আমি অভিনয়ে কীভাবে এলাম, তার বিস্তারিত কয়েকবার বলেছি, তবে এবার আমি একটু বলতে চাই আমার থিয়েটারে আসা আর সেই গ্রুপ থিয়েটারের কিছু কথা।
থিয়েটার গ্রুপ নাগরিকের জন্মলগ্নের কিছু কথা বলেছি এর মধ্যে। তার পরের অংশটাও বলে নেয়া প্রয়োজন। তবে একটা কথা বলে নি-নাগরিক থিয়েটার গ্রুপ হচ্ছে কবি নাট্যকার জিয়া হায়দার ও বিশিষ্ট নাট্য ব্যক্তিত্ব আতাউর রহমানের উদ্ভাবন (brain child)। তাঁরাই তোড়জোড় করেছিলেন-তারপর ইডিপাসের প্রধান চরিত্রটি তো নির্দিষ্ট করতে গিয়ে জন্মের পূর্বেই ভাঙ্গল দল।
তারপর যাই হোক— আমরা টেলিভিশনে ইডিপাস করেছি। রেডিওতে করেছি, শুভ্রা সুন্দর কল্যাণী আনন্দ। দুটোই পরিচালনা করেছেন জিয়া হায়দার।
এর মধ্যে অন্য আর এক নাগরিকও প্রতিষ্ঠিত হলো। টেলিভিশনে নাটকের প্রদর্শনী হলো তাদের রবি ঠাকুরের গল্পের নাট্যরূপ মালঞ্চ। এক সময় মনে হয় তাঁরা মঞ্চেও এলেন— অনেক পরে। তারপর তাঁদের আর কোনো খোঁজ জানা নেই আমার।
আমাদের পরবর্তী প্রচেষ্টা ছিল ক্রিস্টোফার মারলোর ডক্টর ফস্টাস। রেডিও নাটক। মহড়াও শুরু হয়েছিল। ফস্টাস চরিত্রের জন্য খোঁজা হয়েছিল ভাল উচ্চারণ ও বলিষ্ঠ কণ্ঠের অধিকারী একজন অভিনেতার।
পাওয়া গিয়েছিল একজন যুবককে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যারয়ের ছাত্র। ইংরেজি নাটকে অভিনয় করে নাম করেছে সে সময়। নাম চিংকু। বহুদিন পর জেনেছিলাম সে আমাদের সারা যাকেরের বড় ভাই। ৭০ সনে আমার সাথে একটি বিপ্লবী নাটকে অভিনয় করেছিল চিংকু। দুর্ভাগ্য, ফস্টাস নাটকটি আর করা হয়নি, মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ায়। এবং আরও দুঃখের ব্যাপার হলো চিংকু নিহত হয় হানাদারদের হাতে যুদ্ধকালীন সময়ে।
যুদ্ধ শুরু হতেই আমরা সবই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলাম। আমার কথা আগেই সব বলা হয়েছে। মৃত্যুর দ্বার থেকে ফিরে এসেছিলাম সৃষ্টিকর্তার অশেষ দয়ায়।
মুক্ত হলো দেশ, আবার সবাই একত্রিত হলাম। তোড়জোড় শুরু হলো মঞ্চে যাওয়ার। আতাউর হলেন প্রধান উদ্যোক্তা। শুরু হলো মহড়া। নাটক মাইকেল মধুসূদন দত্তের প্রহসন বুড়ো শালিকে ঘাড়ে রোঁ। পরিচালনায়-আতাউর রহমান। অভিনয়ে ছিলাম-ফকরুল ইসলাম, আবুল হায়াত, গোলাম রাব্বানী, রেখা আহমেদ, আতাউরের স্ত্রী মিনু রহমান, ইনামুল হক, তাঁর স্ত্রী লাকী ইনাম এবং বিশেষ ব্যাপার হলো একটি কমেডি ও গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র ‘গদা’তে অভিনয়ের জন্য আমন্ত্রিত হয়ে এলো আলী যাকের।
মুক্তিযুদ্ধকালে বা অন্য কোনো সময়ে আতাউরের সাথে পরিচিত হয়েছিল যাকের। সম্ভবত আরণ্যকের নাটক মুনীর চৌধুরীর কবরে তার অভিনয় দেখে আতাউর আকর্ষণ অনুভব করেছিলেন যাকেরের প্রতি। তাই যাকের এলো নাগরিকে এবং এরপর হলো স্থায়ী সদস্য। নাগরিক মঞ্চে এল প্রথম বুড়ো শালিক নিয়ে। দর্শনীর বিনিময়ে মঞ্চে এলাম আমরা। দু’টাকা তিন টাকা টিকিট— দু’টো শো হলো মতিঝিলে ওয়াপদা মিলনায়তনে। ১৯৭২-এর ৩১ শে জুলাইতে।
বেশ ভাল সংখ্যক দর্শক দেখেছিলেন সে নাটক। আমার চরিত্র ছিল হানিফ গাজী। বেশ প্রশংসা পাওয়া গিয়েছিল, বিশেষ করে জিয়া ভাই-এর প্রশংসাটা আমার কাছে স্মরণীয় হয়ে রয়েছে।
এই নাটকে সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট ছিল, আমাদের মধ্যে মঞ্চে নাটক ঘন ঘন করবার জন্য একপ্রকার ক্ষুধার সৃষ্টি হয়েছিল, সকলেরই মাঝে। বিশেষ করে যাকেরের কথাটি বলা প্রয়োজন— সে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে কলকাতায় থেকে থিয়েটারের প্রতি ভীষণ ভাবে আকৃষ্ট হয়েছিল। বুড়ো শালিক শেষ হওয়া মাত্র ঘোষণা দিল পরবর্তী নাটকে সে নির্দেশনা দেবে। গোলাম রাব্বানী একটি নাটকের বই এনেছিলেন কলকাতা থেকে-প্রখ্যাত নাট্যকার ও নির্দেশক বাদল সরকারের লেখা বাকি ইতিহাস।
সেটাই যাকেরের পছন্দ। সেই সাথে তার পছন্দ আমাকে বাকি ইতিহাসের প্রধান চরিত্র সীতানাথ চক্রবর্তী চরিত্রের জন্য, ব্যাস শুরু হয়ে গেল মহড়া। স্থান-যাকেরেরই বাসায়-রাজারবাগ ‘ছায়ানীড়ে’। নাগরিকের সদস্য সংখ্যা প্রায় প্রতিদিনই বাড়তে লাগলো-আমাদেরই বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন অনেকেই নিয়মিত মহড়ায় আসতে আসতে সদস্য হয়ে গেছে পরে।
এ নাটকে প্রথমত শিল্পী ছিলাম, আমি, আতাউর রহমান, লাকী ইনাম, কাজী তামান্না, গোলাম রাব্বানী, বাদল রহমান এবং ফয়েজ আহমেদ ও ইনামুল হক।
এর মধ্যেই ইনামুল হক (তখন বুয়েটের রসায়ন বিভাগের শিক্ষক) বিদেশে চলে গেলেন সস্ত্রীক, পিএইচডি করতে। সে কারণে লাকীর স্থানে এলেন নায়লা জামান। (এখন বিখ্যাত বিশেষজ্ঞ শিশু চিকিৎসক)। ইনামুল হকের স্থানে আরিফুল হককে পাওয়া গেল। কিন্তু এর মধ্যে যাকেরের সাথে সামান্য ভুল বোঝাবুঝির কারণে গোলাম রাব্বানী এবং তাঁর স্ত্রী কাজী তামান্না সরে গেলেন নাটক থেকে। যতদূর মনে পড়ে ছোট বাচ্চার কারণে তামান্না অনিয়মিত হয়ে পড়েছিল মহড়ায়— এ নিয়েই ভুল বোঝাবুঝিটা হয়। দুঃখজনক হলো এই ঘটনার রেশ ধরেই রাব্বানী সস্ত্রীক গ্রুপ ছেড়ে চলে যান এবং পরবর্তীতে থিয়েটারে যোগ দেন।
সীতানাথের বিপরীতে কনা চরিত্রটি করছিলেন তামান্না। কয়েকদিন খোঁজাখুজির পর নায়লা খুঁজে নিয়ে এলো সারা আমিনকে (পরবর্তীতে সারা যাকের) রাব্বানীর স্থানে এলেন রশীদ হায়দার।
এই নাটকটি করতে এসে গ্রুপটা দাঁড়ালো। প্রথমে একটা লোগো হলো। সকাল এগারটায় নাটক মঞ্চায়নের রীতি তৈরি হলো বাংলাদেশে। ছুটির দিন রোববার সকাল ১১টায় ব্রিটিশ কাউন্সিল মিলনায়তনে পরপর প্রায় ১১টি শো হলো বাকি ইতিহাস নাটকের।
একটু বলে রাখি কোনো তথ্য ভুল হতে পারে। ক্ষমাসুন্দর চোখে দেখবেন— ইচ্ছাকৃত কোনো ভুল করিনি-করবোও না।
চারদিকে সাড়া পড়ে গেল বাকি ইতিহাস নিয়ে। প্রথম শো হয়েছিল ১৯৭৩ সনের ৩রা ফেব্রুয়ারি, সকাল ১১টায় ব্রিটিশ কাউন্সিল মিলনায়তনে। এটাই ইতিহাস বাংলাদেশের নিয়মিত দর্শনীর বিনিময়ে নাটক মঞ্চায়নের।
হৈ হৈ রই রই ব্যাপার হয়ে গেল। পত্রপত্রিকায় ছবি আর প্রতিবেদন, মনে পড়ে সাপ্তাহিক বিচিত্রায় আমাদের এই নাটক নিয়ে প্রচ্ছদ কাহিনি ছাপানো হয়েছিল।
বাংলাদেশ টেলিভিশন, নাটকটি ভিডিও রেকর্ডিং করে, প্রচার করলো। তাতে দেশের মানুষ আরো জানলো যে, এদেশেও কলকাতার মত গ্রুপ থিয়েটার জমে উঠছে।
প্রথম প্রথম টিকিট বিক্রি করতে নানান পন্থার অবলম্বন করতে হলো। যেমন নিজের পকেটে নিয়ে ঘুরতাম-অফিস, বাসা, রাস্তা ঘাট যেখানেই চেনা মানুষ পেতাম-গছিয়ে দিতাম টিকেট। পরবর্তীতে তারাই ফোন করে নতুন নাটকের টিকিট সংগ্রহ করতেন। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন তো চলতোই। জনপ্রিয় দোকানে টিকেট রাখা হতো শো’র দু’তিনদিন আগে থেকেই। অগ্রিম টিকেট বিক্রি চালু করার বিষয়টা সহজ হয়ে এল অনেকটা।
এইসব কিছুর পেছনে প্রায় ৯০ শতাংশ প্রশংসার দাবীদার আলী যাকের। সে আসবার পরই গ্রুপটাতে প্রাণচাঞ্চল্য বেড়েছে-যথাযথ থিয়েটারের নিয়মনীতিতে মহড়া, সংগীত, সেট, পোশাক আশাক সব কিছু প্ল্যান করে করা হয়েছিল।
প্রথম দিনই বলে দিয়েছিল— নাটকে কোনো প্রম্পটার থাকবে না। প্রত্যেককে পুরো নাটক মুখস্থ করে ফেলতে হবে। হয়েছিলও তাই। সবচেয়ে বড় কথা গ্রুপটা একটা স্থিতি পেয়েছিল। যাকেরের তখনকার কার্যালয় ইস্টএশিয়াটিক এ্যাডভার্টাইজিং হয়ে উঠেছিল আমাদের দপ্তর। এবং যাকেরের অফিসের কর্মীবৃন্দ সোৎসাহে নাগরিকের জন্য কাজ করে কৃতজ্ঞতায় আবদ্ধ করেছেন আমাদের। অনেকে নিয়মিত সদস্যও হয়ে গিয়েছিলেন গ্রুপের।
মহড়া চলতো রাজারবাগের বাসায় সেকথা বলা হয়েছে। যাকেরের আত্মীয়স্বজন আর আামদের অনেকের পরিবারের লোকজনও নিয়মিত মহড়ায় থাকায় জমে উঠতো মহড়া এবং অনেক রাত অবধি চলতো সেটা।
বাকি ইতিহাস শেষ হতেই নতুন নাটকের মহড়া শুরু হলো। এবার ডাবল বিল ধরা হলো। এক টিকিটে দুই নাটকের দর্শন। যাকেরের দায়িত্ব পড়লো ফরাসী নাট্যকার মলিয়েরের ইন্টেলেকচুয়াল লেডিসের ভাবানুবাদ করা ও পরিচালনার। আর আমার উপর ভার পড়লো রশীদ হায়দারের লেখা তৈল সংকট নাটকের পরিচালনার।
সেই সময় দেশে কেরোসিন তেলের হয়েছিল প্রচণ্ড সংকট। মানুষের মাঝে প্রবল হতাশা জ্বালানী তেলের জন্য। গ্যাস তখনও এতটা জনপ্রিয় হয়নি দেশে। সরকার ডিলারের মাধ্যমে তেল সরবরাহ শুরু করেন। মানে শুরু হয় কেরোসিনের রেশনিং। এমনি এক ডিলার এবং তারই পাশের বাসায় বসবাসরত এক দরিত্র কেরানিকে নিয়ে ছিল কাহিনীটি। নির্দেশনা দিতে পারিনি আমি-কারণ তখন আমার আলসারের প্রচণ্ড যন্ত্রনা হচ্ছিল কিছুদিন ধরে। আমার অপারগতায় যাকেরই শেষ পর্যন্ত দায়িত্ব নেয় নির্দেশনার। শেষমেষ আমি অভিনয় করি সেই কেরানির চরিত্রে। আমার স্ত্রীর চরিত্রে ছিল সুলতানা কামাল। ডিলার আতাউর রহমান এবং মস্তান ছিল বাদল রহমান।
ইন্টেলেকচুয়াল ladies এর বাংলা বিদগ্ধরমনীকুল-এ অভিনয় করে সারা যাকের, মিনু রহমান (আতাউরের স্ত্রী), বাদল রহমান, সুলতানা কামাল লুলু, আতাউর রহমান, ফয়েজ আহমেদ প্রমুখ।
শোর দুদিন আগে ঘটলো আসল ঘটনা। বিজ্ঞাপন ছাপা হয়ে গেছে— বিক্রি হয়ে গেছে অগ্রিম টিকিট। সবাই প্রস্তুত শোর জন্য— এখন চলছে চূড়ান্ত ঝাড়পোঁছ।
মহড়ায় বাদল রহমান নকল ঘুষির বদলে আসল ঘুষি মেরে বসে আমার নাকে। ওই যে আমি দরিদ্র কেরানী থাকি তেলের ডিলারের বাসায়? একটিন পুরো তেল আমার বাসার চৌকির তলায় পাওয়া যাওয়ায় জনতা আমাকে বেদম মারে। তারই এক দৃশ্যে মাস্তান বাদল মহড়াতে ওই কাণ্ড ঘটায়। প্রচণ্ড রক্তপাত শুরু হয় আমার নাক মুখ দিয়ে। থামানো যায় না কিছুতেই। হাসপাতলে নেয়া হলো আমাকে। আমার স্ত্রী ভীষণ ভয় পেয়ে যায় কারণ মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে আমি মরতে বসেছিলাম নাকের রক্তপাতের কারণে।
হাসপাতালে দিল আমার দুই নাকে গজ ঢুকিয়ে আর সাত দিন চিৎ হয়ে শুয়ে থাকার নির্দেশ। এবার কী হবে নাটকের। আজ বাদে কাল শো। বদলি প্লেয়ার দরকার। সবার দৃষ্টি গিয়ে পড়লো আমাদের প্রম্পটারের ওপর। ওর মুখস্ত সারা নাটক। ব্যাস, আর যায় কোথায়? তাকেই নামতে হলো শো করতে। চারটি শো (যতদূর মনে পড়ে) সে করার পর আমি আবার ফিরে গেলাম আমার চরিত্রে।
এই প্রম্পটারের নাম হলো নূর। যাকে আজ সবাই চেনে আসাদুজ্জামান নূর হিসেবে। নাগরিকের অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এক সদস্য, জবরদস্ত অভিনেতা, তুখোড় আবৃত্তিকার এবং বর্তমান সরকারের এক সংস্কৃতি মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর।
নূর আমার অতি ঘনিষ্ঠ অনুজ বন্ধু, সেই ৬৮, ৬৯, ৭০, ৭১-এর সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সময়কার সহযোগী নূর। অনেকের কাছে বাচ্চাভাই নামেও পরিচিত। রক্তকরবী নাটকের (সেই ১৯৭০-এর) কিশোর আজ এক মহীরুহ অভিনেতা বাংলাদেশের। (এর কৃতিত্ব কি আমার কিছুটা প্রাপ্য? )
এরপর আবার নির্দেশনার দায়িত্ব দেয়া হলো সভাপতি জিয়া হায়দারের স্কন্ধে। দেশী নাটকের পান্ডুলিপির খরা তখন খুব ভালভাবেই অনুভব করেছিলাম আমরা। পশ্চাশ, ষাট, দশকে কলেজ, পাড়া, অফিসের নাটকের জন্য বেশ কিছু নাটক চালু ছিল সে সময় -সেগুলোকে ঠিক গ্রুপ থিয়েটারের কাজের পর্যায়ে বিবেচনা করা হয়নি কখনো। যে কারণে বিদেশী নাট্যকারদের প্রতি ঝুঁকে পড়লাম আমরা।
এবার জিয়া ভাই হাত দিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় অনুদিত আলবেয়ার কামুর ক্রস পারপাস নাটকে। প্রধান চরিত্রে ছিলেন সুলতানা কামাল লুলু। এবং সম্ভবত জানেসার ওসমানও ছিল গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে।
এ নাটকটি সাধারণ দর্শকের জন্য একটু কঠিনই ছিল। কয়েকটি শো হয়েছিল তখন। এরপর আবার আতাউর এলেন ভেঁপুতে বেহাগ নিয়ে (মূল এরিখ মুলনা) এবারও বিদেশী নাটক। এতে আমি অভিনয় করিনি। আমার সুযোগ এল এরপর। গ্রুপের সিদ্ধান্তে দায়িত্ব দেয়া হলো আমাকে সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহর বহিপীর নাটকের। বইটি খুঁজে বের করতে আমাকে প্রচুর পরিশ্রম করতে হয়েছে। ভাগ্যক্রমে জানা গেল আমারই এক বন্ধু ইঞ্জিনিয়ার ড. এহসানুল হক মানির আব্বার কোম্পানি থেকে এই বই প্রকাশ করা হয়েছিল। ছুটলাম সেখানে— দিলকুশায় ছিল খালুর অফিস। বেরুলো বহিপীরের কপি। কিন্তু আমার আবার সমস্যা দেখা গেল আলসারের ব্যাথা নিয়ে। এই আলসার আমাকে জীবনে বহু ভুগিয়েছে। এক আলসার, আর দুই নম্বর পাইলস্। ইস্, কী কষ্টই না করেছি জীবনভর। সেই বুয়েট থেকে খাওয়ার অনিয়মে এবং অখাদ্য কুখাদ্য মেসের খাওয়ায়, ওই দুই রোগ ধরেছিল আমার। একটি সারিয়েছি ২০০৭-এ অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে। অন্যটি বিশ্বে উন্নতমানের আলসারের ওষুধ বাজারজাত হওয়ায় আমাকে ছেড়ে গেছে।
কাজের কথায় আসি। নির্দেশনার কাজ ছেড়ে দিলাম। দায়িত্ব নিলেন জিয়া হায়দার ভাই, কিন্তু আমাকে বহিপীর চরিত্র তাঁর বিশেষ অনুরোধে করতেই হলো।
মহিলা সমিতির মঞ্চে বজরার সেট ফেলে বড় চমৎকার নাটকটি হয়েছিল। আমি মনে করি আমার জীবনে অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাজ বহিপীর। এতে আমার সাথে অভিনয়ে ছিলেন-আতাউর রহমান, মিনু রহমান, সারা যাকের, আসাদুজ্জামান নূর ও এস এম আক্তার। সাপ্তাহিক বিচিত্রায় বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব জাহানারা ইমামের লেখায় ছিল আমার জন্য অকুণ্ঠ প্রশংসা।
বহিপীরেরও খুব বেশি শো হয়নি, তারপরেও এটি ছিল অন্যতম প্রশংসিত প্রযোজনা। ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেল অন্য নাটকের মহড়া— এডওয়ার্ড এলবি’র Everything in the garden এর রূপান্তর ‘এই নিষিদ্ধ পল্লীতে। আলী যাকেরের রূপান্তর ও নির্দেশনা : প্ৰধান চরিত্রে যাকের এবং সারা আমিন।
এসবের মাঝে প্রেমদেবতাও বেশ সক্রিয় হয়ে পড়েছিলেন সবার অজান্তে। এক সময় আমরা জানলাম কেন আলী যাকের অনেক কশরৎ করে তার বিরাট বপুখানিকে চেঁছেপুঁছে হালকা করে ফেলছে। মাশআল্লাহ এখন বোঝা গেল কেন যাকের বারবার বহিপীরের মহড়াতে হাজির হতো, এবং তার পরের নাটকেই সারাকে প্রধান চরিত্রে দাঁড় করিয়ে নিজে বেশ Slim ফিগারে তার পাশে নায়ক হিসেবে দাঁড়ালো। ভালোই জমেছিল তাদের রসায়ন। গ্রুপে সবাই আনন্দিত এমন চমৎকার একটি সম্পর্ক গড়ায়। সারা যার ডাক নাম চিকসি আর যাকেরের ছটলু। শুনেছি চিকসি নাকি কন্ডিশন দিয়েছিল— সে যাকেরের প্রেম গ্রহণ করবে যদি ছটলু তার বপু কমাতে পারে!!
যাই হোক ব্যাপার ‘মধুরেণ সমাপেয়তে’ হয়েছিল। সারা আমিন কিছুদিনের মধ্যে হয়ে গেল সারা যাকের। নিষিদ্ধ পল্লীতে আমি একটি চরিত্র পেলাম। বিবেকের চরিত্র, নাটক ভাল চললো। একটা কথা এখানে বলে নিই-গ্রুপ এতদিনে যাকেরের নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে। সে-ই প্রধান কর্মকর্তার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে তার কাজের মাধ্যমে। যদিও নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের অন্যতম প্রধান প্রতিষ্ঠাতা আতাউর রহমান নিষ্ঠার সাথে তাঁর সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছিলেন, তবে খুবই ‘লো-কী’-তে থেকে। আর সভাপতি জিয়া হায়দার অন্যতম প্রধান প্রতিষ্ঠাতা, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে,-অর্থাৎ গ্রুপ থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন। নাগরিকের নামডাক তখন দেশের মানুষের মুখে মুখে। পত্র পত্রিকায় নিয়মিত থাকতো নাগরিকের সংবাদ।
নাগরিককে নতুন জীবন দিয়েছিল আলী যাকের, এ কথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। তার উদ্ভাবনী মনন দিয়ে, সুন্দর সুন্দর সব বিদেশী নাটক খুঁজে বের করে নিজেই রূপান্তর করে নির্দেশনা দিত। এবং এখানেই মনে হলো তার এক ধরনের পক্ষপাতিত্ব চলে এলো চরিত্র নির্বাচনে।
হয়তো এটাই স্বাভাবিক, কলকাতায়ও আমরা দেখেছি বড় বড় সব নামকরা গ্রুপগুলোও ও তাই করেছে এবং একসময় ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়েছে। পরবর্তীতে বাংলাদেশও সেই পথেই গিয়েছে। এসব নিয়ে আলোচনাটা আমার উদ্দেশ্য নয়, তাতে কারো কোনো উপকার তো হবে না, বরং রং চটে যাবে আনন্দের।
এবার আসি আমাদের সবচেয়ে সার্থক প্রযোজনায়। এটি যে যাকেরের চিন্তাভাবনার ফসল তাও বলার অপেক্ষা রাখে না। বারটল্ট ব্রেখট-(Bertoh Brecht) এর আগমন ঘটলো বাংলাদেশের মঞ্চে। জার্মানীর বিখ্যাত স্বনামধন্য নাট্য বিশেষজ্ঞের এপিক থিয়েটারের নাটক Good woman of Szechwan অবলম্বনে এল সৎ মানুষের খোঁজে। প্রধান চরিত্রে সারা যাকের আসাদুজ্জামান নূর, আমি, জামালুদ্দিন হোসেন, আতাউর রহমান ও যাকের প্রমুখ।
নতুন ধরনের নাট্য প্রযোজনা ঢাকার নাট্যমোদী দর্শককে মাতিয়ে দিল। চারদিকে সাড়া জাগিয়ে দিল সৎ মানুষের খোঁজে। সারার অভিনয়ে সবাই মুগ্ধ। মঞ্চ-প্রয়োগের নতুনত্ব দেখে দর্শক চমকিত ও আপ্লুত। কিছু বোদ্ধাদের থেকে অভিযোগ এল— নাগরিক কেবলই বিদেশী নাটক প্রযোজনা করে, এটা ঠিক নয়। দেশের সংস্কৃতিকে উজ্জীবিত করাও তো তাদের দায়িত্ব। সে ব্যাপারে আমাদের বক্তব্যও তুলে ধরা হলো বিভিন্ন ফোরামে, পত্র-পত্রিকায়। আমরা বললাম-দেশজ সংস্কৃতির চর্চাতো হচ্ছেই কেউ না কেউ সে চর্চা করছে তো! সেখানে নাগরিক চায় দেশীয় সংস্কৃতির পাশপাশি বিদেশী সংস্কৃতিকে ও দেশের মানুষ জানুক। আর নাটকের ক্ষেত্রে আমাদের বিশ্বাস— দেশ-কাল-পাত্রকে অতিক্রম করে কালোত্তীর্ণ নাটক দর্শকের কাছে পৌঁছে দেয়াটাও তো আমাদের দায়িত্ব।
আলোচনা সমালোচনা চলার মাঝেই নাগরিক হাতে নিল আর একটি ব্রেখটিয় নাটক-এবার দায়িত্ব পড়লো নূরের স্কন্ধে। Mr. Puntila and his man Matti অবলম্বনে দেওয়ান গাজীর কিসসা। নাগরিকের সবচেয়ে বকস অফিস সফল নাটক। প্রধান দুটি চরিত্রে অভিনয় করলাম আমি আর আলী যাকের। পাঁচশর উপর শো হয়েছে এ অবধি। দেশে বিদেশে বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন মঞ্চে। শিল্পকলা একাডেমীর মঞ্চেও তাদের উৎসবে মঞ্চায়ন হয় আটাত্তরে এবং এতে যৌথভাবে সেরা অভিনেতার পুরস্কার পাই আমি আর যাকের। এরপর আতাউর এগিয়ে এলেন ঐতিহাসিক নাটক নিয়ে।
ডিএল. রায়ের শাহজাহান। মহড়া শুরু হলো। প্রধান চরিত্রে এলেন যাকের-আর আমাকে মনোনয়ন দেয়া হলো আওরঙ্গজীব চরিত্রে। শেষ অবধি অবশ্যি আমার আর এ নাটকে অভিনয় করা হয়নি।
কারণ, আমি তখন চাকরী নিয়ে চলে গেলাম সুদূর লিবিয়ায়। সেটা ছিল ১৯৭৮ সনের নভেম্বর মাসের ৩০ তারিখ।
লিবিয়ার গল্প অন্যত্র হবে। সেখানে মানসিকভাবে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারিনি আমি, যদিও বহুকষ্টে কাটিয়েছিলাম তিনটি বছর। নাটক করেছি নিজেরাই— মানে প্রবাসী বাঙ্গালীদের নিয়ে, কিন্তু আমার মন পড়েছিল – বেইলী রোড মঞ্চ, টেলিভিশন, এফডিসি, রেডিও স্টুডিওতে। মন শুধু বলতো কখন ফিরে যাবো দেশে আর আমার প্রিয় যায়গায়, প্রাণের কাজগুলোতে আবার কখন ব্যস্ত হয়ে পড়বো।
চলে এলাম তিন বছর পর ১৯৮১ সনের ডিসেম্বরে। তারপর আবার সত্যিই ব্যস্ত হয়ে পড়লাম আমার পুরোন প্রাণের জগতে। তবে প্রথমেই ইস্তফা দিলাম সরকারী চাকরির দাসত্ব থেকে।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন