২৬. আমি কি লেখক?

ওপরের প্রশ্নের উত্তর জানা নেই আমার, সত্যি বলতে কি জানা নেই অনেক প্রশ্নেরই।

সম্ভবত দুহাজার আঠারোতে আমি গিয়েছিলাম সাতক্ষীরা, তৌকিরের চলচ্চিত্র ফাগুন হাওয়ায় অভিনয় করতে। সঙ্গে ছিলেন আমার সহধর্মিনী শিরী। শুটিং শেষে ঢাকা ফিরবার প্রাক্কালে যশোর বিমানবন্দরে এলাম বিমান ধরতে।

তখনও বেশ দেরী বিমান ওড়ার। ঢাকা থেকে আসবে তারপর ছাড়বে আমার বিমান। আমাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে এয়ারপোর্টে কর্মরত ব্যক্তিগণ আমাকে বেশ আদর আপ্যায়নে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ভিআইপি অপেক্ষাগারে নিয়ে বসালেন। বলাবাহুল্য ছবিটবিও তোলা হলো গল্পগুজবও হলো বেশ। বেশ ভাল লাগছিল জনগণের এই রকম ভালোবাসায়। কিছুক্ষণ পরই ওঁদেরই একজন বেশ ছুটেই এলেন ভেতরে-

স্যার ভিআইপি এসেছেন ফ্যামিলি নিয়ে মানে-

মানেটা আর তাঁর বলার দরকার হয় না। আকলমান্দকে লিয়ে ইশারাহি কাফি হ্যায়।

ঠিক আছে আমরা বাইরে বসছি-

জি স্যার, জি স্যার!

আমরা দেরী না করে বসলাম গিয়ে আমজনতার মাঝে। মনটা একটা ইয়ে হলো কারণ আমরা এখানেই বসেছিলাম আর ওনারাই ধরে বেঁধে নিয়ে গেলেন ওখানে।

বুঝলাম রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের কাছে আমাদের মূল্য কতটা— তিনিও ফ্যামিলি নিয়ে এলেন-সঙ্গে সাঙ্গোপাঙ্গো।

শুধু একটি প্রশ্নই মনে আজো জেগে আছে একুশে পদকপ্রাপ্ত ব্যক্তিগুলো কি ভিআইপি? এরকম একটি প্রশ্ন হয়তো অপ্রাসঙ্গিক, তবুও বলি আমি কি লেখক? আমি কিছু লেখালেখি করি— ছোটগল্প, স্মৃতিকথা, দৈনিক পত্রিকার কলাম, উপন্যাস, চুটকি আর নাটক (মঞ্চ ও টেলিভিশন) আর অন্যের গল্পের চিত্রনাট্যও রচিত হয় এই আনাড়ি হাতে। তাই বলে কি আমি লেখক?

আমি কখনো দাবি করি না, করার মত আৰ্ম্মকও নই।

অনেক অনুষ্ঠানে পরিচয় করানো হয় অমূক তমুক ইত্যাদি এবং লেখক আবুল হায়াত। বিব্রত চরম তখন আমি। লজ্জায় নত হয় মাথা।

কীসের কী লেখা! লিখতে মন চায় তাই লিখি। তাও নিজের ইচ্ছায়! বিভিন্ন জনের উৎসাহ এবং জোরারিতে আমি লেখক!

বিপাশাই একদিন আমাকে আশ্বস্ত করলো-

বিব্রত হওয়ার কিছু নেই আব্বু। তুমি লেখ তাই লেখক, ব্যাস। আমি তাই মেনে নিলাম।

আমি লেখক। এই যে লিখছি। জীবনের কথা। কেউ যদি এর ভেতর সাহিত্য খুঁজতে যান তো ঠকবেন। এ হচ্ছে মনের কথা।

এবার বলি শুরুটা কীভাবে।

বলেছিলাম না ১৯৬৪ তে আমি বুয়েটের শেরে বাংলা হলের নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক। বছর শেষে অনেক দায়িত্বের মধ্যে একটি দায়িত্ব ছিল একটি সুন্দর বার্ষিকী ছাপানো। দিন যত ঘনিয়ে আসছিল প্রকাশনার-আমার বার্ষিকী সম্পাদক ততই অস্থির হচ্ছিল কারণ লেখা পাওয়া যায় না। কেউ লিখতে চায় না। স্থপতি কবি রবিউল কবিতা দিয়েছে-কিন্তু গল্প নেই। চাপে পড়ে নিজেই লিখে ফেললাম একটি গল্প। প্রেমের গল্প। সেই বার্ষিকীর কপিও নেই, গল্পের নামও মনে নেই আমার। ৭১-এর যুদ্ধকালে সবই পুড়ে ছাই। এরপরও আমার বার্ষিকী সম্পাদকের মন ভরে না।

দোস্ত আর একটা গল্প দাও।

অসম্ভব, আমি সাধারণ সম্পাদক, সবাই গালাগালি করবে তো।

বেনামে ছাপবো।

অপারগ হয়ে দিলাম। এবার গল্প নয় শিকার কাহিনি। আমি ছোটকালে আব্বার সাথে সিলেটে হাওরে গেছি হাঁস শিকারে— সেই গল্প।

তাই ছাপা হলো, আমার দুটো লেখাই হিট!

এই লেখালেখির যাত্রা শুরু। কিন্তু লেখার কোনা কপি আর পাইনি। ৭১-এর যুদ্ধের সময় শেরেবাংলা হলের সমস্ত দলিল পত্রের সাথে ম্যাগাজিনগুলোও হারিয়ে গেছে।

স্বাধীনতার পর যখন বিটিভিতে মোটামুটি ভাল একটা স্থান দখল করতে পারলাম, তখন হঠাৎ মনে হলো টিভি নাটক লিখলে কেমন হয়। এটা ভাবার কারণও ছিল-সে সময় বেশ কিছু নিম্নমানের স্ক্রিপ্ট-এ অভিনয় করতে হয় আমাদের। পান্ডুলিপির আকাল চলছিল বলা যায়। লিখলাম দুচারটি নাটক। প্রচারও হলো। অপ্রশংসা হয়নি। তবে নিজ নামে লিখিনি -লিখেছিলাম শিরির নামে।

একসময় লিবিয়ায় চলে গেলাম। সেখানে নানান অনুষ্ঠানের প্রয়োজনে লিখলাম ছোটখাটো নাটিকা। সেই থেকে লেখার মধ্যে এক ধরনের আনন্দ পেতে শুরু করি।

দেশে ফিরে প্রথমেই তারকালোক সিনে পত্রিকার সম্পাদক আরেফীন বাদল-এর উৎসাহে ছোট গল্প লিখলাম। তার পরেই লিখে ফেললাম দীর্ঘ ধারাবাহিক কলাম ‘জীবন খাতার ফুটনোট’। এক সময় আনন্দ বিচিত্রার অরুন চৌধুরী ধরে বসলো ‘উপন্যাস লেখেন হায়াত ভাই’। চাপে পড়ে লিখে ফেললাম। এক সময় বই আকারেও বেরুলো তৃষ্ণার শান্তি। এরপর এলো একটি শক্ত দায়িত্ব। দায়িত্বটা দিলেন দৈনিক প্রথম আলোর মতিউর রহমান। তাঁর সাথে আমার পরিচয় সেই ষাটের দশকের শেষে যখন দেশে পাকিস্তান বিরোধী সাংস্কৃতিক আন্দোলন শুরু হয় তখন থেকে। মতি ছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের সংস্কৃতি সংসদের অন্যতম কর্ণধার। সেই থেকেই অনেক ঘনিষ্ঠ আমরা।

মতি বলেন— হায়াত ভাই আমার পত্রিকায় কলাম লেখেন।

আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম-কলাম লিখব আমি? তাও প্রথম আলোর মতো বিখ্যাত একটি দৈনিকের পাতায়।

প্রথমেই না করলাম, কিন্তু মতি নাছোড়বান্দা। রাজি করিয়েই ছাড়লেন।

লিখলাম ‘এসো নীপ বনে’ পাক্ষিক ভিত্তিতে। প্রায় দশ বারো বছর লিখেছি। জানি না কেন জনপ্রিয়তাও পেয়েছি প্রচুর। তারই ফলস্বরূপ চারখণ্ড বইও প্রকাশিত হলো। এভাবেই লেখালেখিতে জড়িয়ে পড়লাম। ছোটগল্প কিছু লেখা হয়েছিল ইতিমধ্যে। তারও সংকলন ছাপানো হলো। কিছু টিভি নাটক লিখেছি প্যাকেজ নাটকের সময়, যা জনপ্ৰিয়তা পেয়েছে। সেগুলোও গল্পে রূপ দিলাম। সিরিয়াল নাটককে উপন্যাস করে ফেললাম। সবই বই আকারে প্রকাশিত হলো।

এ ছাড়াও নয়া দিগন্ত প্রতি বছরই একটি উপন্যাস চাইতো আমার কাছে। লিখে ফেলতাম। এবং সেগুলোও বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে প্রতি বছর বইমেলায়!

ক্রমাগত ভাবে বই প্রকাশনার দিকে উৎসাহিত হলাম। আমার লেখা টিভি নাটকের সংকলন বের হলো, বের হলো মঞ্চ নাটকের বই। মাঝখানে হঠাৎ খেয়াল হলো-আমার নানান রকমের চুটকির সঞ্চয় রয়েছে মনে-সেগুলোর বই করলে কেমন হয়। ছাপিয়ে ফেল্লাম দুই খণ্ড নীপবনের জোকস।

এ ধরনের লেখালেখির মজা আর ছাপার আনন্দে একসময় দেখি আমার নামের ছত্রিশটা বই বাজারে প্রকাশিত। অবাক লাগে— লিখি তো ঘোড়ার ডিম আলতুফালতু সব— এর তো কোনো সাহিত্যমূল্য নেই, নিশ্চিতভাবেই বলা যায়— তারপরও এতগুলো বই, আমার লেখা।

অনেকে আমার পরিচয় দেন লেখক বলে। আমি তাঁদের কাছে করজোড়ে ক্ষমা চাই। ওটি বলবেন না। আমি মোটেও ওই সব সাম্মানিত কাতারের লেখক নই।

আমি হলাম, গাইতে গাইতে গায়েনের মত লিখতে লিখতে লেখক!

সকল অধ্যায়

১. ১. দিনগুলি মোর সোনার খাচায় রইল না
২. ২. তেলের শিশি ভাঙলো বলে খুকুর পরে রাগ করো
৩. ৩. জীবন যখন শুকায়ে যায়
৪. ৪. মোরা ভোরের বেলা ফুল তুলেছি
৫. ৫. আসা-যাওয়ার পথ চলেছে
৬. ৬. শৈশব হারিয়ে গেছে সময়ের স্রোতে
৭. ৭. নদী বহে যায় নূতন নূতন বাঁকে
৮. ৮. আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো
৯. ৯. রেলগাড়ি ঝমাঝম, পা পিছলে আলুর দম
১০. ১০. পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে হারে
১১. ১১. দিগবলয়ে নব শশী লেখা
১২. ১২. ছেলে আমার মস্ত মানুষ মস্ত অফিসার
১৩. ১৩. নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়
১৪. ১৪. দূর কোন পরবাসে তুমি চলে যাইবারে
১৫. ১৫. এলেম নতুন দেশে
১৬. ১৬. নীড়ে ফেরা পাখি
১৭. ১৭. মিলিটারি ॥ আপকা নাম কিয়া?
১৮. ১৮. চল চল চল ভাই আজি শুভদিনে পিতার ভবনে
১৯. ১৯. মাগো মা ওগো মা আমারে বানাইলা তুমি দিওয়ানা
২০. ২০. আছে দুঃখ আছে মৃত্যু বিরহ দহন লাগে
২১. ২১. একজন অভিনেতা হবে ভাল এবং সৎ মানুষ
২২. ২২. মার্কনীর বেতার তরঙ্গে আমি
২৩. ২৩. আমি সিনেমা নির্মাণ করি গল্প বলার জন্য-সত্যজিৎ রায়
২৪. ২৪. বোকার বাক্স
২৫. ২৫. বিজ্ঞাপন একটি সৃজনশীল শিল্পকলা
২৬. ২৬. আমি কি লেখক?
২৭. ২৭. পুরস্কার
২৮. ২৮. মাঠে প্রান্তরে
২৯. ২৯. আমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ
৩০. ৩০. ছানাপোনার কাহিনি
৩১. ৩১. সারমেয় সমাচার
৩২. ৩২. পায়ের তলায় সর্ষে
৩৩. ৩৩. কোন আলো লাগলো চোখে
৩৪. ৩৪. সুন্দরের কোন মন্ত্রে মেঘে মায়া ঢালে
৩৫. ৩৫. তামাম শোধ

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন