পরদিন সকাল দশটায় ম্যাডাম জুইয়ের সাইকিক সেন্টারের সামনে শরৎ বাবু আর দীনবন্ধুকে রেখে চলে গেল চ্যাং। ভেতরে ঢুকতেই তাদের চোখে পড়ল পাম-রিডিং টেবিলের পাশে সোফায় বসে আছে ম্যাডাম জুই। মাথায় সাদা পাথর বসানো লাল রঙের রুমাল পেঁচানো, পরনে বারগান্ডি কালারের চিওঙসাম যাকে সোজা কথায় বলে ম্যান্ডারিন গাওন। গলায় মুক্তোর মালা। এমনিতেই ধপধপে ফর্সা, তার ওপর হালকা মেকাপ আর লাল রঙের লিপস্টিকে ভারী সুন্দর দেখাচ্ছে তাকে। ম্যাডাম জুই বলল, “আসুন, আসুন। বসুন ওই সোফাটায়।” এরপর সামনের টেবিলে রাখা টি পট থেকে ছোটো ছোটো তিনটে কাপে চা ঢেলে দুকাপ এগিয়ে দিলো দুজনের দিকে। “নিন, চা খান। আশা করি ভালো লাগবে।”
চায়ে চুমুক দিয়ে কথা শুরু করলেন শরৎ বাবু। বললেন, “জুই ম্যাডাম, হয়তো এরই ভেতর জেনেছেন, দীনবন্ধু আর আমি একটা টিম। একটা পুরনো পাণ্ডুলিপি খোঁজার দায়িত্ব পড়েছে আমাদের ওপর। ওটার নাম আল আযিফ, লেখক আব্দুল আল হযরত। ১৮২৫ সালে এই কোলকাতা থেকে শাহনামা ছাপা হয়েছিল। ওই শাহনামার ভেতরে শেষের দিকে আল আযিফের ছোটো একটা অধ্যায় ছাপা হয়। ওই বই প্রথমে খুঁজে পায় দীনবন্ধু। তারপর আসে আমার হাতে, শেষমেশ ওটা এখন যে প্রতিষ্ঠানের হয়ে আমরা কাজ করছি তার অধিকারীদের জিম্মায়। তবে ওটা মূল বইয়ের একটা খণ্ড মাত্র। আমরা খুঁজছি পুরো পাণ্ডুলিপিটা। যতদূর বুঝতে পেরেছি আল হযরত ওটা লেখার পর খণ্ডে খণ্ডে ভাগ হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে এখানে-সেখানে। একেক খণ্ড গেছে একেক জনের কাছে। আমি জানতে পেরেছি, আজ থেকে দুশো বছর আগে এই কোলকাতাতেই টং নামের একজন এই পাণ্ডুলিপির কথা জানতে পারে। অনেক কাঠ-খড় পুড়িয়ে ওটা বা ওগুলো সে যোগাড়ও করে ফেলেছিল প্রায়। কিন্তু বিধি বাম। যাদের কাছে ছিল ওই জিনিস, হঠাৎ করেই ফউত হয়ে যায় তারা।”
বাঁ-হাত উঁচু করে তাকে থামাল ম্যাডাম জুই। বলল, “ওসব আমার জানা আছে। ওটা কীভাবে খুঁজে বের করবেন সেইটে বলেন।”
“ওখানেই আসছি। তবে তার আগে কিছু বিষয়ে আমার ধারণা পরিষ্কার হতে হবে। যেহেতু টংয়ের বর্ণনা কেবল আপনিই জানেন, সেহেতু প্রশ্নগুলো আপনাকেই করি। জানা থাকলে সঠিক উত্তর দেবেন। জর্জ টমাস আর হেনরি ক্রাইটন এই দুই ভাগ্যান্বেষী ইংরেজের সাথেই টংয়ের খাতির ছিল। একথা কি ঠিক?”
“ঠিক।”
“এই দুজনের কাজের জায়গা ছিল আলাদা আলাদা। দুজনের কাছেই কি আল আযিফের পাণ্ডুলিপি ছিল?”
“আজ্ঞে, হ্যাঁ।”
“ভিন্ন ভিন্ন?”
“যতদূর বোঝা গেছে বিষয়টা সেরকমই।”
“তাহলে দেখা যাচ্ছে পাণ্ডুলিপির মোট খণ্ড তিনটে। একটা শাহনামার ভেতর, আরেকটা জর্জ টমাসের কাছে ছিল, আর তৃতীয়টা পেয়েছিল হেনরি ক্রাইটন। টমাস আর হেনরির কাছের পাণ্ডুলিপিগুলো নিয়ে একসাথে করতে চেয়েছিল টং। তাই তো?”
“তা-ই।”
“টং চাইল আর অমনি তাকে দুজন পয়সাঅলা দুদে ইংরেজ তাদের অমূল্য সম্পদ দিয়ে দিলো, ব্যাপারটা অদ্ভুত নয় কি?”
“টং তাদের কাছে শুধু দেখতে চেয়েছিল। হয়তো কেনার প্রস্তাব দিতো। তবে তারা যে ওতে রাজি হতো না, সেটা নিশ্চিত।”
“তাহলে ওগুলো হাতে পাওয়ার ব্যাপারে টংয়ের পরিকল্পনা কী ছিল?”
“টংয়ের পরিকল্পনা ছিল ওগুলো তাদের কাছ থেকে চুরি করা। সেটা না করতে পারলে, খুন করা।”
“কিন্তু সেটা সম্ভব হয়নি কারণ টং-কে পাণ্ডুলিপি দেখানোর আগেই নৌকো করে কলকাতায় আসার পথে বহরমপুরে মারা পড়ে জর্জ। জর্জের অন্তিম সৎকার করেছিল টমাসের পুরনো দোস্ত হেনরি ক্রাইটন। দাফনের পর তার সাথে মাল-সামান যা কিছু ছিল সেসব পড়ে ক্রাইটনের হাতে। ধরে নেওয়া যায় পাণ্ডুলিপিটাও পায় সে। অর্থাৎ দুটো আলাদা আলাদা খণ্ড এসে পড়ল ক্রাইটনের হাতে। এ পর্যন্ত কি কাহিনি ঠিক আছে?”
“ঠিক আছে।”
“গুড। এখন প্রশ্ন হলো ক্রাইটনের কাছে যে দুটো পাণ্ডুলিপিই আছে, সেটা কি টং জানতে পেরেছিল?”
“আজ্ঞে, হ্যাঁ।”
“কীভাবে?”
“শেষবার কোলকাতায় আসার সময় জর্জ যে পাণ্ডুলিপি সাথে করে নিয়ে রওনা হয়েছে, সেকথা টংকে আগেই জানিয়েছিল জর্জ। জর্জ মারা যাওয়ার পর বহরমপুরে গিয়ে হাজির হয় টং। হেনরি ক্রইটনের কাছে গিয়ে ব্যাপক সমবেদনা জানায়, বিস্তর কান্নাকাটিও করে। হেনরির সাথে আগে থেকেই পরিচয় ছিল টংয়ের। জানায় তার কাছে জর্জের মেলা দেনা রয়েছে। তবে সেসব মাফ করে দিয়েছে এখন। একথা সেকথার পর পাণ্ডুলিপির প্রসঙ্গ তোলে সে। বলে খুবই নাকি দুষ্প্রাপ্য জিনিস। জর্জ তাকে দেখাতে চেয়েছিল ওটা। টং আশা করেছিল এ ব্যাপারে কিছু একটা বলবে হেনরি। কিন্তু না, একেবারে মুখ বুজে থাকল সে। টং দেখল গভীর জলের মাছ এই হেনরি ক্রাইটন। জর্জের মতো উড়নচণ্ডী, ক্ষেপান্যালা নয় মোটেও। সিদ্ধান্ত নিলো ধৈর্য ধরে খেলিয়ে তুলতে হবে একে। চাপাচাটি না করে, অছিপুরে ফিরে এলো টং। ঘনঘন দাওয়াত দিতে লাগল ক্রাইটনকে। মালদায় পাঠাতে লাগল ডজনকে ডজন রামের বোতল। কিন্তু অতি ঘোড়েল জিনিস এই হেনরি। দাওয়াত খায়, বোতল বোতল রাম খায়, কিন্তু কাজের কথা পাড়ে না। টংয়ের ধৈর্য অসীম। চার দিয়ে টোপ ফেলে বসে আছে তো আছেই। এক সময় না এক সময় ঠোকর দেবেই মাছ।
“শেষমেশ ভাগ্যের শিকে ছিঁড়ল একদিন। বউ আর তিন বাচ্চা ছাড়া হেনরির একমাত্র আত্মীয় বলতে ছিল এক পিসি। ছোটো বেলা থেকে ওই পিসিই কোলেপিঠে করে মানুষ করেছে তাকে। সুদূর স্কটল্যান্ড থেকে তাকে মালদায় নিয়ে এসে নিজের কাছে রেখেছে হেনরি। বাচ্চাদের পড়ায়, দেখাশুনো করে, সঙ্গ দেয় তার বউকে। সেকালে ইংরেজ বউদের বড়ো কষ্ট ছিল। কথা বলার মানুষ ছিল না তাদের। স্বামীরা ব্যস্ত থাকত কাজে, বউরা সারাদিন বসে থাকত বাড়িতে। তো বুড়ো বয়সে রিউমাটয়েড আর্থরাইটিসে ধরল পিসিকে। হাতে-পায়ে খিল ধরে যায়, প্রচণ্ড ব্যথা। ঠিকমত আঙুল অব্দি নাড়াতে পারে না। কোলকাতায় এনে অনেক চিকিৎসা করাল হেনরি। কিছুদিন ভালো থাকে, তারপর আবার যে কে সেই। টংয়ের কানে গেল কথাটা। হেনরিকে টং বোঝাল তার কাছে তিন হাজার বছর আগে আবিষ্কার হওয়া ওয়াংবাই ইলেকচুয়ারি বলে এক ধন্বন্তরি চীনে ওষুধ আছে। সেই সঙ্গে চল্লিশ বছরের অভিজ্ঞ আকুপাংচার করার লোক। একবার যদি বিশ্বাস করে তার ওপর পিসির চিকিৎসার ভার দেওয়া হয়, তাহলে সেই বিশ্বাসের মর্যাদা সে রাখবে। রাখলও। আগের চেয়ে অনেকটাই সুস্থ হয়ে উঠল ফুপু।
“এ ঘটনার দুসপ্তাহ পর আবারও হেনরিকে অছিপুরে দাওয়াত দিলো টং। পান-ভোজনের পর ফের পাণ্ডুলিপির কথা তুললো। এবার আর গাঁইগুঁই করল না হেনরি। সোজা-সাপটা উত্তর দিলো। বলল, ‘দুখণ্ড পাণ্ডুলিপিই আছে আমার কাছে। বহু পুরনো আমলের গোপন বিদ্যে লেখা ওগুলোতে। কীভাবে অভিচারক্রিয়া করে অন্য ভুবনের আতিপ্রাকৃত সত্তাকে ডেকে এনে উদ্দেশ্য হাসিল করা যায় সেসব বিষয়ের বর্ণনা লেখা। আরবি জানি না আমি। কিন্তু তাতে সমস্যা হয়নি। ওই পাণ্ডুলিপির কিছু কিছু লেখা মালদার সুলতানগঞ্জের মুফতি সাহেবকে দেখিয়েছি। এ মতামত তারই। এ কোনো ভালো বই না। তবে বাজে লোকের হাতে পড়লে সর্বনাশ ঘটতে সময় লাগবে না। ওটা নিয়ে আরও কাজ করার ইচ্ছে আছে আমার। মালদা জামে মসজিদের ইমামের কাছে গত ছমাস ধরে আরবি শিখছি। আর ছমাস শিখলেই সড়গড় হয়ে যাবে ভাষাটা। তখন নিজে থেকে পড়েই বুঝতে পারবো কী লেখা আছে পাণ্ডুলিপিতে।’
“একথা শুনে টং বলল, ‘আপনাকে আগেও বলেছি, এখনও বলছি জর্জ টমাস তার কাছে যে খণ্ডটা ছিল সেইটে দেখাতে চেয়েছিল আমাকে। ওই ইচ্ছে এখনও পূরণ হতে পারে, যদি আপনি আন্তরিক আর দয়াশীল হন।’
‘“আমি বুঝতে পারছি না ওই জিনিস দেখার জন্যে আপনি এত মরিয়া হয়ে উঠেছেন কেন? ওটা একটা পার্চমেন্ট কাগজে লেখা হলদে হয়ে যাওয়া বহু পুরনো পাণ্ডুলিপি। এমন বস্তু নানান দেশের মিউজিয়ামে হরহামেশা দেখতে পাওয়া যায়। তাছাড়া, আপনি আরবি জানেন বলেও মনে হয় না। শুধু শুধু চোখের দেখা দেখে কী লাভ?’
‘“লাভ লোকসানের হিসেব করে সব সময় কি সবকিছু হয়, ক্রাইটন সাহেব? অদ্ভুত সব শখ থাকে মানুষের। ওগুলোকে বলে হবি। যতটুকু বুঝতে পেরেছি দুনিয়ায় ওই পাণ্ডুলিপি শুধু এক কপিই আছে। অমন বই ভবিষ্যতে আর কোনোদিন লেখা হবে না। আজ যদি জর্জ বেঁচে থাকত, তাহলে নিশ্চয় দেখাত। যাহোক আপনার ইচ্ছে। দেখাতে চাইলে দেখাবেন, না চাইলে নেই। তবে একটা জিনিস জানতে চাই। আপনার কাছে যে পাণ্ডুলিপিটা আছে ওটা পেলেন কীভাবে?’
‘“সে এক লম্বা কাহিনি। শোনার ধৈর্য কি হবে আপনার?’
‘“অবশ্যই হবে। রামে চুমুক দিয়ে কাহিনি শুরু করুন। কেবল সন্ধে। হাতে ঢের সময় আছে। টেন্ডার ইজ দ্য নাইট।’
‘“হাজার হাজার বছর ধরে পুরো বাংলার রাজধানি ছিল গৌড় আর পাণ্ডুয়া। অদ্ভুত এর ইতিহাস, আর কত যে এ নগরীর ইমারত আর সৌধ কোনো হিসেব নেই তার! এখানে আসার পর দেখলাম খোলা প্রান্তরে পড়ে আছে এক সুবিশাল দক্ষ-যক্ষ। কালের আবর্তে ক্ষয়ে যাচ্ছে কোটি কোটি লোকের ঘাম আর রক্তে তিলতিল করে গড়ে তোলা অতিকায় নগরী। আমাকে ভীষণভাবে টানল সুপ্রাচীন এই শহরের দানবীয় কঙ্কাল। মিশরের থিবস, মেম্ফিস, লাক্সর, কর্নাক আমি দেখিনি। তবে বাজি রেখে বলতে পারি, এগুলোর থেকেও চিত্তাকর্ষক ছিল এই গৌড় আর পাণ্ডুয়া। যাহোক, অবসর পেলেই এই পোড়ো শহরের গলিঘুঁপচিতে ঘুরঘুর করতে লাগলাম আমি। বুঝলাম এত এত অট্টালিকা সংরক্ষণ করার মতো কেউ নেই। ছোটোবেলা থেকেই আমার আঁকার হাত ভালো। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে মূল স্থাপনা, যেগুলো কোনোমতে এখনও টিকে আছে, সেগুলোর ছবি আঁকতে লাগলাম। ছোটোখাটো সংস্কারের কাজও করলাম। এরই ভেতর একদিন গেলাম ফিরোজ মিনারে। কালো কালো স্যাঁতাপড়া হলদে রঙের দালানটা কেমন যেন অদ্ভুতুড়ে। ওখানে গেলে দিনের বেলাতেও গা ছমছম করে। স্থানীয় লোকেরা ওটার ধারেকাছেও ঘেঁষে না। মিনার থেকে ষাট হাত দূরে এক বুড়োটে তেঁতুল গাছের নিচে মানতের অর্ঘ্য দেয় হিন্দু মেয়েরা। তবে সেটা হয় সকালে, নাহয় ভর দুপুরে।
‘“চার মানুষ উঁচু পাথরের বেজের ওপর ইঁটের তৈরি পাঁচ মঞ্জিল উঁচু ইমারতে পাঁচটা খিলান। হাঁ হাঁ করছে সবকটা। কার্নিশ থেকে বট-পাকুড়ের গাছ বেরিয়েছে। নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে পাথরের বেজ পেরিয়ে প্রথম খিলানে ওঠার সিঁড়ি। খোঁজ নিয়ে জানলাম, শেষ কবে ওখানে লোক ঢুকেছিল কেউ বলতে পারে না। বিগত তিনশো বছরে নাকি ওখানে কেউ ঢোকেনি! এই মিনারকে ঘিরে উপকথা, লোককথার ছড়াছড়ি। সবগুলোর বিষয়বস্তু নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড কিম্বা অলৌকিক ঘটনা। একেবারে গোড়া থেকেই আমার মনে হয়েছে ভয়ানক অশুভ কিছু একটা আছে ওখানে। গৌড়ও যথেষ্ট ভয় জাগানিয়া, তবে ফিরোজ মিনারের কাছে কিছুই না। কনস্ট্রাকশনের সময় থেকেই অশুভ ওটা। যত দিন গেছে তত বেড়েছে এর অপবিত্ৰ ভাব।
‘“মিস্ত্রি ডেকে কোনোমতে ওপরে ওঠা যায় এমন একটা সরু সিঁড়ি বানালাম আমি। তারপর পা রাখলাম প্রথম মঞ্জিলে। বিশ ফুট ওপরে অন্ধকার ছাত থেকে শতশত বাদুড় ঝুলছে। মেঝে বাদুড়ের বিষ্ঠার দুফিট নিচে। এক কোনে ধাপে ধাপে উঠে গেছে ভয়ানক খাড়া ফাটলধরা সিঁড়ি। ওটা গেছে একেবারে মাথায় ক্যানোপি অব্দি। আঁধারে ঢেকে আছে সিঁড়িঘর। লেবার লাগিয়ে পরিষ্কার করালাম মেঝে, সিঁড়ি, আর দোতলা। নীল নকশাকাটা সাদা রঙের মেঝে। দেওয়ালে জটিল ইসলামি জ্যামিতিক নকশা আর মোজেইক। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলাম দেওয়াল। প্ৰথম তলা দেখা হলে গেলাম দ্বিতীয় মঞ্জিলে। ভীষণ ঠান্ডা জায়গাটা। আসলেই শীতশীত লাগে। অথচ নিচতলা কিম্বা বাইরে হু হু করে গরম হাওয়া বইছে। দোতলার দেওয়ালে অনেকগুলো খোপ আর কুলুঙ্গি। এক সময় এখানে কেউ থাকত। দোতলার খিলানে দাঁড়ালে অনেক দূর অব্দি দেখা যায়। চারদিকে বড়ো বড়ো জলাশয়, ছোটো ছোটো গ্রাম, বহুদূরে প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ। বিকেলের দিকে প্রায়ই যেতে লাগলাম ওখানে। একরকম নেশা পেয়ে বসল আমাকে। ওখানে কিছুক্ষণ থাকলেই ঠান্ডায় হি হি করে কাঁপতে শুরু করি। ডারহ্যামের মানুষ আমি। এসব ঠান্ডা ওদেশের তুলনায় কিছুই না। তারপরেও কেন যে কাঁপুনি ওঠে গায়ে বুঝতে পারিনি।
‘“একদিন দাঁড়িয়ে আছি ওখানে, কখন যে বিকেল গড়িয়ে সন্ধে হয়েছে ধরতেই পারিনি। তন্ময় হয়ে বহুদূরে গাছের সারির মাথায় সূর্য ডোবা দেখছিলাম। সাঁঝের আঁধার ঘনিয়েছে বাইরে, ভেতরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। খিলানের উলটোদিকে পনেরো ফিট দূরে নিচে নামার সিঁড়ি। এতবার যাওয়া-আসা করেছি, মুখস্থ হয়ে গেছে সব খাঁজভাজ। বহুদিন হয় বাদ দিয়েছি মশাল আনা। অনুমানের ওপর ভর করে নিকষ অন্ধকারে নামতে হবে এখন। খিলানের দিকে পেছন ফিরে মেঝের আদ্দেকটা পেরিয়ে বুঝতে পারলাম: সিঁড়িঘর খুঁজে পাওয়া মুশকিল হবে। পেলেও ভুল স্টেপ ফেললে গড়িয়ে নিচে পড়ার ষোলো আনা সম্ভাবনা। মিনারটা ডায়মন্ড শেপড। ডানে কিম্বা বাঁয়ে দেওয়াল ধরে এক পা এক পা করে এগুনো যায়।
‘“আবারও ফিরে এলাম খিলানের নিচে। বাঁদিকের দেওয়াল ধরে এগুতে লাগলাম এক পা এক পা করে। শেষমেশ পা ঠেকল দেওয়ালের কাটা জায়গায়, যেখান থেকে শুরু হয়েছে নিচে নামার সিঁড়ি। আমরা যেভাবে সিঁড়ির দিকে পেছন দিয়ে খাড়া হেঁটে ধাপ বেয়ে নামি, সেভাবে নামতে সাহস পেলাম না। সিঁড়ির দিকে মুখ করে চার হাতপায়ে হামা দিয়ে নামার সিদ্ধান্ত নিলাম। দোতলার মেঝের কাছে ডান হাতে দেওয়ালের গোড়া ধরে প্রথম সিঁড়ির ওপর বাঁ পায়ের হাঁটু রেখে ডান পা নিচে নামিয়ে দ্বিতীয় ধাপ খুঁজতে লাগলাম। আগেই বলেছি—ভয়ানক খাড়া সিঁড়ি। দুফিটের মতো উঁচু একেকটা। ডান পা আরও খানিকটা নিচে নামাতে গিয়ে চাপ পড়ল ডান হাতে ধরা দেওয়ালের ওপর। মেঝের সাথে লাগোয়া দেওয়ালের যে ইঁটটা ডান হাতে আঁকড়ে ধরেছিলাম, হঠাৎ করেই নড়ে উঠল ওটা। হাতের টানে দেওয়াল থেকে বেরিয়ে আসছে ইঁট!
“আতঙ্কে গলার কাছে চলে এলো হৃৎপিণ্ড। একবার নিয়ন্ত্রণ হারালে গড়িয়ে পড়তে হবে বিশ ফিট নিচে পাথরের মেঝেতে। ফলাফল—অনিবার্য মৃত্যু। বাঁ হাত দিয়ে থাবা মেরে ধরার চেষ্টা করলাম মেঝে। যদি কোনোভাবে রোধ করা যায় পতন! মসৃণ মেঝেতে ছেঁচড়ে গেল তালু, তবে বন্ধ হলো পা হড়কানো। এইবার দুহাতের তালু আর হাঁটু সিঁড়ির ধাপের ওপর রেখে খুব ধীরে ধীরে নিচে নামলাম।
‘“সেদিন রাতে স্বপ্নে দেখলাম—সন্ধে ঘনিয়েছে ফিরোজ মিনারের চারপাশে। সাদা পাগড়ি-জোব্বাপরা লম্বা দাড়িঅলা বুড়ো এক লোক মিনারের সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠছে। বাঁ হাতে দিপদিপ করে জ্বলছে মাটির পিলসুজ। শেষ ধাপের আগে সিঁড়ির ওপর হাঁটু মুড়ে বসে পড়ল সে। ডান দিকে দেওয়াল যেখানে মেঝের সাথে মিশেছে, ডান হাতটা বাড়িয়ে দিলো সেই দিকে। স্বপ্নের এই পর্যায়ে ভেঙে গেল ঘুম। আমাকে ধাক্কা দিচ্ছে আমার স্ত্রী। তিনদিন হলো জ্বরে ভুগছে আমার মেয়েটা। গভীর রাতে বেড়ে গেছে জ্বর, পুড়ে যাচ্ছে গা। মাথায় জল ঢালতে হবে এখন, মুছিয়ে দিতে হবে গা-হাত-পা।
‘“এরপরের চারদিন ব্যস্ত থাকলাম মেয়ের চিকিৎসা নিয়ে। বহরমপুর আর্মি হাসপাতালে নিতে হলো তাকে। পাঁচ দিনের দিন আবারও গেলাম ফিরোজ মিনারে। তবে বেলা থাকতে থাকতে গেলাম, এবার সাথে মশালও থাকল। সিঁড়ির গোড়ায় যে হঁটটা দেওয়াল থেকে বেরিয়ে এসেছিল, সেটাকে ভালো করে দেখলাম। দেড় ফিট বাই এক ফিট পেল্লায় সাইজের ইঁটের প্রায় পুরোটাই বেরিয়ে এসেছে। টেনে বের করে হাতে নিলাম ওটা। কিছু নেই দেওয়ালের খাঁজে। কিন্তু এত হালকা লাগছে কেন ইঁটটা! উলটো করে ধরলাম ওটা। ভেতরটা ফাঁপা। খোঁদলের ভেতর পাতলা কাঠের বাক্স। বাক্সের ভেতর চামড়া মোড়া কী যেন একটা। বাসায় নিয়ে ভালো করে দেখলাম। ওটাই আল আযিফের আরেকটা অংশ। আগেই বলেছি: ফিরোজ মিনার নিয়ে স্থানীয় লোকেদের ভেতর এন্তার রূপকথা-উপকথা চালু আছে। এগুলোর একটা হলো—ওই মিনার তৈরির কিছুদিনের মধ্যেই এক মুসলমান ফকির এসে থাকতে শুরু করে ওখানে। সাথে করে নিয়ে এসেছিল সে ওই পাণ্ডুলিপি। ফকির বাবা মারা যায় এখানেই। ধরেই নিচ্ছি দোতলায় ওই ফকিরই লুকিয়ে রেখেছিল ওটা।’
‘“ওরে বাবা, এ তো দেখি বিরাট কাহিনি! গল্প-উপন্যাসের মতো লাগছে শুনতে। তবে একটা প্রশ্ন করতে চাই?’
‘“কী প্রশ্ন?’
‘“পাণ্ডুলিপির ওই অংশটা পাওয়ার পর আর কখনও কি ফিরোজ মিনারে গিয়েছিলেন?’
‘“না। আর কখনও যাইনি।’
‘“এ থেকে কি আপনার মনে হয় না মনের অজান্তেই ওই পাণ্ডুলিপির এক অদৃশ্য টানে ওখানে যেতেন আপনি? এ কারণেই ওটা খুঁজে পাওয়ার পর সেই আকর্ষণ আর অনুভব করেননি?’
‘“এভাবে কখনও ভেবে দেখিনি, তবে ওটাই হয়তো সত্যি।’
‘“এর অর্থ হলো এই লেখার অদৃশ্য এক প্রভাব আছে। কাছাকাছি যে-ই থাকবে, তার ওপর ক্রিয়াশীল হবে ওটা আর কিছু না কিছু ঘটাবে।’
‘“হতে পারে।’
‘“এজন্যেই বলছিলাম ওগুলো আমাকে একবার দেখতে দেন। ওই পাণ্ডুলিপি হাতে নিয়ে দেখতে চাই, কী ধরনের প্রতিক্রিয়া ঘটে মনোজগতে!’
‘“আপনি তো দেখছি তাতারদের মতো নাছোড়বান্দা রে, ভাই। এত করে বলছেন যখন না দেখিয়ে আর উপায় কী? তবে গুয়ামালটিতে এসে দেখে যেতে হবে।’
‘“ঠিক আছে, আমি রাজি। কবে ওখানে যেতে হবে বলেন?’
‘“আগামি সপ্তাহে রোববার দিন আসেন। মালদা শহরে সরাইখানা আছে। শনিবার ওখানে উঠবেন। রোববার সকাল দশটায় চলে আসবেন আমাদের নীল কুঠিতে।”
.
বলে চলেছে ম্যাডাম জুই।
“পরদিন হেনরি ক্রাইটন বিদেয় নিতেই হংকংয়ে ম্যাসেজ পাঠালো টং। বিস্তারিত জানিয়ে লিখল, স্থানীয় দাগী চোরদের ভেতর থেকে তিনজনের একটা দল নিয়ে যাবে সে। সাথে মোটা টাকাও থাকবে। প্রথমে টাকা দিয়ে হেনরির কাছ থেকে কিনতে চাইবে পাণ্ডুলিপি। যদি না দেয়, তাহলে চুরির ব্যবস্থা করতে হবে। তবে মোটেও সহজ হবে না ও কাজ। ধরেই নেওয়া যায়: হেনরি নিজের বাংলোয় সিন্দুকের ভেতর টাকা-পয়সা, সোনাদানার সাথে তালা দিয়ে রাখে ওটা। এই সিন্দুকটা বাড়ির ঠিক কোন ঘরের কোন জায়গায় সেইটে জানা অতি জরুরি।
“তবে এরও সমাধান করেছে সে। হেনরির আস্তাবলের সহিস এক মুসলমান যুবক। নাম—আজম। এই আজমের সাথে হেনরির বাংলোর নমঃশূদ্র জাতের হিন্দু কাজের মেয়ে কামিনীর ঘনিষ্ঠতা আছে। আজমকে টাকা খাওয়ানো হয়েছে। কামিনী যেন মনিবকে চোখে-চোখে রাখে সেকথা আগেই বলে রাখবে সে। ওই মেয়ের মাধ্যমে জেনে নেওয়া যাবে তাকে দেখানোর পর পাণ্ডুলিপি কোথায় তুলে রাখে হেনরি। বাংলোয় শক্ত পাহারা থাকে, বিশেষ করে রাতের বেলা। এদের চোখে ধুলো দিয়ে প্রবেশ কিম্বা বাহির কোনোটাই সহজ হবে না। ডাইভার্সিটি তৈরি করতে হবে।
“কিন্তু কোনো কাজেই এলো না এতসব পরিকল্পনা। টংয়ের কাছ থেকে বিদেয় নেওয়ার তিনদিন পর মারা গেল হেনরি। বিকেল বেলা ঘোড়া নিয়ে বেড়াতে বেরিয়েছিল। ফিরতি পথে সন্ধে ঘনিয়ে যায়। বিশাল কম্পাউন্ডের একদিকে নীল কারখানা আরেকদিকে পাকা দোতলা বাংলো। মূল রাস্তা থেকে কম্পাউন্ডের গেট পেরিয়ে যে রাস্তাটা বাংলোর দিকে গেছে সেই রাস্তায় পুল বা কালভার্ট পড়ে। শুকনোই থাকে সব সময় শুধু বৃষ্টি-বাদল হলে জল জমে কালভার্টের নালায়। অন্ধকারে ঘোড়াসহ হেনরি যখন কালভার্টে উঠেছে তখন হঠাৎ করেই পুলের নিচ থেকে ক্যা হুয়া ক্যা হুয়া করে একপাল শেয়াল ডেকে উঠল। তারপর দুদ্দাড় করে পালাতে শুরু করল। কাণ্ড দেখে ভয়ানক চমকে উঠল ঘোড়া। পা পিছলে হুড়মুড় করে নালায় পড়ল। তার সাথে পড়ল হেনরি ও ভীষণ আঘাত পেল ঘাড়ে। ক্যারোটিড ডিসেকশনে তৎক্ষণাৎ মারা গেল।
“কোলাকাতা কিম্বা অছিপুর থেকে মালদার দূরত্ব তিনশো পঁচাত্তর কিলো। তেজি ঘোড়ায় দুদিনের পথ। সেকালে খবর পৌঁছাতে দেরি হতো। দলবল নিয়ে মালদায় গিয়ে টং দেখল: এরই মধ্যে শেষ হয়েছে হেনরি ক্রাইটনের দাফন। দারুণ হতাশ হলো বেচারা। চেষ্টা চালাল তারপরেও। সাথের চোরদের দিয়ে লুট করাল সিন্দুক। সামান্য কিছু টাকাকড়ি, ব্যাংকের কাগজ, আর জমির দলিল ছাড়া অন্যকিছু পাওয়া গেল না। কী আর করা, অছিপুরে ফিরে এলো টং। হংকংয়ে রিপোর্ট পাঠালো পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি।”
অনেক্ষণ কথা বলে থামল ম্যাডাম জুই। টি পট থেকে কাপে চা ঢেলে চুমুক দিলো। হিম ঠান্ডা চা। চোখমুখ কুঁচকে বলল, “একটু অপেক্ষা করুন আপনারা। ফ্রেশ চা বানিয়ে এখনই ফিরছি। বেশি সময় লাগবে না।”
টি পটের সাথে কাপ তিনটেও নিয়ে গেল সে। ধুয়ে পরিষ্কার করে নিয়ে আসবে।
সোফার ওমাথায় বসা শরৎ বাবুর দিকে চাইলো দীনবন্ধু। দেখল, মেঝের দিকে চেয়ে গভীর চিন্তায় ডুবে আছে জ্যোতিষী কাম মাস্টার মশাই। একে এখন কিছু জিজ্ঞেস করাটা ঠিক হবে না। তবে একথা ঠিক অনেক কিছু পরিষ্কার হয়েছে ম্যাডাম জুইয়ের কথা থেকে। এখন ঠিক করতে হবে পরবর্তী করণীয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো করণীয়টা কী?
টি পটে চা নিয়ে ফিরে এলো ম্যাডাম জুই। সোফায় বসতেই বাতাসে ভেসে এলো ল্যাভেন্ডারের মিষ্টি সুবাস। স্বীকার করতেই হবে দারুণ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন এই মহিলা। কাপড়-চোপড়, পরিবেশ—সবকিছু একেবারে ঝকঝকে তকতকে। তিন কাপে চা ঢেলে এগিয়ে দিলো সামনে। তারপর জিজ্ঞেস করল, “মিস্টার শরৎ, আর কোনো প্রশ্ন আছে আপনার?”
“দয়া করে আমাকে মিস্টার শরৎ বলবেন না। বরং শরৎ বাবু বলুন। যা জেনেছি তা কম না। কিন্তু যে তিমিরে ছিলাম এখনও সেই আঁধারেই রয়ে গেছি আমরা। একমাত্র সুখবর হলো এই পাণ্ডুলিপির দুটো অংশ সম্ভবত এক জায়গাতেই আছে। আর ওগুলো সর্বশেষ যার হাতে ছিল সে হলো হেনরি ক্রাইটন। কিন্তু সূত্র ওখানেই খতম। এরপর গেল কোথায় ওই জিনিস? খুঁজে বের করতে হলে শুরু করবো কোত্থেকে?”
“আমি বলি কী, আমাদের উচিত টংয়ের পদাঙ্ক অনুসরণ করা। অর্থাৎ মালদা গিয়ে দেখা—হেনরি কোথায় থাকত, কী করত।”
“ধরুন গেলাম ওখানে। কিন্তু তাতে কাজ হবে কতটুকু। হেনরি ক্রাইটন মারা গেছে প্রায় পৌনে দুশো বছর আগে। ওখানে তার নীলকুঠি আদৌ টিকে আছে কি না, কে জানে? আর যদি ভাঙাচোরা কোনো কাঠামো থেকেও থাকে, তাহলেই বা কী? দুশো বছর আগে বেঁচে ছিল এমন এক ইংরেজের তথ্য স্থানীয় লোকেরা দিতে পারবে এমন সম্ভাবনা খুবই কম।”
“দুঃখিত, আপনার সাথে একমত হতে পারছি না। আমার সাইকিক গুরু বলেন, ক্লু বা সূত্র কখনও পুরোপুরি মুছে যায় না। কোথাও না কোথাও কোনো একটা চিহ্ন রেখেই যায়। কিন্তু সেইটে দেখে চেনার ক্ষমতা থাকতে হবে। এজন্যে দরকার তুখোড় ইনটুইশন।”
“কিন্তু ইনটুইশন যদি না থাকে?”
“যতদূর জানি আপনি একজন জ্যোতিষী। ইনটুইটিভ পাওয়ার ছাড়া জ্যোতিষীগিরি করেন কীভাবে?”
শুরুতে ম্যডাম জুইকে দেখে অস্বস্তি বোধ করলেও এখন অনেকটা সহজ হয়েছে দীনবন্ধু। যদিও আগের সেশনের কিছুই মনে নেই তার, শুধু শরৎ বাবুর মুখ থেকে যতটুকু শুনেছে সেইটে ছাড়া—তবুও সাইকিক মহিলার স্মার্টনেস আর কথাবার্তা তাকে বেশ মুগ্ধ করেছে। তার মনে হলো যুক্তি আছে এই মহিলার কথায়। সে বলল, “দাদা, উনি হয়তো ঠিকই বলেছেন। আমাদের ওখানে যাওয়া উচিত। শুরু করতে হলে ওখান থেকেই করতে হবে।”
“বেশ, তবে তাই হোক। কাল সকালেই রওনা হবো আমরা। প্রায় চারশো কিলো রাস্তা। আট ঘণ্টার কমে হবে না। অ্যাম্বাস্যাডর গাড়ি ভাড়া করে যাবো আমরা তিনজন। তবে ওখানে গিয়ে কোথায় উঠবো সেকথাও ভাবতে হবে। ভালো কোনো হোটেলে আজই রিজার্ভেশন দিয়ে রাখলে ভালো হয়। এই কাজটা আপনিই করুন, ম্যাডাম। আপনার পছন্দমতো হোটেল বেছে নিন। বিল নিয়ে ভাববেন না। ওটা আমার ওপর ছেড়ে দিন। আর হ্যাঁ, কতদিন থাকতে হয় বলা যায় না। সাতদিন থাকার মতো কাপড়চোপড় সঙ্গে নেওয়াই ভালো। কী বলেন, ম্যাডাম?”
“আমি রাজি। কাল সকাল আটটার সময় বেরুলে পৌঁছতে পৌঁছতে পাঁচটা বাজবে। মাঝে এক ঘণ্টার ব্রেক। কাল সকাল আটটায় রেডি হয়ে গড়ি নিয়ে চলে আসুন এখানে।”
.
পরদিন সকাল আটটায় দীনবন্ধুকে নিয়ে ইউয়ানশি তিয়ানঝুন সাইকিক রিডিংয়ে গড়ি নিয়ে এসে হাজির হলো শরৎ বাবু। ডোর বেল টিপতেই হ্যান্ডব্যাগ হাতে বেরিয়ে এলো ম্যাডাম জুই। পরনে বারগান্ডি রঙের ম্যাক্সি, কালো লেস লাগানো ফ্ল্যাট স্যান্ডেল। মাথার ওপর চুড়ো করে বাঁধা চুল। শরৎ বাবু বললেন, “ব্যস, এই! শুধুই হ্যান্ড ব্যাগ! স্যুটকেস-টুটকেস নেই সাথে?”
ম্যাডাম জুই বলল, “আলবাৎ আছে। দুটো স্যুটকেস, ম্যালা ভারী। আপনাদের ড্রাইভারকে বলেন ভেতর থেকে ওগুলো এনে গাড়ির ট্রাঙ্কে তুলতে।”
“ও আচ্ছা,” মনে মনে ভাবলেন—যাচ্ছ তো বাবা কেবল দুতিন দিনের সফরে। এই স্বল্প সময়ের জন্যে এত লটবহর সঙ্গে নেওয়ার মানে কী? মুখে বললেন, “সত্যি কথা বলতে কী, আমাদের দুজনের দুটো স্যুটকেস অলরেডি রয়েছে ওখানে। এত মাল-সামানার কি জায়গা হবে ডিকিতে?” একথা বলে কিসমতের দিকে তাকালেন শরৎ বাবু। চোখে প্রশ্ন।
কিসমত বলল, “জায়গা নিয়ে ভাববেন না, স্যার। অ্যাম্বাস্যাডর গাড়ির ডিকি এমনিতেই বেশ পেল্লাই। তার ওপর ওয়র্কশপে নিয়ে আরও গভীর করা হয়েছে ওটা। এই দেখুন, খুলে দেখাচ্ছি।” এ কথা বলে ডিকির ডালা খুলল কিসমত।
শরৎ বাবু আর দীনবন্ধু দেখল—ডিকির একদিকে কেতরে পড়ে আছে তাদের স্যুটকেস দুটো। সামনে পেছনে বিস্তর জায়গা খালি। দৃশ্য দেখে মুচকি হেসে শরৎ বাবু বললেন, “ওরে বাবা, এ যে দেখছি ভুবনেশ্বরের ভীম কুণ্ডের মতো গভীর! করেছ কী বাবা! এখানে তো তিন-তিনটে আস্ত মানুষ ভরে ফেলা যাবে! ব্যাপার কী? অফ টাইমে লাশ-ফাশ টানো নাকি!”
হাসতে হাসতে কিসমত বলল, “কী যে বলেন, স্যার! দমদম এয়ারপোর্ট থেকে প্যাসেঞ্জার আনি। মিডল ইস্ট থেকে আসা প্যাসেঞ্জারের সাথে মেলা লাগেজ থাকে। ডিকি বড়ো না হলে সমস্যা। এ কারণেই বড়ো করতে হয়েছে।”
গাড়ির পেছনের সিটে বসল শরৎ বাবু আর ম্যাডাম জুই, সামনের সিটে ড্রাইভারের পাশে দীনবন্ধু। গাড়ি ছাড়তেই ম্যাডাম জুই বলল, “মালদায় উঁচু মানের কোনো হোটেল নেই। শহরের মাঝখানে বিপিন ঘোষ রোড আর রবীন্দ্র অ্যাভিনিউয়ের মোড়ে সরকারি সার্কিট হাউস আছে। ওখানেই দুটো কামরা বুকিং দেওয়া হয়েছে।”
শরৎ বাবু বললেন, “সার্কিট হাউস থেকে হেনরি ক্রাইটনের নীল কুঠি কতদূরে জানতে পেরেছেন?
“আজ্ঞে, পেরেছি। নীল কুঠিটা মালদা শহর থেকে ষোলো কিলো দক্ষিণে পুরনো গৌড় নগরীর একপাশে। ওই জায়গাটাকে বলে গুয়াতিমালা বা গৌমালতি। গাড়িতে গেলে পৌঁছতে আধ ঘণ্টা লাগবে। মালদা পৌঁছানোর পর এখানে-ওখানে যাওয়ার জন্যে পরিবহন লাগবে। তার কী ব্যবস্থা করেছেন?”
“পুরো এক সপ্তার জন্যে ভাড়া করা হয়েছে এই গাড়ি। ওটা নিয়ে ভাববেন না। তাছাড়া, ড্রাইভার কিসমত পাঠান মালদার ছেলে। কোলকাতায় ট্যাক্সি চালায়। গেল হপ্তায় আমাদের মেসে ঘর ভাড়া নিয়েছে। দেখতে পালোয়ানের মতো হলেও খুবই ভদ্র আর মিশুক ছেলে। কোলকাতা-মালদার সব ঘাঁতঘোঁত তার চেনা। সুতরাং সমস্যা হওয়ার কথা না।”
উত্তর দিকে ছুটছে ঝাঁ চকচকে নতুন অ্যাম্বাস্যাডর গাড়ি। রাণাঘাট পেছনে ফেলে কৃষ্ণনগর পৌঁছে চা-নাশতা খেয়ে আবারও হাইওয়ে ধরে সাঁইসাঁই করে উত্তর দিকে ছুটল। বহরমপুরে গিয়ে ঘণ্টাখানেকের বিরতি নিয়ে লাঞ্চ করার কথা। পলাশি, বেলডাঙা পেরিয়ে বহরমপুরে এসে গাড়ি যখন থামল, তখন বেলা একটা। গোরাবাজারে সূর্য্য সেন রোডে ১৬ আনা বাঙালী খানদানি রেস্তোরাঁ। কিসমতই পথ দেখিয়ে নিয়ে এলো তাদের। খুব নাকি নামকরা হোটেল।
রেস্টুরেন্টের ভেতরের দেওয়ালে আর্টিস্টিকভাবে ঝোলানো চারুলতা, গুপিগাইন বাঘাবাইন, জয় বাবা ফেলুনাথ, পথের পাঁচালী সিনেমার পোস্টার, বিখ্যাত সব বাঙালী চিত্রতারকা আর গায়ক-গায়িকাদের হাতে আঁকা পোট্রেট, কাঠের ফ্রেমে সুন্দর করে বাঁধানো ইংরেজ আমলের হরেক রকমের চিত্রকর্ম, ফটোগ্রাফ। কে জানে, ওসব গায়ক-গায়িকারা হয়তো খেয়েছেন এখানে! পরিচ্ছন্ন পরিবেশ, চারদিকের দেওয়াল জুড়ে বড়ো বড়ো জানালা বহুদূর অব্দি চোখে পড়ে। চমৎকার রুচি-সম্মত জায়গা। সবে একটা বেজেছে, তেমন ভিড় নেই। বড়ো জানালার ধারে কোনার এক টেবিলে গিয়ে বসলেন শরৎ বাবুরা।
যে যার মতো অর্ডার দেওয়ার পর এলো নোনতা দইয়ের সাথে বহরমপুরের বিখ্যাত মিঠাই—ছানাবড়া। রসগোল্লা আর পান্তুয়ার মাঝামাঝি এই মিষ্টি দেখতে কালোজামের মতো। কাশিমবাজারের মহারাজা মণি নন্দীর হুকুমে একশো বছর আগে বানানো হয় এই সুখাদ্য। নির্ভেজাল জিনিস দিয়ে তৈরি ছানাবড়া দারুণ সুস্বাদু। দই মাখিয়ে কেবল দুটো মিষ্টি শেষ করেছেন শরৎ বাবু, এমন সময় তার কনুইয়ে আলতো করে গুঁতো দিলো দীনবন্ধু। চোখের ইশরায় নজর দিতে বলল ম্যাডাম জুইয়ের দিকে। দই মিষ্টি ছুঁয়েও দেখেনি ম্যাডাম জুই। বাঁ-দিকের পেল্লায় কাচের জানালার ভেতর দিয়ে তাকিয়ে আছে বাইরে। জানালার ওপারে বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ, রুপোলি নদী, তারপর গাছ-গাছালির জঙ্গল। সাইকিক মহিলাকে দেখে মনে হচ্ছে এ দুনিয়ায় নেই সে, বিচরণ করছে অন্য ভুবনে। ঝাড়া পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করলেন শরৎ বাবু। কোনো হেলদোল নেই। এইবার নিচু স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, “জুই ম্যাডাম, আপনি ঠিক আছেন? কোনো অসুবিধে হচ্ছে না তো?”
এইবার চাপা কণ্ঠে জুই বলল, “শুনতে পাচ্ছেন, শরৎ বাবু?”
“কী শুনতে পাচ্ছি?”
“ঝিঁঝিঁ, উচ্চিংড়ে, আর গাঁধি পোকার ডাক। শত শত হাজার হাজার পোকা ডাকছে।”
“এই ভর দুপুরে রেস্টুরেন্টের ভেতর পোকা আসবে কোত্থেকে?”
“এখানে না, ওই দূরে জঙ্গলের ভেতর ডাকছে ওগুলো। অদ্ভুত এক মাদকতা আছে পোকাগুলোর আওয়াজের ভেতর। শুনতেই ভালো লাগছে।”
অবাক হয়ে একে অন্যের দিকে চাইলো শরৎ বাবু আর দীনবন্ধু। এ আবার কী মুশকিল রে বাবা! মাথা খারাপ নাকি এই মহিলার? নাকি দিনদাহাড়ে রেস্টুরেন্টে খেতে বসে সাইকিক ভিশন দেখছে? ঝট করে উঠে দাঁড়ালেন শরৎ বাবু। পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে ধরিয়ে দিলেন দীনবন্ধুর হাতে। বললেন, “যাও। কাউন্টারে গিয়ে বিল মিটিয়ে দাও।”
এরপর ম্যাডাম জুইয়ের হাত ধরে বাইরে নিয়ে এলেন তাকে। থুতনি ধরে সূর্যের দিকে ঘোরালেন তার মুখ। তীব্র কিরণে ধাঁধিয়ে গেল সাইকিকের চোখ। পিটপিট করে চোখের পাতা ফেলে শরৎ বাবুর দিকে চাইলো জুই। যেন ঘুম থেকে জাগল। বলল, “আরে মশাই আপনি আমার মুখে হাত দিয়েছেন কেন? বিষয় কী আপনার?”
“বিষয় কিছুই না। অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলেন আপনি। ডাকাডাকি, হাঁকাহাঁকিতেও সম্বিৎ ফেরেনি।”
“তাই নাকি?”
“আজ্ঞে, হ্যাঁ। আপনি বলছিলেন রাতে-ডাকা পোকামাকড়ের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছেন। খুব নাকি মধুর। এখানে আসার পর হুঁশ ফিরেছে আপনার। নাকি এখনও শুনতে পাচ্ছেন পোকার ডাক?”
“নাহ, কিছুই শুনতে পাচ্ছি না।”
“যাক ঝামেলা গেছে। চলুন গাড়িতে উঠি। এখনও অনেক পথ বাকি।”
পরদিন সকাল নটায় গৌমালতির উদ্দেশ্যে রওনা হলো তিনজনের টিম। আসার সময় গৌড় ফেলে এসেছে হাতের ডানে। উলটো দিকে অর্থাৎ দক্ষিণে ষোল কিলো গেলেই গৌড়ের ধ্বংসাবশেষ। এরই এক জায়গায় গুয়ামালটি। শহরের ভেতর দিয়ে এসে মখদুমপুরে বিমল দাসের মূর্তির কাছে ডানে মোড় নিয়ে গৌড় রোডে পড়ল গাড়ি। এরপর সুস্তানি মোড়ে ডানে বাঁক নিয়ে আগে বাড়তেই সামনে দেখা দিলো খাসিমারি দুর্গা মন্দির। যত এগোয় গাড়ি, রাস্তার দুদিকে তত বেশি বড়ো বড়ো দিঘি, জলাশয়, আর আম বাগান। শেষমেশ থামতে হলো সাগর দিঘির পাড়ে এসে। প্রকাণ্ড দিঘি, হ্রদই বলা চলে। রাস্তা এখানেই শেষ।
পুরো এলাকা জুড়ে সরু মোরাম বিছানো রাস্তা। রাস্তার দুপাশে ঢিবির ছড়াছড়ি। এককালে পেল্লায় ভবন ছিল এখন মাটির নিচে সেঁধিয়ে ঢিবি হয়েছে। অনেকগুলো ভবনের কঙ্কালও চোখে পড়ল শরৎ বাবুদের। “এগুলো সম্ভবত ইংরেজ আমলে তৈরি। বয়স মেরেকেটে দুশো-আড়াইশো বছর,” বললেন শরৎ বাবু।
বিলের চারদিক ঘুরে দেখতেই বেলা গড়িয়ে দুপুর হলো। শরৎ বাবু বোঝালেন: নীল কারখানা চালাতে প্রচুর জল লাগত। এতবড়ো প্রাকৃতিক জলাশয়ের কাছেই কারখানা থাকার কথা। আর কারখানা থাকলে নীলকর সাহেবের রেসিডেন্সও কাছেই হবে।
“কাছে মানে কোথায়?” জিজ্ঞেস করল ম্যাডাম জুই। এত হাঁটাহাঁটি করতে গিয়ে হয়রান হয়ে গেছে বেচারি।
“সেটাই প্রশ্ন। খুঁজে দেখতে হবে।”
“গৌড় একটা রাজধানী। বিরাট এর এরিয়া। মোটামুটি খুঁজলেও বছর পেরিয়ে যাবে।”
দীনবন্ধু বলল, “এক কাজ করলে কেমন হয়?”
“কী কাজ?” জিজ্ঞেস করল ম্যাডাম জুই।
এসব ঐতিহাসিক জায়গায় অনেক স্থানীয় লোক থাকে। তাদের বলে ট্যুরিস্ট গাইড। ওরকম একজনকে ডেকে এনে তাকে নিয়ে খুঁজলে, কম সময়ে অনেক বেশি জায়গা কাভার করা যাবে।”
“এটা কি আপনার নিজের আইডিয়া?”
“ঠিক আমার না। এখানে আসার আগে সার্কিট হাউসে কিসমত পাঠান বলছিল।”
“বুদ্ধি মন্দ না। কিন্তু ওকাজটা এই এলাকায় ঢোকার সময় করা দরকার ছিল। এখন ওসব গাইড কোথায় পাবো?” উত্তর দিলেন শরৎ বাবু।
“আমি বলি কী, আমাদের ড্রাইভার কিসমত পাঠান তো কাছেই আছে। ওকে বললেই একজনকে নিয়ে সাথে করে নিয়ে আসবে,” প্রস্তাব দিলো ম্যাডাম জুই।
কিসমতকে ট্যুরিস্ট গাইডের কথা জানাতেই কিসমত বলল, কোনো সমস্যা নেই, স্যার। ভালো ট্যুরিস্ট গাইড আছে আমার সন্ধানে। নাম আব্দুল খান, বিএ পাশ। তবে তাকে পেতে হলে যেতে হবে টিয়াকাটির কাছে। এখানে আসার পথে পড়ে ওই জায়গা। এখন তো দুপুর গড়িয়ে গেছে। ওখানে গিয়ে, যদি পাওয়াও যায়, খুঁজে বের করে আনতে আনতে বিকেল। পাঁচটার পর এ এলাকায় থাকা নিষেধ। তার চেয়ে বরং আজকে যাওয়ার পথে ওর খোঁজ নেই। কথাবার্তা বলে ঠিক করে রাখি। কাল সকালে টিয়াকাটি থেকে আমাদের গাড়িতে উঠিয়ে নেবো। কিম্বা বলবো সাগর দিঘির উত্তর পাড়ে এসে অপেক্ষা করতে। কী বলেন আপনারা?”
“মনে হয় ওটাই ঠিক হবে,” তাড়াহুড়ো করে বলল ম্যাডাম জুই। “এখন সার্কিট হাউসে ফিরে যাওয়াই ভালো। শাওয়ার নিয়ে খাওয়া-দাওয়া করতে হবে।”
যাওয়ার পথে টিয়াকাটিতে গাড়ি থামাল কিসমত। রাস্তার ধারে বড়োসড়ো চায়ের দোকান, মিষ্টান্ন ভাণ্ডার, হুডখোলা জিপ, থ্রি হুইলার স্ট্যান্ড। গৌড় দেখতে আসা ট্যুরিস্টরা খাওয়া-দাওয়া করে এখানে। গাইড ঠিক করে সারাদিনের জন্যে পছন্দমতো পরিবহন ভাড়া করে। আব্দুল খানকে পাওয়া গেল না। সকালেই ট্যুরিস্ট নিয়ে বেরিয়ে গেছে। এখনও ফেরেনি। তবে তাতে সমস্যা হলো না। ছোটো একটা কাগজে চিঠি লিখে চায়ের দোকানের মালিকের হাতে ধরিয়ে দিলো কিসমত। বলল, “এই চিঠিটা আব্দুল খানকে দেবেন আর বলবেন কাল সকাল নটার সময় চলে আসবো আমরা, সে যেন অবশ্যই উপস্থিত থাকে।”
পরদিন সকালে টিয়াকাটি থেকে আব্দুল খানকে উঠিয়ে নিয়ে সোজা সাগর দিঘির উত্তর পাড়ে এসে গাড়ি পার্ক করল কিসমত। আব্দুল খানের বয়স ছাব্বিশ-সাতাশ। ফর্সা রং, লম্বা একহারা গড়ন। টিকোলো নাক, চওড়া কপাল, ভাসাভাসা চোখ। পরনে সাদা শার্ট-প্যান্ট, টেনিস শ্য। মাথায় ক্রুকাট চুল, চোখে সবুজ সানগ্লাস। গাড়ি থেকে সবাই বেরুনোর পর আব্দুল খান জিজ্ঞেস করল, “এখানে এলেন যে বড়ো? বিশেষ কোনো কারণ আছে? দাখিল দরওয়াজা, চাঁদ দরওয়াজা, কোতোওয়ালি দরওয়াজা, বড়ো সোনা মসজিদ, ফিরোজ মিনার—একটাও তো এদিকে না। তবে হ্যাঁ, লোটন মসজিদ আছে। কিন্তু সেটা আরও দক্ষিণে। ওই পথে আর একটু এগোলে ছোটো সোনা মসজিদ, তবে ওটা বাংলাদেশে পড়েছে। এই দিঘিও অনেকেই দেখতে আসে। বিরাট বড়ো আর ভয়ানক গভীর। এ যে কত পুরনো কেউ জানে না।
“তবে ঐতিহাসিকদের মতে প্রায় নশো বছর আগে বল্লাল সেনের আমলে হাজার বিঘে জমির ওপর তৈরি হয় এটা। কত নদী মরে গেছে, শুকিয়ে গেছে শতশত পেল্লায় অক্সবো লেক। কিন্তু এই সাগর দিঘির হয়নি কিছুই। যে কে সেই। সাগর দিঘির দক্ষিণ- পশ্চিম কোণে পুলিন পীরের দরগা। বহু লোক মানত কতে আসে ওখানে। ছশো বছর আগের ওই পীরের দোয়াতেই নাকি টিকে আছে এ দিঘি। ইংরেজরা এই দিঘিকে বলত পন্ড। নানান যুগে অসংখ্য মানুষকে ডুবিয়ে মারা হয়েছে এই দিঘিতে। পায়ে বালুর বস্তা কিম্বা স্রেফ হাত-পা বেঁধে ফেলে দেওয়া হতো দিঘির জলে। মাঘি পূর্ণিমার রাতে এই দিঘির জলের ভেতর থেকে বহু মানুষের কান্নার আওয়াজ ভেসে আসে।”
“ওই আওয়াজ কে শুনেছে?” আব্দুল খানকে থামিয়ে দিয়ে আলটপকা প্রশ্ন করল দীনবন্ধু।
এক মুহূর্তও না থেমে টুরিস্ট গাইড বলল, “যদিও এদিকে রাতে কেউ আসে না, তবুও দুএকজন সাধু-সন্ন্যাসী ঠিকই আসে। যত পুরনো স্থাপনা, মন্দির, মসজিদ, বন-জঙ্গল, হ্রদ-নদী-দিঘি – সব জায়গায় অবাধ বিচরণ এদের। এরাই শুনে সাধারণ মানুষকে জানিয়েছে। সে যাহোক, আপনারা কী মোটামুটি সব জায়গা দেখবেন, না নামকরা দুয়েকটা দেখে চলে যাবেন?”
শরৎ বাবুরা দেখলেন টুরিস্ট গাইড তার কাজ শুরু করেছে। অনর্গল কথা বলে যাচ্ছে। এক সেকেন্ডও সময় নষ্ট করেনি। কোনো সন্দেহ নেই, এ লোক প্রফেশনাল। কিন্তু একে হেনরি ক্রাইটনের নীলকুঠি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা ঠিক হবে কি? হাজার হলেও গোপনীয় মিশন এটা। ম্যাডাম জুই আর দীনবন্ধুকে নিয়ে একপাশে সরে এলেন শরৎ বাবু। জিজ্ঞেস করলেন, “এ লোককে কী বলা হবে এখন? আমরা কী সরাসরি বলবো হেনরি ক্রাইটনের নীলকুঠি খুঁজছি? দুশো বছর আগে এই গৌড়েরই গুয়ামালটি নামের এক জায়গায় ছিল ওটা। এখন কোথায় আছে আমাদের দেখিয়ে দাও। স্বাভাবিকভাবেই সে জিজ্ঞেস করবে, ‘এতসব নামকরা স্থাপনা বাদ দিয়ে ওই নীলকুঠি খুঁজছি কেন? এমন কিছু পুরনোও না, তেমন গুরুত্বপূর্ণও না।’ কিন্তু না বলেও তো উপায় নেই। এ বিষয়ে আপনাদের মতামত কী?”
“আমার মনে হয়ে সরাসরি জিজ্ঞেস করাই ভালো,” বলল ম্যাডাম জুই। “কারণ জানতে চাইলে বলবেন, স্কুলের মাস্টার আপনি। ছাত্রদের নীলকুঠির ইতিহাস পড়ান। এদেশে একেবারে গোড়ার দিকের নীলকুঠি এখানেই তৈরি হয়।”
“দীনবন্ধু, তুমি কী বলো?”
“আমারও ওই একমত। অতকিছু দেখতে গেলে হবে না এখন।”
আব্দুল খানের কাছে ফিরে এসে শরৎ বাবু বললেন, “গাইড মশাই। আমরা গৌড়ের ধ্বংসাবশেষের ভেতর বিশেষ একটা স্থাপনা খুঁজছি। হেনরি ক্রাইটন সাহেবের নীলকুঠি। আজ থেকে দুশো বছর আগে গৌমালতি নামের এক জায়গায় ছিল ওই কুঠি। আপনি কি আমাদের দেখাতে পারবেন ওটা?”
“নীলকুঠি এখানে দুটো ছিল। প্রথম কুঠি তৈরি করে চার্লস গ্র্যান্ট। এই লোক ছিল ভারতীয় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চেয়ারম্যান। সে চলে গেলে রবার্ট আডনি বলে আরেক ইংরেজ কিছুদিন চালিয়েছিল ওটা। এরপর নীলকুঠির ম্যানেজার হয় হেনির ক্রাইটন। কারখানা অনেক বড়ো করেছিল ক্রাইটন। বাসভবনও বানিয়েছিল একাধিক। কারখানা, রেসিডেন্স, নীল চাষের জমি সব মিলিয়ে অনেক বড়ো জায়গা দখলে নিয়েছিল ক্রাইটন।”
“প্রথম যেখানে নীলকুঠি ছিল, সেখানে নিয়ে যেতে পারবেন আমাদের?”
“নিশ্চয়। আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছি সেখান থেকে একশো গজ পশ্চিমে গিয়ে ডানে বাঁক নিয়ে আধা কিলো উত্তরে গেলে চাঁদ সওদাগরের ভিটে। ওখানেই প্রথম নীলকুঠি অর্থাৎ কুঠিয়াল সাহেবের বাসভবন তৈরি হয়। তবে তারপর নীলকুঠি বড়ো হলে তৈরি হয় দ্বিতীয় বাসভবন। অন্য আরেক জায়গায়।”
“এই চার্লস গ্র্যান্টকেই কি স্থানীয় লোকেরা চাঁদ সওদাগর বলে?” জানতে চাইল দীনবন্ধু।
“হতে পারে। সম্ভবত ওই গ্র্যান্টই চাঁদ সওদাগর। মালদার ইংরাজ বাজারে সিল্কের বিশাল কারবার ছিল তার। বিস্তর পয়সা বানিয়েছিল রেশমের ব্যাবসা করে। তাছাড়া ওই লোক ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ব্যাবসা-বাণিজ্যের তত্ত্বাবধায়ক। নতুন ইংরেজ উদ্যোক্তাদের সব ঋণ তার সুপারিশে হতো। তবে ব্যক্তিগত জীবনে দারুণ বিলাসী ছিল লোকটা। দুহাতে পয়সা ওড়াত মদ, নারী, জুয়া, রেসখেলার পেছনে আর বড়ো বড়ো পার্টি থ্রো করে। যাহোক, স্মল পক্সে পরপর দুই ছেলে মারা গেল গ্রন্টের। এতে একেবারে ভেঙে পড়ে বেচারা। ধর্মে মতি হয় তার। এখানকার সবকিছু ছেড়ে দিয়ে ইংল্যান্ডে চলে যায়। ধরে নেওয়া যায় তখনই চূড়ান্ত উন্নতি হয় হেনরি ক্রাইটনের। কিন্তু এতকিছু বাদ দিয়ে এই একটা বিষয়ে জানতে চাইছেন কেন আপনারা?”
আগেই এ প্রশ্নের উত্তর রেডি করা ছিল। শরৎ বাবু তৎক্ষণাৎ গড় গড় করে কারণ বললেন। “ও আচ্ছা বুঝতে পেরেছি। কিন্তু মাস্টারি করেন তো কেবল আপনি। এরা দুজনও কী মাস্টার? একই সাবজেক্ট পড়ান আর সেইম বিষয়ে জানতে চান?” আব্দুল খান বোকা নয় মোটেই। তার চোখে স্পষ্ট সন্দেহ।
দীনবন্ধু বলল, “ওকে সঙ্গ দিচ্ছি আমরা। এসেছি স্রেফ ঘোরাঘুরির উদ্দেশ্য।
“ও, আচ্ছা। ঠিক আছে তাহলে এখন রওনা হওয়া যাক। কী বলেন?”
হেঁটেই রওনা হলো সবাই। চাঁদ সওদাগরের ভিটের পুব, পশ্চিম, আর উত্তরে তিনটে বড়ো বড়ো পুকুর। বিঘে চারেক সমান জমির ওপর অড়হরের ডাল চাষ হচ্ছে। একেবারে দক্ষিণে পৌনে এক বিঘে জমির ওপর ফাঁকা জায়গায় প্রায় ছফুটের মতো উঁচু একটা ঢিবি। ঢিবিটার ওপর ডজন খানেক মাথাভাঙা খাম্বা আর গোটা চারেক ভাঙা দেওয়াল দাঁড়িয়ে আছে। আব্দুল খান বলল, “এটাই ক্রাইটনের নীলকুঠি। ঘুরে-ফিরে ভালো করে দেখে নিন। কোনো প্রশ্ন থাকলে করতে পারেন।”
ভাঙা ভবনটার দিকে এগিয়ে গেলেন শরৎ বাবু। পেছন পেছন দীনবন্ধু আর ম্যাডাম জুই। ভালো করে দেখতেই বোঝা গেল বিল্ডিংটা আদতে দোতলা ছিল। এখন মাটির ভেতর পুরো নিচতলাসহ ওপরের অনেকটাই সেঁধিয়ে গেছে। পুরো ঢিবি দুধকিনি, বিছুটি, আর ঘেঁটুর আগাছায় বোঝায়। এখানে-ওখানে এন্তার ভাঙা টালির টুকরো। আধলা ইঁটের ওপর কুলীন সাপের খোলস পড়ে আছে।
“এই সাপখোপে ভরা পোড়ো জায়গায় কীভাবে কী খুঁজব?” জিজ্ঞেস করল দীনবন্ধু। “পাণ্ডুলিপি দূরে থাক, ভবনেরই অস্তিত্ব নেই!”
“এই খান্ডালা খোঁড়াখুঁড়ি করলে কী কিছু পাওয়া যাবে?” জিজ্ঞেস করল ম্যাডাম জুই।
“খেয়াল করে দেখেন ম্যাডাম, এ ভবনের কড়ি-বর্গ অব্দি হাওয়া হয়ে গেছে। সিন্দুক, আসবাবপত্র যে কত আগে গেছে, কে জানে?” দীনবন্ধুর গলায় হাতাশার সুর।
ধসে পড়া ভবনের চারপাশে একপাক ঘুরে এসে শরৎ বাবু আব্দুল খানকে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি বলছিলেন দুটো নীলকুঠি ছিল গৌমালতিতে। এই যদি একটা হয়, তাহলে আরেকটা কোথায়?”
“ওটা আরও তিন কিলো পুবে,” উত্তর দিলো গাইড।
“ওখানে যাওয়া যাবে?”
“অবশ্যই। আপনারা চাইলে এখনই রওনা হতে পারি।”
গাড়ির কাছে ফিরে এলো সবাই। এগিয়ে গেল তিন কিলো পুবে। বহু পুরনো শিরিষ আর রেন্ট্রি গাছে ঘেরা বিঘে দশেক জায়গা। একপাশে লোহা-লক্কড়ের জঙ্গল। চল্লিশ ফিট উঁচু চিমনি আর বয়লারের ধ্বংসাবশেষ। লাইন ধরে ইঁট বাঁধানো প্রকাণ্ড আকারের সব চৌবাচ্চা। ফেটে চৌচির হয়ে গেছে কালের আবর্তে। বাউন্ডারি লাইনে প্রাচীন বৌদ্ধ বিহারের মতো এলো প্যাটার্নে একসারিতে প্রায় পঞ্চাশটা ইঁটের কামরা। ছাদ নেই, শুধু ছফুট উঁচু সারসার দেওয়াল দাঁড়িয়ে আছে। শ্রমিকদের ব্যারাক। ব্যারাকের ওপারে আদিগন্ত বিস্তৃত উত্তর-দক্ষিণ লম্বা চল্লিশ ফিট চওড়া বিশাল এক খাদ। “হেনরি ক্রাইটনের বাসভবনটা কোথায়,” আব্দুল খানকে জিজ্ঞেস করলেন ম্যডাম জুই।”
“ওটা যে কোথায়, জানা নেই আমার। নীলকুঠি বলতে এই দুটো জায়গাই কেবল চিনি।”
“আরও বিস্তারিত জানার কোনো সুযোগ আছে?”
“মালদা মিউজিয়ামের কিউরেটরকে জিজ্ঞেস করা যেতে পারে। তবে তার জন্যে সময় লাগবে।”
“আজই দেখা করা যায় না উনার সাথে?”
“বিকেল পাঁচটা অব্দি খোলা থাকে জাদুঘর। এখনই যদি রওনা হই, তাহলে সাক্ষাৎ করা সম্ভব।”
“ঠিক আছে। এখানে যা দেখার ছিল দেখেছি। চলুন এই বেলা রওনা হওয়া যাক। আপনারা কী বলেন?” শরৎ বাবু আর দীনবন্ধুর দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করল ম্যাডাম জুই।
“এখানে আর বিশেষ কী দেখবো। তারচেয়ে বরং কিউরেটরের কাছেই যাওয়া যাক,” জবাব দিলেন শরৎ বাবু।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন