সকাল আটটা। সন্তোষ মিত্র স্কয়ারে একটা ফোন-ফ্যাক্সের দোকানের সামনে গাড়ি পার্ক করল কিসমত। বহরমপুর থেকে খুব ধীরে গাড়ি চালিয়ে এসেছে সে। কেবল দোকান খুলেছে টাক মাথা মাঝবয়েসি মালিক। কিসমতের চেহারা দেখে মন দমে গেল টাক মাথার। এ সব লোকাল কল করা পাবলিক। আধ ঘণ্টা কথা বলে পাঁচ টাকা দেবে। কাউন্টারের পেছন থেকে জিজ্ঞেস করল, “ফোন করবেন, না ফ্যাক্স?”
“ফোন।”
“লোকাল, না এসটিডি?”
“ইন্টারন্যাশনাল।”
“ও বাবা ফরেন! কোনো দেশ? দুবাই, না কাতার?”
“সান ফ্রানসিসকো, ইউএসএ।”
“কতক্ষণ কথা বলবেন?”
“পাঁচ মিনিট।”
“তিনশো টাকা অ্যাডভান্স লাগবে।”
পকেট থেকে হাজার টাকার একটা নোট বের করে টাক মাথার দিকে এগিয়ে দিলো কিসমত। সেই সাথে ছোটো কাগজে লেখা চায়না টাউনের পোর্টসমাউথ এলাকার একটা নম্বর।
“কেবল দোকান খুলেছি, মশাই। এত বড়ো নোটের ভাংতি নেই।”
“ভাংতি লাগবে না। পুরোটাই আপনার। তাড়াতাড়ি লাইন লাগান।”
দুবার রিং হতেই ওপার থেকে ফোন ধরল একজন। “হ্যালো?” খ্যাসখেসে গলায় বয়স্ক কেউ জিজ্ঞেস করল।
“চার আট নয়?”
“হ্যাঁ।”
“মহামান্য ড্রাগন হেড, আমি ভ্যানগার্ড বলছি।”
“কোড?”
“চার তিন আট।”
“হুম।”
“মিশন শেষ হয়েছে, পাহাড়ের প্রভু।”
“সোজা দমদম এয়ারপোর্টে চলে যাও। লাউঞ্জে বসে অপেক্ষা করো। টিডব্লিএ-এর একজন পাইলট তোমার সাথে যোগযোগ করবে। প্যাকেজটা তার হাতে দিয়ে দেবে।”
“ফু শ্যান চু-কে কী বলবো?”
“কিছু না। ওটা আমি দেখবো। কোথাও কোনো ক্লু রয়ে যায়নি তো!”
“আজ্ঞে, না। চেষ্টা করেছি যতটুকু সম্ভব মিটিয়ে ফেলার।”
“ক্যাজুয়ালটির কী অবস্থা?”
“সাথেই আছে। প্যাকেজ ডেলিভারি দেওয়ার পর ব্যবস্থা নেবো। আগে থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি।”
তিনদিন পেরিয়ে গেল, কেউ ফিরল না—না দীনবন্ধু না শরৎ বাবু। মনেমনে অস্থির হয়ে উঠেছে অর্জুন। কী করবে এখন? বহরমপুর গিয়ে খোঁজ নেবে দীনের বলে যাওয়া ঠিকানায়? ঠিকানা বলতে তো সেই সার্কিট হাউস আর রেসিডেন্সি সেমেটারি!
চারদিনের দিন সকালে নাস্তার পর মেস ম্যানেজারের অফিসে বসে খবরের কাগজ পড়ছে আর ভাবছে এখন কী করবে, এমন সময় সেখানে ঢুকল কিসমত পাঠান। তাকে দেখে ম্যানেজার সাহেব বলল, “ও আপনি। কিছু বলবেন?”
“আজ্ঞে, হ্যাঁ। ঘরটা ছেড়ে দিতে চাচ্ছিলাম।”
“আদ্দেক মাসই তো বাকি এখনও। এরই ভেতর চলে যাবেন?”
“আজ্ঞে, হ্যাঁ। বালিগঞ্জে একটা চাকরি পেয়েছি। খাওয়া-থাকা ফ্রি, শনি-রবি ছুটি। কাল থেকেই কাজ শুরু করতে হবে ওখানে।”
“অ। তা আপনার গাড়ির কী হবে? যাদের হয়ে কাজ করবেন, তাদের নিশ্চয় গাড়ি আছে।”
“গাড়িটা আপাতত রাখবো ভাবছি। শনি-রবি ভাড়া মারবো।’ “হুম। তা শরৎ বাবুরা সেই যে গেলেন এখনও ফিরলেন না। আপনার গাড়িতেই তো যাতায়াত করতেন ওনারা। ঠিক না?”
“আজ্ঞে, ঠিক। গেলবার বহরমপুরে নাবিয়ে দিয়ে এসেছি। এরপর ওদের সাথে আর যোগাযোগ হয়নি। বলেছিলেন, কদিন ওখানে থাকতে হয় ঠিক নেই। প্রয়োজন হলে জানাবেন।”
“ও আচ্ছা। তা কখন ছেড়ে দিতে চাচ্ছেন ঘর?”
“এখনই। এই নিন ঘরের চাবি।”
এরই ভেতর ইতিকর্তব্য ঠিক করে ফেলেছে অর্জুন। ম্যানেজারের অফিস থেকে কিসমত পাঠান বের হওয়া মাত্র তার পেছন পেছন বারান্দায় বেরিয়ে এলো সে-ও। বলল, “এই যে দাদা, শুনছেন?”
“আজ্ঞে, কিছু বলবেন?”
“বহরমপুরে যেখানে দীনবন্ধুদের নামিয়ে দিয়েছিলেন ওই জায়গায় আমাকে একবার নিয়ে যেতে পারবেন? ভাড়া নিয়ে চিন্তা করবেন না। যা লাগে দিতে রাজি আছি আমি।”
“বেশ তো চলুন। কখন যেতে চান?”
“যদি সম্ভব হয়, এখনই।”
সার্কিট হাউসে এসে অর্জুন জানল—তিনদিন আগে দীনবন্ধুসহ আরও তিনজন উঠেছিল ওখানে, তবে তারপর অন্য কোথাও চলে গেছে তারা, এখনও ফেরেনি। সার্কিট হাউস থেকে বেরিয়ে কিসমত পাঠানের কাছে ফিরে এসে অর্জুন বলল, “এখানে বাবুলবোনা রেসিডেন্সি সেমেটারিটা কোথায় জানেন আপনি?”
“আজ্ঞে, হ্যাঁ।”
“ওখানে নিয়ে যাবেন আমাকে?”
“নিশ্চয়, চলুন।”
বাবুলবোনা রেসিডেন্সি সেমেটারিতে গিয়ে পুরনো আমলের সারি সারি কবর ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ল না অর্জুনের। হতাশ হয়ে গাড়িতে ফিরে এলো সে। কিসমত পাঠান জিজ্ঞেস করল, “এবার কোথায় যাবেন?”
“কোথায় যে ছাই যাবো, তাই তো জানি না। এ দুটো জায়গার কথাই বলেছিল দীন। কিন্তু কোথায় কী! আচ্ছা, সার্কিট হাউস থেকে বলল অন্য কোথায় নাকি গিয়েছে তারা। আপনার গাড়ি করেই তো এখনে-ওখানে যেত ওরা। অন্য কোথাও কি ওদেরকে নিয়ে গিয়েছিলেন কখনও?”
“হ্যাঁ, আরেকটা বাসায় যাওয়া-আসা করতেন ওরা। কাছেই ওটা। যাবেন ওখানে?”
“ওহ, অবশ্যই।”
অর্জুনকে সাথে করে ভাড়া-করা বাসায় নিয়ে এলো কিসমত। বাড়ির সামনেই বেঁটে কেয়ারটেকারের সাথে দেখা। কিসমতকে দেখে কেয়ারটেকার বলল, “এই যে মশাই, অদ্ভুত লোক বটে আপনারা! সে যে এলেন একবার-দুবার, যাওয়ার আগে বলেও গেলেন না। আমি এদিকে ভেবে মরি।”
“আমি গাড়ির ড্রাইভার, দাদা। ভাড়া খাটি। প্যাসেঞ্জাররা কোথায় যায় না যায় সেইটে তো আর আমাকে বলে যায় না।”
এরই মাঝে এগিয়ে এলো অর্জুন। বলল, “ওই লোকগুলোর ভেতর আমার বন্ধু দীনবন্ধু ছিল। তাকে খুঁজছি আমি। ওর ব্যাপারে কিছু জানেন আপনি?”
“না রে, ভাই। এ নামে কাউকে চিনি না আমি। তিনদিনের জন্যে এ বাসা ভাড়া করেছিল এক লোক, আব্দুল না কী যেন নাম। দুদিন পর সকালে দেখি দোর খোলা। কেউ কোথাও নেই। যাওয়ার আগে বলে পর্যন্ত যায়নি। কোনোকিছু ফেলেও যায়নি। শুধু একটা পুরনো ছেঁড়া বই ছাড়া।”
“অ্যাঁ, তাই নাকি! আছে বইটা? দেখা যাবে?” কোনো কারণ ছাড়াই চমকে উঠে বলল অর্জুন।
“অবশ্যই। দাঁড়ান এখানে, নিয়ে আসছি এখন।”
দুমিনিটের ভেতর ফিরে এলো কেয়ারটেকার। হাতে শাহনামা। বইটা চেয়ে নিয়ে খুলল অর্জুন। কেমন যেন ল্যাগব্যাগ করছে। দেখল, টেনে ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে পেছনের দিকে বেশ কিছু পাতা। হঠাৎ শিরশির করে উঠল তার গায়ের ভেতর। মনে পড়ল মোলামের কারবারি মতলব ধাড়ির কথা:
বেশ তো অপেক্ষায় থাকলাম। যদি আদৌ কোনোদিন ফিরে আসে, তো খবর দেবেন। নজুমি কিতাব বড়ো ভয়ানক জিনিস রে ভাই। এর পায়ে পায়ে মৃত্যু। একবার কেউ ওটা খুলেছে তো মরেছে!
***
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন