গভর্নরের সামনে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হলো রাইদাকে। শান্ত চোখে তার দিকে চোখ তুলে তাকালেন রুইয়ানি। দারফুর বলল, “এই মেয়ে, মহামান্য সুলতান যা যা জিজ্ঞেস করবেন, সেসবের ঠিকঠাক উত্তর দিবি।”
“তুমি গোপনে আল-জওফ মরুদ্যানে কারো সাথে দেখা করো?” জিজ্ঞেস করলেন গভর্নর রুইয়ানি।
“জি, সুলতান।”
“কেন?”
“সুলতানা রুখসানার চিঠি নিয়ে যাই আমি। এক ছেলেকে দেই।”
ভয়ানক চমকে উঠলেন রুইয়ানি। তবে মুখে সেটা প্রকাশ পেল না। আবারও শান্ত গলায় বললেন, “নাম কী ওই ছেলের? থাকে কোথায়?”
“ওর নাম আব্দুল আল হযরত। কোথায় থাকে জানি না। শুনেছি আল আমিরিয়া মাদ্রাসার তালেব এলেম সে।”
নাম শুনে আরেকবার চমকালেন গভর্নর। কবিতা-টবিতা লিখে বেশ নাম করেছে এই আল হযরত। শহরের চ্যাংড়া ছেলেপুলে এর লেখা গান রাস্তাঘাটে গেয়ে বেড়ায়। তাহলে এই আল হযরতের প্রেমে পড়েছে রুখসানা। রেশমি কাপড়ের টুকরোয় প্রেমপত্র লিখে রাইদার হাতে দিয়ে পাঠাচ্ছে! কিন্তু ওই অপদার্থ কাপুরুষটার সাথে রুখসানার পরিচয় হলো কীভাবে? ঘামদান প্রাসাদ থেকে বের হওয়া এত সহজ না। মেয়েদের জন্যে তো আরও কঠিন। তাহলে কী এখানে যা ঘটছে সেসব খবর তিনি ঠিকমত পাচ্ছেন না? তার অজান্তে ছুঁচোর নেত্য চলছে প্রাসাদে! নাহ বিষয়টা ভেবে দেখতে হচ্ছে। মুখে বললেন, “রুখসানার সাথে এ ছেলের দেখা হলো কোথায়?”
“হুজুর তো জানেন যে ঈদের আগে প্রাসাদের মেয়েদের বাজারে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়, যাতে দোকানে দোকানে ঘুরে নিজেদের পছন্দ মতো সদাইপাতি করতে পারে। তো সুলতানা রুখসানাকে নিয়ে আবু ওবায়দাহর রেশমি কাপড়ের দোকানে গিয়েছিলাম একবার। ওই দোকানের পাশেই ঘানিমের গাওয়াহি[৪]য়ের দোকান। নানান বয়সের লোকেরা বসে সারাদিন আড্ডা দেয় ওই জায়গায়। আল হযরত ওখানকার নিয়মিত খদ্দের। নতুন নতুন কবিতা লিখে লোকেদের শোনায়। এখানেই তাকে সুরেলা গলায় কবিতা পড়তে দেখে রুখসানা। আমাকে বলে, ‘রাইদা। ওই ছেলেটাকে ডেকে নিয়ে আয় দেখি।’ ওবায়দার দোকানের পাশে একটা পুরনো কানা গলি আছে। খুবই শুনশান আর নির্জন গলি। ওখানেই আলাপচারিতা, শেষে প্রণয়। কিন্তু ইশক যত গভীরই হোক, সুলতানার পক্ষে হামেশা প্রাসাদের বাইরে যাওয়া সম্ভব না। প্রেমের চিরকুট আদান-প্রদানের কাজ আমার ওপরই বর্তায়। মালকিনকে পইপই করে নিষেধ করেছি একাজ করতে। কিন্তু আমার কথা কানেও তোলেননি উনি,” এক নিশ্বাসে এতগুলো কথা বলে থামল মরোক্কান বাঁদি রাইদা।
বাঁদির কথা শুনে রক্ত চড়ে গেল রুইয়ানির মাথায়। নগর কোতোয়াল হামযা ইবনে ইউসুফকে ডেকে বললেন, “এক্ষুণি আল আমিরিয়া মক্তবে যাও। ওখানকার মুদিরে কবির আবেদ বিন কাহহার-কে আমার কথা বলবে। বলবে, ‘আল হযরতকে গ্রেফতার করে দরাবারে নিয়ে আসার জন্যে ফরমান জারি করা হয়েছে। ধর্ম অবমাননার অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে।”
—
৪. সুগন্ধি পাতা আর মশলা দিয়ে বানানো চা জাতীয় পানীয়
কবি হিসেবে সানায় এমনিতেই যথেষ্ট কানাঘুষা রয়েছে আব্দুল আল হযরতের নামে: ওর লেখাজোখায় শরিয়ত সমর্থন করে না, এমন সব বিষয়ের ছড়াছড়ি। হামযার পেয়াদারা যখন মক্তবে পৌঁছাল, আল হযরত তখন বড়ো হুজুর আবেদ বিন কাহহারের হুজরায় রাতের খাওয়া সারছে। লাহমি আল মায়েজি আল মাশুইয়ের সাথে আল খুবজাল সাখিন। সোজা বাংলায় ঝলসানে দুম্বার মাংসের সাথে তন্দুরি রুটি। সাথে শশা, পেঁয়াজের সালাদ আর দস্তার জগভরতি উটের দুধের লাবান। বড়ো ইমামের সাথে বসে খাওয়ার এই বিরল সম্মান পুরো মক্তবের ছাত্রদের ভেতর একমাত্র তার কপালেই মাঝে-সাঝে জোটে। তবে ভালো-মন্দ খাওয়ার আইটেম হলে তবেই।
এর পেছনে কারণও আছে। আল হযরতের জন্ম সানা থেকে প্রায় দেড়শো কিলোমিটার উত্তরে ঊষর পাহাড়ি এলাকায় আল হাযম নামের ছোটো এক শহরে। বিন কাহহারের বাড়িও ওখানেই। আল হযরতের বাবার সাথে টুকটাক আলাপ-পরিচয়ও ছিল এক সময়। ছোটোবেলায় গ্রামের মক্তবে একসাথে পড়েছেন দুজনে। মক্তবের পড়া শেষ হলে আরও বেশি লেখাপড়ার জন্যে আল কাহহার চলে এলেন সানায়। ওদিকে হাযমে থেকে ব্যাবসা- বাণিজ্যে মন দিলো আল হযরতের বাবা। শুরু করল আরবের জিযান থেকে লবণ আর আভা থেকে ফলমূল এনে হাযমে বিক্রি করা। যাতায়াত করতে লাগল ছোটো ছোটো কাফেলার সাথে। পাড়ি দিলো শত শত কিলোমিটার দুর্গম পাহাড়ি মরুপথ। প্রচণ্ড খরতাপ, জল-কষ্ট, রাতে হাড়-কাঁপানো ঠান্ডা। বেদুইন ডাকাতের হাতে পড়ে সর্বস্ব খোয়ানোর ষোলো আনা সম্ভাবনা। তবে একবার মাল-সামান নিয়ে ফিরে আসতে পারলে মোটা টাকা লাভ। এভাবেই বিপদের সাথে পাঞ্জা লড়ে কোনোরকমে দিন পার করছিল আল হযরতের বাবা। তবে হঠাৎ করেই উলটোদিকে ঘুরল ভাগ্যের চাকা।
আল হযরতের বয়স যখন মাত্র পাঁচ বছর ঠিক সেই সময় দক্ষিণের মারিব থেকে আসা এক কাফেলার সাথে জিযানের পথে রওনা হলো তার বাবা। সেই যে গেল, ফিরল না আর। বাবার কপালে কী ঘটেছিল সেইটে হয়তো কোনোদিনই জানা যেত না, তবে ওই যে, ঘুরেই চলেছে ভাগ্যের চাকা। জীবনে এমন ঘটনা ও ঘটে যা কল্পনাকেও হার মানায়। আল হযরতের বাবা নিরুদ্দেশ হওয়ার পর পেরিয়ে গেল দুবছর। এরই ভেতর তার মা মোটামুটি নিশ্চিত হয়েছে স্বামী আর কোনোদিনই ফিরবে না। বেদুইন গাঁটকাটাদের হাতে যদি মারা গিয়ে না-ও থাকে, অন্য কোথাও বিয়ে-শাদি করে থিতু হয়েছে। পুরুষ মানুষে বিশ্বাস নেই! বাড়ি বাড়ি ঝি-গিরি করে আল হযরতের মা যখন কোনোমতে সংসার চালাচ্ছে, ঠিক তখনই ঘটলো আরেক ঘটনা। বিন ফকিহ নামের এক মুসাফির এসে আশ্রয় নিলো তাদের বাড়িতে। তালি দেওয়া জোব্বাপরা রোদজ্বলা পাঁশুটে চেহারা। কোঁচকানো মুখে কালচে ঠোঁটের দুকোণে সাদাটে ফেনা। কটা রঙের লম্বাটে চুল-দাড়িতে জট ধরেছে। ডান হাতে তেল চকচকে জয়তুনের বাঁকানো লাঠি। কাঁধে মোটা কাপড়ের ছেঁড়াফাটা ঝোলা।
মেহমানদারিতে আরবের মানুষ দুনিয়া খ্যাত। মুসাফিরকে খুব খাতির-যত্ন করল আল হযরতের মা। খেতে দিলো উটের ঘন দুধ মেশানো আর মধু মাখানো সাহন, ভেড়ার ভুনা মাংসের সাথে সাদা ধপধপে খবুজ। এক রাত থেকে পরদিন সকালেই ঝোলা গুছিয়ে আবারও পথে বেরুল মুসাফির। যাওয়ার সময় আল হযরতের মাকে ডেকে বলল, “শোনো, মা। তোমার স্বামীর ফিরে আসার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। মারিবের যে কাফেলার সাথে সে গেছে সেই কাফেলা আসলে মারিবের হলেও তার শেষ গন্তব্য ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন এক জায়গা। সুদূর উত্তরাঞ্চলের ওয়াদেয়া এলাকার আল শারারাহ নগরী।
“নাহ, মারিবের কাফেলার বণিকেরা আল হযরতের বাবার গলা কেটে মরুভূমির বালিতে পুঁতে রাখেনি। জিযান থেকে লবণ নিয়ে আরও উত্তরে আল শারারাহর পথে রওনা দেয় তোমার খসম। চির রহস্যময় আর অতি দুর্গম রাব আল খালি মরুভূমির শুরুই হয়েছে এই নগরীর পুব পাশ থেকে। তিব্বতের লাসার মতই নিষিদ্ধ এক জনপদ। ভারী অদ্ভুত ওখানকার লোকেরা! নিজ এলাকার বাইরে কখনও যায় না তারা। নিজেদের মাঝে বাইরের কাউকে এক মাসের বেশি থাকতেও দেয় না। মুসাফির কিম্বা বণিকদের অনুমতি নেই স্থানীয়দের সাথে ওঠা-বসা, খানা-পিনা, বিয়ে-শাদির। ধন-সম্পদের অভাব নেই তাদের। যে কোনো জিনিসের বিনিময় মূল্য খাঁটি সোনা কিম্বা রুপো দিয়ে পরিশোধ করে শারারাহবাসী। একবার পণ্য নিয়ে পৌঁছতে পারলে লালে-লাল হয়ে যাবে যে কেউ। সমস্যা হলো ওখানে যাওয়ার রাস্তা জানা আছে কেবল মারিবের লোকেদেরই। যেতেও হয় ওই মারিবের ভেতর দিয়েই। আর খুব কম ভিনদেশি বণিককেই মারিবের লোকেরা শারারাহতে নিয়ে যায়। অন্য পথে গেলে পানি আর রসদের অভাবে মারা পড়ার শতভাগ সম্ভাবনা। ব্যাপার আরও একটা আছে আর সেটাই হলো সবথেকে বড়ো সমস্যা। ঝামেলাটা হলো ওখান থেকে ফিরে আসা। যাওয়ার সময় মারিবেরা লোকেরা থাকবে, কিন্তু শারারাহতে ব্যাবসা-বাণিজ্য করে ফেরার পথে কেবল মারিব অব্দিই সঙ্গ পাওয়া যাবে তাদের। মারিব থেকে সোনা-রুপো নিয়ে বাড়ি ফিরতে হবে স্রেফ একা। অথবা থাকতে হবে মারিব থেকে কবে কোন কাফেলা বেরোয়— সেই আশায়। আর বেরুলেও সেইটে অপেক্ষায় থাকা ওই বণিকের নিজ এলাকার দিকে যাবে কি না, সেটাও ভেবে দেখতে হবে। মারিবে থাকতে গেলে মেলা ভেজাল। ওখানে ভিনদেশি কেউ থাকলে বড়ো অঙ্কের কর দিতে হয়। অত্যাধিক বেশি সরাইখানার উজরা[৫]। মাসের পর মাস অপেক্ষায় থাকতে থাকতে দেখা যাবে লাভের গুড় পিঁপড়েতেই সাবড়ে দিয়েছে।
[৫. ভাড়া]
“শারারাহর সাথে অন্যান্য এলাকার যোগাযোগ খুব কম। উত্তরের এই বাজপড়া জনপদের মেলা দুর্নাম। এখানে হরদম চলছে জাদু-টোনা, জিন-ইফরিতের কারবার। আর এর পেছনে প্রধান কারণ হলো আল শারারাহ থেকেই রাব আল খালি মরুভূমির শুরু। রাব আল খালি এমন এক জায়গা যেখানে শুধু যাওয়াই যায়, ফিরে আর আসা যায় না। আদ্যিকালে অভিশপ্ত সামুদ জাতি বাস করত ওখানে। রানি বিলকিসের রাজ্য সেবার সবথেকে রহস্যময় অংশ ছিল ওটা। কারণ, বহুকাল আগে রাব আল খালি মোটেও কোনো খালি জায়গা ছিল না। এখানেই তৈরি করা হয়েছিল সা’দ বিন আদের বিখ্যাত ইরাম নগরী। এই ইরামই হলো সাদ্দাতের বেহেশত। এ শহর কত বছর আগে তৈরি হয়েছিল বলা শক্ত। কেউ কেউ মনে করে নূহ নবির আমলে যে মহাপ্লাবন হয়েছিল, এই নগরী বানানো হয়েছিল তারও আগে। দারুণ উঁচু সব পিলারের কারণে টিকে যায় এ জনপদ। কিন্তু এ অনেক লম্বা কাহিনি। এই দীর্ঘ বর্ণনা শোনার ধৈর্য আর সময় কি তোমার হবে?”
“হযরতের বাবার কাছে সাদ্দাদের বেহশতের কথা শুনেছি। কিন্তু সেসব খুবই সামান্য আর ভাসাভাসা। পুরনো দিনের কাহিনি শুনতে আমার খুব ভালো লাগে। আপনি বলেন, শুনছি আমি।” বললো আল হযরতের মা।
আবারও কথা শুরু করল বিন ফকিহ, “ইরাম নাম করেছিল শহরের লাখ লাখ অতিকায় খিলান আর স্তম্ভ বা পিলারের কারণে। আকাশ ছোঁয়া স্তম্ভের ওপর প্রকাণ্ড সব ইমারত কোনো মানুষ নির্মাণ করেনি। ধারণা করা হয় গোপন বিদ্যে ছিল সাদ্দাতের কাছে। আর এই মামনুন বিদ্যে কাজে লাগিয়ে জিনদের বশ করেছিল সে। এই জিন আর তাদের সন্তানেরা রাতদিন খেটে তৈরি করে ইরাম। জিনেরা যদি কেবল ভবন বানিয়েই ক্ষান্ত থাকত তাহলে তেমন সমস্য হয়তো হতো না। ঝামেলা হলো তখন যখন তারা ইরামের যুবতীদের সাথে মেলামেশা আরম্ভ করল। মানুষ আর জিনের এই মিলনের ফলে জন্ম নিলো দৈত্যের মতো এক শ্রেণির অতিকায় মানুষ। সারাদিন এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়ায় এরা। অত্যাচার করে সাধারণ মানুষদের ধরে। আর খায় কত একেক জন! এক দিনেই উড়িয়ে দেয় দুমণ ময়দার সাথে পরিমাণমতো ঘি আর দুম্বার মাংস। তখনও এখনকার মতো খালি হয়ে যায়নি রাব আল খালি। এন্তার হরিণ, বুনো শুয়োর, জঙলি ঘোড়া, আর উট ছিল ইরাম থেকে শুরু করে ওমান অব্দি লাখ লাখ ক্রোশ এলাকার তৃণভূমি জুড়ে। জংলি জানোয়ার শিকার করে ঝলসে খাওয়া দানবগুলোর কাছে এক বিরাট উৎসবের ব্যাপার হয়ে দাঁড়াল। দেখতে দেখতে খতম হয়ে গেল বুনো পশুগুলো।
“কাউকে বসিয়ে খাওয়ানো সাদ্দাতের নিয়মে নেই। ফরমান জারি করা হলো—কাজ করতে হবে এই মানুষরূপী দানবগুলোকেও। কী আর করা, এরাও এদের জিন বাবাদের সাথে হাত লাগালো নিমার্ণ কাজে। আহলে কিতাবে এই দানবদের বলা হয়েছে নেফিলিম বা আনুনাখি। সেখানে অবশ্য জিনের কথা বলা হয়নি। বলা হয়েছে ফেরেশতা বা দেবদূতের কথা। লেখা আছে দেবদূত আর এ দুনিয়ার যুবতীদের মেলামেশার ফসল হলো নেফিলিম।
“যার শুরু আছে তার শেষও আছে। অকল্পনীয় সৌন্দের্যে মোড়া বিপুলাকৃতির ইরাম নগরীর নির্মাণ কাজ যখন প্রায় শেষের দিকে, ঠিক সেই সময় বড়ো ধরনের এক সমস্যা দেখা দিলো!
এক অনিন্দ্যসুন্দরী তরুণী মেয়ে ছিল সাদ্দাদের। নাম— সানাবু। একদিন দুপুরে প্রাসাদের উঠোনে কৃত্রিম ঝরনার নিচে স্ফটিকে তৈরি নীলাব্জ জলাশয়ে স্নান করছে সানাবু, এমন সময় তার ওপর চোখ পড়ল জিন সর্দারের ছেলে যিলযিলার। জিন- মানুষের শংকর না যিলযিলা। একশো ভাগ আসল জিন। জিনদের পইপই করে বলে দেওয়া হয়েছিল—তারা যেন কোনো অবস্থাতেই রাজ পরিবারের কোনো মেয়ের সাথে সম্পর্কে না জড়ায়। কোনো দানব নাতি-নাতনির নানা হতে চান না শাহেনশাহ সাদ্দাদ। কিন্তু যিলযিলার মাথা একেবারেই কাজ করছে না তখন। নিষেধাজ্ঞার কথা সম্পূর্ণ ভুলে গেল সে। সানাবুকে তুলে নিয়ে চলে এলো আল ক্বারা পাহাড়ের ছায়াছায়া শীতল গুহায়। সারা দুপুর তাকে ইচ্ছেমতো ভোগ করল যিলযিলা। তারপর পড়ন্ত বিকেলের লাল আলোয় প্রাসাদের সামনে সানাবুকে ফেলে দিয়ে চলে গেল ওমানের দোফারে। এ এক অতি দুর্গম পাহাড়ি এলাকা। কার সাধ্যি এখানে খুঁজে পায় তাকে! প্রাসাদের প্রহরীরা দেখল ফটকের সামনে রাস্তায় পড়ে আছে কে যেন। কাপড়ের বালাই নেই শরীরে, লুতাভুতা অবস্থা। আরে, এ যে রাজকুমারী সানাবু!
“ঘটনা শুনে রাগে ফেটে পড়ল সাদ্দাত। এত বড়ো স্পর্ধা! বাদশার মেয়ের সাথে বলৎকার! প্রধান মন্ত্রীকে ডেকে এনে আলোচনায় বসলেন তিনি। মন্ত্রী পরামর্শ দিলো: এখনই হুটোপাটা করে কোনো কিছু করার দরকার নেই। নগরী নির্মাণ আর অল্প একটু বাকি। এই কাজ শেষ হোক আগে। তারপর দেখা যাবে কী করা যায়। রাজকন্যার সর্বনাশ কে করেছে, সেইটে জানা গেছে। রাজকুমারী নিজেই সব বলেছে। কিন্তু কামিনাটার বিরুদ্ধে এখনই কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না। হাজার হোক জিন সর্দারের ছেলে এই যিলযিলা। কিছু করতে গেলে বেঁকে বসবে জিন আর নেফিলিমের দল। আক্রমণ করে বসতে পারে রাজপ্রাসাদ! এদের মোকাবেলা করবে, এত সিপাহী নগরীতে নেই। তারচেয়ে বরং ধুল কাফফানের প্রধান পুরোহিতকে ডেকে আনা হোক।
“ধুল কাফফানের প্রধান পুরোহিত রাজধানীতে থাকে না। সে বাস করে শহর থেকে একশো ক্রোশ দূরে প্রাগৈতিহাসিক বির বারহুতের পাশে গড়ে ওঠা এক পাথুরে মন্দিরে। তবে যিলযিলাকে শাস্তি দেওয়া হলেও সমস্যা একটা থেকেই যাবে। আর সেটাই আসল ফ্যাকড়া। প্রশ্ন হলো নগরী নির্মাণ শেষ হলে জিন আর তাদের অতিকায় সন্তানদের নিয়ে কী করা হবে? তাদেরকে বসিয়ে খাওয়ানো অসম্ভব। শেষ হয়ে যাবে রাজকীয় ভাণ্ডার। সাদ্দাদের অধীনে এক লাখ সুলতান, প্রতি সুলতানের অধীনে এক লাখ রইস আল কাবিলা। আর প্রত্যেক রইসের অধীনে এক লাখ করে সৈন্য। পশ্চিমে কেনান[৬] থেকে শুরু করে পুবে হাতামতি[৭] অব্দি যত দেশ-জাতি আছে সেসবই সাদ্দাদের অনুগত। এদের সবাইকে জড়ো করে রণসাজে সাজিয়ে জিন আর নেফিলিমদের সাথে যুদ্ধ করা যেতে পারে। তবে এই লড়াইয়ের ফলাফল কী হবে, সে বিষয়ে নিশ্চিত করে কিছু বলা যাচ্ছে না। দুপক্ষেরই পাল্লা ভারী। তবে জিন আর দানবের রয়েছে অতিলৌকিক ক্ষমতা। মানুষের সংখ্যা যত বেশিই হোক, ঐশ্বরিক ক্ষমতা ব্যবহার করতে না পারলে যুদ্ধে টিকে থাকা অসম্ভব।
[৬. বর্তমানে ইজরায়েল
৭. বর্তমানে ইরান]
“ভেবেচিন্তে বির বাহুতের পাথুরে মন্দির আজিগুরাটে নিজেই যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন সাদ্দাদ। সভাসদেরা বলেছিল দূত পাঠিয়ে ধুল কাফফানের প্রধান পুরোহিত যিলকিয়াজেডেক-কে দরবারে ডেকে এনে সবকিছু বলা হোক। কিন্তু সম্রাট তাতে রাজি হলেন না। এ এক অতি বড়ো সিদ্ধান্ত। সাম্রাজ্যের বাঁচা-মরা নির্ভর করছে এর ওপর। হাটের মাঝখানে বসে যিলকিয়াজেডেক গুহ্যকথা আলোচনা করবে—এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই। তাছাড়া, আজিগুরাটে ধুল কাফফানের অধিষ্ঠান। ওই জায়গায় জাগ্রত এই অপদেবতা। মন্দিরের গর্ভগৃহে দেবতার সান্নিধ্যলাভ যত সহজে হয়, ইরাম নগরীর রাজদরবারে ততখানি কিছুতেই হবে না। ধুল কাফফান ভালো কোনো দেবতা না। তার মেজাজ-মর্জি বোঝা খুব শক্ত। একটু ঊনিশ-বিশ হলেই মিথ্যে ভবিষ্যতবাণী শুনিয়ে ধোঁকা দেবে। আর একবার ধোঁকায় পড়লে ধ্বংসের হাত থেকে ফিরে আসার কোনো পথ নেই।
“পরদিন সকালে হাজারখানেক দেহরক্ষী, শ-পাঁচেক রাঁধুনি, চাকর-নফর, আর উটের পিঠে এন্তার রসদ চাপিয়ে সোনা-রুপো, নীলকান্তমণি দিয়ে সাজানো রাজকীয় তাঞ্জামে চড়ে আজিগুরাটের পাথুরে মন্দিরের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন সাদ্দাদ। ওটা বয়ে নিয়ে চলল পেল্লায় চেহারার ষোলোজন কুশ ক্রীতদাস। তাঞ্জামের ভেতর চারজন অনিন্দ্য সুন্দরী যুবতী আতর-গোলাপ ছিটিয়ে ছোটো চামর দুলিয়ে হাওয়া-বাতাস দিতে লাগল সারসের পালক দিয়ে বানানো তাকিয়ায় হেলান দিয়ে বসা সাদ্দাদের গায়ে। তার সামনে সোনার থালায় উর্দুনী আঙুরের মদ, মেসোপটেমিয়ার শুকনো আবহাওয়ায় জলের সেঁচ দিয়ে জন্মানো অতি উৎকৃষ্ট গমের সাদা রুটি, আর দজলা-ফোরাত নদীর দোয়াব এলাকা থেকে ধরা বালুহাসের ঝলসানো মাংস।
“যথেষ্ট দ্রুত চলেও সাদ্দাদের বহরের সারাদিনের সর্বোচ্চ গতিবেগ দিনে দশ ক্রোশ। এই রাফতারে চললে যেতে এগারো দিন, আসতে এগারো দিন। তারপর ওখানে থাকতে হবে আরও সাতদিন। কারণ, বিশ্রাম দিতে হবে সৈন্য আর বেহারাদের। এক মাসের কারবার। যতই লোক-লস্কর, খাবার-দাবার, মদ- মেয়েমানুষ থাকুক না কেন, দুর্গম মরুভূমির বিচিত্র চরিত্র সবকিছু লণ্ডভণ্ড করে দিতে পারে যেকোনো সময়। ধেয়ে আসতে পারে মরুঝড় সাইমুম। পুরো কাফেলায় মরণ কামড় বসাতে পারে প্রাণাঘাতী পীত জ্বর। রাতের বেলা হঠাৎ করেই হিমাঙ্কের নিচে নেমে যেতে পারে তাপমাত্রা। স্থানীয় ভাষায় একে বলে—শামাল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই অসাড় হয়ে পড়বে হাত-পায়ের মাংসপেশী। মৃত্যু তখন কেবল সময়ের ব্যাপার।
“লাগাতার নয় দিন চলার পর বির বাহুত যখন আর মাত্র দশ ক্রোশ দূরে, ঠিক তখনই দুঘর্টনাটা ঘটল। রাব আল খালিতে বছরে মেরেকেটে এক কিম্বা দুদিন বৃষ্টি হয়। পরিমাণে অতি সামান্য। আগে যখন ওটা খালি ছিল না, তখনও খুব একটা বৃষ্টি হতো না ও এলাকায়। চাষ-বাস হতো উন্নত সেচ ব্যবস্থা ব্যবহার করে। নদিন ধরে লাগাতার পথ চলে ক্লান্তির শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে কাফেলা। চ্যাটচেটে ঘামে ভেজা কাফেলার প্রতিটি নারী-পুরুষের শরীর। পোশাকে বিজবিজ করছে ধুলো-বালি। পুরো রাস্তায় মাত্ৰ তিন জায়গায় পাতকুয়ো পাওয়া গেছে। মানুষেরা যতখানি পানি খায়, জানোয়ারেরা খায় তার দশগুণ। পেটভরে পানি খেয়ে খালি মশকগুলো ভরতেই কুয়োর জল তলানিতে। গোসল, হাত-মুখ ধোয়া এক অসম্ভব ব্যাপার। সন্ধে ঘনাতেই তাঁবু খাটিয়ে, খেয়ে- দেয়ে শুয়ে পড়ল বেশিরভাগ যাত্রী। পাহারায় থাকল মাত্র শ-খানেক সৈন্য। মাঝরাতের দিকে ঘন কালো মেঘে ছেয়ে গেল আকাশ, বইতে লাগল হিলহিলে ঠান্ডা হাওয়া। সেই সঙ্গে শুরু হলো তুমুল বর্ষণ।
“সাদ্দাদের লোকেরা তাঁবু খাটিয়েছিল উঁচু উঁচু ঢিবির মতো বালিয়াড়ির মাঝখানে সমান জায়গার ওপর। দেখতে দেখতে প্রথমে টাখনু গিরে তারপর হাঁটু অব্দি পানি জমে গেল। বরফের মতো ঠান্ডা পানিতে ভিজে সপসপে হলো শতশত লোক, উট- ঘোড়া-গাধা। ভারী বর্ষণ একটু কমতেই কাফেলার সবাই যখন হি হি করে কাঁপছে, ঠিক সেই সময় ধেয়ে এলো হিম শীতল উত্তুরে বাতাস। শামাল। কী মানুষ, কী পশু–ঠান্ডায় দাঁতে দাঁত লেগে খটাখট শব্দ হতে লাগল। ঊষর মরুভূমির গরম মোকাবেলা করে অভ্যস্ত সবাই। তীব্র ঠান্ডার আক্রমণ ঠেকানোর কোনো উপায় তাদের জানা নেই। নেই উপযুক্ত কাপড়-চোপড়। সঙ্গে আনা লাকড়ি জ্বালিয়ে আগুনে হাত-পা যে শেঁকবে সে উপায় কোথায়? ভিজে ন্যাতা হয়ে গেছে জ্বালানী কাঠ আর শুকনো ডালপালা। ভোর হওয়ার আগেই প্রচণ্ড শীতে আইনখিফাদ হারারাত আল জিসমে[৮] আক্রান্ত হয়ে মারা পড়ল কাফেলার আদ্দেক লোক। বাকি আদ্দেক কোনোমতে টিকে গেলেও, বেদম জ্বরে ধুঁকতে লাগল তারা। দেখা গেল সাদ্দাদের একশোজন কুশ বেহারার ভেতর কাজ করার মতো অবস্থায় আছে মাত্র দশ জন। বাকি নব্বই জনের ভেতর ইহজগতের মায়া কাটিয়েছে পঞ্চাশ জন, কালান্তর জ্বরে কাতরাচ্ছে বাকি চল্লিশ। কী আর করা, জনা বিশেক দেহরক্ষী নিয়ে আজিগুরাটের পথে ঘোড়ায় চড়ে রওনা হলেন সাদ্দাদ।
[৮. অতিরিক্ত ঠান্ডায় রক্ত জমাট বেঁধে যাওয়া]
“দুপুরের পর চোখে পড়ল রাস্তা চলে গেছে দুসারি ধূসর পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে। এখানে-ওখানে মাথা উঁচিয়ে আছে বড়ো বড়ো পাথরের চাঁই। ক্রোশ পাঁচেক চলার পর কালো হয়ে এলো পাহাড়ের রং। রাস্তার দুপাশ থেকে নিরেট দেওয়ালের মতো খাড়া উঠে গেছে পাথুরে ঢাল। মাত্র তিনটে ঘোড়া চলতে পারে পাশাপাশি। এরপর আরও সরু হয়ে এলো রাস্তা। দুটো ঘোড়া চলার মতো চওড়া। তারপর স্রেফ একটা। ক্রমেই উঁচুতে উঠছে পথ। সামনে পড়ল পেল্লায় এক সমতল পাষাণ চত্বর। ওটার উলটোদিকে ধাপে ধাপে উঠে গেছে কুচকুচে কালো পাথুরে পাহাড়ের গা কেটে বানানো অসংখ্য সিঁড়ি। সিঁড়ির মাথায় ছোট্ট একটা বারান্দা মতো জায়গার উলটোদিকে তেকোনা মাথাঅলা এক গুহামুখ। আবলুস কাঠের ভারী দরজা লাগানো তাতে। দরজার পাশে লোহার আংটায় ঝুলছে পেতলের তৈরি ইয়া বড়ো ঘণ্টা। ঘণ্টার লটকন বা জিভে লাল কাপড়ের ফালি বাঁধা। ওই কাপড়ের ফালি ধরে ঝাঁকালেই ঢং ঢং করে বাজবে ঘণ্টা। ভেতর থেকে সাড়া দেওয়া হবে দরজার ওপর লাগানো একটা ফোঁকড় খুলে।
“তবে এসব নিয়ম-কানুন হলো সাধারণ দর্শনার্থীদের জন্যে। সম্রাট সাদ্দাদের কথা আলাদা। গুহামুখের দরজা খুলে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এসে পাথরের চাতালে অপেক্ষা করার কথা যিলকিয়াজেডেকের। দুদিন আগেই দ্রুতগামী ঘোড়ায় রাজদূতসহ পাঁচজনের ছোটো একটা কাফেলা পাঠানো হয়েছে। পাহাড়ের ওপর থেকে নিচে পথের ওপর নজর রাখার কথা দলটার। সম্রাটের আসা বহুদূর থেকে চোখে পড়বে তাদের। যিলকিয়াজেডেককে এত্তেলা পাঠিয়ে প্রস্তুত রাখতে পারবে সিঁড়ির গোড়ায়। যেন মহামান্য সম্রাটকে সাদর অভ্যর্থনা জানাতে পারে প্রধান পুরোহিত মশাই
“কিন্তু কোথায় কে? শুনশান নীরব চারদিক। কেউ কোথাও নেই! খাঁ খাঁ করছে পাহাড়ি পরিবেশ। মাঝেমধ্যে পাহাড়ের চুড়ো থেকে ধেয়ে আসছে দমকা বাতাস। পাক খেয়ে ওপরে উঠে যাচ্ছে রাজ্যের ধুলোবালি। ঘোড়া থেকে নেমে চারজন দেহরক্ষী নিয়ে পাহাড়ের ঢাল কেটে বানানো সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে রইলেন সাদ্দাদ। মহামান্য সম্রাটকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্যে কেউ নেই! এমন বিব্রতকর অবস্থায় জীবনে কখনও পড়েননি সাদ্দাদ। চারজন দেহরক্ষীর ভেতর দুজন তৎক্ষণাৎ ধাপ বেয়ে উঠে গেল সিঁড়ির মাথায় তেকোনা দরজার কাছে। মাথার বহু ওপরে লাল কাপড়ের ফেটি বাঁধা লটকন টেনে ঘণ্টা বাজানোর ঢং ঢং আওয়াজ উঠল। পর পর তিনবার ঘণ্টা বাজানোর পর খুলে গেল আবলুশ কাঠের তেকোনা দরজা। ঢেউ খেলানো বাবরি চুল আর বেণি করা দাড়িঅলা সাদা আলখাল্লাপরা এক মাঝবয়সি পুরোহিতের সাথে কথা হলো দেহরক্ষী দুজনের। তারা নিচে নেমে সম্রাটকে জানাল গত তিনদিন ধরে যিলকিয়াজেডেক মন্দিরের গর্ভগৃহে ঢুকে বসে আছে, সম্পূর্ণ একা। নির্দেশ দিয়ে গেছে বের হয়ে না আসা অব্দি কোনো অবস্থাতেই বিরক্ত করা যাবে না তাকে। বছরের এই সময়টাতে মহান ধুল কাফফানের কাছে নিজেকে পুরোপুরি সমর্পণ করে যিলকিয়াজেডেক। দেবতা তাকে একান্ত অনুগত মনে করে আশির্বাদ করলেই কেবল গর্ভগৃহ থেকে বের হয় পুরোহিত মশাই। মহামান্য সম্রাট যদি পুরোহিতের সাথে কথা বলতে চান, তাহলে যিলকিয়াজেডেক মন্দির থেকে বের হয়ে না আসা অব্দি অপেক্ষা করতে হবে তাকে।
“কিন্তু আগে যে পাঁচজনের ছোটো একটা দলকে পুরোহিতের কাছে পাঠানো হয়েছিল, তাদের কী হলো? জানতে চাইলেন সম্রাট। জানা গেল এ প্রশ্নের উত্তরও। ওই পাঁচজন কারও কথা না শুনে জোর করে গর্ভগৃহে ঢুকেছিল। পই পই করে তাদের বারণ করা হয়েছিল এ কাজ যেন না করে। কিন্তু তারা নাছোড়বান্দা। প্রধান পুরোহিতের সাথে দেখা করবেই করবে। যে কোনো মূল্যে! সবকজনই একসাথে গর্ভগৃহে ঢুকেছিল। সে-ও দুদিন আগে। এখন অব্দি একজনও বের হয়ে আসেনি!
“যিলকিয়াজেডেক কবে বের হবে ঠিক নেই। অনির্দিষ্ট কালের জন্যে অপেক্ষায় থাকা সম্ভব না। বিশাল ভূখণ্ডের দণ্ড-মুণ্ডের কর্তা সাদ্দাদ। কোটি কোটি লোক দেবতার মতো ভক্তি করে তাকে। কারও সাথে সাক্ষাতের জন্যে অপেক্ষা করার ধৈর্য তার নেই… তা সে যতবড়ো ভূস্বামী কিম্বা পুরোহিতই হোক। তবুও ধুল কাফফানের প্রধান পুরোহিত বলে কথা। এ লোকের ক্ষমতা মেলা। আর প্রয়োজনটাও তার নিজের। সমস্যাটা এমন, অন্য কেউ এর সমাধান করতে পারবে না। পুরো সাম্রাজ্যে এই একজনই আছে। কী আর উপায়, অপেক্ষা করারই সিদ্ধান্ত নিলেন সাদ্দাদ। তবে সিঁড়ির গোড়ায় পাথুরে চত্বরে না, ভেতরে নিরাপদ পরিবেশে ভদ্রস্থ কোনো জায়গায়। দলবল নিয়ে তেকোনা দরজা দিয়ে ঢুকে বিরাট এক সুড়ঙ্গ পেরুলেন তিনি। এরপর বেরিয়ে এলেন বাটির মতো খোলা এক জায়গায়। চারদিকে উঁচু পাথুরে প্রাচির দিয়ে ঘেরা সবুজ ঘাসে ঢাকা গোলাকার প্রান্তর। প্রান্তরের একপাশে ঘিরে টলটলে নীল পানির জলাশয়। এখানে-ওখানে জলপাই, বেদানা, আর কমলা গাছের ঝাড়। বৃত্তাকার ঘেসো প্রান্তরের ঠিক মাঝখানে হলদে পাথরে তৈরি ষাট হাত উঁচু চারকোনা হারিম[৯]। হারিমের চার দেওয়ালের মাঝখানটা জুড়ে নিচ থেকে ওপর অব্দি চওড়া সিঁড়ির সারি। হারিমের চুড়ো সমতল বর্গাকৃতি। এই সমতল পাষাণ চত্বরের ওপর কালো পাথরে তৈরি নিখুঁত বর্গাকার চারকোনা মন্দির। মন্দিরের ওপর চারকোনা বুরুজের মতো দুটো মিনার। একটা বেঁটে, আরেকটা উঁচু। বেঁটে বুরুজ মন্দিরে ঢোকার দরজার পরে লম্বা সুড়ঙ্গ পেরিয়ে মাঝারি আকারের এক কামরার ওপর। উঁচুটা গর্ভগৃহের ছাদের ওপর।
[৯. পিরামিড]
“মন্দিরের কাছে ঘেসো জমির ওপর তাঁবু খাটাল সাদ্দাদের লোকেরা। মহা আড়ম্বরে চলল খানাপিনা। নিয়মিত বসতে লাগল মদের আসর, হই হই করে চলতে লাগল পাশাখেলা। এক দিন, দুদিন করে তিন দিন কাটল। গর্ভগৃহ থেকে যিলকিয়াজেডেকের বেরিয়ে আসার কোনো নাম-ই নেই! এদিকে ধৈর্য হারিয়ে যাচ্ছে সাদ্দাদের। মনের ভেতর জমছে শঙ্কার মেঘ। পুরোপুরি অরক্ষিত হয়ে পড়ে আছে ইরাম নগরী। জিন আর নেফিলিমের দল যদি দখল করে নেয় ওটা, তাহলে ঠেকানোর কেউ নেই। তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে হবে শুধু। এদিকে পুরোহিত ব্যাটা কবে গর্ভগৃহ থেকে বেরুবে তার কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। শেষমেশ চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিলেন সাদ্দাদ। মন্দিরের গর্ভগৃহে ঢুকে সরাসরি দেখা করবেন যিলকিয়াজেডেকের সাথে। যাচ্ঞা করবেন তার পরামর্শ।
“চতুর্থ দিনের দিন সকালে উঠে মন্দিরের দরজা পেরিয়ে ভেতরে ঢুকলেন সাদ্দাদ। সঙ্গে কোনো দেহরক্ষী নেই। স্রেফ একা। ভেতরে নিকষ আঁধার। মশাল হাতে না ঢুকলে চোখে দেখা যায় না কিছুই। হিম শীতল পরিবেশ। কাঁপুনি উঠে গেল গায়ে। মন্দিরের কালো পাথরের দেওয়ালে খোদায় করা প্রাগৈতিহাসিক নাগের সারি সারি মূর্তি। মাথায় সবজেটে পাথরে তৈরি ঠেলে বেরিয়ে আসা হিংস্র চোখ। দেওয়ালের এখানে-ওখানে খোদাই করা আছে বীভৎস সব সরীসৃপের আকৃতি। জীবন্ত দুঃস্বপ্ন। আদ্যিকালের মানুষেরা হাঁটু গেড়ে বসে পুজো করছে তাদের। ঘিনঘিনে গিরগিটিগুলোর পায়ের কাছে পাথরে খোদাই করা হয়েছে এ দৃশ্য- ও। সবকিছু দেখেশুনে সাদ্দাদের মনে হলো: এ মন্দিরের বয়সের কোনো গাছ-পাথর নেই। বহুকাল আগে সভ্যতার উন্মেষ যখন ঘটেনি, হিংস্র আর নিষ্ঠুর দেব-দেবীর দাসত্ব করতে হয়েছে মানব জাতিকে। কাটাতে হয়েছে অসহনীয় বঞ্চনা আর সীমাহীন কষ্টের জীবন। এ চিত্র সেইসব দিনের। তবে ওগুলো এখানে খোদাই করার উদ্দেশ্য মানব জাতির প্রতি সমবেদনা জানানো না, উলটো ওইসব নিষ্ঠুর দেব-দেবী আর অতিপ্রাকৃত ক্ষমতার অধিকারী ওই গিরিগিটিগুলোকে আন্তরিক শ্রদ্ধা জ্ঞাপন
“নিখুঁতভাবে কাটা চৌকোনো পাথরের সুড়ঙ্গ ধরে এগিয়ে চলছেন সাদ্দাদ। হু হু করে কমছে তাপমাত্রা। সুড়ঙ্গ শেষ হতেই বড়ো একটা গোলাকার কামরায় পৌঁছালেন তিনি। উলটোদিকের দেওয়ালে পেতলের তৈরি ছোটো একটা আয়তকার দরজা চোখে পড়ল। ওই দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকতে হলে ঘাড়-মাথা নিচু করে কুঁজো হয়ে ঢুকতে হবে। প্রচণ্ড ঠান্ডায় হি হি করে কাঁপতে কাঁপতে আলতো করে ঠেলা দিলেন দরজার পাল্লায়। কিছুটা নড়ে উঠল ভারী পাল্লা, তবে পুরো খুলল না। তার চেতনার এক অংশ চেঁচিয়ে না করছে ভেতরে ঢুকতে। কু ডাকছে মনের ভেতর। ওখানে অমঙ্গল। কিন্তু ওসবে আমল দিলেন না সাদ্দাদ। তার নাম সাদ বিন আদ। পাষাণের মতো শক্ত কলিজা। এমন লোক মানব ইতিহাসে দু-একজনের বেশি নেই।
“ভেতরে পা দিয়ে প্রথমে কিছুই চোখে পড়ল না তার। ছায়া ছায়া আন্ধকার। বিশাল কামরা, প্রকাণ্ড উঁচু ছাদ। চকচকে কালো মেঝের ওপর হাঁটু সমান সাদা ফকফকে ধোঁয়ার কুণ্ডলি, যেন ঘন কুয়াশায় ঢেকে আছে মেঝে। অসংখ্য নীলাভ আলোর সরু রশ্মি ধোঁয়ার আস্তরণের ওপর গোলকার ফুটকি তৈরি করেছে। হাতের মশাল ওপরে তুলে দেখার চেষ্টা করলেন তিনি। রশ্মিগুলো দেওয়ালের গায়ে অনেক উঁচু জায়গা থেকে আসছে। ওখানে চার দেওয়ালে একই সমান্তরালে চারটে তিনমাথাঅলা নাগের মূর্তি। পিঠ ভরতি পাখা, বড়ো বড়ো নখঅলা খাটো আকারের চারটে পায়ের থাবায় ঘাড় থেকে ছিঁড়ে নেওয়া মানুষের চার মাথা। নীলচে আলোর রশ্মি আসছে নাগেদের চোখের মণি থেকে। কামরার উলটোদিকের দেওয়াল জুড়ে তিরিশ হাত লম্বা ছাইরঙা পাথরে গড়া ধুল কাফফানের মূর্তি। ঘোড়ার শরীর, মানুষের মাথা ও চোখ; কিন্তু ঠোঁটগুলো পাখির। চিকন বিনুনি করা মুখের দাড়ি আর মাথার চুল। এক হাতে মানুষের মাথার খুলি, অন্য হাতে বর্শা। সারা শরীরে কিলবিল করছে মাংসপেশী। সবুজ পাথরের চোখে অপার্থিব দ্যুতি।
“দেবতার সামনে মেঝের ওপর উপুড় হয়ে পড়ে আছে যিলকিয়াজেডেক। কোমার থেকে হাঁটু অব্দি সাদা ফিনফিনে কাপড়ে ঢাকা। উর্ধাঙ্গ সম্পূর্ণ খালি। বেঁচে আছে না মরে গেছে তা বোঝা যাচ্ছে না। এই দুর্দান্ত ঠান্ডায় লোকটা খালি গায়ে দিনের পর দিন মেঝের ওপর শুয়ে আছে কীভাবে কে জানে? খাবার- দাবার কিম্বা পানীয় জলই বা কোথায়? পায়ে পায়ে প্রধান পুরোহিতের কাছে এগিয়ে গিয়ে তার নাম ধরে ডাকলেন সাদ্দাদ। যে রকম ঠান্ডা, বেশিক্ষণ টেকা যাবে না এখানে। কাজ শেষ করে বেরিয়ে যেতে হবে যত দ্রুত সম্ভব। ‘মহান যিলকিয়াজেডেক, মহান যিলকিয়াজেডেক, শুনতে পাচ্ছেন আমার কথা?’
“ডাক শুনে আস্তে করে উঠে দাঁড়াল যিলকিয়াজেডেক। ঝাড়া চার হাত লম্বা। অসম্ভব ফর্সা আর বেজায় রোগা। লোমের বংশ নেই পুরো শরীরে। খুলির সাথে লেপটে আছে চামড়া। সবকটা রগ বেরিয়ে আছে মাথা আর হাতের। তোবড়ানো গাল, ধ্যাবড়ানো নাক। প্রথম দেখাতেই বিভ্রান্ত হলেন সাদ্দাদ। এ কি আদৌ বেঁচে আছে! ভালো করে মুখের দিকে তাকাতেই তার চোখে পড়ল – অন্ধকার কোটরের ভেতর জবাই করা খাসির মতো নিষ্প্রাণ কালো চোখের মণি। জীবনে নানান জাতের মানুষ দেখেছেন সাদ্দাদ, তবে এমন অদ্ভুত কিসিমের কাউকে কখনও দেখেননি। তার মনে হলো: এ লোকের ভেতর বাস করে ভয়ঙ্কর অশুভ কোনো প্রেতাত্মা, যে চায় ধ্বংস হয়ে যাক এ প্রকৃতি, লয় হয়ে যাক সব সৃষ্টি। তিলে তিলে কষ্ট পেয়ে মরুক পৃথিবীর সব প্রাণী। এ এক অনন্ত অভিশাপের জীবন্ত প্রতীক। এর আরাধ্য চির অন্ধকারের এক প্রলয়ঙ্কারী নিষ্ঠুর দেবতা
“ফ্যাসফেঁসে গলায় সাদ্দাদকে বলল যিলকিয়াজেডেক, ‘মহান ধুল কাফফানের অর্চনা শেষ হয়নি এখনও। আরাধনায় ছেদ পড়লে তার ফল হয় ভয়ঙ্কর। কী চান আপনি?’
অত্যাধিক ঠান্ডায় হি হি করে কাঁপতে কাঁপতে সাদ্দাদ বললেন, ‘আপনি তো জানেন জিন আর নেফিলিমেরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তৈরি করছে ইরাম নগরী। দুনিয়ার বুকে এমন শহর আর কোনোদিন হবে না। কারণ, এই ধরনের দালান-কোঠা, রাস্তা-ঘাট কোনো মানুষের পক্ষে তৈরি করা সম্ভব না। তবে এদের নিয়ে ঝামেলায় আছি এখন। নগরী নির্মাণের কাজ প্রায় শেষ। কিন্তু
কাজ শেষ হলেও এরা জায়গা ছেড়ে চলে যাবে তেমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। তখন এদেরকে পুষে রাখা মানে খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি হয়ে যাওয়া। আমার লাখ লাখ সৈন্য-সামন্ত নিয়ে এদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করতে পারি। তবে সে যুদ্ধে সমূলে বিনাশ হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। জিন আর নেফিলিমরা অতিপ্রাকৃত শক্তির অধিকারী।’
‘“এরা তো অনেক বছর ধরে কাজ করছে। এমন পরিণতি যে হবে, সে তো আগে থেকেই আপনার মাথায় থাকার কথা। হঠাৎ করেই এ বিষয় এমন জরুরি হয়ে উঠল কীভাবে? ভেতরে ভেতরে আর কিছু ঘটেছে নাকি?’
‘“ঘটেছে। জিন সর্দারের ছেলে যিলযিলা আমার মেয়ে সানাবুকে নির্যাতন করেছে। তারপর পালিয়ে গেছে দুর্গম পাহাড়ি এলাকা দোফারে। এত বড়ো সম্রাট হওয়ার পরও জিন আর নেফিলিমদের চাপে এর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছি না। সানাবু এখন মৃত্যুর সাথে যুঝছে। বাপ হয়ে নিজের মেয়ের সর্বনাশ মুখ বুজে সহ্য করতে হচ্ছে। এ অন্যায় যদি চুপচাপ মেনেও নেই, তাতেও সমস্যার সমাধান হবে না। জিন আর নেফিলিমরা কাজ শেষ হওয়ার পরও ইরামেই থেকে যাবে। আমাকে জোগান দিতে হবে তাদের খাবার-দাবার, আরাম- আয়েশের। মেনে নিতে হবে ন্যায়-অন্যায় সব রকমের আব্দার। এ কিছুতেই হতে দেওয়া যায় না। এ অবস্থা থেকে মুক্তি চাই আমি। মহান ধুল কাফফানের প্রধান পুরোহিত আপনি। পথ বাতলে দিন।’
‘“মহান ধুল কাফফানের দয়ায় পথ অবশ্যই বাতলে দিতে পারবো। তবে তার মূল্য পরিশোধ করতে হবে।’
‘“যে কোনো মূল্যে রাজি আমি,’ কোনো কিছু না ভেবেই তৎক্ষণাৎ উত্তর দিলেন সাদ্দাদ।
‘“বেশ। যা বলছি মন দিয়ে শুনুন। আপনি বলেছেন—ইরাম নগরী তৈরির কাজ শেষ হতে আর বেশিদিন বাকি নেই। ধরেই নিচ্ছি আগামি নব্বই দিনের ভেতর শেষ হবে নির্মাণ কাজ। এই কটা দিন ধৈর্য ধরতে হবে আপনাকে। কাজ শেষ হলে তাদেরকে বলবেন নগরী থেকে পনেরো ক্রোশ দূরে কোহিতূর পাহাড়ের ওপর দুহাজার কামরার এক প্রাসাদ-দুর্গ বানিয়ে দিতে। লম্বায় দেড় ক্রোশ, চওড়ায় এক। কাজটা সহজ হবে না মোটেও। পাহাড়ের চুড়ো কেটে মালভূমির মতো চ্যাপ্টা করতে হবে আগে। তারপর নিশ্চিত করতে হবে বিপুল পানির সরবরাহ। বানাতে হবে অসংখ্য চওড়া মসৃণ রাস্তা। কাজ শেষ হওয়ার পরদিন সন্ধের সময় সব জিন আর নেফিলিমদের দুর্গ চত্বরে ডেকে ভোজের আয়োজন করবেন। খেয়াল রাখবেন একজনও যেন বাদ না যায়। খানা- পিনার পর নাচ-গানের মজমা বসাবেন। পারস্যের গিলান কিম্বা ইয়াযদ প্রদেশের শ-পাঁচেক সুন্দর যুবতী যেন থাকে। সেই সাথে অফুরন্ত মদের ভাণ্ডার। দুর্গ চত্বরের ঠিক মাঝখানে সাদা গালিচার ফরাস পেতে সভাসদদের নিয়ে তাকিয়ায় হেলান দিয়ে বসবেন আপনি। রাত দ্বিপ্রহরে মৌজ-মাস্তি যখন তুঙ্গে, ঠিক তখন পরপর তিনবার দুহাতে আলতো করে তালি বাজিয়ে চিৎকার করে বলবেন, ‘ইয়া ধুল কাফফান, ইয়া সাইয়িদি, ইয়া তাহকিক খুতাতি।’ এ কথা বলার সাথেসাথে প্রচণ্ড ভূমিকম্পে কেঁপে উঠবে পুরো দুর্গ। জমিনে দেখা দেবে ইয়া বড়ো ফাটল। হলহলে আগুনের শিখা, ছাই, আর ধোঁয়া বেরিয়ে আসবে ওই গহ্বর থেকে। ফাটলে সৃষ্টি হবে অভ্যন্তরীণ টান। সেই টানে অতলে তলিয়ে যাবে সমস্ত জিন আর নেফিলিমের দল। আর কোনোদিন ফিরে আসবে না।’
“এজন্যে আমাকে কী মূল্য চোকাতে হবে?’
“জিন আর নেফিলিমদের সাথে চিরতরে তলিয়ে যাবেন আপনিও।’
“শত্রু বিনাশ হলো কিন্তু সেই সঙ্গে মরতে হলো আমাকেও — এতে কী লাভ? হতাশ কণ্ঠে বললেন সম্রাট।
“মূল্য আপনাকে চোকাতেই হবে। আরও একটা দিন অপেক্ষা করলে আপনাকে হয়তো মরতে হতো না। অন্যভাবে পরিশোধ করতে হতো ধুল কাফফানের ঋণ। তবে ওই যে, তার আলয়ে অনধিকার প্রবেশ করেছেন। বিঘ্ন ঘটিয়েছেন তার প্রধান পুরোহিতের আরাধনায়। এখন নিজের জীবন দিয়ে শোধরাতে হবে সেই ত্রুটি। আর হ্যাঁ, এখানে কী কথা হয়েছে, সে বিষয়ে কাউকে কিছু বলা যাবে না। এই রাজ যদি কোনো কারণে ফাঁস হয়, তাহলে ধুল কাফফান ফিরিয়ে নেবেন তার সমর্থন। এইবার পেছন ফিরে তাকান।’
পেছন ফিরে তাকতেই সাদ্দাদ দেখতে পেলেন—রাজদূতসহ আগে যে পাঁচজনকে পাঠিয়েছিলেন, তাদের সবকজনের কপালে ইয়াবড়ো গজাল মেরে মন্দিরের ধূসর পাথরের দেওয়ালে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। তুষারে ঢাকা পড়ে গেছে তাদের হাত-পা-মাথা। আবার মুখ খুলল যিলকিয়াজেডেক। বলল, ‘ধুল কাফফানের মন্দিরে বিনা অনুমতিতে প্রবেশ করলে অথবা তার আরাধনায় ব্যাঘাত সৃষ্টি করলে তার একমাত্র শাস্তি মৃত্যু। আপনিও এর ব্যতিক্রম নন। তবে যেহেতু আপনি মহান সম্রাট সাদ্দাদ বিন আদ, সেহেতু আপনার মৃত্যু হবে কিছুটা দেরিতে। আপনার মৃত্যুর পর ইরাম নগরী চলে যাবে মহান ধুল কাফফানের হাতে। তার মর্জি অনুযায়ী পরিচালিত হবে দুনিয়ার ইতিহাসে অনন্য ওই শহরের কর্মকাণ্ড।’ সাদ্দাদ, জিন, আর নেফিলিমদের বিনাশ এভাবেই হয়েছিল।”
“এরপর স্তম্ভের নগরী ইরামের কী হলো, চাচা?” জিজ্ঞেস করল আব্দুল আল হযরত। মায়ের সথে সে-ও এতক্ষণ মহিত হয়ে শুনছিল আল ফকিহের বয়ান।
বলে চলল ফকিহ, “ইরাম নগরী গড়ে তোলা হয় রুপোর প্রলেপ দেওয়া লাল ইঁটের মতো চারকোনা পাথর দিয়ে। চওড়া তকতকে রাস্তা, বাগান আর তালগাছে ঘেরা অসংখ্য বিলাসবহুল ভবন, বিপণী বিতান। শহর জুড়ে এন্তার ঝরনা, ঝকঝকে স্বচ্ছ জলের কৃত্রিম নদী-নালা। অতিরিক্ত ভোগ-বিলাস, অগুনতি অনিন্দ্যসুন্দরী যুবতী, শুঁড়িখানা, ভীষণ আরামদায়ক সরাইখানা, লোভনীয় ভোজনালয়, জুয়ার আড্ডা, আর গণিকালয় ছিল এ নগরীর অন্যতম আকর্ষণ। মদ, মেয়ে মানুষ, দামিদামি খাবার- দাবার, আর জুয়া। চব্বিশ ঘণ্টা ফূর্তিতে মেতে থাকত ওখানকার বাসিন্দারা, যেন বাইবেলের সডোম ও গমোরাহ নগরী! এখানেই শেষ না, মহান ঈশ্বরের ইবাদত বাদ দিয়ে তারা পুজো করতে শুরু করল ইবলিসের প্রধান দুই সাগরেদ ধুল কাফফান আর আইম- এর। ফি হপ্তায় প্রতি মঙ্গলবার জোড়া ষাঁড় বলি দিয়ে এ দুজনকে অর্ঘ্য নিবেদন করা হতো।
“কিন্তু অতিরিক্ত বিলাসিতায় কাল কাটালে যা হয়। মানসিক বিকৃতির শিকার হয় কিছু কিছু লোক। উত্তেজনা পাওয়ার জন্যে নানান রকমের নেশার আশ্রয় নেয়। খুঁজে ফেরে অদ্ভুত ধরনের সব হিংসাত্মক কর্মকাণ্ড। ষাঁড়ের বদলে নরবলি চড়াতে শুরু করল ইরামেরা হর্তাকর্তারা। হাড়িকাঠে প্রাণ গেল যত ভবঘুরে, ভিখিরি, আর হতদরিদ্র মানুষের। ইরাম নগরীর বোঝা মনে করা হতো এদের। নানান জয়গা থেকে দুমুঠো খাওয়ার জন্যে আসত এরা। তবে এলে আর ফিরতে পারত না। তাছাড়া জুয়া খেলেও সর্বশান্ত হতো অনেকে। তখন নবি-রাসুলদের যুগ। নানান কওমের ওপর ধড়াধড় নাজিল হচ্ছে খোদার গজব। কারণ, তারা গোমরাহ বা বিপথগামী। গজবের হাত থেকে রেহাই পেল না ইরামের লোকেরাও। খোদার অভিশাপে ইরাম নগরী, রানি বিলকিসের রাজ্যপাট—এসবই ধ্বংস হয়ে যায়। প্রথমে দেখা দিল অস্বাভাবিক খরা। দিনের পর দিন বয়ে চলল সাইমুম আর লু হাওয়া। প্রচণ্ড গরমে তিষ্ঠানো দায়। কিচকিচে বালি আর ধুলোয় ঢাকা পড়ল বাড়িঘর, রাস্তাঘাট। ধ্বংস হয়ে গেল উন্নত সেচ আর কৃষি ব্যবস্থা, শুকিয়ে কাঠ সমস্ত গাছ আর তরুলতা। একেবারে জলশূন্য হয়ে পড়ল খালবিল, ঝরনা। এরপর হানা দিলো গুটি বসন্তের মতো এক ভয়ানক মহামারি। ইরামবাসীর গা থেকে খসে পড়তে লাগল চামড়া-চর্বি। অবশেষে একটা মানুষও আর রইল না ইরামে। খাঁ খাঁ করতে লাগল অসংখ্য ইমারত, পেল্লায় বিপণীবিতান, কালো পাথরে মোড়া মসৃণ, চওড়া রাস্তা-ঘাট। অবস্থা এমন দাঁড়াল যে আধা-জংলি শেয়াল-কুকুর পর্যন্ত হারিয়ে গেল ইরাম থেকে! ধীরে ধীরে নগরীর অগুনতি পোড়ো ভবন আর জমকালো মন্দিরগুলোতে বাসা বাঁধল অভিশপ্ত আত্মা, জিন, ইফ্রিত, আর প্রেতের দল।”
মায়ের পাশে বসে মন দিয়ে আল ফকিহর কথা শুনছিল আল হযরত। মনে মনে ভাবছে, সবই বুঝলাম, কিন্তু বাবার কী হলো? শেষমেশ জিজ্ঞেস করেই বসল, “হুজুর। এত কথা বললেন, কিন্তু আমার বাবার কথা তো বললেন না?”
“রোসো বাছা, রোসো। ওকথাতেই আসছি। লবণ আর রেশমি কাপড় বেচে মোটা টাকা বানিয়েছিল তোমার বাবা। ওই টাকা নিয়ে ফিরতে পারলে সানাতে দোকান দিয়ে পাকাপাকিভাবে থিতু হতে পারত। রেশমি কাপড় যে তার কাছে ছিল—একথা ঘুণাক্ষরেও কেউ জানতে পারেনি। মোটা সুতি কাপড়ের থানের ভেতর লুকিয়ে রেখেছিল। ব্যাবসায়িক গোপনীয়তা! বহুদিন হয় ব্যাবসা করছে। দূরদৃষ্টি ছিল খুব। এই রেশমি কাপড় তাকে মালামাল করে দিলো ঠিকই, তবে ওটাই শেষমেশ কাল হয়ে দাঁড়াল। মারিব থেকে সঙ্গে আসা সহ-ব্যবসায়ীদের কোপানলে পড়ল সে। তাকে ওখনে রেখে নিজেরাই ঘরে ফেরে মারিবের বণিকেরা। তোমার বাবা হয়ে গেল সম্পূর্ণ একা। সপ্তাহখানেক শারারাহতে কাটিয়ে একটা উট আর কিছু রসদ নিয়ে বেরিয়ে পড়ে সে। এরপর তার আর কোনো হদিস পাওয়া যায়নি।”
“কিন্তু এতকথা আপনি জানলেন কোত্থেকে?” দরজার ওপাশ থেকে জিজ্ঞেস করল আল হযরতের মা।
আল ফকিহ বলল, “তোমার কাছে মিথ্যে বলবো না, মা। ওই কাফেলার সাথে আমিও ছিলাম। আমার কাজ ছিল ব্যবসায়ীদের রান্না-বান্না করা, উট আর গাধাগুলোর পানি আর খাবারের যোগান দেওয়া। তোমার স্বামীর সাথে আমিও রওনা হয়েছিলাম। মারিবের কাফেলা চলে গেলেও আমি থেকে যাই। এরপর দুজনে মিলে রওনা দেই। কিন্তু শারারাহ ছাড়াতেই এক প্রচণ্ড মরুঝড়ের কবলে পড়ি আমরা। পুরো দুদিন ঘুটঘুটে আঁধার হয়েছিল আকাশ। কে যে কোথায় ছিটকে পড়লাম কে জানে। অনেক কষ্টে ওয়াদিয়ার রাস্তা খুঁজে পাই আমি। সেখান থেকে অন্য এক কাফেলার সাথে পুবে চলে যাই। যামাক হয়ে সালাসিল তারপর তারিমে। শেষমেশ পশ্চিমে দিকে রওনা দিলাম। হাইনিনে আসার পর বেদুইন ডাকাতের পাল্লায় পড়ে কাফেলার অর্ধেক বণিক মারা পড়ল। বাকিদের দাস হিসেবে বেচে দিলো বেদুইনেরা। আমি ডাকাত সর্দারকে কয়েকদিন ভালো-মন্দ রেঁধে-বেড়ে খাইয়েছিলাম। খুশি হয়ে আমাকে মুক্তি দিলো সে। আজ দুবছর হয় পথেপথে ভবঘুরের মতো ঘুরে বেড়াই। খোদারই হয়তো ইচ্ছে, পুরনো বন্ধু, তোমার স্বামী আল ইমরানের বাড়িতে অতিথি হিসেবে অশ্রয় পেয়েছি। ভেবেছিলাম, সে হয়তো ফিরেও আসতে পারে। আশা করতে দোষ কী, তাই না!”
“ফিরে যে আসেননি, সে তো দেখতেই পাচ্ছেন। তা আপনার বাড়ি কোথায়?”
“আমি সাগর পাড়ের লোক। আমার বাড়ি এক্কেবারে পশ্চিমে, হুদাইদা বন্দরে। আমি বিদেয় হবো এখন, তবে যাওয়ার আগে একটা অনুরোধ করবো। তোমাকে রাখতে হবে সেটা।”
“অনুরোধটা কী?”
“আল হযরতকে কাছে-পিঠে কোনো মক্তবে পাঠাবে। তার লেখাপড়া শেখা প্রয়োজন।”
“এ গাঁয়ে কোনো মাদ্রাসা নেই। পাশের গ্রামে আছে। বেশ দূরে ওটা। ছোটো ছেলে, যওয়া-আসা করতে কষ্ট হবে। তাছাড়া, খরচপত্রেরও একটা ব্যাপার আছে।”
“হোক কষ্ট। তারপরেও তার বিদ্যে শেখা খুব জরুরি।”
“বিদ্যে শেখা খুব জরুরি একথা বলে আসলে কী বোঝাতে চাইছেন?”
“দেখো, বছরের পর বছর পথে-প্রান্তরে ঘুরে ভালো-মন্দ বহু লোকের সাথে দেখা হয়েছে আমার। গিয়েছি দুর্গম এলাকায় অদ্ভুত সব জায়গায়। মরুর বুকে এমনও এলাকা আছে, যেখানে নানান রকমের তন্ত্র-মন্ত্রের চর্চা হয়। এমন কিছু ব্যাপার দেখেছি যা যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। এসব জায়গায় ঘুরে, ফকির-দরবেশের সঙ্গ করে আজব কিছু ক্ষমতা জন্মেছে আমার ভেতর। মাঝে মাঝেই এমন হয়’, কাউকে দেখলে মনে হয় এরা আর দশটা মানুষের মতো সাধারণ কেউ না। ভবিষ্যতে সম্পূর্ণ ভিন্ন কিছু একটা করার জন্যে দুনিয়ায় এসেছে তারা। মা, তোমার ছেলে আল হযরতকে দেখে মনে হয়েছে, এ ছেলে বড়ো হয়ে খুবই অন্যরকম কিছু করবে।”
“অন্যরকম কী করবে?”
“সেইটে বলতে পারবো না। অতো ক্ষমতা আমার নেই। তবে এটুকু বলতে পারি, আধ্যাত্মিক হোক কিম্বা দুনিয়াবি—যেকোনো কিছু ঠিকঠাক মতো করতে হলে চাই মক্তবি লেখাপড়া। মূর্খ আর পশুর ভেতর পার্থক্য সামান্যই। হাজার বছর ধরে তিলতিল করে গড়ে তোলা বান্দার সব জ্ঞান—জাহেরি অথবা বাতেনি—এসবই আছে লিখিত অবস্থায়, কিতাবের ভেতর হরফের আকারে। এসব হরফ পড়ে রহস্যেমোড়া জ্ঞানের সার বের করে কাজে লাগাতে হলে যে দক্ষতা দরকার সেইটে তৈরি হয় কেবল মক্তবেই। আমার মন বলছে এ ছেলে ভবিষ্যতে যে কাজ করবে তার জন্যে মক্তবি লেখাপড়া অবশ্য কর্তব্য। একটা কথা ভেবে দেখো, ভবিষ্যতে যদি কেউকেটা কেউ যদি না-ও হয়, তবুও লেখাপড়া শিখে কাবিল হলে খলিফার হুকুমতে ভালো একটা কাজ জুটেও তো যেতে পারে।”
কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে মুখ খুলল আল হযরতের মা, “ঠিক আছে। হযরতের বাবার বন্ধু ছিলেন আপনি। এত করে যখন বলছেন, মক্তবে পাঠাবো ছেলেকে। এখন দুটো বাড়িতে ঝিগিরি করে পেট চালাচ্ছি, আরও একটা বাড়ির কাজ ধরতে হবে এই আরকি।
বিদেয় নেওয়ার আগে কাছে ডেকে আল হযরতের ঘাড়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো আল ফকিহ। নিজের মুঠোকরা দুহাত সামনে বাড়িয়ে বলল, “এই দুটো মুঠোর ভেতর থেকে যেকোনো একটা বেছে নাও তো দেখি।”
কথা শেষ হয়েছে কী হয়নি, ফকিহর বাঁ হাতের মুঠো আলতো করে ছুঁয়ে দিলো আল হযরত। এইবার দুটো মুঠোই উপুড় করে মেলে ধরল ফকিহ। ডান মুঠোয় কিছু নেই। বাঁ মুঠোয় চারকোনা ছোট্ট একটা কাপড়ের টুকরো। কোনো এক সময় সাদা রঙের ছিল। কালের বিবর্তনে কটা হয়ে গেছে। কাপড়ের টুকরোটার ওপর কালো কালিতে জটিল এক সিজিল আঁকা। একটা বর্গক্ষেত্রের ভেতর দ্বিতীয় আরেকটা বর্গক্ষেত্র। ভেতরের বর্গটা দশ ভাগে ভাগ করা। এই দশটা ছোটো ছোটো খোপের ভেতর পাঁচটা অদ্ভুত চিহ্ন।
আল হযরত জিজ্ঞেস করল, “কী এটা?”
“এটা একটা রক্ষাকবচ। এসব এখন বুঝবে না। তুমি ছেলেমানুষ, হারিয়ে ফেলবে কাপড়ের টুকরোটা। এক কাজ করো। আমার সাথে বাজারে চলো। রুপোর একটা তাবিজে কাপড়টা ভরে তোমার হাতে বেঁধে দেবো এখন।”
আল ফকিহ বিদায় নেওয়ার পরদিনই মক্তবে যাওয়া শুরু করল আল হযরত। পাক্কা দেড় ঘণ্টা হেঁটে মক্তবে যেতে হয়, ফিরতেও ব্যয় হয় সমপরিমাণ সময়। রওনা হয় ফজর নামাজের পরপরই, ফিরতে ফিরতে প্রায় মাগরিব। শীত-বসন্তে কিছুটা সুবিধে হলেও গরমে যাতায়াত করতে জান পানি হয়ে যায়।
মক্তবে আল হযরতের তখন সপ্তম বছর চলছে। ভীষণ গরম পড়ল একদিন। দুপুরের আগেই ছুটি দিয়ে দিলেন মুদাররিস। যে যার মতো বাড়ির পথ ধরল ছেলেরা। আল হযরতও রওনা হলো। কিছুক্ষণ হাঁটার পর হঠাৎ করেই মরে এলো রোদের তেজ, ঝপ করে নেমে গেল তাপমাত্রা। ওপরদিকে মুখ তুলে আল হযরত দেখল—আকাশ কালো করে মেঘ জমছে। ছায়াছায়া পরিবেশ, হু হু করে বইছে শীতল বাতাস। মনের আনন্দে হেঁটে চলল সে। আধঘণ্টা পথ চলার পর তিন রাস্তার মোড়ে এসে পৌঁছল। বহু পুরনো পরিত্যাক্ত এক হাভেলি আছে এখানে। কে কবে এ ভবন তৈরি করিয়েছিল কেউ জানে না। হা হা করছে পাথুরে দেওয়ালে জানালা-দরজার বড়ো বড়ো খোঁদল। হাওয়া খেলে বেড়াচ্ছে ধুলোভরা অসংখ্য ফাঁকা কামরায়। আদ্দেক ধসে পড়েছে দোতলার টানা ঝুল বারান্দা। স্থানীয় লোকেরা একে বলে কাসর আল মাসকুন। সোজা বাংলায়—হানাবাড়ি।
পোড়ো দালানটার কাছে আসতেই আকাশ চিরে বিদ্যুত চমকাল। কড়কড় করে বাজ পড়ল কাছে কোথাও। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে শুরু হলো তুমুল বৃষ্টি। ড্যাঙডেঙে ফাঁকা চারপাশ, একেবারে গড়ের মাঠ। মাথা গোঁজার কোনো ঠাঁই নেই। এমন ঘন-বর্ষণ যে দশ হাত দূরের জিনিসও চোখে পড়ে না! যেন চোখের সামনে সাদা চাদর টাঙিয়ে দিয়েছে কেউ। বাধ্য হয়েই পোড়ো হাভেলির কোমর সমান উঁচু বারান্দায় উঠে আধ-খাওয়া খিলানের নিচে আশ্রয় নিলো আল হযরত। ভাবল, কিছুক্ষণ পর বৃষ্টি থামলে ফের হাঁটা শুরু করবে। কিন্তু বিধি বাম। বৃষ্টি আর থামে না। শেষমেশ বর্ষণ যখন ধরে এলো তখন মাগরিবের ওয়াক্ত হতে আর বেশি বাকি নেই।
হাভেলির বারান্দা থেকে নেমে তিন রাস্তার মোড়ের কাছে এসে বাঁয়ে ঘুরল সে। পানিতে ভেসে যাচ্ছে পাথুরে রাস্তা। আর এই ছলছলে পানির ওপর চৌকো কালোমতো কী যেন একটা পড়ে আছে। জিনিসটা রাস্তা থেকে তুলে আল হযরত দেখল: চামড়ার খাপে মোটা কাপড়ে বাঁধানো কতকগুলো তুলোট কাগজ। খাপ খুলতেই চোখে পড়ল কীসব যেন লেখা রয়েছে হলদে কাগজগুলোতে। আকাশ মেঘলা থাকাই ভালো করে দেখা যাচ্ছে না হরফগুলো। বাড়ি পৌঁছতে রাত হয়ে গেল আল হযরতের।
পরদিন ছিল শুক্রবার, মক্তব বন্ধ। সকালে নাস্তা সেরে চামড়া- বাঁধানো কাগজগুলো ধীরে-সুস্থে ছানবিন করল আল হযরত। ভারী অদ্ভুত সারিসারি অক্ষর আর এখানে-ওখানে জটিল সব নকশা! পরদিন মক্তবের মুদাররিসকে কাগজগুলো দেখাল সে। কিন্তু ওস্তাদজিও কোনো ধারণা দিতে পারলেন না। শুধু এটুকু বললেন, “এ বহু পুরনো লিপিতে লেখা কিতাব। মুআল্লিমের কাছে শুনেছি আদ্যিকালে সেবিয়ান আর মিনিয়ান নামে দুটো ভাষা ছিল। হতে পারে এ কিতাব ও দুটোর কোনো এক ভাষায় লেখা।”
ওস্তাদজির কাছ থেকে বইটা নিয়ে বাড়ি ফিরে কাপড়ে মুড়ে কুলুঙ্গিতে তুলে রাখল আল হযরত। আপাতত ওখানেই থাক। ভবিষ্যতে দেখা যাবে কী লেখা আছে ওতে।
.
সেই রাতে অদ্ভুত এক স্বপ্ন দেখল সে। দেখল, পাঁচধাপঅলা পিরামিডের মতো একুশ মঞ্জিল উঁচু প্রকাণ্ড যিগুরাটের মাঝ বরাবর তৈরি করা সিঁড়ির অগুণতি ধাপ বেয়ে উঠে যাচ্ছে একদল পুরোহিত। পরনে হাঁটুঅব্দি লম্বা নকশি পাড়ের ঘাগরা। কোমরের ওপরের অংশে সাদা থান জড়ানো। ডান বগলের নিচ দিয়ে গলিয়ে বাঁ কাঁধের ওপর এনে পেঁচিয়ে পরা হয়েছে থান। নিখুঁতভাবে কামানো মাথা। মুখ থেকে বুক অব্দি নেমে এসেছে সরু বিনুনিকরা থাককাটা ইয়া লম্বা দাড়ি। সোনালি রঙের যিগুরাটের টেবলটপ মাথায় আকাশি রঙের মন্দির। মন্দিরের দেওয়াল জুড়ে পোড়ামাটির তিন মানুষ উঁচু অসংখ্য লালচে ফলক। ফলকের গায়ে ষাঁড়ের ছবি খোদাই করা। ওগুলোর পিঠে পাখা, মুখ মানুষের। কানের নিচ থেকে গাল বেয়ে হাঁটুঅব্দি নেমে এসেছে বিনুনিকরা ইয়া লম্বা দাড়ি।
সবার আগে লম্বা ডিগডিগে প্রধান পুরোহিত। তার পেছনে পনেরোটা সারিতে ষাটজন সহকারী। এক এক সারিতে চারজন। দেবতার ভোগ বয়ে নিয়ে যাচ্ছে এরা। প্রধান পুরোহিতের কোলে নাদুস-নুদুস ছোট্ট এক হরিণ ছানা। সহকারীরদের ঘাড়ে বারো পিপে মদ, দুই কলসি দুধ, পাঁচ ঝুড়ি রুটি, একুশটা ভেড়া, আটটা দুম্বা, চারটে বুনো শুয়োর। বাকিদের হাতে তিনটে সারস পাখি, তিনটে উট পাখির ডিম, আর দুটো হাঁসের ডিম। কেউ না বলে দিলেও আল হযরত বুঝল—এগুলো দেবতার দৈনিক নৈবেদ্য।
যিগুরাটের সিঁড়ির গোড়া থেকে একশো হাত দূরে দাঁড়িয়ে আছে রঙচঙে আখাল্লাপরা বহু লোক। মন্দির দূরে থাক, যিগুরাটের দোর গোড়ায় আসাও সাধারণ জনগণের জন্যে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। শেষমেশ যিগুরাটের চতুর্থ মঞ্জিলের টেবলটপ মাথায় পৌঁছাল পুরোহিতের দল। আকাশ-নীল মন্দিরের সামনে জনতার দিকে মুখ করে লাইন দিয়ে দাঁড়াল। মাঝখানে প্রধান পুরোহিত। তার ডানে-বাঁয়ে জীব-জন্তুসমেত তিরিশজন করে সহকারী। প্রধান লম্বা পুরোহিতের মাথা সহকারীদের থেকেও একহাত ওপরে। দুহাতে হরিণছানা মাথার ওপর তুলে ধরল সিড়িঙ্গে পুরোহিত। আকাশ ফাটিয়ে নিচে দাঁড়িয়ে থাকা জনতা সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠল, জয়! নিনহুরসাগের জয়!
জয়ধ্বনি শেষ হতেই মাথার ওপর তুলে ধরা হাত নিচে নামালো পুরোহিত। সাথেসাথে ঘন কালো মেঘে ছেয়ে গেল আকাশ। কোত্থেকে যেন উড়ে এলো সাতটা ধপধপে রাজহাঁস। নীল মন্দিরের চৌকো মাথার ওপর চক্রাকারে উড়তে শুরু করল।
আবারও মাথার ওপর হরিণছানা তুলে ধরল পুরোহিত। আগের মতোই গগনবিদারি জয়ধ্বনি দিলো যিগুরাটের পায়ের কাছে জড়ো হওয়া হাজার হাজার জনতা।
জয়! দুমুযিদের জয়!
হঠাৎ দুভাগে ভাগ হয়ে গেল মন্দিরের মাথার ওপর ঝুলে থাকা আকাশজোড়া কালো মেঘ। দেখা দিলো ফাটল। ধপধপে সাদা ফাটল বেয়ে ঠিকরে পড়ছে উজ্জ্বল সূর্য কিরণ। এইবার ওই ফাঁকের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো সাতটা হাড়গিলে ধেড়ে শকুন। মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা পুরোহিতদের মাথার ওপর হাওয়ায় ভেসে থাকল কিছুক্ষণ। এরপর শূন্যে গোত্তা খেয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল গোল হয়ে ঘুরতে থাকা রাজহাঁসগুলোর ওপর। নিরীহ হাঁসেদের পিঠে পায়ের তীক্ষ্ণ নখ বিঁধিয়ে একসারিতে উড়ে হারিয়ে গেল সরে যাওয়া মেঘের সাদা ফাটলের ভেতর দিয়ে। দেখতে দেখতে কেটে গেল আকাশের কালো মেঘ। এইবার চতুর্থ মঞ্জিলের চওড়া চত্বর পেরিয়ে দলবল নিয়ে মন্দিরের চৌকো দরজা গলে ভেতরে ঢুকল ঢ্যাঙা পুরোহিত।
স্বপ্নের ভেতরেই আল হযরতের চোখে পড়ল: দরজার ঠিক ওপরে দেওয়ালের গায়ে পোড়ামাটির ফলকে দাড়িঅলা এক ধাড়ি ছাগীর ছবি খোদাই করা। গলা আর সামনের দুপা ছাগলের হলেও ধড়ের বাকি অংশ বড়ো বড়ো আঁশেভরা কাতলা মাছের মতো। খাড়া শিংঅলা ছাগীর বাঁ পা সামনের দিকে বাড়ানো, ডান পা পেটের পাশে মুড়ে রাখা। এ যেন জমিনের ওপর বসে থাকা জলকুমারী যার ঘাড়, মাথা, আর হাত এক ছাগীর!
ফাঁকা হতে শুরু করল জনতার ভিড়। দেবতারা পুজোর অর্ঘ্য গ্রহণ করবেন বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন। পুজো-আচ্চা যা করার পুরোহিতেরা করবে এখন। এবার নিশ্চেন্তে ঘরে ফিরতে পারে যিগুরাটের সামনে জড়ো হওয়া জনতা
হররোজ আছরের ওয়াক্তে মক্তব থেকে ফিরে রুটি খায় আল হযরত। সাথে থাকে হয় সবজি, নাহয় ডাল। মা বাড়িতে থাকলে নিজ হাতে বেড়ে দেয়। না থাকলে, আল হযরতের ঘরের মেজের ওপর ঢাকা দেওয়া থাকে খাবার। স্বপ্ন দেখার পরদিন মক্তব থেকে ফিরে এসে আল হযরত দেখল: তার জন্যে প্রতিদিনকার বরাদ্দ রুটি-সবজি-ডাল… এসব কিছুই নেই। কী ব্যাপার, এমন তো হওয়ার কথা না, মনেমনে ভাবল সে। মাতবাখ অর্থাৎ রসুইঘরে গিয়ে দেখল হাঁড়ি-কুড়ি সব তাকের ওপর পরিপাটি করে সাজানো। ঠান্ডা হিম হয়ে আছে চুলো। সেই সকালেই যা রান্না হয়েছিল, তারপর আর চুলো জ্বলেনি। আচ্ছা, মা গেল কোথায়? এদিক-ওদিক তাকাতেই তৎক্ষণাৎ এ প্রশ্নের উত্তর মিলল। মায়ের কামরার সামনে দুম্বার চামড়া দিয়ে বানানো ছেঁড়া-ফাটা মেয়েলি হিদা পড়ে আছে। ওহ, মা দেখছি বাড়িতেই আছে! কিন্তু পায়ের আওয়াজ পেয়ে তো বেরিয়ে আসার কথা তার। বাইরে এলো না যে বড়ো!
আলতো করে ধাক্কা দিতেই হাট হয়ে খুলে গেল কামরার দরজা। আল হযরত দেখল: চিত হয়ে বিছানায় শুয়ে আছে তার মা। জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে শরীর। হুঁশ প্রায় নেই বললেই চলে। কী করা এখন? খাওয়াই জোটে না, হেকিম-বদ্যি করবে কোত্থেকে! টাকা কোথায়? মার ব্যাপারটা নাহয় পরে দেখা যাবে। খিদেয় ছুঁচো নাচছে পেটে। কিছু একটা না খেলেই নয়। তার মায়ের ঘরে দেওয়ালের তাকে চিনেমাটির একটা রেকাবিতে শুকনো দুটো খেজুর ছিল। ও দুটোর সাথে সেরখানেক পানি খেয়ে কোনোমতে রাত পার করল আল হযরত। সকালে উঠে মার কছে গিয়ে দেখল মা তখনও বেহুঁশ। নাহ, হেকিম ডেকে না আনলে আর চলছে না। সেই সাথে চাই দাওয়াই আর ভালো পথ্য। কিন্তু এসবের জন্যে দরকার কাঁড়িকাঁড়ি টাকা। এদিকে মহল্লার কারও সাথে তেমন ওঠা-বসাও নেই আল হযরতের। মাদ্রাসার মুদাররিস বিন হিন্দির সাথেই যা কিছু খাই-খাতির।
খালি পেটে পানি খেয়ে মাদ্রাসার পথে রওনা হলো সে। রোদের তেজ তখনও বাড়েনি। বেশ ঠান্ডা আবহাওয়া, ঝিরঝিরে বাতাস। ঘণ্টা দেড়েক হেঁটে মক্তবে পৌঁছাল আল হযরত। আসতে দেরি করে ফেলেছে। এখানে-ওখানে দুচারটে ছেলে চোখে পড়ল। কেমন একটা ঢিলেঢালা ভাব। ক্লাসরুমে ঢুকে দেখে—ফরাসের ওপর হামাদের পাশে ফার্স্টবয় বিন কাসিম বসে আছে। গুটগুট করে কী নিয়ে যেন আলাপ করছে দুজনে। এদের থেকে একটু দূরে বসল আল হযরত। পেরিয়ে গেল বেশ কিছু সময়। কিন্তু ক্লাসের বাকি ছাত্ররা কোথায়? তার থেকেও বড়ো কথা—বিন হিন্দি হুজুর কেন আসছেন না? ওয়াক্ত মেনে চলার ব্যাপারে যথেষ্ট কঠোর ইনি। কিছুক্ষণ পর ফরাস থেকে উঠে পড়ল আল হযরত। বিন কাসিমকে জিজ্ঞেস করল, “হুজুর কোথায়? পড়াতে আসবেন না আজ?”
অবাক হয়ে তার দিকে তাকাল বিন কাসিম। তবে সে মুখ খোলার আগেই হামাদ বলল, অনেক দিন ধরেই রোগে ভুগছিলেন হুজুরের মা। ইন্তেকাল করেছেন আজ ভোরে। মক্তবের সব মুদররিসেরা গেছেন উনার বাড়িতে। বাদ যোহর জানাযা। আজ কোনো ক্লাস হবে না। বিন হিন্দির বাড়ি এখান বেশ দূরে। খালি পেটে অতদূর হেঁটে যাওয়া দুষ্কর। তাছাড়া বাড়িতে মা একা। কী করা? ভেবে-চিন্তে বাড়ি ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো আল হযরত।
ফিরতি পথে দেখল বহুগুণ বেড়ে গেছে রোদের তেজ, তেতে উঠেছে পায়ের তলার বালি। তিন রাস্তার মোড়ে পৌঁছুতেই ফাঁকাফাঁকা লাগতে লাগল মাথার ভেতর, টলে উঠল শরীর। কোথাও একটু থেমে জিরিয়ে না নিলেই নয়। কিন্তু বসবে কোথায়? আশপাশে জিরোনোর জায়গা বলতে শুধু কাসর আল মাসকুন। গতবার যখন গিয়েছিল, কেমন একটা ছমছমে অনুভূতি হয়েছিল। ওখানে আবারও যেতে হবে, একথা ভাবতেই কাঁটা দিলো গায়ে। কিন্তু না গিয়েও বা উপায় কী? অবস্থা যা দাঁড়িয়েছে মাথা ঘুরে রাস্তার ওপর পড়ে যাবে যেকোনো সময়।
টলোমলো পায়ে পোড়ো হাভেলির দিকে এগিয়ে গেল সে। মাজা সমান উঁচু বারান্দায় গিয়ে উঠল। ভেতরে ঢোকার বড়ো দরজার ফোঁকর দিয়ে হালকা হাওয়া আসছে। বেশ ঠান্ডা। তার মনে হলো পাথরের টুকরোয় ভরা গরম বারান্দার ওপর না বসে বরং ভেতরের ছায়াছায়া শীতল পরিবেশে বসলে ভালো হয়। কোনোকিছু না ভেবেই গোবরাট পেরিয়ে ভেতরে ঢুকল আল হযরত। বিরাট কামরা, বহু ওপরে ছাদ। ঘরটার দুপাশের দেওয়াল থেকে শুরু হয়েছে প্রায়ান্ধকার লম্বা কিরডোর। পাথুরে মেঝেতে হাত-পা ছড়িয়ে বসে পড়ল সে। কিছুক্ষণ পর বসে থাকাও কষ্টকর মনে হলো তার কাছে। শেষমেশ চিত হয়ে শুয়েই পড়ল ধুলোভরা মেঝের ওপর।
.
ঘণ্টাখানেক চোখ বুজে শুয়ে থাকার পর কিছুটা ধাতস্থ হলো সে, চোখ মেলে তাকাল। চোখ গেল বহু ওপরে পলকাটা ছাতের কেন্দ্রের দিকে। দেখল কেন্দ্র ঘিরে একটা বৃত্তের ভেতর অদ্ভুত এক প্রাণির ছবি খোদাই করা। তার মনে হলো কোথায় যেন দেখেছে এমন আরেকটা ছবি। আরে তাই তো, এ যে স্বপ্নে দেখা ওই অর্ধেক মাছ আর অর্ধেক ছাগী! তবে এই ছাগীটার পায়ের নিচে প্রাচীন লিপিতে কীসব যেন লেখা। নিচ থেকে ভালো মতো দেখা যাচ্ছে না। আরও ভালো করে খোদাইকরা ছবিটা দেখার জন্যে কামরার একেবারে মধ্যিখানে গিয়ে দাঁড়াল আল হযরত। হ্যাঁ, এই তো। আরও স্পষ্ট হয়েছে চিত্রটা। পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে ছাগীর দুচোখের লাল মণি। সম্ভবত রঙিন কোনো পাথরে তৈরি। ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকা অবস্থাতেই হঠাৎ আল হযরতের মনে হলো ছাগীর লেজটা যেন ডানে-বাঁয়ে নড়ছে। পানিতে সাঁতার কাটার সময় মাছের লেজ যেমন ডানে-বায়ে দোলে, ঠিক তেমনি। তাছাড়া টিপটিপ করে যেন জ্বলছে চোখের লাল মণিগুলো।
ঠিক সেই সময় পায়ের নিচে একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করল সে। ক্রমেই গরম হয়ে উঠছে উটের চামড়া দিয়ে তৈরি হিদার সোল। হুড়মুড় করে পা সরাল আল হযরত। জমে থাকা পুরু ধুলো ডান পা দিয়ে সরিয়ে দেখল পাথুরে মেঝের ওপর যেখানটায় দাঁড়িয়ে ছিল, ঠিক সেখানেই নীল রঙে আরেকটা মাছের লেজঅলা ছাগীর ছাবি আঁকা! হুবহু ওপরেরটার মতো। তবে আকারে বেশ ছোটো আর এটা আঁকা হয়েছে একটা বর্গাকার হলদে পাথরের ওপর। ছাগীর পেটের কাছে আদ্যিকালের আরবি হরফে লেখা ‘সুহুরমাসু’। আল্লাহই জানেন একথার অর্থ কী? মনেমনে ভাবল সে। তবে নিঁখুতভাবে আঁকা ছবিটা দেখতে চমৎকার। পাকা কারিগরের কাজ।
কিন্তু গরম লাগল কেন পায়ের পাতায়? হিমঠান্ডা পুরো মেঝের অন্যসব পাথর। ব্যতিক্রম শুধু এইটে। নিচে কোনো কিছু নেই তো আবার! শাবলের চাঁড় দিয়ে খুলে দেখতে পারলে হতো, যেভাবে
মেঝের অন্য পাথরের সাথে লাগানো! কে আর এখন শাবল খুঁজতে যাবে? আর শাবল হাতে এদিকে হেঁটে আসতে দেখলে হাজারটা প্রশ্ন করবে মহল্লার লোকেরা। তারচেয়ে বরং এক কাজ করা যাক—পাথরের টুকরো দিয়ে মেঝের ওই চিত্রটার ওপর বাড়ি দিয়ে দেখলে কেমন হয়? পাতলা পাথর হলে ভেঙে যাবে। আর যদি মোটা হয়, তাহলে একটু-আধটু নড়বে তো বটেই। খুঁজে-পেতে মাঝারি মাপের পাথরের একটা টুকরে নিয়ে এলো আল হযরত। টুকরোটা দিয়ে জোরে বাড়ি দিলো নীল রঙে আঁকা ছবির ওপর। নড়ে উঠল ছবিঅলা পাথরটা। অন্য পাথর থেকে আলগা হয়ে উঁচু হলো এক পাশ। আরও দুতিন বার বাড়ি দেওয়ার পর মেঝে থেকে ছবিঅলা পাথরটা সহজেই ওঠাতে পারল আল হযরত। এক বিঘত পুরু পাথর। দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে একহাত। তবে ওজন যতটুকু হওয়ার কথা ততটুকু না, কেমন যেন হালকা! আলতো করে একপাশে নামিয়ে রাখল পাথরের চাঁইটা। ওটা যেখানে ছিল, কিছুই নেই সেখানে। হাঁ করে তার দিকে তাকিয়ে আছে চুন-বালির আস্তর মাখা চৌকো গর্ত। মনটাই খারাপ হয়ে গেল বেচারার। গর্তের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ফোস করে নিশ্বাস ছেড়ে নজর দিলো পাশে পড়ে থাকা ছাগীঅলা পাথরের দিকে। ইচ্ছে হলো লাথি মারে ওটার গায়ে। তবে সেকাজ করলে পায়ের টাখনু-গিরে ভাঙার সম্ভাবনা ষোলো আনা। রাগের মাথায় ধ্যাত্তেরিকা বলে উলটে দিলো পাথরটা। আর ঠিক তখনই তার নজরে পড়ল লালচে মতো কী যেন রয়েছে পাথরটার উলটোদিকে। গোলমতো একটা গর্ত ওখানটায়। কী আছে ভালো করে দেখার জন্যে দরজার কাছে আলোয় নিয়ে এলো চৌকো পাথরটা।
গর্তের ভেতর থেকে উঁকি দিচ্ছে লাল রঙের মোটা মখমলের কাপড়ের একটা ছোট্ট ঝোলা। ঝোলার মুখ সরু সোনলি রঙের রেশমি দড়ি দিয়ে বাঁধা। কালের বিবর্তনে বিবর্ণ কাপড় আর দড়ির রং। জীর্ণ হয়ে গেছে কাপড়। ঝোলাটা হাতে নিতেই আল হযরতের মনে হলো বেশ ওজন ওটার। তবে ভেতরে নিরেট শক্ত কিছু নেই। দড়ির গিঁট খুলে দেখল ভেতরে বালির মতো কী যেন। এতো তরিযত্ন করে শেষমেশ বালু ভরে রেখেছে ঝোলায়! দ্বিতীয়বার হতাশায় মুষড়ে পড়ল আল হযরত। কিন্তু পরক্ষণে হঠাৎ করেই তার মনে হলো: বালি তো এত ভারী হয় না! ঝোলার ভেতর হাত ঢুকিয়ে এক খমচা বালি মুঠোয় নিয়ে চোখের সামনে ধরতেই চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল আল হযরতের। সূর্যের আলোয় ঝিকিয়ে উঠেছে মুঠোভরতি সোনালি রঙের গুঁড়ো! এ যে সোনার ধুলো, সেটা আর কাউকে বলে দিতে হবে না। ঝুলিটা জেবে ভরে বিন হিন্দির বাড়ির পথে রওনা হলো সে। এ ব্যাপারে যা করার হুজুরই করুন।
.
সোনার গুঁড়ো বেচে মোটা টাকা পেল আল হযরত। মায়ের চিকিৎসা হলো, মেরামত করা হলো বাড়ি। খাওয়া-দাওয়ার আর কোনো অভাব রইল না। লোকের বাড়িবাড়ি গিয়ে ঝিগিরিও আর করতে হলো না তার মাকে। তবে এই ডামাডোলের ভেতর সর্বনাশ একটা হয়েই গেল। বাড়ি মেরামতের সময় ঘরের সব জিনিসপত্র সরিয়ে ভাড়াকরা অন্য আরেক বাড়িতে রাখা হয়েছিল। মাকে নিয়ে সে-ও উঠেছিল ওখানেই। যেভাবেই হোক আল হযরতের ধারণা হলো রাস্তার ওপর পড়ে পাওয়া পুরোনো হরফে লেখা কিতাবটা অতি মূল্যবান। এখানে-সেখানে বয়ে বেড়াতে গিয়ে যদি কোনোভাবে হারিয়ে যায় ওটা, তাহলে বিরাট ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। ভেবে-চিন্তে আবারও মাদ্রাসার মুদাররিস বিন হিন্দির স্মরণাপন্ন হলো সে। তাকে বলল, “হুজুর, বাড়ি মেরামতের কাজ চলছে। দুর্মূল্য এ কিতাব আপাতত আপনার কাছেই থাকুক। কী বলেন?”
“কোনো অসুবিধে নেই। রেখে যাও আমার কাছে। সময় – সুযোগ মতো ফিরিয়ে নিয়ে যেও,” উত্তর দিলেন বিন হিন্দি।
এই ঘটনার পরদিন রোজকার মতো মক্তবে ক্লাস করছে আল হযরত। যোহরের নামাজের ওয়াক্তে হঠাৎ করেই এলো এক মর্মান্তিক দুঃসংবাদ। কী বিষয়? না, আগুন লেগেছে বিন হিন্দির বাড়িতে। হই হই করে হুজুরের বাড়ির উদ্দেশ্যে ছুটলো মাদ্রাসের যত তালেবে এলেম। নেভাতে হবে আগুন, বাঁচাতে হবে মাল- সামান।
কিন্তু ওবাড়ি তো আর কাছে না! অকুস্থলে পৌঁছে সবাই দেখল পুড়ে ঝামা হয়ে গেছে বাড়িতে যা ছিল সব। ছাইকালি মেখে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে আছে মুদাররিসের বিবি আর দুই মেয়ে। করার প্রায় কিছুই নেই। এখন সবার মনে একটাই প্রশ্ন। বাড়িতে আগুন লাগল কী করে? হঠাৎ হইচই শুরু হলো জড় হওয়া প্রতিবেশী আর শিক্ষার্থীদের ভেতর। কী ব্যাপার? আবারও আগুন লাগল নাকি? না, আগুন-ফাগুন ধরেনি। ধরার জায়গাও নেই। হুজুরের দাড়ি ধরে টানছে তার বিবি, মুখ দিয়ে স্রোতের মতো বেরুচ্ছে গালিগালাজ। জানা গেল মাঝে-মধ্যেই মাথা খারাপ হয়ে যায় মুদাররিসের বিবির। কেউ কেউ বলে জিনের আছর হয় তার ওপর। যাহোক, দুপুরের খানা পাকাচ্ছিল বিবি। আর তখনই শুরু হয় পাগলামি। নিজেই চুলো থেকে জ্বলন্ত চেলা কাঠ নিয়ে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে পুরো বাড়িতে। বাসা নাকি ভরতি হয়ে গেছে বিষাক্ত মাকড়সায়। অনবরত মারণ-জাল বুনছে তারা দেওয়াল আর ছাদে। কাঁচা ইঁট আর কাঠ দিয়ে তৈরি আদ্যিকালের পুরনো বাড়ি। মরু এলাকার শুষ্ক আবহাওয়া। দেখতে দেখতে উড়েপুড়ে খতম।
হঠাৎ আল হযরতের মনে পড়ল তার কিতাবের কথা। হুজুর ওটা বাড়িতে এনে রাখেননি তো আবার? তার আশংকাই সত্যি হলো। অন্য সবকিছুর সাথে ছাই হয়ে গেছে ওটাও। হুজুরের যা হওয়ার তা হলো, কিন্তু আল হযরতের ক্ষতি হলো মারাত্মক। ভীষণ উপকারী ছিল চামড়ায় বাঁধানো পুরনো সেই কিতাবটা!
হাযম মক্তবের পাঠ শেষ করে সানায় চলে এলো আল হযরত। উদ্দেশ্য—মক্তবি লেখাপড়ার সর্বোচ্চ ধাপে পৌঁছনো। এই আল আমিরিয়াতেই সুমায়েল ইয়ান্দুজা নামে নামকরা এক উর্দুন মুআল্লিম ছিলেন। ধবধবে ফর্সা, ছিপছিপে গড়ন, খাড়া নাক, পাথরকুঁদে বের করা চেহারা, মুখভরতি সফেদ দাড়ি। সত্তরের ওপর বয়েস হলেও তিরের মতো সোজা মেরুদণ্ড। পুরো অবয়বজুড়ে ফুটে বেরুচ্ছে দুর্দান্ত এক ব্যক্তিত্ব। একে আমিরিয়া মাদ্রাসার মুদির আল শামস আল হাযম অব্দি সমঝে চলেন। একাধিকবার গভর্নর স্বয়ং তাকে মাদ্রাসার অধ্যক্ষ বা মুদিরের পদ নিতে অনুরোধ করেছেন। কিন্তু কোনোবারই ওই পদ নিতে রাজি হননি ইয়ান্দুজা। বলেছেন, পদ-পদবিতে তার কোনো আকর্ষণ নেই। আরবি ভাষার উচ্চতর ব্যাকরণ পড়াতেন ইনি। শেখাতেন ওই ভাষার বিবর্তনের ইতিহাস। অগাধ তার পাণ্ডিত্য। কানাঘুষা আছে—আইয়ামে জাহেলিয়া আমল থেকে শুরু করে সুপ্রাচীন সুমেরিও গুপ্তবিদ্যা অব্দি তার নখদর্পণে। অত্যন্ত রাশভারী এই বৃদ্ধ মুদারিসকে এড়িয়ে চলত তরুণ তালেবে এলেমেরা।
কিন্তু আল হযরতের বেলায় ঘটলো উলটো ঘটনা। সুমায়েল ইয়ান্দুজার ওপর ভীষণ শ্রদ্ধা জন্মালো তার। হাদিস-কোরআন- তফসির, ইযমা-কিয়াস-ফিকাহ এসবের দিকে নজর না দিয়ে মনোযোগী হলো আরবি ভাষা শেখার দিকে। ঘুরঘুর করতে লাগল ইয়ান্দুজার পেছন পেছন। মুদাররিসের কখন কী দরকার সেদিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। ওজুর পানি দরকার হুজুরের? দৌড়ে পেতলের লোটাভরতি পানি এনে দেয়। তেমাথার কাছে আব্বাসের খবুজের দোকান। যোহর নামাজ শেষ হতেই সেখানে ছোটে আল হযরত। কী বিষয়? মোয়াল্লেম ইয়ান্দুজা দুপুরে গরম রুটি খেতে পছন্দ করেন। তার জন্যে মোখমাজুন-এর ভাঁটের গনগনে আগুনে শেঁকা ধবধবে নরম রুটি আনতে হবে। শুধু যে রুটি আনবে তাই না। ফেরার সময় সাথে করে আল ওবায়েদের মাতামু থেকে খেজুর পাতার চাঙড়ে দুম্বার কলজে ভুনাও নিয়ে আসবে। বসরার জওহার আলওয়ার্দ হুজুরের বিশেষ প্রিয়। সানার কিছু ব্যবসায়ী, যারা বাগদাদে যাতায়াত করে, তাদের হাত-পা ধরে বসরা থেকে ছোটো যুজাজাভরতি গোলাপের আতর আনিয়ে দেবে। তবে শেষমেশ যে উপহারটা সে ইয়ান্দুজাকে দিলো, তার তুলনা বিরল। মরোক্কো থেকে সবুজ রঙের জিলদুন হিদা বা ফিতেঅলা চামড়ার স্যান্ডেল শ্য আনিয়ে প্রিয় মুদারিসের সামনে হাজির করল। সানায় উটের চামড়ায় তৈরি যে হিদা পাওয়া যায় তা যেমন কাঠের মতো শক্ত, তেমনি কদাকার। নরম আর চমৎকার মরোক্কান জুতো কেবলমাত্র উচ্চ পদস্থ সরকারি আমলা আর সেনাপতিরাই পরে।
যাহোক, এত খাতির-যত্ন করে অবশেষে ইয়ান্দুজার মন জয় করল আল হযরত। মুয়াল্লিম তাকে বললেন, “আরবি ভাষায় তোমার জ্ঞান অতি উত্তম। আর কী কিছু শিখতে চাও?”
বিনয়ে গলে গিয়ে ঘাড় বাঁকা করে আল হযরত বলল, “হুজুর আপনি হাকিমে আযিম। আপনার অজানা কিছু নেই। তবুও দয়া করে জানতে যখন চেয়েছেন, তখন মনের ইচ্ছেটা বলি। সেবিয়ান আর মিনিয়ান ভাষা দুটো যদি শেখাতেন, তাহলে এই অধমের বহুদিনের আকাঙ্ক্ষা পুরণ হয়। ওই ভাষা দুটোর তালিম কি দেবেন, হুজুর?”
মনেমনে চমকে উঠলেও বাইরে সেটা প্রকাশ করলেন না ইয়ান্দুজা। এ জবান সাধারণ মানুষের জন্যে নয়। এসব ভাষায় কথাবলা লোকেরা পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে বহুকাল আগে। খোদার অভিশাপ নাজিল হয়েছিল তাদের ওপর। নিষিদ্ধ দেব- দেবীর পুজো করত তারা। তবে দুনিয়া থেকে বিদেয় হওয়ার আগে গোপন আর অপার্থিব সব বিদ্যে লিখে রেখে গেছে এই দুই ভাষায়। এ বিদ্যে অপাত্রে পড়লে ভয়ঙ্কর বিপর্যয় ঘটে যেতে পারে। মুখে বললেন, “এগুলো আদ্যিকালে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া ভাষা। এর বাস্তব কোনো প্রয়োগ নেই। এসব শিখে সময় নষ্ট করে কী লাভ? তারচেয়ে বরং অ্যারামেয়াক শেখো। পুরনো আরবের ইতিহাস আর কিংবদন্তি যা আছে তার প্রায় পুরোটাই এ ভাষায় লেখা। যদিও লেখকেরা বেশিরভাগই খ্রিষ্টান কিম্বা ইহুদি অথবা পৌত্তলিক আরব, তবুও চলমান আরবিতে এসব লেখা অনুবাদ করলে বড়ো একটা কাজ হবে। তালেবে এলেমরা নিজ জাতি সম্পর্কে জানতে পারবে।”
“হুজুর, ছোটো মুখে বড়ো কথা হয়ে যায় তবুও বলছি, ওসব কাজ সিরিয়ান ইহুদিদের জন্যেই বরং তোলা থাক। আমাকে আপনি সেবিয়ান আর মিনিয়ান শেখান।”
এবার শেষ চেষ্টা করলেন ইয়ান্দুজা। বললেন, “ধরে নাও ওগুলো শেখালাম তোমাকে, কিন্তু ওই জ্ঞান আয়ত্ত করার পর সেটা প্রয়োগ করবে কোথায়? ওসব ভাষায় লেখা পুঁথি-পত্র খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব। একথা ঠিক পাথরের দেওয়াল কিম্বা স্তম্ভ বা মাটির ফলকেও বিস্তর লেখা-জোখা আছে, তবে সেসব কবেই হারিয়ে গেছে কালের গর্ভে!”
“দুনিয়া থেকে কোনোকিছুই চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে যায় না, মুহতারাম। হাজার বছরের সুবিশাল কর্মযজ্ঞ ধ্বংস হলেও কিছু না কিছু রয়েই যায়। আর যদি ওসব ভাষায় লেখা কিছু খুঁজে না-ই পাই তো তাতেই বা কী? আপনিই বলেছেন লাভ-লোকসান হিসেব করে শেখা যে বিদ্যে তা আসলে প্রশিক্ষণ, প্রকৃত জ্ঞান চর্চা নয়!”
“বেশ। শিখতে যখন চাও, শেখাবো তোমাকে। তবে তার আগে শর্ত আছে একটা। ছোট্ট একটা পরীক্ষায় কামিয়াব হতে হবে। দুটো প্রশ্ন করবো। দেখি তো সঠিক জবাব দিতে পারো কি না? যদি পারো, তাহলে কাল থেকেই শুরু করবো শেখানো। আর যদি নাকাম হও, তাহলে ত্যাগ করতে হবে এ খায়েশ।”
“বেশাক। সওয়াল করেন, হুজুর,” কোনো কিছু না ভেবেই তুরন্ত উত্তর দিলো আল হযরত।
“বলতে পারবে সেবিয়ান ভাষায় কারা কথা বলত? আর এ ভাষা হারিয়েই বা গেল কেন?”
“সেবিয়ান লফজটা এসছে সাবা থেকে। সেই সুলাইমান (আ.) পয়গম্বরের সময় সেবার রানি বিলকিসের জামানার লোকেরা এ ভাষায় কথা বলত। আমাদের এই দেশেই উত্তর-পুবে ছিল সেবার রানি বিলকিসের রাজধানী। খুব সমৃদ্ধশালী ছিল এ ভাষায় কথা বলা মানুষেরা। নাফরমানির কারণে আল্লাহর গজব নাজিল হয়েছিল এদের ওপর। খুব অল্প সময়েই দুনিয়া থেকে হারিয়ে যায় তারা।”
“বাহ, বেড়ে বলেছ। এখন বলো মিনিয়ান ভাষায় কথা বলত কারা?”
এ প্রশ্নটা করে আল হযরতের মুখের দিকে চাইলেন ইয়ান্দুজা। ঠোঁটের ডগায় হালকা হাসির রেখা। তিনি নিশ্চিত প্রথম প্রশ্নের উত্তর ভাগ্যক্রমে দিতে পারলেও, এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পরবে না আল হযরত। যথেষ্ট কঠিন এ সওয়াল। মিনিয়ান ভাষা সেবিয়ান ভাষার থেকেও হাজার বছরের পুরনো। এ এক অতি প্রাচীনকালের পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া জবান। বেশিরভাগ মানুষ জিন্দেগিতে এর নামও শোনেনি।
সওয়াল শুনে চুপ করে রইল আল হযরত। কী যেন ভাবল কিছুক্ষণ। তারপর বলল, “হুজুর। এ ভাষায় কথা বলত অতুল বৈভবের অধিকারী ইরাম নগরীর বাসিন্দারা। এই শহরকে বলা হতো লাখো আমুদ অর্থাৎ স্তম্ভের শহর। অনেকে বলে এটাই নাকি ছিল সাদ্দাতের বেহেশত।”
আল হযরতের জবাব শুনে থ হয়ে গেলেন ইয়ান্দুজা। আল হযরতকে যতখানি ফটকাবাজ টাইপ শিক্ষার্থী মনে হয়েছিল, এখন দেখা যাচ্ছে ততখানি ফেরেববাজ এ না। ভেবেছিলেন ফালতু কিছু গান-পদ্য লিখে সস্তা নাম কামিয়েছে এ ছোকরা। আদতে দেখা যাছে ভেতরে মাল-মশলা কিছু আছে এর! মনে মনে এসব কথা ভাবলেও মুখে বললেন, “সেবিয়ান ভাষার কথা বাদ দাও। ও ভাষা খুব বেশি পুরোনো না। কিন্তু মিনিয়ান ভাষার ব্যাপারে জানলে কীভাবে বলতে পারবে?”
হাযম মক্তবের হুজুরের বিষয়টা পুরোপুরো চেপে গেল আল হযরত। ওসব কথা বললে পিছিয়ে যেতে পারেন ইয়ান্দুজা। ভাবতে পারেন কালো চামড়ায় মোড়া ওই অভিশপ্ত কিতাব আসলে হারিয়ে যায়নি। এখনও রয়ে গেছে আল হযরতের কাছে। আর এ কারণেই মিনিয়ান ভাষা শিখে না-জায়েজ ফায়দা লুটতে চাইছে এ ছোকরা। বলল, “জনাব উফনুন আল তাঘলিবি-এর নাম তো শুনেছেন। নবিজির (স.) আমলের মানুষ। কবিতা লিখে নাম করেছিল খুব। এক কবিতায় ইনি বলেছেন:
“জন্মাতাম যদি ইরাম শহরে
যদি বেড়ে উঠতাম লুকমান কিম্বা যাদান কওমে
যদি কাব্য রচনা করতে পারতাম মিনিয়ান ভাষায়?’
“বিখ্যাত এই কবির লেখা পড়ে মনে হয়েছে মিনিয়ান ভাষায় কথাবলা লোকদের বিষয়ে এর আগ্রহ ছিল ব্যাপক। কিন্তু যত আগ্রহই থাকুক, ওই ভাষা তিনি শিখতে পারেননি। জানতেও পারেননি মিনিয়ান ভাষায় লেখা পুঁথিপত্রে কী আছে।”
কী আর করা, প্রাচীন ভাষা দুটো আল হযরতকে শেখালেন ইয়ান্দুজা। তবে তার কাছে গোপন বিদ্যার যেসব প্রাচীন পুঁথি-পত্ৰ ছিল সেসবের একটাও তাকে দেখালেন না। আল হযরতের মূল উদ্দেশ্যই ছিল ওই লেখাগুলো মুআল্লেমের কাছ থেকে হাতিয়ে নেওয়া। তবে মুহতারাম বেঁচে থাকতে সেটা প্রায় অসম্ভব। কোনোভাবেই ওগুলো হাতছাড়া করবেন না তিনি। একমাত্র উপায় ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করা। মানুষ মরণশীল। হুজুরের যে বয়স, ফেঁসে যাবে যেকোনো দিন। আর তখন তার হুজরায় গিয়ে ছানবিন করলেই বেরিয়ে আসবে আসল জিনিস। মুআল্লেম ধনাঢ্য ব্যক্তি নন। খোঁজাখুঁজি করলেও কেউ কিছু মনে করবে না। তার হুজরায় কে আর কী পাবে!
তবে সে সুযোগ আল হযরত আর পেল কোথায়? ইয়ান্দুজা আল বিদা হওয়ার আগেই গভর্নর রুইয়ানির রোষানলে পড়ল সে।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন