ফিরে এলাম দেশে।
তিনটি বছর পরবাসে কাটিয়ে সপরিবারে ফিরে এলাম নিজ দেশের বুকে। সেটা ছিল ১৯৮১’র ডিসেম্বর। প্রাণটা জুড়িয়ে গেল দেশের মাটির সংস্পর্শে, আলো বাতাসে। কী করে যে মানুষ বছরের পর বছর ধরে বিদেশের মাটিতে পড়ে থাকে!
এলাম তো ফিরে। বাসা তো ঠিক হয়নি। শান্তিবাগে ছোট বোন মমতাজের বাসায় আশ্রয় নিয়ে বাসা খোঁজার কাজে ব্যস্ত হলাম। কিন্তু প্রথম সুযোগেই গিয়ে হাজির হলাম বাংলাদেশ টেলিভিশনের রামপুরা স্টুডিওতে।
রেডিও টেলিভিশন আর মঞ্চ-এই ত্রিশক্তির টানেই তো ডলারের মায়া কাটিয়ে পালিয়ে ফিরলাম নিজ দেশে। অনেকেই বোকামী বলেছেন-কিন্তু আমার মনের উপর তো কথা নেই। উপরন্তু শিরী যখন আমার সাথে একমত হয়েছে-ব্যাস। চলো, বোঁচকা বাঁধ। প্রথমদিনেই সাক্ষাৎ হলো বন্ধুবর প্রয়োজক মুস্তাফিজুর রহমানের সঙ্গে। মহড়া হচ্ছিল কোনো এক নাটকের। আমায় দেখে সবাই হৈ হৈ করে উঠলেন-মুস্তাফিজ তো প্রস্তাবই দিয়ে ফেললেন ওই নাটকে অভিনয়ের। শুধু আমাকে নেয়ার জন্যই বলা-চরিত্রের গুরুত্ব ছিল না—মুস্তাফিজ নিজেই বললেন-থাক, এটা আপনার করার প্রয়োজন নেই। ওই সপ্তাহেই আবদুল্লাহ আল মামুন ডাকলেন একটি চমৎকার চরিত্রে অভিনয়ের জন্য। ওই আমার রঙীন ক্যামেরায় প্রথম নাটক। সম্পূর্ণ নাটকটিই হয়েছিল রাজেন্দ্রপুর রেল স্টেশনে, আউটডোর নাটক, রোমান্টিক নায়ক নায়িকা ছিল আফজাল আর চম্পা। সম্ভবত চম্পার প্রথম টিভি নাটক।
পরের সপ্তাহে করলাম মোস্তফা কামাল সৈয়দের একটা নাটক। অভিনেতা চারজন। আব্দুল্লাহ আল মামুন, সৈয়দ আহসান আলী সিডনি, রামেন্দু মজুমদার এবং আমি। রচনায় ছিলেন অধ্যাপক মমতাজ উদ্দিন আহমেদ। মোটমুটি বলা যায় মাস খানেকের মধ্যেই আমি আবার আমার টেলিভিশন জগতে পুরোনো আসন ফিরে পেতে শুরু করলাম। মানসিক যে ডিপ্রেশন ছিল—লিবিয়ার সেই মরুপ্রান্তরে সেটা থেকে মুক্তি পেতে সময় বেশি লাগলো না। মঞ্চের সহকর্মীদের সাথে সাক্ষাতে প্রাণ বেশ মেতে উঠলো আনন্দে।
মগবাজারে বন্ধুবর আমীরুল হক চৌধুরীর একটা কফিশপ ছিল-মোদ্দাকথায় শিল্পী সাহিত্য জগতের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের আড্ডার আখড়া হিসেবে পরিচিত। সেখানে গেলাম একদিন সকালে। রোববার ছিল বোধকরি সেদিন। প্রথমেই পেলাম আমীরুল আর প্রিয় মানুষ গোলাম মুস্তাফাকে।
আসুন আসুন জীবন বাবু। স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের জন্য অভিনন্দন।
তাঁর স্বাগতম বার্তাটি এমনই ছিল। সেই তিতাস একটি নদীর নাম সিনেমার শুটিংকাল থেকে তিনি আমায় মাঝে মাঝে জীবন বাবু বলে ডাকতেন।
একথা সেকথায় নাগরিকের কথা উঠলো।
দেখা হয়েছে বন্ধু বান্ধবদের সঙ্গে? মুস্তফা জিজ্ঞেস করেছিলেন ‘না জানিনা কে কোথায়।’
‘চলেন আমার সঙ্গে।’
‘কোথায়?’
‘আসেন না।’
সোজা নিয়ে গেলেন মেটিয়াবুরুজ হাউজে, ইস্কাটনেই।
আলী যাকেরের বাসায়। আমি যখন লিবিয়ায় যাই তখন সে থাকতো ধানমন্ডি পাঁচ নম্বর সড়কে।
আমাকে দেখে একটা হৈচৈ পড়ে গেল। সেখানে সম্ভবত মিটিং চলছিল। আতাউরও ছিলেন-তিনি একই ভবনের অন্য তলায় থাকতেন।
দোস্ত তোকে অচলায়তন করতে হবে।
যাকেরের আহ্বান।
কেন সালেক খানের কী হলো?
হয়েছে কিছু সমস্যা। তুই করবি দাদাঠাকুর। পারবি না।
পারবো না কেন। তবে Understudy চরিত্র তো ভয় হয়। ওই রকম না হলে দর্শক গ্রহণ করতে পারে না।
হাসলো যাকের। পিঠে একটা চড় দিয়ে।
এসেই পড়েছিস যখন দেওয়ান গাজীও করবি।
মাখন কে করছে? নূর?
না, দুলু চলে যাওয়ার পর নূর করতো। আমি লিবিয়া যাওয়ায় মাখন চরিত্র করতো দুলু।
দুলু ছিল স্থপতি। সে আমেরিকায় চলে যাওয়ায় নূর শুরু করেছিল।
এখন অবশ্য যুবরাজ করছে। খুব ভালো করে। গান গায় সুন্দর।
আমি যখন লিবিয়া যাই তখন বোধকরি যুবরাজ সবে নতুন এসেছিল নাগরিকে।
যাই হোক ওইদিনের পর আরও চাঙ্গা হয়ে উঠলাম-নাগরিকের পুরো কার্যক্রমের সাথে অতিসত্ত্বর যুক্ত হতে পারবো সেই আনন্দে।
.
এর মধ্যেই ঢাকা ওয়াসায় গিয়ে হাজির হলাম। জয়েনিং রিপোর্ট দেয়ার জন্যে। সেখানেও বেশ ভালোই অভ্যর্থনা পাওয়া গেল-কিন্তু সামান্য কিছু ব্যক্তি মনে হলো ভাল মনে গ্রহণ করলেন না আমায়। কারণ বুঝলাম পরে-আমি আসাতে তাদের সিনিয়রিটির ঝামেলা হতে পারে সেই আশঙ্কায়।
আমার লিয়েন ছিল এক বছরের-আমি এসেছি তিন বছর পর এই আমার অপরাধ। এই ফাঁকে অনেকে সিনিয়রিটি লিষ্টে তাদের নাম উপরে উঠিয়ে ফেলেছে।
চেয়ারম্যান তখন আমারই প্রাক্তন চিফ ইঞ্জিনিয়ার,-তিনি আমার-Joining Report টা ঝুলিয়ে রাখলেন-কিছু মানুষের চাপে। আমার অবশ্য তখন সরকারি চাকরি করার ইচ্ছা ছিল না মোটেই। মাস খানেক অপেক্ষা করে দিলাম ইস্তফা-পত্র। সেটা ও ঝুলতে থাকলো। Joining লেটার গ্রহণ না করে তো ইস্তফাপত্র গ্রহণ করা যাবে না। এই দোলাচলের মধ্যে আমি একটি বেসরকারি কোম্পানিতে যোগ দিয়ে ফেললাম। Associated Engineers & Drillers কোম্পানির সত্ত্বাধিকারী আকবর হোসেন আমার পূর্বপরিচিত। ঢাকায় আমার সাথে পরিচয়। তিনি আসলে ছিলেন আমার অভিনয়ের ভক্ত। ইতোমধ্যে ঘটনাক্রমে ঢাকা ওয়াসার চেয়ারম্যান বদল হলো। অবসর প্রাপ্ত বিগেডিয়ার ফিরোজ সালাউদ্দিন চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পেলেন। কদিন পর আমাকে তলব। শুনলাম তিনি নাকি আমার এক চাচা শ্বশুরের বন্ধু।
রিজাইন দিলে কেন? সোজাসুজি তুমি দিয়ে শুরু।
সরকারি চাকরি আর করবো না।
কেন? জয়েনিং রিপোর্ট এ্যাক্সেপ্ট করেনি বলে রাগ হয়েছে?
ভীষণ দিলখোলা মানুষ ছিলেন ভদ্রলোক। পুরান ঢাকার বনেদি ঘরের মানুষ।
আমি উত্তর দিই নি।
আমি অর্ডার দিচ্ছি তুমি জয়েন করো আজই। সিনিয়রিটিও যথাযথ পাবে।
বুঝলাম সমস্ত খবরা খবর নিয়েছেন তিনি। একে জামাই, তার উপর জনপ্রিয় নাট্যশিল্পী-বেশ খাতির পাচ্ছিলাম তাঁর কাছে।
না স্যার আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি।
I admire your decision তারপরেও বলছি, দুদিন সময় নাও। I will wait for your telephone call.
Thank you Sir.
.
সিদ্ধান্ত আর পাল্টাইনি আমি। সসম্মানে বিদায় হলাম ঢাকা ওয়াসা থেকে। সঙ্গে পেলাম গ্রাচুইটির টাকা প্রায় পঞ্চাশ হাজার।
এবার আকবর সাহেবের কোম্পানিতে পাকাপাকিভাবে যোগ দিলাম-অর্থাৎ কাগজে কলমে চিফ ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে। গাড়ি দেয়ার কথা হলো, তখন বললাম-ভাই আমার গাড়ি লাগবে না, আমাকে লোন দেন। আপনি অর্দ্ধেক দেন, আমি আপনার টাকাটা মাসে মাসে শোধ করে দেব। তাই সই। ৯০,০০০ হাজার টাকায় কিনলাম সাদা রঙের টয়োটা পাবলিকা। দুবছরেই ধার শোধ করে হলাম দেশে নিজের গাড়ির মালিক। কমকিছু তো নয়।
এর মধ্যে ১৯৮২ মার্চের ২০ তারিখে অবশ্য জেনারেল এরশাদ সামরিক শাসন ঘোষণা দিয়ে ক্ষমতা দখল করে বসেছেন। আমার মনে হয় সেই সূত্রেই ব্রিগেডিয়ার ফিরোজ সালাউদ্দিন ঢাকা ওয়াসার চেয়ারম্যান হয়েছিলেন। সে যেটাই হোক দেশে তখন এক ধরনের নিয়ম মেনে চলার হিড়িক চলছিল। অনেক প্রকার জ্ঞান দিচ্ছিলেন জণগনকে- এরশাদ সাহেব, নিয়মিত। সাধারণ মানুষের একসময় গা সওয়া হয়ে গেল এসব। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুইমিং পুলের কাজ দেখাশোনা করার দায়িত্ব নিলাম। আর কোম্পানির অন্যান্য কাজও আমাকে মাঝে মাঝে দেখতে হতো-মানে আমার চেহারাটা যখন প্রয়োজন হতো দেখানোর জন্য তখন এমডি সাহেবের সঙ্গ দিতে হতো আমাকে। আমি সেসময় আবার সেই ৭৭-৭৮ সালের মতো ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। আবার একটু ফিরে যাই অভিনয় জগতে। সেই জগতটার টানেই তো পাখি ফিরে এল নীড়ে। ফিরে আসবার পর খুব অল্প সময়েই আমি ব্যস্ত হয়ে পড়েছি মিডিয়ায়, বলেছি সে কথা।
মেয়েরা স্কুলে ভর্তি হয়ে গেল। আমি আবার আমার অভিনয় জগতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠে একটা Site অফিস ছিল-ওখানেও বসতাম প্রতিদিন কিছুক্ষণের জন্য। তখন এরশাদের আমল। চাঁদার জন্য বন্দুক নিয়ে কয়েকবার ছাত্ররা এসেছিল আমার কাছে। চেহারার কারণে রেহাই পেয়েছি— সে একরকম থ্রিলিং অভিজ্ঞতা। যেমন, কাজ করছি, হঠাৎ একজন চাদর গায়ে দিয়ে এসে আমার সামনে বসলো, তার আগে পিস্তল বের করে টেবিলে রাখলো।
স্লামালেকুম আঙ্কেল,
সালামের উত্তরটা হাসিমুখেই দিলাম।
অনেকদিন তো হলো, ছেলেরা একটু চাইনিজ খেতে চায়!
ঠিক আছে অফিসে বলবো।
কালকের মধ্যেই কিন্তু।
হুঁশিয়ারী দিয়ে চলে যায়।
তারপর চার পাঁচদিন আমি আর ওমুখো হই না,
কাঁচপুরে কোম্পানির একটা Jute mill ছিল (Abdul Malek Jute Mill)। সেখানে ও মাঝে মধ্যে যেতে হতো। কাজকর্ম দেখার জন্য (civil works)। বেশ ভালই চলছিল, হঠাৎ করে আমার এক ভাগ্নি জামাই স্থপতি শাহজাহান (তরু) যে আমার সাথে লিবিয়াতেও ছিল, প্রস্তাব দিল—
মামা কী চাকরি করবেন, চলেন ব্যবসা করি।
ব্যবসা করবো আমি, না বাবা, ও আমার দ্বারা হবে না।
ও রকম ব্যবসা না। প্রকৌশল পরামর্শক। সম্মানজনক ব্যবসা ভদ্রলোকের ব্যবসা।
তারপর একটু খুলে বললো-
মনসুর সাহেব নামের পাবনার এক ভদ্রলোকের উপদেষ্টা প্রকৌশলীর ফার্ম আছে ট্রপিকাল কনসালট্যান্টস লিঃ। তিনি এটা ছেড়ে দিতে চান। সবকিছুই বিদ্যমান আমরা ঢুকলেই শেয়ারের মালিক হয়ে যাবো।
বেশ অনেকদিন আমাকে বলে বলে রাজীই করিয়ে ফেললো। আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু খুব ভালো Structural প্রকৌশলী মো: আমিনুর রহমানকে রাজী করিয়ে তাকেও দলে ভিড়ালাম।
নতুন অফিস খুলে বসলাম মিরপুর রোড, ঢাকা কলেজের উল্টোদিকের গলিতে, শাহাজাহান হলো ব্যবস্থাপনা পরিচালক, মনসুর সাহেব থাকলেন চেয়ারম্যান। আমি আর আমিন হলাম পরিচালক। শাহাজাহান শিক্ষা অধিদপ্তরের একটা কাজও জুটিয়ে এনেছিল-সেটা নিয়েই কয়েকজন Drafting staff জোগাড় করে নবউদ্যমে শুরু হলো আমাদের উপদেষ্টা প্রকৌশলীর কাজ।
সময় যত যেতে লাগলো, বাস্তবতা প্রকট হতে শুরু হলো। কাজ তো বের করা যায় না, আমার চেহারা ব্যবহার করেও কোনো লাভ হয় না। আমাকে খুব খাতির করে চা নাস্তা খাওয়ায়— আর আসল বেলায়-পরের কাজটাই আপনাকে দেবো!
এদিকে পকেটের টাকায় টান পড়া শুরু হলো। জমানোতে হাত দিতে হচ্ছে— বিদেশ থেকে আসবার পর অনেকে ধার নিয়ে-৫/১০ হাজার করে শোধ দিয়ে আমাকে নাস্তানাবুদ করে ফেলেছে ততদিনে। টিভিতে অভিনয় করে তো দিন চলে না। সিনেমার অফার পেয়েও আর যাইনি ওপথে।
এদিকে শাহাজাহান আর আমিনুরের মাঝে পেশাগত দ্বন্দ্ব শুরু হয়ে গেছে। স্থপতি বড় না প্রকৌশলীদের কাজ গুরুত্বপূর্ণ এ নিয়ে ঠান্ডা লড়াই থেকে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়-প্ৰায় নিয়মিত হয়ে গেল। আমিনের স্ত্রী প্রকৌশলী ডোরা চাকুরিরত-তার আর্থিক সমস্যা নেই। শাহাজাহানেরও মোটামুটি ভাল অবস্থা। আমি পড়লাম কপিকলে। আমার হাতে কিন্তু চাকরী রয়েছে কয়েকটা। সবাই আমাকে চায়— জানি প্রকৌশলী সার্টিফিকেটের সাথে আমার চেহারাটার দাম তাদের কাছে অধিক।
শেষে ওদের ওই দ্বন্দ্বের কারণে কাজেরও ক্ষতি হতে লাগলো— একটা কাজ এলো রাজুকের পূর্বাচল হাউজিং-এর বেশ বড় কাজ। কাজ এগুচ্ছে কিন্তু বিল পাওয়া যায় না। যে সব ম্যান পাওয়ার ভাড়া করা হয়েছে তাদেরও বেতনের সমস্যা। আমার হাতে টানাটানি— ছেড়ে দিলাম কোম্পানির ব্যবসা।
শাহজাহানকে বললাম, আমার পক্ষে এ টানাটানি সম্ভব না। সোজা সরল জীবন আমার কাম্য। তোমরা ঝগড়াঝাটি করো, আমাকে মাফ করো।
বিদায় নিলাম ওদের কাছ থেকে। দুদিন পর আমিন ও চলে গেল। পরে শাহজাহান কাকে কাকে জোগাড় করে কোম্পানি চালিয়েছে।
আমার চাকরি ছাড়ার খবর পেয়ে Design Associates-এর কর্ণধার স্থপতি অনু আমাকে পাকড়াও করলো-
হায়াত ভাই আমার এখানে বসেন।
রাজী হয়ে গেলাম।
কিন্তু ভাই চাকরি করবো না।
দরকার নেই, আপনি আমার এখানে উপদেষ্টা হিসেবে থাকবেন।
বসলাম অনুর অফিসে। যখন যে কোনো প্রকল্পে আমার প্রয়োজন হতো, অনু বলতো আমি সহায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে দায়িত্ব পালন করে দিতাম।
মাস শেষে একটা খাম দিত। আমি খুশি ছিলাম। এ ছাড়াও মাঝে মধ্যে প্রয়োজনে বললেই সে খাম পাঠিয়ে দিত। এভাবে ভালই চলছিল, এ সময় বেশ কিছু নাটকে জড়িয়ে পড়ায় এবং বাংলাদেশ টেলিভিশনের সিনেমা হুমায়ুন আহমদের শঙ্খনীল কারাগারে অভিনয়ের সুবাদে আর্থিক টানাটানিটা ছিল না। সিনেমাটি পরিচালনা করেছিলেন মুস্তাফিজুর রহমান। শিরীও এই সময় বেশ ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল বাচ্চাদের নিয়ে-দুজনেই ভিকারুননিসা পড়ছে— তাদের প্রাইভেট টিচার-এর কাছে নেয়া, গানের স্কুল, নাচের স্কুল-আমার অফিসেরও তো নিয়মমাফিক ছিল না কাজকর্ম, –আমার মনে জাগালো চিন্তা, থিতু হওয়া দরকার। চলচ্চিত্রে অনেক ডাক পেলাম-কিন্তু কেন যেন মন টানছিল না ওটাকে পেশা হিসেবে নেয়ার।
এদিকে দুটো বড় প্রকৌশলী প্রতিষ্ঠান আমাকে টানছিল তাদের কোম্পানিতে যোগ দেয়ার জন্য। একটা ছিল জিয়াউল হক সাহেবের…. আর অন্যটি প্রকৌশলী রফিক সাহেবের DDC. জিয়াউল হক সাহেবেরটাতে ঢুকে পড়লাম। কারণ ওটা ছিল সরাসরি একটা ADB প্রজেক্ট। দুবছরের ম্যানমানথ্ সহ। সহযোগী কোম্পানি ছিল একটি ব্রিটিশ কোম্পানী। রাজউকের DAP প্রকল্প। বেশ আনন্দ নিয়েই কাজ শুরু হলো। ব্রিটিশরা দু’দিনেই বুঝে ফেললো আমাকে— তখনই শুরু হলো আমার কাজ। মানে গোটা ঢাকা প্রকল্প অঞ্চলের সব পৌরসভা, Union ইত্যাদি অফিসে অফিসে তাদের সাথে যেতে হবে— সহজে কাজ উদ্ধারের জন্য। যেতামও, আর কাজও হতো সময়ের আগে।
একটা মজার ঘটনা বলি— পৌরকাজের টিম লিডার Ben আমাকে একদিন রুমে ডেকে বললো— মি. হায়াত, আমরা তো ক্যান্টনমেন্ট যেতে পারবো না। নিয়ম নেই। বৃহত্তর ঢাকার বাসযোগ্য এলাকা নির্ধারণের জন্যে এলাকার মানচিত্র দরকার, তুমি তো জানো। হ্যাঁ জানি।
এখন ক্যান্টনমেন্ট তো আলাদা পৌরসভা, ওদের ম্যাপগুলোও লাগবে। তুমি একটু যেতে পারবে।
যেতে পারবো, কিন্তু ম্যাপ আনতে পারবো কিনা জানি না।
প্লিজ ট্রাই।
ওকে।
পরদিনই চলে গেলাম ক্যান্টনমেন্টে। ইঞ্জিনিয়ার ইন চীফ তখন মেজর জেনারেল আবদুল হালীম (ভুল হলে মাফ চাই)। সাদরে আমায় গ্রহণ করলেন তিনি। আপ্যায়নও হলো। এরপর যখন আমি আমার উদ্দেশ্যের কথা জানালাম-তখন উনি বেশ দিলখোলা একটা হাসি দিলেন-
হায়াত সাহেব। ওটাতো আমাদের রাষ্ট্রের গোপন তথ্য, এই ম্যাপ কাউকে দেয়া যাবে না।
I am sorry.
তারপর আরও কিছুক্ষণ রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তার ওপর কিছু কথাবার্তা হলো। অফিসে ফিরে এসে Team Leder কে আমার mission-এর ব্যর্থতার খবর দিলাম।
এর দুতিন দিন পর সক্কাল বেলায়, আমি অফিসে চেয়ারে তখনো বসার সময়টুকুই পাইনি। আমার Team Leader হন্তদন্ত হয়ে এলেন আমার কাছে।
মি. হায়াত, কাম, কাম উইথ মি।
প্রায় টেনে নিয়ে গেলেন তাঁর চেম্বারে।
Look.
কী এটা।
তোমাদের দেশের রাষ্ট্রীয় গোপন ম্যাপ।
টেবিলে বিছানো এক সেট master plan – দেখলাম, ঢাকা Cantonment corporation এলাকার মানচিত্র।
পেলেন কোথায়?
আসাদের N.York-এর অফিস থেকে পাঠিয়েছে, Sattelite-এর তোলা ছবি। বাকি আর কিছু বলতে পারবো না।
ভালই কেটেছে এখানে দুটি বছর। রাজউক ভবনের annex ভবনের সাত তলায় ছিল আমাদের অফিস। আরও দু’চার জন আমার ব্যাচের প্রকৌশলীরও imput ছিল সেখানে। অনেক Town planner দেশি, বিদেশি, সুন্দর একটা পরিবেশে কাজ করতাম। ভালই লাগছিল।
সমস্যা দেখা দিল প্রজেক্ট শেষ হবার কিছু দিন পর। তখন আমার কোনো প্রজেক্টে imput না থাকায়, মতিঝিলে প্রধান অফিসে বসতাম। সেখান থেকে পাঠানো হলো আর এক প্রজেক্টে— ওয়াসার প্রজেক্ট সেটা। সুয়ারেজ asbuilt drawing update করার কাজ। অফিস তখন কাওরান বাজারে।
ভালই লাগছিল, সেখানে ওয়াসার পুরোনো দু’চারজন সহকর্মীকেও পেলাম, কিন্তু একদিন সকাল বেলা এমডি জিয়াউল হক সাহেব উদয় হলেন প্রকল্প অফিসে, একান্তে ডেকে বসলেন আমার সাথে।
হায়াত সাহেব আপনার সাথে একটা জরুরি কথা আছে।
জী বলেন।
আপনার ম্যান মানথ্ শেষে হচ্ছে আগামী সপ্তায়, এখন নতুন কোনো প্রজেক্ট না আসা পর্যন্ত আপনি আমার অফিসে বসবেন।
সমস্যা নেই।
না মানে, যতদিন নতুন প্রজেক্ট না আসে বেতন ৫০% দেয়া হবে। আবার যখন input হবে তখন New project-এর scale-এ বেতন দেয়া হবে।
Thank you.
মানে।
কালকেই আমার ইস্তফাপত্র পাবেন।
কেন?
কারণ আমার appointment কোনো project wise ছিল না। আমি monthly salary তে এসেছি-আর সে জন্য আপনি Project-এর নির্ধারিত Salary-র চেয়ে কম বেতন দিয়েছেন
সব সময়।
আর কি কথা হলো, না হয় না বললাম।
পরদিন থেকে আমি বেকার। মানে চাকরিবিহীন প্রকৌশলী।
তার কিছু আগের কথা বলি। ইন্সটিউশন অব ইঞ্জিনিয়ার্সের সদস্য তো আমি বহু আগেই হয়েছিলাম। এমনকি লিবিয়া যাবার পূর্বে দু’টার্ম এক্সিকিউটিভ কমিটির সদস্যও নির্বাচিত হয়েছিলাম। দেশে ফেরার পর আর ওমুখো হইনি, এমনি যাওয়া হয়নি। এই সময়টা মনে নেই কার অনুপ্রেরণায় আবার নির্বাহি পরিষদের সদস্য হলাম। সাধারণ সম্পাদক বন্ধুবর এ কে আজাদ, প্রেসিডেন্ট ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী। তাঁরা আমাকে একটা বেশ বড় দায়িত্ব দিলেন। সাংস্কৃতিক দপ্তরের এবং বিশেষ করে মিলনায়তন ব্যবস্থাপনার। কাজটি আমার পছন্দের হয়েছিল বলে প্রচুর সময়ও দিতাম-পুরো মিলনায়তন পুনর্বাসনের কাজ করা হলো তখন, আর প্রায়ই কিছু সংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করতাম।
ও মনে পড়েছে এরও আগে IEB-র মহিলা পরিষদের অনুরোধে একটি মঞ্চনাটক নির্দেশনা দিয়েছিলাম মিনিস্টার। সেটা খুবই সাড়া ফেলেছিল বিধায় বন্ধুবর-এ. কে আজাদের অনুপ্রেরণায় আমি আবার নির্বাচন করে কেন্দ্রীয় পরিষদে ফিরেছিলাম।
এরপর হলো আমার একটু ইচ্ছা যে, আবার নির্বাচন করবো তবে ঢাকা কেন্দ্রের চেয়ারম্যান পদে, মোটামুটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্তই নিয়েছিলাম। এমন সময় আবার আজাদ এবং কয়েকজন সহপাঠির প্ররোচনায় কেন্দ্রীয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদক পদে দাঁড়ালে-সেবার ওই পদে প্রার্থী হয়ে গেলাম তিন জন। প্রকৌশলী ইব্রাহীম, প্রকৌশলী নুরুল হুদা, আর আমি। তারপর আর— কি বলবো। আমাকে নিয়ে বেশ নাচানাচি হলো ইন্সটিউটে, কিন্তু আমি একটু ভরসা করেছিলাম আমার চেহারার উপর— তেমন প্রচার করিনি— করবো কখন, সে সময় তো আমার ছিল না। আমি ব্যস্ত আমার প্রজেক্ট অফিসের উপদেষ্টার চাকরি, টিভি, রেডিও, মঞ্চ নাটক নিয়ে।
ফলাফল-হতে পরলাম না নির্বাচিত। সম্ভবত প্রকৌশলী-ইব্রাহীম সেবার সাধারণ সম্পাদক হয়েছিল— পরে শুনেছিলাম যারা আমাকে অনেক হাততালি দিয়ে দাঁড় করিয়েছিল, সবাই যখন বুঝেছে যে আমি তাদের মতবাদের (?) সাথে লাইনযুক্ত নই, তারা পিঠটান দিয়েছে। যাই হোক না কেন, আমি এরপর আর ওদিক সহজে মাড়াই নি, কারণ ততদিনে আমি অতিমাত্রায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছি— মঞ্চ এবং টিভিতে এবং শেষ অবধি চলচ্চিত্রকেও পেশা হিসেবে নিয়ে।
হ্যাঁ, জিয়াউল হক সাহেবের অফিসের দপ্তরে পরদিনই একটি ইস্তফাপত্র পাঠিয়ে ঘরে বসে রইলাম চুপচাপ। নাহ্, চাকরি আর করবো না।
তা হলে কী করবে?
শিরীর প্রশ্ন।
কদিন বিশ্রাম নিই, তারপর ভাববো।
ভাবো।
শিরী কোনোদিনই, আমার কোনো ব্যাপারে নেগেটিভ প্রতিক্রিয়া দেখায়নি বরং সব সময় কার্যকরি পরামর্শ দিয়ে জীবনটাকে সহজ ও সুন্দর করে তুলেছে।
কোনো এক অনুষ্ঠানে দেখা হলো হুমায়ুন ফরিদীর সাথে। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগতের জনপ্রিয়তার মধ্যগগনে জ্বলজ্বল করছে তখন ফরিদী। তার অভিনয় শৈলীতে মুগ্ধ দর্শক। খল চরিত্রকে সৃজনশীল চিন্তাভাবনায় একজন অভিনয় শিল্পী যে কোন্ মাত্রায় পৌঁছাতে পারে তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ ফরিদী।
আপনি সিনেমায় আসেন না কেন? ফরিদী কথায় কথায় বললো।
ইচ্ছা করে না, অনুরোধের সিনেমা করেছি, কিন্তু পেশা হিসেবে কেন জানি মন চায় না। আসেন, আপনার কিন্তু অনেক ডিমান্ড।
ভেবে দেখি।
এই শিল্পীকে আমি অত্যন্ত স্নেহ করতাম শুধু তার গুনের জন্য নয়, সিনিয়র শিল্পী (সে যেই হোক) তার প্রতি ভক্তি আর শ্রদ্ধার জন্য। তার অকাল মৃত্যু বিরাট একটা শূন্যতা সৃষ্টি করেছে সংস্কৃতির জগতে তা অনস্বীকার্য।
বাসায় ফিরে আবার শিরীকে নিয়ে আলোচনায় বসলাম।
এভাবে বসে থেকে কী হবে! তোমার চাহিদা আছে, তুমি অভিনয় পাগল মানুষ। সিনেমায় পেশাগত শিল্পী হলে অসুবিধা কোথায়?
রাতেই ফোন করলাম ফরিদীকে। সিদ্ধান্ত জানালাম-সিনেমায় নামব পেশাগত শিল্পী হয়ে। অভিনন্দন।
তুই ব্যবস্থা কর।
নিশ্চয়। আমি আমার পরিচিত জনদের জানিয়ে দেব। দেখবেন এক মাসের মধ্যেই কত অফার আসে।
ব্যাস আমি নিশ্চিত হয়ে বসে রইলাম ঘরে। নাটক করি খাইদাই ঘুমাই। স্বপ্ন দেখি আমি মহাব্যস্ত হয়ে গেছি চলচ্চিত্রে। গেল এক মাস -দুমাস ও গেল। কোনো খবর নেই। আবার একদিন দেখা ফরিদীর সাথে।
কীরে কোনো খবর হচ্ছে নাতো।
হবে হবে। আপনাকে তো আর যেনতেন চরিত্রে নেবে না। আপনার জন্য চরিত্র তৈরি হবে। তারপর ডাকবে। দেখবেন সাড়া দিয়ে কুল পাবেন না।
সুতরাং আবার অপেক্ষা। ওদিকে কিন্তু চাকরি ঝুলছে আসার জন্যে। Consulting field municipal -এ engineer খুব একটা ছিল না তখন। সুতরাং আমার Biodata টা জরুরি ছিল অনেক আন্তর্জাতিক প্রকল্পের জন্য।
তিন মাস পার হয়ে গেল। এবার তো জমানো টাকার থলে শেষ প্রান্তে। আমারও মানসিক জোর বেশ দুর্বল হয়ে যেতে শুরু করেছে।
নাহ! বাদ দাও সিনেমা। আগে জান বাঁচাও। DDC র কর্ণধার রফিক সাহেবের দপ্তরে গেলাম। কি হায়াত, জয়েন করবে আমার এখানে?
জি, সে জন্যই এলাম।
Good কালই জয়েন করো।
ব্যাস আবার গোলামীর ফাঁদে পা দিলাম, বাধ্য হয়েই।
এখানেই সৃষ্টিকর্তার খেলাটা বাকী ছিল। পরবর্তী এক সপ্তাহের মধ্যে হাফ ডজন সিনেমার অফার আমার বাসায়। প্রথমেই এল সোহানুর রহমান সোহান, তারপর শহীদুজ্জামান খোকন দুটো সিনেমা নিয়ে, বেনজীর বেনু ভাই এল তার ছবির জন্য। আরও কে কে মনে নেই এই মুহূর্তে।
কী করবো এখন। এক কথায় না করলাম না কাউকে। দু তিন দিন ঝুলিয়ে রেখে আলোচনার টেবিলে বসলাম শিরীর সাথে।
তুমি তো চাকরি করার বিরোধী, এ সুযোগ ছাড়া উচিৎ হবে না।
ব্যাস ঝুলে পড়লাম। তবে চাকরি রেখে। তাদের এটুকু সহযোগিতা আমি পেলাম যাতে ছুটির দিন (সপ্তাহে দুদিন) আর বিকেল শিফট (পাঁচটা থেকে দশটা/১১টা) এরপর তো medical leave, earn leave হেন ছুটি, তেন ছুটি সব কাজে লাগিয়ে, মোটামুটি চালানো শুরু করে দিলাম। ছবি আসতে লাগলো। আমি বুঝে শুনে নিজের সময় বুঝে কাজ করতে লাগলাম। পুরোপুরি চলচ্চিত্র শিল্পী হিসেবে পেশাজীবী হয়ে গেলাম (যদিও চাকরিজীবীও সমভাবে!
এদিকে অফিস থেকে জাইকার ঢাকা শহরের বন্যা নিয়ন্ত্রনের প্রকল্পে আমার পোস্টিং হলো। হেড অফিসের বাইরে, পৃথক অফিসে বসার ব্যবস্থা। নটা-পাঁচটা, ছুটি সপ্তাহে দুদিন। সুবিধাই হলো আমার।
ওই প্রকল্পে দু’বছর কাজ করলাম। মানে আমার Input ছিল চব্বিশ ম্যানমানথ্। ঢাকা পৌরসভাসহ ওয়াসা, রাজউক, সবারই আমি Municipal পার্ট-এর দেখাশোনা করতাম। Team Leader ছিলেন ইরানি-আমেরিকান প্রকৌশলী মজিদ গাবুসি। এবং দেশের অন্যান্য নামকরা প্রকৌশলীরও Input ছিল এই প্রকল্পে।
তখন, ১৯৯৫ এর শেষের দিকে দেশে শুরু হলো প্যাকেজ নাটক অনুষ্ঠান নির্মাণ। মানে BTV-এর বাইরে যে কোনো এক অনুষ্ঠান নির্মাণ করে BTV-এর কাছে বিক্রি করা যাবে। ব্যাস হিড়িক পড়ে গেল বেসরকারীভাবে নাটক নির্মাণ। বেড়ে গেল আমারও কাজের পরিধি। এবং যেহেতু প্যাকেজে যারা কাজ করে-তারা বেশিরভাগই (সে সময়) অন্য কোনো পেশাতেও জড়িত ছিল, তাই শুটিংগুলো অফিস সময়ের বাইরে করা হতো। এটাই তো আমি চাইছিলাম। TV Acting কে পেশা হিসেবে মনে মনে আশা করছিলাম অনেক দিন ধরে। সিনেমার কাজ কমাতে শুরু করলাম। একদম ছাড়িনি, কারণ চাইছিলাম— ওটার সঙ্গে যেন যোগাযোগটা বিচ্ছিন্ন না হয়।
প্যাকেজের কাজের চাপ বাড়তে থাকলো, এবং এক সময় বুঝতে পারলাম যে এখন বোধকরি চাকরিটা ছাড়া যায়। আবার তখনই আমার কোম্পানী আমাকে Laos পাঠাতে চাইলো-Consultant হিসেবে। লাওসের বিভিন্ন শহরের ড্রেইনেজের প্রকল্পের ফিজিবিলিটি স্টাডির জন্য। মাত্র ২/৩ মাসের জন্য। সুযোগটা ছাড়লাম না। এতে দু’রকম লাভ হলো— Laos দেখা হলো, আবার জীবনে প্রথম মাথা গোঁজার একটা ঠাঁই হচ্ছিল (ফ্ল্যাট Booking দিয়েছিলাম) তার জন্য অর্থেরও ভাল যোগান হলো। এ সময় আমিও একটা প্যাকেজ নাটক নির্মাণ করে ফেললাম হারজিৎ Impress টেলিফিল্মের ব্যানারে।
তারপরই রওয়ানা হলাম Laos. চমৎকার একটি দেশ। একদিকে থাইল্যান্ড অন্যদিকে ভিয়েতনাম। আবার চীনও আছে উত্তরে। সারা দেশ জুড়ে শুধু গাছ আর গাছ। সেগুন গাছ। ওদের প্রধান রপ্তানি হচ্ছে সেগুন কাঠ। আর বন্য পশুর মধ্যে জাতীয় পশু হচ্ছে হাতি। ওরা বলে Land of million elephants. ফ্রেঞ্চ কলোনি ছিল। এখন মিলিটারিরা শাসন করে। চীন ওদের প্রধান বন্ধু। না গেলে সত্যিই মিস করতাম। উত্তর-দক্ষিণ, পূর্ব-পশ্চিমে কয়টি প্রধান শহর ভিয়েনতিয়েন, পাকসে, লুয়াংপ্রবাং, সাবান্নাক্ষেতও ঘুরে বেড়াতে হতো বিমানে চড়ে। দারুণ ব্যাপার ছিল। ভীষণ আনন্দ পেতাম কাজে।
প্রথম মাসের input দিয়ে ফিরে এলাম। আবার আমার প্রকল্প অফিসেই বসলাম কাজে। প্যাকেজ নাটক চলছে। বানালাম আর একটি নাটক। গিয়াসউদ্দিন সেলিমের লেখা দ্বৈরথ। এটাও হিট। এটাও Impress-এর। বুঝলাম, এটাই আমার ডেসটিনি। লাওসের কাজ সেরে এসে ওই মাঠেই পুরোপুরি নামবো।
দু’মাস পর আবার গেলাম Laos. বাকি ম্যানমানথের input দিতে। এবার ঘুরে ঘুরে দেখলাম ভিয়েতনামের আনাচে কানাচে। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ওরা। দেশের মানুষের সংখ্যা কম, মেয়েরাই কাজ করে-ছেলেরা বসে বসে মদ খায় আর আড্ডা মারে। জানি না এখন এই তিরিশ বছর পর Laos-এর অবস্থা কি! তখনই সেই ১৯৯৬-এ দেখছি মাত্ৰ World Bank, ADB জাইকা ঢুকছে ওখানে। এতদিনে চেহারা নিশ্চয় পাল্টেছে।
কাজ শেষ করে ফিরে এলাম জুন ১৯৯৬। এদিকে আমার ঢাকার প্রকল্পের কাজও শেষ। আমাকে হেড অফিসে ফিরিয়ে আনা হলো। বুঝলাম এই ই সময়।
দিলাম দরখাস্ত, তিন মাসের বিশেষ ছুটির। বিনা বেতনের ছুটি। ভাবলাম, একদম ছেড়ে দেয়ার চেয়ে লেজটা থাকুক বাঁধা-প্রয়োজন হতেও তো পারে।
ছুটি সঙ্গে সঙ্গে মিললো-কারণ প্রকল্প ছাড়া বসে বসে বেতন দেয়ার চেয়ে কোম্পানি ভাবলো, বিনা বেতনে ছুটি দেয়া ভাল ও সুবিধার। কারণ আমার bio data টা ব্যবহার করা যাবে। এবার আমি আমার চূড়ান্ত পেশা পেলাম। অভিনেতা, নির্দেশক এবং নাট্যকার, Video মিডিয়া। লেগে গেলাম কোমর বেঁধে এই কাজে। প্রচুর কাজ আছে হাতে। এই সময়টা Channel I এবং ATN বাংলার জন্য প্রচুর কাজ করেছি আমি। NTV যখন এল তাদেরও চ্যানেল চালু হওয়ার সময় আমার বানানো ধারাবাহিক ও চালু হলো সেখানে।
প্রকোশলীর সার্টিফিকিটটা প্যাকেটে পুরে আলমারীতে ভরে রাখলাম। বুঝলাম এখানে টিকতে পারবো, কারণ এই মিডিয়াটার বিস্তৃতি ঘটা অনিবার্য।
আবার ছুটি বাড়ালাম ছ’মাসের জন্য। সঙ্গে সঙ্গে মনজুর হলো। এরপর শুধু কাজ আর কাজ, রাত নেই দিন নেই সকাল নেই বিকেল নেই, নেই ঝড়বৃষ্টি, নেই শীত-শুধু কাজ, কখনো অভিনয়, কখনো নির্দেশনা আর নাট্য রচনা চলছে সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন রকম লেখালেখি। দম ফেলবার সময় নেই। সিনেমাও সমান্তরালে চললো, তবে অল্প পরিসরে। সুতরাং এবার ইস্তফা চাকরি-তে। আমি মুক্তি পেলাম দাসত্ব থেকে।
২৮ বৎসর একাধারে কাজ করে যাচ্ছি Video মিডিয়াতে। জীবনে পেশাগত যে আনন্দ পেতে চেয়েছিলাম, পাচ্ছি সেটা। তখন দেশে ছিল দু’চারটে চ্যানেল, আর আজ সেখানে প্রায় ৩৬টি। কাজের পরিমাপ আন্দাজ করা যায়! শুধু কাজের পরিমাপ কেন, কাজের ধারাও গেছে পাল্টে। প্রযুক্তিগতভাবে! অনেক উন্নতি হচ্ছে এই মাধ্যমের। ছেলে মেয়েরা শিখে এসে এটা পেশা হিসেবে নিচ্ছে আজ। বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি নিয়ে এসে কাজ করছে— আমাদের মত দেখে শেখা নয়। শিখে পেশা নিচ্ছে। এটাতো বিরাট ব্যাপার। আমাদের মহা ব্যস্ততায় ভাটা পড়লো ২০১৯ সালে। করোনায়। Covid 19 গোটা পৃথিবীর মানুষকে নাড়িয়ে দিল। হানা দিল এদেশেও। হঠাৎ করে অস্থির মানুষ। আত্মীয়স্বজন যেন সব পর হয়ে গেল। কী এক অদ্ভুত অসুখ। চেনা চেনা মানুষগুলো হঠাৎ হঠাৎ দুম করে পরপারে চলে গেল, কী এক ভীতি মানুষের মধ্যে। দেশ হারালো কতো কৃতিসন্তান। অপূরনীয় ক্ষতি হয়ে গেল জাতির।
একদিন আক্রান্ত হলাম আমিও। স্ত্রী-সন্তান মিলে মুহূর্ত দেরী না করে ভর্তি করে দিল হাসপাতালে। ভাবিনি ফিরবো, সকলে তো ফিরছিল না তখন। আল্লার অশেষ মেহেরবানিতে এলাম ফিরে এক সময়।
দিন চলে যায়। এক সময় কোভিডও গেল। পৃথিবীর বুকে বিরাট ক্ষত রেখে গেল। ধীরে সুস্থে মানুষ আবার উঠে দাঁড়ালো, স্বাভাবিক হয়ে এলো সব কিছু। কাজ শুরু হলো আবার। আবার ব্যস্ততা।
বড় মেয়ে বিপাশা এর মধ্যেই সিদ্ধান্ত নিল আমেরিকায় যাবে। ওখানেই থাকবে ও পরিবার নিয়ে। আমরা আপত্তি করিনি (যদিও মন চায়নি)। ভেবেছি ওদের জীবন ওরাই গড়বে, কীভাবে গড়বে সেটা ওরাই সিদ্ধান্ত নেবে। ছোট মেয়ে বিদেশ থেকে Marketing management-এ মাস্টার্স করে এসে বুটিকের ব্যবসা করছে। মোবাইল কোম্পানির ভাল চাকরি ছেড়ে— সে তার নিজের পছন্দের পেশা বেছে নিয়েছে। তাকেও না করিনি। ওই যে নিজের জীবন নিজেই বেছে নাও, এই মতবাদে বিশ্বাসী আমরা।
একাধারে চাকরি টেলিভিশন-মঞ্চ, রেডিও সব জায়গায় ছোটাছুটি-মেয়ে দুটোর স্কুল যাওয়া, সাথে শিক্ষকের কাছে নেয়া—আনা, গানের নাচের ক্লাসে নেয়া-সব দিক দিয়ে মহা ব্যস্ত সময় আমার তখন।
মাঝে মাঝে বন্দুক নিয়ে যাচ্ছি শিকারে,-পাগলায় না হয় মানিকগঞ্জের দিকে। সে নেশা অবশ্য একসময় কেটে যায়। আজও মনে হলে নিজেকে অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড় করাই আমি। বন্দুকটার কাহিনি অন্যত্র বলা হয়েছে বিধায় আর না বাড়াই কথা। থিয়েটারে এক সময় একটা ঠান্ডা বিরোধ বাধে আমার আর যাকেরের।
যাকের আমাকে একদিন বললো-নতুন নাটক নামাবো-সৈয়দ ভাই ( সৈয়দ শামসুল হক) লিখছেন। তুই কররি প্রধান চরিত্র। স্ক্রিপ্ট পড়া হলো, পরে দেখলাম প্রধান চরিত্রে যাকের নিজেকে কাস্ট করেছে,-আর আমার জন্যে একটি ক্ষুদ্র, অতি কম গুরুত্বের চরিত্র বরাদ্দ করা হয়েছে।
আমি প্রত্যাখ্যান করলাম এবং অত্যন্ত মনোকষ্টে ঘোষণা দিলাম, আমি দলত্যাগ করলাম। আমার ধারনা সৈয়দ ভাই ওই চরিত্রটি এত ভালো লিখেছেন যে যাকের আর লোভ সম্বরণ করতে না পেরে নিজেই করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। একথা যাকের কোনো দিন অবশ্য স্বীকার করেনি, সে নাকি আমাকে এমন কথা দেয় নি কখনো। আমিও আমার কথা নড়চড় করার কারণ দেখিনা। যাকের আমার বাসায় এল, অফিসে এল, আমাকে বোঝাতে যেন আমি গ্রুপ না ছাড়ি। নূর বেশ কবার ফোন করলো, বাসায় এল। আতাউর রহমান অনেক চেষ্টা করলেন আমাকে বোঝাতে। কিন্তু তখন আমার ভীষণ রাগ আর অভিমান-এতদিন পর (প্রায় চার বছর) আমি কেন এমন গুরুত্বহীন চরিত্র করবো!
.
অনেকে বলেছে-আমি বাড়াবাড়ি করছি। হ্যাঁ করছি—আমি বলেছিলাম আমার অধিকার বলে আমি যে দাবি করছি তার যোগ্য অবশ্যই আমি ছিলাম।
শেষ পর্যন্ত আমার মান ভাঙলো, গ্রুপে ফিরে গেলাম। নাটক আমার প্রাণ—গ্রুপ আমার প্রাণের বন্দর। একে অবহেলা করতে পারিনি। তবে ওই যে জেদ-নূরলদীনের সারা জীবন আমি কোনোদিন দেখিনি। যাকের অভিনয় করেছে-প্রশংসা পেয়েছে প্রচুর। যথার্থ কারণেই পেয়েছে-সে অত্যন্ত ভালো এবং মেধাবী অভিনেতা–ভালো সে করবেই-কিন্তু কথা ওই একটাই-আমার আজও ধারণা আমি আমার প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত হয়েছি।
যাই হোক নাগরিক আমার হৃদয় জুড়ে ছিল, এখনও আছে। তবে নানান কারণে আমি আর এখন এ্যাকটিভ নই। কিছুটা তো শারিরীক কারণেও বটে। বাকিটা নানান রকম ঘটনা এবং নাগরিকের ক্রিয়া কর্মের কারণে। সেসব এখন আর বলে কারো মন খারাপ করতে চাই না। বা দ্বন্দ্বে জড়াতে চাই না। মনটা শুধু আমারই বিষাদে পূর্ণ থাক, ছড়াতে চাই না সে বিষাদ অন্যের মনে। বেঁচে থাক নাগরিক অনন্তকাল – দয়া করে যদি কেউ কখন কোনো ভাবে কোথাও উল্লেখ করে আমার নামটি যে আবুল হায়াত নামের একজন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য অভিনেতা ছিল নাগরিকের-যে শুধু অভিনেতাই নয়, প্রাণের অভ্যন্তরে নাগরিককে স্থায়ী স্থান দিয়েছিল, সেটাই হবে আমার বড় পাওয়া। নাগরিকের জন্মলগ্ন থেকে জানপ্রাণ দিয়েছি একে প্রতিষ্ঠা করার জন্য। সেখানে আমি কোনোদিন কোনো প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্ব নিতে উৎসাহী ছিলাম না-তবে আমার গ্রুপ করার প্রধান বা মূল চাহিদা ছিল অভিনয় করা।
কিন্তু অবস্থা এমন দাঁড়ালো যে অভিনয় করা হচ্ছে না-শুধু দলে আসা আর যাওয়া চলছে। চলেছে নানান অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহণ ও আলোচনা। সভা মিটিং ইত্যাদি। লিবিয়া থেকে আসামাত্র যাকের আমাকে রক্তকরবীর দাদাঠাকুর করতে বললো। এ নাটকটি আমার লিবিয়ায় থাকাকালীন সময়ে হয়েছিল। মূল দাদাঠাকুরের সাথে গ্রুপ-এর সমস্যা হওয়াতে সালেক খানকে গ্রুপ থেকে খারিজ করা হয়েছিল বিধায় আমাকে অনুরোধ করা। যাইহোক ওটা করেছি। দেওয়ানগাজিতে আবার প্রত্যাবর্তন করলাম মাখন চরিত্রে। এ ভাবেই চলছিল সব।
এমন সময় নূরলদীন দিন নিয়ে ঘটনাটা ঘটলো। এরপর যৌথ প্রযোজনায় থিয়েটার আর নাগরিকের ম্যাকবেথ সেখানেও রাজা ডানকানের চরিত্রাভিনয় করলাম। ব্রিটিশ কাউন্সিলের আনুকূল্যে কিষ্টোফার স্যান্ডফোর্ডের পরিচালনায় নাটকটি হয়েছিল। এখানেও Casting-এর ব্যাপারে শুনেছি দুই দলের প্রধানদের পরিচালকের সাথে ঘনঘন ওঠাবসা ইত্যাদি ঘটেছিল। ফলশ্রুতিতে আমার অতি সামান্য গুরুত্বের চরিত্রপ্রাপ্তি।
এরও বেশ পরে আর একটি নাটক হয়েছিল এই দুই দলের প্রযোজনায় ব্রিটিশ কাউন্সিলের আনুকূল্যে দি টেমপেস্ট। রামেন্দু মজুমদার আমাকে একদিন বললেন অভিনন্দন। শেক্সপিয়ারের নাটক হচ্ছে। আপনাকে প্রধান চরিত্র দেয়া হচ্ছে। শুনে আনন্দ পেয়েছিলাম তবে আনন্দ ভঙ্গ হলো যখন দেখলাম ওই নাটকে আমার কোন চরিত্রই নেই। শুধু নিজের কথাই বলে যাচ্ছি স্বার্থপরের মতো। আমার মতো হয় তো আরও অনেকে ও বঞ্চিত হয়েছে গ্রুপ থেকে। এবং এক সময় গ্রুপ ছেড়ে গেছে তারা, অন্যগ্রুপ ও তৈরি হয়েছে তাদের দ্বারা। কিন্তু আমি পারিনি গ্রুপ ছাড়তে। ওই নাগরিক আমার প্রাণের বন্দর ওখানে তো স্থায়ী নোঙ্গর করে আছি। আমি আছি কিন্তু নেই। এমন একটা মানসিক অবস্থায় আমি।
দুঃখিত, কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ জানানোর জন্যে তো আজ আমি নিজের জীবন কথা লিখতে বসিনি। কিন্তু মনের কষ্ট সব সময় চেপে রাখা অসম্ভব হয়ে পড়ে। যাদের বিরুদ্ধে কিছু বললাম, তাদেরও নিশ্চয় যুক্তি আছে তাঁদের কাজের।
তারপরও মনে পড়ে আমি বিসর্জন নাটকের নির্দেশনা দিলাম গ্রুপে, সবাই খুশি মনে রাজী হয়নি জানি, তারপরও অনুমতি পেলাম। কাষ্টিং করতে গিয়ে মনে হয়েছিল রঘুপতি আবুল কাশেমের মতো একজন মানুষকে মানাবে ভালো। যদিও তাঁর চেয়ে ভালো অভিনেতা গ্রুপে বিদ্যামান।
যাকেরকে দিলাম রাজা গোবিন্দমানিক্যর চরিত্র। মনে হয়েছিল এই চরিত্রের অন্তর্দ্বন্দ্ব সে খুবই ভালো ফোটাবে। কিন্তু দুঃখজনক হলো মঞ্চায়নের ঠিক দশ-বারো দিন পূর্বে যাকের ঘোষণা দিল সে ওই নাটক-এ অভিনয় করবে না-কারণ কি?
I dont feel like acting in this play.
সোজা কথায় পরিচালকের প্রতি অনাস্থা জ্ঞাপন।
মহা বিপদ, শো Sporsored, তারিখ ঠিক। প্রচার সম্পন্ন। বন্ধু জামালুদ্দিন হোসেনের শরণাপন্ন হলাম। শেষ রক্ষা হলো।
একে আমি কি বলবো?
কেউ তো বলেনি আজ অব্দি যে বিসর্জন বাজে প্রডাকশন হয়েছে। হয়তো জনপ্রিয় হয় নি। কিন্তু সেটাই কি নাটকের মানদণ্ড।
আমি গ্যালিলিওতে অভিনয় করিনি। দেখিনি কোনো শো। কারণ কী? ওই যে মনের ক্ষোভ! আমি হয়তো জেদি, অভিমানী, কিন্তু অপরাধী বলবো কি নিজেকে। এখনো আমি মনে করিনা সেটা।
নাগরিকে তখন প্রডাকশন কমিটি ছিল। যেটা নতুন প্রযোজনার অনুমোদন দিত। সেই কমিটি পাশ কাটিয়ে গ্যালিলিওর মহড়া শুরু হয়ে গেল-সবাই বুঝে ওঠার আগে। আমি তো বলবো না গ্যালিলিও বাজে নাটক। অভিনয় খারাপ। কারণ বাস্তবে তো তা নয়। সবই ভালো। অসাধারণ প্রযোজনা, কিন্তু প্রকল্প বাস্তবায়নের পদ্ধতিতে গলদ প্রচুর। মন খারাপ হয়েছে, ক্ষোভ ঝেড়েছি। সবাই জেনেছে বুঝেছে। কিন্তু আমি তো গ্রুপকে ত্যাগ করতে পারিনি। সেখানেই তো দুর্বল আমি। আতাউর রহমানের হিম্মতী মাতে তো অভিনয় করলাম। করেছি না। আমি তো অভিনয় চেয়েছি, কিছু করার মতো অভিনয়। কিন্তু বঞ্চনা বাড়তেই থেকেছে।
ভাবলাম রবীন্দ্রনাথের শেষরক্ষা প্রযোজনা করবো। প্রযোজনা কমিটি পাণ্ডুলিপি পড়ার অনুমতি দিল। দীর্ঘক্ষণ পড়লাম পাণ্ডুলিপি। সাধারণ সম্পাদক বললেন-এটা কোনো নাটকই না প্রযোজনার মতো। তিনি কোনোদিন এর নামও শোনেন নি কখনো। একবাক্যে সায় দিল অন্য সিনিয়ররা।
হলো না আমার প্রডাকশন করা।
আমার অভিমানটা বড় খারাপ প্রকৃতির। আমি গ্রুপ ছাড়লাম ঘোষণা দিয়ে। দেওয়ান গাজির শো ছিল,-বললাম দুঃখিত আমি আর নাগরিকে নাই।
আবার অনুরোধ, উপরোধ। নূর ছুটে এল বাসায়। বাসার মানুষও বোঝালো, আমার কথায় কথায় রাগ করা অন্যায়। সাধারণ সম্পাদক আতাউর এলেন না, কিন্তু দীর্ঘ এক পত্র লিখে পাঠালেন আমাকে-তার কিছু অংশ লিখে দিলাম আপনাদের জন্য –
“ফোন করতাম কিন্তু যে আড়ষ্ঠতা পেয়ে বসেছে তা কাটিয়ে উঠে ফোন করতে পারলাম না। “যাকের আজ সকালে ফোনে একটি কথা আমাকে একান্তে জানিয়েছে, তা হল, আমার সাথে অপ্রীতিকর একটা সম্পর্ক রেখে আপনি নাগরিকে কি করে ফিরে আসবেন। “নাগরিকে সবাই চায় আপনি নাগরিকে আবার ফিরে আসুন, আমিও আন্তরিকভাবে তাই চাই …
“আপনি হয়তো আমাকে ভাল লোক মনে করেন না, কুচক্রী ভাবেন, তাই কথা বলার চেষ্টা করলে আপনি বিরক্ত হবেন।…
…আপনার সিদ্ধান্ত আপনি পরিবর্তন করুন, আমি ব্যক্তিগতভাবে খুশি হব।…
“…সেদিন শেষরক্ষা বা অন্যসব বিষয়ে আমি যা বলেছি সেগুলো সব আমার কথা নয়, অন্যদের কথা, আমি শুধু বলতে গিয়ে অপরাধী হয়েছি…”
“…নিশ্চিত করতে পারি ভবিষ্যতে আমার কারণে আপনার কোনো অসুবিধা হবে না। ফিরে আসুন।”
আমার কিছু বলার নেই। এই পত্রেই অনেক কিছু বলা হয়ে গেছে।
আবার ফিরলাম নাগরিকে।
কারণ আমি অভিনয়কে ভালোবাসি। ভালোবাসি নাগরিককে। এর জন্য কী না করেছি আমি। আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়ে প্রচুর সময় দিয়েছি এর পেছনে নিজের ক্যারিয়ার তুচ্ছ করে।
এভাবেই চলছিল আমার সাথে নাগরিকের সহযাত্রা। এর মধ্যে হঠাৎ করেই সারা যাকের ডাকলো তার নাটকে অভিনয় করার জন্য। নাগরিকের প্রযোজনা সৈয়দ শামসুল হকের মুখোশ (এরিয়াল ডর্ফম্যান এর অনুবাদ) তিন চরিত্রের নাটক। অন্যতম প্রধান চরিত্রে আমাকে চায় সারা। আমি প্রথমেই না করে দিই। আমি কোনো নাটকে আর অভিনয় করবো না নাগরিকে। কিন্তু সে নাছোড়বান্দা। সে আমাকে নেবেই,-আমি বোধহয় একদিন বলেই ফেলেছিলাম।
নাগরিকে তো অনেক বড় বড় শিল্পী আছে, তাদের কাউকে নাও না।
সারা মুচকি হেসেছিল।
আমার আপনাকেই লাগবে।
ওর চাওয়ার কাছে পরাজিত আমি রাজী হই শেষ পর্যন্ত। খুব ভালো কাজ করেছিল সারা। পরে সারার আর একটি নাটকেও অভিনয় করলাম। আসলে, ওই যে, অভিনয়ই তো আমার প্রাণ। আমি কেন মঞ্চে মৃত্যু কামনা করি। ভালোবাসি বলেই তো।
সারাকে আবারও একবার অন্তর থেকে ভালোবাসা আর কৃতজ্ঞতা আমার অন্তরের কষ্টটা সে লাঘব করেছিল তখন। মুখোশ আমাকে যেন নতুন জীবন দিয়েছিল মঞ্চে।
ক’দিন আগে সারার নির্দেশিত অন্তরে বাহিরে চিত্রাঙ্গদা দেখলাম। বেশ ভালো লাগলো। নাটকে নিমার পুত্রবধূর নৃত্য ও অভিনয় ছিল মনোমুগ্ধকর।
সারাই চালাচ্ছে এখন নাগরিক, সাথে আছে নূর আর নতুনরা, হয়তো আগের মতো কর্মমুখর নয় গ্রুপ, তবু চলছে তো। এটাই ভালো লাগা।
বন্ধু আলী যাকেরকে যত কিছুই বলি না,-তার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা আমি সব সময় প্রকাশ করি। বাকি ইতিহাসে তার পরিচালনায় অভিনয় করে জীবনে প্রথম পুরস্কার লাভ, আমি কখনো ভুলিনি, ভোলার নয়। তার নির্দেশনা আর অভিনয় দুটোই ভালো, তবে অভিনয়ে সে অসাধারণ। একসাথে আমরা দু’জন মঞ্চে থাকতাম আমাদের রসায়ন ছিল চমৎকার। সাংগঠনিক ক্ষমতাও দারুন। নাগরিক-এর যে স্বর্ণযুগ তার প্রধান কৃতিত্ব তারই।
যাকেরের মৃত্যুটা থিয়েটারের জন্য একটি বিরাট ক্ষতি। বাংলাদেশের দর্শনীর বিনিময়ে নিয়মিত নাট্য চর্চার যে অবস্থান আজ, তাতে তার অবদান অপরিসীম। এজন্যেই সে স্মরণীয় হয়ে থাকবে দেশের দর্শককূলের হৃদয়ে।
তার আগে অবশ্য জিয়া হায়দার আর আতাউর রহমানের যে স্বপ্ন, থিয়েটার গ্রুপ করবেন-এবং তার সফল বাস্তবায়ন তার জন্যও তাঁরা থাকবেন ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে।
জিয়াভাই-এর নির্দেশনায় আমি সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহর বহিপীর নাটকে অভিনয় করেছি (তার আগে টিভিতে ইডিপাস) তখনই তাঁকে দেখেছি কতটা Methodical পরিচালক তিনি। সেখান থেকে শেখা আমার অনেক কিছুই, এরপর বলবো আতাউর রহমানের (আতা ভাই) কথা। আমার ধারণা তিনি বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান মঞ্চ নাটক নির্দেশক। হয়তো অত Methodical নন। কিন্তু Imaginative ভীষণ রকম। সফল নির্দেশক।
নাগরিকের সাতকাহনের কলেবর আর বৃদ্ধি করতে চাই না। এ ব্যাপারে প্রকৃত তথ্য সংবলিত লেখার একমাত্র যোগ্যতম ব্যক্তি আমাদের মঞ্চসারথি আতাউর রহমানই। অনেক কিছু আমি হয়তো বলতে পারিনি, যা তাঁর লেখায় জনগণ নিশ্চয় অবহিত হবেন। ধীরে ধীরে আমার সংশ্লিষ্টতা কমে এল গ্রুপে। এমন সময় আমার জন্য আশীর্বাদ হয়ে এল TV package প্রোগ্রাম। অর্থাৎ বাংলাদেশে বেসরকারীভাবে টিভির জন্য অনুষ্ঠান নির্মানের অনুমতি দিল সরকার।
চারদিকে সাড়া পড়ে গেল নাটক নির্মাণের। ওই মাধ্যমে আমার চাহিদা আমার খুব ভালো জানা ছিল। আমি পাড়ি জমালাম সেই পথে। ব্যস্ত হয়ে পড়লাম শুটিং নিয়ে রাতদিন চলতে লাগলো শুটিং। গ্রুপে পুরোনো নাটকের দু’চারটে শো কালেভদ্রে হলে করতাম। অন্যথায় নয়। এক সময় প্যাকেজ নাটক পরিচালনাও শুরু করলাম। তখন আর আমার কোনোদিকে তাকাবার নেই সময়। শুধু কাজ আর কাজ।
এর মাঝে নাগরিকের প্রাণপুরুষ আলী যাকেরের মৃত্যু ঘটায় গ্রুপে একটি শূন্যতার সৃষ্টি হয়। সে সময় আমাকে সভাপতির পদ গ্রহণ করার প্রস্তাব করে নূর এবং সারা। হয়তো গ্রুপে আলাপ করেই। কিন্তু আমি অনেক চিন্তা ভাবনা করেই এতে অপারগতা প্রকাশ করি। কারণ এই সময়ের মধ্যে আমি থিয়েটার থেকে মানসিকভাবে বেশ অনেকটা দূরত্বে চলে এসেছি।
আমার অপারগতায় গ্রুপতো আর থেমে থাকেনি। চলছে। আশাকরি চলবে। নিজস্ব মহিমায়, নিরবধি।
এই লেখা শুরু করেছিলাম, তা প্রায় পাঁচ বছর পূর্বে, শেষ যেন হতে চায় না। নানান কারণে অনেকদিন পড়ে ছিল— এবার শেষ করার পণ করেই বসেছি।
বয়েস এবার আশি পূর্ণ হবে। অসুখ বিশুখ তো আর বসে নেই-
বৃদ্ধ শরীরটাকে পেয়ে বসেছে অনেকটা। আমি মানতে চাই না এসব বাধা। যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছি অসুখের সাথে। ভাল আছি আল্লার অশেষ কৃপায়।
ওই যে সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়, লোটা কম্বল উপন্যাসের কিংবদন্তী লেখক, আমার প্রিয় মানুষ, বলেছিলেন— যদি ভাল ভাবে বাঁচতে চান আনন্দে থাকবেন। আর আনন্দে থাকার একমাত্র উপায় হচ্ছে কাজ করবেন।
আমি আনন্দে থাকি। কাজে থাকি।
আমৃত্যু থাকতে চাই কাজে।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন