তখন কুষ্টিয়া শহরে ডালের ব্যাবসা করে অর্জুন। এই শহরের সব দোকান-পাট পুব-পশ্চিমে চার কিমি লম্বা নবাব সিরাজুদ্দৌলা রোডের ওপর। পশ্চিমে বাসস্ট্যান্ডের কাছে ‘স্ট্যান্ডার ফল ভান্ডার’ দিয়ে শুরু হয়ে এক্কেবারে পুব মাথায় বড়ো বাজার রেল লাইনের ওপারে ‘জগদীশ মিষ্টান্ন ভান্ডার’-এ শেষ। এরপর রবীন্দ্রনাথের কাচারি বাড়ি, গোখরো সাপে ভরা পোড়ো মোহিনী মিল, লালনের আখড়া। ফল কিনে বাজার করে মিষ্টি খেয়ে লালনের আখড়ায় বসে গান শুনে বাড়ি যাও! বড়ো বাজার বা মেছো বাজারে সব কিছুর হোলসেল। দুশো বছরের পুরনো এই বিপণী-কেন্দ্রে মাকড়শার জালের মতো ছায়া-ছায়া গলি-ঘুপচির ভেতর ছোটো ছোটো গুমটিতে উপচে পড়া মাল। পটকা-আতশবাজি, মটকা- তিলেখাজা, খয়ের-সুপুরি, ডিজেল-সয়াবিন, সিমেন্ট-রড, গম- ভাঙা চাকি, চিটেগুড় মাখানো হুঁকোর তামাক, বেতের ঝুড়ি, জলের পাম্প, স্পঞ্জ স্যান্ডেলের ফিতে, ভাঙড়ি লোহা, পাওয়ার টিলার, দুমণ চালের ভাত রাঁধা ডেক, অড়হরের ডাল, সেকেন্ড হ্যান্ড ছালার বস্তা—কী নেই! সকাল-সন্ধে কুলির হাঁকা-হাঁকি, পাইকারি বেচা-কেনা। অর্জুনের মোকাম ছিল এখানেই, চালের আড়ৎ-এর পাশে, বাজারের একেবারে শেষ মাথায় গড়াই নদীর ধারে। ওপারে হরিপুর। পাশের দোকানি মতলব ধাড়ি ‘মোলাম’- এর কারবারি। মোলাম হলো পাতলা নরম পলিথিনের সেকেন্ড হ্যান্ড শিট। সারাদিন রিক্সা-ভ্যান বোঝাই হয়ে ধুলো-কাদা মাখা মোলাম আসে। হরিপুরের মাঝবয়েসি এক বোবা মহিলা ছেঁড়া হাফপ্যান্ট পরা লিকলিকে ছোটো দুটো ছেলেকে সাথে নিয়ে নদীর পাড়ে সেই মোলাম ধুয়ে, রোদে শুকিয়ে, চার ভাঁজ করে পাট পাট সাজিয়ে রাখে দোকানের মেঝের ওপর। ব্র্যান্ড নিউ পলিথিন শিট প্রতি সের ষাট টাকা, মোলাম দশ!
মতলব ধাড়ি অশিক্ষিত ধরনের লোক, তবে ভেক ধরে আইএ পাশের। প্রায়ই অর্জুন তাকে বলতে শোনে, “হরিপুর হাইয়ে আন্ডার ম্যাট্রিক অব্দি পড়েছি। আগেকার দিনের আন্ডার ম্যাট্রিক, এখনকার আইএ—এই বলে রাখলাম।” দোকানে দুপাতার দৈনিক কুষ্টিয়া রাখে, ওদিকে সন্ধেবেলা খেরো খাতায় সারাদিনের আয়- ব্যয়ের হিসেব লেখায় অর্জুনকে দিয়ে।
তখন চৈত্র মাস, ডালের কারবারিদের হাই সিজন। সন্ধের পর দোকানের সামনে কর্মচারীরা খেসাড়ির ডাল কাঁটা করছে: লাভ লাভ, দুই দুই, তিন তিন . . .। অর্জুন টপাটপ সংখ্যা টুকে নিচ্ছে হিসেবের খাতায়, এমন সময় দীনবন্ধু মিত্র এলো। গায়ে ফিনফিনে ধুতি-পাঞ্জাবী, পায়ে পামশু, হাতে খয়েরি রঙের কাপড়ে বাঁধানো বই, রামায়ণের থেকেও বেশি মোটা। দীনবন্ধু অর্জুনের স্কুল জীবনের সহপাঠী। এখন দীনমণি বালিকা বিদ্যালয়ে বাংলা পড়ায়। সূক্ষ্ম রুচির নিপাট ভদ্রলোক। প্রায়ই বিকেলের দিকে মোকামে এসে গল্প-গুজব করে। ইশারায় চেয়ার দেখিয়ে তাকে বসতে বলল অর্জুন। কাঁটা করা শেষ হতে হতে আরও আধা ঘণ্টা পেরুলো। এবার পাট সুঁই দিয়ে বস্তার মুখ সেলাই করে পেছনের গোডাউনে সাজিয়ে রাখার পালা। ওটা কর্মচারীরাই সারতে পারবে। দুকাপ চা আর লেডুয়া বিস্কুটের অর্ডার দিয়ে দীনবন্ধুর দিকে মনোযোগ দিলো অর্জুন:
“তারপর বন্ধু, কী খবর বলো?”
“খবর আর কী। এদিক দিয়েই যাচ্ছিলাম, ভাবলাম দেখা করে যাই।”
ঠিক সেই সময় ধাড়ি এসে হাজির, হাতে খেরো খাতা। চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলল, “আরে ‘দিন’ বাবু যে। এই ‘রাত’-এর বেলা! হি হি হি . . .।”
এই রসিকতাটা মতলব ধাড়ি প্রায়ই করে। অনেক দিন আগে সন্ধের সময় দীনবন্ধুকে দোকানে আসতে দেখে ওকথাটা অর্জুনই বলেছিল। মতলব কাছেই ছিল। সেই যে রপ্ত করল, তারপর থেকে বলেই চলেছে। প্রায় সব হাস্যরসই কাউকে না কাউকে ছোটো করে তৈরি হয়, যাকে বলে অ্যাট দ্য এক্সপেন্স অভ সামবডি এলস। অনেকটা অসচেতনভাবে। তবে তার মধ্যে সূক্ষ্মতা থাকে। যাকে উদ্দেশ্য করে ওটা প্রস্তুত হয়, হাসে সে-ও। এবং সেটি এককালীন। এর সচেতন পুনরাবৃত্তি একটি অতি-বিরক্তিকর, অভব্য আচরণ। কিন্তু ‘হাই শিক্ষিত’ মতলব মিয়াকে সেই কথাটা কে বোঝাবে! দীনবন্ধু একজন শিক্ষক, অর্জুনের সুহৃদ, ও অতিথি। তার অসম্মান কোনোভাবেই কাম্য নয়। প্রসঙ্গ অন্যদিকে ঘোরানোর জন্যে অর্জুন বলল, “কী হিসাব লিখতে হবে বের করেন। এখনই সেরে দেই। হাতে মেলা কাজ।”
“আরে সে হবে খন। এতদিন পর মাস্টার বাবু এলেন, আগে একটু জ্ঞানের কথা-বার্তা হোক। চা-টার অর্ডার কী দিয়েছেন? না আমি বলব?” এর পরপরই মতলব ধাড়ির দৃষ্টি গেল মোটা বইটার ওপর। নেচে উঠল চোখের তারা। জ্ঞান-গর্ভ আলোচনার বিষয়বস্তু পাওয়া গেছে! “আরে অ্যাত্তো মোটা বই! রামায়ণ, না মাহভারত? কী সুন্দর বাঁধাই! মনে হয় কোলকাতার।”
“ওটা মেটেরিয়া মেডিকা,” দীনের সংক্ষিপ্ত উত্তর।
“অ। ধর্মের বই নাকি? হিন্দু ধর্মের বইয়ের ইংরেজি নাম! কালে কালে কত কী যে দেখব!”
অর্জুন বলল, “মেটেরিয়া মেডিকা ধর্মের বই না। ওটা হোমিয়োপ্যাথ ডাক্তারদের বই।”
“হোমোপতি বই! আমি ভাবলাম, কী না কী! তো হোমোপতি বই দিয়ে কী করবেন? মাস্টারি বাদ দিয়ে ডাক্তারি ধরবেন নাকি? মেছো বাজারে ওই একটা জিনিসই কেবল নেই—ডাক্তারের ডিসপেন্সারি। পাশের দোকানটা খালিই পড়ে আছে। মালিক আমার পরিচিত। শিশি বোতল, কম্পাউন্ডার নিয়ে লেগে পড়েন। ভাড়া নিয়ে সমস্য হবে না। গ্যারান্টি।
“কী বলেন না বলেন, মতলব ভাই। দীন বোধহয় তার বাবার জন্যে কিনেছে ওটা। আপনি জানেন না, দীনের বাবা বাসাতেই হোমিয়োপ্যাথি প্রাকটিস করেন। বিনামূল্যে নিদেন দেন।”
“তাতে কী? শোনেননি, বাপকা বেটা সেপাইকা ঘোড়া, কুছ নেহি তো থোড়া থোড়া? বাপ বাড়িতে, ছেলে বাজারে। সকালে হাঁটতে বেরিয়েছ, পাড়াতেই বাবাকে শরীরটা একবার দেখিয়ে নাও। বিকেলে কেনাকাটা করতে এসছো, বাজারে ছেলেকে রোগ দেখাও। হা হা হা।”
এর ভেতর চা-লেডুয়া বিস্কুট এলো। অকূলে কূল পেল অর্জুন। কথার মেইল ট্রেন চা-বিস্কুটের জাংশনে থামতে বাধ্য! ছোটো চারকোনা লাঠির মতো লেডুয়া বিস্কুটের পৌনে এক ইঞ্চি থিকনেস, লম্বায় তিন—যেন খটখটে কাঠের গোঁজ। খাওয়া শ্রমসাধ্য ব্যাপার। চায়ে ভিজিয়ে না খেলে চোয়াল ব্যথা হওয়ার সম্ভাবনা শতভাগ।
এই বিশেষ বিস্কুট আগে এখানে ছিল না। ‘৬৫ সালের যুদ্ধের পর পশ্চিমবঙ্গ থেকে রিফুজিরা সম্পত্তি বিনিময় করে দলে দলে কুষ্টিয়ায় এসে উঠল। সাথে লেডুয়া বিস্কুট আর ঘট ভরা চা। সেই থেকে রিফুজিদের নাম হলো ঘটি! দেখা গেল লেডুয়া বিস্কুটের সাথে নাবিস্কোর বিস্তর ফারাক। দেখতে দেখতে নাবিস্কো শেষ, ওদিকে খাওয়া শুরু করলে শেষই হয় না লেডুয়া। লোকাল বেকারিতেই প্রডাকশন, দাম ক্রয়-ক্ষমতার ঢের নিচে। এখন ঘটি- অঘটি স-ব ওই লেডুয়ার ওপর! আমেরিকার এক বিখ্যাত রুটির নাম বেগেল। সাইজে এক ইঞ্চি মোটা বড়ো জিলিপির সমান। মাঝখানে এত্ত বড়ো ফুটো। বেজায় শক্ত, যেন হাওয়া ভরা টিউব। ওই রুটি আগে ওখানে ছিল না। ইহুদি রিফুজিরা সাথে করে নিয়ে গিয়েছিল। বেগেলের সাথে এক কাপ কফি। ব্যস, সারাদিন নিশ্চিন্ত। দুই লেডুয়া আর এক কাপ চায়ের ওই একই কাজ!
নাস্তার জাংশন মতলবের কথার মেইল ট্রেন প্রায় ধরলই না। গাল ভরা বিস্কুট নিয়ে চলতেই থাকল। বলল, “তবে হ্যাঁ। বই একটা আছে হাটশ হরিপুরের জমির সরদারের বাড়িতে। হাজার বছরের পুরনো। নয়শো হিজরিতে জুনায়েদ বোগদাদির লেখা। এই ম্যাট্রিকমিডিয়ার থেকেও বড়ো।”
“নয়শো হিজরি মানে এখন থেকে পাঁচশো বছর আগে। হাজার বছর তো না। এটা চৌদ্দশো এক হিজরি,” বলল দীনবন্ধু।
“ওই হলো হাজারও যা, পাঁচশোও তা!”
“সমস্যা আরও আছে। পাঁচশো বছর আগে কোনো ছাপাখানা ছিল না। তখনকার সব বই হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি। কাগজ, বাঁধাই এখনকার মতো অবশ্যই হবে না। বলতে গেলে আগে বাঁধাইয়ের কোনো ধারণাই ছিল না। বইয়ের কাগজ হলো বটপাতা, তালপাতা, অথবা চামড়ার টুকরো।”
“বোগদাদে তখন কাগজ ছিল রে ভাই। জুনায়েদ বোগদাদি নাম করা সুফি লোক।”
“বাগদাদে লেখা হলে ওটা তো আর বাংলা ভাষায় হবে না, আরবিতে হবে। জমির সরদার কী আরবি জানে? বইয়ের শিরোনামই বা কী? বিষয়বস্তুর ব্যাপারটা না হয় বাদই দিলাম।”
“বিষয়বস্তুর কথা বাদ দেবেন কেন? ওটা হলো নজুমি কিতাব। গোপান বিদ্যা।”
“ঠিক আছে। কিন্তু জমির সরদার বইটা পেল কোত্থেকে? আর ওটা যে গোপন বিদ্যার বই, তা-ই বা জানলেন কীভাবে?”
“জমির সরদার হেড রাজমিস্ত্রি। শৈলকুপার জমিদার পাহাড়ি সান্ন্যালদের বাড়ি ভাঙতে গিয়েছিল। আদ্যিকালের পোড়ো বাড়ি। দেশ ভাগের পর থেকেই খালি। ৬৫ সালের পর হলো এনিমি প্রপার্টি। প্রথমে উধাও হলো রেলিং-দরজা- জানালা। এরপর বিম-বর্গা, ইঁট-কাঠ। সিঁড়ির নিচে গুমটি ঘরের মতো ছিল। সবসময় অন্ধকার, সাপ-খোপের আড্ডা। ওই গুমটির দেওয়ালে এক কুলুঙ্গির ভেতর পেয়েছিল ওটা। মোটা কাপড়ে পেঁচানো। বাড়ি বয়ে আনার পর গাঁয়ের মসজিদের ইমাম সাহেব দেখে বলেছেন ওটা জুনায়েদ বোগদাদির লেখা নজুমি কিতাব। কুফুরি কালাম। ওই বই নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করা ঠিক না। হয়তো ফেলেই দিত। তবে আরবিতে লেখা বই। জানে ধরে ফেলতে পারেনি। তাকের ওপর রেখে দিয়েছে।”
“বইটা কী একবার দেখা যাবে?” নাছোড়বান্দার মতো জিজ্ঞেস করল দীনবন্ধু।
জ্ঞানী মরে শাস্ত্র নিয়ে, মুর্খ মরে তর্কে।
দীনকে অর্জুন বলল, “বাদ দাও এসব। এ কী বলতে কী বলে তার নেই ঠিক।”
অর্জুনের কথা কানেও তুলল না দীনবন্ধু। জেদ চেপে গেছে। হেস্ত-নেস্ত করেই ছাড়বে। আবার বলল, “কী? করতে পারবেন বইটি দেখানোর ব্যবস্থা?”
“অবশ্যই পারবো। দেখতে হলে হাটশ হরিপুর যেতে হবে। যাবেন হাটশ হরিপুর?”
“নিশ্চয়।”
পরের রোববার দীনবন্ধুকে নিয়ে মতলব ধাড়ির বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলো অর্জুন। সাথে দীনমণি বালিকা বিদ্যালয়ের মওলানা স্যার। ইনি আরবি, ফারসি দুটোই জানেন। প্রথমে নৌকো করে গড়াই পার হলো তারা। বেশিরভাগই চর, এখানে সেখানে হাঁটু সমান ছলছলে পানি। বলতে গেলে এক রকম হেঁটেই মেরে দিলো। ওপারে পৌঁছে মাইলটাক যাওয়ার পর ধাড়িদের বাড়ি। চড়া রোদে হাঁটতে গিয়ে ঘেমে-নেয়ে একাকার। মনেমনে অর্জুনের ধারণা, মতলব ধাড়ি খাতিরের চূড়ান্ত করবে। এমনিতেই গ্রামের মানুষের আতিথেয়তা প্রবল। শহরের প্রতিবেশী ব্যবসায়ী সে। আলগা খাতিরের ষোলো আনা সম্ভাবনা। বাড়ি খুঁজে বের করতে সমস্যা হলো না। সবাই এক নামে চেনে ধাড়িদের।
মতলব ধাড়ির বাড়ি টিনের। সামনে মাঝারি সাইজের ঘেসো আঙিনার ডান পাশে ভেঁটুল গাছের নিচে টিউব ওয়েল। ওপাশে গোরুর গোয়াল। বামে শান বাঁধানো বকুল গাছের একদিকে বাপ- দাদার কবর। আঙিনায় খেজুরের পাটির ওপর কাঁচা হলুদ শুকোচ্ছে। চারদিকে সুনসান অলসতা। বকুল গাছের তলায় বসবে কী না ভাবছে অর্জুন, এমন সময় গোয়াল থেকে বেরিয়ে এলো কিষাণ টাইপ এক লোক। বলল, “বাবু, আপনার কুষ্টিয়া থেকে আসছেন, তাই না?”
“হ্যাঁ, কুষ্টিয়া থেকে আসছি। মতলব ধাড়িকে খবর দাও,” বলল অর্জুন।
“মতলব ভাইরা কেউ বাড়ি নেই। গতরাতে উনার শ্বশুর মারা গেছেন। সকালেই কুমারখালি চলে গেছে সবাই। আমাকে বলে গেছে আপনারা এলে যেন খবরটা দেই।”
বিরাট সমস্যায় পড়ল অর্জুনেরা। যাত্রার শুরুতেই ভেজাল। দীনবন্ধু বলল, “ঠিক আছে। কোনো অসুবিধে নেই। বিপদ-আপদ জীবনের সঙ্গী। তবে তুমি বাপু আমাদের একটু উপকার করতে পারো কি না দেখ?”
“কী উপকার?”
“আমরা হাটশ হরিপুরে জমির সরদারের বাড়ি যাব। এই এলাকায় কখনও আসিনি। রাস্তা-ঘাট ভালো চেনে এমন কাউকে দিতে পারবে সাথে? যাওয়া-আসার পয়সা দেব।”
“বাবু, আমিই আপনাদের নিয়ে যেতে পারতাম। কিন্তু এদিকে আবার বাড়ি খালি। আমার ছোটো ভাই ঘুঘুরকে বরং দেই। সে-ই সাথে যাক। কী বলেন?”
টমটমে ভাড়া করে চারজন মিলে রওনা হলো হাটশহরিপুরের দিকে। হেরিং বোন রাস্তার একদিকে খোলা চরে বাতাসের ঘূর্ণিতে বালু উড়ছে। প্রচণ্ড গরম। স্রোতের মতো ঘাম ঝরছে ঘোড়ার গা থেকে। গাড়ি চলে চলে রাস্তার মাঝখানটা কুমিরের পিঠ। দুপাশে ক্ষয়ে যাওয়া গভীর মসৃণ খাঁড়ি। খাঁড়ির ভেতর দিয়ে ঢাকা যাওয়ার কারণে ঝাঁকি কম। ঘণ্টা দেড়েক চলার পর হাটশ হরিপুরে জমির সরকারের বাড়ি পৌঁছল ছোটো দলটা। পাঁচিল দিয়ে ঘেরা টিনের পুরনো চারচালা। টিনের দেওয়াল, পাকা মেঝে। বাড়ির সামনে কোনো বারান্দা নেই। শুধু এক চিলতে আঙিনায় একটা বুড়ো খেজুর গাছ। প্রায় প্রতিটা ডাল থেকে বাবুই পাখির বাসা ঝুলছে। এটাই গন্তব্য।
ঘরের দাওয়ায় পাটি পেতে বসতে দেওয়া হলো অর্জুনদের। বুড়ো হয়ে গেছে জমির। নাতনিকে দিয়ে বইটা আনিয়ে দেখাল। বলল, “বাবু। এই দেখেন বই। ভেতরে যে কী লেখা আল্লাহই জানে!
কালো কাপড়ে বাঁধানো ভারী বই। কাভার পেজে আরবি হরফে শিরোনাম লেখা। মাওলানাই হাত বাড়িয়ে নিলেন। কিছুক্ষণ উলটে-পালটে দেখে নিয়ে বললেন, “এ হলো ফারসিতে লেখা কবি ফেরদৌসির শাহনামা মহাকাব্য!”
দীন জিজ্ঞেস করল, “দেখেন তো কবে ছাপা হয়েছে ওটা?”
“১৮২৫ সালে কোলকাতার মিরাত মুদ্রণ থেকে।”
“ইংরেজিতে টাইটেল, প্রেস, প্রকাশকের নাম, ঠিকানা, সন— এইসব লেখা থাকার কথা। আছে ওটা ওখানে?”
“নাহ। ইংরেজি অক্ষরে কিছু লেখা নেই। সব ফারসিতে।”
“ওহ, এইবার বুঝেছি। ১৮২২ এ রামমোহন কোলকাতা থেকে মিরাত আল আখবার নামে সাপ্তাহিক পত্রিকা বের করতেন। ফারসি ভাষায় লেখা। বাঙালির প্রথম প্রত্রিকা! ওই প্রেস থেকেই ১৮২৫-এ এই শাহনামা ছাপা হয়েছিল তাহলে। খুব বেশি কপি ছাপেনি মনে হয়। এ বই দুষ্প্রাপ্য!”
এই হচ্ছে মোলামের কারবারি মতলব ধাড়ির নজুমি কিতাব!
.
দীন জমির মিয়াকে বলল, “সরদার। এটা একটা পুরনো গল্প- কাহিনির বই। আমি একটা প্রস্তাব দিচ্ছি। বইটা বেচে দেন আমাদের কাছে। এমনিতে পড়েই আছে। হয়তো একদিন হারিয়ে যাবে। ওটা সংরক্ষণ করা দরকার।”
কথাটা শুনে কিছুক্ষণ থম ধরে থাকল জমির সরদার তারপর বলল, “বইটা আমার স্ত্রী-ই দেখেশুনে রাখত। তাকের ওপর রেহেলে কোরান শরীফ, তার পাশে ওই নজুমি কিতাব। সে না থাকলে. হারিয়ে যেত অনেক আগেই। দুঃখের কথা আর কী বলব। সেই বউটাই গত হয়েছে ছমাস আগে। বলছেন সংরক্ষণ করবেন -বরং এমনিতেই নিয়ে যান ওটা। দাম লাগবে না। একটা বই-ই তো! এত কষ্ট করে বাড়ি বয়ে এসে একটা জিনিস আব্দার করেছেন!” এরপর মাওলানার দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনি কী বলেন, মাওলানা সাহেব?”
“সরদার, দীন বাবু শিক্ষিত মানুষ। লোক ভালো। উনি যদি বলেন সংরক্ষণ করবেন, তাহলে অবশ্যই সে কাজ করবেন। আপনি আজ আছেন, কাল নেই। তারপর কোথায় যে ওটা যাবে কে জানে? দিতে যখন চাইছেন, দিয়ে দেন।”
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন