“ছোট খোকা বলে অ আ
শেখে নি সে কথা কওয়া”
কবিগুরুর উপুর্যুক্ত ছড়ার সূত্রেই বলি— শিশুর কথা বলা শুরু কবে হবে তা নির্ভর করে, বাবা-মার ওপর। ইউনিসেফের একটা প্রকল্পের নাটক নির্মাণ করতে গিয়ে জেনেছিলাম— একটি শিশু শূন্য বয়স থেকে পাঁচ পর্যন্ত শেখে। অর্থাৎ গর্ভবস্থায়ও সে শেখে-সেখানে বাবা-মার দায়িত্বটাই তাহলে বেশি।
আসলে আমাদের সমাজে শিশুদের মনস্তত্ত্ব নিয়ে খুব কমই মাথা ঘামানো হয়। সে কী চায়, কী করতে চায় বা তার কী ভাল লাগে এগুলো যেন আমাদের ভাববার বিষয় নয়। আমরা আমাদের চাওয়া-পাওয়া, ভয়-ভাবনা চাপিয়ে দিতে চাই ওদের ওপর।
না, সেটা আমার এ মুহূর্তের বিষয় নয়। আমি বলছিলাম আমার বাবা-মাও এ নিয়ে কোনোদিন ভেবেছিলেন বলে আমার মনে হয় না, তবে এক দিক দিয়ে আমি অবশ্যই ভাগ্যবান— তাঁরা কোনোদিন তাঁদের চিন্তাভাবনা আমার ঘাড়ে চাপাবার চেষ্টা করেননি। তাই আমি বেড়ে উঠেছি আমার ইচ্ছায়, আমার মত করে। তাতে হয়েছে কী, ভাল ছাত্র হতে পারিনি, এবং মানুষটাও হইনি খারাপ বোধহয়।
নিজের মত করে বেড়ে ওঠার একটা আনন্দ নিশ্চয় আছে। সেই আনন্দটাই কিছুটা ভাগ করে নিই সবার সাথে। নানান পরিচ্ছেদে শৈশবের নানান কথা হয়তো বলা হবে, তবে এবার একটু গুছিয়ে বলতে চাই। পুনরাবৃত্তির জন্য ক্ষমাপ্রার্থী।
সেই তিন বছর বয়সে গ্রাম হতে আত্মীয় স্বজনের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে শহরে চলে আসার কারণে ছোঁয়া পাইনি কখনো একান্নবর্তী পরিবারের। তার পরও পাঁচ ভাইবোনোর একমাত্র ভাই হওয়ায়, আশ্রয় প্রশ্রয় ছিল অবাধ। সেই কারণেই, ওই যে বলছিলাম, নিজের মত করে বেড়ে ওঠার সুযোগটা পেয়েছি অবাধ।
আম্মা ছিলেন পুরোপুরি গৃহিনী। তাঁর চোখ থাকতো চারদিকে। আমার ওপর তাঁর মনিটরিং পুরোপুরিই ছিল বলে হয়তো আমি বেপথু হইনি কখনো। এখন এটা বুঝি ভাল। শৈশবের সেই স্মৃতিগুলোই, এই শেষ বয়সে এসে আরো বেশি করে মনে ভেসে উঠছে। সেগুলো না বলে থাকি কী করে!
ওই যে বাটালি আর টাইগারপাস পাহাড়ের মাঝখানটায় ছিল সুন্দর এক সমতল ভূমি। আমাদের বাসার ঠিক পেছনটাতেই পাহাড়ের গোড়ায় এক বিশাল বটগাছ। বয়স কত ছিল কে জানে। শকুনে ভর্তি থাকতো মগডালটা। দিনের বেলায় দল বেঁধে আনন্দে ফুল তুলতে যেতাম, কিন্তু রাতটা ছিল ভীতিকর। বিদ্যুৎ তখনও আসেনি আমাদের এলাকায়। সন্ধে হতে না হতে শিয়ালের কোরাস। আর একটু রাত হলে তক্ষক সাপের ডাক। রীতিমত হরর সিনেমার পরিবেশ।
এই পরিবেশেই শুরু হয়েছিল, নতুন দেশে এসে নতুনভাবে জীবন যাপন। মেঝেতে সপ বিছিয়ে হারিকেনের আলোয় আমি হয়তো স্লেটে হাতের লেখা মকশো করছি। সাথে সাথে অ. আ. ই. ঈ চিৎকারও চলছে। চিৎকারটা অনেক সময় শিয়ালের সাথে পাল্লা দিয়ে চলতো। বড় বোনরা যেহেতু স্কুলে ভর্তি হয়নি ওদের পড়াশুনার বালাই ছিল না। ওরা বিরক্ত হতো আমার চিৎকারে। অন্য ঘর থেকে হুকুম আসতো বাতাসে -আস্তে পড়।
তখন আমার কণ্ঠের আওয়াজ আরও বৃদ্ধি পেতো প্রতিবাদ স্বরূপ।
দেখছো আম্মা রবি কী করছে! এক বোন চিৎকার দিতো।
রবি পড়ো। আম্মা রান্নাঘর থেকে বলতেন হয়তো।
তখন আমি দ্বিগুণ উৎসাহে অ. আ. ই. ঈ শুরু করতাম আরো উঁচু কণ্ঠে।
এবার অন্য বোন এসে হারিকেনটা টান দিয়ে নিয়ে কুপি একটা আমার সামনে দিয়ে চলে যেতো। আর কুপিটাই ছিল আমার অতি অপছন্দের বস্তু। সুতরাং গলা ফাটিয়ে শুরু হতো কান্না। এরপর একটা হৈ চৈ। রাতে আর রাগের কারণে খাওয়া হলো না আমার। আম্মার হাজার আদরেও না।
আবার পরদিন দুপুরে হয়তো ভাই বোন সব এক সাথে খেতে বসেছি— মনে করেন ডিমের তরকারী সেদিন। আমারটা চটপট খাওয়া শেষ করে এক বোনের প্লেট থেকে তার ভাগের ডিমটা পট করে মুখে দিয়ে দিলাম দৌড়।
এবার অভিযোগ যেতো হেড কোয়ার্টারে। আব্বা শুনে মিষ্টি করে বলতেন— ‘ছি, এমন কোরো না। ওরা তোমার বড় বোন।’
তারপর লুকিয়ে হাতে চারটে পয়সা দিয়ে বলতেন-
‘যাও, আইসক্রিম খেয়ো।
সে সময় ঠেলাগাড়ি নিয়ে আসতো আইসক্রিম ওয়ালারা। মেশিনে বরফ ঘষে ঘষে কাঠিতে লাগিয়ে সিরাপ ঢেলে দিতো লাল লাল। আহা কী মজা যে লাগতো চুষতে। দাম ছিল দু পয়সা। দুধেরটা আবার এক আনা।
এ হলো আমার শৈশবের এক দৃশের চিত্রনাট্য। লিখতে লিখতেই এখন আমার চোখটা ঝাপসা হয়ে এলো। আর ভীড় করে এলো হাজারো স্মৃতি। মনে মনে গেয়ে উঠলাম—
মোরা ভোরের বেলায় ফুল তুলেছি দুলেছি দোলায়
বাজিয়ে বাঁশি গান গেয়েছি বকুলের তলায় –
আমাদের বাগানে ছিল বেলিফুল গাছের লম্বা সারি। ঝাঁকড়া সব গাছ। ফুলও ফুটতো অসংখ্য। সন্ধে হতেই সৌরভ ছড়িয়ে পড়তো গোটা পাড়াতে। আর বুঝতেই পারছেন পাড়ার ছেলেমেয়েরা ভোরের বেলা বেড়া টপকে এসে ফুল নিয়ে যেত মাঝে মাঝে। এতে আমি রাগ হলেও আব্বাকে কখনো দেখিনি উষ্মা প্রকাশ করতে।
পাকিস্তানে আসবার পর আমার পরও দুটো বোনের জন্ম হয়। মমতাজ, আমার সাত বছরের ছোট। আর একেবারে ছোট বোন পুতুল তো তেরো বছর ছোট। ওকে কোলে নিয়ে কত যে ঘুরেছি। আমার ন্যাওটা ছিল খুব। ‘ভাই ভাই’ করে ঘুরতো পিছু পিছু। বাগানের কাজে ওরা অনেক সাহায্য করতো আমাকে। বিশেষ করে ঘর থেকে পানি নিয়ে আসতো ছোট ছোট মগে আর গাছে গাছে ঢালতোও। মজা পেত খুব এ কাজে। পরে ওদের কথা বিস্তারিত বলা যাবে।
ফুল ছোটবেলা থেকেই আমার পছন্দের বস্তু। এখনও তাই। বিশেষ করে বেলি আমার অতি প্রিয়, বিয়ের পর থেকে অর্ধাঙ্গিনীকে বেলী মৌসুমে প্রায় প্রতিদিনই মালা উপহার দিই— অদ্যাবধি চলছে সে প্রক্রিয়া। বিয়ের আগে ও যে ফুল দেয়া চলতো না বলবো না। পাহাড়ে ওঠা আমার সেই ছোট্টবেলার নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় ছিল, তারও মূল কারণ ফুল। পাহাড় দুটোতে প্রচুর জঙ্গলী গাছ ছিল যা প্রতি নিয়ত বিভিন্ন রকমের ফুলে থাকতো আলোকিত হয়ে। ফুল তোলার জন্যেই পাহাড়ে ওঠার প্রতিযোগিতা চলতো আমাদের। ওই সব ফুল তুলতে গিয়ে পা যে কাঁটাতে কত রক্তাক্ত হয়েছে তার হিসেব নেই। আম্মা ল্যানটেনাগুলো জংলী ফুল বলে হেলায় ছুঁড়ে ফেলতেন, আর সেই ফুল এখন অভিজাতদের বাগানের শোভা বর্ধন করে!
.
কিছুদিন আগেও বাটালী পাহাড়ে গিয়ে দেখেছি, না ল্যানটেনা না তোকমা-কোনো জংলী ফুল গাছেরই চিহ্নমাত্র পড়েনি চোখে।
বাগানে আমাদের দুটো ফলগাছ ছিল সেই প্রথম থেকেই। একটি পেয়ারা অন্যটি কুল। এই পেয়ারা গাছের ডাল কেটে আমাকে গুলতি বানিয়ে দিয়েছিল বাড়ির কাজের ছেলে জহির। রাবার কোথা থেকে জোগাড় করেছিল জানিনা-তবে গুলি বানানোর তরিকা শিখিয়েছিল সে। দোহাজারী-নাজিরহাট রেল লাইনের পাশে ছিল সব বরোপিটের (Borrow pit) ডোবা। সব নরম কাদায় ভরা। একদিন জহির নিয়ে গেল আমায় সেই ডোবা থেকে কাদা তুলতে। তার জন্যে প্রচুর বকুনী খেলেও মাঝে মধ্যে কাজটি করতাম আমি। মজা লাগতো ভীষণ। এঁটেল মাটির কাদায় ছোট ছোট গুলি তৈরি করে চুলোর মধ্যে ফেলে দিতাম। পুড়ে শক্ত হয়ে গেলে সেগুলো ব্যবহার হতো গুলতিতে। বিভিন্ন টারগেটে নিশানা মকশো করার কাজে। পরে চড়াও হলাম বাড়ির মুরগি আর পায়রার ওপর। ফলশ্রুতিতে আম্মার বকাবকি প্রাপ্তি হতো নিয়মিত।
এবার শুরু হলো মাঠে ঘাটে তাবৎ নির্দোষ কুকুর বিড়ালের ওপর অত্যাচার। আব্বার চোখে পড়তেই সাবধান করলেন-কুকুর রেগে গেলে কামড় দেবে এবং একবার কামড় দিলে কী হয়— ধনুষ্টংকার। তার মানে পেটে দশ বিশটা ইঞ্জেকশন। শুনে তো আমার আত্মা খাঁচাছাড়া হবার উপক্রম। অতএব গুলতি কার্যক্রম থেকে বাদ গেল সারমেয় ও মার্জার কুল।
তবে গুলতি ছাড়িনি— পাখির ছড়াছড়ি ছিল এলাকায়। তাদেরকেই টার্গেট করে চলতে থাকল আমার শিকার কার্যক্রম। হঠাৎ একদিন রেলপাড়ের এক ডোবাতে এক কানি বক ঘায়েল হলো আমার গুলতির গুলির আঘাতে। ওহ! সে কি উত্তেজনা আমার। যেন দিগ্বীজয় করে ফেলেছি আমি।
আব্বা শুনে খুশি হলেন (নিজে তো পাকা শিকারী) এবং কথা দিলেন আমাকে একটা এয়ারগান কিনে দেবেন। তবে তার জন্যে আমাকেও টাকা জমাতে হবে। আমি রাজী হলাম বিনাশর্তে। পরের দিনই চলে এল এক বেশ বড় সাইজের মাটির ব্যাংক এবং তাতে আব্বা শুরু করলেন যাত্রা একটি আধূলি ফেলে।
আম্মা যে মাঝে মধ্যে দু’এক আনা সংযোজন করতেন না তা নয়, তবে প্রধান দাতা ছিলেন আমার দুই আপা আর দুলাভাইদ্বয়। ওঁরা এলে কড়কড়ে এক টাকার নোট পড়তো ব্যাংকে। কখনো চকচকে চাঁদির টাকাও বটে।
এভাবে কতদিন চলছিল জানি না— আমার ধৈর্য রাখা কিন্তু সম্ভব হচ্ছিল না আর। একদিন সিদ্ধান্ত নিলাম ভাংবো ব্যাংক। আম্মার অনেক নিষেধ উপেক্ষা করেও ভাংলাম এবং পাওয়া গেল মাত্র পঁচিশ কি তিরিশ টাকা। ওতে তো এয়ারগান হয় না। বাজারে তখন ছোটো এয়ারগানের দাম চল্লিশ থেকে পঁয়তাল্লিশ টাকা। এবার আমার ঘ্যানঘ্যানানি শুরু হলো বাকি টাকার জন্য। সে সমস্যারও সমাধান করলেন মেজো আপা-তাঁদের আর্থিক অবস্থাটা বেশ ভাল তখন। দুলা ভাই সে সময় মরিস মাইনর গাড়ি চড়ছিলেন। বিদেশী কোম্পানির বড় সাহেব আমার দুলাভাই মনিরুজ্জামান।
কেনা হলো এয়ারগান। সাথে কৌটাভর্তি এক গুচ্ছ সীসার গুলি। কিন্তু মারবো কোথায়? কাকে? খুঁজতে লাগলাম টার্গেট। আব্বা একদিন একটা মগ রাখলেন বারান্দার ছাদে-বললেন, ‘মারো এটা।’
জানি না কতগুলো গুলি ছোঁড়ার পর ওটাতে লাগাতে পেরেছিলাম। কিন্তু পেরেছিলাম বেশ ক’বার। এ সময় আম্মার আরজি ‘একটা কাক মেরে দে তো বাপ, বড্ডো জ্বালায়’। আমাদের কোয়ার্টারের উঠোনের এক পাশে ছিল একটা আম গাছ। সেখানেই ছিল কাকদের বাসা-সকাল হতেই শুরু হতো ওদের উৎপাত।
টার্গেট এবার করলাম ওদের। একটা দুটো গুলি ছোঁড়ার পর ওরাও বুঝে গেল ওদের মারণাস্ত্র আমার হাতে। ব্যাস, আমাকে দেখতেই ওরা টুক করে সরে পড়তো এবং কা কা চিৎকারে সাবধান করে দিত অন্যদের। এবার আমি ঘরের ভেতর থেকে জানালা দিয়ে তাদের ওপর তাক করলাম একদিন। আর তৎক্ষণাৎ সাফল্য ধরা দিল আমার ঝুলিতে। কুপোকাত এক কাক। মারাত্মত আহত।
এবারই ঘটলো ভয়ংকর বিদ্রোহ। সব কাক তাকে ঘিরে একত্র হয়ে চিৎকার চেঁচামেচি করে, তাকে হত্যা চেষ্টার প্রতিবাদে মাতিয়ে তুললো সারা বাড়ি। আমাকে দেখলেই ওদের উত্তেজনা বাড়ে, বাধিয়ে দেয় হৈ চৈ। ধেয়ে আসতে চায় আমার দিকে, প্রচণ্ড স্লোগানসহ, প্রতিশোধ চায় ওরা।
আমি ক’দিন আড়াল করলাম নিজেকে। ভাবলাম ঘটনা ভুলে যাবে ওরা। উহু তা নয়! একদিন পর রাস্তায় বেরিয়েছি আর সমস্ত কাক আমার মাথার ওপর এসে বিশাল জমায়েত করে স্লোগান দিতে দিতে এগুতে লাগলো এক সাথে— যেখানে যাই কাকেরা চলে সেখানে। যেমন ড্রোন ক্যামেরা চলে সেইভাবে। আমি ভয়ে দ্রুত ঘরে ঢোকার জন্য দৌড় দিতেই দেয় এক ঠোকর আমার মাথায়। রক্তাক্ত আমি।
এবার বাধ্য হয়ে ক্ষ্যান্ত দিলাম কাক নিধন যজ্ঞ। সাবধানে যাওয়া আসা করলাম ক’দিন। ওরাও আমাদের বিরোধী দলের মতো ভুলে গেল শোক। এই এয়ারগান আর কোনোদিন ওদের ওপর প্রয়োগ করিনি আমি।
একবার আমার মেজো বোনের শ্বশুরবাড়ি ঢাকার অদূরে বেরাইদ গ্রামে গিয়ে কয়েকটি ঘুঘু এবং বক মেরেছিলাম আমি। চড়ুই, টুনটুনিরা অবশ্যি প্রায়ই আমার টার্গেট হয়েছে, প্রাণ দিয়েছে অকাতরে।
গুলতির গুলি ছুঁড়তে যেমন হাত পেকেছিল, তেমনি এক সময় মার্বেল খেলায়ও পেকেছিল হাত। এ ব্যাপারে প্রায় সর্বসময় ছিল আমার অব্যর্থ নিশানা। বেশ মালটিকালারের কাঁচের মার্বেল পাওয়া যেতো সে সময় বাজারের দোকানে। পাড়ার বড় ভাইদের খেলা দেখে শখ হওয়ায় আব্বার কাছ থেকে পয়সা নিয়ে কিনে কিনে কাঁচের বোতলে জমাতাম মার্বেল। ছোট বোন পুতুল চাইতো আমার কাছ থেকে, কখনো মন ভালো থাকলে দিতাম দু’চারটে। খেলা দেখতে দেখতে এক সময় খেলার নেশা ধরে বসলো আমাকে। আমার হাতের নিশানা দেখে অনেকে অবাক তখন।
এ ছেলে তো ‘খলিফা ছোকরা’ বলতো আমাকে। জিতে জিতে বেশ মার্বেল জমেছিল। সবই কিন্তু হতো বাড়ি থেকে লুকিয়ে। কেউ একদিন আব্বাকে বলে দিয়েছিল বিধায় আবা মৃদু বকুনী দিয়ে নিষেধ করলেন—
তুমি পড়াশোনা কর আর না কর-জুয়া খেলবে না কখনো; জুয়া সম্পর্কে আমার ভাল-মন্দ খুব একটা ধারণা ছিল না তখন স্বাভাবিক কারণেই।
তবে ক’দিন মন খারাপ ছিল ভীষণ। তার পরে আর খেলা হয়নি। আসলেই জুয়ার কী ই-বা বুঝতাম তখন-আমি তো খেলতাম আনন্দ পাওয়ার জন্যে। সেটা হয়ে গেল বন্ধ। কষ্ট হতো ভীষণ মনে। এখন বুঝি ওটাই ছিল নেশা। কষ্ট হলেও নেশাটা বন্ধ হয়েছিল, আর জীবনে কোনোদিন কোনো নেশা আমাকে টানতে পারেনি। হাজার শুকর জানাচ্ছি আল্লাহ রাব্বুল আল-আমীনের কাছে। কিন্তু শৈশবে আনন্দ করার শেষ বলে কিছু নেই। নানান আনন্দ, নানা রকম।
এমন কোনো দিন আমাদের ছিল না যেদিন আমরা সবাই দল বেঁধে, মুক্ত পরিবেশে, খেলাধুলায় মাতিনি। কত রকম খেলা!— ডাংগুলি, সেভেন টাইম, হাডুডু, দাঁড়িয়াবান্দা, ব্যাডমিন্টন, ফুটবল, ভলিবল, ক্রিকেট সব, সব ছিল। স্কুল ছুটির পরে বাসায় এসে চাট্টি খেয়েদেয়ে দৌড়। মাগরিবের আযানের সাথে সাথে বাড়ি ফেরা। ছুটির দিনে দুপুর বাদে খেলা চলতোই।
হায়রে এখনকার ছেলে মেয়েরা খেলার মাঠই পায় না। স্কুল করে বাসার ভেতরে, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় করে বহুতল ভবনে। খেলবে কোথায়! মনে পড়ছে আমার শিক্ষালয়গুলোর কথা— টাইগারপাস কিন্ডারগার্টেন স্কুল, চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল, পাহাড়তলী রেলওয়ে স্কুল, চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল বুয়েট কি বিস্তৃত তাদের চৌহদ্দি। মুক্ত বিহঙ্গের মত ছুটে বেড়াতাম আমরা।
মেয়েরাও তো ঘরে বসে থাকতো না। মাঠের আশপাশে তারাও খেলতো-চুকিতকিত খেলাতে আমাদের ডাকতো কখনো কখনো। এক্কা দোক্কা তো খেলেছি ওদের সাথে। কুমিল্লার ফজলুর রহমান সাহেব, আব্বার সহকর্মী। পশ্চিমের বাসাটায় থাকতেন। তাঁর সম্ভবত ছেলে মেয়ে ছিল আট জন। তাদের মধ্যে দু’জন মিনু আর রুবি আমার প্রায় সমবয়সী, ওদের সাথে কতদিন কড়ি খেলেছি। খেলতে খেলতে রাগারাগি, ঝগড়া, কড়ি নিয়ে কাড়াকাড়ি-এসব ভোলা যায়! একদিন তো কড়ি কাড়াকাড়িতে গিলে ফেলেছিলাম একখান কড়ি!
শৈশবকাল বড়ই বৈচিত্রময় এবং রঙিন। মুক্ত প্রজাতির মত চিন্তাহীন মনে কতকিছুই না করার ইচ্ছা জাগে, ইচ্ছে মত করাও হয় কখনো সেসব— তাতে আনন্দে বুক ভরে-আবার বাধা পেয়ে কখনো কান্নায় ভাসে বুক। তার পরও মনে হয় যাই ফিরে সেই শৈশবে। মানব জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় বোধকরি শৈশবই।
বাড়ির ভেতরে ছিল আম গাছ, আগেই বলছি। আরও একটা আম গাছ ছিল ফজলুর রহমান চাচার বাসা আর আমাদেরটার মাঝখানটাতে। সাথে ছিল একটা জাম গাছ। কালো জাম। এগুলো প্রিয় ফল আমার। বিশেষ করে সে সময় কাঁচা আম খাওয়ার জন্য দল বেঁধে-এগাছ ওগাছ ঘুরতাম। মনে পড়ে কে যেন শিখিয়ে দিয়েছিল কাঁচা আম কাটার জন্য ঝিনুক ঘষে ছিলানী তৈরি করাটা। গাছে বসে বসে-পকেট থেকে কাগজে মোড়া লবন-মরিচ মিশানো মশলা বের করে রসিয়ে রসিয়ে খাওয়া চলতো আমাদের।
মনে পড়ে খেলার সাথী হাদিদের বাসার একটা ফজলি আমের গাছ ছিল। ওর আব্বা শখ করে লাগিয়েছিলেন গাছটা। ওদের বাড়ি ছিল আমাদের কিন্ডারগার্টেন স্কুলের ঠিক পেছনে। বেড়ার বাড়ি। রেলের অনেক কোয়ার্টার তখন বেড়ার তৈরি ছিল। তো বাড়ির সাথে বাগানে বেশ কয়েকটা আম ধরেছিল সেবার। আমার ভীষণ লোভ হয়েছিল ওর প্রতি। আম শুনেছি মিষ্টি। ব্যাস একদিন বৈশাখের দুপুরে, খাঁ খাঁ রৌদ্রে, সবাই যখন দিবানিদ্রায়, বিশ্রামে, আমি একটি আম না বলে পেড়ে নিয়ে দৌড় (এটাকে চুরি বলা ঠিক হবে না) এবং লুকিয়ে বাসায় নিয়ে এসে একা একা পুরো আমটাই খেয়েছিলাম সেদিন। আম খাওয়ার এই আনন্দ বোধ করি আর কোনোদিন পাইনি। তবে জীবনে আর কোনোদিন পরের ধনে লোভ হয়নি এ কথা হলফ কর বলতে পারি।
আব্বা সারা বছরই কোনো কোনো সময় ট্যুরে যেতেন পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন স্থানে। রাজশাহী দিনাজপুর গেলে আম লিচু আনতেন ঝুড়ি ভর্তি। খাটের তলায় আম্মা সাজিয়ে রাখতেন আম। সেই আম চুরিও আমার টার্গেট ছিল। টুক করে সরিয়ে আড়ালে একটি আম নিয়ে প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে দিতাম দৌড়। বাইরে পাহাড়ের পাদদেশে বিশাল বটগাছটার তলায় নিরিবিলিতে সেটা সাবড়ে মুখ মুছে বাড়ি ফিরতাম যেন কিছুই হয়নি। এগুলো পরের ধন তো নয়!
আব্বার পাখি শিকার দেখে যেমন বন্দুক কেনার জন্য পাগল হয়েছিলাম, তেমনি উৎসাহ জেগেছিল মাছ ধরার। আব্বা ছিলেন নিয়মিত মাছ শিকারী। কোথায় কোথায় না যেতেন। সেই ধলঘাট, ভেঙ্গুরা, হাটহাজারী, সীতাকুণ্ড, কৈবল্যকর্ম, সীতাকুণ্ড যেখানে খবর পেতেন মাছের সেখানেই ছুটতেন ছিপ নিয়ে। আব্বার ছিল নানান রকম সব ছিপ। কলেজে পড়ার সময় একবার সাথে করে নিয়ে গিয়েছিলেন আমাকে। সারাদিন রোদে বসেও আব্বার ছিপে এলো না মাছ। আমি বিরক্ত হয়ে আর মাছ ধরতে যাইনি কোনোদিন আব্বার সাথে। তবে এখনও ছোট মাছ ছিপ দিয়ে ধরে আনন্দ পাই প্রচুর। এবং কোথাও সুযোগ পেলেই বসে যাই।
আমাদের পাড়াতে একটি পুকুর ছিল আমবাগানে। শখ হলো ওখানে মাছ ধরবো। আমি দু পয়সা দিয়ে বড়শি কিনলাম দুটো। আর একজন জোগাড় করে ফেললো দুটো কঞ্চি। তাই নিয়ে বসলাম পুকুর ঘাটে কেঁচো নিয়ে। বয়স তখনো দশ হয়নি। পুঁটি মাছ ধরে দিয়ে দিতাম বন্ধুকে। ছিপ ও ওর কাছেই রাখা হতো। উদ্দেশ্য বাড়িতে যেন না যায় খবর। কারণ একমাত্র পুত্রের পানির কাছে যাওয়া ছিল নিষিদ্ধ। সাঁতারও ওই পুকুরে লুকিয়ে শেখার চেষ্টা চলছিল। কিন্তু ঠিক ওই সময়ই জনৈক ব্যক্তির পুকুরে ডুবে মৃত্যুর কারণে তাও বন্ধ হয়ে গেল চিরতরে। আজও জানি না সাঁতার কাটতে।
পরে একজন খবর দিল এক বিশেষ জায়গায় মাছ ধরার ব্যবস্থা আছে। ঝাউতলার ওই দিকে পাহাড় কাটা হয়েছে, সম্প্রতি তাতে বৃষ্টির পানিতে একটি ডোবার মতো সৃষ্টি হয়েছে। সেখানে কি এক মাছ ছেড়েছে কন্ট্রাকটর। পরে জেনেছি তেলাপিয়া মাছ হয়েছে প্রচুর। বঁড়সি ফেললেই শিওর শট।
সেখানে গেলাম লুকিয়ে। মাছও ধরলাম দু’চারদিন। সে খবরও বাড়ি পৌঁছাল সময় মত। আম্মা কান্নাকাটি করে কসম দিয়ে নিষেধ করলেন-এর পর ওই বয়সে আর পানির কাছে যাইনি আমি। আর এখন তো এক ধরনের ফোবিয়া কাজ করে। নৌকাতে চড়তেও হাত পা কাঁপে। এই সেদিনকার কথা, RAB প্রযোজিত সিনেমা অপারেশন সুন্দরবন ছবিতে খুব ভাল একটি চরিত্রে অভিনয়ের অফার ফিরিয়ে দিলাম। শুধু স্পিডবোটে চড়ে খুলনা থেকে সুন্দরবনে যেতে হবে সেই ভয়ে। বিয়ের পর নৌকায় যখন শ্বশুরবাড়ি বেরাইদে যেতাম, তখন আমার সহায় হতো শিরী। ওতো সাঁতারে ওস্তাদ। বলে দিত, যদি নাও ডোবে ভয় পেয়ো না, শুধু আমার শরীরটা ছুঁয়ে থাকবে। আমি তোমাকে টেনে নিয়ে যাবো। আল্লার নাম জপতে জপতে নৌকায় চড়েছি অনেকবারই। পার হয়েছি তাঁর কৃপায়। এখন তো বেরাইদে যাই মোটর গাড়ি চড়ে, একশ ফুট চওড়া ভিআইপি রাস্তা দিয়ে।
মান্নাফ চাচার কথা বলেছি না, ওই যে আমাদের বাসার একটা ঘর যাঁর নামে বরাদ্দ ছিল। একদিন বললেন—
‘সিনেমা বানাবে?’
অবাক আমি। আব্বা আম্মার হাত ধরে দু’একটা সিনেমা দেখেছি— তার আগে চাচাই নিয়ে গিয়েছিলেন একদিন, সে গল্পও করেছি কোথাও।
‘কীভাবে?’ বিস্ময়ভরা কণ্ঠে জিজ্ঞেসা করেছিলাম আমি।
‘দেখাচ্ছি। একটু চুন নিয়ে এসো তো।’
কথাটা বলে তিনি ঘরের কোনায় পড়ে থাকা এক টুকরো কাচ তুলে নিলেন হাতে। আমি দৌড়ে গিয়ে আম্মার পানের বাটা থেকে বেশ একগাদা চুন নিয়ে এলাম আঙ্গুলের ডগায়।
বেশ বাহাদুরীর হাসি মুখে নিয়ে চাচা ভাঙ্গা কাচের ওপর চুন দিয়ে আমার নামটা (রবি) লিখে, নির্দেশ দিলেন আমায়-
দরজা জানালা বন্ধ কর।
ছুটে গিয়ে পালন করলাম তাঁর আদেশ। অন্ধকার হলো ঘর। তিনি তাঁর টর্চটা বের করে কাচটা এক হাতে খাড়া করে ধরে অন্য হাতে টর্চটা জ্বালিয়ে আলো ফেললেন সেই কাচে। দেখ, ম্যাজিক দেখ।
সাদা দেয়ালের দিকে ইঙ্গিত করলেন চাচা।
দেয়ালে ফুটে উঠলো আমার নাম।
টর্চটা কাছে দূরে করে দেখালেন-নামটা ছোট বড় হচ্ছে সেই সাথে।
আমি তো হাঁ।
এরপর ওই কাঁচটায় একটার পর একটা ছবি আঁকলেন আর দেখাতে থাকলেন ম্যাজিক। আমি তো চমৎকৃত, বিস্ময়ে হতবাক।
এর মধ্যে চাচা বাসা পেয়ে চলে গেলেন এক সময়। কিন্তু আমার মাথা থেকে ওই ম্যাজিক বিদায় নেয়নি একেবারে। অনেক ভাঙ্গা কাচ জোগাড় করে এক সময় মায়ের পান খাওয়ার চুন দিয়ে নানান ছবি এঁকে একা একা ছায়াছবি প্র্যাকটিস করতাম। চাচাই শিখিয়েছিলেন মাছ, পাখি, বাড়ি, গাছ, মোটরগাড়ি, সূর্য ইত্যাদি আঁকা।
হঠাৎ একদিন কোথায় যেন একটা বেশ বড় মতন জানালার ভাঙ্গা কাঁচ হাতে এল আমার। ওতেই ছবি আঁকলাম চুন দিয়ে। মাথায় ঢুকলো আবার সেই সিনেমার পোকা। এবার আমি একাই ঘর বন্ধ করে ব্যবস্থা করে ফেললাম ছবি দেখাবার। দর্শক আমার সব খেলার সাথী। টিকেট দু’পয়সা, চার পয়সা।
মোশারফ নামে আমার সমবয়সী এক খেলার সাথী ছিল। ওর সাথে কেন যেন আমার একটা বৈরী সম্পর্ক ছিল আগাগোড়া। সে এল একদিন ছবি দেখতে-সিনেমা। আমি তাকে বেচবো না টিকিট। কিন্তু সে টিকেট কিনবেই! টিকেট তৈরি করতাম আব্বার নিয়ে আসা রেলের টাইম টেবলের পাতা টুকরো করে কেটে— তাতে আমার সই দিয়ে। হ্যাঁ সেই বয়সে রপ্ত করেছিলাম একটা জব্বর সইও।
মোশারফ ভীষণ ক্ষিপ্ত হয়ে জোর করে ঘরে ঢুকে লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে গেল আমার সব সিনেমার জিনিসপত্র। আমি পাড়া মাথায় করলাম কান্না কাটি করে। জারী হলো আম্মার কড়া নির্দেশ। আর সিনেমা নয়। ঢের হয়েছে, স্কুল পাশ করার পর মোশারফের আর খোঁজ খবর পাইনি। সম্পর্কটি কিন্তু আমাদের সবসময় অমনই ছিল। একটু বোধহয় গোঁয়ার ছিল সে-তাতেই আমরা অনেকে তাকে এড়িয়ে চলতাম।
ক্যামেরার ম্যাজিক ত্যাগ করলেও ক্যামেরার প্রতি আমার সখ জন্মেছিল সে সময়। আমাদের বাসায় ঠিক পেছনের সারির এক বাসায় বাস করতেন এক বাঙালি খ্রিস্টান পরিবার। ভদ্রলোককে আমরা ডাকতাম দাদাবাবু আর ওঁর স্ত্রীকে দিদি। বাড়ি ছিল ওঁদের কৃষ্ণনগর। বড় সুন্দর বলতেন বাংলা। দাদাবাবুর একটা ক্যামেরা ছিল। খুব সম্ভবত ইয়াশিকা। যেকোনো কারণেই হোক আমাদের পরিবারের সাথে ভীষণ নিকট সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। দাদাবাবুরা প্রায় আমাদের নানান জায়গায় বেড়াতে নিয়ে যেতেন। আমার আর আমার বোনদের অনেক সুন্দর সুন্দর ছবি তুলে দিতেন। মুগ্ধ হয়ে যেতাম সেসব ছবি দেখে।
মনে পড়ে, তখন আমি একটু বড় হয়ে গেছি আমার দুই বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। আরো দুটি ছোট বোন এসেছে আমাদের সংসারে-আমি বহু সাধ্য সাধনা করে একদিনের জন্য দাদাবাবুর কাছ থেকে ক্যামেরাটা ধার নিলাম।
একটা কোডাক ফিল্ম কেনার জন্য আব্বার কাছে প্রচুর ঘ্যান ঘ্যান করে এক টাকা চার আনা পেয়েছিলাম। ওই রিলে তখন মাত্র বারোটা ছবি তোলা যেত। প্রথমেই ছবি তুললাম আব্বার আর আম্মার। আম্মার ছবি তোলা গিয়েছিল বহু সাধ্য সাধনার পর। মমতাজ পুতুলের ছবিও তুললাম, আর কে যেন আমার কয়েকটা ছবি তুলে দিয়েছিল। সেই আমার জীবনের প্রথম ক্যামেরায় হাত দেওয়া।
চার বোনের এক ভাই হওয়ায় যেমন আদূরে আর আহ্লাদে ছিলাম, তেমনি ছিলাম দুৰ্বল। মানসিক এবং শারীরিক দুভাবেই। তারপরও চঞ্চল বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে গাছে চড়া শিখেছিলাম। বেশি দূর উঠতাম না— মাঝামাঝি পর্যন্ত যাওয়ার পর সুবিধামত ডালে বসে পড়তাম। ফলের গাছে চড়াটাও আমাদের ছিল নিয়মিত বিষয়। গাছে বসেই কাঁচা আমের শ্রাদ্ধ হতো আমাদের দিয়ে। জাম গাছে উঠতাম না-আম্মার নিষেধ। জাম গাছ নাকি খুবই নরম— যে কোনো সময় ডাল ভাঙ্গার সম্ভাবনা থাকে। কুল (বরই) গাছে উঠে গা হাত পা কাঁটায় ছড়েছি বহুবার। পেয়ারা গাছ তো আমাদের বাগানেই ছিল। প্রায় রোজই ওঠা হতো। ভাল কথা মনে পড়লো— কুলের বিচিগুলো প্যান্টের পকেটে জমিয়ে রাখতাম। পরে সেগুলো পাটায় ভেঙ্গে ভেতরের শাঁসটা খেতাম। বড়ই আনন্দ ছিল এ কাজে!
প্রায় রোজ রাতে বাদুড় এসে পেয়ারা খেয়ে ফেলতো। একদিন আমার সেই এয়ারগান দিয়ে মেরে দিলাম একটা বাদুড়। তারপর ওটা ওখানেই শুকিয়ে পচে ঝুলে রইল দীর্ঘ সময়ের জন্য। ফলে বাদুড়গুলো আর ওখানে আসেনি কখনো।
ছোটবেলায় নানারকম অপকর্মের সাথী হয়ে যেত আমাদের কাজের ছেলেটা— জহির। বড় খলিফা ছেলে ছিল সে। বয়সে আমার চেয়ে বড়ই ছিল। সে আমাকে শিখিয়েছিল কীভাবে আম গাছের কচি পাতা দিয়ে বাঁশি বাজাতে হয় (এখন পারি না আর), কীভাবে কাঁচা আমের আঁটি দিয়ে ভেঁপু বাজানো সম্ভব। শৈশবের এই সব স্মৃতি বড়ই আনন্দ দেয় এই বৃদ্ধ বয়সে। সেই যে আমার নানা রঙের দিনগুলি রইলো না…..।
সেই সময়কার খেলার সাথীদের নাম বেশ কিছু মনে আসছে এখন। এদের কেউ সমবয়সী, কেউবা ছোট বা বড়। সবাই আমরা খেলার সাথী। সমবয়সীদের মধ্যে ছিল মিন্টু (জামালুদ্দিন হোসেন) আর ছোট মিন্টু। বন্ধু জামাল লম্বা হওয়ায় ওকে সবাই লং মিন্টু বলতো। এ ছাড়া বেবি, মুকুল, সেলিম, মিজান, কামাল, মাহবুব, নান্না (অবাঙালী), বাবুল, লালু, সাজু, রেজাউল, সালাম, চেমা, আরও অনেকে।
এদের অনেকেই পরবর্তীতে ভালভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে জীবন পথে। অনেকে হযতো জীবন সংগ্রামে পরাজিত। অনেকেই হয়তো ঝরে পড়েছে স্বাভাবিক জীবন থেকে। এটাই অমোঘ নিয়ম। কেউ পারে, কেউ পারে না। বাবা মা তাদের নিয়ে কত স্বপ্নই দেখেন— সব কি আর বাস্তবায়িত হয়?
দুষ্টুমির এক গল্প মনে পড়ে গেল হঠাৎ। আমি আর এক খেলার সাথী, নামটা মনে করতে পারছি না, একদিন চার পয়সার ছটা আকিজ বিড়ি কিনে মতি ঝর্ণায় গিয়ে ফুক ফুক করে সব কটা সিঁড়ি ফুঁকলাম। জীবনে প্রথম। না ঠিক প্রথম বলা যায় না। একদম ছোট বেলায় মানাফ চাচা এক পাফ খাইয়েছিলেন আমায়!
তো সিঁড়ি তো আনন্দেই ফুঁকা হলো— তারপরও মনে হলো-এখন মুখের গন্ধ নিয়ে বাড়ি যাবো কী করে! ধরা তো নির্ঘাৎ। শেষে প্রচুর কলাপাতা আর লেবু পাতা চিবিয়ে অনেক-অনেকক্ষণ পর ফিরলাম বাড়ি। সেদিন আর সহজে কারো সাথে কথা বলিনি, ধরা পড়ার ভয়ে। ধরা সেদিন পড়িনি— তবে সিগারেট ধরালাম কলেজে ঢুকে— কখনো কখনো একটা দুটো কিনে খেতাম— কেবলই কলেজে। পাকাপোক্ত ধরা হলো প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর!! গত তিরিশ বছর অবশ্য আমি ‘আধুনিক’ (আমি ধুমপান নিবারণ করি)। ১৯৯২ থেকে No smoking।
এখন ভাবতে অবাক লাগে শৈশবে আমাদের বন্ধুবান্ধবের মধ্যে তখন তেমন বই পড়ার আগ্রহ ছিল বলে মনে পড়ছে না। কারণ আমাদের মধ্যে বই চালাচালি ছিল না। একমাত্র লং মিন্টুকে দেখতাম, স্বপন কুমারের ডিটেকটিভ বই-এর পোকা ছিল সে, ছ’আনা দামের সিরিজ বই। প্রতি মাসে কলকাতা থেকে আসতো। ওর কারণে আমিও আসক্ত হয়েছিলাম এই বইয়ে। আমাদের মধ্যে লেনদেন ছিল এই বইএর। আর আব্বা আমার জন্য বাচ্চাদের মাসিক পত্রিকা ‘শুকতারা’-এনে দিতেন। অবশ্যই আনতেন বার্ষিক সংখ্যাটা। আব্বা ছিলেন বই-এর পোকা, ক্লাবের সেক্রেটারি হিসেবে প্রচুর বই পড়ার সুযোগ ছিল তাঁর-পরবর্তীতে আমারও নেশা পুরোপুরি ধরেছিল আব্বার কারণে। তবে সে সময় পড়া একটা বইয়ের কথা বলতেই হয়-মনে হয় ফাইভ সিক্সে পড়ি, কে একটা ‘আম আঁটির ভেঁপু এনে দিয়েছিল। বিভূতি ভূষণের পথের পাঁচালির সংক্ষিপ্ত এডিশন-বাচ্চাদের জন্য। পড়ে কেঁদেছিলাম খুব। দুর্গার মৃত্যু ভীষণ নাড়া দিয়েছিল মনটাকে।
আব্বা আমার কাছে ছিলেন একজন সব্যসাচী, বিচিত্র সব কাজ কর্মে ব্যস্ত থাকতেন। তার মধ্যে অন্যতম ছিল বন্দুক দিয়ে শিকার-পাখি থেকে শুরু করে বাঘ-হরিণ পর্যন্ত— তবে তাঁর মুন্সিয়ানা ছিল ঘুঘু শিকারে। আমি সেই ছোট্টবেলা থেকে সঙ্গে যেতাম তাঁর শিকারে। খুব ভাল লাগত পাখি গুলি খেয়ে পড়লে দৌড়ে গিয়ে তাদের ধরতে। আব্বার সাথে শ্রীমঙ্গলে হাওরে গেছি বালিহাঁস শিকারে। তখন দেখেছি পরিযায়ী পাখিদের ঝাঁক। ছাতক ও গিয়েছিলাম একবার। দিনভর নৌকায় হাওরে। অদ্ভুত অনুভূতি।
একদিনের কথা মনে পড়ছে— ঘুঘু শিকারে গেছি আমরা-তখন আমি দশম শ্রেণির ছাত্র। গাছের ঝোপে দুটি ঘুঘু দেখে আব্বা বললেন তুমি মারো। আমার তো হাত কাঁপা শুরু হয়েছে— সাহস দিলেন আব্বা-
শুরু তো একদিন করতে হবে, আজই হয়ে যাক দেখি।
বন্দুক হাতে দিয়ে আব্বা আমার পেছনে দাঁড়ালেন-যেন পেছনে পড়ে না যাই বন্দুকের ধাক্কায়।
বিসমিল্লাহ! বলে দিলাম ট্রিগারে টিপ। ধুম! দুটোর মধ্যে একটা স্পট ডেড। অন্যটা পালালো।
আব্বার বন্ধু সাখাওয়াৎ সাহেব বলে উঠলেন-
ফিফটি পারসেন্ট শিওর শট। নট ব্যাড।
সেই শুরু, এরপর বহু পাখির প্রাণ হরণ হয়েছে আমার দ্বারা। এক সময় বোধোদয় হলো-এটা ঠিক হচ্ছে না— ব্যাস— ফুলস্টপ দিলাম এই কর্মে। এখন ভাবি কি করে পারতাম এই অপরাধটা করতে। বন্দুকে গুলি ছোঁড়া বন্ধ করেছি, তাও প্রায় পঁয়ত্রিশ চল্লিশ বছর হয়ে গেছে। বন্দুকটা আছে। যত্নেই আছে। আব্বার খুব শখের বন্দুক। ১৯৫০-এ বা ওই রকম সময়ে প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা ধার নিয়ে পাঁচশো টাকায় কিনেছিলেন— আমেরিকার উইনচেস্টার কোম্পানির তৈরি বারো বোরের একনলা বন্দুক, কিন্তু হ্যান্ড রিলিটারে ছটা গুলি ছোঁড়া যায় কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে।
নানান কারণে আব্বার আর কোনো স্মৃতিচিহ্ন নেই আমার কাছে, আছে শুধু ওই বন্দুকটা। তাই ওকে বহন করে চলেছি। এবার মায়া ছাড়তে হবে, বয়স আশি হতে চললো তো— সরকারি নিয়মে এ বয়সের পর ফায়ার আর্মের লাইসেন্স আর দেয়া হবে না আমাকে। আমার উত্তরসূরিদের জিজ্ঞাসা করেছি— কেউ উৎসাহী নয় এটার দায় বহন করতে— সুতরাং একমাত্র উপায় সরকারের মোহাফেজ খানায় জমা দেয়া। দেখি কী করি।
হুঁ, বড় কষ্ট হয়, ক্ষুব্ধ হই নিজের ওপরই— আব্বার চশমাটা, ঘড়িটা, না একটা চিঠি, একজোড়া জুতা, একটা প্যান্ট কিংবা জামা— কিছুই রাখতে পারলাম না। হঠাৎ করেই সব ছেড়ে ছুড়ে লিবিয়া চলে যাওয়ায় সব এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল-নইলে হয়তো ভুগতে হতো না আজকের এই হতাশায়। হঠাৎ সেদিন একটু আলোর দেখা পেলাম। ড্রয়ার হাতড়ে আব্বার ব্যবহৃত দুটো পিতলের পেপার ওয়েট পাওয়া গেল।
আহা কি আনন্দ। আজ তারা আমার স্টাডি টেবিলে শোভা পায়।
হতাশাকে সরিয়ে দিয়ে দুটো আনন্দের কথা বলা যাক আবার। ফুল কুড়ানো যেমন প্রিয় কাজ ছিল আমার, ফল পাড়াটা বা কুড়ানোটাও কম প্রিয় কাজ ছিল না।
টাইগারপাসে রাস্তার ধারে বেশ কটা জামরুল গাছ ছিল। থোকা থোকা সাদা জামরুল ভরা থাকতো মৌসুমে। একটু বড় না হতেই আমরা হামলে পড়তাম সেই গাছে। বাড়ির একেবারে কাছেই ছিল তিনটে খেজুর গাছ। খেজুর পাকলেই আমি তীর্থের কাকের মত সময় গুনতাম— কখন পাকা খেজুর পড়বে, আর তুলে নিয়ে গপ করে মুখে পুরব। শীতের দিনে তিনটে গাছেই রসের হাঁড়ি বাঁধা হতো— গুলতি দিয়ে সে হাঁড়ি ফাটিয়ে উপরমুখী হয়ে রস খেয়ে বকুনীও কম খাইনি। পাড়ার বড় ভাইরা আমাদের দিয়ে এ অপকর্ম করাতো।
ছোট্টবেলাটা নানা কারণেই রঙ্গীন হয়ে আছে। সবারই তাই থাকে নিশ্চয়। কারো কোনো দায়দায়িত্ব নেই। প্রকৃতির মাঝে অবাধ বিচরণ (বিশেষ করে আমার ক্ষেত্রে, চার বোনোর এক ভাই হওয়ায়)— অপরাধের শাস্তি নেই বললেই চলে। নানা আশ্রয় প্রশ্রয়ে পড়াশুনাটা লবডংকা। ভাল ছেলে, সুশীল বালক, প্রতি বছর পাশ করছে— কিন্তু ছাত্র হিসেবে বড়ই করুণ অবস্থা। গৃহশিক্ষক ছিলেন— কিছুই শেখাতে পারেননি। এখন বুঝি তাঁর সে যোগ্যতাই ছিল না— পরে এলেন সাময়িক শিক্ষক— তিনিও ফিটফাট বাবু— আমার কথায় উঠবস করতেন— চাকরি হারাবার ভয়ে। তাই মার্কশীটে লালকালি না পড়লেও নম্বরের ঘরগুলো দুঃখ দুর্দশায় ভুগতো। আসলে পড়তে বসাটা আমার কাছে মনে হতো বিশেষ যন্ত্রণাদায়ক ব্যাপার।
শিক্ষকের দোষই দিয়ে গেলাম কেবল, দুঃখিত আমি। ক্লাস টেনে পড়ার সময় টেস্টের আগেই আক্রান্ত হলাম জলবসন্তে। ভুগলাম প্রায় দু’মাস। টেস্ট পরীক্ষাতে প্রকাশ পেল আমার আসল মেধা। ফলে স্কুল বদল এবং কঠিন অভিজ্ঞ ও উপযুক্ত শিক্ষক নিয়োগ হতে দেরি হলো না আর। ফল-ম্যাট্রিক, ইন্টার ভালভাবে উত্তানো এবং বুয়েটে ভর্তি। স্যারের নামটা আজ কিছুতেই স্মরণে আসছে না। কিন্তু আমার এই জীবনের জন্য তাঁর প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার নেই শেষ।
আজ আমার প্রাইমারি স্কুলের কাদির স্যারের কথাও খুব মনে পড়ে— স্যার বহুবার বলেছিলেন আমাকে—
‘হোলা হরে না যে, হইল্লে হারে।’
আমার শেষ প্রাইভেট শিক্ষক প্রমাণ করে দিয়েছিলেন সেটা হাতে নাতে। কোন কথা থেকে কোন কথায় চলে এলাম। শৈশব? হ্যাঁ। কথায় কথায় শৈশব আজ উজ্জ্বল হয়ে আসছে স্মৃতির পাতায়। বৃদ্ধ বয়সে এটাই হয়। নিকট অতীত ভুলে দূরের অতীত চলে আসে নিকটে।
আব্বার কথায় ফিরে যাই। খুবই শিল্পমনা ছিলেন মানুষটা। রেলওয়ের কর্মচারিদের ক্লাবের সেক্রেটারি হয়ে নানান রকম কার্যক্রমে রেখেছিলেন তার প্রমাণও। টাইগারপাসে তাঁর প্রতিষ্ঠিত গার্লস হাইস্কুল এখনও তাঁর ক্রিয়াকর্মের উজ্জ্বল নিদর্শন হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। ফুল ছিল তাঁর প্রিয় বস্তু। অতি প্রিয়। তাঁর কারণেই আমাদের ফুল বাগান সারা বছরই ফুলে ফুলে থাকতো উজ্জ্বল হয়ে। বেলি, গোলাপ ছাড়াও মৌসুমী ফুলের চাষ ছিল আমাদের নৈমিত্তিক ব্যাপার।
বিপাশা আব্বার এই গুনটি পেয়েছে ছোট্টবেলা থেকে। ফুল দেখলে ওকে কেউ ঠেকাতে পারতো না। কাছে গিয়ে ঘ্রাণ নিতো, আর সাথে সাথে চোখ মুখ আনন্দে উদ্ভাসিত হতো তার। সে যে চিত্রশিল্পী হবে বোধহয় সেটারই ইঙ্গিত ছিল এতে।
মনে পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবরেটরি স্কুলে ভর্তি হয়ে (সেই কেজিতে) প্রায় প্রতিদিন একটি ফুল প্রিন্সিপালের ঘরে গিয়ে তাঁর হাতে দিয়ে আসতো। সৌন্দর্যবোধটি সে পেয়েছে তার দাদার কাছ থেকে। তার প্রমাণ রেখে যাচ্ছে এখনও।
আব্বার হাতের কাজ ছিল দেখার মতো। এত সুন্দর কাগজের ফুল কাটতে পারতেন কী বলবো। স্বাধীনতা দিবস এলেই-নিজে রঙ্গীন কাগজ, দড়ি, আঠা, (বাবলা গাছের) কিনে নিয়ে আসতেন— বলতেন গেট বানাতে— ছুটে যেতাম পাহাড়তলী—দেবদারু গাছের ডাল সংগ্রহ করতে— খালেক চাচাকে ডাকা হতো বাঁশের বেড়া দিয়ে গেট তৈরি করতে-রাত জেগে গেট সাজাতাম পাতা আর আব্বার রঙ্গীন কাগজ কাটা ফুল দিয়ে-তিনকোনা নিশানও তৈরি হতো। পতাকাও একটা কিনে এনে লাগানো হতো গেটের মাথায়। আজকাল আর এসবের চল নেই। ফ্ল্যাট বাড়িতে করার সুযোগই বা কোথায়! কোনো রকমে একটি পতাকা গুঁজে দেয়াই সব এখন।
খালেক চাচার কথাটা একটু বলি। বয়স ওনার চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ হবে যখন প্রথম দেখেছি তাঁকে। পরে অবশ্য প্রায় প্রতি বছরই দেখতাম। বেঁটেখাটো মানুষটা। খুক খুক করে কাশিটা ছিল তাঁর ট্রেডমার্ক, সেই সাথে অনবরত সিঁড়িতে টান। বাঁশের বেড়া বোনায় দারুণ অভিজ্ঞতা ছিল তাঁর। একেবারে নিখুঁত। প্রথম দেখি যখন আমাদের বাগানের বাউন্ডারির বেড়া বানালেন তিনি। তারপর প্রায় প্রতি বছরই আসতেন মেরামত কাজের জন্য। বেশি পুরোন হয়ে গেলে তৈরি করতেন নতুন বেড়া।
গল্প করা পছন্দের কাজ ছিল তাঁর। কাজ আর কথা। আমার ভীষণ আগ্রহ ছিল এইসব কাজ দেখার। লেখাপড়া, খেলাধুলা, খাওয়াদাওয়া ভুলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতাম চাচার সাথে। প্রতিটি কাজ দেখতাম মনোযোগ দিয়ে। কী নিপুন শিল্পকর্ম সৃষ্টি করতেন খালেক চাচা।
আমাদের রেলওয়ে কোয়ার্টারে বছরে একবার রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করতে আসতো Railway low (inspector of works) এর লোক। তাদের কাজের সময় বাড়ি থেকে নড়তাম না। কীভাবে সিমেন্ট বালি এগ্রিগেটে মেশাচ্ছে— কীভাবে লাগাচ্ছে— কন্নি দিয়ে, চুন গুলছে কীভাবে পানিতে-আবার পাট দিয়ে ব্রাশ তৈরি করে দেয়ালে লাগাচ্ছে-ছাদ মেরামতের সময় বিটুমিন এনে জ্বালিয়ে গলিয়ে ছাদের ফাটায় ঢালছে। এসব ভীষণ আগ্রহ আর আনন্দ নিয়ে দেখা ছিল আমার প্রিয় বিষয়।
সেই প্রথমে কিন্তু আমাদের কোয়ার্টারে বিদ্যুৎ ছিল না। এমন কি বাড়ির সামনে রাস্তা ও অন্ধকার থাকতো রাতে বিদ্যুতের অভাবে। কীভাবে কখন রাস্তায় বিদ্যুতের আলো ফুটলো খুব একটা খেয়াল নেই। তবে মনে আছে ঠিক আমাদর বাড়ির সামনে বাগানের বেড়া ঘেঁষে একটি বিদ্যুত-খুঁটি লাগানো ছিল, তাতে বাতি জ্বললো। সে কি আনন্দের নহর আমাদের মাঝে। বাড়িতে তখনো হারিকেন আর কুপি।
মনে পড়ে প্রচন্ড গরমের সময় রাতে ওই রাস্তার বাতিতে বাগানে পাটি বিছিয়ে পড়তাম। কখনো বাগানের কাজও করতাম। এর কিছুদিন পর শুরু হলো বাড়ির ভেতরের কাজ। আমার এখন পর্যন্ত মনে পড়ে প্রতি ইঞ্চি তার লাগানো আমি প্রখর দৃষ্টি দিয়ে আত্মস্থ করেছি। যেদিন বাড়িতে আলো জ্বললো আমি বোধকরি সবচেয়ে বেশি উপভোগ করেছি সে আনন্দ।
আব্বা একদিন আমার এই পাগলামি দেখে বলেছিলেন—
রবি, তুমি কি ইলেট্রিশিয়ান হতে চাও?
উত্তর দিই নি সেদিন। পালিয়ে ছিলাম বাইরে।
কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হলাম সিক্সে উঠে ১৯৫৪ তে। বয়েস তখন দশ। এ সময়ই হঠাৎ করে একদিন, জুম্মাবারে আমাকে বাড়ি থেকে বেরোতে নিষেধ করা হলো। ব্যাপারটা বুঝে উঠতে না উঠতে জুমার নামাজের পর হাজাম ব্যাটা বাড়িতে এসে হাজির, তারপর যা হবার তাই হলো।
বেশ অনেকদিন স্কুল যেতে হলো না, এটাই লাভের লাভ ছিল আমার। মায়ের পুরোনো শাড়ী পরে ঘুরে বেড়াতাম, আর বড়রা ভেঙাতো আমাকে-আঙুলের ওপরে ছুরি চালানো দেখিয়ে, সে বেশ এক স্মৃতি। স্কুলে ফিরেও ক্লাসে একটা হইচই পড়েছিল এটা নিয়ে-কারণ সাধারণত এত বয়সে বন্ধু বান্ধব কারও খত্না হয় নাই, সবার অতি অল্প বয়সেই হয়েছে কাজটি।
এই চুয়ান্নো সালটা ছিল পাকিস্তানে ধুন্ধুমার রাজনীতির বছর। এ বছর পূর্ববঙ্গ আইনসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। একদিকে মুসলিম লীগ অন্যদিকে যুক্তফ্রন্ট। কয়েকটি দলের সম্মিলিত জোট। যুক্তফ্রন্টের নৌকা আর মুসলিম লিগের হারিকেন। আমরা কি এতশত বুঝি! মিছিলে চিৎকার করতাম বড়দের সাথে না বুঝেই। সে এক বড় মজার বিষয় ছিল, অমুক ভাই, অমুক ভাই, তোমার ভাই আমার ভাই। হাতে সব ছোট ছোট ঝাণ্ডা নিয়ে ছুটতাম আমরা। দারুণভাবে জয়ী হয়েছিল যুক্তফ্রন্ট। এবং তারাই গঠন করেছিল সরকার। এগুলো তো আমাদের বোঝার বিষয় ছিল না। মিছিলে ছিল না ঢিল ছোঁড়াছুঁড়ি, না লাঠালাঠি, কিংবা কোনো বাধা। আমরা খুব উপভোগ করতাম বিষয়টা। তার ওপর আবার একদিন স্কুলে ছুটি পেলাম ভোটের জন্য।
পরদিন স্কুলে গিয়ে দেখি সাদা দেয়ালে সব ছোপ ছোপ অমোচনীয় কালির দাগ। স্কুল ঘর নোংরা রাবিশে ভর্তি, ইত্যাকার সব ব্যাপার। ওই ছিল জীবনে প্রথম কোনো নির্বাচনের অভিজ্ঞতা।
সপ্তম শ্রেণিতে উঠতে না উঠতেই শুরু হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসন। হ্যাঁ, আমেরিকা-পাকিস্তানের হ্যান্ডশেকের ছবিওয়ালা বই চলে এল আমাদের হাতে। কী সুন্দর ছবি আর ছাপা বইতে। শুনেছি এগুলো ছাপা হতো আমেরিকাতেই। সাথে আরো কিছু এলো। টিন ভর্তি সব মাখন, ঘি, দুধ। কী হবে? স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের পুষ্টিপূরণ হবে এতে। পাকিস্তানিরা অপুষ্টিতে ভুগছে— ওদের আমেরিকার মদদ দরকার হয়ে পড়েছে এই পুষ্টি পূরণে।
মাখন ঘি আর চিনি ভরা বড় বড় পাউরুটির দুটো পিস দিয়ে আমাদের দেয়া হতো টিফিন। আর এক মগ দুধ। মগ বাড়ি থেকে আনতে হয়েছিল আমাদের। কী ঘন সেই দুধ, সে সব দুধ খেয়ে কতজন যে পেটের পীড়ায় ভুগলো কিছুদিন! তারপরও আমেরিকান দুধ তো ছাত্রদের বাড়ি বাড়িও পৌঁছেছিল আমেরিকার ঘি আর দুধের বড় বড় কৌটো!
শুধু দুধ মাখনেই শেষ নয়। সেবার ফ্লুও এলো দেশে। সবাই বলতো আমেরিকাই এনেছে, এ সুবাদে তার জন্য ছুটি স্কুল। মজাই মজা। লম্বা ছুটি সব। সিনেমা হল টল বন্ধ। খুব বেশি মনে না থাকলেও আবছা মনে পড়ে সবই। ভীড় এড়িয়ে চলতে বলা হয়েছিল জনগনকে।
এল আমেরিকান টিকা। কলেরার টিকা। স্কুলে ধরে ধরে টিকা দেয়া শুরু হলো। টিকা মানে ইনজেকশন! আমি মহা ভীত। ছোট্টবেলা থেকে ট্যাবলেট আর সুঁইকে ভয় পেতাম যমের মত, ধরা খেলাম স্কুলে। প্রথম দিনেই দিয়ে দিল আমাকে Injection। রাতে ভীষণ জ্বর। দ্বিতীয়দিন সকালে মাঠে এ্যাসেম্বলিতে জাতীয় সংগীত গাইতে গাইতে ব্যাস্। মানে পতন। ফিট। সে নিয়ে কত হাসাহাসি বন্ধুদের।
আর এক ফিটের গল্প বলি এবার। আমি কিন্তু ছোট্টবেলা থেকেই ফিটফাট বাবু। এটা মাথায় অবশ্যি আমার দুই বড় বোনের কল্যাণে। তারা সাজিয়ে রাখতো আমাকে সবসময়, চুলে টেরি কেটে দিত ছোটবেলা থেকেই। তার চেয়ে বড় কথা হলো, আমার আব্বা ছিলেন সদা সর্বদা ফিটফাট। লুঙ্গি-গেঞ্জি হোক বা পাজামা-পাঞ্জাবি— কি প্যান্ট কোট-সব সময় পাটভাঙ্গা কাপড় পরতেন। মাথায় তেল দিতেন নিয়মিত। চুলে টেরি ছিল অবশ্যই। শেষের দিকে দেখেছি ব্যাকব্রাশ। যাই হোক। ছোটবেলা থেকে দেখেছি বাড়ির মানুষগুলো প্রায় সময়ই ইস্ত্রি করা কাপড় পরে। কারণ বাড়িতে নিয়মিত ধোপা আসতো। নামটা মনে হয় (ধরে নি) মতি। মাসে দুবার আসতো। এক গাদা কাপড় নিয়ে যেত, দিয়ে যেত। মতিকে দেখতাম এই লম্বা লম্বা শার্ট পরতো ধূতির ওপর। আব্বাকে একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম— ‘ও এত লম্বা শার্ট পরে কেন?’
‘ওগুলো তো ওদের শার্ট না, বাবা।’
‘তাহলে!’
‘ওরা তো গরীব। মানুষের বাড়ি থেকে ময়লা কাপড় নিয়ে গিয়ে ধোয়, তারপর দশদিন পরে। তারপর ধুয়ে মাড় দিয়ে ইস্ত্রি করে দিয়ে যায়!’
এরপর থেকে ধোপা বাড়ির কাপড় পরার ওপর আমার ভক্তি ছিল নড়বড়ে। আম্মা তো ধোপা বাড়ির কাপড়ে জীবনেও নামাজ পড়েছেন দেখিনি।
আমার কাপড় তো তেমন সুযোগ পেত না ধোপাবাড়ি যাবার-আমি করতাম কী? কাপড় সুন্দর করে ভাজ করে বালিশের তলায় দিয়ে ঘুমোতাম। ওতে অনেকটা কাজ হতো। আর একটু বড় হয়ে রপ্ত করেছিলাম অন্য কায়দা।—
বাসার খুব কাছেই ছিল একটা লন্ড্রী, সেখানে দেখতাম বিরাট আকারের দুটো সলিড লোহার ইস্ত্রি দিয়ে কাপড় ইস্ত্রী করা হতো। একটার ভেতর কয়লা ভরা যেত, অন্যটা ব্যবহার করা হতো কয়লার চূলায় তাতিয়ে নিয়ে। চেয়ে চেয়ে এসব ক্রিয়াকর্ম দেখাটা ছিল আমার শৈশবেরই খেলার অংশ। সিক্সে পড়ার সময় একটা সিনেমা দেখেছিলাম আম্মাদের সাথে। ‘বহুত দিন হুয়ে। এতে নায়ক রতন কুমার একটা বড় কাঁসার বাটি চুলোয় গরম করে-সেটা দিয়ে ইস্ত্রি করছে শার্ট।
ব্যাস, এই বুদ্ধি আমিও প্রায় চালিয়েছিলাম সে সময়। ইলেকট্রিক ইস্ত্রি দেখেছি একদিন মনে পড়ে। ফোর ফাইভেই পড়তাম। কোন এক বড় লোক আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলাম পতেঙ্গার পোর্টট্রাষ্ট এর বাংলোয়। প্লাগ লাগিয়ে এক কর্মচারী কাপড় ইস্ত্রি করছিল— আমি অবাক হয়ে ইস্ত্রিটার চকচকে ধারটাতে আঙ্গুল দিয়েছিলাম গরম হয় কিনা দেখতে আর সঙ্গে সঙ্গে কাজের লোকের বিকট চিৎকার। এই কর কী!
স্মৃতির শেষ নেই। কত বলবো। শৈশব বয়ান করতেই পাতা ফুরিয়ে যাবে বোধকরি। জগতের শ্রেষ্ঠ সময়ই তো এটা। প্রতি পলকের প্রতিটি ক্ষণ আজ মনে পড়তে চাচ্ছে— ঠেলে বেরুতে চাচ্ছে নিজে পথ করে নিয়ে-তাকে রুখবো কী করে জানিনে-মনে পড়ছে নাপিত হরির (মনে করি) কথা। ছোটখাট কালো কুচকুচে মানুষটা। গলায় রুদ্রাক্ষের মত কী যেন দিয়ে মালা তৈরি করে পরতো। ময়লা খাটো ধূতি। শততালি দেয়া ফতুয়ার মত হাত কাটা জামাটা। মাথায় কদম ছাঁট চুল। প্রতি রোববার বাঁধা ছিল তার। আমদের ঘুম ভাঙার আগেই দেখতাম হাজির। আব্বা আগে উঠেই আয়েশে গা এলিয়ে দিয়েছেন তার সামনের চেয়ারে।
এদিনটা আব্বা ওর হাতে শেভ করতেন। কাটাতেন হাত পায়ের নখ। মাসে একদিন চুলটাও কাটানো ছিল নিয়ম। আমার পালা এলে পালাতাম। ধরাও খেতাম। হঠাৎ কী বিশি করে কেটে দিত আমার সুন্দর চুলগুলোকে!!
মনে হতো যেন মাথায় বাটি বসিয়ে ছেঁটে দিয়েছে। বন্ধুমহলে এ নিয়ে হতো হাসাহাসি। এই অবসরে আর একটা মজার খেলার কথাও মনে পড়ে গেল। মেশিনে সেমাই বানানো। তখনকার দিনে এটা রেওয়াজ ছিল। ঈদ এলেই বাড়ি বাড়ি ঈদের জন্য সেমাই বানানোর ধুম পড়ে যেত। হয়তো গোটা পাড়ায় মেশিন ছিল একটা কি দুটো। সেটাই ঘুরে ঘুরে সব বাড়িতে যেত। টেবিলে মেশিনটা স্ক্রু দিয়ে টাইট করে বসানো হতো। এক মুখ দিয়ে ময়দার লেই ঢোকানো হত, অন্য মুখ দিয়ে সেমাই বেরুতো। এই সেমাইটা পাওয়ার জন্য একটা হ্যান্ডেল ঘোরানো হতো। এই কাজটি করতাম আমরা ছোটোরা। আহা কি আনন্দ।
হ্যাঁ, যা বলছিলাম, তখন যেমন রাগ হতো আমার ওই হরির ওপর তেমনি রাগতাম ইকবালের ওপর। ইকবাল ছিল খলিফা। পাড়ায় দর্জির দোকান বলতে ওই একটিই ছিল তখন। যত ভীড় সব ওর কাছেই। একটা জামা ওকে বানাতে দেওয়া হলো কি চৌদ্দবার চৌদ্দদিন ধরে ধরণা দিতে হতো সেই কাপড়ের জন্য। উহ! অসহ্য লাগতো।
‘এই তো হো গেয়া ভাইয়া! কাল সুবাহকো লে যাও।’
কী মোলায়েম গলায় প্রতিবারই এক কথা, সুবা না হয় শাম।
আমাদের সময়টাতে ন্যাংটো বেলায় কোমরে কালো সূতোয় তামার ফুটো পয়সা ঝুলিয়ে দৌড়ে বেড়ায়নি এমন শিশু কচিৎ কখনো হয়তো দেখা যেতো। কিন্তু আমার একজন আব্বা ছিলেন— যিনি পীরের পুত্র অথচ অত্যন্ত প্রগতিবাদী ফলে ওসব তাগা তাবিজ আমার গলায় বা কোমরে ঝোলাবার সুযোগ পাননি আমার নানা বাড়ির মানুষজন। কিন্তু এরাও তো সৈয়দ বংশের মানুষ— পানি পড়া— দোয়া ফোঁকা ইত্যাদিতে বিশ্বাসী ভীষণ। মা ও তো এদেরই একজন।
চট্টগ্রামে এক ফকির সাহেবের খুব ভক্ত ছিলেন আম্মা। কীভাবে তাঁর সাথে যোগাযোগ হয়েছিল জানি না, শুনিও নি কোনোদিন। কিন্তু তাঁকে দেখে সেই ছোটবেলাতেই আমার ও খুব ভক্তি হতো। আব্বা এসব না মানলেও শ্রদ্ধাটা তাঁর প্রতি আব্বার পুরোপুরিই ছিল। এই ফকির সাহেবের নাম ছিল ‘আল্লায় দিব’। এটাই তাঁর ছিল জিকিরের বুলি। সেলাই ছাড়া দুই পিস সাদা কাপড় পরতেন। একই কাপড়ের একটা ঝোলা কাঁধে। তখনই বয়স ষাট পঁয়ষট্টির কম তো নয়। মুখ ভর্তি চাপ দাড়ি।
আল্লায় দিব, বুলি নিয়ে চলাফেরা করতেন। মাসে দু’মাসে একবার এসে দেখা দিতেন আম্মাকে। অষুধ দিতেন আমাদের জন্য। কী জন্য জানি না। জানতেন না আব্বাও। ‘তোমার ছেলের শরীর খারাপ। খাওয়াইও।’
আম্মা দিতেন। খেতামও আমি। সবই বিশ্বাসের ভরে।
বাচ্চাদের তিন চাকার সাইকেল চোখে দেখিনি ছোটবেলায়। কিন্তু সাইকেল চড়ার শখ ছিল ষোলো আনা। চেনাজানা কারো সাইকেল দেখলে চড়তে চাইতাম। কিন্তু এক সময় চালানোর শখ চেপে বসেছে মাথায়। বন্ধুরা কেউ কেউ দেখতাম পাড়ার সাইকেল সারাইয়ের দোকান থেকে ঘণ্টায় এক আনা দু’আনায় ভাড়া করে এনে চালানো শিখে ফেলতো। তাদের দেখাদেখি আমিও বাড়িতে লুকিয়ে সেই কাজটিই করেছিলাম। স্কুলের মাঠে শেখার সুবিধাটা ছিল আমাদের। স্কুল তো ছিল বাড়ির সামনের রাস্তার ওপারেই। বড় দুলাভাইয়ের ছোট ভাই তখন আইএসসি পাস করে নাটোর থেকে চট্টগ্রামে এসেছেন মেডিকেল পড়তে। তাঁর জন্য কেনা হয়েছে সুন্দর একটা র্যালি সাইকেল। আনকোরা নতুন। চেয়ে চেয়ে দেখাই সব তখন। আর বড় লোভ হতো এটা চালানোর। কিন্তু নতুন সাইকেল কি আর দেয় নভিসের হাতে। পরের বারই এঁরা সবাই ঈদ করতে গেলেন নাটোর। নতুন সাইকেলটি রেখে গেলেন আমাদের বাসায়। আর যায় কোথায়। আব্বা যখন সন্ধেয় ক্লাবে অফিসে বসতেন, ওই ফাঁকে বেশ কিছুক্ষণ চালিয়ে নিতাম। কিন্তু বিপদ কি আর ছাড়ে। একদিন সাহস করে রাস্তায় উঠলাম। তারপর কী হলো না হলো, বিশাল এক পতন সাইকেল নিয়ে। ব্রেক ট্রেক ভেঙ্গে একাকার। পরের কাহিনি না হয় উহ্যই থাক! নিজের সাইকেল পেলাম ইন্টার পাস করে কলেজে ভর্তি হওয়ার সাথে সাথে। আমার সাইকেল চালানোয় সবচেয়ে বড় উৎসাহ দাতা ছিল ছোট বোন দুটো। সাইকেলের সিটে তো বসতে পারতাম না। রডের ভেতর পা ঢুকিয়ে চালাতাম।— ওই ভাবেই বোন দুটোকে নিয়ে বহুবার চালিয়ে বেড়িয়েছি সাইকেল প্রথম দিকে।
আর দুটো কথা বলে এ পর্বের ইতি টানি।
ছোট বেলায় খুব বিপদ হতো যখন রিকশায় চড়ে আম্মা আর বড় বোনদের সাথে কোথাও যেতে হতো। ওঁরা শাড়ি দিয়ে পুরো রিকশা ঘিরে ফেলতেন-তার ভেতরে বসলে আমার দম বন্ধ হবার উপক্রম হতো বিধায় আমি পাদানীতে বসে যাওয়াটাই পছন্দ করতাম। তাঁদের সাথে ঘোরাটা ভালোও লাগতো আমার। সমুদ্র দেখতে গেলাম, দাদাবাবুর ক্যামেরায় ছবি তুললাম। পলোগ্রাউন্ড-এর মাঠে ‘কমলা সার্কাস’ দেখার আনন্দ উপভোগ করেছি। বাণিজ্য মেলায় ঘুরেছি নিয়াজ স্টেডিয়ামে-আরও কী কী সব উপভোগ করেছি মনেও পড়ে না।
ও হ্যাঁ সেই সময় পলোগ্রাউন্ডে ইরানী বেদুঈনরা এসে তাঁবু খাটিয়ে থাকতো মাঝে মাঝে স্কুলে যাওয়া আসার পথে ওদের দেখতাম আমরা। ওরা নাচতো, গাইতো, পাথর আর ছুরি কাঁচি বেচতো। ওদের দেখে মজা পেতাম আমরা, ভয়ও লাগতো। যখন ওরা আমাদের কাছে বিক্রি করতে চাইতো আর আমরা ‘না’ করতাম তখন ছুরি দেখাতো—ওই সব চকচকে ছুরি দেখে আমরা পালাতাম।
সেই ইরান আজ কোথায়। পারমানবিক বোমার অধিকারী!
যাক! এ পর্ব দীর্ঘতর করতে চাই না আর!
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন