টি-৩৭ বি, টাইগার পাস রেলওয়ে কলোনি। এই ঠিকানাটা বাইশ বছর আমার সাকিন হয়ে রইলো! কোথাকার মানুষ কোথায় এসে খুঁটি গাড়ে অবাক লাগে ভাবতে।
চট্টগ্রাম শহরটা সমুদ্র এবং পাহাড়ের মাঝে অবস্থিত বিধায় এর সৌন্দর্যের তুলনা নেই। তদুপরি রেলওয়ে এলাকার আলাদা একটা মর্যাদা সেই ব্রিটিশরাই তৈরি করে গেছে। রেলের লাল বিল্ডিং, টালির ছাদওয়ালা বাংলো, বিরল প্রজাতির সব গাছের সারি শহরকে করে রেখেছিল সুন্দরতর।
আমাদের বাড়ির পেছনেই টাইগারপাস পাহাড়। তার পাশেই বিখ্যাত বাটালি পাহাড়। যা পুরো শৈশব কৈশোরের খেলার যায়গা ছিল আমাদের। টাইগারপাস পাহাড়ের ঠিক নিচেই একটি বৃদ্ধ বটগাছ, (এখনও আছে আশা করি), তার নিচের ধাপে এক সারি কোয়ার্টার, যেগুলো পাকিস্তান আমলে তৈরি হলো, চোখের সামনেই। এর পরের ধাপে আমাদের পুরোনো বাড়িগুলো। বাড়ির সামনের বাগান পেরুলেই পিচঢালা রাস্তা, পূর্ব-পশ্চিম ছুটে গেছে পোলোগ্রাউন্ড থেকে পাহাড়তলী। রাস্তার নিচের ধাপে আর এক সারি ব্রিটিশ আমলের বাড়ি। তার পেছনে তরজা বেড়ার কোয়ার্টার। এগুলোও দেখলাম ছোটবেলাতেই— তৈরি হলো। তার পরই একটি ইট বিছানো রাস্তা। শেষ ধাপে আবার এক সারি পাকা বাড়ি— ছোট ছোট, অথচ সুন্দর। এগুলোও ব্রিটিশদের তৈরি। এর পেছনেই আমার প্রিয় খেলার স্থান-রেল লাইন। দোহাজারী-নাজিরহাট লাইন।
ছোট্টবেলাতে যার প্রেমে পড়েছিলাম-সে হলো ওই রেল লাইন, তার সাথে পাহাড়। দুটো জিনিসকে এত কাছে পেয়েছিলাম বলেই হয়তো বা ভালোবেসেছিলাম। এক লাইনের ওপর দিয়ে হাঁটা বা স্লিপারের ওপর দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে চলা, পাথর কুড়িয়ে ঘষে আগুন জ্বালানো, লাইনে কান পেতে ট্রেনের আগমনী শোনা ছিল অতি প্রিয় খেলা, ছুটির দিনে রেললাইন দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সেই ষোলোশহরের দিকে চলে যেতাম গুলতি হাতে। শুধু শুধুই শালিকদের উত্যক্ত করতাম গুলতি ছুঁড়ে। মেরেছিও অনেক।
গুলতির গুলি বানাবার জন্যে এঁটেল মাটি আনতে হাঁটু কাদায় নেমে যেতাম, তারপর গুলির মত করে মায়ের চুলায় পুড়িয়ে জমিয়ে রাখাটা ছিল প্রায় নিত্যদিনের কাজ। দোহাজারী নাজিরহাটের লাইন থেকে আর একটু দক্ষিণে গেলেই দেওয়ানহাট শান্টিং ইয়ার্ড। সারাদিন মালগাড়ির শান্টিং চলতো। একবার এগোতো একবার পেছাতো। খুব ধীর গতিতে এই কাজ হতো বিধায়, আমরা প্রায়শই চড়ে বসতাম গার্ডের রুমে। কখনো ইঞ্জিনের সামনে। বকা খেয়েছি কত। তারপরও আনন্দের ব্যাপারে তোয়াক্কা করা হতো না ওই সব বকাবকি। আর পাহাড়! বলেছি তো বাড়ির খিড়কির দরজা খুললেই টাইগারপাস পাহাড়। সেখানকার মজা আবার অন্যরকম। বিকেলের দিকটাই ছিল আমাদের পাহাড়ে চড়ার সময়। কে কত দ্রুত চড়তে আর নামতে পারে, সেটই ছিল খেলার প্রধান বিষয়। কতবার পড়ে গিয়ে কাঁটা আর পাথরে জখম হয়েছি হিসাব নেই তার। পাহাড়ের একেবারে উঁচুতে এক কোনায় একটা ভাঙ্গা যায়গা ছিল— যেখান থেকে লাফ দিলে নিচে নরম বালিতে পড়া যেত। এটাও ছিল খেলার অন্য অংশ— কে কত দ্রুত লাফিয়ে পড়ে আবার বালি ভেঙ্গে ওপরে উঠে আসতে পারে।
টাইগারপাস পাহাড়ের পাশেই বাটালি পাহাড়। এর পেছনের পাহাড়টায় সরকারি অনেকগুলো বাংলো। সেই চত্বরে ছিল অনেকগুলো কুল আর পেয়ারার গাছ। তার লোভে সেখানে প্রায় যাতায়াত করতে হতো আমাদের। সমুদ্রের জলে সূর্যাস্ত দেখার জন্য প্রায়শই যাওয়া পড়তো বাটলি পাহাড়ে। আশপাশে যখন নানান রঙের বাহার ছড়িয়ে সমুদ্রের কোলে লুকিয়ে যেত সূর্যটা, আমরাও বাড়ি ফিরে আসতাম, কারণ এটাই বাড়ির বাইরে থাকার শেষ সময় ছিল আমাদের। মাগরিবের আযান ছিল ফাইনাল হুইসেল। এরপর বাইরে নট এ্যালাউড্।
হ্যাঁ পাহাড়ের কথা বলছিলাম। বাটালি হিল বলে সবাই। হঠাৎ একদিন কাটা শুরু হলো পাহাড়টা। রাতে ঘুম ভেঙ্গে যেতো বোমা ফাটার শব্দে। আব্বা জানালেন— বাটালি হিলে ডিনামাইট ফাটানো হয় রাতে। সারাদিন মাটি নিয়ে যাওয়া হয় পতেঙ্গায়, নেভীদের কী যেন তৈরি হবে সেখানে।
স্কুলে যাওয়া-আসার পথে প্রতিদিনই অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতাম-নানান সব যন্ত্র দিয়ে মাটি তোলা হচ্ছিল ট্রাকে। এক ইটালিয়ান কোম্পানী এই কাজ করছিল। একদিন ক্যাটারপিলার চড়ে গেল বাটালি পাহাড়ের চূড়ায়। ওই যে পেছনের পাহাড়ের রাস্তাটা দিয়ে। খুব মন খারাপ হয়েছিল সেদিন। চাঁছতে শুরু করলো পাহাড়ের মাথাটা। সমান হয়ে গেল চূড়া। ঝোপ-জঙ্গল সাফ।
তারপরেই সব বন্ধ। কেন বন্ধ জানি না, তবে শুনেছি কেউ একজন আদালতের শরণাপন্ন হয়েছেন এবং অনেক গুণীজন পাহাড়কাটা বন্ধের জন্য আরজি করেছিলেন সরকারের কাছে। ভাগ্য ভাল, আর কাটা হয়নি সে পাহাড়। তাই এখনও দেখতে পাই সবাই, ক’দিন আগে আবার একটা চেষ্টা হয়েছে কেটে ফেলার। বোধহয় এবারও ঠেকানো গেল। কিন্তু, দুর্জনের ছলের তো অভাব নেই। কবে দেখবো-সব সমান হয়ে গেছে। বাটালি পাহাড় শুধু বই-এর পাতায় স্থান নেবে হয়তো।
পাহাড়গুলোতে আরও কিছু আকর্ষণ ছিল আমার। পাহাড়ি নানান বর্ণের ফুল, বিশেষ করে ল্যানটেনা ফুলের ছড়াছড়ি আর তোকমা, তোকমা গাছেরও ছিল ছড়াছড়ি। শরবত খাওয়ার জন্যেই স্বাস্থ্য সম্মত উপাদান এই তোকমা। আমি সংগ্রহ করে বোতলে ভরে রাখতাম। রোজায় আম্মা তোকমার শরবত করতেন। অন্য একটি কাজেও ব্যবহৃত হত এটা। ফোঁড়া ফাটানোতে খুবই উপকারী বস্তু।
পুরো শৈশব এবং কৈশোর চট্টগ্রামের টাইগারপাসেই কেটেছে। জীবনের সবচেয়ে মধুর স্মৃতি সবই প্রায় এখানকার।
মুর্শিদাবাদের সালারে ট্রেনের ইঞ্জিন দেখা আর রেল কোম্পানির স্টিমারের ডেকে খেলার সাথী পাওয়ার পর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পরবর্তী স্মৃতিটা মনে ঠিক আসে না। অনেক ঘটনা তো ভিড় করে আসে— প্রথমটাকে বেছে নিতে পারি না ঠিক। সুতরাং এই চেষ্টা না করে আবার একটু শুরু থেকে শুরু করা যাক। বিরক্তির কারণ হলে দুঃখিত।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন