রেলওয়ে আবিষ্কারের (১৮০৪ খ্রী.) পঞ্চাশ বছরের মধ্যে ভারতবর্ষে রেল চলে আসে। লর্ড ডালহৌসিকে এজন্য ভারতীয় রেলের জনক বলা হয়। ১৮৫৩ -এ বোম্বাই থেকে থানে পর্যন্ত চারশ যাত্রী নিয়ে শুরু হয় এর যাত্রা।
রেল নিজস্ব কায়দায় এ উপমহাদেশে বিস্তৃতি ঘটায় তার নেটওয়ার্ক। এই সুত্রে রেল-লাইন দিয়ে গাড়ি চলতে শুরু হয়ে যায় এই বাংলায়।
পদ্মার এপারে রেল বসাবার প্রধান কারণ ছিল এ বাংলার পাটকে কলকাতা হয়ে ডান্ডিতে পৌঁছানো। এ বাংলার প্রথম লাইন ছিল কলকাতা-গোয়ালন্দ-সেই ১৮৬২ সনে। তার আগে অবশ্য কলকাতা দার্জিলিং লাইন হয়েছে। ক্রমে ময়মনসিংহের পাট বহন করার জন্য লাইন বসে ময়মনসিংহ থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত।
পর্যায়ক্রমে লাইন বাড়তে বাড়তে চট্টগ্রাম-আসাম লাইনও একদিন প্রতিষ্ঠিত হয় আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ে নামে। প্রধান কার্যালয় স্থাপিত হয় বন্দর নগর চট্টগ্রামে। CRB হোলো প্রধান অফিস (Central Railway Building).
পাকিস্তান আমলে Pakistan Eastern Railway নাম হয় এবং একে দুটো Distrct-এ ভাগ করা হয়। চট্টগ্রাম এবং পাকসী।
তো এই CRB অফিসে এসে যোগ দেন আমার আব্বা মোহাম্মদ আব্দুস সালাম ১৯৪৪ সনের দিকে। কলকাতা থেকে তাঁকে বদলী করা হয় চট্টগ্রামে— তখন যেটা পছন্দ করেন নি বলেই শুনেছি। কিন্তু পরবর্তীতে নানান কারণে তাঁকে তৃপ্ত দেখেছি তাঁর চাকরি এবং পোস্টিং নিয়ে।
সব চেয়ে বড় কথা একটা পাকা কোয়ার্টার পেলেন টাইগারপাস রেলওয়ে কলোনিতে, মান্নাফ সাহেব নামে এক সহকর্মীর সঙ্গে। তিন বছরের মধ্যে নতুন কোয়ার্টার পেয়ে মান্নাফ সাহেব চলে যান অন্যত্র।
টাইগারপাসের মাটি, পাহাড়, আকাশ, আলো-বাতাস আমাকে মুগ্ধ করেছে সেই ছোট্ট বেলাটি থেকে। শুধু টাইগারপাস বললে ভুল হবে চট্টগ্রাম শহর আমার ভালবাসার শহর। এর ভূমিগঠন, শ্যামলসবুজ প্রকৃতি এর সমূদ্রতীর এখন অবধি আমাকে আকর্ষণ করে দূর্বারগতিতে। ভুলতে পারি না চট্টগ্রামের কোনো কিছুই। সর্বদা মনটায় ছবি ভেসে ওঠে সেইসব দিনের। সোনালী দিনের।
টাইগারপাস কেন এত গুরুত্বপূর্ণ আমার কাছে? কারণ পুরোটা শৈশব, কৈশোর এবং যৌবনের উন্মেষ কাল যাপন করেছি এখানে। প্রাইমারি, হাইস্কুল, কলেজ পাশ এখান থেকে। সব চেয়ে বড় কথা অভিনয়ের হাতেখড়ি— এই খানেই।
রেলওয়ের কথা বলেছি। ওদের নিজস্ব একটা সংস্কৃতি ছিল। এখনও সেটা বিদ্যমান। যেখানেই তারা গেছে নিজেদের এলাকাটাকে চমৎকারভাবে গুছিয়েছে। সেই আমলের চট্টগ্রামের কলোনিগুলো, তাদের অফিস, CRB, অফিসার্স বাংলো, পাহাড় কেটে নির্মিত সড়কগুলো, খেলার মাঠ, স্কুল সবকিছুই আজও দিয়ে যাচ্ছে তাদের রুচি ও সংস্কৃতির পরিচয়।
এই সাথে আরো একটি কাজ তারা করেছে— দেশীয় সংস্কৃতির বিকাশেও পিছপা ছিল না তারা। তাদের কর্মকর্তা কর্মচারিদের জন্য ক্লাব ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানও তৈরি করে দিয়েছিল। এই সূত্রে চট্টগ্রামেও ছিল ওয়াজিউল্লাহ ইন্সটিটিউট। চট্টগ্রামের সংস্কৃতি চর্চার আতুড়ঘর বলা চলে-এমন কোনো স্থানীয় শিল্পী নেই যিনি এখানে তাঁর শিল্প কর্ম প্রদর্শন করেননি— সে অভিনয় হোক বা সংগীত বা নৃত্য-বা সমাজসচেতনতামূলক ক্রিয়াকর্ম— সব কিছুতেই অগ্রগামী ছিল এই ওয়াজিউল্লাহ ইন্সটিটিউট। এটা ছিল কর্মচারিদের জন্য বিশেষভাবে প্রতিষ্ঠিত।
আমার জ্ঞান হওয়ার পর থেকে আমি দেখেছি আমার আব্বা এই ওয়াজিউল্লাহ ইনস্টিটিউটের সাধারণ সম্পাদক এবং আমৃত্যু তিনি তাই ছিলেন।
চট্টগ্রামে সেই সময় বেশ সাংস্কৃতিক চর্চার চল ছিল। আর্য সংগীত এবং সংগীত পরিষদ ছিল এর অন্যতম কেন্দ্র। এই ওয়াজিউল্লাহ ইন্সটিটিউটও ছিল এই চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক প্রাণ কেন্দ্র। বাইরের অনুষ্ঠান ছাড়া রেলওয়ে কর্মচারি-বৃন্দ প্রায় প্রতি মাসে একটি করে মঞ্চ নাটক উপস্থাপন করতেন সদস্যদের বিনোদনে।
আম্মা নাটক দেখার ব্যাপারে খুবই উৎসাহী ছিলেন। বোধহয় প্রথমবার জোর করেই নিয়ে গিয়েছিলেন আব্বা। পরবর্তীতে সেটাই পরিণত হয়েছিল আম্মার উৎসাহের বিষয়ে। আর আমি একমাত্র পুত্র হিসেবে আম্মার সঙ্গে প্রায় সব নাটকই দেখতাম ওয়াজিউল্লাহ ইন্সটিটিউটে। সবটুকু হয়তো দেখা হতো না সবসময়। মাঝ পথেই ঘুমিয়ে পড়তাম প্রায়ই।
পরে উৎসাহ বাড়তে বাড়তে শখই চেপে গেল অভিনয়ের। একটি মানুষ, একজন অভিনেতা কীভাবে অনুপ্রাণিত করতে পারে ছোট্ট বাচ্চাকে বলতে পারবো না, কিন্তু আমিই সেই ছোট্ট ছেলেটা— যাকে অমলেন্দু বিশ্বাস ভীষণভাবে অনুপ্রাণিত করেছিলেন। আমার অভিনয়ের আকরকে উদ্ভাস করতে সহায়ক ভূমিকা রেখেছিলেন অমলেন্দু বিশ্বাস-বাংলাদেশের প্রয়াত যাত্ৰা সম্রাট।
চট্টগ্রামের মঞ্চ তখন দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন অমলেন্দু বিশ্বাস। চাকরী করতেন পোর্ট রেলওয়ে-তে। পোর্ট রেলওয়ে আর পাকিস্তান ইস্টার্ন রেলওয়ে একই প্রতিষ্ঠান ছিল তখন— পরে ভাগ হয়ে পোর্ট ট্রাস্ট হয়। এই মহান অভিনেতা ছিলেন আব্বার ঘনিষ্ঠজন, বাড়িতেও এসেছেন স্ত্রী শান্তি বিশ্বাসকে নিয়ে মনে আছে আমার। শরৎচন্দ্রের প্রায় সব গল্পের নায়কই ছিলেন তিনি। নীহাররঞ্জন গুপ্তের ‘উল্কা’য় তাঁর অভিনয় এখনও আমার মনে স্পষ্ট ছবি হয়ে আছে। ও হ্যাঁ। তিনি আবৃত্তিও করতেন অসম্ভব ভালো। মনে পড়ে মঞ্চে ব্যাকড্রপে গ্রামের পট লাগিয়ে একটি কদম গাছের কাটওয়ার্কের সামনে পিঁড়িতে বসে লুঙ্গি পরে একটা গামছা গায়ে জড়িয়ে আবৃত্তি করেছিলেন।
এইখানে তোর দাদীর কবর ডালিমগাছের তলে-
যেমন তাঁর কণ্ঠ, তেমন স্পষ্ট উচ্চারণ, চেহারাও গড়ন সেইরকম। আমি সেই ছোট্ট বেলাতেই মুগ্ধ অমলেন্দু বিশ্বাসে।
ওই মঞ্চে তখন অন্যান্য আরও যাদের অভিনয় দেখেছি— তাঁদের কথাও খুব মনে পড়ে। সাদেক নবী এবং তার স্ত্রী, সিকদার সাহেব, চৌধুরী ও হক সাহেব (এঁরা নারী চরিত্র করতেন) ডাক্তার বারি, জব্বার সাহেব, তন্দ্রা ভট্টচার্য, পূর্ণিমা, রোজারিও, মাহবুব হাসান আরও অনেকে। সবার নাম এখন আর স্মরণে আসে না। এক হিসেবে এদের সবাইকেই আমার অভিনয়ের অনুপ্রেরণাদাতা বলা যায়।
একদিন ঠিক করলাম আমিও অভিনয় করবো। কিন্তু কে নেবে অভিনয় করতে। বা কোথায় করবো? পরামর্শ দিল বন্ধু মিন্টু।
চল নিজেরাই মঞ্চ করে অভিনয় করি।
হ্যাঁ চল।
মিন্টু আমারই বয়েসী, ন্যাংটো বেলার বন্ধু। আমার বাসার পেছনেই থাকতো। ১৫-২০ ফুট উঁচুতে, ঠিক টাইগারপাস পাহাড়ের নীচে ওদের বাসা। ওদের খিড়কি খুললেই দেখা যেতো আমাদের খিড়কি। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। সেইন্ট প্লাসিডে পড়তো। ভাল ছাত্র। সদাসর্বদা থাকতো বাপ-মায়ের মনিটরিং-এ।
বাবা সিদ্দিক হোসেন ছিলেন পোর্ট রেলওয়েতে কর্মরত। তিনিও মাঝে মাঝে ওয়াজিউল্লাহতে অভিনয় করতেন। ওরও শখ অভিনয় করবে অমলেন্দু বাবুর মত।
সেই আমাদের দু’জনের অভিনয় শুরু। পরে পাড়া, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, রেডিও, টেলিভিশন, থিয়েটার গ্রুপ সব যায়গায় এক সাথে অভিনয় করেছি আমরা। এখন আমেরিকায় প্রবাসী জীবন তার। পোশাকী নাম জামালুদ্দীন হোসেন। ওর স্ত্রী রওশন আরা হোসেন— এক সময়ের দাপুটে মঞ্চ অভিনেত্রী, সুঅভিনয়ের জন্য তিনিও খ্যাত সব মাধ্যমেই।
ঠিক করলাম আমরাও অভিনয় করবো। আব্বাকে বলার সাহস নেই। আম্মার সাহায্য চাইলাম। আর আমার এক মামা জনাব মাহবুব হাফিজ, মাত্র প্রিভেন্টিভ অফিসার হয়ে চট্টগ্রাম পোর্টে জয়েন করেছেন তখন। কোয়ার্টার না পাওয়ায় আমাদের বাড়িতেই থাকতেন। মানাফ চাচা যে ঘরটা ছেড়ে গেছেন সেটিই ছিল আমাদের বৈঠকখানা। এখানেই থাকতেন হাফিজ মামা। মামা ছিলেন দারুণ মিশুক মানুষ। দেশের রাজনীতি নিয়ে প্রায়ই তর্কে মাততেন আব্বার সাথে। আমার সাথে খুব ভাব ছিল তাঁর।
মামার উপদেশে টিপু সুলতান নাটক ঠিক হলো। তিনিই পরিচালক। টিপুর পার্ট কে করবে তাই নিয়ে টানা হেঁচড়া শুরু হয়। মিন্টু বলে তুই কর, আমি বলি তুই কর। শেষে মামাই সিদ্ধান্ত দিলেন—
‘মিন্টু তুমি লম্বা। হ্যান্ডসাম-তুমি টিপু কর। রবি তুমি ফর্সা তুমি কর মসিয়ে লালে ব্যাস! আরও কজনকে নিয়ে শুরু হলো মহড়া।
আব্বাকে বলতে সাহসই হলো না। আমার যত আবদার সব আম্মার কাছেই। আম্মার হাতে চড় থাপ্পড় ছিল ডাল-ভাত, কিন্তু আব্বা? না, কোনোদিন ছেলেমেয়েকে চোখ গরম করতেও দেখিনি। একদিন ছাড়া-সে অন্য গল্প। তারপরেও আব্বাকে ভয় করতামই। আব্বা সবই জানতেন, বলেননি কিছুই। সুতরাং দুদিক থেকেই আশ্রয় প্রশ্রয় উভয়ই ছিল। জীবনে প্রথম মঞ্চ তৈরি করার রোমাঞ্চের বর্ণনা দেয়া সম্ভব নয়। তারপরও বলি— রীতিমত উত্তেজিত ছিলাম সকাল থেকেই। আব্বা অফিসে বেরিয়ে যেতেই শুরু হয় দৌড়ঝাঁপ। দুটো চৌকি টেনে বের করলাম ঘর থেকে, হাফিজ মামারটা অবশ্যই। তাতে বিছানো হলো সতরঞ্জি। আম্মার পুরোনো শাড়ি দিয়ে উইংস তৈরি করলাম আর দুটো পুরোনো চাদর এনে করা হলো যবনিকা। মামাই বুদ্ধি দিলেন কীভাবে তাতে সেফটিফিন গেঁথে তারে ঝুলিয়ে যবনিকার মত খোলা-বন্ধ করা যাবে। তখন সবে বিদ্যুৎ এসেছে বাড়িতে— সেখান থেকেই লাইন নিলাম। শো হবে রাতে। একটা হারমোনিয়ামও যোগাড় হয়েছিল-সামান্য আবহ সংগীত দেয়ার জন্য।
তবে একটা কথা না বললেই নয়। তখনকার দিনে পাড়ায় পাড়ায় বিচিত্রানুষ্ঠান হত, তাতে নাচগান, ম্যাজিক, কমিকস, ক্যারিকেচার হত। মঞ্চগুলো আমাদের চোখের সামনেই নির্মিত হতো বিধায় সে অভিজ্ঞতাও আমরা কাজে লাগিয়েছি আমাদের মঞ্চ নির্মাণে। উপদেষ্টা হাফিজ মামা তো ছিলেনই। আমবাগান মাঠে প্রতি বছর হতো বিচিত্রানুষ্ঠান। কোথায় গেল সেই সব দিন! হায় রে।
যত দূর মনে পড়ে আব্বা আমার সেই অভিনয় দেখেননি। মা তো দেখেছেন অবশ্যই। পাড়ার কিছু খালা, চাচী, মামা, চাচা খালু দেখলেন। হৈ হৈ রৈ রৈ ব্যাপার। পিচ্চি পিচ্চি ছেলেরা মঞ্চ বেঁধে নাটক করছি।
আমরা তো আনন্দে আত্মহারা। কী করে ফেললাম। আসলেই তো কী যে করে ফেলেছিলাম সেদিন! বুকের ভেতর একটা দারুণ কিছুর বীজ বপন হয়ে গেল সেদিনই। “তোমায় হৃদমাঝারে রাখবো, ছেড়ে দেবো না,” সেই বীজ আজ মহীরুহে রূপান্তরিত হয়েছে, কিন্তু আঁশ মেটেনি আজও। এখনও অভিনয়-ক্ষুধার্ত আমি। আমৃত্যু করে যেতে চাই এই কাজটি। জানি না মহান আল্লাহ কী রেখেছেন ভবিতব্যে।
সেই অভিনয়ের পরদিন কিছুটা দমে গেল মনটা যখন আব্বাকে বলতে শুনলাম আম্মাকে-তোমার ছেলের অভিনয় নাকি অভিনয়ই মনে হয়নি, কারা কারা সব বলছিল। আম্মাও মন খারাপ করেন একথায়। আমি তো হতাশার চরমে। শুধু মামা আর মিন্টুর বাহবা পেলাম। তাতে মন ভরল না। মনের ক্ষুধা মনে নিয়েই অপেক্ষা চললো। আবার মঞ্চে উঠলাম পনের বছর বয়সে— প্রথাগত মঞ্চে নাটক কলির জ্বিন। আব্বার ইন্সটিটিউট ওয়াজিউল্লাহয়। মাঝের বছরগুলোয় নিজেকে সান্ত্বনা দিয়েছি— ক্যারিকেচার কার্যক্রম করে। বন্ধুদের মাঝেই।
এর মাঝে আর এক মিন্টু আমাদেরই বন্ধু— তাকে যখন দেখলাম ওয়াজিউল্লাহ ইন্সটিটিউট মঞ্চে শরৎবাবুর নাটক বিন্দুর ছেলেতে অভিনয় করছে— তখন তো হিংসায় জ্বলে পুড়ে হতে থাকলাম অঙ্গার।
ওয়াজিউল্লাহ ইন্সটিটিউটের একটা শাখা ছিল টাইগারপাসে। এটা আব্বার উদ্যোগেই হয়েছিল। বেড়ার ঘর, টিনের ছাদ, একজন কেয়ারটেকার দেখাশোনা করতেন। নামটা মনে আসছে না এখন! সম্ভবত খালেক। আমরা ডাকতাম চাচা।
সন্ধ্যার পর পাড়ার চাচা-খালুরা তাস আর কেরাম খেলতেন। আর আমরা ছোটরা দিনের বেলা কেরাম খেলায় মত্ত থাকতাম সেখানে। সুযোগ পেলেই চাচাকে ফুসলিয়ে কেরামের ব্যবস্থা হতো। এখানে কিছু সিনিয়র ছাত্রও সামিল ছিল আমাদের সাথে। কেউ পড়তো পাহাড়তলী রেলওয়ে হাইস্কুলে, কেউ কলেজিয়েট স্কুলে, কেউবা মিউনিসিপালিটি হাইস্কুলে।
এখানকারই এক সিনিয়ার কেরাম বন্ধু (কলেজিয়েট ছাত্র) একদিন হাত ধরে নিয়ে গেল কলেজিয়েটে ভর্তি পরীক্ষার জন্য। হলাম ভর্তি। শুরু হলো আর এক অধ্যায়, কলেজিয়েট জীবন। কত বড় একটা স্কুল-ওহ মাই গড। টাইগারপাস কিন্ডারগার্টেন ওর কাছে পুঁচকে ইঁদুর ছানার মত। টিনশেড থেকে ইয়া লম্বা চওড়া পাকা লাল ইঁটের দালান। ভয়ই পেয়েছিলাম প্রথমে। পরে সাহস হতে ও সময় লাগলো না। মেলা বন্ধুবান্ধব জুটল একসময়।
উত্তর নালাপাড়া আইস ফ্যাক্টরি রোডে অবস্থিত স্কুলটি ১৮৩৬ সনে পাবলিক বা সরকারি হাইস্কুল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। চট্টগ্রাম রেলস্টেশন খুব কাছেই। সারাদিন রেলের আসা যাওয়ার শব্দ পরিবেশে এনে দেয় অন্য রকম ছন্দ। ১৮৮৬তে নাম হয় চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল। ২০০৮-এ কলেজে উন্নীত হয়েছে। সামনে বিরাট খেলার মাঠ, হোস্টেল, পুকুর, হেড স্যারের বাংলো সব মিলিয়ে বিস্তর এলাকা নিয়ে স্কুলটা গঠিত। সে সময়কার সবচেয়ে পুরোনো স্কুল এবং একই সাথে অতি উচ্চমানের শিক্ষালয়। ওখানেই পার করেছি পাঁচ পাঁচটি বছর। ছাত্র যেমনই ছিলাম না কেন স্যাররা খুব পছন্দ করতেন আর সেই কাদের স্যারের মতই বলতেন।
—পড়ো। মন দিয়ে পড়ো। পড়লে নিশ্চয় পারবে।
কিন্তু রবির মন কখনো পড়াশুনায় স্থির হয়নি। কেন জানি না-পড়তে ভাল লাগতো না। বেশিক্ষণ পড়ার টেবিলে বসার ধাত ছিলই না আমার। সুতরাং ক্লাসে রেজাল্ট দেখাবার মত হয়নি কখনো।
বাবা-মার তরফ থেকে ভাল রেজাল্ট করার কোনো তাগিদ কোনো দিন বোধ করিনি আমি। পড়তে হবে, ব্যস পড়লাম। কতক্ষণ পড়লাম, কী পড়লাম কেউ মাথা ঘামাত না তা নিয়ে আমার দশ বছর বয়স হতে না হতেই দু’বোনোর বিয়ে হয়ে যাওয়ায় আমার ওপর খবরদারী করার মত আর কেউ ছিল না। মুক্ত স্বাধীন ছিলাম আমি। ঘুম থেকে উঠতাম কাক ভোরে— তখন ওটা ছিল আমাদের বন্ধুদের মধ্যে প্রতিযোগিতার বিষয়। কে আগে উঠে, ফুল তুলবে, মালা গাঁথবে, স্যারকে দিবে এসব। তারপর একটু পড়েই খেয়েদেয়ে স্কুল। বিকেলে ফিরে নাস্তা করেই খেলার মাঠে। মাগরেবের আজানের সাথে সাথে দৌড়ে বাসায়।
কলতলায় হাতমুখ ধুয়ে পড়তে বসো— পড়ো কি পড়ো না তা দেখার তো কেউ নেই। নটা বাজতে না বাজতেই ‘ক্ষিধে পেয়েছে’ বলে মার কাছে আবদার। ব্যাস খেয়েদেয়েই ঘুম। তখন তো আর টিভি ছিল না। রেডিও পর্যন্ত ছিল না বাসায় একটা। সুতরাং ঘুমই প্রধান আশ্ৰয়। আমার পড়াশুনার তদারকির জন্য শিক্ষকের অভাব হয়নি কখনো সে তো বলেছি। কিন্তু পড়াশুনার ব্যাপারে আমাকে এতটুকু আগ্রহী করতে পারেননি কেউ কোনোদিন। তবে নিজের স্বপক্ষে একটি কথা দ্বিধা নিয়েই বলছি— মেধাতে কিছু একটা অবশ্যই ছিল যার কারণে পরীক্ষায় চল্লিশ টল্লিশ নম্বর ঠিকই পেয়ে যেতাম। দু’একটা সাবজেক্টে লাল কালি পড়লেও গড়পড়তায় হয়ে যেত পাশ। আর ছেলে ভালো (!!) হওয়ায় স্যারদের প্রিয়পাত্র ছিলাম এ কথা বলতেই হবে।
কলেজিয়েটে তো ভর্তি হলাম। শুরু করলাম নতুন হালচালে অভ্যস্ত হতে। প্যান্টের ভেতর শার্ট ইন করে পরার চেষ্টা চললো-চুলে তেল দিয়ে টেরিকাটারও চলল চেষ্টা। যদিও এ ব্যাপারটাতে ছোট্ট বেলা থেকেই আমি একটু সজাগ ছিলাম। বড় বোনদুটো শুনেছি আমাকে সাজাতে পছন্দ করতেন খুব। ছোটরাও কম যায় নি —
ভাই এটা করো না, ভাল লাগছেন না।
ভাই, ওটা যেন কেমন লাগে তোমাকে—ইত্যকার।
মাথায় চুলও ছিল মাশাআল্লাহ! আম্মা চুল আঁচড়াতেন আর বলতেন-
‘ব্যাটা ছেলের মাথায় আল্লা এত চুল কেন দিলেন?’
আম্মার কথা শুনেছেন আল্লাহ। তাই ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সময় থেকেই উড়তে শুরু করলো আমার চুল বাতাসে ভর করে। উড়ছে তো উড়ছে। থামাথামির নাম নেই আর। ব্যস এক সময় শেষ। পাশ করে যখন বেরুই মোটামুটি হাফ ডান্। তারপর তো আজকের এই দশা। কিন্তু আমি ওটা নিয়ে বিব্রত নই কখনই। আমি বলি, এ সৌন্দর্য অনন্য।
হ্যাঁ, কলেজিয়েট স্কুল। অনেকটা বড় ইংরেজি E ধরনের একতলা লাল ইঁটের বিল্ডিং। টানা বারান্দা এপার ওপার। মাঝে একটি কমনরুম বড় সাইজের।
খেয়াল করলাম আমার প্রাইমারির ছাত্রদের চেয়ে এরা অনেক কেতাদূরস্ত। তখন আমাদের স্কুল ড্রেস ছিল না বিধায় পয়সা-ওয়ালাদের পুত্রদের পোশাক আশাক ছিল বেশ ঝকমকে এবং দামী। একজনের কথা মনে আছে— চট্টগ্রামের বিখ্যাত ব্যবসায়ী ইসলাম খান সাহেবের পুত্র— সে আসতো মরিস অক্সফোর্ড বা ঐ ধরনের একটি গাড়িতে চড়ে। ইসলাম খান সাহেব ছিলেন চট্টগ্রামের অন্যতম প্রধান ধনাঢ্য ব্যক্তি। চট্টগ্রামের প্রথম বনেদী হোটেল, ‘মিসখা’-র মালিক ছিলেন তিনি। এ ছাড়াও তাঁর আর একটি গুন ছিল বিশেষ— তিনি চট্টগ্রামের বড়বড় ফুটবল খেলায় রেফারীগিরি করতেন তখন। বেশ নাম ছিল এ ব্যাপারে তাঁর।
যাই হোক কলেজিয়েটের ছাত্র হয়ে এক ধরনের শ্লাঘা কাজ করতো নিজের মধ্যে। আত্মীয়স্বজনরাও শুনে ভাবতেন নিশ্চয় খুব ভাল ছাত্র নইলে কলেজিয়েটে কেন সুযোগ পায়!
ছেলে ভাল ছিলাম বিধায় অনেক বন্ধু হয়েছিল আমার, যারা সত্যিই মেধাবী ছাত্র, ক্লাসে ফার্স্ট সেকেন্ড হতো।
মনে আছে ক্লাস সেভেনে যখন পড়ি, ক্লাস ক্যাপ্টেন কামাল ছিল আমার বেশ ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তখন খেয়াল করতাম অনেকেই টিফিনের পর কামালকে বলে পালাতো। আমারও একদিন মনে হলো— টিফিনের পর ইংরেজি ক্লাসের পড়া হয়নি আমার। নির্ঘাৎ শাস্তি পেতে হবে— কামালকে ধরলাম-দোস্ত, আমাকে আজ পার করো, আমি পালাবো।
যাও, আমি আছি।
আমি বইখাতা নিয়ে সোজা বাসায়।
পরদিন এসে শুনি টিফিনের পর ইংরেজি ক্লাসে স্যার রোল কল করেছেন, আমার নামের পাশে পড়েছে লাল কালির দাগ।
দু’আনা ফাইন।
তার চেয়ে বড় কথা বদনাম হয়ে গেল। তবে বেশিদিন কেউ মনে রাখেনি, এই যা। হ্যাঁ ওই প্রথম আর শেষ ক্লাস পালানো। না, ঠিক শেষ না, ক্লাস পালানো চালু হলো ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ভর্তি হওয়ার পর। নন-ইঞ্জিনিয়ারিং ক্লাসগুলো থেকে মাঝে মধ্যে ডুব দিতাম, পানি খেতে যাওয়ার নাম করে।
.
বাঙালী সিনেমার পোকা। কথাটা এদেশে এখন কতটা সত্য সিনেমা হল দেখে বলা মুষ্কিল। তবে পশ্চিমবঙ্গে কথাটা ভীষণ ভাবে সত্যি। মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্তরা এখনো পয়সা জমায় মাসে অন্তত একটা সিনেমা সপরিবারে দেখার জন্যে। আমি জীবনে প্রথম সিনেমা দেখি মান্নাফ চাচার সাথে।
চাচা কী চাকরি করতেন আমি জানি না, তবে আব্বার চেয়ে জুনিয়র ছিলেন বয়সে, চাকরিতে হয়তোবা সমান সারিতেই ছিলেন। অবিবাহিত মানুষ। লম্বা ঢ্যাংগা টাইপের। প্যান্টসার্ট পরাটা খুবই প্রিয় ছিল তাঁর। আর ধূমপান! চেইন স্মোকার যাকে বলা হয়। পাসিং শু নামের এক সিগারেট খেতেন চাচা। সিগারেটের খালি প্যাকেট দিয়ে নানান রকম কাঠামো তৈরি শিখেছিলাম তাঁর কাছে।
তো এই চাচার, চাকরি আর খাওয়া ছাড়া কোনো কাজ তো ছিল না— সপ্তাহে কমপক্ষে একটা সিনেমা তো দেখতেনই, আর রেলওয়ে ওয়াজিউল্লাহ ইন্সটিটিউটে তাস খেলতেন। খাওয়া দাওয়া আমাদের বাসাতেই করতেন। আমাদের জহির তাঁর ফাইফরমাস খাটতো, আমিও মাঝে মধ্যে খাওয়া দিয়ে আসতাম তাঁর ঘরে।
তখনকার দিনে লজেন্সটা আর Savoy এর চকলেট (কালেভদ্রে) আমার প্রাপ্তি হতো তাঁর কাছ থেকে। একদিন বললেন-
রবি, চলো সিনেমায় যাই, যাবে?
যাবো।
আমি ভীষণ খুশি। বাধ সাধলেন আম্মা।
না, এতটুকু ছেলে সিনেমা দেখবে কী?
আব্বা হেসে সম্মতি দিলেন-
যাক না, ঘুরে আসুক।
সেই প্রথম সিনেমা দেখা। বয়স তখন কতো? পাঁচ বোধহয়।
গেলাম কিন্তু আধঘণ্টার মত দেখেছি সিনেমাটা। তারপরই বাড়ি ফেরার বায়না ধরেছিলাম। চাচারও সিনেমা মাথায় উঠেছিল। এরপর ও দু’তিনবার গিয়েছি তাঁর সাথে কোনোবারই দেখা হয়নি পুরোটা।
আব্বা-আম্মাও সিনেমা দেখতেন। বাংলা সিনেমা আসলেই তাঁরা দুজন দেখতে যেতেন হলে, আমাদের নিতেন না কোনো দিন। একবার ঢাকায় এলাম ছোটো খালার বাসায় বেড়াতে। খালা থাকতেন গেন্ডারিয়ায়। সেইবার সূচিত্রা-উত্তমের একটা সিনেমা দেখতে নিয়ে গিয়েছিলেন আমাকে। আব্বা,আম্মা, খালা-খালু আর আমি, সাগরিকা বোধহয়। এটা বেশ ভাল মনে আছে আমার। মুকুল সিনেমা হলে।
ও হ্যাঁ, সেই প্রথম বুড়িগঙ্গা নদী দেখলাম, চিনলাম্। বুড়িগঙ্গার পানিতে গোসল করলাম। সেই ৪৭-এ গোয়ালন্দ-চাঁদপুর স্টিমার সার্ভিসে চট্টগ্রাম যাওয়ার পর এই ছিল আমার প্রথম নদী দর্শন। কী সুন্দর স্বচ্ছপানি। খেয়া নৌকায় লোকজন পারাপার করছে, কেউ মাছ ধরছে ছিপ দিয়ে। আর কত মানুষ গোসল করছে ঘাটে। আমার এখনও স্পষ্ট মনে পড়ে আমি আর আমার খালাতো ভাই সেলিম গামছা দিয়ে চিংড়ি ধরায় মেতেছিলাম সেদিন। হায়রে বুড়িগঙ্গা। কী হাল আজ তোমার?
হ্যাঁ তো সিনেমার পোকা হলাম আরও পরে। ক্লাস টেনে পড়ার সময় চট্টগ্রামের লায়ন সিনেমাতে ‘মায়ামৃগ’ দেখেছিলাম-লুকিয়ে। লুকিয়ে মানে বাসায় না বলে। অজুহাত একটা ছিল স্কুলে ফুটবল ম্যাচ আছে, দেখবো।
এর মাঝে যা দেখেছি সব ওই আব্বা-আম্মার সাথে। বোনদের তো কম বয়সেই বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। সুতরাং বাড়িতে আমি তখন বড়। মমতাজ পুতুল অনেক ছোট। ওদের জন্ম চট্টগ্রামে। কলেজে ঢুকে সিনেমা দেখার সুবিধা হয়ে গেল। টিফিনের পর ক্লাস ফাঁকি দিয়ে দেখতাম। বন্ধু বুলু ছিল আমার সঙ্গী। দিনগুলো বড় হলে আমাদের সুবিধা হতো। দিনে দিনে ম্যাটিনি দেখে ফিরতে পারতাম। অজুহাত প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস দেরিতে শেষ হয়-ইত্যাদি। আর খেলার অজুহাত তো ছিলই।
এই সময়টায় ১৯৬০-৬২তে প্রচুর হিন্দি ছবি দেখা হয় আমার আর বুলুর। বাংলাও বাদ যেত না। বিশেষ করে উত্তম-সূচিত্রা হলে তো কথাই নেই। পঞ্চাশের দশকের ছায়াছবিগুলো ঘুরে ফিরে আসতো। আর আমরা ঝাঁপিয়ে পড়তাম। তখন আমাদের মুখে মুখে সব জনপ্রিয় সিনেমার গান চলতো। দেবানন্দের মত চুল পাফ করা, চুলের পেছনে উত্তম ছাঁট, শার্টের কলার দেবানন্দের মত উঁচু করে রাখা, দিলীপ স্টাইলে কথা বলা, এগুলো আমাদের নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় ছিল। ‘হায় আপনা দিল তো আওয়ারা’ আমাদের ছিল অতি প্রিয় গান, আর বাংলায় ও ‘বাক বাক বাকুম পায়রাত।’
তখন আবার বাজারে টেডি প্যান্টের আবির্ভাব ঘটলো। আমরাই বা বাদ যাই কেন, প্যান্ট এডিট করে আমরাও টেডি হয়ে গেলাম।
এই সূত্রে একটি ঘটনা মনে এল। তখন ঢাকায় পড়ি। ঈদে বাড়ি গেছি। আব্বা একটা প্যান্ট পিস কিনে দিয়ে বললেন, ‘যাও দর্জিকে দিয়ে এসো’, ‘জি আচ্ছা’ বলে আমি আমার ব্যাগে ভরে রাখলাম কাপড়টা। কয়দিন পর আব্বার প্রশ্ন ‘কই প্যান্ট আনলে না?’ ‘ঢাকায় বানাবো আব্বা, উত্তর আমার। এর উত্তরটা আব্বার ছিল খুবই মজার— ‘কেন এখানে চোংগা প্যান্ট বানাতে পারে না?’
মান্নাফ চাচা ছিলেন চেইন স্মোকার। মাঝে মধ্যে আম্মাকে বলতে শুনেছি— মানুষটা এত ধুঁয়া খায় কেন, অসহ্য লাগে’। আব্বা হেসে বলতেন— ওটা ওর নেশা, আমার যেমন পান খাওয়া।’
‘খুব খারাপ নেশা’। বিরক্ত হয়ে আম্মা অন্যদিকে সরে যেতেন। তো এই খারাপ নেশাটা কেমন দেখার জন্য কি শখ কারো হয় না? হয়, আমার তো হয়েছিল। ফোর কিংবা ফাইভে পড়ার সময় ঘটেছিল। বলেছি তো সে বিড়ি ফুঁকার গল্প আপনাদের।
এর আগে ‘ধুঁয়া’র স্বাদ দিয়েছিলেন মান্নাফ চাচা। প্রায় সিগারেট নিয়ে আমার মুখের কাছে ধরে বলতেন-
‘রবি, খাবে নাকি? দেখ না একবার।’
না বুঝে না শুনে দিয়েছিলাম একদিন একটান। তারপর কাশি, আম্মার বকুনি, আব্বার হাসি, বোনদের বকাঝকা। বেচারা চাচা ভীষণ বিব্রত হয়েছিলেন সেদিন।
বিড়ি খাওয়ার ওই ঘটনার পর কলেজে না যাওয়া পর্যন্ত আর ধুঁয়ো-মুখো হইনি। তবে কলেজিয়েট স্কুলের অনেক সহপাঠিই হাতছানি দিত খেলার মাঠের অন্য পারে ফাঁকা লাল ঘরটায় যাবার জন্যে। ওখানে টিফিন পিরিয়ডে বেশ ধুঁয়ো-আড্ডা জমতো।
চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হয়ে প্রথমদিন প্রথম ক্লাসটাই ছিল ইংরেজির, এ.বি দুই সেকশন মিলে ক্লাস, কেমিস্ট্রির গ্যালারিতে। ক্লাস নিয়েছিলেন ভাইস প্রিন্সিপাল এরশাদ উল্লাহ স্যার। অত্যন্ত সহজ সরল রসিক ভদ্রলোক ছিলেন স্যার। ক্লাসে ঢুকে তাঁর প্রথম সম্বোধনই ছিল-‘লেডিস এ্যান্ড জেন্টেলমেন, গুড মর্নিং এ্যান্ড ওয়েলকাম টু চিটাগাং গভর্নমেন্ট কলেজ।’ এরপর তিনি একসময় বলেছিলেন ‘আজ থেকে তোমরা আর কিশোর কিশোরী নও। যুবক-যুবতী। হোপ ইউ উইল বিহেভ লাইক ইয়াংমেন এ্যান্ড উইমেন।
সত্যি সত্যিই যে নিজেকে যুবক মনে হলো। বন্ধুদের সাথে অফ পিরিয়ডে গিয়ে এক আনা দিয়ে একটা ক্যাপেস্টন সিগারেট নিয়ে দড়ি থেকে আগুন ধরিয়ে বসে গেলাম ফুঁকতে। কিন্তু না না, নেশা হয়নি। আমার সহপাঠি বন্ধু বুলু আমাকে নিষেধ করেছিল এ নেশায় মাততে এবং আমিও যেন কেমন করে তার কথা রেখেছিলাম। আর টাকা পয়সারও তো একটা ব্যাপার ছিল।
সত্যিকার অর্থে নেশা ধরলো বুয়েটে ঢুকে। তখন অবশ্যি বুয়েট ছিল না। ছিল EPUET (এপুয়েট)। ওখানে ভর্তি হওয়া মানে প্রথম দিনই ছাত্ররা নিজেদের মনে করতো চিফ ইঞ্জিনিয়ার। পড়ার চাপ যখন বুঝতে শুরু করতো, দ্বিতীয় বর্ষে এসে হয়ে যেত সুপারিন্টেন্ডেন্ট ইঞ্জিনিয়ার, তৃতীয় বর্ষে এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার, চতুর্থ বর্ষে হতো এ্যাসিট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার। পাশ করে বের হতো এ্যাপ্রেন্টিস ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে। তখনকার সময়ে অবশ্য পাশ করামাত্র ঘটকদের খপ্পরে পড়ে অনেকের কপাল খুলে যেত।
আমিও ফাস্ট ইয়ারে চিফ ইঞ্জিনিয়ার হয়ে হলে পানবিড়ির দোকানে বাকি-খাতা খুলে ফেললাম। দিনে চারবেলা চারটে ক্যাপস্টান সিগারেটের দাম খাতায় উঠতে লাগলো নিয়মিত। পাশ করে বেরুলাম পাক্কা সিগারেট খোর হিসেবে। নেশাটা আরও বাড়লো কাজের ক্ষেত্রে গিয়ে। অনেক সময় রাতভর সাইটে কাজ করতে হতো। তখন চা-সিগারেটই ছিল সাথী। সিগারেট নিধনের সংখ্যা দিনকে দিন বাড়তে লাগলো। ব্র্যান্ড চেঞ্জ হয়ে ততদিনে বিদেশি ফিল্টারে চলে গেছি। সর্বদা নাটক, সিনেমা, চলচ্চিত্র, টিভি, রেডিও আবার অফিস। দম ফেলার সময় নেই। প্রচুর কাজ, প্রচুর টেনশন। আর প্রচুর ধূমপান। একদিন চলে গেলাম লিবিয়ায়। সেখানে মন খারাপের ইতিহাস তৈরি হলো। দেশ, নাটক, সিনেমা টিভি মঞ্চ আমাকে পাগলের মতা হাতছানি দিত। সময় কাটতো না, সুতরাং সিগারেট খাও, ধুঁয়া ওড়াও, ভাবনাচিন্তা কমে যাবে। দামও কম।
তিন বছর পর দেশে ফিরে আবার আমার অভিনয় নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। সরকারি চাকরি ছেড়ে নিলাম বেসরকারি চাকরি। সচ্ছল জীবন যাপন করতে চাই। ধূমপান আগের মতই চলছিল। কিন্তু তখন দেশে ধূমপান বিরোধী আন্দোলন শুরু হয়ে গেছে। ভেবেছিলাম, “না, এবার ছাড়তে হয়।’ কিন্তু কিছুতেই পারছিলাম না। একদিন নাতাশা স্কুল থেকে ফিরে আমার হাত থেকে জলন্ত সিগারেট কেড়ে নিয়ে দুমড়ে মুচড়ে ফেলে দিয়ে বললো— ‘তুমি সিগারেট খাবে না। আপা বলেছে, তুমি সিগারেট খেলে তার ধুঁয়া আমাদের খেতে হয়। তাতে আমরা মরেও যেতে পারি। তুমি কি তাই চাও?’
এরপর আর কীভাবে ধূমপান করি? কিন্তু ছাড়তে পারছিলাম না কিছুতেই। শেষে এমন হলো রাতে ছাড়লে দিনে ধরি, দিনে ছাড়লে রাত্রে ধরি। এমন সময় একটি বিদেশি ম্যাগাজিনে এক মনোবিজ্ঞানীর লেখা পড়লাম, সম্ভবত টাইম ম্যাগাজিনে, তিনি লিখেছেন-‘ধূমপান ছাড়ার সহজতম উপায়’ নিয়ে।
তিনি বলছেন-আমি জানি পৃথিবীতে বহু ধূমপায়ী আছেন যাঁরা ধূমপান ত্যাগ করার জন্যে অস্থির হয়ে আছেন। কিন্তু পারছেন না। আসলে ধূমপান ত্যাগ করা খুবই সহজ, নইলে আপনি কী করে দিনে ১০-১২ বার ধূমপান ত্যাগ করেন। তবে এভাবে চলবে না, প্রকৃতই যদি আপনি ধূমপানের অভিশাপ থেকে মুক্ত হতে চান তার সহজতম উপায় আমি বাতলে দিচ্ছি-Just Don’t smoke.
সত্যিই এতে আমার কাজ হলো। ক’দিন পর ছিল বিবাহ বার্ষিকী, ৪ঠা ফেব্রুয়ারি। তিন তারিখ রাতে সিগারেটের ভরা প্যাকেট এবং Ronson লাইটার শিরীর হাতে দিয়ে বললাম-এই হলো তোমার বিবাহ-বার্ষিকীর উপহার। আজ থেকে তোমার স্বামী ধূমপানমুক্ত ব্যক্তি। সেটা ছিল ১৯৯২ সন। সেই শেষ। আর ধরিনি ও বস্তু।
আর হ্যাঁ, কিছুদিন বাদে ‘আমি ধূমপান করি না’ (আধুনিক) এর একটি স্মরণিকা উপহারও পেলাম।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন