নজ্জুমি কিতাব – ২৫

খোঁজ লাগল টমাস। কী? নাহ, রাইনহার্ডের খুব কাছাকাছি থাকত কে? যে থাকত, সে এই দুর্গে এখন না থাকলেও আশপাশেই কোথাও না কোথাও থাকে। খোঁজ খোঁজ খোঁজ। শেষমেশ পাওয়া গেল হাত্মারাম হোলকারকে। রাইনহার্ডের খনাসামা কাম ব্যাটম্যান ছিল এই হোলকার। চাকরি ছেড়ে দেয় রাইনহার্ড মারা যাওয়ার পরপরই। ইদানিং বিস্তর পয়সার মালিক হয়েছে সে। দুর্গের সৈন্যদের আনাজপাতি আর মাংস সপ্লাই দেয়।

চেপে ধরতেই টমাসকে হড়হড় করে সব বলে দিলো হাত্মারাম, মাই চিপা গেটের তালার চাবি অব্দি পাওয়া গেল তার কাছে! ওই গেট দিয়েই সন্ধের পর ভবনে ঢুকত আর বেরুত সে। বেদির পেছন দিকে ফাঁকা একটা জায়গা দেখাল হোলকার। ওখানে কাঠের একটা রেহেলের ওপর কালো চামাড়ায় বাঁধানো প্রাচীন পুঁথির বান্ডিল। বন্ডিল খুলে টমাস দেখল—আরবি ভাষায় লেখা পার্চমেন্ট কাগজের তাড়া। বিভিন্ন পাতার এখানে-ওখানে নানান রকমের সিজিল বা নকশা আঁকা।

টমাস অশিক্ষিত। আরবি ভাষা জানার প্রশ্নই ওঠে না। নকশার মাথামুণ্ডুও কিছু বুঝল না সে। তবে হোলকারকে চেপে ধরল আরো শক্ত করে। মাটির তলার এই মন্দির সম্পর্কে জানতে চায় সে। এসবের সাথে রাইনহার্ডেরই বা কী সম্পর্ক?

হাত্মারাম হোলকার তাকে ডিটেইল কিছু জানাতে পারল না। শুধু জানাল: এই দেবতার নাম হাস্তুর। বহু হাজার বছর আগের দেবতা ইনি। রাইনহার্ড আসার অনেক আগে থেকেই এ মন্দির ছিল এখানে। সাহেবের কাছে সে শুনেছে, এই মন্দির তৈরি হয়েছিল হাজার বছর আগে সুলতান মাহমুদের ছেলে মাসুদ যখন আশিগড় দখল করেছিল সেই সময়ে। মাসুদ আর মাহমুদের ভাতিজা মওদুদ প্রায় দেড় যুগ ধরে শাসন করেছিল এই গড়। ওই সময় দলে দলে আরব বণিক আর মুসাফিরেরা এখানে এসে আশ্রয় নেয়। পরে দিল্লির তোমার রাজবংশের রাজা মহিপাল মওদুদের লোকেদের তাড়িয়ে দেয় এখান থেকে। এই মন্দির চলে আসে মহিপালের হাতে। তবে আগের পূজারিদের দুর্গেই রেখে দেয় সে। পুরো হরিয়ানার ব্যাবসা-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করত এরাই। বিপুল ধন-সম্পদের মালিক তারা। তাদেরই পরামর্শে হাজার বছর ধরে রক্ষা করা হয় নিশ্ছিদ্র গোপনীয়তা।

রাইনহার্ড এখানকার দণ্ড-মুণ্ডের কর্তা হওয়ার পর এই ছোট্ট অথচ প্রচণ্ড ধনী সম্প্রদায়টা সাহেবের সাথে দেখা করে। নানান কথা-বার্তার পর সাহেব বুঝতে পারেন—জাতে আরব এই গোষ্ঠি প্রায় হাজার বছর ধরে বাস করছে এখানেই। সব থেকে অবাক বিষয় হলো: এই সুদীর্ঘ সময়ে সবরকম ব্যাবসা-বাণিজ্যের একচ্ছত্র অধিপতি শুধুমাত্র এরাই। টাকার কুমির একেক জন। সবকটাকে ফাটকে ঢোকালেন রাইনহার্ড। কী?

নাহ, তোমাদের ভেতর গুহ্য কী ব্যাপার-স্যাপার আছে সবকিছু খুলে বলতে হবে আমাকে।

দিনের পর দিন না খাইয়ে রাখা হলো বন্দিদের। মারা গেল বুড়ো আর মাঝবয়েসিরা। টিকে থাকল শুধু যুবকেরা। বাড়িতে এদের সুন্দরী কমবয়েসি স্ত্রী, ছোটো ছোটো ছেলেমেয়ে। শেষমেশ মুখ খুলল এরা। সাহেবকে দেখিয়ে দিলো সবকিছু। রাইনহার্ড সাহেব ছিলেন অত্যন্ত নিষ্ঠুর প্রকৃতির। সবকিছু দেখেশুনে নেওয়ার পর ওই গোষ্ঠির যারা বেঁচেছিল তাদের ডেকে বললেন, “আটচল্লিশ ঘণ্টা সময় পাবে। এর ভেতর ব্যাবসাপাতি, সয়- সম্পত্তি যা কিছু আছে সব আমার জিম্মায় রেখে চলে যাবে হরিয়ানা থেকে। চিরতরে। যদি দেখি ফিরে এসেছ, তাহলে তাৎক্ষণিকভাবে শিরশ্ছেদ করা হবে।”

“তারপর কী হলো?” জিজ্ঞেস করল টমাস।

“এরপর সাহেব নিজেই নৈবেদ্য দিতেন দেবতা হাস্তুরকে। হুজুর, আপনি ধারণাও করতে পারবেন না কী পরিমাণ টাকা-পয়সার মালিক হয়েছিলেন রাইনহার্ড সাহেব! ওখানে শুয়োরের চর্বির মোমবাতি জ্বালিয়ে গাঁদা অর জবা ফুল সহযোগে নৈবেদ্য দেওয়া হতো। প্রতিমাসে একবার ছাগ-বলি। এ কাজ সাহেবের পক্ষে একা করা সম্ভব ছিল না। আমাকে নিয়েই করতেন এসব। প‍ই পই করে সাবধান করেছিলেন কাউকে যেন ঘুণাক্ষরেও কিছু না বলি।

“হঠাৎই মৃত্যু হলো সাহেবের। সেই থেকে আমি একাই পুজো দিতে লাগলাম। সেই সাথে পয়সাও আসতে লাগল হু হু করে। তবে যে পুঁথিটা রাইনহার্ড সাহেব পেয়েছিলেন সেইটে পূর্ণাঙ্গ না। চামড়ায় মোড়া পুঁথির বান্ডিল দেখে সাহেবের হয়তো সন্দেহ হয়েছিল। না হলেও, উনি এমনিতেই জিজ্ঞেস করতেন। অন্ধকারে ঢিল মারার অভ্যেস ছিল তার। তবে ঢিলটা জায়গামতো লেগে যায়। হাস্তুরের উপাসকেরা তাকে জানায়: প্রায় চারশো বছর আগে ইরান থেকে এক ফকির আসে এখানে। ভীষণ জ্ঞানী ছিল নাকি। ক্ষমতাও ছিল প্রচুর। এই পারস্য ফকির পুঁথির অর্ধেকটা নিয়ে ভারতবর্ষের পুবে চলো যায়। পরে তার আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। ফিরে পাওয়া যায়নি হারিয়ে যাওয়া পাতাগুলো।”

খানসামা হাত্মারাম হোলকারকে নিয়ে হাস্তরকে নৈবেদ্য দেওয়া শুরু করল টমাস। ওদিকে ভয়ানক অসুস্থ হয়ে পড়ল বেগম সামরু। এই সুযোগে হাঁসির রাজা বনে গেল টমাস। আশিগড়কে বানালো রাজধানী। তবে সুখ জুটলো না কপালে। শিখ, মারাঠা, আর পাতিয়ালার রাজার সাথে লাগাতার লড়াই করতে হতো তাকে। ছেদ পড়তে শুরু করল হাস্তুরের নিয়মিত উপসনায়।

অবশেষে শিখ আর পাতিয়ালা সৈন্যের কাছে হেরে গেল সে। কোনোমতে একটা বজরা যোগাড় করে কোলকাতার পথে রওনা হলো। সাথে নিলো বিস্তর সোনার মোহর, হিরে-জহরত, আর পুঁথির পাতাগুলো। মুর্শিদাবাদের কাছে এসে অদ্ভুত এক জ্বর পড়ে টমাস। হেনরি ক্রাইটন নামের এক নীলকর সাহেবের সাথে আগে থেকেই পরিচয় ছিল তার। আশ্রয় নেই তারই কাছে।

সপ্তাহখানেকের ভেতর মারা গেল টমাস। তবে মারা যাওয়ার আগে পুঁথির কাগজগুলো তুলে দিলো ক্রাইটনের হাতে। অনুরোধ করল মোহর আর হিরে-জহরত বেচে সেই টাকা যেন আয়ারল্যান্ডে তার ভাই-বোনের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

২৬

হেনরি ক্রাইটন ছিল গৌড়ের এক নীল করাখানায় সুপারিন্টেনডেন্ট। বাবা-মা স্কটল্যান্ডের। তবে তার জন্ম ইংল্যান্ডের সান্ডারল্যান্ডে। হতদরিদ্র বাবা-মার ঘরে। ছোটোবেলাতেই ক্রাইটন বুঝে যায়: স্বদেশে বেঁচে থাকতে হলো তাকে হয় ইঁট-ভাঁটায় লেবারের কাজ করতে হবে, না হয় হতে হবে কয়লাখনির শ্রমিক। এমন হাড়ভাঙা খাটুনির কাজ তাকে দিয়ে হবে না। এ কাজে ভবিষ্যত বলে কিছু নেই। যতদিন গায়ে তাকত আছে ততদিনই কাজ। চাকরি গেলে কিম্বা বুড়ো হলে পথে পথে ভিক্ষে করে খেতে হবে। খাবারের জন্যে দুবেলা ধর্না দিতে হবে চার্চের দোরে দোরে।

ক্রাইটন মনে মনে খুঁজতে লাগল এমন একজনকে যাকে ধরে বিদেশ যাওয়া যায়। সকাল-বিকেল ঘুরঘুর করতে লাগল ডারহ্যামের হার্টলপুল সমুদ্র বন্দরে। তখন নানান দেশে রাজত্ব করছে ইংল্যান্ড। আমেরিকা, ক্যারিবিয়ান আইল্যান্ডস, আফ্রিকা, ইন্ডিয়া। ওসব জায়গায় নাকি বিস্তর সুযোগ-সুবিধা। জায়গামতো সেট হতে পারলেই হলো। ভাগ্যান্বেষী হতে দোষ কী? দেখাই যাক না, কী আছে কপালে!

তবে হ্যাঁ, ওসব জায়গায় যেতে হলে মেলা টাকার দরকার। জাহাজ ভাড়া, থাকার জায়গার খরচা, কাজ খুঁজে বের করা— হ্যাপা কম না। এমন যদি কাউকে পাওয়া যেত, যে নিয়ে যাওয়ার খরচাও দেবে আবার চাকরিসহ থাকার জায়গাও! এসব ভেবেই দিন কাটতে লাগল ক্রাইটনের। কিন্তু পেট তো আর বসে থাকবে না! বাধ্য হয়ে কাজ নিতে হলো জুতো আর বুট তৈরির কারখানায়। প্রতিদিন বারো ঘণ্টার হাড়ভাঙা পরিশ্রম। মজুরি যা পায়, তাতে পেট চলে কোনোমতে।

হার্টলপুল বন্দরে আদ্যিকালের পুরনো এক গির্জা আছে। সেইন্ট হিল্ডার গির্জা। হর রোববার সকালে এখানে প্রার্থনা করতে আসে ক্রাইটন। বিদেশে ব্যাবসা আছে এমন অনেক ধনী ইংরেজও আসে এই গির্জায় . . . যদি কারও নেক নজরে পড়ে যায়! তার আবার খুব ছবি আঁকার নেশা। প্রেয়ার শেষ হলে গির্জার সামনে সিঁড়ির ওপর বসে ইজেল খাড়া করে বন্দরের দিকে তাকিয়ে জাহাজের ছবি আঁকত সে।

ওভাবেই কাটল তিন-তিনটে বছর।

ছয় দিন জুতোর কারখানায় বারো ঘণ্টা কাজ। সাত দিনের দিন সকালে সেন্ট হিল্ডার গির্জায় প্রার্থনার পর ছবি আঁকা। প্রায় যখন হতাশ হয়ে পড়েছে ক্রাইটন, ঠিক তখনই ছিঁড়ল ভাগ্যের শিকে। এক রোববারে গির্জার সামনে একমনে নতুন এক জাহাজের ছবি আঁকছে সে, এমন সময় তার পরিচয় হলো চার্লস গ্রান্টের সাথে। এই গ্র্যান্ট মালদায় থেকে ব্যাবসা করে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে রেশম আর তুলো সাপ্লাই করা-ই তার কাজ, সে-ই জাহাজটার মালিক। এদিকে তিন বছর ধরে প্রতি রোববার ছবি এঁকে-এঁকে হাত পেকে গেছে ক্রাইটনের। ছবিটার ডিটেল দেখে ভারী খুশি হলো গ্র্যান্ট। বলল, “এই ছোকরা। বেচবে নাকি ছবিটা?”

“এই ছবি আপনি কিনতে চান? কিন্তু কেন? এমন কত জাহাজ পড়ে আছে এই হার্টলপুল বন্দরে। বিশেষ কোনো কারণ?”

“কারণ, ওই জাহাজের মালিক আমি নিজে।”

“ওহ, তাই বুঝি!” উত্তর দিলো ক্রাইটন। এরই ভেতর বুঝে ফেলেছে এতদিনে ভাগ্যের শিকে বোধহয় ছিঁড়তে চলেছে। এর মতো লোকই তো এতদিন ধরে খুঁজছে সে! মুখে মধু ঢেলে বলল, “অমন ছবি কত আছে আমার ঘরে। এতদিন ধরে আঁকছি কেউ কোনোদিন পছন্দ করে কিনতে চাইনি কোনো ছবি। আপনি যখন চাইছেন, নিয়ে যান। দাম লাগবে না। আমার কাজ আপনার পছন্দ হয়েছে এই ঢের বেশি!”

চালাকু-চতুর ক্রাইটনকে মনে ধরল গ্র্যান্টের। ভাবল, এমন একজন চটপটে, স্বাস্থ্যবান অ্যাসিস্ট্যান্টই তো দরকার। ছোকরটাকে একটা সুযোগ দিয়ে দেখা যেতে পারে।

ক্রাইটনকে তার সহকারী হিসেবে নিয়োগ দিলো গ্র্যান্ট।

২৭

বাংলায় তখন জাঁকিয়ে বসেছে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। বিপুল সামাজিক প্রতিপত্তি চার্লস গ্র্যান্টের। পয়াস-কড়িও আয় করেছিল ব্যাপক। কিন্তু তার আরও টাকা চাই। পুব বাংলায় নীল চাষ করে সাহেবরা এরই ভেতর আঙুল ফুলে কলাগাছ হতে শুরু করেছে। দেখাদেখি গ্র্যান্টও মালদহের গৌমালতিতে গুয়ামালাটি নীল কারখানা তৈরি করল। ওটা ছিল গৌড়ের ধ্বংসাবশেষের খুব কাছে। ওই কারখানায় জান পানি করে খাটল ক্রাইটন। তিন বছরের মাথায় ক্রাইটনের কাজে সন্তুষ্ট হয়ে তাকে পদোন্নতি দিয়ে নীল কারখানার ম্যানেজার বানিয়ে দিলো গ্র্যান্ট। ইংল্যান্ডে নীল রপ্তানির ফলে টাকা আসতে লাগল হু হু করে।

সবকিছু ভালোই চলছিল, কিন্তু হঠাৎ করেই দেখা দিলো বিপত্তি। ইংল্যান্ডে ফিরে যেতে বাধ্য হলো গ্র্যান্ট। ওখানে তার পরিবার থাকত। কী নাকি গোলমাল দেখা দিয়েছিল ফ্যামিলিতে। যাহোক, গ্র্যান্টের অবর্তমানে গুয়ামালাটি নীল কারখানার সুপারিন্টেনডেন্ট হলো হেনরি ক্রাইটন। ১৮০৭ সালে মরার আগ অব্দি ওই পদেই ছিল।

আগে থেকেই ক্রাইটনের ছিল ছবি আঁকার নেশা। গৌড়ের ধ্বংসাবশেষের খুব কাছে ছিল এই নীল কারখানা। তো ছবি আঁকার বিষয়বস্তু হিসেবে শুরুর দিকে ফসলের মাঠ, গাছ-পালা, খাল-বিল—এসব আঁকলেও, শেষদিকে ক্রাইটন ঝুঁকে পড়ে গৌড়ের প্রাচীন ধ্বংসাবশেষগুলোর স্কেচ করার দিকে। কী এক অমোঘ আকর্ষণে পুরাকীর্তিগুলো চুম্বকের মতো টানত তাকে।

শেষমেশ ছবি আঁকা বাদ দিয়ে শুরু করল ঘোরাঘুরি। প্রচুর তথ্য সংগ্রহ করল নানান জায়গা থেকে শিলালিপি উদ্ধার করে। আশপাশের ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলো দেখতে দেখতে তার মনে হলো: কিছু কিছু স্থাপত্য এতই মনোমুগ্ধকর, ওগুলো সম্পূর্ণভাবে ভেঙে পড়ার আগেই সংস্কার করা অত্যাবশ্যক। টাকার অভাব নেই। ওদিকে গ্র্যান্টেরও ফিরে আসার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।

তবে তাকে সবথেকে বেশি আকৃষ্ট করেছিল বিখ্যাত আদিনা মসজিদ আর ফিরোজ মিনার। আদিনা মসজিদ এক এলাহি কারবার। ওটার সংস্কার একমাত্র সরকারের পক্ষেই সম্ভব। তবে হ্যাঁ, ফিরোজ মিনারকে কিছুটা হলেও ঠিকঠাক করা যেতে পারে।

২৮

ফিরোজ মিনার নিয়ে ক্রাইটনের এক অদ্ভুত অবসেশন ছিল। আর এর কারণ সম্ভবত এর অতীত ইতিহাস। এই মিনার তৈরি করান বাংলার সুলতান সৈফুদ্দিন ফিরোজ শাহ। এ জাতে হাবসি অর্থাৎ আবিসিনিয়ার কৃষ্ণাঙ্গ কৃতদাস। আসল নাম মালিক আন্দিল শাহ। কাজ করতেন ইলিয়াস শাহী সেনাবাহিনীর সিপাহসালার হিসেবে। মেরেকেটে দুই বছরের মতো বাংলা শাসন করেছিলেন ইনি। গদিতে বসেন পূর্ববর্তী সুলতান বুরবাক শাহকে মেরে।

যাহোক, ফিরোজ মিনারের জায়গায় আগে থেকেই এক তুলসি মন্দির ছিল। এই মন্দিরের পুরোহিত দেবজ্যোতির ছিল এক পরমাসুন্দরী কন্যা। মালদাহ চিরকাল আম বাগানের জন্যে বিখ্যাত। একদিন ঝাঁ ঝাঁ দুপুরে মন্দিরের পাশেই জ্যৈষ্ঠ মাসের মাঝামাঝি গাছপাকা আম পাড়তে গেল সেই পূজারি ব্রাহ্মণের মেয়ে মণিকর্ণিকা। ঠিক সেই সময়েই আম বাগানের ভেতর দিয়ে ঘোড় ছুটিয়ে যাচ্ছিলেন সুলতান ফিরোজ। সিঁদুরে আম ভরতি বেতের সাজি হাতে ব্রাহ্মণতনয়া আপন মনে মধুর সুরে মীরার ভজন গাইছে তখন। জ্যৈষ্ঠের খরতাপে লাল টকটক করছে ফর্সা মুখ, হাওয়ায় উড়ছে একমাথা ফিনফিনে এলো চুল, অপূর্ব গানের কণ্ঠস্বর। দেখে-শুনে মেয়েটাকে ভারী পছন্দ হলো সুলতানের। ইচ্ছে হেরেমে নিয়ে গিয়ে খাস-বাঁদি করে রাখেন। এখানে বলে নেওয়া ভালো মালিক আন্দিল বা ফিরোজ শাহ ছিলেন একজন খোজা কৃতদাস। দৈহিক কামনা-বাসনা তার ছিল না। কিন্তু সুন্দরী বাঁদী আর গানের বেজায় ভক্ত ছিলেন সুলতান।

কিন্তু আশা করলেই তো আর তা পূরণ হয় না। ব্রাহ্মণ কন্যাকে বিয়ে করে ঘরে আনা কিম্বা প্রাসাদে উঠিয়ে নিয়ে আসা– কোনোটাই সম্ভব না। তখন বাংলায় ইসলাম প্রচারের শুরুর দিক। হিন্দু প্রজা-ই বেশি। সুলতান নিজেই যদি অধার্মিকের কাজ করেন, তাহলে হিন্দু তো বটেই, মুসলমান প্রজারাও নাখোশ হবে।

কী করা, কী করা?

সমস্যা থাকলে তার সমাধানও আছে। সুলতানের হেরেমে মৈনাক নামের এক মাঝবয়েসি হিন্দু হিজড়া মহিলা কাজ করত। হেরেমের মেয়েদের সাজগোজ করানো আর সুলতানের মনোরঞ্জনের জন্যে তাদের নাচ-গান শেখানোই তার কাজ। সুলতান প্রায়ই গল্প করতেন মৈনাকের সাথে। জানাতেন নিজের চাহিদা আর আকাঙ্ক্ষার কথা। তো এই মৈনাককে সবকথা খুলে বললেন সুলতান ফিরোজ।

মৈনাক তাকে বলল, “এক কাজ করুন, জাঁহাপনা। ওই তুলসি মন্দিরের জায়গায় কুতুব মিনারের আদলে একটা মিনার তৈরি করান। নাম দেন ফিরোজ মিনার। কাজ দেখাশোনার ভার দিন ওই পূজারি ব্রাহ্মণের ওপর। তারপর কী করতে হবে, সময় এলে বলে দেবখন। দেখবেন এক ঢিলে দুই পাখি মরেছে। সুলতান হিসেবে আপনার গড়া একটা স্থাপত্যও হয়েছে, সেই সাথে পূর্ণ হয়েছে দিলের আরমানও।”

সেকালে মন্দিরের জায়গায় মিনার কিম্বা মসজিদ তৈরি খুব কমন একটা বিষয় ছিল। এ নিয়ে কেউ তেমন মাথা ঘামাত না। ঘামাল না এক্ষেত্রেও।

.

শুরু হলো মিনার তৈরির কাজ। মিনারটার উচ্চতা তখনকার দিনের পাঁচ মঞ্জিল, এখনকার প্রায় নব্বই ফিট। মিনার যখন দুমঞ্জিল উঁচু হয়েছে আর তার ওপর গম্বুজ তৈরির কাজ চলছে, তখনই নির্মাণ কাজ দেখতে গেলেন সুলতান। মৈনাক তাকে বলে দিয়েছে এইবার কী করতে হবে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হবো হবো করছে। পূজারি দেবজ্যোতিকে নিয়ে ফিরোজ শাহ উঠে এলেন দোতলার ছাদে। চারদিকে তাকিয়ে দেখে ফেটে পড়লেন রাগে। “এ কী! পোয়া ক্রোশ দূরের দাখিল দারওয়াজা তো চোখে পড়ছে না, দেখা যাচ্ছে না চিকা মসজিদও! এসব কী হচ্ছে এখানে! আমি চেয়েছি কুতুব মিনারের মতো সুউচ্চ স্থাপনা। এ যে দেখছি দুমঞ্জিল উঁচু বেঁটে খাটো এক মন্দিরের চুড়ো! কার হুকুমে হয়েছে এসব?” চিৎকার করে বললেন সুলতান।

সুলতানের প্রধান পরিচারক হিন্দিয়া বলল, “ধর্মাবতার। মাননীয় দেবজ্যোতি মহাশয়কে জানিয়েই করা হয়েছে এসব। উনার নির্দেশের বাইরে গাঁথা হয়নি একটা ইঁটও।”

রাগে কাঁপতে কাঁপতে ফিরোজ শাহ দেবজ্যোতিকে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমাকে দেওয়া হয়েছে সার্বিক তত্ত্বাবধানের দায়ত্বি। লাখ টাকা খরচ করার পর এই হলো দায়িত্ব পালনের নমুনা! দূর হ হতভাগা আমার সামনে থেকে!” এই বলে ছাদ থেকে এক লাথিতে দেবজ্যোতিকে নিচে ফেলে দিলেন সুলতান। বাজেয়াপ্ত করলেন তার স্থাবর সম্পত্তি। গাড়ি বোঝাই করে সুলতানী মালখানায় নিয়ে যাওয়া হলো দেবজ্যোতির সমস্ত অস্থাবর সম্পত্তি। গোলম আর বাঁদি হিসেবে বেচে দেওয়া হলো পূজারি ব্রাহ্মণের স্ত্রী, চাকর-চাকরানি, আর কিষাণদের। মণিকর্ণিকাকে তুলে দেওয়া হলো হিজড়া মৈনাকের হাতে।

এরপর হিন্দিয়ার সুপারিশে মিনার নির্মাণের দায়িত্ব দেওয়া হলো সনাতন নামের এক ব্রাহ্মণ যুবকের ওপর। এই সনাতনের বাড়ি ছিল মুড়গাঁওয়ে। সেকালে মুড়গাঁও দক্ষ রাজমিস্ত্রি আর প্রতিভাবান স্থপতিদের আবাসস্থল হিসেবে বিখ্যাত ছিল। সাইটে এসে সব ঘটনা শুনলেন সনাতন। তারপর নীল রঙের এক বললেন, পেতলের মডেল বানিয়ে সুলতানকে দেখালেন। “ফিরোজ মিনারের বাইরের দেওয়ালের পুরোটায় মুড়ে দেওয়া হবে ফিরোজা বা নীল পাথরে। যেন সূর্যের কিরণ লেগে দূর থেকেও চোখে পড়ে ঝাড়া ষাট হাত উঁচু এই মিনার। তাছাড়া মহামান্য সুলতানের ফিরোজ নামেরও একটা সার্থকতা থাকবে এতে। পুরো গৌড় কিম্বা পাণ্ডুয়ায় এত উঁচু শিখর আজ অব্দি কেউ গড়তে পারেনি।”

খুশি হয়ে মাথা নাড়লেন সুলতান। বললেন, “সাবাশ বেটা! কুর্তার হাতা গুটিয়ে লেগে পড়ো কাজে।”

.

সনাতনের তত্ত্বাবধানে মিনারের কাজ যখন প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, ঠিক সেই সময় ঘটলো আরেক ঘটনা। পীর শাহু নামের এক দরবেশ এসে হাজির। ইরানের খোরাশান প্রদেশে তার বাড়ি। দৈবের কাছ থেকে নির্দেশ পেয়েছেন। ফিরোজ মিনারে থেকে উপাসনা করতে চান। হিন্দিয়ার মাধ্যমে সুলতান ফিরোজের কানে গেল সেকথা। সুলতান ডেকে পাঠালেন পীর শাহুকে। জিজ্ঞেস করলেন, “এত জায়গা থাকতে আপনি মিনারে থাকতে চাইছেন কেন? ওটা তো কারও থাকবার জন্যে তৈরি হয়নি। তৈরি হয়েছে আজান দেওয়ার জন্যে। আর রাজধানীর দিকে কারা আসছে দূর থেকে সেইটে দেখার জন্যে। ফকির সাহেব, আপনি বরং অন্য কোথাও থাকার জায়গা বেছে নিন।”

পীর শাহু বললেন, “মহামান্য সুলতান, এই মিনার শেষ হওয়ার ছয় মাসের ভেতর দুনিয়া ছেড়ে চলে যেতে হবে আপনাকে। আততায়ীর হাতে নিহত যদি হন না-ও হন, কঠিন বিমারিতে পড়ে মৃত্যু নিশ্চিত। আর কদিনই বা আছেন দুনিয়ায়। এই ভিনদেশী ফকিরের একটা আব্দার নাহয় রাখলেন-ই। কী বলেন, জাঁহাপনা?”

ইরানি ফকিরের লম্বা পাগড়ি, সাদা ধপধপে দাড়ি, টিকালো নাক, আর খয়েরি চোখের উদাস দৃষ্টি দেখে মনটাই দমে গেল ফিরোজ শাহের। বললেন, “বেশ। থাকুন যে কদিন ইচ্ছে। হায়াত- ময়ুত আল্লাহর হাতে। দেখি, ছমাসের ভেতর ইন্তেকাল করি কি না! যদি করি তো বাঁচলেন, আর না মরলে মিথ্যে কথা বলার জন্যে জিভ কেটে নেবো আপনার। মনে থাকে যেন!”

“সে আপনার মর্জি।” স্মিত হেসে বললেন পীর শাহু।

.

মিনারের কাজ শেষ হওয়ার পরপরই হঠাৎ করেই মারা যান সৈফুদ্দিন ফিরোজ শাহ। তবে তিনি অসুখে ভুগে মরলেন, না আততায়ীর হাতে—সেইটে বোঝা যায়নি!

২৯

ফিরোজ মিনারেই রয়ে গেলেন পীর শাহু। থাকতেন দোতলায়, ইবাদত-বন্দেগি করতেন, আযান দিতেন। আশপাশের যত বউ- ঝিরা তার কাছে যেত ঝাড়-ফুঁক করাতে, জল-পড়া নিতে, তাবিজ-কবজ আনতে। তবে এসবের বিনিময়ে কখনও কোনো পয়সাকড়ি নিতেন না ফকির সাহেব।

বেশ নাম-ডাক করেছিলেন পীরবাবা। তার কাছে নাকি পোষা ইফ্রিত থাকত। গভীর রাতে উজ্জ্বল আলোয় ডুবে যেত ফিরোজ মিনার। বাতাসে ভেসে আসত অসংখ্য মানুষের কোলাহল আর সম্মিলিত উপসনার আওয়াজ। শুধু এর কারণেই গৌমালতি গাঁয়ে কখনও কোনো মহমারির আক্রমণ হয়নি। মিনার-চত্বর ছেড়ে পীর শাহু কোথাও যেতেন না। গাঁয়ের লোকেরা যে দই, চিঁড়ে, কলা- মুলো দিয়ে যেত তা থেকে মাত্র এক বেলার আহার রেখে বাকিটা দর্শনার্থীদের মাঝেই বিলিয়ে দিতেন। তবে তার মৃত্যুটা ছিল অস্বাভাবিক ও ভয়ঙ্কর।

পীর শাহু মারা গিয়েছিলেন মকর সংক্রান্তির রাতে। বাড়াবাড়ি রকমের ঠান্ডা ছিল দিনটা। সকাল থেকেই ঘন কুয়াশায় ঢাকা পড়েছে চরাচর। দুহাত দূরের জিনিসও দেখা যায় না। দুপুরের দিকে কুয়াশা কিছুটা ফিকে হলেও সন্ধে থেকে আবারও জাঁকিয়ে পড়তে শুরু করল। মালদাতে ঠান্ডা এমনিতেই বেশি, গরম-ও। তবে সে রাতের ঠান্ডা ছিল অস্বাভাবিক। লেপ-তোশক গায়ে দিয়েও ঠকঠক করে কাঁপতে হয়। ঘরে আগুন না জ্বাললে, শীত যায় না। রাত দ্বিপ্রহরে কড়কড় করে মেঘ ডাকতে লাগল। বজ্রপাতের প্রচণ্ড শব্দে থরথর করে কেঁপে উঠল জমিন। প্রায় দুঘণ্টা ধরে চলল প্রকৃতির এই তাণ্ডব। তারপর ভোরের দিকে শান্ত হয়ে এলো পরিবেশ। লাল টকটকে সূর্য উঠল পরদিন ভোরে। বৃষ্টিস্নাত স্নিগ্ধ সকাল। গাছের ডালে ডালে পাখির কলরব। ফুলে ফুলে মৌমাছির গুনগুন। ভালো লাগার এক অপূর্ব অনুভূতি।

সেই সাত সকালেই এক বিধবা এলো তার নাতনীর জন্যে জল- পড়া নিতে। দুদিন ধরে বেদম জ্বর। উপশম হচ্ছে না কিছুতেই। পীর শাহু প্রতিদিন সকালে ফিরোজ মিনারের পাথুরে সিঁড়ির ওপর বসে থাকতেন। কিম্বা মিনার চত্বরে নরম সবুজ ঘাসের ওপর হাঁটাহাঁটি করতেন। একমাত্র ব্যতিক্রম বৃষ্টি-বাদলের দিন। বিধবা দেখল, ঝকঝকে সকাল অথচ ফকির সাহেবের কোনো দেখা নেই। সিঁড়ি ভেঙে মিনারের ভেতর ঢুকল বিধবা। আশ্চর্য রকমের ফাঁকা চারিদিক। খাঁ খাঁ করছে পাথুরে মেঝে, মিনারের দেওয়াল। না কোনো ব্যবহার্য জিনিস, না কাপড়-চোপড়। তকতকে পরিষ্কার পরিবেশ। পীর সাহেবের চিহ্নও নেই কোথাও! কোনো কালে যে ছিল, এমনটাও মনে হয় না!

ছুটে গিয়ে গাঁয়ের লোকদের খবর দিলো মহিলা। দল বেঁধে এসে খুঁটিয়ে সবকিছু দেখল তারা। এর আগে কোনোদিনই মিনারে পা রাখেনি কেউ। ফকির বাবা একাই থাকতেন। ভেতরে ঢুকতে দিতেন না কাউকে। নাহ, সত্যিই উধাও হয়েছেন ফকির সাহেব। তবে মিনারের ভেতরকার দেওয়ালে আর মেঝেতে খড়ি-মাটি আর সিঁদুরের অসংখ্য আঁকি-বুকি। আর ওইসব আঁকি-বুকির ভেতর ছোটো ছোটো খোপে দুর্বোধ্য সব হরফ আঁকা। ব্যস, এই-ই। পীর শাহুকে আর কোনোদিনই দেখতে পায়নি গাঁয়ের কেউ। যেমন হঠাৎ আর্বিভাব, তেমনি রহস্যময় তিরোধান!

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন