শরৎ বাবুদের বিদায় দিয়ে নাক বরাবর উত্তর দিকে হনহন করে হেঁটে পাঁচগ্রাম-নবগ্রাম-লালবাগ রোডে চলে এলো আব্দুল খান। রাস্তার দক্ষিণে বোজেন গারাজ, উত্তরে অমিয়া এন্টারপ্রাইজ। নানান ধরনের কৃষিকাজের যন্ত্রপাতি বিক্রি হয় অমিয়া এন্টারপ্রাইজে। বড়ো শো রুম, মেলা ইনভেস্টমেন্ট। ওখানকার এক সেলসম্যানকে একশো টাকা ধরিয়ে দিয়ে খিদিরপুরে ট্রাঙ্ককল করল আব্দুল খান। এরই ভেতর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে সে। আজকের রাতটা পাওয়া গেছে। যে করেই হোক, আজ রাতেই খুঁড়তে হবে ওই কবর। সমাধি চিনে নেওয়ার ব্যাপার ছিল, সেইটে হয়ে গেছে এখন। পাণ্ডুলিপি নিয়ে চম্পট দিলে কে ঠেকায় তাকে!
এখন দরকার লোকবল। একাজ একা করা যাবে না। যেভাবেই হোক রাজি করাতে হবে মঞ্জিল খানকে। রহমান আর গুঙ্গা নামের দুজনকে দিতে চেয়েছে সে। এখনও সময় আছে। ঘণ্টাখানেকের ভেতর যদি রওনা দেয়, বিকেল নাগাদ পৌঁছে যাবে এখানে। ফোনে খান সাহেবকে পাওয়া গেলে হয় এখন!
মঞ্জিল খানের ব্যক্তিগত নম্বরে ফোন করল আব্দুল খান। রিং হয়, রিং হয় কিন্তু কেউ ধরে না। পরপর তিনবার ফোন করে হতাশ হয়ে গেল সে। এইবার ফোন করল হাশিম গ্যালারির নম্বরে। রিং হতেই ওপাশ থেকে ফোন ধরল একজন, “হ্যালো। হাশিম গ্যালারি। কীভাবে সাহায্য করতে পারি আপনাকে?”
“আমি বহরমপুর থেকে আব্দুল খান বলছি। মঞ্জিল খান ভাইকে দাও। জরুরি।”
“উনি এখানে নেই।”
“কখন আসবেন?”
“বলতে পারবো না।”
“ঠিক আছে। এলে বলবে, বহরমপুর থেকে মালদার আব্দুল খান ফোন করেছিল। জরুরি দরকার।”
“কী দরকার বলা যাবে?”
“না।”
“আপনার কোনো ফোন নম্বর থাকলে দিন। উনি আসলে কলব্যাক করতে বলবো।”
“আমার কোনো ফোন নম্বর নেই। দুঘণ্টা পর আবার আমি কল করবো। বলবে উনি যেন ফোনের কাছে থাকেন।
“ঠিক আছে।”
খালি বাড়ির খোঁজে বের হলো আব্দুল খান। বোজেন গারাজ থেকে আরও দক্ষিণে সেমেটারি রোডের পশ্চিমে বড়ো বড়ো আম গাছে ঘেরা পুরনো আমলের একটা দোতলা বাড়ির খোঁজ পেল। সামনে পাকা কম্পাউন্ড। বাড়ির মালিক কোলকাতায় ব্যাবসা করে। মাঝেমধ্যে এখানে এসে থাকে। একজন কেয়ারটেকার আছে। আব্দুল খান তাকে বোঝাল—পুজোর আগে মালিকের যখন আসার কোনো সম্ভাবনা নেই, তখন বাড়তি কিছু পয়সা বানালে ক্ষতি কী? সে তো আর জানবে না এখানে কী হয়েছে। শেষমেশ তিনদিনের জন্যে তিনশো টাকায় বাড়িটা ভাড়া দিতে রাজি হলো কেয়ারটেকার।
দুঘণ্টা পর আবারও অমিয়া এন্টারপ্রাইজে গেল আব্দুল খান। ফের একশো টাকা দিয়ে ফোন করল মঞ্জিল খানের নম্বরে। কোনো উত্তর নেই। হাশিম গ্যালারিতে ফোন করে কথা বলল সেলসম্যানের সাথে। নাহ, এখনও দোকানে আসেনি খান সাহেব। হতাশায় মুষড়ে পড়ল ট্যুরিস্ট গাইড। এরপর মঞ্জিল খানকে ফোনে পেলেও কোনো লাভ নেই। কোলকাতা থেকে আসতে আসতে মেলা দেরি হয়ে যাবে রহমান আর গুঙ্গার। যে রকম আজদাহা কবর, খুঁড়তে প্রচুর সময় লাগবে।
অগত্যা বাইরে থেকে খেয়ে সার্কিট হাউসে ফিরে এলো আব্দুল খান। বিকেল বেলা চায়ের আসরে ম্যাডাম জুই জিজ্ঞেস করল, “বাড়ি কি খুঁজে পেলেন, খান সাহেব?”
“আজ্ঞে, পেয়েছি। ভালো বাড়ি। মালিক কোলকাতায় থাকে। মাঝেমধ্যে ওখানে এসে থাকে। সেমেটারিতে যাওয়ার পথে হাতের ডানে। ফার্নিচার, হাঁড়িকুড়ি—সবই আছে। কেয়ারটেকার দেখাশুনো করে। তিনদিনের জন্যে তিনশো টাকা দিতে হবে।”
“বাহ, বেশ ভালো ডিল। কাল সকালে গিয়ে দেখে আসবো খন।”
“কবর কবে খুঁড়বেন?”
“কাল রাতে।”
“কারা করবে কাজটা?”
“হেনরির সমাধি যারা খুঁড়েছিল তারা। রাত দশটায় কাজ শুরু হবে। আপনি সুপারভাইজ করবেন। রাত পৌনে দশটার সময় সেমেটারির সামনে হাজির থাকবেন।”
পরদিন সেমেটারির কাছে ভাড়া করা বাড়িতে এসে হাজির হলো সবাই। একশো বছরের কম না দালানটার বয়স। কড়িবরগা দেওয়া উঁচু ছাদ, মোটা দেওয়াল, ছোটো ছোটো জানালা, সরু দরজা, বড়ো বড়ো ঘর। তবে নিয়মিত মেন্টেনেন্স হয়, পলেস্তারা খসে পড়ছে না কোথাও। সাদা রং করা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন বাড়ি। বসার ঘরটা বিশাল। একপাশে বেতের সোফা, অন্যপাশে ডাইনিং টেবিল, মাঝে অনেকখানি খালি জায়গা। ঘুরেফিরে বাড়িটা দেখল সবাই। রসুইঘর মূল ভবন থেকে আলাদা। পাকা উঠোনের উলটোদিকে। পেছনের বারান্দার একপাশে দোতলায় ওঠার কাঠের সিঁড়ি। ওপরে টানা বারান্দা আর চারখানা ঘর।
বাড়ি দেখা শেষ করে বেতের সোফায় বসল চারজন। ম্যাডাম জুই বলল, “ঘর-দোর দেখা শেষ। এখন আমরা চলে যাবো এখান থেকে। সন্ধের সময় রাতে থাকার মতো কাপড়-চোপড় নিয়ে ফিরে আসবেন। রাতটা এখানে কাটাবো আমরা। সবাই একটা করে টর্চ রাখবেন সাথে।”
সন্ধের সময় সার্কিট হাউস থেকে বেরুতেই শুরু হলো তুমুল ঝড়-বৃষ্টি। এরই ভেতর কোনো রকমে ভাড়াকরা বাড়িতে এসে উঠল সাবই। আঁধারে ডুবে আছে পুরো দালান। ইলেকট্রিক লাইন আছে এ বাড়িতে, তবে ঝড়-বৃষ্টি শুরু হওয়া মাত্র চলে গেছে কারেন্ট। কী আর করা টর্চ বের করে জ্বাললো সবাই। আব্দুল খান বলল, “ম্যাডাম, এই বাজে আবহাওয়ায় গোপনে অপারেট করার সুবিধেটুকু পাওয়া যায় ঠিকই, তবে কাজ সম্পাদন করা হয়ে পড়ে দ্বিগুণ কঠিন, সময়ও লাগে মেলা। যত দ্রুত সম্ভব কাজ শুরু করা উচিত আমাদের। যে রকম অন্ধকার আর ঝড়-বৃষ্টি, পুরো সেমেটারিও যদি কেউ উঠিয়ে নিয়ে যায়, টেরই পাবে না কেউ।”
“বুঝতে পেরেছি আপনার কথা। দেখি কী করা যায়। কিসমতকে কি এখনও আছে, না চলে গেছে?”
“এখনও আছে এখানে।”
“ঠিক আছে ওকে নিয়ে একটু বাইরে যাচ্ছি আমি। বেশিখন লাগবে না। আপনারা বিশ্রাম নিন। যাবো আর আসবো।”
দুঘণ্টা পর ফিরে এলো ম্যাডাম জুই। পেছনে দুটো ঢাউস সাইজের ব্যাগ হাতে কিসমত ড্রাইভার। কেরোসিন কুকার, কেটলি, চায়ের সরঞ্জাম, ড্রাই কেক, দুতিন রকমের বিস্কুট, দুজন মোমবাতি, হ্যারিকেন, আরও টুকিটাকি জিনিস। প্যাকেটগুলো ডাইনিং টেবিলের ওপর নামিয়ে রেখে চলে গেল কিসমত। আজকের মতো শেষ তার কাজ।
কিসমত বিদেয় হতেই ম্যাডাম জুই বলল, “খান সাহেব, সেমেটারির গেটে চলে যান আপনি। আমাদের লোকেরা আপনার জন্যে অপেক্ষা করছে ওখানে। আপনাকে দেখে একবার টর্চ জ্বেলে ফের নিভিয়ে দেবে তারা, এর উত্তরে পরপর তিনবার টর্চ জ্বালবেন আপনি। ওদেরকে নিয়ে সোজা চলে যাবেন কবরের কাছে। স্পট চিনিয়ে দেবেন।”
“তারা সংখ্যায় কয়জন?”
“পাঁচজন।”
.
সেমেটারিতে পৌঁছতে পৌঁছতে ভিজে চুপচুপে হয়ে গেল আব্দুল খান। হি হি করে কাঁপতে লাগল ঠান্ডায়। গেটের কাছে আসতেই মহুয়া গাছের পেছন থেকে জ্বলে উঠেই নিভে গেল একটা টর্চের আলো। সংকেত দেওয়া শেষ হলে কাছে এগিয়ে এলো একজন। ঘুটঘুটে অন্ধকারে কালো রেনকোটপরা লোকটাকে প্রায় দেখাই যায়না। ঘ্যাড়ঘেড়ে গলায় আগন্তুক বলল, “আগে বাড়ুন। স্পট দেখিয়ে দিন।”
“কিন্তু আরও তো লোক থাকার কথা। বাকিরা কোথায়?”
“ওসব নিয়ে ভাবতে হবে না। আগে বাড়ুন।”
কী আর করা গেট পেরিয়ে ভেতরে ঢুকে হাঁটা শুরু করল আব্দুল খান। কবরের কাছে গিয়ে থামতেই এগিয়ে এলো প্রথম জন। ভালো করে কবরটা দেখল সে। তারপর আকাশের দিকে তাক করে একবার জ্বেলেই নিভিয়ে দিলো হাতেধরা টর্চটা। ভুতের মতো কোত্থেকে এসে হাজির হলো কালো রেনকোটপরা আরও চারজন। হাতে মাটি খোঁড়া আর কংক্রিট ভাঙার নানান জাতের টুলস।
শুরুতেই অনেকগুলো পাঁচ ফিট লম্বা অ্যালুমিনাম পাইপ মাটিতে পুঁতে কালো রঙের ভারী পলিথিন দিয়ে কবরের চারপাশ ঘিরে ফেলল লোকগুলো। তারপর হুডেড পেট্রোম্যাক্স জ্বাললো। এখানকার আলো বাইরের কারো চোখে পড়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। এরপর ব্যাটারি অপরেটেড হ্যান্ডহেল্ড শোভেল এক্সকাভেটর বের করল। চারজনের হাতে চারটে এক্সকাভেটর। পাশাপাশি দাঁড়িয়ে চালু করল মেশিন।
আধঘণ্টার ভেতর সমাধির সমান্তরালে বড়োসড়ো একটা গর্ত খুঁড়ে ফেলল লোকগুলো। চার ফিট লম্বা, দুই ফিট চওড়া। চার ফিট গভীর। তবে ঝামেলাও কম হলো না। বৃষ্টির কারণে প্যাঁচপেচে কাদা হয়ে গেছে মাটি। তালতাল নরম মাটি কামড়ে ধরে থাকতে চাইলো শোভেল বা বেলচা। বারবার সাফ করতে হলো শোভেল।
একবার থেমে এক্সকাভেটরের ব্যাটারি বদলে স্পেয়ার ব্যাটারি সেট করল গোরখুঁড়েরা। আরও আধ ঘণ্টায় দুফিট চওড়া গর্তটাকে সমাধির একেবারে গোড়ায় নিয়ে গেল তারা। সামনে চুন-সুড়কির গাঁথুনিঅলা ইঁটের দেওয়াল দেখা দিলো। এবার তিনটে আমেরিকান ডিওয়ল্ট কর্ডলেস ড্রিল মেশিন বার করল তারা। দুই হাজার আরপিএমের তিন পয়েন্ট দুই জুলের এই মেশিনগুলো হালকা, কিন্তু অসম্ভব শক্তিশালী। তিনটে মেশিনে তিনটে ভিন্নভিন্ন সাইজের কংক্রিট বিট লাগাল—কোয়ার্টার ইঞ্চ, হাফ ইঞ্চ, আর এক ইঞ্চি। প্রথমে কোয়ার্টার ইঞ্চ বিট লাগানো মেশিনটা দিয়ে চুন- সুড়কির জয়েন্টে সরু একটা ফুটো করল। একটার পর একটা ফুটো করেই চলল। শেষমেশ ফুটোগুলো তিন ফিট ব্যাসের একটা বৃত্ত তৈরি করল। এরপর ওই ছিদ্রগুলোতেই হাফ ইঞ্চ বিটের মেশিন দিয়ে ড্রিল করে ফুটোগুলো আকারে বড়ো করল তারা। শেষে বের করল এক ইঞ্চি বিট।
দারুণ স্মার্ট আইডিয়া!
পুরো কাজটা শেষ হলো প্রায় নিঃশব্দে। শুরুতেই এক ইঞ্চি বিট ব্যবহার করলে নিশুতি রাতে এক কিলো দূর থেকে কঁ কঁ আওয়াজ শোনা যেত। এবার শতছিদ্র বৃত্তটাতে দুপা দিয়ে লাথি মারতেই হুড়মুড় করে ভেতর দিকে ভেঙে পড়ল। তিন ফিট ব্যাসের গোলাকার এক ফোঁকড় তৈরি হয়েছে সমাধির মাটির নিচের দেওয়ালে। ঘড়িতে এগারোটা বাজে। মাত্র দুঘণ্টা লেগেছে কাজটা করতে! কবর খোঁড়া শুরু হলে পর ম্যাডাম জুইয়ের লোকেদের সাথে খাতির জমাতে চেয়েছিল আব্দুল খান। কিন্তু লোকগুলো তকে কোনো পাত্তাই দেয়নি। শেষমেশ হাল ছেড়ে দিয়ে দেওয়ালে হেলান দাঁড়াতে গেল সে। তৎক্ষণাৎ ঘ্যাড়ঘাড়ে গলায় সেই আগের লোকটাই তাকে বলল, “ওভাবে দাঁড়াবেন না। পেট্রোম্যাক্সের আলো আপনার চেহারায় রিফ্লেক্ট হবে। দূর থেকে কারও চোখে পড়তে পারে। আপনি বরং বসে পড়ুন।।”
আবারও ঘুরে আব্দুল খানের দিকে তাকাল গোরখুঁড়ে। একই রকম কণ্ঠস্বরে বলল, “আপাতত শেষ হয়েছে কাজ। ম্যাডামকে খবর দিন। তুরন্ত।
“কিন্তু তার আগে ভেতরে ঢুকে আমি একবার দেখতে চাই।”
“ভুলেও ওকাজ করতে যাবেন না। ওখানে শুধু ম্যাডাম ঢুকবেন। উনি যদি কাউকে ঢোকাতে চান তো সে অন্য কথা। যান, ভাগুন এখন। দশ মিনিটের ভেতর ম্যাডামকে নিয়ে আসবেন এখানে।” এরপর নিজের লোকদের দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমরা ওদিকে যাও। ঘাসের চাপড়া কেটে নিয়ে এসো।”
ভাড়া-বাড়ি থেকে ম্যাডাম জুই যখন কিসমতকে নিয়ে বাইরে যায়, তখন বুদ্ধি করে রেনকোট কিনে নিয়ে এসেছিল। কিন্তু সেই রেনকোট আব্দুল খানের ভাগ্যে জোটেনি। সেমেটারির গেট পেরুতেই আব্দুল খানের সাথে দেখা হলো শরৎ বাবুদের। কালো রেনকোটপরা তিনজনকে তার দিকে এগিয়ে আসতে দেখে ভয়ানক চমকে উঠল সে। কিন্তু তারপরেই টর্চের আলোয় পরিচিত মুখ দেখল। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে কোনোমতে কাঁপাকাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল, “আপনারা এখানে!”
“সমাধি খুঁড়তে কতক্ষণ লাগতে পারে সে হিসেব করেছি আমরা। এ কারণেই এগিয়ে এসেছি। চলুন, সাইটে যাই, “ কাটাকাটা গলায় বলল ম্যাডাম জুই।
পলিথিন শিট দিয়ে ঘেরা জায়গাটার ভেতর গিয়ে দাঁড়াল সবাই। পেট্রোম্যাক্সের আলোয় হা হা করছে সমাধির ইঁটের দেওয়ালে তৈরি হওয়া খোঁদল। গর্তে নেমে খোঁড়লের ভেতর হামা দিয়ে ঢুকতে যাবে ম্যাডাম জুই, এমন সময় প্রচণ্ড শব্দে কাছেই বাজ পড়ল। আলোর বন্যায় ভেসে গেল চারদিক। বিশ গজ দূরে দাঁড়িয়ে ছিল আদ্যিকালের এক মরা তাল গাছ। আদ্দেক নাই হয়ে গেছে ওটা। দাউদাউ করে জ্বলছে বর্তুলাকার কাণ্ড। বাজের আওয়াজে কানে তালে ধরে গেছে সবার। উপুড় হয়ে জমিনে পড়ে গেছে ম্যাডাম জুই। দাঁড়িয়ে ছিল যারা, হাঁটু ভেঙে বসে পড়েছে মাটির ওপর। একটু পর কোনোমতে টলতে টলতে উঠে দাঁড়াল সবাই। পাশেই ছিল গোরখুঁড়ের দল। ম্যাডাম জুইকে ধরে মাটি থেকে ওঠালো তারা। কাদাজলে মাখামাখি পুরো শরীর।
“আপনি ঠিক আছেন তো, ম্যাডাম?” জিজ্ঞেস করল ঘ্যাড়ঘ্যাড়ে গলা।
“আমি ঠিক আছি,” ঠান্ডায় হি হি করে কাঁপতে কাঁপতে উত্তর দিলো সাইকিক। “ভীষণ অন্ধকার ভেতরে। কিছু দেখা যাচ্ছে না। দুটো পেট্রোম্যাক্স দিয়ে এসো আগে। আর হ্যাঁ ভেতরে জায়গা কম। সবাই একসাথে ঢোকা যাবে না। আমি আগে ঢুকবো, তারপর আপনারা যদি ঢুকতে চান তো ঢুকবেন।”
.
পেট্রোম্যাক্স দেওয়ার পর ভেতরে ঢুকল ম্যাডাম জুই। তার পেছন পেছন ক্রো বার আর ড্রিল মেশিন হাতে ঘ্যাড়ঘেড়ে গলা। কুঁজো হয়ে দাঁড়ানোর মতোন জায়গা আছে ছোট্ট চেম্বারটার ভেতরে। এখানেও শ্যাতলাপড়া কালো রঙের জমকালো কফিন। ওটার পাশে হাঁটু গেড়ে বসল ম্যাডাম জুই আর পেট্রোম্যাক্স হাতে ঘ্যাড়ঘেড়ে গলা। লিড খোলার পর পেট্রোম্যাক্স উঁচু করে ধরল ঘ্যাড়ঘেড়ে। খসে পড়েছে কফিনের ছেঁড়াফাটা কাপড়ের লাইনিং। ভাঙাচোরা কংকাল চোখে পড়ল। মিইয়ে যাওয়া তুলো বের হওয়া কালচে বালিশের একদিকে গড়িয়ে পড়েছে করোটি। কংকালের পরনে কালো রঙের শতচ্ছিন্ন হানফু—টংয়ের দেহাবশেষ। মামি মতো বুকের কাছে দুই হাত জড়ো করা। দূর অতীতে লম্বাটে কাঠের বাক্স ধরা ছিল দুহাতে। এখন বুকের খাবাচির ভেতর সেঁধিয়ে গেছে ওটা।
আলগোছে বাক্সটা উঠিয়ে নিলো ম্যাডাম জুই। পেট্রোম্যাক্সের আলোয় দেখল নানান আকৃতির সিজিল খোদাইকরা ওটার ডালার ওপর। বাক্সটা ওঠানোর সময় ম্যাডাম জুইয়ের চোখে পড়ল কফিনের ভেতর চারকোনায় চারটে পাথরের পিলসুজ। কী মনে করে পিলসুজগুলোও উঠিয়ে নিলো সে।
বাইরে বেরুতেই সামনে এগিয়ে গেল আব্দুল খান। বলল, “ওই বাক্সটা পেয়েছেন বুঝি? এটাই তাহলে টংয়ের কবর। ওহ খোদা! শেষমেশ পাওয়া গেল জিনিসটা!”
“এটাই সেটা কি না, বলতে পারবো না।”
“খুলে দেখেননি এখনও?” প্রশ্ন করল দীনবন্ধু।
“আজ্ঞে, না। যদি কিছু থেকেও থাকে, যা খুঁজছি ওটাই সেই জিনিস কি না, বুঝতে পারতাম না।”
“যে রকম হড়হড় করে জল ঢুকছে সমাধির ভেতর, না খুলে ভালোই করেছেন। তারচেয়ে বরং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ভাড়া- বাড়িতে ফিরে যাই আমরা। তারপর খুলে দেখা যাবে ভেতরে কী আছে। কী বলেন?”
“ঠিকই বলেছেন আপনি। সাইট থেকে যত তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যাওয়া যায় ততই মঙ্গল।” এইবার ঘ্যাড়ঘেড়ে গলার দিকে তাকিয়ে ম্যাডাম জুই বলল, “আমরা চলে যাচ্ছি এখন। তোমরা বাকি কাজটুকু শেষ করে চলে যাও।”
মাথা ঝাঁকিয়ে বাউ করল ঘ্যাড়ঘেড়ে। ইশারা করল তার সঙ্গীদের দিকে তাকিয়ে। শুরু হলো গর্ত বোজানোর কাজ। এরই ভেতর গর্তের চারপাশে ঘাসের চাপড়া কেটে এনে ডাঁই করেছে তারা। গর্ত বোজানো পর ঘাসের চাপড়া দিয়ে ঢেকে দেবে। যে রকম বৃষ্টি, চাপড়া দিয়ে আলগা মাটি ঢেকে দেওয়ার পর বোঝাই যাবে না এতবড়ো গর্ত খোঁড়া হয়েছে এখানে!
শরৎ বাবুরা যখন ভাড়া-বাড়ির বৈঠকখানায় পৌঁছল, তখন বাজে রাত একটা। মাত্র চার ঘণ্টায় অপারেশন শেষ! বারান্দায় ওঠার আগেই রেনকোট আর জুতো খুলে ফেলেছ সবাই। যেন মেঝের ওপর জলকাদার ছোপ না পড়ে। সকালবেলা কেয়ারটেকারের চোখে পড়লে সন্দেহ করতে পারে। ম্যাডাম জুই বলল, “আপনারা সবাই কাপড় পালটে ফ্রেশ হয়ে আসুন। চা-নাস্তা খেতে খেতে ওই বাক্সটা খুলবো আমরা। দেখা যাক, কী বেরোয় ভেতর থেকে।
ড্রাই কেক খেয়ে চা হাতে সোফায় বসেছে সবাই। সেন্টার টেবিলের ওপর হ্যারিকেন জ্বলছে। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা টিপ থেকে কাঠের বাক্সটা কোলের ওপর উঠিয়ে নিলো ম্যাডাম জুই। ওপরের ডালাতে কোনো লকিং ম্যাকানিজম নেই। ষোলো ইঞ্চি বাই ছয় ইঞ্চি বাই ছয় ইঞ্চি সাইজের পালিশ করা কাঁঠাল কাঠের বাক্স। ডালার জয়েন্টের ঠিক মাঝখানে কয়েন ঢোকানোর মতো সরু একটা ফাঁক। ফাঁকটুকুর ভেতর ডান হাতের বুড়ো আঙুলের নখ ঢুকিয়ে চাঁড় দিলো ম্যাডাম জুই। কোনো হেলদোল নেই। বোঝায় যাচ্ছে নিচের পার্টের সাথে টাইট হয়ে লেগে রয়েছে ওপরের ঢাকনা। পকেট থেকে এক টাকার একটা কয়েন বের করে শরৎ বাবু বললেন, “ওখানে একটা কয়েন ঢুকিয়ে চাঁড় দিতে হবে। এই নিন কয়েন।”
সরু ফাঁকের ভেতর ঢুকে গেল কয়েনের আদ্দেকটা। এইবার কয়েনটার বের হয়ে থাকা অংশটাকে চাবির মতো ঘোরাতেই থ্যাস করে আলগা হয়ে গেল ওপরের ঢালা। আস্তে করে ডালা খুলে ওটা টিপয়ের ওপর রাখল ম্যাডাম জুই। ভেতরে সোনালি জরির কাজ করা লাল সিল্কে মোড়া পাশাপাশি দুটো রোল। এর ঠিক নিচে নীল ফিতে দিয়ে বাঁধা বাঁশ কাগজের আরেকটা রোল। বাঁশ কাগজের রোলটাই আগে হাতে তুলে নিলো ম্যাডাম। ফিতে খুলে চোখের সামনে মেলে ধরল পাতাগুলো। লাল কালিতে বিজবিজে চীনে হরফে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লেখা। প্রথম পৃষ্ঠাটা কিছুক্ষণ পড়ে, অন্য পাতাগুলো উলটেপালটে দেখে টিপয়ের ওপর নামিয়ে রাখল সে। বোঝাই যাচ্ছে ওগুলো টংয়ের লেখা।
এইবার লাল সিল্কে মোড়া পাণ্ডুলিপি দুটো হাতে তুলে নিলো ম্যাডাম জুই।। সাবধানে মোড়ক খুলতেই চোখে পড়ল কটা রঙের পার্চমেন্টে মোটা কালো কালি দিয়ে আরবিতে লেখা ম্যানুস্ক্রিপ্টের তাড়া।
আল আযিফ!
সবাই তাকিয়ে আছে পাণ্ডুলিপির দিকে। দম ফেলতেও ভুলে গেছে। হঠাৎ ঝমঝম বৃষ্টির আওয়াজ ছাপিয়ে কানে এলো ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। মনে হলো বাড়ির চারদিকে অগুণতি ঝিঁঝিঁ, উচ্চিংড়ে, আর গাঁধি পোকা ডাকছে। সেই সাথে ধেয়ে এলো হিলহিলে ঠান্ডা হাওয়া। নিভু নিভু হয়ে এলো হ্যারিকেন। গায়ে কাঁপুনি উঠে গেল সবার। আড়ষ্ট হয়ে এলো হাত-পা। আটকে যেতে লাগল দম, চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াল নিশ্বাস নেওয়া। মনে হলো সাগর তলে বিশাল এক অন্ধকার গহ্বরে তলিয়ে যাচ্ছে তারা। হাঁসফাঁস করতে করতে কোনো রকমে শরৎ বাবু বললেন, “ম্যাডাম, শিগ্রি বন্ধ করুন ওই বাক্স। কিন্তু তার আগে পাণ্ডুলিপিটা ঢোকান ওটাতে।’
কোনোমতে পাণ্ডুলিপিটা বাক্সে ভরে ঢাকনা আটকাতে পারল ম্যাডাম জুই। সবার মনে হলো এক যুগ লাগল কাজটা করতে। ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে এলো পরিবেশ। বুক ভরে নিশ্বাস নিতে পারছে সবাই। কিছুটা ধাতস্থ হওয়ার পর শরৎ বাবু বললেন, “এ তো ভারী অদ্ভুত কাণ্ড দেখছি। এ নিয়ে কাজ করেছে কীভাবে মানুষ?”
“আপনি না চেয়েছিলেন এটা পরীক্ষা করে দেখতে!” বলল ম্যাডাম জুই।
“তা ঠিক। কিন্তু ওটা খুললে পরে যে এমন প্রতিক্রিয়া হবে স্বপ্নেও ভাবিনি! বোঝাই যাচ্ছে ভীষণ অভিশপ্ত এ জিনিস।”
“এই ঘটনা শুরু হওয়ার আগে থেকেই আল আযিফ সম্পর্কে জানা ছিল আমার। আপনাদের ওই শাহনামা হাতে পাওয়ার পর বিস্তর রিসার্চ করেছি এটার ওপর। তবে যতটুকু জেনেছি সবই ভাসাভাসা।”
“ওই সামান্য জ্ঞান দিয়ে আর কী কাজ হবে? ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকই শুনতে হবে শুধু!” আব্দুল খানের মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি।
“তবে এটা নিয়ে কী করতে হবে সে ব্যাপারে জানার একটা সুযোগ তৈরি হয়েছে।”
“কখন? এখানে বসে থেকে, এইমাত্র?
“হ্যাঁ এখানে, এইমাত্র।”
“আরবি ভাষা জানেন আপনি? পড়ার সময়ই বা পেলেন কোথায়?”
“আরবি ভাষাও জানি না, সময়ও পাইনি?”
“তাহলে? আপনার সাইকিক পাওয়ারের বলে!”
“ওই বাঁশ কাগজে অনেক কথা লিখেছে টং। এই পাণ্ডুলিপি নিয়ে কী করতে হবে, তার একটা ধারণা ওখানে দেওয়া আছে। আমি মনে করি ওটা পড়লে বোঝা যাবে অনেক কিছু। কিছুকিছু ধারণা আগে থেকেই আছে। ভাবছি কাল রাতে এটা নিয়ে এখানেই একটা যজ্ঞ করবো। আপনারা চাইলে এ যজ্ঞে অংশ নিতে পারেন।”
“আমি মুসলমান। পুজো-টুজো করতে পারবো না।”
“কিছুই করতে হবে না আপনাকে। শুধু দর্শকের মতো বসে থাকবেন। অবশ্য যদি চান।”
“তাহলে ঠিক আছে। পর্যবেক্ষক হতে কোনো আপত্তি নেই আমার।”
মনেমনে বেশ উৎফুল্ল বোধ করছে আব্দুল খান। আরও একদিন একরাত সময় পাওয়া যাবে। যদি কোনোভাবে মঞ্জিল খানকে ফোনে ধরা যায়, তাহলে দান মারা যেতে পারে। এখনও সুযোগ আছে।
কাঠের বাক্স হাতে নিয়ে সোফা থেকে উঠল ম্যাডাম জুই। বলল, ‘অনেক লম্বা একটা দিন গেছে। যে যার কামরায় গিয়ে বিশ্রাম নেন এখন। রাত অনেক হয়েছে। যেটুকু বাকি আছে ঘুমিয়ে কাটানো ভালো।”
পরদিন আটটার দিকে ভাড়া-বাড়ি থেকে বের হয়ে সার্কিট হাউসে ফিরল সবাই। সকালের নাস্তা ওখানেই সারা হবে। ভুনা খিচুড়ি আর খাসির মাংস খেয়ে যে যার কামরায় ফিরে গেল শরৎ বাবু, দীনবন্ধু, আর জুই। রাতে ভালো ঘুম হয়নি কারও। পেট ভরে খাওয়ার পর ক্লান্তিতে ভেঙে পড়ছে শরীর। গেল না কেবল আব্দুল খান। খিদিরপুরে ফোন করতে হবে। সার্কিট হাউস থেকে করা যায়, কিন্তু ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যেতে পারে সেটা। সামনের রাস্তা ধরে কিছুটা হাঁটলেই ফোন-ফ্যাক্সের দোকান। টাকা দিয়ে এসটিডি কল করা কোনো ব্যাপারই না।
প্রথমে মঞ্জিল খানের ব্যক্তিগত নম্বরে ফোন করল আব্দুল। কেউ ধরল না। এইবার কল করল হাশিম গ্যালারিতে। আগের সেই সেলসম্যানের একঘেয়ে গলা, একই গৎ-বাঁধা বুলি: মালিক নেই। কোথায় গেছে জানা নেই।
খুব ভালো হতো যদি মঞ্জিল খানের বাসার ফোন নম্বর থাকত। ওখানে একবার ফোন করতে পারলে, খান সাহেবকে হয়তো ধরা যেত। কিন্তু ওটা নেই কাছে। কোলকাতায় থাকলে ফোন গাইড খুলে দেখা যেত। ও কাজ এখানে সম্ভব না। বহরমপুরের ফোন গাইডে খিদিরপুরের নম্বর পাওয়া যাবে না। আচ্ছা টেলিগ্রাম করলে কেমন হয়? উঁহু, ফোনেই পাওয়া যাচ্ছে না, তার ওপর টেলিগ্রাম! এখন কী করা? একটাই রাস্তা, সেটা হলো তক্কে তক্কে থাকা। কখনও যদি এতটুকু মওকা পাওয়া যাই তৎক্ষণাৎ চম্পট দিতে হবে কাঠের বাক্সটা নিয়ে। ওই যে কথায় বলে না: চুরি বিদ্যা বড়ো বিদ্যা। এখন ধৈর্য ধরাই বুদ্ধিমানের কাজ। সার্কিট হাউসে ফিরে এলো আব্দুল খান, ঘুমিয়ে পড়ল নিজের কামরায় গিয়ে।
দুপুরের পর কিসমত পাঠানকে নিয়ে সেই যে বেরিয়েছে ম্যাডাম জুই, ফিরে আর আসেনি। কী নাকি কাজ আছে। কিসমতকে দিয়ে খবর পাঠিয়েছে দীনবন্ধু আর আব্দুল খানকে নিয়ে শরৎ বাবু যেন ভাড়া-বাড়িতে চলে আসেন। তবে আসার আগে সার্কিট হাউস থেকে রাতের খাওয়া সেরে নিতে হবে।
দুপুরে ঘুম থেকে উঠে লাঞ্চ সেরে হলরুমের সোফায় বসে আছে আব্দুল খান, এমন সময় দেখল কিসমতকে নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে ম্যাডাম জুই। সাথেসাথে বুদ্ধি খেললো তার মাথায় কোনোভাবে ওর রুমে যদি একবার ঢোকা যায়! নিশ্চিত তালা দেওয়া থাকবে রুমে। হয় চাবি জোগাড় করো, না হয় তালা ভাঙো। এটা হোটেল না যে কোনোভাবে ধোঁকাবাজি করে রিসেপশন থেকে চাবি চেয়ে আনবে। সার্কিট হাউসের রুমের চাবি বোর্ডারকে দিয়ে দেওয়া হয়। একেবারে চেক আউট করার সময় ফেরত দিতে হয় চাবি। বাকি সময়টা সর্বক্ষণ বোর্ডারের কাছে থাকে ওটা।
যাহোক, ঘুরেফিরে দেখে তো আসা যাক।
ম্যাডাম জুইয়ের রুমের সামনে এসে আব্দুল খান দেখল- পুরোপুরি খোলা দরজা। এ কী! খোলা কেন দরজা? পায়ে পায়ে ভেতরে ঢুকল সে। বাথরুম থেকে ছড়ছড় করে জল পড়ার শব্দ আসছে। ওটার দরজাও খোলা। এবার বাথরুমের দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াল সে। উঁকি দিলো ভেতরে। যন্ত্রপাতি নিয়ে একজন প্লাম্বার কাজ করছে। আব্দুল খান জিজ্ঞেস করল, “এই যে, ভাই। কী করছেন এখানে?
“ম্যাডাম কমপ্লেন করেছেন গিজার কাজ করছে না। ওটা চেক করতে এসেছি। আপনি কে?”
“আমি ম্যাডামের লোক। উনি পাঠিয়েছেন কাজ কতদূর হলো দেখার জন্যে। কাজ শেষ হওয়া অব্দি আছি আমি। শেষ হলে পর চেক করে দেখে তারপর যাবো।
“আপনি ম্যাডামের লোক হলে আমি কী করছি সেটা তো জানা থাকার কথা আপনার। আবার জিজ্ঞেস করছেন কেন?”
“আপনিই যে কাজটা করতে এসেছেন জানতে হবে না সেটা? যদি অন্য কাজে এসে থাকেন? যাহোক, আর কতক্ষণ লাগবে?”
“বেশিক্ষণ লাগবে না। ঠিক করা হয়ে গেছে। জল গরম হচ্ছে কি না চেক করে দেখছি। আর মাত্র দুমিনিট সময় দিন।”
মাত্র দুমিনিট! ও খোদা! বেড়ালের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়েছিল ঠিকই, তবে তা মুহূর্তের জন্যে মাত্র। যাহোক, এ দুমিনিটেই কিছু করা যায় কি না, দেখা যাক। রুমের চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে ক্লজেট খুলল সে। হ্যাঙারে কাপড়-চোপড় ঝুলছে। তার নিচে বড়ো একটা স্যুটকেস। স্যুটকেসটা টেনে বের করতে যাবে, এমন সময় বেরিয়ে এলো প্লাম্বার। বলল, “এই যে, দাদা। শেষ হয়েছে কাজ।”
থতমত খেয়ে আব্দুল খান বলল, “ও আচ্ছা।” কথাটা বলে ওখানেই দাঁড়িয়ে রইল সে। জামার নিচে কুলকুল করে ঘামছে সে। ভাগ্যিস বের করেনি স্যুটকেসটা!
“কী হলো দাঁড়িয়ে রইলেন যে বড়ো! জল গরম হচ্ছে কি না চেক করে দেখবেন না?”
মনেমনে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল আব্দুল খান। বলল, “না, মানে ক্লজেটের দরজাটা দেখলাম খোলা। ভাবলাম আটকে দেই ওটা। চলুন, জল চেক করে দেখি এখন।”
বাথরুমের কাজ শেষ করার পর কোমর থেকে বড়ো একটা চাবির গোছা বের করে রুমের তালা আটকে দিলো প্লাম্বার। বলল, “ম্যাডামকে বলবেন ঠিক হয়ে গেছে গিজার।”
“আজ্ঞে, বলবো।”
হতাশ হয়ে নিজের রুমে ফিরে এলো আব্দুল। চুপচাপ শুয়ে থাকা ছাড়া কিছু করার নেই এখন। লাক ফেভার করছে না। তাই বলে হাল ছাড়া যাবে না। ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে হবে।
রাতের খাওয়া শেষ করে ভাড়া-বাড়িতে এসে হাজির হলো শরৎ বাবুরা। ম্যাডামের নির্দেশে যার যার কাপড় ছেড়ে পুরোহিতদের মতো হুডঅলা কালো আলখাল্লা পরতে হয়েছে। পা সম্পূর্ণ খালি। বসার ঘরে পা দিয়েই চমকে উঠল সবাই। ভোল পুরোপুরি পালটে ফেলা হয়েছে কামরাটার। আগে যেখানে সোফা ছিল সেইখানে এখন ফাঁকা জায়গা। ইশারায় শরৎ বাবু, দীন, আর খানকে ওখানেই আসন পিঁড়ি হয়ে বসতে বলল ম্যাডাম জুই।
ঘরের চার কোনায় হাউহাউ করে জ্বলছে চারটে ইয়া বড়ো মশাল। শেষ মাথায় যেখানে ডাইনিং টেবিল ছিল, সেখানে দেওয়াল ঘেঁষে কাঠের একটা বেদি রাখা হয়েছে। দুপাশে পেল্লায় সাইজের দুটো পোড়া মাটির মটকা বা জালা। প্রতিটা মটকার ওপর পেতলের গামলায় গোলাপ জল। বেদির ওপর ধপধপে সাদা কাপড় বিছানো। কাপড়টার ওপর নীল রঙের সিজিল। কৌণিক চারকোনা আয়তক্ষেত্রের ওপর একটা বৃত্ত। আয়তক্ষেত্রকে চারটে বিন্দুতে ছেদ করেছে বৃত্ত। ওই চারটে ছেদ-বিন্দু আর আয়তক্ষেত্রে চার কোণে ছোটো ছোটো আটটা বৃত্ত। আয়তক্ষেত্রের চার বাহুতে চারটে জ্বলন্ত পিলসুজ নির্দেশ করছে উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিম পিলসুজে কর্পূর মেশানো সুগন্ধি তেল। সিজিলের ডান দিকে তামার তৈরি ছোটো একটা ছুরি। বাঁদিকে বেলের শুকনো খোল, বেলপাতা, গোল একটা রুটি, আর একমুঠো লবণ। এসব জিনিসের পেছনে ডান-বাঁ, উভয়দিকে রুপোর পানপাত্রে মিষ্টি সরবতে মেশানো কিশমিশ। এই দুই পানপত্রের ঠিক মাঝখানে গর্তঅলা ব্রোঞ্জের গোলক। অ্যালকোহল ঢালা হয়েছে গোলকের গর্তের ভেতর। আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে অ্যালকোহল ভরতি গর্তে। দিপদিপ করে নীলচে আগুন জ্বলছে। বেদির একেবারে ধার ঘেঁষে কয়েন আকৃতির পঞ্চাশটা ছোটো ছোটো শুকনো মাটির টুকরো।
পুজো মন্ডপের বেদির সামনে আঁকা ধূসর রঙের তিনটি সাংকেতিক চিহ্ন। প্রথমটা মানুষের প্রতীক, নিচে রোমান হরফে লেখা আরা। দ্বিতীয়টি প্রাচীন দেবতাদের আহ্বান করার সাংকেতিক অক্ষর, নিচে লেখা—অ্যাগা। তৃতীয় প্রতীক চিহ্নের নিচে লেখা—ভ্যানডার। বেদির পায়ের কাছে পাশাপাশি সাতটা ভিন্নভিন্ন সিজিল আঁকা সাতটা সিলমোহর সাজানো। প্ৰথম সিজিলটা আঁকা বেগুনি রঙের রেশমি কাপড়ে মোড়া রুপোর পাতের ওপর, দ্বিতীয়টা খেজুর গাছের পাতা দিয়ে পেঁচানো পার্চমেন্টে, তৃতীয়টা সাদা রেশমি কাপড়ে ঢাকা তামার টুকরোর ওপর, চতুর্থটা সোনালি রঙের রেশমি কাপড়ে মোড়া সোনার পাতের ওপর, পঞ্চম সিলমোহর ধূসর রঙের মোটা কাপড়ে মোড়া লোহার পাতের ওপর রক্ত দিয়ে আঁকা, ষষ্ঠ সিজিল আঁকা সবুজ রেশমি কাপড়ে মোড়া পেতলের পাতের ওপর, আর সপ্তম সিজিল নীল রঙের রেশমি কাপড়ে মোড়া তামার পাতের ওপর। চিহ্নগুলোর সামনে একটা খাপখোলা চকচকে তলোয়ার আর বেশ কিছু জিনিস ভরতি বেতের তৈরি একটা বড়ো ঝুড়ি।
কালো রঙের আলখাল্লা আর উঁচু চুড়োঅলা গোল টুপি মাথায় ম্যাডাম জুইকে দেখতে লাগছে আদ্যিকালের ওরাকল অভ ডিলফাইয়ের নারী পুরোহিতের মতো। আলখাল্লার বুকের কাছে সাদা রঙের পেন্টাগ্রাম আর টুপির ওপর একই রঙে অক্টাগ্রাম আঁকা। গলায় রুপোর চেনে ঝুলছে ছয় কোনোঅলা সোনার তারার লকেট।
“দীনবন্ধু বাবুর পাণ্ডুলিপি হাতে আসার পর থেকেই এ বিষয়ে যতটুকু সম্ভব জানার চেষ্টা করেছি,” গম্ভীর গলায় কথা শুরু করল ম্যাডাম জুই। “বিশ শতকের গোড়ার দিকে অগাস্টাস মন্টেগিউ সমার্স নামে ইংল্যান্ডে এক রহস্যময় ক্যাথলিক যাজক বাস করতেন। ইনি প্রেততত্ত্ব, তন্ত্র-মন্ত্র, আর ডাকিনীবিদ্যার ওপর যত বই লিখেছেন, অমনটা আর কেউ লেখেননি। তার বেশ কিছু বই সংগ্রহ করিয়ে পড়েছি আমি। এ কারণে যখন চীনে ভাষায় টংয়ের লেখা ওই কাগজগুলো পড়ি, তখন বর্ণনাগুলো বুঝতে সুবিধে হয়েছে। আল আযিফ এক জটিল জিনিস। এ পাণ্ডুলিপিতে সুমেরিও শব্দের ছড়াছড়ি, পুরোপুরি অজানা, দুর্বোধ্য, ও রহস্যময় এসব শব্দ। একটা সুমেরিয় শব্দ ‘আম হা’ বারবার এসেছে। এই আম হা হলো বৈদিক ॐ শব্দের আরেক রূপ। এই আম হা ডকিনীবিদ্যার আদি গুরু। এছাড়া আরও দুটি শব্দ আছে সেগুলো হলো জোনেহ আর আনজোনেহ। জোনেহ-এর অর্থ গ্রহ-নক্ষত্র। এই গ্রহ-নক্ষত্রের বাইরেও অনেক অতিপ্রকৃতি সত্তা রয়েছে। এগুলোকে বলে আনজোনেহ। অর্থাৎ গ্রহ-নক্ষত্র দিয়ে ঘেরা জায়গার বাইরের অংশ। নিষিদ্ধ জায়গায় দেওয়ালের গায়ে কিম্বা মাটির ফলকে যেসব টেক্সট পড়ে আল আযিফ লেখা হয়েছে সেটা আসলে এরিশকিগালের প্রধান ঐন্দ্রজালিক নানগারের কিতাব। নানগারের কিতাবের বয়স পাঁচ হাজার বছরেরও বেশি …”
“এত কথা দরকার কী, আসল কথা বলেন,” ঘেউ ঘেউ করে উঠল আব্দুল খান। পাণ্ডুলিপি হাতাতে না পেরে ভয়ানক অস্থিরতায় ভুগছে সে। “পাণ্ডুলিপি কোথায় রেখেছেন?”
“আমার কাছেই আছে।”
“আমার কাছে মানে কী? আপনার হাত তো খালি। এ ঘরের কোথাও চোখে পড়ছে না ওটা।
“এই বেদির নিচে আছে।”
“সবগুলো? মানে তিনটেই?”
“আজ্ঞে, হ্যাঁ, তিনটেই। শাহনামার ভেতর যে অংশটুকু ছিল সেটা বই থেকে ছিঁড়ে বের করে নিয়েছি।”
“শাহনামা কোথায়? ফেলে দিয়েছেন! ও বই দুষ্প্রাপ্য,” এবার দীনবন্ধুর কণ্ঠে হতাশা।
“না। তুলে রেখেছি। পরে দেবো আপনাকে। ও নিয়ে দুশ্চিন্তা করবেন না। দয়া করে চুপ করুন এখন। আমাকে বলতে দিন। টং লিখেছে, এ বই পড়লেই ভয়ঙ্কর সব দৃশ্যপট ভেসে ওঠে চোখের সামনে। মৃগী রোগীর মতো মুখ দিয়ে ফেনা কেটে খিঁচুনি ধরে শরীরে। বিপর্যস্ত হয়ে পড়তে হয় মানসিকভাবে। আসল পাণ্ডুলিপি আমজনতার সামনে তুলে দেওয়া সম্ভব না কিছুতেই। এখানে যেসব অপদেবতা আর দেব-দেবীর কথা বলা হয়েছে, বিগত ছয় হাজার বছরে তাদের নাম কেউ উচ্চারণও করেনি। এখানে উল্লেখিত দেব-দেবী বা কোনো ডায়াগ্রাম ইহুদি কিম্বা খ্রিষ্টান ধর্মের আবির্ভাবেরও ঢের বেশি আগের। এমনকি পুরাকালের ইহুদি তন্ত্ৰ কাবালার সাথেও এর কোনো মিল নেই।
“এই আম হার পঞ্চাশটা নাম। এই নামগুলোর আলাদা আলাদা চিহ্ন রয়েছে। ওই চিহ্নগুলো ছোটো ছোটো কাদার টুকরোর ওপর খোদায় করে বেদির ওপর রাখতে হয়েছে। টংয়ের কফিনে বহুদিনের পুরনো চারটে পাথরের পিলসুজ পেয়েছিলাম। কী মনে করে উঠিয়ে এনেছিলাম ওগুলোও। ভাগ্যিস এনেছিলাম। না আনলে সম্পন্ন করতে পারতাম না এ অভিচারক্রিয়া। উপাচারের শর্তানুযায়ী বহু পুরনো আর অতি ব্যবহারে জীর্ণ হতে হবে ওই পিলসুজগলো। সম্ভবত হেনরির সমাধিতে ওগুলো পেয়েছিল টং। যাহোক, সাধনার সময় যত ভয়ানক দৃশ্যেরই অবতারণা হোক না কেন, যতই অস্বাভাবিক হয়ে উঠুক পরিবেশ, যত বীভৎস জীবরেই আগমন ঘটুক, অভিচার ক্রিয়া থামানো যাবে না। সাধক যদি শক্তিশালী হয়, কোনো কিছুকেই ভ্রুক্ষেপ না করে, আর সঠিকভাবে মন্ত্রোচ্চারণ করে ইষ্ট দেবতাকে স্মরণ করে তাহলে সিদ্ধি মিলবেই। আমি এখন আভিচারক্রিয়া শুরু করবো। নড়াচড়া না করে চুপ করে বসে থাকুন। আপনাদের কাছে এটুকুই নিবেদন।”
এবার বেদির সামনে পুরো মেঝেটা মহুয়া গাছের ডাল-পাতার তৈরি ঝাড়ু
দিয়ে পরিষ্কার করে নিলো ম্যাডাম জুই। এরপর জুঁই ফুল দিয়ে বড়ো বড়ো দুটো বৃত্ত বানাল। একটার ভেতর আরেকটা। বৃত্তের ভেতর উত্তর-পুব কোণে একদলা মাটির তালের ওপর পেতলের একটা গামলা রাখল। গামলার গায়ে রোমান হরফে লেখা— আগামাসসাবাতু। ওই শব্দটার নিচে গাঢ় লাল রঙের কালি দিয়ে অদ্ভুত ধরনের তিনটে সিজিল আঁকা। এইবার ডান হাতে একপাশে রাখা তলোয়ারটা তুলে নিলো সে। বাঁ হাতে গামলার ভেতর ঠেসে ধরল সাদা ধপধপে একটা কবুতর। এক কোপে দুখণ্ড করে ফেলল ওটা। তারপর সুরেলা কণ্ঠে আরম্ভ করল মন্ত্রপাঠ:
ইস মাস সারাতিশা মুশি লিপশুরু রুক্মিশা লিমনুতি!
ইযা নিমা ইলানি রাবুতি শিমা ইয়া দাবাবি!
দিনা দিনা আলাকতি লিমদা!
আলসিকু নুশি ইলানি মুশিতি!
ইয়া মাস সারাতি ইস মাস সারাতি বা ইদস মাস সারাতু!
মন্ত্র পাঠ করা হয়ে গেলেই হাতের তরাবারি পেতলের গামলার পেছনের জমিনে মাটির তালের ওপর সজোরে গেঁথে দিলো সে। একই সাথে উচ্চারণ করল:
ইয়া মাশ সারাতু! ইয়া মাশ সারাতু! ইয়া মাশ সারাতু যি কিয়া কানপা! বারগেলমলোনেথ কিয়াশ্তাহ।
মন্ত্রপাঠের পর নৈবেদ্য হিসেবে বেতের ঝুড়ি থেকে সেঁকে নেওয়া রুটি, কিশমিশ আর দুর্বা ঘাস তুলে নিয়ে গামলার ভেতরটা সাজাল। এরপর ওগুলোতে ঘি ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিলো। এবার ঝুড়ি থেকে বের করল একটা মড়ার খুলি। জমিনের ওপর খুলিটা রেখে তরবারি দিয়ে আঘাত করল খুলির চাঁদিতে। সঙ্গে সঙ্গে দুটুকরো হলো করোটি। এরপর গলা থেকে রুপোর চেন খুলে সোনার তারাটা ডান হাতের তালুর ওপর রাখল সে। এইবার খুব নরম সুরে আমহাকে আহ্বান করল:
উঘ হুদুঘ হুঘার ইশতুগবির।
খুসবি কুরক নামতার! খিতিম কুরুকু! আমানু! আমানু! আমানু!
একই সাথে ফুঁ দিতে লাগল ওই তারার ওপর। তারপর পাক খেতে খেতে তাওয়াফ করা শুরু করল উত্তর দিক থেকে পুবে তারপর দক্ষিণ থেকে পশ্চিমে। মোট ছয়বার ঘোরা শেষ হলে বেদির কাছে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসল। এর ঠিক পরপরই মিইয়ে গেল মশালের আলো। ফিকে আঁধার নেমে এলো ঘরের ভেতর। হালকা নিলচে আলোয় দেখা গেল একটি চির সবুজ আর ঐশ্বর্যশালী দ্বীপে ছবির মতো এক গোছা গ্রাম, ছোট্ট নগরী, বিপণী কেন্দ্র, উপসনালয়। রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে সুঠাম, সুন্দর নারী- পুরুষ-শিশুর দল। দ্বীপটার একদিকে ধূসর পাহড়া, অন্যদিকে নীল সাগর। বদলে গেল দৃশ্যপট। দেখা গেল পাহাড়ের চুড়োয় গুহার ভেতর আম হা-কে আহুতি দিচ্ছে চারজন টাকমাথা এক-চোখ কানা পুরোহিত। স্বাস্থ্যবান এক তরুণকে চ্যাপ্টা পাথরের ওপর শুইয়ে তার পেট চিরে বলি চড়ালো তারা। গম্ভীর স্বরে বারবার বলল, “হে মহান কালো জাদুর দেবতা। এ দ্বীপের ধ্বংস চাই আমরা। বদলা চাই আমাদের ওপর করা নির্যাতনের। অর্ঘ্য পেয়ে যদি সন্তুষ্ট হয়ে থাকেন, তাহলে সাড়া দিন আমাদের আহ্বানে।”
ধীরে ধীরে কালো মেঘ জমলো তাদের মাথার ওপর। তারপর বনবন করে পাক খেতে লাগল সেই মেঘপুঞ্জ। ঘূর্ণির ঠিক কেন্দ্ৰ থেকে তিরের মতো ছুঠে এলো বজ্র। আঘাত করল বলি হওয়া তরুণের লাশটাকে। মুহূতেই পুড়ে ছাই হয়ে গেল হতভাগ্য ছেলেটার দেহাবশেষ। আভূমি নত হয়ে আম হা-এর উদ্দেশ্যে কুর্নিশ করল চোখকানা পুরোহিতের দল।
আবারও পরিবর্তন ঘটলো দৃশ্যপটের। হঠাৎ মড়ক লাগল দ্বীপে। মারা গেল বহু নারী-পুরুষ-গবাদি পশু। তারপরেও বেঁচে গেল অনেকেই। এইবার সাগরের ওপর দিয়ে উড়ে এলো কালো কাপড়ে ঢাকা প্রেতের দল। ঝাঁপিয়ে পড়ল অদৃশ্য পঙ্গপালের মতো। প্রথমে গেল গবাদি পশুর পাল। মাথা আর ধড় আলাদা হয়ে এখানে সেখানে পড়ে থাকতে লাগল গোরু, ভেড়া, ছাগলের দল। কারা যেন তাদের রক্ত চুষে খেয়ে ছিবড়ে করে ফেলেছে। এরপর এলো মানুষের পালা। চোখ উপড়ে নিয়ে তাদের হাত- পাগুলো রাতের আঁধারে কারা যেন ছিঁড়ে ফেলতে লাগল।
এ দৃশ্য মিলিয়ে যেতে না যেতেই দপ করে নিভে গেল ঘরের চারকোনার চারটে মশাল। পুরোপুরি অন্ধকার হয়ে গেল হলঘর। থকথকে আঁধার। ম্যাডাম জুই দূরে থাক, নাকের সামনে এক ইঞ্চি দূরের জিনিসও চোখে দেখা যাচ্ছে না। হঠাৎ ঘরের চারদিকে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল আগুনের লেলিহান শিখা। ধেয়ে ধেয়ে এলো শরৎ বাবুদের দিকে। সেই সাথে শুরু হলো গুমগুম শব্দে বজ্ৰপাত। অদ্ভুত সব আকৃতি দেখা গেল বজ্রপাতের নীলচে আলোয়। মাথা সাপের ধড় মানুষের, মানুষের মাথার সাথে ধেড়ে ইঁদুরের শরীর, বাঘের দেহের সাথে কুমিরের মুখ, করতালি বাজিয়ে নাচছে অগুণতি কংকাল, ধেয়ে আসছে জীবন্ত লাশের দল, মাংস খসেখসে পড়ছে তাদের গা থেকে। মড়াপচা দুর্গন্ধে দম বন্ধ এলো শরৎ বাবুদের। হঠাৎ যেমন এসেছিল তেমনি আচম্বিতেই অদৃশ্য হলো অদ্ভুতুড়ে আকৃতির দল।
শুরু হলো আরেক দৃশ্য। চড়চড় করে ফেটে দুভাগ হয়ে গেল শান বাঁধানো মেঝে। সেই ফাটলের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো তিনমাথাঅলা বীভৎস নেকড়ে। ঝাঁপ দিলো শরৎ বাবুরা যেখানে বসে আছে, সেই জায়গা লক্ষ্য করে। এইবার নিশ্চিত মৃত্যু, ভাবল দর্শকের সারিতে বসা তিনজন।
ঠিক সেই সময়ে পরম শ্রদ্ধা ও বিনম্রতার সাথে বেদির দিকে অগ্রসর হলো ম্যাডাম জুই। মাথা নুইয়ে প্রণাম করে বেদির ওপর নিভুনিভু ব্রোঞ্জের গোলক থেকে আগুন নিয়ে মাটির পিলসুজ চারটে জ্বাললো। এইবার আম হা-এর নাম জপ করতে করতে হোমের আগুনে মেশকে আম্বরের সাথে কস্তুরি মৃগনাভীর টুকরো আহুতি দিতে শুরু করল। সেই সঙ্গে স্পষ্ট আর তীক্ষ্ণ গলায় উচ্চারণ করল:
এনু শুব
আন গিগ আবসু
কিশ এগিগা
গার শাগ দা সিসিই আমারদা ইয়া
ডিঙ্গির উদ কালামা সিনিকু
ডিঙ্গির নিনাব গুইয়ু নেক্সরানিকু
গা ইয়া শু শাগমুকু
এইবার ব্রোঞ্জের তৈরি গোলকের আগুনে গোল রুটিটা পোড়াল ম্যাডাম জুই। তারপর যজ্ঞের আসনের চারদিকে লবণগুলো ছিটিয়ে দিলো। কাজটা শেষ করে ঝুড়ি থেকে তুলে নিলো ফালি করে কাটা লেবুর টুকরো, বার্লি, আর সাদা ময়দা। বার্লি আর সাদা ময়দার সাথে লেবুর রস মিশিয়ে লেই বানাল। তারপর সেই লেই দিয়ে চক্র এঁকে তার ভেতর চোখ বন্ধ করে দাঁড়াল। এ হলো দেবতা আহ্বানের মণ্ডল বা পবিত্র গণ্ডি। বিড়বিড় করে মন্ত্র পড়ছে ম্যাডাম জুই। হঠাৎ চোখ খুলল সে। নীলচে আভা বেরুচ্ছে চোখগুলো থেকে। আগুনের মতো লাল হয়ে উঠেছে তার মুখাবয়ব। রক্তমাংসের সেই ধীর-স্থির সাইকিক ম্যাডাম জুই নয়, এ যেন অন্য ভুবনের চির-নিষ্ঠুর এক অজানা সত্তা! তীক্ষ্ণ রিনরিনে গলায় সে বলল, “অর্ঘ্য চান দেবতা। দিতে হবে তার উপযুক্ত নৈবেদ্য। এখনই।”
ছোঁ মেরে বেদির ওপর থেকে তামার ছুরিটা তুলে নিলো ম্যাডাম জুই। ফুলের বৃত্তের এপারে যেখানে শরৎ বাবুরা বসেছিলেন চোখের পলকে চলে এলো সেখানে। হিসহিস করে বলল, “আল আযিফ চাস তুই। আমার ঘরে হানা দিয়েছিলি। চুরি করবি ওটা। গর্দভ কোথাকার! আমাকে কী ভাবিস তুই? আমার পুরো মুখস্থ তোর কুকর্মের ফিরিস্তি। এইবার শোধ হবে সব ঋণ!”
এরপর কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই আব্দুল খানের গলায় তামার ছুরি বসিয়ে দিলো ম্যাডাম জুই। গলার সামনে দিয়ে ঢুকে ঘাড়ের ওপাশে দিয়ে বেরিয়ে গেল ছুরির ফলা। আসন পিঁড়ি হয়ে বসা অবস্থাতেই চিত হয়ে মেঝের ওপর পড়ল ট্যুরিস্ট গাইড। হেঁচকি তুলতে তুলতে মারা গেল। ব্যাপার দেখে হতভম্ব দীনবন্ধু তাড়াতাড়ি উঠে ধরতে গেল আব্দুল খানকে। ঠিক সেই মুহূর্তে খপ করে তার বাঁ হাত চেপে ধরলেন শরৎ বাবু। ইশারা করলেন চুপচাপ বসে থাকতে।
ওদিকে আবারও গণ্ডির ভেতর ফিরে গেছে ম্যাডাম জুই করুণ সুরে পড়ে যাচ্ছে মন্ত্ৰ:
উলুক ঝুল এদিন না যু!
আল ঝুল এদিন না যু!
গিগিম ক্সুল এদিন না যু!
মুলা ঝুল এদিন না যু!
মাস্কিম যুল এদিন না যু বারা!
এদিনা না যু! যি আনা কানপা! যি কিয়া কানপা!
মনে হলো একটা ক্ষীণ হালকা লালচে আলো ঢেউয়ের মতো বয়ে যাচ্ছে বেদির ওপর দিয়ে। ধীরে ধীরে মাটি থেকে ওপর দিকে উঠে আসছে বেদিটা। যেন ঘুম ভেঙে ধীরে ধীরে শূন্যে উড়তে চাইছে অতিকায় শিলাখণ্ড। হিমাঙ্কের নিচে নেমে গেল ঘরের তাপমাত্রা। অজানা আশঙ্কায় থরথর করে কেঁপে উঠল শরৎ বাবু আর দীনবন্ধুর শরীর।
কালো কাপড়পরা বেদির দিকে মুখ করে থাকা ম্যাডাম জুইয়ের চেহারা অন্ধকারে কিছুই দেখা গেল না। হঠাৎ করেই তামার ছুরিটা উঁচু করে ধরল সে। এরপর এমন ভঙ্গি করতে শুরু করল দেখে মনে হলো হাওয়ায় চাকু চালাচ্ছে। ঢেউয়ের মতো বয়ে যাওয়া ভুতুড়ে লালচে আলো লেগে চকচক করতে লাগল ধারাল ছুরির ফলা। হঠাৎ শূন্যে ঝুলে থাকা বেদিটা মেঝের যে জায়গায় বসেছিল, সেখান থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে এলো একটা হিলহিলে সাপের লেজ। এতবড়ো সাপ বাবার জীবনেও দেখেননি শরৎ বাবু কিম্বা দীনবন্ধু। সাপের লেজের সবথেকে সরু অংশটাই দুজন পূর্ণ বয়স্ক মানুষের বাহুর সমান। একের পর এক বেরিয়ে আসত লাগল সাপের দল। কিলবিল করতে লাগল মেঝের ওপর। মোচড়াতে লাগল শরীর। এদের দাপাদাপিতে রিনরিন করে কেঁপে উঠল মেঝে। ক্রমেই উচ্চকিত হতে লাগল ম্যাডাম জুইয়ের মন্ত্রপাঠ। এরপর ডানে-বাঁয়ে দুলতে লাগল সে। আর সেই সাথে গলার সবটুকু জোর দিয়ে চালিয়ে গেল মন্ত্রপাঠ।
ইস মাস সারাতিশা মুশি লিপশুরু রুক্মিশা লিমনুতি!
ইযা নিমা ইলানি রাবুতি শিমা ইয়া দাবাবি!
দিনা দিনা আলাকতি লিমদা!
আলসিকু নুশি ইলানি মুশিতি!
ইয়া মাস সারাতি ইস মাস সারাতি বা ইদস মাস সারাতু!
ইয়া ইয়া যি আযাগ! ইয়া ইয়া যি আযকাক! ইয়া ইয়া কুতুলিযিকুর!
হঠাৎ শরৎ বাবু খেয়াল করলেন— যেখানে তিনি বসেছিলেন সেই জায়গার মেঝেটা কেমন যেন ভিজে ভিজে। এ কী! মেঝের ওপর জল এলো কোত্থেকে! মাটিতে হাত রাখতেই তরল কী যেন ঠেকলো তালুতে। মুখের কাছে তালুটা এনে শুঁকে দেখলেন কেমন যেন আঁশটে গন্ধ। এ কী? এত রক্ত এলো কোত্থেকে! সেই সাথে তার কানে এলো হাড় ভাঙার বীভৎস মটমট আওয়াজ। ডান দিকে তাকাতেই আবছা আলোয় দেখলেন—আষ্টেপৃষ্ঠে আব্দুল খানের মৃতদেহ পেঁচিয়ে ধরেছে এক অপ্রাকৃত অতিকায় সাপ, পিষছে বজ্র আঁটুনিতে। ভয়ে কেঁপে উঠলেন শরৎ বাবু। নিজের অজান্তেই চিৎকার বেরিয়ে এলো তার মুখ থেকে। আওয়াজ পেয়ে পেছন দিকে ঘুরে তাকাল ম্যাডাম জুই। আর ঠিক তখনই চোখে পড়ল এক বীভৎস দৃশ্য।
প্রথমে শরৎ বাবু ভেবেছিলেন বাতাসে চাকু চালাচ্ছে ম্যাডাম। এখন দেখলেন বুকের ওপর কোনো কাপড় নেই তার। ধারালো ছুরির আঘাতে ফালাফালা করে ফেলেছে নিজের বুক! শরৎ বাবু বুঝলেন—এই অভিশপ্ত ধর্মের অপদেবতাদের কাছে রক্ত অতি প্রিয়। হঠাৎ তার মনে পড়ল বহুদিন আগে পড়া মালিক মুহম্মদ জইসির লেখা এক ভবঘুরে কবির বর্ণনার কথা।
তেরশো সালের গোড়ার দিকে চিতোর গড়ের রাজা রতন সেনের সাথে দিল্লীর বাদশাহ আলাউদ্দিন খিলজির যুদ্ধ হয়েছিল। ওই যুদ্ধের সময় আব্দুল মালিক ইসামি নামের এক ভবঘুরে কবি ওখানেই ছিল। ইসামির জবানিতে ঘটনাটা এই রকম:
চিতোর গড় যুদ্ধের কথা জীবনে কখনও ভুলতে পারিনি আমি। বিশেষ করে যুদ্ধক্ষেত্রে দেখা একটা দৃশ্যের কথা। ঘটনাচক্রে রক্তক্ষয়ী ওই যুদ্ধের সময় কাছাকাছিই ছিলাম আমি। সন্ধের মুখোমুখি কচুকাটা হয়ে গেল পরাজিতরা। বিজীয় দল অসংখ্য লাশ খোলা ময়দানে রেখেই চলে গেল নিজেদের শিবিরে। সাধারণত যুদ্ধের পরপরই রাতের বেলা যুদ্ধক্ষেত্রে শকুনের মতো হামলে পড়ে লুটেরার দল। লক্ষ্য মৃত সৈন্যের শিরস্ত্রাণ, বর্ম, ঢাল, আর তলোয়ার চুরি করা। পারলে পা থেকে জুতোও খুলে নেয়। তবে এবার তেমনটা ঘটল না। বিজয়ী সৈনিকরা পাহারা বসাল যুদ্ধের ময়দানে। উদ্দেশ্য ভোর হলে তারা-ই সংগ্রহ করবে বিজীতদের সবকিছু। ওদিকে পাহারাদারদের চোখ এড়িয়ে দূরে দূরে ঘুর ঘুর করতে লাগল লুটেরারা। সুযোগ পেলেই শুরু করবে মচ্ছব। কী মনে করে আমিও ভিড়ে গেলাম লুটেরার দলে। ভাবলাম, এমন সুযোগ খুব কমই মেলে। এমন মওকা হেলায় হারানো বিরাট বোকামি হবে। অন্যদের সাথে অপেক্ষা করছি কখন পাহারা শিথিল হয়!
গড়াতে লাগল প্রহরের পর প্রহর। মাঝরাত পেরিয়ে গেল। বকের ধৈর্য নিয়ে অপেক্ষা করছি আমরা। আর ঠিক তখনই অদ্ভুত এক ঘটনা ঘটল—লাল আগুনের আভায় আলোকিত হয়ে উঠল দূর পাহাড়ের সারি। ধীরে ধীরে যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে এগিয়ে আসতে লাগল সেই আলো। এক পর্যায়ে লাল আভায় ভরে উঠল ময়দান। লুটেরার সর্দার ছিল বেঁটে, মোটা এক দাড়িঅলা বুড়ো। ব্যাপার দেখে ফ্যাসফেঁসে গলায় বুড়ো বলল, “সর্বনাশ! এ তো দেখি পিশাচী লামাশতার দল। গুরুতর আহত আর মৃত সৈন্যের রক্ত খেতে এসেছে! জান নিয়ে পালাও সবাই। এদের হাতে পড়লে আর রক্ষে নেই!”
.
যে যক্ষ কিম্বা প্রেতের পুজোই করুক ম্যাডাম জুই, এ যে রক্ত খাকী তাতে কোনো সন্দেহ নেই। মনে মনে ভগবানকে স্মরণ করলেন শরৎ বাবু। চেঁচিয়ে বললেন, ‘হে মহান ঈশ্বর, রক্ষে করুন আমায়।’ তার চিৎকারে বাধা পড়ল ম্যাডাম জুইয়ের গোপন সাধনায়। স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে পড়ল সে। বীভৎস দৃশ্য। রক্তে ভেসে যাচ্ছে বুক-পেট-উরু, দুচোখে নীলাভ দ্যুতি। ঘামে ভেসে যাচ্ছে মুখ, ঠোঁটের কোনা দিয়ে ফেনা কাটছে।
খলখল করে পৈশাচিক হাসি হাসল সে। তারপর তামার ছুরিটা ডান হাতে ধরে শরৎ বাবুর দিকে ধেয়ে এলো আম হার চীনে পূজারিণী। দৃশ্য দেখে জমে গেলেন শরৎ বাবু। পা যেন গেঁথে গেছে মেঝেতে। কোনো রকমে বললেন, “দীনবন্ধু, আমাকে বাঁচাও, ভাই!”
এতক্ষণ কী এক ঘোরের ভেতর ছিল দীনবন্ধু। শরৎ বাবুর কথা শুনে ঘোর কাটল তার। ম্যাডাম জুই শরৎ বাবুর বুক লক্ষ্য করে ছুরি চালাতে যাবে, এমন সময় ঝট করে উঠে দাঁড়াল সে। উন্মত্ত পূজারিণীর হাত থেকে শরৎ বাবুকে বাঁচানোর একটাই উপায়— নিজেকে লাইন অভ ফায়ারে প্রক্ষেপ করা। লাফ দিয়ে শরৎ বাবুর সামনে গিয়ে পড়ল দীনবন্ধু। তাকে জড়িয়ে ধরল নিজের বুকে।
ঠিক সেই মুহূর্তে তার কাঁধের ওপর ঘ্যাসস করে ঢুকে গেল ছুরির তীক্ষ্ণ ফলা। কাঁধে আমূলবিদ্ধ ছুরি নিয়ে দড়াম করে মেঝের ওপর পড়ল দীন। হঠাৎ উলটো ঘুরে ছুটতে শুরু করলেন শরৎ বাবু। পেছন থেকে ডান হাত সামান্য উঁচু করে বহু কষ্টে দীন বলল, “শরৎদা, আমাকে এখানে একা ফেলে যাবেন না। সাথে করে নিয়ে যান আমাকে।”
কে শোনে কার কথা! প্রাণপণে ছুটলেন শরৎ সিনহা। ঘরের দরজা পেরিয়ে বারান্দা, তারপর হেরিং বোন রোড ধরে পাঁচগ্রাম- নবগ্রাম-লালবাগ রোডে বোজেন গারাজের দিকে। তার মনে হলো ফেটে চৌচির হয়ে যাবে হৃৎপিণ্ড। তুমুল বর্ষণে ভিজে চুপচুপে হওয়ার পরও নাক-কান-মুখ দিয়ে গরম ধোঁয়া বেরুতে লাগল। এমন সময় আকাশ চিরে বাজ পড়ল। বিকট শব্দে টলে উঠল পায়ের তলার মাটি। তাল সামলাতে না পেরে বোজেন গারাজের কাছে বালি আর এবড়ো-খেবড়ো ইটে-ভরা জমিনের ওপর আছাড় খেয়ে পড়লেন শরৎ সিনহা। উড়ে গেল সামনের চার পাটি দাঁত।
কিন্তু তার পরেও তার মনে হলো: কেউ একজন পেছন থেকে খুব জোরে ধাক্কা দিয়েছে তাকে। উপুড় হয়ে পড়েছেন শরৎ সিনহা। ঘাড় ঘুরিয়ে পেছন দিকে তাকালেন তিনি। আক্রমণটা করল কে? তাহলে কী পেছন পেছন এতদূর তাড়া করে এসেছে ম্যাডাম জুই!
অবাক হয়ে লক্ষ করলেন—উন্মত্ত ম্যাডাম জুই ধাক্কা দেয়নি তাকে, ধাক্কা দিয়েছে কিসমত পাঠান! চোখের কোনা দিয়ে দেখলেন: ইয়া বড়ো এক জাপানি কাতানা নিয়ে তার কোমরের ওপর আলতো করে এক পা রেখে দাঁড়িয়ে আছে কিসমত পাঠান। কাঁধের দুদিকে ঝুলছে গোছা গোছা চুল। ক্ষীণ চাঁদের আলোয় তাকে দেখতে লাগছে রাবণ রাক্ষসের মতো। “কিসমত তুমি!” অস্ফুট স্বরে কাঁপাকাঁপা গলায় বলল শরৎ সিনহা।
কোনো কথা বলল না কিসমত। কাতানা দিয়ে কুড়োলের মতো তেরছাভাবে কোপ দিলো শরৎ সিনহার ঘাড়ে। ধড় থেকে আলাদা হয়ে গেল জ্যোতিষীর মাথা। বৃষ্টির জলে ধুয়ে গেল সমস্ত রক্ত। কাতানা কোমরে ঝুলিয়ে কাঁধে উঠিয়ে নিলো শরৎ বাবুর কবন্ধ লাশ। একহাতে চুলের মুঠি ধরে তুলে নিলো তার কাটা মাথা। গাড়ির কাছে এসে চটের বস্তায় ভরে রেখে দিলো ট্রাঙ্কের ভেতর।
.
ভাড়া-বাড়ির বসার ঘরে ফিরে এলো কিসমত। আগের মতোই মটির ওপর বসে রয়েছে বেদিটা। এটাকেই মন্ত্রবলে প্রকৃতির নিয়মের বিরুদ্ধে শূন্যে উঠিয়েছিল ম্যাডাম জুই। তবে অদ্ভুত চিহ্নগুলোতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে অতিলৌকিক আগুনের লাল আভা। সেই ইয়া বড়ো ঘিনঘিনে সাপগুলোর কোনো অস্তিত্বও নেই কোথাও। বেদির সামনে হাঁটু গেড়ে বসে আছে ম্যাডাম জুই। সামনে মেঝের ওপর পাশাপাশি তিনটে পাণ্ডুলিপি সাজানো। একটু দূরে ডালা খোলা কাঠের বাক্স। বিড়বিড় করে তখনও মন্ত্র পড়ে চলেছে ম্যাডাম জুই। “ম্যাডাম,” গম্ভীর গলায় চাপা স্বরে তাকে ডাকলো কিসমত পাঠান। কোনো উত্তর নেই। “ম্যাডাম, শুনতে পাচ্ছেন আমার কথা?” আবারও জিজ্ঞেস করল ড্রাইভার। আগের মতোই নিরুত্তর চীনে সাইকিক।
খাপ থেকে কাতানা বের করল কিসমত। আঘাত হানল ম্যাডামের পিঠের ঠিক মাঝ বরাবর। চোখের পলকে এফোঁড়- ওফোঁড় হয়ে গেল ম্যাডাম জুইয়ের পিঠ। ক্ষুরের মতো ধারাল কাতানার বাঁট গিয়ে ঠেকল তার কালো আলখাল্লা ঢাকা পিঠে।
এইবার পাণ্ডুলিপি তিনটে উঠিয়ে কাঠের বাক্সের ভেতর ভরল সে। সরিয়ে রাখল একদিকে। সময় নিয়ে সাফ করল পুরো ঘর। মুছে ফেলল রক্তের দাগ, যজ্ঞের সমস্ত চিহ্ন। বস্তায় ভরে ট্রাঙ্কে ওঠাল আব্দুল খান, দীনবন্ধু, ম্যাডাম জুইয়ের লাশ। তাদের ব্যবহার্য কাপড়-চোপড়, জুতো, ব্যাগ। তারপর বাক্সের ডালা আটকে বগলের নিচে নিয়ে বেরিয়ে গেল বসার ঘরের দরজা খুলে। পুব আকাশে ভোরের আলো ফুটছে তখন।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন