস্কঅলা আরেকটা সমাধি পেরিয়ে গোলাকার কস্ক্রিটের মেঝের ওপর প্রায় পনেরো ফিট উঁচু তিনকোনা প্লাস্টার করা স্ট্রাকচার। স্ট্রাকচারের ওপর একটা নিখুঁত ডোম বা গম্বুজ। ডোমটা দাঁড়িয়ে আছে তিনটে খিলানের ওপর। খিলানগুলো ভর করে আছে ওগুলোর দুপাশে অর্থাৎ ত্রিভুজের তিনকোনে একজোড়া করে ছয়টা করিন্থিয়ান পিলারের ওপর। স্তম্ভগুলোর পেছনদিক অর্থাৎ সমধির দিকে মুখ করা অংশ বৃত্তচাপের মতো দেওয়াল দিয়ে ঢাকা। ভেতর থেকে পিলার চোখে পড়ে না। এতে গোলাকার ঘরের মতো দেখতে লাগে ভেতরটা। ডোমের ঠিক নিচে পেল্লায় কাস্তের মতো বাঁকা কার্নিশ। এই কার্নিশের তিন মাথা দাঁড়িয়ে আছে দেওয়ালে ঢাকা দুজোড়া করে ছয়টা পিলারের ওপর। ডোমের নিচে মেঝের ওপর কফিন আকৃতির সমাধি। কফিনের ঠিক মাথার কাছে পেন্টাগ্রামের ভেতর সিমেন্টে তৈরি বালুঘড়ির ওপর গুণচিহ্নের মতো দুটি আড়াআড়ি হাড়, তার ওপর করোটি—যাকে লোকে বলে ডেঞ্জার সাইন। সমাধিটা রয়েছে একটা কৌণিক ক্ষেত্রের ভেতর। সৌধটা দেখিয়ে দিয়ে দীনবন্ধু বলল, “এই যে দেখছেন। এই হলো সেই কবর। ও যে কফিনের মাথার কাছে সিমেন্ট দিয়ে বানানো চিহ্ন, ওটা খেয়াল করুন। তুদিগংয়ের মন্দিরে বেদির ওপর যেটা দেখেছি, হুবহু সেই জিনিস। ঠিক কি না?” ম্যাডাম জুইয়ের দিকে তাকিয়ে কথাটা বলল সে।

অবাক হয়ে বেশ খানিক্ষণ অদ্ভুত সমাধিটার দিকে তাকিয়ে রইল সবাই। বসন্তের সকাল। ঝকঝকে আকাশ, সোনালি রোদ। হু হু বাতাস বইছে। ঘেসো জমিনে লুটোপুটি খাচ্ছে ঝরে পড়া শুকনো পাতা। নীরব, নিস্তব্ধ, শুনশান চারিদিক। দুশো বছরের পুরনো এত বড়ো সমাধিক্ষেত্রে এই চারজন ছাড়া আর কেউ নেই।

“এত দৌড়াদৌড়ি করে শেষ গন্তব্য তাহলে এই?” নীরবতা ভেঙে মন্তব্য করলেন শরৎ বাবু

“আপনার ইন্টুইশন কি সে কথাই বলে?” জিজ্ঞেস করল ম্যাডাম জুই।

“এখানে কিছু একটা আছে। আপনার কী ধারণা? আপনি জোত্যিষী না হলেও, সাইকিক তো বটে।”

“আমারও সেই রকমই ধারণা। আপনাদের কাউকে আগে বলিনি। এখন বলছি, টংয়ের কবরে কিম্বা তুদিগংয়ের মন্দিরে যখন যাই, তখন আপনাদের কাছ থেকে পাওয়া শাহনামা সাথে নিয়ে গিয়েছিলাম আমি। ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শোনা যায় কি না, পরীক্ষা করে দেখার জন্যে। কিন্তু তেমন কিছু ঘটেনি। অথচ এখানে এলে কান ঝালাপালা হয়ে যায় আমার, যদি ও বই থাকে আমার সাথে। এ জায়গাটার সাথে শাহনামার কোনো না কোনো সংযোগ আছে।”

“একথা আগেও একবার বলেছেন। কিন্তু হেনরির কবর খুঁড়ে মেলেনি কিছুই।”

“ভুল জায়গায় খুঁজেছি আমরা।”

“সে নাহয় বুঝলাম, কিন্তু এখন কী করা?” জিজ্ঞেস করল আব্দুল খান।

“খুঁড়তে হবে এ কবর,” উত্তর দিলো দীনবন্ধু।

“যে রকম হেভি কংক্রিটের সমাধি, কাজটা সহজ হবে না মোটেও।”

“কংক্রিটে হাত দেওয়া যাবে না। সাইড থেকে মাটি খুঁড়ে এগুতে হবে,” বললেন শরৎ বাবু। “এর ভালো দিক হলো এই সমাধির তিন পাশে যথেষ্ট ঘেসো জমি রয়েছে। কাছাকাছি অন্য সমাধি থাকলে খোঁড়া মুশকিল হতো। তারপরেও বিষয় কী জানেন? এক রাতের ভেতর খোঁড়াখুঁড়ি করে আবার আগের মতো মাটি-চুটি বুজিয়ে রাখা আদৌ সম্ভব কি না!” পাকা গোরখুঁড়ের মতো মতামত দিলেন শরৎ বাবু।

প্রফেশনাল লোক লাগালে অবশ্যই সম্ভব। যদি অনুমতি দেন, আমি নিজে সুপারভাইজ করতে রাজি আছি,” ভেসে এলো আব্দুল খানয়ের উত্তেজিত কণ্ঠস্বর।

“আপনি সুপারভাইজ করতে চান?” মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করল ম্যাডাম জুই।

“আজ্ঞে, হ্যাঁ।”

“বেশ তো করবেন। এ আর এমন কী? তাহলে আজকের মতো বিদেয় হই আমরা।

সেমেটারির গেটের কাছে এসে গাড়িতে উঠল সবাই, উঠল না শুধু আব্দুল খান। বলল, “আপনারা সার্কিট হাউসে চলে যান। আমি এই এলাকায় বাসা দেখে, ঠিকঠাক করে, তারপর ফিরবো। বিকেলের দিকে দেখা হবে। কেমন তো?”

“ঠিক আছে। আপনি আপনার কাজ শেষ করে আসুন তাহলে,” বলল ম্যাডমা জুই।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন