নজ্জুমি কিতাব – ৩০

দৌলতপুর থানার শিকারপুর বর্ডার পার হয়ে বাস ধরে কোলকাতায় এসে শনি আর শীতলা মন্দিরের মাঝামাঝি গোঁসাই লেনের এক মেসে গিয়ে উঠল দীনবন্ধু। এখান থেকে সোনাগাছি যৌনপল্লী একেবারে কাছে। সোনগাছি নামটা এসেছে সোনা গাজি থেকে। এই সুফি সাধকের একটা মাজার আছে ওখানে। কলকাতার দর্জি পাড়ায় দীনবন্ধুর পিসেমশায় ভবতারিণী থাকেন। ওখানে না গিয়ে, এই মেসে ওঠার পেছনে কারণ আছে। ‘৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় দীনেরা কোলাকাতয় এসে আট মাস ছিল, পিসেমশায়দের বাড়িতে। সেই সময় শরৎ সিনহা নামের মাঝবয়েসি এক হাই স্কুল টিচার এক বিধবা বড়ো বোনকে নিয়ে থাকতেন পাশের বাড়িতে। দীনকে খুব স্নেহ করতেন এই শিক্ষক। তার বিধবা বোনের একমাত্র ছেলে ছিল অবিকল দীনের মতো দেখতে। বারো বছর বয়সে ধনুষ্টংকারে আক্রান্ত হয়ে মারা যায় সে।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কুষ্টিয়ায় ফিরে আসলেও চিঠিপত্রের মাধ্যমে শরৎ সিনহার সাথে যোগাযোগ ছিল দীনের। তো সেই বিধবা বোন মারা যাওয়ার পর দর্জিপাড়ার বাসা ছেড়ে দিয়ে এই মেসে ওঠেন শরৎ বাবু। তখন থেকে রয়ে গেছেন এখানেই। তন্ত্র- মন্ত্র আর আধিভৌতিক বিষয়ে প্রবল আগ্রহ এই মাস্টার মশায়ের। দরজি পাড়ায় থাকতে প্রতি রোববার সকালে বিনে পয়সায় হাত দেখতেন, কোষ্ঠি বিচার করতেন। নানান জায়গা থেকে লোক আসত তার কাছে। দর্শনার্থীদের ভিড় লেগে থাকত সকাল আটটা থেকে দুপুর দুটো অব্দি।

টেনেটুনে পাঁচ ফুট চার ইঞ্চি লম্বা হবেন শরৎ বাবু। মিশকালো গায়ের রং। হলকা-পাতলা গড়ন। পাতলা ঠোঁট, বাঁকানো নাক, ভাসাভাসা চোখ, মাথাভরতি টাক। নিখুঁতভাবে কামানো দাড়ি- গোঁফ, গলায় কাঠের সরু মালা। সবসময় সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি পরে থাকেন। পায়ে ট্যান কালারের পাম শ্য, খয়েরি রঙের মোজা। সাত্ত্বিক জীবন-যাপন করেন। মাছ-মাংস ছুঁয়েও দেখেন না। মেসের নিচ তলায় একটা ঘর ঘালি ছিল। ওখানাই ভাড়া নিলো দীন।

সে যে বাংলাদেশে কাউকে কিছু বলে আসেনি, সেইটে শুরুতে বুঝতে পারেননি শরৎবাবু। দিন পাঁচেক পরে জানতে পেরে নিজে ভবানী বাবুর বাড়ি গিয়ে খবর দিয়ে আসলেন। দীনকে অনুরোধ করেছিলেন সঙ্গে যেতে, কিন্তু সে যায়নি। কোলকাতায় আসার পর থেকেই কেমন যেন উদাস হয়ে আছে ছেলেটা। সারাদিন ঘরে থাকে। কথা-বার্তা বলে খুব কম। তার এখানে আসার কারণ কী সেইটেই এখন অব্দি বোঝা যায়নি। আরেকটা দিন দেখবেন শরৎ বাবু। দীন যদি নিজে থেকে বলে তো ভালো, না হলে তাকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিতে হবে।

দেখে মনে হয়: অদ্ভুত কিছু একটা চেপে বসেছে এ ছেলের ঘাড়ে!

.

পরদিন দুপুরে স্কুল থেকে মেসে ফিরলেন শরৎ বাবু। দীনকে ডেকে নিয়ে একসাথে খাওয়া-দাওয়া সারলেন। এরপর নিজ কামরায় নিয়ে এলেন তাকে। চেয়ার এগিয়ে দিলেন দীনের দিকে, নিজে বসলেন বিছানার ওপর। সরাসরি বললেন, “দীনবন্ধু। এখানে আসার পর থেকেই দেখছি তুমি খুব চুপচাপ। সব সময় গভীরভাবে কী যেন ভাবছ। হঠাৎ করেই এখানে আমার কাছে কেন এলে, সেটাও জানি না। মনের আনন্দে এখানে-ওখানে ঘোরঘুরি করার ছেলে তো তুমি নও। বিলক্ষণ বুঝতে পারছি— গোপন কোনো বিষয় আছে। বলি কী, ঢাকঢাক গুড়গুড় না করে সবকথা খুলে বলো আমাকে। যতটুকু সাধ্যে কুলোয়, করবো তোমার জন্যে। নাও, কালক্ষেপণ না করে শুরু করো এবার।”

হাটশ হরিপুর থেকে শুরু করে কোলাকাতা আসা অব্দি যা যা ঘটেছে, সবকিছু ভেঙেচুরে বলল দীনবন্ধু। জানাল: কোলকাতায় শরৎ বাবুর কাছে এসে ওঠা কোনো সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত ছিল না। এই নজ্জুমি কিতাব হাতে আসার পর থেকেই কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেছে তার চিন্তা-ভাবনা। অদ্ভুত এক ঘোরের ভেতর বাস করছে সে। কাউকে কিছু না জানিয়ে শরৎ সিনহার কাছে চলে আসা কোনো কাকতাল না, এখানে আসার পেছনে কাজ করেছে রহস্যময় কোনো অজানা শক্তি। রাতের বেলা নানান জায়গার স্বপ্ন দেখে সে। ফাঁকা মরুভূমি, বহু পুরনো বিধ্বস্ত নগরী, কায়রো, দামেস্ক, কিম্বা আলেকজান্দ্রিয়ার মতো সুপ্রাচীন শহর। পুরোটা দিন ঘুমঘুম লাগে। ইচ্ছে হয় বিছানায় শুয়ে কাটিয়ে দেয় দিনটা। শরৎ বাবু দেখলেন দিন-রাত বিছানায় শুয়ে থাকার কারণে ফুলে উঠেছে দীনের চোখ-মুখ, হাত-পায়ের পাতা। তাছাড়া, বইটা পড়ে দেখার প্রবল ইচ্ছে জাগে মনে। তবে আরবি ভাষা জানা না থাকার কারণে সম্ভব হয়নি ওকাজ।

শরৎ বাবু বললেন, “ওই নজুমি কিতাব না কী, সেইটে দেখাতে পারবে আমাকে?”

“অবশ্যই দেখাতে পারবো। একটু অপেক্ষা করুন। এখনই নিয়ে আসছি।”

.

বইটা হাতে নিয়ে নেড়ে-চেড়ে দেখলেন শরৎ সিনহা। মোটা মোটা আরবি হরফে শেষের দিকে পুরো একটা চ্যাপ্টার লেখা। লেখার ভেতর নানান ধরনের রেখাচিত্র, সাংকেতিক চিহ্ন। বইয়ের অন্য অধ্যায় থেকে একেবারেই আলাদা। এই লেখাগুলোই যত গণ্ডগোলের মূল। কিন্তু কী লেখা আছে এখানে? আরবি জানা থাকলে বোঝা যেত। আরবি জানে এমন কাউকে কি দেখাবেন? শুধু দেখালেই তো হবে না, ওখানে কী লেখা আছে সেইটে পড়ে বোঝার জন্যে কিছুদিনের জন্যে বইটা তাকে দিয়ে দিতে হবে। এ ঝুঁকি নেওয়া ঠিক হবে? যতুটুকু জানা গেছে, মারাত্মক এক বিধ্বংসী ক্ষমতা রয়েছে এই বইটির। এ বই একবার হাতছাড়া হলে ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।

আরেকটি উপায় আছে। সেটি হলো তার গুরুদেব, রুদ্র ভৈরবের কাছে যাওয়া। গুরুদেব থাকেন হংসেশ্বরী মন্দিরের কাছে ছোটো একটা মঠে। হুগলি জেলার বাঁশবেড়েয় আদি প্রকাশ জগৎজননী দক্ষিণাকালীর এই মন্দিরটি তৈরি হয় দুশো বছর আগে। এরও তিনশো বছর আগে তৈরি হয় ওই মঠ। টেরাকোটার কাজকরা ছোটো একটা ত্রিরত্ন শিব মন্দির আছে ওখানে। গুটি কয়েক শিষ্যকে ওখানেই পাঠদান করেন গুরুদেব। ট্রেনে গেলে মঠে পৌঁছতে সর্বোচ্চ দেড় ঘণ্টা।

৩১

পরের দিন রোববার। নজুমি কিতাব কাঁধের ঝোলা ব্যাগে ভরে সকাল দশটার সময় শরৎ বাবু একাই রওনা হলেন গুরুদেবের মঠের উদ্দেশ্যে। দীনবন্ধুকে বলে গেলেন, “এখানে আসা অব্দি ঘরে বসে আছ। বাইরে বেরিয়ে একটু ঘোরঘুরি করে এসো। মন ফ্রেশ হবে।”

শার্ট-প্যান্ট পরে মেস থেকে বেরুল দীনবন্ধু। মেসের সামনেই গোঁসাই লেনের পর বলরাম দে স্ট্রিট। ওই রাস্তা ধরে পশ্চিমে হাঁটা ধরল সে। ডানে বাঁক নিতেই সামনে পড়ল বিবেকানন্দ রোড। আবারও ডানে মোড় নিতেই সামনে দেখা দিলো রবীন্দ্র সরণী। দিগম্বর জৈন মন্দির ছাড়িয়ে মাওলানা শওকত আলি রোড ধরে এগিয়ে যেতেই পেল হরিণ বাড়ি লেন। হরিণ বাড়ি লেন ধরে আরও কিছুটা হেঁটে যাওয়ার পর বামে মোড় নিতে শুরু হলো তিরেতা বাজার। কোলকাতার এই তিরেতা বাজারকেই লোকে বলে চায়না টাউন। ব্রিটিশ আমলের প্রথম গভর্নর জেনারেল উইলিয়াম হেস্টিংসের আমালে টং অ্যাচুও নামের এক চীনেম্যান কোলকাতায় আসে। পরে কোলাকাতা থেকে তিরিশ কিলো দূরে অছিপুরে আমের বাগান কিনে চিনিকল বসায়। এরপর থেকেই দলে দলে আসতে থাকে চীনেরা। এক সময় প্রায় বিশ হাজার চীনেম্যান থাকত এখানে। কাজ করত চামড়ার কারখানায়। এছাড়াও কাঠের ফার্নিচার, ঘড়ি সারাই, রেস্তোরাঁ, টেইলারিং আর রেশমি কাপড়ের ব্যাবসা ছিল তাদের। তবে এরা টাকা বানিয়েছিল আফিমের কারবার করে। সাতচল্লিশে ভারত স্বাধীন হওয়া অব্দি রীতিমত লাইসেন্স নিয়ে আফিমের ব্যাবসা করত এখানকার চীনেরা। এখন সংখ্যায় অনেক কমে গেছে এরা। বেশ কিছু শিফট করেছে পাশের এলাকা ট্যাংরায়।

রাস্তার দুপাশে হলদে আর লাল রঙের দালান, দোকানপাট, গুয়ান দেবতার মন্দির। চীনে হরফে লেখা নানা আকারের সাইনবোর্ড। রেস্টুরেন্ট থেকে ভেসে আসা খাবারের সুগন্ধে ম ম করছে পরিবেশ। গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে চলল দীন। অবাক হয়ে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। এমন অদ্ভুত জায়গাও কোলকাতায় আছে! ‘৭১ সালে এ শহরে আট মাস ছিল বটে, কিন্তু এদিকপানে আসা হয়নি।

একটা জুতোর দোকানের পাশে সাদা রঙের কাঠের ফ্রেমে বাঁধানো কাচে ঘেরা ছোট্ট একটা অফিস চোখে পড়ল। সাইন বোর্ডে লেখা: ইউয়ানশি তিয়ানঝুন সাইকিক কনসালটেন্সি। কাচের গায়ে ইংরেজিতে লেখা সাইকিক ক্লেয়ারভয়্যান্স, ট্যারো কার্ড রিডিং, অ্যাস্ট্রোলজি, পাম রিডিং, ক্রিস্টাল বল রিডিং। এছাড়াও, ক্রিস্টাল বল, মোটামোটা রেখা আঁকা হাতের তালু, আর ট্যারো কার্ডের ছবি। নানা আকারের চীনে হরফের নিচে ইংরেজিতে লেখা: ম্যাডাম জুই গুওলিয়ং, ফরচুন টেলার। এখানে আই চিং ও ফেং শুই পদ্ধতিতে নিখুঁতভাবে ভবিষ্যত গণনা করা হয়।

এ ধরনের কোনোকিছু দীন জীবনে কোনোদিন দেখেনি। কুষ্টিয়ার থানাপাড়ায় হরলাল মিশ্রকে দিয়ে অনেক দিন আগে একবার হাত দেখিয়েছিল। কিন্তু সেখানে এতসব আড়ম্বর ছিল না। দুটো পুরনো চেয়ার আর ছোটো একটা টেবিল ছিল হরলালের বৈঠকখানায়। টেবিলের ওপর দর্শনার্থীর দুই হাত রেখে তালুর রেখা পড়ত সে। কী মনে হলো কে জানে, কাচের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল দীনবন্ধু। দরজার ওপরে ছাত থেকে ঝুলছে উইন্ড চাইম। দোল খেয়ে টুংটাং আওয়াজ বেরুল ওটা থেকে। আবছায়া অন্ধকার ভেতের।

প্রথমে চোখে পড়ল না কিছুই। একটু পরেই চোখে আঁধার সয়ে আসতে দেখতে পেল লাল কাপড়ে ঢাকা গোল একটা টেবিল সামনে নিয়ে বসে আছে মাঝবয়েসি গোলগাল এক চীনে মহিলা। ধপধপে ফর্সা মুখে হালকা মেকাপ। আপেলের মতো টসটসে গাল, ঠোঁটে লাল টুকটুকে লিপস্টিক। চীনে মহিলাদের তুলনায় যথেষ্ট বড়ো টানাটানা কাজল কালো চোখের পাতায় সবুজ আই শ্যাডো। নাকের দুপাশে বেশ খানিকটা দূরত্বে আই ব্রাউ পেন্সিলে আঁকা ধনুক বাঁকা ভ্রু। চওড়া কপাল। পেছনে টানটান করে বাঁধা সিল্কের মতো কালো চকচকে চুল। পরনে ফুলহাতা কালো রঙের কিমোনোর মতো পোশাক। চাঁপাকলি আঙুলের নখে গাঢ় লাল নেল পলিশ। গলায় মোটা মোটা লাল, নীল, সবুজ, হলুদ, আর কালো পাথরের চওড়া মালা। এই বয়সেও যে কাউকে আকৃষ্ট করবে মহিলা। পুরো মেঝে জুড়ে আটকোনা অদ্ভুত এক মানচিত্র আঁকা। মানচিত্রজুড়ে মোটা মোটা লাইন টানা। ঢোকার দরজা থেকে শুরু করে একটা লাল মোটা লাইন সোজা চলে গেছে সাইকিক মহিলার পায়ের কাছে।

স্মিত হেসে পরিষ্কার বাংলায় মহিলা বলল, “ম্যাডাম জুইয়ের আড্ডায় আপনাকে স্বাগতম জানাচ্ছি।” ভারী লাল ভেলেভেটে মোড়া গদিঅলা একটা সাদা রঙের চেয়ার দেখিয়ে আবারও বলল, “এগিয়ে এসে সামনের ওই গোল চেয়ারটায় আরাম করে বসুন।”

রিনরিনে, মিষ্টি মহিলার কণ্ঠস্বর। একেবারে ভাবলেশহীন মানুষও আকৃষ্ট হতে বাধ্য। প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে হেঁটে এখানে এসেছে দীনবন্ধু। টনটন করছে পায়ের পাতা। এগিয়ে গিয়ে ধপ করে বসে পড়ল খালি চেয়ারটায়। হেলান দিলো চেয়ারের পিঠে। ঠিক তখনই সুইচ টিপে আলো জ্বাললো মহিলা। টেবিলের ওপর ছাদ থেকে ঝুলছে গোলাকার শেড দিয়ে ঢাকা লাইট। উজ্জ্বল আলোয় ভরে উঠল শুধুমাত্র টেবিলের ওপরটা। তার চোখে পড়ল টেবিলের ঠিক মাঝখানে মাঝারি আকারের ক্রিস্টাল বল। একপাশে নিখুঁতভাবে সাজিয়ে রাখা ট্যারো কার্ডের বান্ডিল, ম্যাগনিফাইং গ্লাস, একটা নোটপ্যাড, আর লাল-নীল পেন্সিল। টেবিলের বাঁ দিকে তিনটে রুপোর কাঁচা-টাকা সাইজের পেতলের পয়সা। পয়সাগুলোর মাঝখানে চারকোনা ফুটো। ফুটো ঘিরে চীনে হরফ লেখা। ওগুলোর পাশে চপস্টিকের মতো এক গোছা কাঠের চ্যাপ্টা স্টিক। পার্থক্য শুধু এই, চপস্টিক গোলাকার, কিন্তু এই স্টিকগুলো চারকোনা।

আবারও মুখ খুলল ম্যাডাম জুই। রিনরিনে গলায় স্পষ্ট করে বলল, “আপনি কি হাত দেখাতে চান? না ট্যারো কার্ড গণনা করাবেন? চাইলে ক্রিস্টাল বলও রিড করাতে পারেন। প্রতিটি আইটেমের জন্যে পঞ্চাশ টাকা করে ফি দিতে হবে। এই যে চ্যাপ্টা স্টিক আর তিনটে কয়েন দেখছেন, এগুলো দিয়ে যে গণনা করা হয় তাকে বলে আই চিং। গণনটা বেশ জটিল। মেলা কিছু হিসেব করতে হয়। আই চিং করালে ষাট টাকা ফি। আর ওই যে মেঝের ওপর মোটা মোটা লাইন টানা ম্যাপের মতো চিত্রটা দেখছেন, ওটাকে বলে ফেং শুই। ফেং শুই করতে সবচেয়ে বেশি সময় লাগে। এর পারিশ্রমিক পঁচাত্তর টাকা। প্রথম তিনটে আইটেমের যেকোনো একটা শুরু করার আগে টেবিলের বাঁ পাশে পঞ্চাশ টাকা অগ্রিম রাখতে হবে। টাকাটা চাপা দিতে হবে এই পেপারওয়েটটা দিয়ে,” এ কথা বলে ম্যাডাম জুই তার ডানপাশে রাখা ছোটো একটা টেবিলের ওপর থেকে হলদে রঙের জেড পাথরে তৈরি গুয়ান দেবতার মূর্তি খোদায়করা একটা চকচকে পেপারওয়েট উঠিয়ে নিয়ে টেবিলের ডানপাশে রাখল।

পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে পঞ্চাশ টাকার একটা নোট নিয়ে টেবিলের বাঁ পাশে পেপারওয়েটের নিচে রাখল দীনবন্ধু। বলল, “ট্যারো কার্ড রিড করাতে চাই।”

“বেশ। ট্যারো কার্ডই হোক তাহলে,” মিষ্টি হেসে উত্তর দিলো ম্যাডাম জুই। টেবিলের ডান পাশে রাখা ট্যারো কার্ডের ডেকটা দেখিয়ে বলল, “এখানে আটাত্তরটা কার্ড আছে। কার্ডগুলো টেবিলের ওপর মেলে ধরব আমি। আপনি যে কোনো তিনটে বেছে নেবেন। প্লেইং কার্ডের মতোই সব তাসের এক পিঠে একই রকম ছবি, কিন্তু অন্য পিঠে প্রত্যেকটাতে ভিন্ন ভিন্ন ছবি। যে তাসগুলো তুলবেন আপনি, সেগুলোর ছবি রিড করে আপনার ভাগ্য গণনা হবে। তবে তার আগে আপনার জন্ম তারিখ, সময়, আর কোথায় অর্থাৎ কোনো স্থানে জন্মেছেন সেইটে বলবেন। ভাগ্য গণনার জন্যে তথ্যগুলো খুব দরকারি।”

রাইটিং প্যাডে জন্ম তারিখ, সময় এইসব লিখে নেওয়ার পর তার ডান পাশে রাখা আটাত্তরটা ট্যারো থেকে একুশটা কার্ড তুলে নিয়ে টেবিলের ওপর সাজিয়ে মহিলা বলল, “নিন। এখান থেকে তিনটে কার্ড তুলে উলটো করে মেলে ধরুন। কোনো কার্ড ওলটানোর পর যদি দেখা যায় উলটো হয়ে আছে ছবি, তাহলে ওটাকে ওভাবেই রাখবেন, ভুলোও সোজা করতে যাবেন না। সোজা আর উলটো ছবির অর্থে ব্যাপক পার্থক্য আছে।”

পরপর তিনটে তাস তুলে নিয়ে উলটো করে টেবিলের ওপর মেলে ধরল দীন। প্রথম কার্ডটার ওপর রোমান হরফে লেখা দুই। নিচে ইংরেজিতে লেখা: হাই প্রিস্টেস। প্রাচীন মিশরীয় রাজমুকুট আর আলখাল্লাপরা এক মহিলা পুরোহিতের ছবি। তার ডান হাতে বই, বাঁ হাতের ওপর পলকাটা লম্বাটে ক্রিস্টাল প্রিজম। তাসটা দেখে ম্যাডাম জুই বলল, “আপনি বাস করছেন এক ঘোরের ভেতর। স্রেফ সহজাত প্রবৃত্তির ওপর ভর করে চলাফেরা করেন আপনি। মাঝেমাঝে আপনার মনের গভীরে অন্য কোনো সত্তার কণ্ঠস্বর শুনতে পান।”

দ্বিতীয় কার্ডটির নম্বর দশ। নিচে লেখা: দ্য হুইল অভ ফরচুন, অর্থাৎ ভাগ্যের চাকা। কার্ডের ওপরে বাঁ পাশে পাখাঅলা পরি, ডান পাশে গ্রিফিন। মাঝখানে স্ফিংসের মুণ্ডুর নিচে দুই রিমঅলা চাকা। ভেতরের রিংটা ছোটো, বাইরেরটা বড়ো। দুটো রিমকেই ভেদ করেছে আটটা স্পোক। স্পোকের ফাঁকে ওপরে-নিচে দুটুকরো মেঘ। চাকার নিচে ডানদিকে সিংহ আর বাঁদিকে ষাঁড়ের চিত্র। এই দুই প্রাণীর মাঝখানে গুবরে পোকা

এক বিরাট ভজঘট!

তাসের ছবি দেখে চীনে মহিলা বলল, “পুরোপুরি পালটে যাবে আপনার জীবন। সত্যি বলতে কী, এরই ভেতর শুরু হয়েছে ওই প্রক্রিয়া। আপনাকে চূড়ান্ত পরিণতির দিকে ঠেলে দেবে ভাগ্য। একে মেনে নেওয়া ছাড়া অন্য কোনো গতি নেই।”

তৃতীয় কার্ডের নম্বর তেরো। ওপরে লেখা: ডেথ, অর্থাৎ মৃত্যু কার্ডের একেবারে ওপরে একটা বালুঘড়ির ছবি। এর নিচে মাথায় রাজমুকুটপরা এক কঙ্কাল। দুই হাতে কাঠের লম্বা হাতলঅলা ধারালো কাস্তে। একটা দোরের দুপাশে জমিনের ওপর খাড়া হয়ে আছে মানুষের হাত কাটা কবজি। কবজির দুই দিকে দুটো সূর্যমুখী ফুলের গাছ।

ম্যাডাম জুই বলল, “এই তাসের অর্থ হলো আপনার জীবনের একটি অধ্যায় শেষ হয়েছে। সম্পূর্ণ রূপান্তর ঘটা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।”

কথা শেষ করে এইবার ডেক থেকে চৌদ্দটি তাস তুলে নিয়ে টেবিলের ওপর মেলে ধরল চীনে মহিলা। দীনবন্ধুকে বলল দুটো তাস তুলে নেওয়ার জন্যে।

দীন যে কার্ডটা ওঠালো সেটার নাম: পেজ অভ ওয়ান্ড, এর অর্থ—দণ্ডের চাকর। তাসের ওপর লম্বা একটা লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে থাকা টুপিপরা এক চাকরের ছবি। লাঠির ওপর পানপাতার মতো তিনটে গোলাকার পাতা। চাকরের পেছনে ডানে-বাঁয়ে পাহাড়ের চুড়ো। কার্ড দেখে সাইকিক মহিলা বলল, “সামনের দিনগুলোতে অভিযানে বেরুবেন আপনি। অপরিচিত পরিবেশে অদ্ভুত সব অভিজ্ঞতা হবে আপনার।”

মহিলার নির্দেশে আরও একটা কার্ড তুললো দীন। ওলটানোর পর দেখা গেল ওটাতে লেখা: ফাইভ অভ ওয়ান্ডস, পাঁচ দণ্ড। তাসের ওপরে দুদিকে দুটো পতাকা, নিচে দুটো ঢাল। দুই দিকে আড়াআড়ি দুটো দুটো করে চারটে বর্শা। নিচ থেকে উঠে এসেছে কবজিতে ধরা আর একটা বর্শা। বর্শার মাথা ছুঁয়েছে আড়াআড়ি বর্ণাগুলোর ছেদ বিন্দুতে। এবার ম্যাডাম জুই বলল, “সামনের দিনগুলোতে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়বেন আপনি। তীব্র প্রতিযোগিতা আর রেষারেষি মোকাবেলা করতে হবে আপনাকে।”

এরপর আরোও চৌদ্দটা কার্ড তুলে নিয়ে উলটো করে টেবিলের ওপর রেখে দীনকে যে কোনো একটা তুলে নিতে বলল চীনে সাইকিক। যে কার্ডটা তুললো দীন সেটার নাম—টু অভ কাপস। তাসের ওপর রোমান অক্ষরে দুই সংখ্যা লেখা, নিচে পাখাঅলা সিংহের মুখ। তাসের মাঝখানে জড়াজড়ি করে আছে সারা গায়ে ফুটকিঅলা দুটো বিষধর সাপ। সাপগুলোর লেজ গিয়ে ঢুকেছে দুটো পানপাত্র বা ওয়াইন গ্লাসের ভেতর। সাপগুলোর দুপাশে আলোর রশ্মি।

এতক্ষণে ভিন্ন একটা কিছু দেখা যাচ্ছে,” বলল ম্যাডাম জুই। “আপনার একজন শুভাকাঙ্ক্ষী আছেন। গভীর বন্ধুত্ব আছে আপনাদের দুজনের ভেতর। মেলা সাহায্য পাবেন তার কাছ থেকে। তবে শেষমেশ কী হয় বলা যায় না।”

“তার মানে?”

“এর অর্থ—হেল্প করা বন্ধ করতে পারে ওই শুভাকাঙ্ক্ষী।” আবারও ডানপাশে রাখা ট্যারো কার্ডের ডেক থেকে চৌদ্দটা কার্ড তুলে নিলো চীনে সাইকিক। সাজিয়ে রাখল টেবিলে। ওখান থেকে একটা তাস তুলে নিতে বলল দীনকে। যে কার্ডটা তুললো দীন সেটার নাম–সেভেন অভ সোর্ডস, অর্থাৎ সাতটি তলোয়ার। রোমান হরফে সাত লেখা। তার নিচে তারাভরা আকাশের ব্যাকগ্রাউন্ডে ক্রিস্টালের পাহাড়। এই পাহাড়ের চুড়োয় ফলা নিচের দিকে দিয়ে পাশাপাশি খাড়া করে রাখা ছয়টি তরবারি। পাহাড়ের পায়ের কাছে সাত নম্বর তলোয়ারটা সামনের ডান পায়ে ধরে আছে এক খেঁকশেয়াল। খেঁকশেয়ালের সামনে-পেছনে দুটো জলপাইয়ের চারাগাছ। কার্ডটা দেখে সাইকিক ম্যাডাম বলল, “চরম প্রতারণা আর চালাকির শিকার হবেন আপনি। চেনা- জানার ভেতরই কেউ প্রবঞ্চক হিসেবে দেখা দেবে।”

এইবার শেষ চৌদ্দটা কার্ডের ভেতর থেকে একটা বেছে নিতে হলো দীনবন্ধুকে। যে তাসটা উঠে এলো তার নাম: টেন অভ পেন্টাকলস, অর্থাৎ দশটি পাঁচবাহুঅলা তারা। ছবিতে দেখা যাচ্ছে আলোর রশ্মির ভেতর ঝাঁকড়া বটগাছের মতো একটি গাছের গায়ে ত্রিভুজের ওপর ছয়টি তারা। গাছটির ওপর অন্ধকার আকাশে দুটো আর আলোভরা আকাশে আরও দুটি তারা। গাছটি দাঁড়িয়ে আছে একটা পাহাড়ের চুড়োয়। পাহাড়ের নিচের দিকে ঢালের দুদিকে দুটো জলপাই গাছের চারা।

“এর অর্থ কী?” জিজ্ঞেস করল দীন।

ম্যাডাম জুই বলল, “ভারী অদ্ভুত এই কার্ড! এর অর্থ হলো বহুকাল আগে হারিয়ে যাওয়া বিশেষ একটা কিছু খুঁজে পাবেন আপনি। এ এমন এক জিনিস যার পরম্পরা চলে আসছে হাজার হাজার বছর ধরে। অনেক মানুষের ভাগ্য গণনা করেছি, দেখেছি অনেক বিচিত্র জিনিস। তবে একথা আমাকে স্বীকার করতেই হবে, খুবই ভিন্ন ধরনের ভাগ্য আপনার। কিছু যদি মনে না করেন, ছোট্ট আরেকটা গণনা করতে চাই। আপনি অনুমতি দিলে শুরু করতে পারি। করবো?”

“এর জন্যে কি আলাদা পয়সা দিতে হবে?”

“এক পয়সাও দিতে হবে না। এ প্রক্রিয়া শুধু আমার কৌতূহল মেটাবে।”

“বেশ শুরু করুন তাহলে।”

টেবিলের ড্রয়ার থেকে লম্বা চেইনে বাঁধা চমৎকার নকশাঅলা একটা স্টপ ওয়াচ বের করল ম্যাডাম জুই। স্টপ ওয়াচের ডায়ালের রিম ঘেঁষে নম্বর লেখা। ডায়ালের মাঝখানে বড়ো একটা লাল কাঁটা। কাঁটার চারপাশে সাদা মাদার অভ পার্লের ওপর একটার ভেতর আরেকটা জটিল বৃত্ত বা কনসেন্ট্রিক সার্কেল প্যার্টান আঁকা। ঘড়িতে দম দিয়ে ওটা উঁচু করে দীনের মুখের সামনে তুলে ধরল সাইকিক ম্যাডাম। সুইচ টিপতেই ঘোরা শুরু করল লাল কাঁটা আর সেই সাথে ওটার সাথে তাল রেখে অ্যান্টাইক্লকওয়াইজ ঘুরতে শুরু করল কনসেন্ট্রিক সার্কেল প্যাটার্ন। অনবরবত বড়ো হচ্ছে বৃত্তের কেন্দ্র। বড়ো হতে হতে মিলিয়ে যাচ্ছে ঘড়ির সোনালি রঙের রিমের গায়ে লাগানো নম্বরগুলোর ভেতর।

এইবার দীনকে ম্যাডাম জুই বলল, “ঘড়ির ডায়ালটার দিকে ভালো করে খেয়াল করুন। চোখের পাতা ফেলবেন না।”

হাঁ করে স্টপ ওয়াচের ডায়ালের দিকে তাকিয়ে আছে দীন। হঠাৎ করেই ডায়ালটা পেন্ডুলামের মতো ডানে-বাঁয়ে দোলাতে শুরু করল সাইকিক। ধীরে ধীরে ঘোলা হয়ে এলো দীনের চোখের দৃষ্টি। ধীর হয়ে এলো শ্বাস-প্রশ্বাস। বন্ধ হয়ে গেল শরীরের সব নড়াচড়া। গোল টেবিলের সামনে মূর্তির মতো বসে রইল সে। এইবার চীনে সাইকিক প্রশ্ন করল, “আপনি বাংলাদেশের লোক। কোলকাতায় কেন এসেছেন? কোনোকিছু গোপন না করে একেবারে গোড়া থেকে সবকিছু আমাকে খুলে বলুন।

পুরোপুরি সম্মোহিত অবস্থায় আনুপূর্বিক যাকিছু ঘটেছে, সবকিছু হড়হড় করে বলে গেল দীন। বাদ দিলো না কিছুই। বেশ কিছু তথ্য চীনে মহিলা নোটবুকে লিখে নিলো। এরপর যখন দেখল বলার মতো জিনিস দীনের কাছে আর কিছু নেই তখন রিনরিনে গলায় বলল, “আমি ঘণ্টা বাজানোর সাথে সাথে সম্মোহন থেকে জাগবেন আপনি। জাগার পর এর আগে যা যা ঘটেছে কিছুই মনে থাকবে না আপনার। এমনকি আমার এখানে আসার কথাও না। এখন চেয়ার থেকে উঠুন। দরজা খুলে বাইরে বেরুনোর পর ঘণ্টা বাজাবো এখন, যেন এই ডেরায় যে কখনও ঢুকেছিলেন তা কিছুতেই মনে করতে না পারেন। ঠিক আছে?”

চীনে সাইকিকের কথায় মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিলো দীনবন্ধু। হাঁটা ধরল যে পথে এসেছিল সেই পথ ধরে।

৩২

দীনবন্ধু রাস্তার মোড় ঘুরে অদৃশ্য না হওয়া অব্দি দরজার কবাট ধরে দাঁড়িয়ে রইল জুই গুওলিয়ং। তারপর তড়িঘড়ি এগিয়ে গেল কালো টেলিফোন সেটের দিকে। ক্রেডল থেকে রিসিভার তুলে কল করল একটা নম্বরে। একবার রিং হতেও ওপাশে ফোন ধরল একজন। হাকা চীনে ভাষায় জুই বলল, “ফু শান চু-এর সাথে কথা বলতে চাই।”

“ফু শান চুর আইডেন্টিফিকেশন নম্বর বলেন,” খ্যানখেনে গলায় বলল ও প্রান্তের লোক।

“চার তিন আট।”

“আপনার নাম আর আইডেন্টিফিকেশন সংখ্যা জানান। “জুই গুওলিয়ং। চার নয়।”

“এক মিনিট ধরুন।”

জুই বুঝল, যে তথ্য সে নিজের সম্পর্কে দিয়েছে, সেটা ওপারে ভেরিফাই করে দেখা হচ্ছে। ঠিক এক মিনিট পর ওপ্রান্ত থেকে ভেসে এলো খ্যানখেনে কণ্ঠস্বর।

“কী বিষয়ে কথা বলতে চান?”

“বিষয় অত্যন্ত গোপনীয়। সরাসরি ফু শ্যান চুকে জানাতে চাই।”

“ফোনে বলা যাবে না?”

“না। দেখা করে মুখোমুখি বলতে হবে।”

“একটু ধরুন।”

আবারও নীরবতা। গড়িয়ে গেল কয়েক মুহূর্ত। ফিরে এলো খ্যানখেনে গলার মালিক। বলল, “এখন বাজে দুপুর বারোটা। ঠিক দুটোর সময় আপনার অফিসের সামনে গাড়ি যাবে। ওই গাড়িতে উঠে চলে আসবেন। দেরি যেন না হয়। চার তিন আট- এর সাথে আপনার সাক্ষাতের সময় বিকেল তিনটে।”

ক্রেডলে রিসিভার রেখে অফিস বন্ধ করে ওপরতলায় উঠে গেল জুই। এখানেই দুকামরার একটা ফ্ল্যাটে থাকে সে। শাওয়ার নিয়ে ঝটপট কিছু খেয়ে ভালো পোশাক-আশাক পরে রেডি হতে হবে এখন।

৩৩

শরৎ বাবু বাঁশবেড়েয় তার গুরুদেব, রুদ্র ভৈরবের মঠে যখন পৌঁছালেন তখন দুপুর বারোটা। এইমাত্র মঠের ছাত্রদের পাঠদান শেষ করেছেন গুরুদেব। টোলের বারান্দায় হাতলাঅলা চেয়ারে বসে উদাস চোখে তাকিয়ে আছেন মন্দিরের সামনে ইঁট দিয়ে গোড়া বাঁধানো তুলসি গাছের দিকে। শরৎ সিনহাকে সিঁড়ি বেয়ে বারান্দায় উঠে আসতে দেখে স্মিত হাসলেন। বললেন, “আরে শরৎ যে! তা এতদিন পরে কী মনে করে? সব ভালো তো?”

গড় হয়ে প্রণাম করে পায়ের ধুলো মাথায় নিয়ে মুখ খুললেন শরৎ বাবু। বললেন, “ভগবানের দয়ায় আর আপনার আর্শীবাদে সবকিছু ভালোই চলছে গুরুদেব। একটা বিশেষ কাজে এসেছি। যদি অনুমতি দেন তো শুরু করি।”

“একটা কিছু মুখে দিয়ে নাও আগে। ডাবের জল আর খই- মুড়কি আছে। এই হারাধন এদিকপানে একটু শুনে যা তো,” গলা চড়িয়ে ফাই-ফরমায়েশখাটা ছেলেটাকে ডাকলেন রুদ্র ভৈরব। বছর বারো বয়সের গোলগাল চেহারার ফর্সা একটা ছেলে এসে বারান্দার নিচে দাঁড়াল। “এই বাবুর জন্যে একবাটি খই-মুড়কি আর কাঁসার গেলাসে করে ডাবের জল নিয়ে আয় তো, বাছা।”

হারাধন চলে গেলে রুদ্র ভৈরব জিজ্ঞেস করলেন, “বৃহৎ পরাশর হোরাশাস্ত্র, নাড়ীজ্যোতিষ, আর সারাবলী-এর ওপর তুলনামূলক আলোচনার যে বইটি তুমি লিখতে চেয়েছিলে তার অগ্রগতি কতদূর?”

“ওটা নিয়ে কাজ শুরু করেছিলাম। বেশ কিছু অগ্রগতিও হয়েছিল, তবে মাঝ পথে থেমে গেছে।”

“কেন? কী এমন ঘটলো আবার?”

“আমার কাছে জৈমিনী আর কৃষ্ণমূর্তি পদ্ধতি খুবই অভিনব মনে হয়েছে। বিশেষ করে এ যুগের কে এস কৃষ্ণমূর্তির কাজ তো অনবদ্য।”

এরই ভেতর ডাবের জল আর খই-মুড়ি এসে গেল। নিঃশব্দে ওগুলো খাওয়া শেষ করলেন শরৎ বাবু। তারপর গুরুদেবের দিকে তাকালেন। বললেন, “গুরুদেব, দীনবন্ধু নামে বাংলাদেশী এক ছেলে আমার বিশেষ পরিচিত। এই ছেলে ও দেশ থেকে একটা বই এনেছে। পারস্য কবি ফেরদৌসির শাহনামা। ফারসিতে লেখা। রাজা রামমোহন রায়ের মিরাত মুদ্রণ থেকে ১৮২৫ সালে ছাপা হয়েছে বইটা। তো ওই বইয়ের শেষের দিকে আরবিতে লেখা একটা অধ্যায় আছে। ও বলছে ওই অধ্যায়ে এক গোপন বিদ্যের কথা বলা হয়েছে। এই বইয়ের কারণে দীনবন্ধুর এক সহকর্মী মারা গেছে, অপঘাতে মৃত্যু। ওখানে কী নিষিদ্ধ জ্ঞানের কথা বলা হয়েছে, সেইটে বুঝতে পারছি না। এজন্যেই আপনার কাছে আসা। আমি জানি আপনি পিশাচ সিদ্ধ। যদি কষ্ট করে অভিচারক্রিয়ায় বসেন, তাহলে এ বিষয়ে সম্যক উপলব্ধি ঘটতে পারে। এই অভিলাশ নিয়েই আপনার দ্বারস্থ হয়েছি। বাকিটা আপনার মর্জি।”

শরৎ বাবুর কথা শুনে কিছুক্ষণ থম ধরে বসে রইলেন রুদ্র ভৈরব। তারপর বললেন, “বইটি কি আছে তোমার কাছে?”

“আজ্ঞে, আছে। সাথে করে নিয়ে এসেছি। দেবো আপনাকে?”

“দাও।”

কাঁধের ঝোলা ব্যাগ থেকে নজুমি কিতাব বের করে গুরুদেবের হাতে দিলেন শরৎ সিনহা। বইটি ধরা মাত্র পুরো শরীর কেঁপে উঠল রুদ্র ভৈরবের। হাত থেকে প্রায় পড়েই যাচ্ছিল। কোনোমতে সামলে নিলেন নিজেকে। থমথম করছে তার মুখ। যেন আষাঢ়ের মেঘ জমেছে ওখানে। গম্ভীর গলায় গুরুদেব বললেন, “এ এক নিষিদ্ধ শাস্ত্র। সুপ্রাচীন কালের বিস্মৃত হয়ে যাওয়া দেব-দেবী, অভিশপ্ত অপদেবতা, আর চির অন্ধকারের অতিপ্রাকৃত সত্তাদের ডেকে আনা হয় এর মাধ্যমে। উদ্দেশ্য কুমতলব চরিতার্থ করা। মুসলমানেরা একে বলে কুফরি কালাম। এ হলো আমার স্বজ্ঞা বা স্বতঃলবদ্ধ জ্ঞান, যাকে তোমার বলো ইন্টুইিশন, সেইটের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া। যাহোক, জানতে যখন চাইছো, রেখে যাও ওটা। মঙ্গলবার রাতে অভিচার ক্রিয়া করবো আমি। দেখি কতখানি জানা যায়। আগামি বুধবার এই সময় আবার এসো।

৩৪

ঠিক তিনটের সময় কালো রঙের একটা অ্যাম্বাস্যাডর এসে দাঁড়াল ম্যাডাম জুইয়ের সাইকিক সেন্টারের সামনে। গাড়ি থেকে নেমে এলো একজন তরুণ চীনেম্যান। দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর আগেই ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো জুই গুওলিয়ং। কাচের দরজার ওপাশ থেকে রাস্তার ওপর চোখ রেখেছিল সে। পরনে নীল রঙের চাইনজ স্কার্ট আর টপ। মাথার ওপর চুড়ো করে বাঁধা খোপা। পায়ে হিলঅলা চকচকে কালো জুতো। গাড়ির পেছনের দরজা খুলে তরুণ চীনেম্যান ভেতরে বসাল তাকে। তারপর নিজে তার পাশে বসে গাড়ির দরজা আটকে বলল, “আপনার চোখ বাঁধতে হবে। কিছু মনে করবেন না। এটাই নিয়ম।”

“আমি জানি। এর আগেও একবার গেছি ট্রায়াডের ডেরায়। যা করার তাই করুন আপনি।”

চোখ বাঁধা হয়ে গেলে হরিণ বাড়ি লেন থেকে ক্ষিরোদ বিদ্যাবিনোদ অ্যাভিনিউ পেরিয়ে চাঁদনি চকে চিত্ত রঞ্জন অ্যাভিনিউতে পড়ল গাড়ি। এরপর লেনিন সরণি হয়ে শেয়ালদাহ। তারপর ম্যারেজ রেজিস্ট্রেশন অফিসকে ডান হাতে রেখে দেবেন্দ্রচন্দ্র রোড হয়ে ট্যাংরাতে ঢুকল কালো অ্যাম্বাস্যাডর। দাঁড়াল বিখ্যাত জুতোর দোকান সেন ফো অ্যান্ড কোংয়ের পাশে লাল টকটকে এক চারতলা ভবনের সামনে। অগুণতি গজাল মারা দেড়-মানুষ সমান লম্বা শালকাঠের পেল্লায় দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকল গাড়ি। পুরো নিচ তলাটা গারাজ। আরও চারটে গাড়ি পার্ক করে রাখা হয়েছে ওখানে। পাহারায় রয়েছে ছয়জন হাউগোট্টা চীনেম্যান। পরনে হাফ স্লিভ কালো গেঞ্জি, কালো প্যান্ট, কালো টেনিস শ্যু।

গাড়ি থেকে নামিয়ে জুইয়ের হাত ধরে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে লম্বা করিডোর দিয়ে হাঁটিয়ে একটা কামরায় এনে আটকে দেওয়া হলো দরজা। তারপর খুলে ফেলা হলো তার চোখোর বাঁধন। দেওয়ালের রং থেকে শুরু করে এ ঘরের কার্পেট, পর্দা, ফার্নিচার—সবকিছু সাদা। পেল্লাই সাইজের সেক্রেটারিয়েট টেবিলের উলটোদিকে নীল স্যুটপরা এক লোক বসে আছে। মাথাভরতি টাক, চোখে কালো রিমের চশমা, পঞ্চাশের ওপর বয়স। গায়ের রং কটকটে হলদে। ফোলাফোলা পাতার কারণে চোখ প্রায় দেখাই যাচ্ছে না। হাতে ধোঁয়া ওঠা পাইপ। তামাকের মিষ্টি গন্ধে ম ম করছে ঘরের বাতাস। সেক্রেটারিয়েট টেবিলের এপাশে একটাই চেয়ার।

জুইকে বসতে ইশারা করল ফু শ্যান চু। তারপর ঘ্যাড়ঘেড়ে গলায় বলল, “মাত্র দশ মিনিট সময় পাবেন। এর ভেতর যা বলতে চান বলে শেষ করবেন। আপনার দেওয়া তথ্য যদি ট্রায়াডের কাজে না লাগে, তাহলে ফর্টি নাইনার থেকে নিচের স্তর হ্যাংগিং ব্ল ল্যান্টার্ন অর্থৎ ল্যাম ট্যাং লুং-এ নামিয়ে দেওয়া হবে আপনাকে। তাছাড়া, আগামি এক বছর ট্রায়াডের কোনো প্রটেকশন পাবেন না আপনি। নিন, শুরু করুন এবার।”

পত্রপাঠ কথা শুরু করল ম্যাডাম জুই, “পেশায় সাইকিক হওয়ার কারণে প্রাচীন পুঁথিপত্র, গোপন ও নিষিদ্ধ বিদ্যা সম্পর্কে জানতে হয় আমাদের। দুবছর শিক্ষানবিসী হিসেবে থাকার পর আমার দীক্ষা হয় হংকংয়ের ৎসিং শাং মঠে। সেই সময় মেইনল্যান্ড চায়নার সবচেয়ে নামকরা সাইকিক ছিলেন লি সান হুই। আমাদের ওখানে এসে এক মাস পড়িয়েছিলেন উনি। তার কাছ থেকে আল আযিফ নামে আরবি ভাষায় লেখা একটা বইয়ের কথা শুনি। আরবি ভাষায় ‘আযিফ’ বলতে রাতের বেলা পোকামাকড়েরা নানান রকমের যেসব শব্দ করে সেসব আওয়াজকে বোঝায়। ধারণা করা হয়, এগুলো আসলে প্রেতাত্মার বিলাপ। এই বইটি লেখে আব্দুল আল হযরত নামের এক উন্মাদ কবি। জীবনের শুরুতে অবশ্য পুরোপুরি সুস্থই ছিল। পাগল হয় অনেক পরে। এর জন্ম আর বেড়ে ওঠা অষ্টম শতাব্দিতে উমাইয়া খলিফাদের সময় ইয়েমেনের সানা শহরে। তরুণ বয়সেই কবি হিসেবে নাম করে ফেলে আল হযরত।

“আল হযরতের যৌবন কেটেছে বাগদাদের কাছে ব্যাবিলনের ধ্বংসস্তূপ আর মিশরের প্রাচীন মেমফিস নগরীর গোলকধাঁধার মতো অন্ধকার সুড়ঙ্গের ভেতর ঘোরাঘুরি করে। এর পরের দশ বছর সে কাটিয়েছে সম্পূর্ণ একাকী দক্ষিণ আরবের মরুভূমি চষে বেড়িয়ে। দক্ষিণের এই মরুভূমিকে প্রাচীন কালে বলা হতো রাবা আল খালিয়ে বা খালি জায়গা। আগে যেমন, একালেও তেমনি ভাবা হয়—এক জাতের ইফ্রিত আর হিংস্র পিশাচ এই মরুভূমির রক্ষাকর্তা। এ এক অতি দুর্গম ভূখণ্ড। যারা পেরুতে পেরেছে এই বিশাল মরু, তারা প্রায় সবাই দাবি করেছে অস্বাভাবিক আর সম্পূর্ণ অলৌকিক সব দৃশ্যপট ও ঘটনা দেখার। জীবনের শেষ প্রান্তে পৌঁছে আল হযরত সিরিয়ার দামেস্কে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এখানেই শহরের এক কুখ্যাত পাড়ার তস্য গলিতে আধো অন্ধকার গুমোট ঘরের ভেতর বসে লেখে তার বিখ্যাত আল আযিফ। এরপর পুরোপুরি অদৃশ্য হয়ে যায় আল হযরত। কখনও তার আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।

“ইবন খালকান্দ নামের বারো শতকের এক লেখক আল হযরতের জীবনী লেখেন। বইটিতে একবার এককথা তারপর আবার সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা লেখা। এ এক চির বিভ্রান্তিকর জীবনালেখ্য। যাহোক, খালকান্দ লিখেছেন: দিন-দাহাড়ে বড়ো বাজারের প্রান্তে, রাস্তার পাশে বিস্তর নারী-পুরুষের সামনেই অতিকায় এক মিশকালো প্রেত আল হযরতকে ধরে তার ঘাড় মটকে আস্ত গিলে ফেলে। আল হযরতের মাথা কীভাবে খারাপ হলো, সেইটে নিয়েও নানান মত। আল হযরত নিজেই দাবি করেছে: দুর্গম ও নিষিদ্ধ আল ইরাম নগরীতে গিয়েছিলে সে। একে বলা হয় থাম বা খাম্বার নগরী। হাজার হাজার ইয়া উঁচু পিলারের ওপর গড়ে ওঠা চির রহস্যময় এক অতিকায় প্রাচীন শহর। আদ জাতির রাজা সাদ বিন আদ এর প্রতিষ্ঠাতা। এই শহর যে কত পুরনো তা বলতে পারেনি কেউই। একে বলা হয় মরুভূমির আটলান্টিস। বাতালামেয়াস নামের এক আধা গ্রিক-আধা মিশরীয় আজ থেকে প্রায় দুহাজার বছর আগে এই নগরীতে যাওয়ার একটা ম্যাপ তৈরি করে। সেই সাথে ওখানকার কিছু ছবিও এঁকেছিল। অদ্ভুত সব ভবনের বিস্তৃত বর্ণনাও দিয়েছিল। পাণ্ডুলিপি প্রস্তুতের কাজ শেষ হওয়ার পরপরই তিন রাস্তার মোড়ে মদের পিপে বোঝায় ঘোড়ার গাড়ির নিচে চাপা পড়ে মারা যায় বেচারা। সেই সাথে হারিয়ে যায় তার পাণ্ডুলিপিও। মোট কথা আল আযিফ বা আল হযরতের ওপর যা-ই লেখা হয়ে থাকুক, কোনো না কোনোভাবে সে-সবই বিনষ্ট হয়েছে। তবে গণনা করে লি সান হু‍ই বুঝতে পারেন, পুরোপুরি বিনষ্ট হয়নি আল আযিফের পাণ্ডুলিপি। কোথাও না কোথাও, কারও কাছে রয়ে গেছে ওগুলো। কিন্তু কোথায়, কার কাছে সেইটে জানা সম্ভব হয়নি।”

দীর্ঘ বর্ণনা শুনে এরই ভেতর তিতিবিরক্ত হয়ে উঠেছে ফু শ্যান চু। হাত তুলে জুইয়ের কথার মেল ট্রেনের চেন টানল সে। বলল, “এসব আষাঢ়ে গল্পের সাথে ট্রায়াডের কী সম্পর্ক? ম্যাজিকের বই নিয়ে মাথা ঘামায় না ট্রায়াড। যথেষ্ট হয়েছে, এবার থামুন।”

“মাননীয় চার তিন আট। ওটা সস্তা ম্যাজিকের বই না। এসবের সাথে আমাদের মহান সংগঠনের সম্পর্ক আছে। দয়া করে আমাকে আর দুমিনিট কথা বলতে দিন।”

“বেশ। বলুন কী বলতে চান। তবে, ওই যে বললেন–সময় মাত্র দুমিনিট।”

“এই বইয়ের একটি অধ্যায়ের সন্ধান পাওয়া গেছে!”

“তো?” হলদে মুখ কালো করে বলল ফু শ্যান চু।

“ওই অধ্যায়ের ওপর ভর করে বইটির অন্যান্য অংশের কাছেও পৌঁছানো সম্ভব।”

“ধরুন পৌঁছানো গেল। কিন্তু তারপর কী?”

“ওই বইয়ের রয়েছে অমিত সম্ভাবনা। ওটার সাহায্যে নিখুঁতভাবে ভবিষ্যত গণনা করা সম্ভব। সে ব্যক্তিই হোক কিম্বা কোনো প্রতিষ্ঠান। যেমন ধরুন—শেয়ার মার্কেট, রেসের মাঠ, জুয়ার আড্ডায় রুলেত খেলায় কোন নম্বর উঠবে। সম্ভব বশীকরণ করা। আদালতের বিচারক কিম্বা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হর্তাকর্তাদের চিন্তা-চেতনার ওপর ব্যাপক প্রভাব খাটিয়ে নিজেদের পক্ষে কাজ করানো যেতে পারে। আপনি তো জানেন, ট্রায়াডের সদস্যদের সাথে কোর্ট আর পুলিসের সংঘর্ষ লেগেই আছে। এই বইটির সাহায্যে প্রাচীনকালের অতিলৌকিক সত্তাদের ডেকে এনে তাদেরকে দিয়ে প্রলয়ঙ্করী প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটানো সম্ভব। দুর্ভিক্ষ, বন্যা, মহামারি সৃষ্টি করে উজাড় করে দেওয়া যায় জনপদের পর জনপদ। পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় বিশাল জনগোষ্ঠিকে। ট্রায়াডের আসল উদ্দেশ্য তো রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করা, ঠিক কি না?”

“ধরুন বইটা সংগ্রহ করলাম আমরা, কিন্তু ওটার ব্যবহারবিধি জানবো কীভাবে? তাছাড়া, প্রক্রিয়াটাই বা কে করবে?”

“ব্যবহারবিধি আমি বের করে ফেলবো। বই ব্যবহারের প্রক্রিয়াও করতে পারবে আমার মতো যে কেউ।”

“বুঝলাম। এখন বলেন ওটার খোঁজ পেলেন কীভাবে? কার কাছে?”

“এ বিরাট এক কাকতাল। মহান গুয়ান গং দেবের আর্শীবাদ—” একথা বলে চার তিন আটের কাছে দীনবন্ধুর কথা সবিস্তারে বর্ণনা করল জুই।

“মহান শ্যান চুয়ের কাছে বিষয়টি নিবেদন করবো আমি। তিনি পর্বতের প্রভু ও ড্রাগনের মাথা। তার কাছ থেকে অনুমতি পেলে, তবেই এর ভেতর নাক গলাবো আমরা। তবে হ্যাঁ, চারজনকে কাজে লাগানো হবে এখন। এরা পালা করে ওই বাংলাদেশী ছেলে আর কোলকাতার যে লোকের সাথে সে থাকে—এই দুজনের ওপর নজর রাখবে। যোগাযোগ রাখবে আপনার সাথেও। আপনি বলেছেন এই ছেলে কোলকাতার এক ভদ্রলোকের সাথে মেসে থাকে। মেসটি কোথায় জেনে নিয়েছেন তো?”

“অবশ্যই জেনে নিয়েছি। সোনাগাছি এলাকার গোঁসাই লেনে, বলরাম দে স্ট্রিটের কাছাকাছি।”

“মেসের নাম কী?”

“চাটুজ্জে-বাঁড়ুজ্জে।”

“চার নয়, আপনাকে ধন্যবাদ। সবকিছু ঠিকঠাক মতো শেষ হলে, ট্রায়াডের প্রতি এই আনুগত্যের পুরষ্কার আপনি পাবেন। ঝাইজিয়ান, গুড বাই।”

.

ম্যাডাম জুই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেই তার দিকে এগিয়ে এলো দুজন। আবারও কালো কাপড় দিয়ে তার চোখ বেঁধে দেওয়া হলো। এরপর গাড়িতে করে তার সাইকিক সেন্টার কাম বাসার সামনে নামিয়ে দেওয়ার আগে, খুলে দেওয়া হলো চোখের বাঁধন।

সোজা নিজের অফিসে ঢুকল ম্যাডাম জুই। ধপ করে চেয়ারে বসে ফঁস করে বিরাট এক দম ছাড়ল। মনে মনে ভাবল: যাক। ট্রায়াডে পাকাপোক্ত একটা অবস্থান তৈরির সুযোগ এতদিনে পাওয়া গেছে। তাছাড়া, একবার আল আযিফ যদি পাওয়া যায় হাতে, তাহলে আর দেখতে হবে না। দুনিয়ার সেরা সাইকিক হওয়া থেকে কেউ রুখতে পারবে না তাকে!

আর ক্ষমতা?

ওটাও কী কম হবে! চার আট নয় বা মহান শ্যান চুর সাথে এক টেবিলে বসে ফ্রায়েড রাইস কিম্বা মিক্সড হাকা নুডল খাওয়া কোনো ব্যাপারই হবে না তখন!

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন