১৮. চল চল চল ভাই আজি শুভদিনে পিতার ভবনে

‘চল চল চল ভাই
আজি শুভ দিনে
পিতার ভবনে,
অমৃত সদনে
চল চল চল যাই।’

খোন্দকার মোহাম্মদ আব্দুস সালাম। আমার বাবা। চিরকাল ‘আব্বা’ ডেকেছি আমরা ভাই-বোনেরা সবাই। আব্বা তাঁর নামের ‘খোন্দকার’ কবে ছেঁটে ফেলেছিলেন জানিনা। আমি জ্ঞান হওয়া থেকে জেনেছি আব্বার নাম এম. এ. সালাম (M.A. Salam).

.

আব্বাকে নিয়ে একটি বিশেষ পরিচ্ছেদ লেখার ইচ্ছে আমার গোঁড়া থেকেই। এই মানুষটি আমার স্বপ্নের মানুষ আমার আইডল বলতে যা বোঝায়, তাই। বেঁচে থাকতে অতটা বুঝিনি, আজ এই বয়সে এসে তা বুঝতে পারছি।

জন্ম ১৯০৯ সনে মুর্শিদাবাদে আমার দাদার বাড়িতেই। আগেই লিখেছি আমার দাদাজান খোন্দকার জয়নুল আবেদীন ছিলেন পীর-সেই ধারা বাবারা দু’ভাই কেউ আর গ্রহণ করেননি। আব্বা লেখাপড়াটা চালিয়ে ম্যাট্রিক পাশ করেন। তারপর তো কলকাতায় রেলওয়ের টালি ক্লার্কের চাকরি গ্রহণ করেন। চাচা আব্দুল মালেক (মালু মিয়া) কত দূর পড়েছেন জানা হয়নি কোনো দিন, তবে তিনি নিজ গ্রাম থেকে বেরোননি কখনো।

পরের ইতিহাসও অনেকটা বলেছি, কিন্তু এখন যেটা বলতে চাই, তা হলো এই মানুষটাকে আমি পেয়েছি একজন সব্যসাচী হিসেবে। একাধারে নানান দিকে নিজের কার্যক্রম চালিয়ে গেছেন এবং তাতে অসফল হয়েছেন তা বলা যাবে না।

একদম ছোটবেলার কথা শুনেছি, বাড়ির পাশেই কেষ্টধন জমিদারের পুত্রের সাথে তাঁর আন্তরিক সখ্যতা ছিল। হরিহর আত্মা বলা যায় যাকে। পীরের পুত্র হলেও তাদের বিভিন্ন পূজোআচারে তাঁর সক্রিয় অংশগ্রহণ সবাইকে অবাক করে দিত। বিশেষ করে দুর্গাপূজোয় সময় ও বাড়ির এমন কোনো অনুষ্ঠান ছিল না যাতে তাঁর অংশগ্রহণ ছিল না। আবার এইদিকে আমাদের বংশ সুন্নি মুসলমান হলেও গ্রামে মহরমে তাজিয়া বানানোর ধুম পড়ে যেতো। সেখানেও আমার আব্বা সালু মিঞার তেজদীপ্ত অংশগ্রহণ অবশ্যই থাকতো। দুই ধর্মের দুই অনুষ্ঠানেই তাঁর হাতের কাজের বৈশিষ্ট পরিলক্ষিত হতো বিশেষভাবে।

গান-বাজনা, অভিনয় (যাত্রা চলতো পূজোতে) এর প্রতি তাঁর আকর্ষণ তখন থেকেই। তারই প্রতিফলন দেখা গেল পরবর্তীতে। যখন আমরা চলে এলাম চট্টগ্রামে। ওয়াজিউল্লাহ ইন্সটিটিউট, রেলওয়ে কর্মচারিদের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের পীঠস্থল। ব্রিটিশরা করে দিয়ে গেছিল।

আব্বা হয়ে গেলেন তার সাধারণ সম্পাদক। কবে হয়েছেন জানি না, তবে আমি জ্ঞান হওয়ার পরই দেখেছি, তিনি ওই পদে অধিষ্ঠিত। তাঁরই পৃষ্ঠপোষকতায় নিয়মিত নাটক হতো, হতো নানান রকম সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। আমার অভিনয়ে আসার ব্যাপারটাও সেখান থেকে, তা বলেছি আগেই।

এই প্রতিষ্ঠানে একটি গ্রন্থগার ছিল, কিন্তু তার বিস্তৃতি ঘটে আব্বার হাত দিয়ে। কারণ তিনি ছিলেন বই-এর পোকা। প্রায় প্রতি মাসেই বই কেনা হতো এই গ্রন্থাগারের জন্য। যা কেনা হতো, তার প্রতিটি বই তিনি পড়তেন।

এক সাথে অনেক বই নিয়ে বাসায় চলে আসতেন। সেখান থেকে ফেরত গেলে খাতায় নাম উঠে শেলফে যেত। বাসায় বই পড়া নিয়ে আম্মা প্রায় ক্ষেপতেন, দেখতাম। আব্বা বই পড়ার সময়-দুনিয়াদারী ভুলে যেতেন। এই নিয়েই ছিল আম্মার খিটখিটি।

একদিন মনে পড়ে, আম্মা কোনো একটা ব্যাপারে ভীষণ রেগেমেগে আব্বার কাছে এসে বললেন–শুনছেন?

দুতিন বার বলার পর আব্বা প্রচণ্ড হাসতে শুরু করলেন। এরপর তো আম্মা অগ্নিশর্মা। আমাকে নিয়ে ছেলেমেয়েদের সামনে হাসি ঠাট্টা করেন?

কেঁদেই ফেলেন আম্মা।

আরে, আরে কী হয়েছে? কাঁদছো কেন?

হঠাৎ হুঁশ ফিরেছে আব্বার। তিনি সত্যিই হতভম্ব। কেন কাঁদছেন আম্মা।

সমস্ত ব্যাপার শুনে আব্বার হাসি আর থামে না। তিনি আসলে বইটির কোনো এক ঘটনায় মশগুল ছিলেন। এবং তারই কোনো হাস্যকর পরিস্থিতিতে হাসি চাপতে পারেননি— আম্মার ডাক তিনি শোনেনইনি আসলে।

ধূমপান করতে দেখিনি কোনো দিনও। তবে, হ্যাঁ, দোক্তা দিয়ে পানটা খুবই রসিয়ে রসিয়ে খেতেন তিনি। আমি তাঁর পান খাওয়ার এই কায়দা (Style) স্টাইলটা নকল করেছিলাম বহুব্রীহি ধারাবাহিক নাটকে। এবং জেনেছিলাম এই ধারাবাহিক নাটকটি যতখানি জনপ্ৰিয় হয়েছিল-তারচেয়ে কম জনপ্রিয় হয়নি এই আমার পান পাওয়ার ধরণটি।

পান খাওয়াটা নেশাই ছিল তাঁর, সেই সাথে আরও কিছু নেশায় তিনি বুঁদ হয়ে থাকতেন সারাজীবন। তার মধ্যে অন্যতম প্রধান ছিল মাছ ধরা। আর্থিক অনটনের মধ্যেই তার এ শখ পূরণে কোনো কমতি ছিল না। সিনথেটিক ছিপ কিনেছিলেন। নাইলনের সূতো দিয়ে মাছ ধরা হতো তখনই। বেশ কয়েকবার পুরস্কারও পেয়েছেন মাছ ধরায়।

আর এক বড় নেশা ছিল— পাখি শিকার। মুর্শিদাবাদে তাঁর বাবার ছিল দুনলা বন্দুক-তাতেই হাত পাকানো ছিল। চট্টগ্রামে শুরু হয়েছিল-বড় সাহেবের সাথে শিকারে গিয়ে তাঁদের বন্দুকে শিকার করে। কিন্তু তাতে কি মন ভরে। সেই পঞ্চাশ দশকের শুরুতেই প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে ধার নিয়ে কিনে ফেললেন আমেরিকার উইনচেস্টার কোম্পানির সিঙ্গেলবোর বিপিটার শটগান। শুনেছি পাঁচশোরও বেশি দাম পড়েছিল তখন। আবার এই একটিমাত্র স্মৃতি আমি এখনও বহন করছি বংশানুক্রমে, সেটা অবশ্যি বলা হয়েছে।

বৎসরের প্রায় সব রবিবারই ছিল আব্বার এই দুই শখের কাজে ব্যবহারের জন্যে। শীতকালে শিকার, গ্রীষ্ম-বর্ষায় মাছ মারা। আব্বার অফিসে যারা স্থানীয় সহকর্মী ছিলেন তাঁদের গ্রামেই শিকার কিংবা মাছ ধরার জন্য যাওয়া হতো তাঁর। হাটহাজারী, নাজিরহাট, ধলঘাট, দোহাজারী, ভেঙ্গুরা, সীতাকুণ্ড, বাড়বকুণ্ড এই সমস্ত এলাকার বেশি যাওয়া পড়তো। তবে হরিণ শিকারের জন্য সুন্দরবনে গেছেন বেশ ক’বার, আর প্রতি বছর শীতে একবার শ্রীমঙ্গলের হাওরে হাঁস শিকার ছিল অবশ্য কর্তব্যের তালিকায়। একটু বড় হয়ে আমি এসব অনেক অভিযানে শামিল হয়েছিলাম। আব্বার বন্দুক দিয়ে পাখি শিকারের হাতে খড়ি হয়েছিল ম্যাট্রিক পাশের পর।

একবার মাচায় বসে মাছ ধরার সময় দুর্ঘটনায় পড়েন। বেশ বড় মাছ আটকেছিল বঁড়শিতে-ওঠাবার সময় মাছের হ্যাচকা টানে উল্টে পড়েন মাচারই তীক্ষ্ণমুখওয়ালা খুঁটির ওপর। বুকের ভেতর গেঁথে গিয়েছিল সেটা অনেকটাই। প্রায় জীবন নিয়ে টানাটানি অবস্থা হয়েছিল। ওয়াজিউল্লাহ ইন্সটিটিউটে নানান খেলার আয়োজন ছিল। তার মাঝে খুবই স্বাভাবিক কারণে বেশির ভাগ সদস্য নিয়মিত খেলতেন তাস। হয়তো অনেকে সিকি, আধুলির লেনদেনের খেলাও খেলতেন— কিন্তু আমার আব্বা ছিলেন অন্য মানুষ— তাসের পোকা— কিন্তু কণ্টাক্ট ব্রিজ তাঁর অতি প্রিয় খেলা ছিল। রেলের অফিসার-কর্মচারিদের মিলিত কম্পিটিশনে তিনি হয়েছিলেন চ্যাম্পিয়ন। এত বেশি সিরিয়াস ছিলেন এই খেলায় যে একবার ভুল কার্ড খেলায় পার্টনারকে চড় বসিয়েছিলেন উত্তেজনার বশে। সেও এক ইতিহাস।

খাওয়া দাওয়ায় সৌখিন ছিলেন কিন্তু কোনো আড়ম্বর ছিল না। নিজের আর্থিক সামর্থ্যের ব্যাপারে ছিলেন সদা সচেতন। তার মধ্যে থেকেই নানান রকম খাবারদাবারের ব্যবস্থা করতেন আম্মাকে দিয়ে। বিরক্ত হতেন আম্মা অনেক সময়-তাতে শুধু হাসাতেন আব্বা। এমন ঠান্ডা মেজাজের মানুষ দ্বিতীয়টি চোখে পড়েনি আজ অবদি। এর ছিটে ফোঁটাও যদি পেতাম আমি। অনেক সময় আম্মা রান্না ঘর থেকে পিঠ টান দিলে আব্বা নিজেই লেগে পড়তেন সেই কাজে। আসলে রান্নার ব্যাপারে তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। বিশেষ করে কাচ্চি বিরানীতে ছিলেন ওস্তাদ। মনে পড়ে টাইগারপাস পাড়াতে বা আত্মীয়-স্বজনদের বাড়ির বিয়েতে রান্নায় সালাম সাহেব নেই এমন ঘটনা ছিল বিরল। তিনি সবসময় থাকতেন রান্নার প্রধান পরামর্শক। অসাধারণ ছিল তাঁর কাচ্চি রান্নার হাত।

এরপর আসি তাঁর অন্য রকম সব কাজের কথায়। আগেই বলেছি ছোটবেলা থেকে আব্বা ছিলেন সংস্কৃতিমনা। সৌন্দর্যবোধ ছিল অসাধারণ। সাধারণ কাগজ কাঁচি দিয়ে কেটে দারুণ সব ফুল বা অন্য কিছু বানানোর হাত ছিল পাকা। স্বাধীনতা দিবসের আগেই বলতেন গেট বানাও। লোক চলে আসতো বেড়া দিয়ে গেট বানাতে। বলতেন— দেবদারু পাতা আনো। ছুটতাম সেই পাতা সংগ্রহে। আব্বা রঙিন কাগজ কেটে রাখতেন। নিজেই হাত লাগাতেন আমার সাথে সাজসজ্জায়।

তাঁর জন্যে আমাদের বাসার সামনে বিরাট বাগানটি কখনোই অগোছালো থাকতে পারতো না। প্রখর দৃষ্টি রাখতেন, বাগানের প্রতি। আমাকে হাত ধরে শিখিয়েছিলেন কীভাবে বাগানের কাজ করতে হয়। মাটি তৈরি করা, চারা লাগানো, চারার যত্ন এবং গাছের যত্ন নেয়া ইত্যাকার কাজ। তিনিই শিখিয়েছেন বলেই আমাদের বাগানটি ছিল পাড়ায় এক নম্বর। মৌসুমী ফুলের সময় আলো হয়ে থাকতো বাগানটা। আর বেলি ফুল গাছের ঝাড়ের কথাতো বলেছি আগেই।

সংগঠক হিসেবে তিনি ছিলেন অনন্য। ওয়াজিউল্লাহ ইন্সটিটিউটকে শুধু তাস খেলার ক্লাব থেকে সত্যিকারের একটি ক্লাবে উন্নয়ন করেছিলেন এক হাতে। তাছাড়াও নানান প্রতিষ্ঠানের সদস্য হিসেবে কাজ করতেন অহরহ। পাড়ার বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেও অন্যতম আহ্বায়ক ছিলেন আব্বা।

তার সবচেয়ে বড় কাজটি ছিল টাইগারপাসে রেলওয়ে কর্মচারিদের মেয়েদের জন্য একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা। নিজের জীবনের অনেক সুন্দর সময় বিসর্জন দিয়েছেন তিনি এই স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য। মনে পড়ে— একবার শিক্ষকদের বেতন দেয়ার সমস্যা সমাধানে আম্মার গহনাও বন্ধক দিতে হয়েছিল তাঁকে। এক সময় রেলের অনুমোদন আসে-মানুষ স্কুলটিকে চিনতে শুরু করে। আর আজতো বিরাট স্কুল ‘টাইগারপাস রেলওয়ে এমপ্লয়িজ গার্লস হাই স্কুল’। আব্বা ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক এই স্কুলের। নিজ সন্তানদের চেয়ে প্রিয় ছিল এই স্কুল তাঁর জীবনে। আমি যে বছর ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করলাম তার পরের বছরই অবসর নিলেন আব্বা। বয়স তখন কতো হবে পঞ্চান্নো-ছাপান্নো। অবসরকালীন ছুটিতে চাকরি নিলেন এ কে খান কোম্পানিতে অ্যাডমিনিস্ট্রিটিভ অফিসার হিসেবে। এর কদিন পরই বিছানায় পড়েন প্রস্টেট ক্যান্সারে। তখনকার দিনে তেমন ওষুধও ছিল না এ রোগের। আমি তখন ঢাকায় চাকরি করি ওয়াসায়। আব্বারও রেলের কোয়ার্টার ছাড়ার সময় হয়ে এল। আমি বাসা ঠিক করলাম এখানে। ওখানে আব্বাকে বিশাল এক বিদায় সম্বর্ধনা দেয়া হয় টাইগারপাস কলোনিবাসীর তরফ থেকে। আমার বোনদের কাছে শুনেছি মালপত্র সব রেলের মালগাড়িতে বুক করা হয়েছে। আব্বা যখন আসবেন তখন তিনি ছিলেন এ্যাম্বুলেন্সে। গাড়ি যখন চলতে শুরু করে আব্বা বললেন ‘আমাকে একবার স্কুলে নিয়ে যাও। স্কুলটাকে শেষ দেখা দেখতে দাও’। অ্যাম্বুলেন্স স্কুলে গেল। এম্বুলেন্সের দরজা খুলে দেয়া হয়। আব্বা প্রাণভরে দেখলেন তাঁর সাধের স্কুল–বাগান ভরা শুধু ফুল আর ফুল। আব্বা কাঁদছেন, আম্মা, আমার দুই বোন কাঁদছে। গোটা কলোনির মানুষ কাঁদছে। সেই দৃশ্য টাইগারপাসের মানুষ আজও ভোলেনি। এর ছ’মাস পর আব্বা ঢাকার মোহাম্মদপুরে ইন্তেকাল করেন (৬ সেপ্টেম্বর ১৯৬৯ সন)

আসলে আব্বার দ্বারা আমি ভীষণভাবে প্রভাবিত। জীবনটা আমি নানাভাবে চেষ্টা করেছি আব্বার মতন করতে। কতটুকু পেরেছি বলতে পারবো না। ছোটবেলা থেকে আমার সাংগঠনিক কাজ করার প্রবণতা ছিল, অদ্যাবধি সেটা আছে। বুয়েটের শেরেবাংলা হলের এল্যামনাই এ্যাসোসিশনটা আমার ভাবনা থেকে প্রতিষ্ঠিত, সেটা এখন বেশ একটা কার্যকরি প্রতিষ্ঠান গোটা বুয়েটে। আমি এখন তার একজন সম্মানিত সদস্য।

আব্বার সাথে কথাবার্তা খুব বেশি হতো না কখনো। তারপরও তাঁর জীবনাচার তো লক্ষ্য করতাম। কীভাবে কথা বলতেন, মানুষের সাথে মিশতেন, কাজকর্ম আর নেশায় মাছ ধরা, শিকার, কন্ট্রাক্ট ব্রিজ, সমাজসেবা, মগ্ন থাকায়— তাতেই একটা জিনিস আমি শিখেছি এবং নিজের জীবনে প্রয়োগও করেছি।

ছোটবেলা থেকে আমরা ভাইবোনেরা আব্বার কাছ থেকে কেন যেন বেশ দূরে দূরে থাকতে পছন্দ করতাম। যত আবদার সব আম্মার কাছে ছিল আমাদের। আম্মার হাতের চড়-থাপ্পর বেশ খেয়েছি কিন্তু আব্বা? জীবনেও নয়।

আব্বার সাথে কেন দূরত্ব ছিল আজও বুঝি না। হয়তো খুব বেশি ন্যাওটা ছিলাম আম্মার। আজ বুকের ভেতরটা হাহাকার করে ওঠে যখন দেখি তাঁর কাছে বসে কতকিছুই জানতে পারতাম-তা আর হলো না।

আর মুক্তিযুদ্ধের সময়কার দিকবিদিক ছুটাছুটি আর হঠাৎ করে সিদ্ধান্তের জন্য বিদেশে চাকুরি করতে গিয়ে হারিয়ে ফেলেছি সব স্মৃতি। জমানো ছিল তাঁর লেখা অনেক পোস্টকার্ড। নাই একটাও। নেই একটুকরো কাগজ যাতে তাঁর হাতের লেখা (অসাধারণ সুন্দর লিখতেন আব্বা), নেই কোনো চশমা কোনো কিছু নেই। শুধু আছে বন্দুকটা। বলেছি তো ওটাও এবার সরকারকে দিয়ে দিতে হবে।

তবে দুটো ঘটনা এখানে উল্লেখ না করলে অন্যায় হবে বলে আমি মনে করি। তখন বয়স ছিল এগার কিংবা বার। আব্বা সকালে বললেন-

যাও তো বাবা, তোমার সাখাওয়াৎ খালুর কাছ থেকে দশটা টাকা নিয়ে এসো তো।

আমি উত্তর না দিয়ে অন্যত্র চলে গেলাম। আমি জানতাম টাকাটা ধার চাইতে যেতে হবে।

আব্বা এর আগে কোনোদিন আমাকে এ দায়িত্ব দেননি, তবে আজ কেন?

সে বয়সেই বুঝে ফেলতে দেরি হয়নি-এ মাসে দুতিনবার ধার নেয়া হয়ে গেছে নিশ্চয়— এবার আব্বা আর নিজে চাইতে পারছেন না।

মনটা খারাপ হয়েছিল আমাদের আর্থিক অবস্থা ভেবে। বিশেষ করে সে সময় আব্বাকে বলতে গেলে দুটো সংসার টানতে হতো-নিজেরটা আর বড় মেয়েরটা, তার অনেকগুলো সন্তানসহ। বড় দুলাভাই কর্মহীন হয়ে বসে ছিলেন তখন।

কিছুক্ষণ পর আব্বা এলেন আমার কাছে-

‘কই গেলে না?’

আমি কোনো উত্তর না দিয়ে অন্যদিকে ঘুরে রইলাম।

‘কি হলো যাও।’

‘আমি যাবো না।’

কী করে যেন কথাটা মুখ থেকে বেরিয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে এক বিশাল চড় এসে পড়ল গালে।

‘বেয়াদব ছেলে।’

এই প্রথম এবং শেষ চড় আব্বার হাতের। আব্বার ভেতরে কতটা কষ্ট থাকলে এমন কাজ করতে পারেন, এখন অনেকটা বোধহয় উপলব্ধি করতে পারি। এইটা লিখতে গিয়েও জল এসে গেল চোখে।

‘মাফ করে দিয়েন আব্বা। যদি আজ এসে আর একটা চড় দিতেন, কী যে আনন্দ হতো। এই ঘটনাটা আমাদের সারা জীবনের অনেক কিছুরই বহি:প্রকাশ সেই জন্যেই লিখলাম বিস্তারিত। আমার সন্তান এবং তাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মও যেন আন্দাজ করতে পারে মধ্যবিত্তের মর্মকথা এই ঘটনার মাধ্যমে।

আব্বার বিষয়ে আর একটি ব্যাপারে বলার প্রয়োজন বোধ করছি আমি।

মানুষের জীবনের চাওয়া পাওয়ার বিষয়ে আব্বার একটু ভিন্ন ধরনের চিন্তাভাবনা ছিল। ছোটদের যেমন বাবা-মা সাধারণত মানসিক ভাবে তৈরি করার চেষ্টা করেন যে জীবনে সে কী হবে! এই একটা ব্যাপারে আমার আব্বা বিশেষ ভাবে আম্মাও ছিলেন উদারপন্থী। কোনোদিন আমার মনে পড়ে না যে তাঁরা আমায় জিজ্ঞেস করেছিলেন-

রবি তুমি বড় হয়ে কী হতে চাও?

ওই যে আগেই বলেছি তাঁরা এসব ব্যাপারে পুরোপুরি ছিলেন উদারপন্থী। পড়াশুনা করছে ছেলে-কিছু একটা হবে নিশ্চয়।

মনে পড়ে, ম্যাট্রিক পাশ করার পর আব্বা শুধু জিজ্ঞেস করেছিলেন-

কী পড়বে সাইন্স না আর্টস?

‘সাইন্সে চেষ্টা করি?’

ব্যাস বাদবাকী হয়েছে নিজের চেষ্টাতেই।

ইন্টার পাশ করার পরও একই ঘটনা।

‘হায়ার সেকেন্ড ডিভিশন তো পেলে, কী পড়বে?’

‘ইঞ্জিনিয়ারিং চেষ্টা করি?”

‘করো।’

ব্যাস ঢাকায় চলে এলাম। বাদবাকী সবই আমাকে একাই করতে হলো, কীভাবে কী করতে হবে জানলাম বন্ধু জামালউদ্দীন ওরফে লং মিন্টুর কাছ থেকে। সে আমার আগের বছরেই ভর্তি হয়েছিল বুয়েটে। আমি জানতাম এখানে ভর্তি হওয়া বড় কঠিন ব্যাপার। তাই মিন্টুর সাহায্যের প্রয়োজন ছিল। করেছেও সে। এক মাস আমাকে Engineering Drawing শিখিয়েছে।

এতগুলো কথা এ জন্যেই বললাম কারণ আব্বার দর্শনটা ছিল অন্যদের চেয়ে ভিন্ন। পারিবারিক সমাবেশে বলেছেন বহুবার, নানা উপলক্ষ্যে—

‘দেখ, চাওয়াটা রাখবে ছোট, তাহলে জীবনে কোনোদিন হতাশায় ভুগবে না। মনের মধ্যে বড় বড় চাওয়া থাকলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তোমার চাওয়া পূরণ হবে না এবং তুমি প্রায়শই ভুগবে হতাশায়।

বিশ্বাস করেন, এই দর্শনে আমি বিশ্বাসী হয়ে কাজ করেছি সারাটা জীবন। তাই হতাশায় ভুগেছি কদাচিৎ!

সাংবাদিক ভাইয়েরা বহুবার আমায় প্রশ্ন করেছেন-

‘আমার জীবনের না পাওয়া কী আছে?’

‘সে রকম কিছু মনে পড়ে না। না, নেই।’

এই উত্তরই বেশ দৃঢ়কণ্ঠেই দিয়েছি আমি এবং এখনো দিই।

সকল অধ্যায়

১. ১. দিনগুলি মোর সোনার খাচায় রইল না
২. ২. তেলের শিশি ভাঙলো বলে খুকুর পরে রাগ করো
৩. ৩. জীবন যখন শুকায়ে যায়
৪. ৪. মোরা ভোরের বেলা ফুল তুলেছি
৫. ৫. আসা-যাওয়ার পথ চলেছে
৬. ৬. শৈশব হারিয়ে গেছে সময়ের স্রোতে
৭. ৭. নদী বহে যায় নূতন নূতন বাঁকে
৮. ৮. আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো
৯. ৯. রেলগাড়ি ঝমাঝম, পা পিছলে আলুর দম
১০. ১০. পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে হারে
১১. ১১. দিগবলয়ে নব শশী লেখা
১২. ১২. ছেলে আমার মস্ত মানুষ মস্ত অফিসার
১৩. ১৩. নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়
১৪. ১৪. দূর কোন পরবাসে তুমি চলে যাইবারে
১৫. ১৫. এলেম নতুন দেশে
১৬. ১৬. নীড়ে ফেরা পাখি
১৭. ১৭. মিলিটারি ॥ আপকা নাম কিয়া?
১৮. ১৮. চল চল চল ভাই আজি শুভদিনে পিতার ভবনে
১৯. ১৯. মাগো মা ওগো মা আমারে বানাইলা তুমি দিওয়ানা
২০. ২০. আছে দুঃখ আছে মৃত্যু বিরহ দহন লাগে
২১. ২১. একজন অভিনেতা হবে ভাল এবং সৎ মানুষ
২২. ২২. মার্কনীর বেতার তরঙ্গে আমি
২৩. ২৩. আমি সিনেমা নির্মাণ করি গল্প বলার জন্য-সত্যজিৎ রায়
২৪. ২৪. বোকার বাক্স
২৫. ২৫. বিজ্ঞাপন একটি সৃজনশীল শিল্পকলা
২৬. ২৬. আমি কি লেখক?
২৭. ২৭. পুরস্কার
২৮. ২৮. মাঠে প্রান্তরে
২৯. ২৯. আমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ
৩০. ৩০. ছানাপোনার কাহিনি
৩১. ৩১. সারমেয় সমাচার
৩২. ৩২. পায়ের তলায় সর্ষে
৩৩. ৩৩. কোন আলো লাগলো চোখে
৩৪. ৩৪. সুন্দরের কোন মন্ত্রে মেঘে মায়া ঢালে
৩৫. ৩৫. তামাম শোধ

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন