নজ্জুমি কিতাব – ৫০

শরৎ বাবু আর ম্যডাম জুইকে নিয়ে কিসমত পাঠান যখন বাবুলবোনা রেসিডেন্সিয়াল সেমেটারিতে পৌঁছল, তখন সাড়ে তিনটে বাজে। বিশাল এলাকা জুড়ে ভেঙেপড়া ভীম মোটা বাউন্ডারি ওয়াল। ওয়ালের এপাশে কৃষ্ণচূড়া, রেনট্রি, আর রেনট্রি, নারকোল গাছের সারি। কোনোটারই বয়স একশো বছরের নিচে না। পাঁচিলের গায়ে জংধরা ছোটো এক পাল্লার লোহার গেট। নীরব, শুনশান পরিবেশ। গেটের ওপাশে মোরাম বিছানো রাস্তা, বাঁধানো কবরের সারি, কবর ঘিরে উলু খাগড়ার দঙ্গল। হালকা হাওয়ায় দুলছে উলু খাগড়ার মাথা।

গাড়ি থেকে নেমে গেটের কাছে চলে এলেন শরৎ বাবু। পেছন পেছন পায়ে পায়ে এগিয়ে এলো ম্যাডাম জুই। কাঁধে ঢাউস সাইজের লেডিস ব্যাগ। গেটের ডান দিকে পাঁচিলের এপাশে মহুয়া গাছের ডালে তিনটে কাক বসে আছে। হঠাৎ করেই ঝটপট ডানা মেললো তারা। গোরস্থানের গেটের ওপর শূন্যে পাক খেতে লাগল। সেই সাথে বিশ্রি খ্যা খ্যা ডাক। বিরক্তির চূড়ান্ত। কিছুক্ষণ পরে আগে যেখানে ছিল আবারও সেখানে গিয়ে বসল কাকগুলো। থেমে দাঁড়িয়েছিলেন শরৎ বাবু আর ম্যাডাম জুই। এবার আবারও আগে বাড়লো দুজন।

গেট পেরুতেই আরেক কাণ্ড। দুকান চেপে ধরে লাল সুড়কি বিছানো রাস্তার ওপর হাঁটু গেড়ে বসে পড়েছে ম্যাডাম জুই। সেজদার ভঙ্গিতে সামনে-পেছনে দুলছে। মাটিতে গড়াচ্ছে লেডিস ব্যাগ। এ তো ভারী জ্বালা হলো দেখছি! মনেমনে ভাবলেন শরৎ বাবু। ম্যাডামকে কাঁধ ধরে দাঁড় করালেন। বললেন, “এ কী ম্যাডাম! মাটিতে বসে পড়লেন যে বড়ো। কোনো সমস্যা?”

“ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। হাজার হাজার লাখ লাখ ঝিঁঝিঁ পোকা। কান ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছে। আপনি শুনতে পাচ্ছেন না?”

“কই না তো! এখনও শুনতে পাচ্ছেন ওই ডাক?”

“না। আপনি ধরে ওঠানোর পর থেমে গেছে ওটা।”

“কী করবেন এখন? থাকবেন, না ফিরে যাবেন?”

“ভীষণ দুর্বল লাগছে শরীর। সার্কিট হাউসে ফিরে যাওয়াই ভালো।”

“সে না হয় গেলাম, কিন্তু এমনটা হচ্ছে কেন? এর আগেও তো একবার হয়েছে, তাই না?”

“হুঁ। তবে কেন হচ্ছে কিছুটা বোধ হয় ধরতে পেরেছি।”

“কী কারণ?”

“এখন বলবো না। আগে আরও নিশ্চিত হয়ে নেই, তারপর।”

৫১

বিকেলের দিকে শরৎ বাবুর টিমের সাথে মিটিংয়ে বসল আব্দুল খান। বলল, “পারিশ রেজিস্টার কোথায় আছে জানা গেছে। তবে ওটা সংগ্রহ করা সহজ হবে না। ফাদার যদি স্বেচ্ছায় দেখতে দেন তো ভালো। না হলে, কীভাবে কী করবেন আপনারা ভেবে দেখেন।”

শরৎ বাবু বললেন, “কীভাবে কী বলতে আপনি আসলে কী বোঝাতে চাইছেন? চুরি-ডাকাতি?”

“নির্ভর করছে হেনরির সমাধি খুঁজে বার করা কতখানি জরুরি তার ওপর। যদি একান্তই দরকার হয়, তাহলে আঙুল তো একটু বাঁকা করতেই হবে।”

“ওটা যে খুব জরুরি সেটা আপনাকে কে বলল?”

“কেউ বলেনি। আমি নিজ থেকেই জিজ্ঞেস করছি। কিছু মনে করবেন না।”

শরৎ বাবু দেখলেন এই ট্যুরিস্ট গাইড ব্যাটা মোটেও কোনো সোজ লোক না। মহা ঘোড়েল। মনেমনে অনেক কিছু ভেবে বসে আছে। তারা যে সাধারণ কোনো ট্যুরিস্ট কিম্বা গবেষক নন, সেইটে বিলক্ষণ ধরতে পেরেছে ব্যাটা। ভবিষ্যতে না আবার কোনো ঝামেলা করে বসে এ লোক। ভালো জ্বালা হলো দেখছি! যত গোপনে কাজটা সারা যাবে ভাবা হয়েছিল, মাঠে নেমে দেখা যাচ্ছে তত গোপন থাকছে না ব্যাপারটা।

অবশ্য এ নিয়ে দুশ্চিন্তার কারণ নেই। ঝামেলা হলে ট্রায়াড আছে। ওরাই সামাল দেবে এসব। মুখে বললেন, “ধরুন আঙুল বাঁকা করতে হবে। ওই পদ্ধতিতে কি জিনিসটা আপনি সংগ্রহ করতে পারবেন?

“পারবো, তবে মোটা টাকা খরচা হবে।”

“আচ্ছা ঠিক আছে। প্রয়োজন হলে আপনাকে আমরা জানাবো।”

“কবে জানাবেন? জানেনই তো মালদা ফিরতে হবে আমাকে। এখানে থাকা খরচান্ত ব্যাপার।

“রাহা খরচ নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। দিন প্রতি পাঁচশো টাকা করে পাবেন। যাহোক, কালকের ভেতরেই সিদ্ধান্ত জানাবো আপনাকে। এখন আপনার বোর্ডিংয়ে ফিরে যান। কাল সকাল দশটায় আসবেন। ঠিক আছে?”

“আজ্ঞে, আপনি যা বলেন।”

আব্দুল খান চলে গেলে ম্যাডাম জুই আর দীনবন্ধুকে নিয়ে বসলেন শরৎ বাবু। বললেন, “ওই রেজিস্টার সংগ্রহ করা ছাড়া গতি নেই। আমার মনে হয় এ বিষয়ে ট্রায়াডকে জানানো উচিত। রেজিস্টার তারাই সংগ্রহ করে এনে দিক। আমি বলি কী, ম্যাডাম জুই আপনি ওদেরকে সবকিছু খুলে বলেন। তারপর অনুরোধ করেন, আমরা যাতে রেজিস্টারটা দেখতে পারি সে ব্যবস্থা করতে। ঠিক আছে?”

“হুঁ। আজই জানাচ্ছি ওদেরকে। দেখা যাক কী নির্দেশ আসে।”

“আপনার ঝিঁঝিঁর ডাক শোনার ব্যাপারটা তো বললেন না। এখন কি বলবেন?”

“আমি জানি না এতটা বলা ঠিক হবে কি না। তবুও একসাথে কাজ যখন করছি, তখন বলি। আপনাদের কাছে আল আযিফের যে অংশটুকু ছিল। অর্থাৎ ওই শাহনামা বইটা এখন আমার কাছে। প্রথম যখন বহরমপুরের ওপর দিয়ে যাই, মনে আছে দুপুরের খাবার খেতে নেমেছিলাম গোরা বাজারে? তখনও ও বই আমার কাছেই ছিল। এবারও যখন গোরস্থানে যাই, সঙ্গে ছিল ওটা। তবে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকের তীব্রতা ওখানটায় অনেক বেশি ছিল। আমার ধারণা এই বইয়ের কারণেই ঘটছে এসব। কিছু না কিছু আছে ওই গোরস্থানে।”

“অর্থাৎ আপনি বলতে চাচ্ছেন আমাদের বইটাতে যে অংশ আছে ওটা আপনাকে অন্যান্য অংশগুলোর অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে?”

“কতকটা সেই রকমই। আমার ধারণা পাণ্ডুলিপির এক অংশের সাথে অন্যান্য অংশের নিবিড় সম্বন্ধ আছে। আমার যে অদ্ভুত অনুভব, এটা তারই ইঙ্গিত।”

“কিন্তু ঝিঁঝিঁ পোকা, গাঁধি পোকার ডাক কেন?”

“আল আযিফ আরবি শব্দ। এর অর্থ জানেন?”

“না। অর্থ কী?”

“রাতে যেসব পোকামাকড় বেরোয় তাদের ডাক।”

“তাই নাকি?”

“আজ্ঞে, হ্যাঁ।”

“তাহলে আমরা মোটামুটি নিশ্চিত হতে পারি ওই রেসিডেন্সি সেমিটারিতেই কোথাও আছে পাণ্ডুলিপির হারানো অংশগুলো, ঠিক কি না?”

“আজ্ঞে, হয়তো।”

“তাহলে ট্রায়াডকে বলে আর্মেনিয়ান চার্চের ওই রেজিস্টার ম্যানেজ করা জরুরি। আপনি তাহলে ট্রায়াডের সাথে যোগাযোগ করেন। কী বলেন?”

যোগাযোগ করবো। কিন্তু এই গ্যারন্টি কি আপনারা দিতে পারবেন যে ওই পারিশ রেজিস্টারেই সেমিটারির সমাধিগুলোর লে আউট আছে? পুরো ব্যাপারটাই অনুমান নির্ভর। কোনো নিশ্চয়তা তো নেই। আছে?”

“আজ্ঞে, না।”

“তারপরেও চেক করে দেখতে হবে। ট্রায়াডের সাথে যোগাযোগ করবো আমি। দেখা যাক কী ফলাফল হয়।”

৫২

পরদিন সকাল দশটায় সার্কিট হাউসে আব্দুল খান এসে দেখল হলরুমের সোফায় শরৎ বাবুর টিমের সাথে এক পাদরি বসে আছেন। পরিচয় করিয়ে দিলেন শরৎ বাবু। আব্দুল খান সাহেব, “ইনি হলেন কাহানা, অর্থাৎ ফাদার সিমিয়ন। আর্মেনিয়ান চার্চের আধিকারিক। আর ফাদার ইনি হলেন আব্দুল খান, আমাদের ট্যুরিস্ট গাইড।

“গুড মর্নিং ফাদার, হাউ ডু ইউ ডু,” হ্যান্ডশেক করার জন্যে হাত বাড়িয়ে জবাব দিলো আব্দুল খান। এই সাত সকালে ফাদার এখানে নিজে থেকে এসে বসে আছেন! অবাক কাণ্ড! মনেমনে ভাবল সে।

“আপনি আমাদের চার্চের পুরনো পারিশ রেজিস্টার দেখতে চাচ্ছেন বলে খবর পেয়েছি আমরা। কোনো সনের পারিশ রেজিস্টার দেখতে চান আপনি?”

“১৮০৭ সালের।”

“কোনো সমস্যা নেই। প্রয়োজন মনে করলে এখনই আমার সাথে চার্চে যেতে পারেন আপনি। যে রেজিস্টার দেখতে চান, দেখিয়ে দিচ্ছি। এখানে এনেও দেখাতে পারতাম, কিন্তু চার্চের রেজিস্টার বাইরে বের করার কোনো নিয়ম নেই। একটু কষ্ট করে যদি আমার সাথে আসেন, তো বাধিত হই।”

“অবশ্যই। চলুন এখনই রওনা হই তাহলে।”

শরৎ বাবু বললেন, “আমরাও যেতে চেয়েছিলাম কিন্তু গাড়িতে জায়গা হবে না। দীনবন্ধু তুমি সাথে যাও। কাজ হয়ে গেলে এখানেই ফিরে আসবে। ঠিক আছে?”

“আজ্ঞে, হ্যাঁ,” উত্তর দিলো দীনবন্ধু।

.

গাড়িতে উঠে প্রথমেই যে কথাটা আব্দুল খান ফাদারকে জিজ্ঞেস করল সেটি হলো তারা যে রেজিস্টার খুঁজছে সেটা পাদরি মশাই জানলেন কীভাবে। উত্তরে কাহানা সিমিয়ন বললেন, “গতরাতে কোলকাতার চার্চ অভ হোলি ন্যাজারেথ থেকে একজন সিনিয়র ক্যাথোলিকসের ফোন পেয়েছি। আমাকে বলা হয়েছে আপনাকে যেন সব রকমের সহায়তা দেই।”

“এ ধরনের ফোন কি হরহামেশাই পান আপনারা?”

“আজ্ঞে, না। কালেভদ্রে পাই। শরীরে আর্মেনিও রক্ত বইছে, এমন ব্যবসায়ী কোলকাতায় অনেক। খুব বড়ো আর প্রভাবশালী কোনো ডোনার যদি গির্জার কোনো জ্যেষ্ঠ আধিকারিকের কাছে কোনো সহায়তা চান, আমরা সাধ্যমত সেটা দেওয়ার চেষ্টা করি। এই ব্যাপারটাও অমনই।”

“ও আচ্ছা, বুঝতে পেরেছি।” শরৎ বাবুদের অনেক উঁচু পর্যায়ে যোগাযোগ আছে দেখছি, মনেমনে ভাবল আব্দুল হক।

.

চার্চের রেকর্ড রুমে ঢোকার পর বাঁ-দিক থেকে চার নম্বর আলমিরাটা খুললেন কাহান সিমিয়ন। ভেতরে ফিতে দিয়ে বাঁধা রোল করা কটা রঙের মোম কাগজ। একই সাথে চামড়া বাঁধানো ভীম মোটা রেজিস্টার। রোসট্রামের মতো টেবিলের ওপর রোলকরা কাগজটা মেলে ধরলেন কাহান। ১৭৫৭ সালের বাবুলবোন সেমিটারির ম্যাপ। দশ একর জায়গার ওপর চওড়া রাস্তার দুপাশে সারিসারি কবরের লট। প্রত্যেক পঞ্চাশটা কবরের পর মূল রাস্তা থেকে ডানে-বাঁয়ে সরু রাস্তা বেরিয়েছে। সরু রাস্তাগুলোর দুপাশেও কবরের সারি। কবরস্থানে ঢোকার মুখে বাঁ দিকে মূল রাস্তার পাশে এক নম্বর কবর। ডানে দুই। অর্থাৎ বাঁয়ে বেজোড় আর ডানে জোড় সংখ্যা। এই একই সংখ্যা ভেলামেও আছে। সংখ্যার পাশে কার কবর, কবে জন্ম-মৃত্যু—এসব তথ্য লেখা।

“ম্যাপের কাজ পরে,” দীনবন্ধুকে বলল আব্দুল খান। “প্রথম কাজ হলো ভেলামের বর্ণনা পড়ে দেখা।”

ভেলামে সালগুলো সিরিয়ালি লেখা। পাঁচ নম্বর পৃষ্ঠা শুরু হয়েছে ১৭৭৩ থেকে। বর্ণনা এই রকম: ক্যাপ্টেন স্কিনার, মৃত্যু ১৭৭৩, কবর নম্বর ৫১; জন ক্রেন, মৃত্যু ১৭৮৭, কবর নম্বর ৫২; ফ্রেডারিক গ্রিফিথস, মৃত্যু ১৭৯১, কবর নম্বর ৫৩; দেওয়ানি আদালতের রেজিস্ট্রার ড্যানিয়েল ডিকি, মৃত্যু ১৭৯২, কবর নম্বর ৫৪; মিসেস ক্যারেলিন ব্রাউন, মৃত্যু ১৭৯৮, কবর নম্বর ৫৫; জর্জ টমাস, মৃত্যু ১৮০২, কবর নম্বর ৫৬; জন উইলসন, মৃত্যু ১৮০৩, কবর নম্বর ৫৭; ক্যাপ্টেন ল্যামবার্ট, মৃত্যু ১৮০৫, কবর নম্বর ৫৮; হেনরি ক্রাইটন, মৃত্যু ১৮০৭, কবর নম্বর ৫৯।

এবার গোরস্থানের ম্যাপে গিয়ে দেখতে হবে হেনরি ক্রাইটনের সমাধির অবস্থান। সহজ কাজ। তবে সমস্যা একটা থাকতে পারে। সেটি হলো যদি কোনো কবর একেবারে ধ্বংস হয়ে যায় তাহলে সরেজমিনে নম্বর গুনে আসল সমাধি খুঁজে বের করা কঠিন হতে পারে। তবুও আশার কথা এই যে, কবর উড়ে গেলেও খালি লট থাকবে। গুনতিতে লটটাকে ধরলেই হবে।”

কাহানের কাছে একটা সাদা কাগজ আর কলম চাইল আব্দুল খান। তথ্যগুলো লিখে নিলো। মূল ম্যাপ দেখে খসড়া একটা নকশাও এঁকে ফেলল। নকশায় কেবল ঊনষাটটা কবরেরই রাফ স্কেচ থাকল। কাজ শেষে আব্দুল খান বলল, “শ্রদ্ধেয় কাহান, অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে। দিনটি আপনার জন্য শুভ হোক। বিদায়।”

“ওই একই কামনা আপনার জন্যেও। আমাদের কাছে আর কোনো প্রয়োজন থাকলে, জানাতে দ্বিধা করবেন না। বিদায়।”

দীনবন্ধুকে নিয়ে সোজা বাবুলবোনা রেসিডেন্সিতে চলে এলো আব্দুল খান। তাকে বলল, “আপনি ডান দিক থেকে জোড় সংখ্যা গুনুন। আমি বাঁ দিক থেকে বেজোড়। গোনা শুরু করবেন দুই থেকে। ঠিক আছে?”

“আজ্ঞে, ঠিক আছে।”

৫৩

বাবুলবোনা সেমিটারির কবরগুলো ভারী অদ্ভুত ধরনের। সবকটা সমাধি বাঁধানো। নানান রকমের নির্মাণশৈলী। আয়তকার সাত বাই চার কংক্রিটের প্ল্যাটফর্মের ওপর হিন্দু মন্দিরের মতো ক্রমশ ওপরের দিকে সরু হয়ে যাওয়া চারকোনা চূড়া, বাঁধানো ফ্ল্যাট কবরের পাশে ফেরাউন আমলের ইজিপশিয়ান অবিলিস্ক কিম্বা কারুকাজ করা ইয়া লম্বা রোমান পিলার। অনেকগুলো আবার ছাদঅলা কংক্রিট স্ট্রাকচারের নিচে ঢালাই কবর, চার থেকে তিন জোড়া পিলার ধরে রেখেছে কারুকাজ করা কার্নিশঅলা ছাদ। বেশিরভাগ কবরেরই প্লাস্টার খসে, ইঁট বেরিয়ে গেছে। তবে এক কবরের সাথে আরেকটার গ্যাপ পর্যাপ্ত।

কবর গুনতে গুনতে এক জায়গায় এসে থেমে গেল দুজন। মূল রাস্তা থেকে বাইলেন বের হয়েছে এখানে। বাইলেনের কবরগুলোতে বাটা নম্বর দেওয়া। ডানদিকের গলি শুরু হয়েছে ২/১ নম্বর দিয়ে, বাঁ দিকেরটা ১/১ নম্বর দিয়ে। প্রথমে মূল রাস্তার দুইপাশ শেষ করে পরে দেওয়া হয়েছে বাটা নম্বরের কবরগুলো। বাইলেন পেরিয়ে আরও আটটা কবরের পর পাওয়া গেল ৫৯ নম্বর সমাধি। তিন ফিট উঁচু টেবিলের মতো করে বাঁধানো কবরটা। কবরের সামনে রাস্তার দিকে মুখ করে সিমেন্টের দণ্ডের ওপর সেল্টিক ক্রস। অর্থাৎ একটা নিখুঁত বৃত্তের ভেতর যোগ চিহ্ন। সিমেন্টের দণ্ডের নিচে দেড় ইঞ্চি গভীর একটা আয়তকার জায়গা খালি। ওখানে এক সময় সমাধি ফলক ছিল। খুব সাদামাঠা কাজ। বোঝাই যাচ্ছে বেশি একটা টাকা-পয়সা ছিল না কবরের মালিকের।

বাঁ দিক থেকে বেজোড় সংখ্যার সমাধিগুলো গুনছিল আব্দুল খান। ঊনষাট নম্বরে এসে থামল সে, বলল, “এটাই হিসেব অনুযায়ী হেনরি ক্রাইটনের সমাধি হওয়ার কথা। তবে সাবধানের মার নেই। প্রথম থেকে আবারও গুনে আসতে হবে। আপনার ওদিকে যে কবরটা আছে তার নম্বর ষাট হওয়ার কথা। ঠিক আছে সংখ্যাটা?”

কথাটা বলার পর কোনো উত্তর এলো না দীনের কাছ থেকে। হেনরির কবরের দিকে তাকিয়ে কথা বলছিল আব্দুল খান। উত্তর না পেয়ে তার দিকে ঘুরে চাইল সে। দেখতে পেল—বাইলেন বরাবর বেশ কিছুটা দূরে অদ্ভুত গড়নের ত্রিভুজাকৃতির ছাদঅলা বিশাল একটা বাঁধানো কবরের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে দীন। কাণ্ড দেখে রাগে পিত্তি জ্বলে গেল ট্যুরিস্ট গাইডের। বলল, “এই যে মশাই, হাঁ করে কী দেখছেন ওদিকে? আমি কি বলেছি শুনেছেন আপনি?”

হঠাৎ যেন সম্বিত ফিরল তার। হড়বড় করে বলল, “আজ্ঞে, হ্যাঁ, ঠিক আছে।”

“কথায় কথায় হুঁ ধরবেন না। দেখে বলছেন, না না-দেখে বলছেন? ঠিক করে বলেন?”

“আজ্ঞে, দেখেই বলছি।”

“অতীব গুরু দায়িত্ব পালন করছি আমরা। কাজে মনোযোগ দেন। ঠিক আছে?”

“আজ্ঞে, ঠিক আছে। পুরো ধ্যান দিচ্ছি।”

একেবারে গোড়া থেকে আবারও গুনে এলো দুজনে। গুনতি ঠিক আছে। ওই সেল্টিক ক্রসঅলা কবরটাই হেনরির সমাধি। যা খোঁজা হচ্ছিল, পাওয়া গেছে সেটা। দীনবন্ধু আর আব্দুল খান সার্কিট হাউসে ফিরে দেখা করল শরৎ বাবু আর ম্যাডাম জুইয়ের সাথে। জানাল, আইডেন্টিফাই করা হয়েছে হেনরির কবর। ম্যাডাম বলল, “গাইড সাহেব, ওটাই যে হেনরির কবর সে ব্যাপারে আপনি কতখানি শিয়োর?”

“যদি চার্চের রেকর্ড ঠিক থাকে, তাহলে একশো শতাংশ।”

“তাই?”

“আজ্ঞে, হ্যাঁ। সমাধি খুঁজে দেওয়ার দায়িত্ব দিয়েছিলেন, খুঁজে দিয়েছি। এখন ওটা নিয়ে আমরা কী করবো?”

“আপাতত কিছুই করবেন না। আজকে অনেক খাটা-খাটনি করেছেন। কালকে রেস্ট নিন। পরশু আপনাকে জানাবো কী করতে হবে।”

“রেস্ট আর কী নেবো। যদি চান তো কাল সকালে কবরটার কাছে আপনাদের নিয়ে যেতে পারি।”

“তার কোনো প্রয়োজন দেখছি না। দীনবন্ধু তো আপনার সাথেই ছিল। সে-ই ওটা দেখিয়ে দিতে পারবে।”

“ঠিক আছে আপনাদের যা মর্জি। চলি তাহলে,” একথা বলে অনিচ্ছাসত্ত্বেও উঠে দাঁড়াল আব্দুল খান। কবর নিয়ে কী করা হবে জানার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠেছে।

“কবর তো পাওয়া গেল। এখন কী করণীয়?” আব্দুল খান বিদেয় নিতেই জিজ্ঞেস করলেন শরৎ বাবু।

“মাইরি বলছি আপানি এখনও বুঝতে পারছেন না ওটা নিয়ে কী করবো!” ম্যাডাম জুইয়ের কণ্ঠে অবিশ্বাস।

“ওটা কি আপনি খুঁড়তে চাচ্ছেন?”

“অবশ্যই।”

“কিন্তু ওই বেআইনি কাজ দিন-দাহাড়ে করবেন কীভাবে? কবর খুঁড়তে গেলে হাজার লোকে দেখবে। পুলিশ-প্রশাসন-চার্চের লোক-স্থানীয় বাসিন্দা—ধুন্ধুমার লেগে যাবে! পাণ্ডুলিপি খোঁজা দূরে থাক, জেল জরিমানা হবে আমাদের! তাছাড়া মৃতের শান্তি বিনষ্টেরও একটা বিষয় আছে!”

“বেআইনি, মৃতের শান্তি বিনষ্ট—এসবই যদি আপনার ভাবনার বিষয় হয়, তাহলে এ মিশনে এসেছেন কেন? আপনি তো কচি খোকা নন। খড়ের চটি আগেই সব ব্যাখ্যা করেছেন আপনার কাছে। কাজ শুরু করার পর মাঝপথে এসে এসব বোলচাল ঝাড়লে হবে?”

ম্যাডাম জুইয়ের কাটাকাটা কথা শুনে থম মেরে গেলেন শরৎ বাবু। তবে মুখ খুলল দীনবন্ধু। বলল, “ঠিক আছে। আপনার কথা মতোই কাজ হবে। এখন বলেন গোপনে খোঁড়াখুঁড়ি করবেন কীভাবে? আর কারা করবে ওই কাজ?”

“আজ রাতেই খোঁড়া হবে। মাঝরাত থেকে চারজন লোক খুঁড়তে শুরু করবে ওখানে। আশা করছি ভোর চারটের ভেতর খোঁড়া শেষ হবে। রাত নটার দিকে আপনাকে সাথে নিয়ে একজন সেমেটারিতে যাবে। কবরটা চিনিয়ে দেবেন ওকে। সমাধি আইডেন্টিফাই করার পর এখানে ফিরে আসবেন আপনি। শেষ রাতে তিনজনে মিলে ওখানে যাবো আমরা। ওই সময়ে আমাদের ওখানে থাকা জরুরি। অবশ্য আপনারা দুজন যদি থাকতে না চান, তো সেটা আপনাদের সিদ্ধান্ত। তবে একথা ভুলবেন না ওই পাণ্ডুলিপি খুঁজে দেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছেন আপনারা। অন্তত শ্রদ্ধেয় খড়ের চটি আমাদের সে ধারণাই দিয়েছেন।”

“না না, আমরা অবশ্যই থাকবো,” এবার কথা বললেন শরৎ বাবু। “কিন্তু ব্যাপারটা যেন গোপনে করা হয়। আইনি ঝামেলায় কে পড়তে চায় বলুন? ছাপোষা মানুষ আমরা, এ ধরনের অ্যাডভেঞ্চার করে অভ্যেস নেই। বুঝলেন না? হে হে হে।”

“ঠিক তিনটের সময় সেমিটারিতে যাবো আমরা।”

“তাহলে তো কিসমতকে আগে থেকে বলে রাখতে হবে।”

“না। তাকে কিছুই বলা যাবে না। আমাদের ওখানে নিয়ে যেতে অন্য গাড়ি আসবে। এসব বিষয়ে তৃতীয় কাউকে না জড়ানোই ভালো। তাছাড়া, ওই ড্রাইভারের সাথে আব্দুল খানের খাতির আছে। অতি সহজেই সবকিছু জেনে ফেলবে সে। মহা ধুরন্ধর ওই ট্যুরিস্ট গাইড। ছোঁকছোঁক করছে সব সময়। এরই ভেতর অনেক কিছু সন্দেহ করেছে।”

“কিন্তু গোর খোঁড়ার কাজটা করবে কারা?” জিজ্ঞেস করল দীনবন্ধু।

“ট্রায়াডের লোকেরা। ওসব নিয়ে আপনাদের ভাবতে হবে না। আমাদের কাজ খোঁড়া শেষ হলে তার ফলাফল নিয়ে। ঠিক আছে?”

“আলবাৎ। তবে রাত তিনটেয় সার্কিট হাউস থেকে বের হলে সন্দেহ করবে না এখানকার লোকেরা?”

“ওসব নিয়ে ভাবতে হবে না। এখানকার লোকদের ম্যানেজ করার ভার আমার ওপর ছেড়ে দিন। ভোর তিনটের সময় আপনারা দুজন আমার রুমের দরজায় নক করবেন। একসাথে বেরুবো।”

৫৪

ভোর তিনটের সময় সার্কিট হাউস থেকে ম্যাডাম জুইকে সাথে নিয়ে বেরিয়ে শরৎ বাবু আর দীনবন্ধু দেখল: গাড়ি-ঘোড়ার কোনো চিহ্নও নেই কোথাও। ঘটনা কী? ম্যাডামের দিকে চাইতেই সে বলল, “গাড়িটা একটু দূরে পার্ক করা হয়েছে। কিছুটা এগুলেই পাওয়া যাবে।”

ডানে মোড় নিয়ে একশো ফিট হাঁটতেই এগিয়ে এলো কালো রঙের অ্যাম্বাসেডর। দূর থেকে নজর রাখছিল ড্রাইভার। একবার হেডলাইট জ্বালিয়েই নিভিয়ে দিলো। তৎক্ষণাৎ পরপর দুবার টর্চ জ্বালল ম্যাডাম জুই। সংকেত বিনিময় শেষ। পাশে এসে ঘ্যাস করে ব্রেক করল গাড়ি। দরজা খুলে চড়ে বসতেই ধীরে আগে বাড়ল, দশ মিনিটে পৌঁছে দিলো বাবুলবোনা সেমিটারির গেটে।

নিঃশব্দ পরিবেশ, আকাশে চাঁদ নেই। ঘোর আঁধারে ডুবে আছে চরাচর।

গাড়ি থেকে নেমে ম্যাডাম জুই বলল, “দীনবন্ধু বাবু, হেনরির কবর আগেই দেখে গিয়েছেন আপনি। আপনি আগে আগে যান, পেছন পেছন আমরা যাবো।”

ঊনষাট নম্বর কবরের কাছে পৌঁছে দেখা গেল, টেবিল আকারের সিমেন্টের বেদির নিচে মাটি খুঁড়ে বিরাট এক সুড়ঙ্গ করে ফেলা হয়েছে। ওপরের বেদিটার ঠিক নিচেই সাত বাই চার ফিট সাইজের একটা ঘরের মতো। হুডঅলা চারটে বড়ো বড়ো পেট্রোম্যাক্সের আলোয় পুরু কাঠের কালচে রঙের কফিন দেখা যাচ্ছে ওটার মেঝের ওপর। একটু দূরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে কাপড়ে মুখ ঢাকা চারটে লোক। চাপা গলায় ম্যাডাম জুই বলল, “শরৎ বাবু, দীনবন্ধুকে সাথে নিয়ে বাইরে বের করে আনুন কফিনটা। তারপর ওটার ডালা খুলুন।”

“কিন্তু . . . ওই লোকগুলোকে বললে ভালো হতো না?” কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন শরৎ বাবু।

“না। কফিনে হাত ছোঁয়াতে মানা করা হয়েছে ওদের। আপনাদেরকেই করতে হবে কাজটা। আর হ্যাঁ, যা করার জলদি করুন। কাজ হয়ে গেলে আবারও মাটি সমান করে আগের মতো করে রাখতে হবে সবকিছু। নষ্ট করার মতো সময় আমাদের হাতে নেই। দয়া করে যদি-কিন্তু বাদ দিয়ে কাজে হাত লাগান।”

গর্তের ভেতর নেমে কফিন টেনে জমিনের ওপর বের করে আনতে কালঘাম ছুটে গেল শরৎ বাবু আর দীনবন্ধুর। ধুলো- মাটিতে সয়লাব পুরো শরীর। ভেতরে লাশের ওজন নেই ঠিক, তবে শাল কাঠের মজবুত কফিনের ভার অনেক। ভাগ্য ভালো, হাতল লাগানো রয়েছে কফিনটার চারপাশে। না থাকলে ওই গন্ধমাদন টেনে ওপরে নিয়ে আসা ভীষণ কঠিন হয়ে যেত তাদের জন্যে।

কফিনের আঙটায় ঝোলানো আদ্যিকালের জংধরা তালা। গাঁইতির চাঁড় দিতেই মট করে ভেঙে গেল। দুই প্রান্ত ধরে কফিনের ডালা তুলে ধরল শরৎ বাবু আর দীনবন্ধু। একটা পেট্রোম্যাক্স উঁচু করে কফিনের ভেতর উঁকি দিলো ম্যাডাম জুই। দুশো বছর আগের ছেঁড়া-ফাটা কালো রঙের কলোনিয়াল স্যুট, টাই, সাদা লিনেনের শার্ট, আর দোমড়ানো কালো রঙের জুতো পরা ক্ষয়ে যাওয়া নরকঙ্কাল। ডান হাতের কব্জির নিচে কাঠের ছোটো একটা বাক্স। বাঁ হাত দিয়ে কাঠের বাক্সটা উঠিয়ে নিলো ম্যাডাম জুই। কফিনের পাশে ঘেসো জমিনের ওপর রেখে খুলল ওটা। ভেতরে রঙচটা রোঁয়া ওঠা লাল ভেলভেটের ওপর রুপোলি একটা কয়েনের মতো চাকতিতে কালো কালিতে চীনে হরফ লেখা। লেখাটা দেখা মাত্র মুখ কালো হয়ে গেল ম্যাডাম জুইয়ের। এতক্ষণে দীনবন্ধু আর শরৎ বাবুরও চোখে পড়েছে ওটা। শরৎ বাবু বললেন, “ওখানে কী লেখা, ম্যাডাম?”

“সান হি হুই। ওটার অর্থ স্বর্গ-মর্ত্য-মানুষ। ট্রায়াডের সিম্বল।”

“যাহ, এ-ও কী সম্ভব!”

পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, পাণ্ডুলিপিটা ছিল এখানে। তারপর ট্রায়াডেরই কেউ হাতিয়ে নিয়েছে ওটা। সেই বাবার আমলেই। এ যেন ফেরাউনের সমাধি, কবর দেওয়ার সাথে সাথে লুট!

বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরো।

“এ সমাধি লুট হয়েছে হেনরির দাফন হওয়ার পরপরই। সবার অজান্তে। শুধু তাই না। যে লুট করেছে সে আবার ব্লুও রেখে গেছে, যাতে ভবিষ্যতে কেউ যদি এ অব্দি এসেই পড়ে, তাহলে যেন জানতে পারে কে বা কারা করেছে এই কাজ!”

এরই ভেতর নিজেকে সামলে নিয়েছে ম্যাডাম। বলল, “ওখান থেকে উঠে আসুন আপনারা। সাথে কয়েনটাও নিয়ে আসুন। এখন কবর যেভাবে ছিল, সেভাবেই রাখতে হবে। ভোর হতে বেশি দেরি নেই। আমার লোকেরা হাত লাগাবে এখন।”

হন হন করে হেঁটে সেমেটারির গেট পেরিয়ে গাড়িতে উঠতে যাবে, এমন সময় পাশের মহুয়া গাছটার তলা থেকে ছায়ামূর্তির মতো কে যেন বেরিয়ে এলো। পরক্ষণেই খ্যানখেনে গলায় বলল, “এই যে, মশাইরা। একটু দাঁড়াবেন?”

চমকে উঠল শরৎ বাবুর টিম। আব্দুল খানের গলার আওয়াজ না? হুঁ, একদম তাই। মনে মনে ভাবল তারা। এদিকে কাছে চলে এসেছে আব্দুল খান। বলল, “আপনারা এত রাতে এখানে! ঘটনা কী?”

আগে-পিছে না ভেবেই দীনবন্ধু ফট করে বলে ফেলল, “এই যে এনাদের হেনরির কবর দেখাতে এনেছিলাম। ওরা তো দেখেননি।”

“ওহ হো তাই বুঝি? তা এই রাত দুপুরে!”

“রাতের বেলা নিরিবিলি, ওনাদেরও ঘুম আসছিল না। তাই আরকি।”

“সে কারণে নিশুতি রাতে সংগোপনে গোরস্থানে ঘোরাঘুরি! দারুণ বলেছেন মাইরি। তা আপনি আর শরৎ বাবু কি সেমেটারির মাটিতে কুস্তিও লড়েছেন? ধুলো-মাটিতে বোঝায় গায়ের পোশাক। হা হা হা। তা কবর খুঁড়ে দেখা কি শেষ, জনাব?”

আবারও চোখের পলকে নিজেকে সামলে নিলো ম্যাডাম জুই। বলল, “গাইড সাহেব, আমাদের সাথে আসুন। সার্কিট হাউসে গিয়ে সব বুঝিয়ে বলছি আপানকে। কেমন তো?”

“বেশ বলছেন যখন, চলুন।”

ড্রাইভারকে ম্যাডাম জুই বলল, “এক্ষুণি সার্কিট হাউসে যাওয়ার দরকার নেই। এখনও আঁধার হয়ে আছে চারদিক। ঘণ্টাখানেক বাইরে ঘোরাঘুরি করে তারপর সার্কিট হাউসে যাও।”

.

ঘণ্টাখানেক এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরির পর সার্কিট হাউসে পৌঁছে হলরুমে ঢুকেই সবার জন্যে নাস্তার অর্ডার করল ম্যাডাম জুই। বলল, “আপনারা একটু বসুন, রুম থেকে ফ্রেস হয়ে আসছি আমি।”

রুমে এসে টেলিফোনে ট্রায়াডকে সবকিছু জানাল জুই। নির্দেশনাও পেল সাথে সাথে। বিশেষ করে আব্দুল খানের ব্যাপারে। এই ছাপোষা ট্যুরিস্ট গাইড যে এমন উটকো ঝামেলা বাধিয়ে ফেলবে কে জানত? তাকে এসবের ভেতরে টেনে আনার কারণে ক্ষুব্ধ হয়েছে ট্রায়াড। আব্দুল খানকে এখানে আনার সিদ্ধান্ত একান্তই ম্যাডাম জুইয়ের। কিন্তু এখন আর কিছু করার নেই। ভুলটা শোধরাতে হবে, যেভাবেই হোক। হলরুমে ফিরে এসে ম্যাডাম জুই দেখল নাস্তা দেওয়া হয়েছে টেবিলে। মাদ্রাজি খাস্তা পরোটা, ছোলার ডাল, সবজি, অমলেট; সাথে কমলার রস।

নাস্তা শেষ হওয়ার পর চা খেতে খেতে ম্যাডাম জুই জিজ্ঞেস করল, “আব্দুল খান সাহেব, আপনি আমাদের ওখানে খুঁজে পেলেন কীভাবে?”

“ওখানে মানে? গোরস্থানে?”

“আজ্ঞে, হ্যাঁ।

“আপনারা যখন আমাকে সার্কিট হাউস থেকে বিদায় জানলেন তখনই আমি যে বোর্ডিংয়ে থাকি সেখানে ফিরে যাইনি। আমার সন্দেহ হয়েছিল শিগ্রিই কিছু একটা করবেন আপনারা। কারণ আপনাদের কাজকর্মের ভেতর এক ধরনের তাড়াহুড়ো লক্ষ করেছি। পারলে কালকের কাজ আজই করে ফেলেন। কিন্তু কী করবেন, সেইটে বুঝতে পারছিলাম না। ভাবলাম সার্কিট হাউসের ওপর নজর রাখলে কেমন হয়? আপনারা কেউ একজন বেরুলে তাকে ফলো করলে কিছু না কিছু জানা যাবে।

“স্রেফ আন্দাজের ওপর ভর করে রাত নটা অব্দি অপেক্ষা করে টায়ার্ড হয়ে বোর্ডিংয়ে ফিরে যাবে, এমন সময় দেখলাম সার্কিট হাউস থেকে দীনবন্ধু বাবু বেরিয়ে আসছেন। দূর থেকে দেখলাম আরেক জন অপরিচিত লোক এসে যোগ দিলো তার সাথে। ভাগ্য ভালো, রিকশা নিয়ে রওনা হয়েছিল তারা। আরেকটা রিকশা ভাড়া করে আমিও পেছন পেছন গেলাম।

“যা ভেবেছি তাই। সেমেটারিতে গিয়ে থামল দীনবন্ধু বাবুর রিকশা। গেট থেকে অনেকটা দূরে আমার রিকশা ছেড়ে দিয়ে পায়ে পায়ে এগিয়ে এলাম। দেখলাম, লোকটাকে নিয়ে ভেতরে ঢুকলেন দীনবন্ধু বাবু। বেরিয়েও এলেন অল্প কিছুক্ষণ পরই। বুঝলাম হেনরির সমাধি চিনিয়ে দিতেই এখানে আসা। আমার আরও মনে হলো আজ রাতেই কিছু একটা ঘটবে এখানে।

“শহরে ফিরে এসে খেয়েদেয়ে রাত বারোটার দিকে সেমেটারির গেটের কাছে পৌঁছেছি, এমন সময় দেখলাম কারা যেন টর্চ জ্বালিয়ে এদিকপানে হেঁটে আসছে। বুঝলাম, এরা সাধারণ লোক না। এদের হাতে পড়লে বিরাট ঝামেলা হয়ে যাবে। লুকাতে হবে কোনো এক জায়গায়। এদিক-ওদিক তাকাতেই ফটকের ডান পাশে ঝাঁকড়া মহুয়া গাছটা চোখে পড়ল। গাছে উঠে মোটা একটা ডাল বেছে নিয়ে ঠাঁয় বসে রইলাম। দেখতে লাগলাম কারা কী করে। আপনারা যখন সমাধি থেকে ফিরে এলেন তখন ভাবলাম গাছের ডালে বসে থেকে আর লাভ নেই। এখন সময় হয়েছে কী পেয়েছেন ওখানে সেইটে জানার। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো ওখানে কী পেয়েছেন তা এখন অব্দি জানা হয়নি। কী পেয়েছেন ওখানে?”

“যদি ভেবে থাকেন আমরা যা খুঁজছি তা পেয়েছি, তাহলে ভুল করবেন।”

“আসলে কী খুঁজছেন আপনারা?”

“সেইটে বলা যাবে না। তবে এটুকু জেনে রাখুন টাকা-পয়সা, হিরে-জহরত খুঁজছি না আমরা।”

“তাহলে কী খুঁজছেন? গুপ্তধনের নকশা?”

“তা-ও না।”

“তাহলে কী? গোপন কোনো নথিপত্র?”

“বললাম তো বলা যাবে না।”

“দেখুন আপনারা যদি নন-কোঅপারেট করেন, তাহলে চলবে কীভাবে?”

“আপনি আসলে কী চান?”

“আমি চাই আপনাদের এই খোঁজাখুঁজির কাজে শরিক হতে। সত্যি কথা বলতে কী, প্রথম থেকেই আমার সন্দেহ হয়েছে। ওসব গবেষণা-ফবেষণা সব বুজরুকি। গবেষণাই যদি উনি করবেন, তাহলে এত দলবল নিয়ে আসার দরকার কী? সার্কিট হাউসে থাকছেন, এন্তার টাকা খরচা হচ্ছে। একজন ছাপোষা স্কুল মাস্টারের পক্ষে কি এতকিছু সম্ভব? সবকিছুর ভেতর কেমন একটা তাড়াহুড়ো। গবেষণার কাজে তাড়াহুড়ো থাকবে কেন? তাছাড়া, উনার চাইতে আপনার কমান্ডই বেশি মনে হয়েছে। গবেষণা করছেন উনি, আর হুকুম করছেন আপনি! আপনাদের তিনজনের ভেতর কেমন একটা ঢাকঢাক গুড়গুড় ব্যাপারও আছে। আপনাদের সাথে সময় কাটালে যেকেউ বুঝবে। ট্যুরিস্ট গাইড হিসেবে কাজ করছি আজ পাঁচ বছর। হাজার হাজার মানুষের সান্নিধ্যে এসছি এ সময়ে। লোক দেখলে কার কী উদ্দেশ্য বুঝতে পারি আমরা। যাহোক, কী খুঁজছেন সেইটে বলবেন না। না বলুন, হেনরির সমাধিতে কী পেয়েছেন, সেইটে অন্তত বলুন।”

“একটা ক্লু পেয়েছি।”

ভালো কথা। সেই ক্লু ধরে এখন এগিয়ে যেতে হবে, তাই তো?”

“আজ্ঞে, হ্যাঁ। তবে তার আগে আমরা জানতে চাই আপনাকে আমাদের দলে যদি না নেই, তাহলে আপনার সিদ্ধান্ত কী হবে?”

“কর্তৃপক্ষকে জানাতে বাধ্য হবো আমি। ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলোতে ঘোরঘোরি করছেন, রাতের আঁধারে ষণ্ডামার্কা লোকদের দিয়ে দুশো বছরের পুরনো গোরস্থানে খোঁড়াখুঁড়ি চালাচ্ছেন! অথচ আপনারা গবেষক নন, পশ্চিম বঙ্গ সরকার কিম্বা আর্কিয়োলজিক্যাল সার্ভে অভ ইন্ডিয়ার অনুমতি নেওয়া তো দূরের কথা। আমরা ট্যুরিস্ট গাইড। ঐতিহাসিক স্থাপনা রক্ষা আমাদের কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। ওগুলো দেখিয়েই দুবেলা খেতে পাই আমরা।”

“স্রেফ আপনার মুখের কথা শুনে আমাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে কর্তৃপক্ষ?”

“মালদা মিউজিয়ামের কিউরেটর সুবোধ বাবু সাক্ষী দেবেন। উনার কাছে গিয়েছেন আপনারা। তাছাড়া, আর্মেনিয়ান চার্চের কাহানও আরেক সাক্ষী।”

হঠাৎ মুখ খুললেন শরৎ বাবু। ম্যাডাম জুইয়ের কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে খুব নিচু স্বরে বললেন, “আব্দুল খান সাহেবকে এককালীন কিছু টাকা দিয়ে দিলে হয় না? টাকা নিয়ে মালদা ফিরে যাক উনি। গিয়ে আবারও ট্যুরিস্টদের ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে গৌড়ের ধ্বংসাবশেষ দেখানো শুরু করুক। কী বলেন, ম্যাডাম?”

“টাকা নিয়েও যে উনি আমাদের কথা ফাঁস করে দেবেন না সে নিশ্চয়তা কোথায়? পাণ্ডুলিপি না পাওয়া অব্দি একে কাছে কাছে রাখাই উত্তম।” এবার আব্দুল খানকে উদ্দেশ্য করে ম্যাডাম জুই বলল, “ঠিক আছে, আমাদের টিমে কাজ করবেন আপনি। আগেই বলেছি এখনও অধরাই রয়ে গেছে মিশন। যা-ই খুঁজি না কেন শেষমেশ যদি পাই, তাহলে তো দেখতেই পাবেন। এখন বলেন এসবের বিনিময়ে আপনি কী চান?”

“চারভাগের একভাগ বখরা।”

“ওহ, আচ্ছা। ঠিক আছে মেনে নিলাম আপনার শর্ত। কাল এখান থেকে কোলকাতা ফিরে যাবো আমরা। এরপর ক্লু ধরে এগোবো।”

ব্লু ধরে তো এখান থেকেই এগোনো যায়। এর জন্যে কোলকাতা ফিরতে হবে কেন? ধরুন, আপনার কথা অনুযায়ী কোলকাতা ফিরে গেলাম তারপর স্টাডি করে দেখা গেল এই বহরমপুরেরই কোনো একটা জায়গা নির্দেশ করছে ব্লু, তখন তো আবার এখানেই ফিরে আসতে হবে। ঠিক কি না?”

“আপনার কথায় যুক্তি আছে। তবে যতটুকু বুঝতে পারছি কোলকাতায় না ফিরে উপায় নেই আমাদের। কারণ, ওই ব্লুয়ের গোড়া রয়েছে ওখানেই। সুতরাং কালকে আমাদের সাথে কোলকাতা যাচ্ছেন আপনি। ওখানে শরৎ আর দীনবন্ধু বাবুর থাকার জায়গা আছে। আপনি থাকবেন চায়না টাউনে। একটা ঘরের ব্যবস্থা আমার করে দেবো।”

“শরৎ বাবুদের সাথেই থাকতে চাই আমি।”

“আপনাদের ওখানে এর থাকার জায়গা হবে, শরৎ বাবু?

“হতে পারে। মেস ম্যানেজারের সাথে কথা বলে দেখতে হবে। যদি না হয়, তাহলে আপনার জায়গা তো রইলই।”

.

আব্দুল খানকে নিয়ে মেসে ফিরতেই মেস ম্যানেজার অনীল কুণ্ডুর সাথে দেখা হলো শরৎ বাবু আর দীনবন্ধুর। অনীল কুণ্ডু বলল, “আরে মশাই, এতদিন কোথায় ছিলেন আপনারা? বাংলাদেশ থেকে অর্জুন নামের এক ভদ্রলোক এসছেন। রোজ দর্জিপাড়া থেকে সকালে আসেন এই মেসে, বিকেলে ফিরে যান। আজও এসে বসে আছেন আমার আপিস ঘরে। দাঁড়ান, পাঠিয়ে দিচ্ছি এখন।”

“কুণ্ডু মশাই, আমাদের সাথে একজন অতিথি আছেন। ইনার থাকবার জন্যে একটা ঘর চাই। খালি আছে কোনো ঘর? থাকলে দেওয়া যাবে?”

“পুব দিকে কোনার একটা ঘর খালি আছে। কিচেনের পাশে। ওখানা দেওয়া যাবে। তা কদ্দিন থাকবেন ইনি?”

“এই ধরুন সপ্তাহ দুয়েক।”

এক মাসের নিচে ঘর ভাড়া দেওয়া যাবে না। তা সে দুহপ্তাই থাকুন কিম্বা এক হপ্তাহ। ভাড়া পুরো এক মাসেরই দিতে হবে। রাজি থাকলে ঘর দেখিয়ে দিচ্ছি। কি, দেখাবো?”

“আচ্ছা, এক মাসের ভাড়াই দেবো। ঘর দেখান আপনি। আর হ্যাঁ, আপনার আপিস ঘরে আগে চলুন। অর্জুনের সাথে দেখা করতে হবে।”

সিদ্ধান্ত হলো—অর্জুন আপাতত দীনবন্ধুর সাথে মেসেই থাকবে। দর্জিপাড়া থেকে কাপড়-চোপড় নিয়ে এলো সে। দীনবন্ধু এ পর্যন্ত যা যা ঘটেছে সংক্ষেপে জানাল তাকে। সব শুনে অর্জুন বলল, “শোনো দীন, তোমার মায়ের শরীর ভালো না। এজন্যে কাকা বাবু আসতে পারেননি, পাঠিয়েছেন আমাকে। কাকিমা সুস্থ থাকলে উনি নিজেই আসতেন। আমি বলি কী, বাদ দাও এসব। ও বই সর্বনাশা। শুরু থেকেই অঘটন ঘটেই চলেছে। কাকা বলে দিয়েছেন, পত্রপাঠ তোমাকে নিয়ে দেশে ফিরতে। চলো, কালই ফিরে যাই আমরা। তুমি যেমন পাসপোর্ট, ভিসা ছাড়া এসেছ, আমিও তেমনি। বিশু মেড়োর লোক বউ বাজারে কারবার করে। ওর কাছে গেলে বর্ডার পার করার ব্যবস্থা করে দেবে। চলো, কালই রওনা হই।”

“তা হয় না, অর্জুন। এতদূর এসে এর শেষ না দেখে ছাড়ছি না আমি। আর বড়োজোর এক সপ্তাহ। এর ভেতরেই হ্যাস্ত-ন্যাস্ত কিছু একটা হয়ে যাবে। আমি বলি কী, এই সাতদিন তুমি এখানে থাকো। কোলকাতা শহরটা ঘুরেফিরে দেখো। তারপর দুজনেই একসাথে কুষ্টিয়া ফিরবো। কেমন তো?”

“তাহলে কাকা বাবুকে কী বলবো এখন?

“তুমি দর্জিপাড়া গিয়ে পিসেমশাইকে বলো, বেনারসে বেড়াতে যাবো আমরা দুজন। এক সপ্তাহ পর ওখান থেকে ঘুরে এসে একসাথে বাংলাদেশে ফিরবো।”

“আমি একা যাবো? তুমি পিসেমশাইয়ের সাথে দেখা করবে না?”

“একবার তো দেখা করে এসেছি। বড্ড ঝামেলা করেন পিসি মা। এখন গেলে বলবেন, আমাদের এখানে দুদিন থেকে কুষ্টিয়ায় ফিরে যা। পরে আরেকবার এসে বেনারস যাবিখন। ওপারে দাদা- বৌদি দুশ্চিন্তা করছেন, এখন আর কোথাও গিয়ে বেড়ানোর দরকার নেই। তাছাড়া কাল সকালে শরৎ বাবুকে নিয়ে কাজে বেরুতে হবে।”

“বেশ, তুমি যা ভালো মনে করো।”

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন