টাইগারপাস কিন্ডারগার্টেন স্কুল। আমার প্রথম বিদ্যাপীঠ। ছোটখাট স্কুল একটা। বেড়ার দেয়াল আর টিনের চাল স্কুলটার। চারপাশে একটু খেলার জায়গা। কাঁটাতারের বেড়ায় ঘেরা।
নামেই কিন্ডারগার্টেন, কিন্তু আমরা সাধারণত কিন্ডারগার্টেন বলতে যা বুঝি মোটেও তার ধারে কাছে নয়। মামুলী প্রাইমারি স্কুল। কেবলই রেলওয়ের কর্মচারিদের ছেলেমেয়েদের জন্য প্রতিষ্ঠিত। ব্রিটিশ আমলের শেষের দিকে স্থাপিত। একেবারে আমাদের বাসার উল্টো দিকে। রাস্তার এপার ওপার।
মোটে তিনজন শিক্ষক। হেডস্যার, সেকেন্ড স্যার আর মৌলভী স্যার। আমি যে ক’বছর পড়েছি কোনো শিক্ষক বদল হতে দেখেছি বলে মনে পড়ছে না। প্রথমে শিক্ষক ছিলেন দু’জন, পরবর্তীতে সেকেন্ড স্যার অর্থাৎ আমাদের প্রিয় শিক্ষক কাদের স্যার অর্ন্তভুক্ত হয়েছিলেন শিক্ষক তালিকায়।
এখানেই আমার শিক্ষা জীবন শুরু।
কবে কখন কীভাবে ভর্তি হয়েছিলাম জানি না, তবে আব্বা নিজে গিয়ে যে আমাকে ভর্তি করেননি এটা আমি নিশ্চিত হয়েছিলাম পরবর্তী সময়ে।
এসব ব্যাপারে মানে সন্তানের স্কুলে গিয়ে কিছু বলা বা করা, এগুলো থেকে আব্বা সবসময় দূরত্ব বজায় রেখে গেছেন। অথচ এই আব্বাই একসময় নিজ চেষ্টায় মেয়েদের একটি হাইস্কুল প্রতিষ্ঠা করে গেছেন, ভাবতেই অবাক লাগে।
ভর্তি হলাম আমি, কিন্তু বোন দুটোর বেলায় আব্বা-আম্মা যৌথভাবে ‘না’ করে দিয়েছিলেন, কারণ তারা বড় হয়ে গেছে! সুতরাং তাদের আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও বাড়িতেই পড়াশুনা চালাতে হলো। (আব্বার প্রতিষ্ঠিত স্কুলটি মেয়েদের স্কুল!!) সময়ের সাথে সাথে আব্বার মুর্শিদাবাদের পারিবারিক বিধিনিষেধ পালনে অনাগ্রহী হয়ে পড়াটা লক্ষ্যনীয় বিষয়। এ পরিবর্তন না হলে আমি ও সেই দশ বছর বয়সে অভিনয় শুরু করতে পারতাম না নিশ্চয়। আব্বার কথা না হয় পরে বলি। ফিরে যাই স্কুলে।
আটচল্লিশে ভর্তি হলাম স্কুলে। কি জানি বয়স নিয়ে কী সমস্যা হল, দুম করে স্কুল থেকে আমার নতুন জন্মতারিখ লিপিবদ্ধ হলো। অর্থাৎ মূল বয়সের তুলনায় আমাকে তিনমাসের বড় দেখানো হলো। ২৫ জুন, ১৯৪৪ এটাই পরবর্তীতে আমার কাগুজে বয়েস হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেল। যদিও আসল জন্মতারিখ ১৩৫১র ২৩ ভাদ্র। বর্তমান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ৭ সেপ্টেম্বর ১৯৪৪।
এর ঝামেলা এখন প্রতি বছরই পোয়াতে হয় ফেসবুকে। আমি কাগুজে বয়সটা দিয়ে রেখেছি-সুতরাং তাদের নোটিফিকেশন অনুযায়ী প্রতি বছর ২৫ জুন প্রচুর জন্মদিনের শুভেচ্ছা পাই। আবার বন্ধুমহলে বা নাটকের জগতে প্রায় সবাই জানে আমার জন্মদিন। সুতরাং সেদিনও বঞ্চিত হই না শুভেচ্ছা থেকে।
অন্য সবার মত নিশ্চয় আমিও প্রথম দিন স্লেট আর বই নিয়ে হাজির হয়েছিলাম স্কুলে। তখন আমার স্কুল ভীতি হয়েছিল কিনা জানা নেই, তবে এটুকু মনে পড়ে (যখন বুঝতে শিখেছি তখন থেকে) যে স্কুলের সবই ভাল লাগতো, শুধু পড়াশুনা ছাড়া।
শিক্ষা জীবন যদিও শুরু টাইগারপাস কিন্ডারগার্টেন স্কুলে-হাতেখড়ি কিন্তু মুর্শিদাবাদে আমার নানা বাড়িতে। করন্দী গ্রামে।
বংশানুক্রমে এঁরাও সবাই পীর সংশ্লিষ্ট মানুষ। ধর্ম-কর্মে ভীষণভাবে মনোযোগী প্রায় প্রত্যেকেই। তাই শিশুর হাতেখড়ি হতো আরবী হরফ দিয়ে। মসজিদে।
আমার আব্বার বয়ানে যতটুকু জানি-নতুন পাজামা পাঞ্জাবি পরে, ‘গোসল-অজু সেরে (নিশ্চয় মা করিয়েছিলেন) আতর মেখে, মাথায় কিস্তি টুপি লাগিয়ে আব্বা নিয়ে গিয়েছিলেন বাড়ির ঠিক উল্টো দিকের মসজিদটায়।
জুম্মার নামাজের পরপরই উপস্থিত মুসল্লিদের দোয়া দরুদের মাঝে ইমাম সাহেব আমার হাতে স্লেট দিয়ে দেন। তারপর দেন পেন্সিল।
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম।
বলে তিনি আমার হাতটি ধরে স্লেটে লিখলেন ‘আলিফ’।
সবাই কোরাসে উচ্চারণ করেন-আলহামদুলিল্লাহ্।
সেই শুরু। শেষ হয়নি আজও। পড়ছি আর লিখছি। ভালমন্দ, যা পাই পড়বার চেষ্টা করি, কিছু ছাইভস্ম লিখবারও চেষ্টা করি। শেখা হয়নি কিছুই। সেটা অবশ্য এখন বুঝি ভালভাবেই বুঝি।
হ্যাঁ, তো সেই কিন্ডারগার্টেনে পড়াশোনা চললো ফাইভ ক্লাস পর্যন্ত। ছাত্র আমি তখন থেকেই খারাপ। পড়ার প্রতি অমনোযোগী, কাদের স্যারের অভিযোগের ছিল না শেষ। তাঁর আঞ্চলিক ভাষায় আব্বাকে বলতেন—
‘হোলা হইরলে হারে…। কিন্তু হরে না যে।’
আব্বার উত্তর ছিল শুধুই হাসি।
আহ্লাদের পুত্র তো— তিন কন্যার পর একমাত্র পুত্রধন। সেই সুবিধাটা নিতে কখনো কার্পণ্য করিনি আমিও।
আজ এই বার্ধক্যে এসে বারবার সেই দিনগুলোর ছবি ভেসে ওঠে চোখের সামনে। মাথার নিউরনগুলো পুরোনো স্মৃতিকে সজাগ করতে যেন সদা তৎপর।
যেমন এই মুহূর্তে মনে পড়ছে, সেকেন্ড স্যারের আসবার দিনটি।
প্রবল বর্ষণ মুখর দিন ছিল সেটা।
আমরা সবাই উন্মূখ হয়ে রয়েছি নতুন স্যারকে দেখার জন্যে। ভিজতে ভিজতে স্কুলে উপস্থিত প্রায় সবাই। কিন্তু স্যারের দেখা নেই।
সামনের একচিলতে বারান্দায় ছুটোছুটিতে ব্যস্ত আমরা। কিন্তু সমস্যা করছিলেন একজন আগন্তুক-যিনি আমরা আসবার আগে থেকেই ভ্যাবলার মত দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখছিলেন আর ভাবছিলেন কি যেন!
আমরা প্রচণ্ড বিরক্ত তাঁর ওপর। কয়েকবার সরে যেতেও বলেছিলাম— তিনি শুধু নীরবে সরে দাঁড়িয়েছিলেন, ব্যাস।
সময়মত স্কুল বসে গেল। আমরা যে যার ক্লাসে। হঠাৎ হেড স্যার এসে হাজির। হৈ চৈ বন্ধ। তোমাদের নতুন স্যার এসেছেন। উনি তোমাদের অঙ্ক ক্লাস নেবেন।
ইয়া আল্লাহ, এ যে সেই বিরক্তিকর মানুষটা!
ততক্ষণ ভাল করে দেখা হয়ে গেল স্যারকে— কুচকুচে কাল গায়ের রং। পাজামা আর তিন পকেট সার্ট পরা। দুটোই সাদা রঙের। তার চেয়েও বেশি সাদা তাঁর ঝকঝকে দুপাটি দাঁত। মুখ খুললেই মনে হয় হাসছেন তিনি।
আমাদের পছন্দ হলো না স্যারকে!
তরা অঙ্কা হারসনি? যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগ?
জি স্যার। আমরা কোরাসে জানাই।
ক’চাই— এক মন লোহা ভারী না এক মন তুলা ভারী?
তার পরই শুরু হলো আসল খেলা।
সবাই চিৎকার করে উত্তর দিল।
কেউ বলে লোহা, আবার কেউবা তুলা।
স্যার হেসে (নাকি দাঁত বের করে?) বললেন-এরই থামস না তোরা!
আমরা থামলাম।
তুই ক’।
ফার্স্ট বেঞ্চির একজন উঠে স্মার্টলি বললো-
লোহা ভারী!
কিললাই?
লোহার তো ওজন বেশি, তাই।
আরেকজনের হাত উঠে গেল ততক্ষণে—
ক’, তুই’ ক।
সেও উঠে চৌকষ ভঙ্গিতে দিল উত্তর।
তুলা ভারী স্যার।
কিল্লাই?
তুলা এমনিতে হালকা, কিন্তু পানিতে ভিজালে তো লোহার থেকে ভারি হবে।
এভাবেই একবার তুলার পাল্লা ভারী হয় তো অন্যবার ভারী হয় লোহার পাল্লা।
স্যার নির্বিকার। হাসছেন মনে হলো।
সেদিন স্যার নানান গল্প করলেন— কিন্তু উত্তরটা দিলেন না। ঝুলিয়ে রাখলেন পরের দিনের জন্যে। আর আমরা, গর্ধভরা মহা ধান্দা নিয়ে বাড়ি ফিরলাম। উত্তরটা আব্বাকে জিজ্ঞেস করতেই তিনি ফেটে পড়লেন হাসিতে।
উত্তর শুনে সত্যিই হতভম্ব আমিও। সেই ছোট্টবেলাতেও নিজেকে মহাগর্ধভ ভেবেছিলাম সেদিন। পরের দিন স্যার উত্তর নিয়ে অনেক কথাই বলেছিলেন— তবে খুবই আদরের সাথে। এটাই ছিল কাদের স্যারের পড়াবার রীতি।
আর একদিন মনে পড়ছে, স্যার আমাদের ধন্দে ফেলেছিলেন এক প্রশ্ন দিয়ে-দুই-এ দুই-এ কী হয়?
সবাই একবাক্যে যখন উত্তর দিলাম ‘চার হয়’-স্যার সবেগে মাথা এদিক ওদিক করে বললেন— হয়নি।
সবাই এক সাথে প্রতিবাদ করে উঠেছিলাম চেঁচিয়ে।
হাত তুলে থামতে বললেন আমাদের, তারপর ঝকঝকে দাঁতের সুন্দর হাসি দিয়ে বলেছিলেন—
দুইয়ে, দুইয়ে দুধ হয়।
আমরা হতবাক।
কাদের স্যার আমাদের বিশেষ করে পড়াতেন অঙ্ক আর বিজ্ঞান। আর প্রয়োজনে সবই। আমাদের প্রিয় স্যার হয়ে উঠতে সময় লাগেনি মোটেও। ড্রিল করাতেন, অদ্ভুত অদ্ভুত সব খেলা শেখাতেন প্রায় প্রতিদিনই, একটির কথা আজও মনে পড়ে— নামাজের সিজদার ভঙ্গিতে সারিবদ্ধভাবে বসে কোরাসে গান ধরতে হতো— ওরে ও কোলাব্যঙ, তোর লম্বা দুটি ঠ্যাং
ঘ্যাংর, ঘ্যাং ঘ্যাংর ঘ্যাং।
শুধু গান নয়, সঙ্গে শারীরিক কসরত। প্রথম লাইনের সাথে পশ্চাত প্রদেশ ওঠানামা করাতে হতো আর দ্বিতীয় লাইনের সময় হাত-পায়ে এক সাথে ভর দিয়ে লাফাতে হতো কোলাব্যাঙের মত!
কাদের স্যারকে খুব মনে পড়ে। ড্রিলক্লাসে পড়ে টড়ে গেলে ছুটে কাছে এসে জড়িয়ে ধরে বলতেন-
ব্যথা হাইসস্ নিরে?
তারপর কী সে আদর!
তিনি যে শুধু আমাদের প্রিয় স্যার ছিলেন তা নয়, গোটা টাইগারপাস, আমবাগান এলাকায় একজন জনপ্রিয় ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছিলেন।
আইয়ুব আমলে বেসিক ডেমোক্রেসির সদস্যপদের জন্য দাঁড় করিয়েছিলেন সবাই মিলে-এমন একজন জনপ্রিয় ব্যক্তির জয় নিশ্চিত ধরে নিয়েছিল সবাই। মানুষটির টাকা পয়সা বলতে কিছু ছিল না। শুধু জনপ্রিয়তার ওপর ভর করে বিপুল ভোটে সরকারী দলের প্রতিযোগীকে পরাজিত করেন স্যার। তখন আমি ঢাকায় পড়াশুনা করি। খবরটা পেয়ে মনে খুবই আনন্দ হয়েছিল আমার।
প্রাইমারি পেরিয়ে হাইস্কুল, কলেজ। কলেজ পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়। সময় গড়িয়েছে অনেক, কিন্তু কাদের স্যারের কোনো পরিবর্তন কেউ দেখেনি। যখনই দেখা হয়েছে কদমবুসি করতে চেয়েও পারিনি। তার আগেই টেনে বুকে নিয়েছেন এই নিরাহঙ্কারী মানুষটি।
বালা আসস্ নিরে?
ভাল আছি স্যার, খুবই ভাল আছি। আপনাদের আশীর্বাদেই আজ এত দূরে আসতে পেরেছি আমি।
মনে মনে একথা বলি আজও।
টাইগারপাস কিন্ডারগার্টেন স্কুলের পরবর্তী প্রিয় স্যার ছিলেন মৌলভী স্যার। নামটা আজও জানি না তাঁর। কয়েকজনকে জিজ্ঞাস করেও উদ্ধার করা গেল না স্যারের নামটা।
দেশ নোয়াখালী। মাঝারী ধরনের উচ্চতা। কিছুটা স্থূল শরীর, মুখভর্তি দাড়ি, সাদা সামান্য, হাঁটু ছাড়ানো ঝুলওয়ালা পাঞ্জাবি পরতেন খাটো লুঙ্গির ওপর। পাজামা পরতে দেখিনি কোনোদিন। খুবই ছটফটে ধরনের ব্যক্তিত্ব ছিল তাঁর। হাঁটাতেও সেটি ছিল প্রতিফলিত। টায়ারসোলের স্যান্ডেল ফটফট শব্দ তুলতো তাঁর হাঁটার সময়।
অতীব সরল মনের মানুষটা মাঝে মধ্যে হয়ে পড়তেন খুবই নির্মম। পড়া না পারলে হাতের বেত চলতো শপাশপ। ক্লাস শেষে আবার বইতো আদরের ফোয়ারা। মনে পড়ে একদিন, তখন থ্রি কিংবা ফোরে পড়ি-সহপাঠি সুরুজকে কলমা তৈয়ব জিজ্ঞেস করায় সে শুরুটা করেছিল এভাবে-
‘কমলা তৈয়ব—
ব্যাস, রাগ চড়ে গেল স্যারের।
আবার ক’।
আবার’ও একই ভুল। কয়েকবারের পর নির্মম প্রহার।
সেদিন বেতটা আমিই এনে দিয়েছিলাম স্যারের নির্দেশে।
দুঃখটা আজও বাজে আমার প্রাণে।
সুরুজের শত্রু হয়েছিলাম বেশ অনেকদিনের জন্যে।
স্যার সাধারণত বেত হাতে নিয়েই ঘুরতেন এ ক্লাস থেকে ওই ক্লাস। সেদিন কেন যেন বেত আনতে ভুলে গিয়েছিলেন আর তাতেই ওই ঘটনার পক্ষ হয়ে গেলাম আমি। সুরুজের সম্ভবত আর পড়া হয়নি ওই স্কুলে, কারণ তার বাবা বদলি হয়ে চলে যান অন্যত্র। মৌলভী স্যারের মারের হাত থেকে কেউ রক্ষা পেয়েছে শোনা যায়নি। তবে মেয়েদের ব্যাপারে স্যার ছিলেন দয়ালু। ওদের গায়ে হাত তুলতে দেখিনি কোনো দিন। ধমক-ধামক পর্যন্তই, ব্যাস।
আমি একদিন সুরা মুখস্ত না হওয়ায় ভয়ে ভাঙ্গা বেড়ার ফাঁক দিয়ে পালিয়েছিলাম স্যারের ক্লাস থেকে।
পরদিন অভিযোগ পৌঁছায় বাসায়।
আব্বার যথারীতি প্রশ্রয়ের হাসি। কিন্তু আম্মা সেদিন সুরাটা মুখস্ত করিয়ে ছেড়েছেন আমাকে। নামাজ শিখেছি আমরা সেই প্রাইমারিতে, মৌলভী স্যারের কাছে কায়দা আমসিপারা, কোরান এগুলো বাসায় বাধ্যতামূলকভাবে পড়তে হয়েছে।
ভাল কথা, ‘কায়দা’ শব্দটা নিয়ে মনে অনেক প্রশ্ন ছিল একসময়। লিবিয়ায় চাকরি করতে গিয়ে অনেক আরবি শব্দের অর্থ আবিষ্কার করেছি আমি। নিজের কৌতুহল থেকেই জেনেছি। যেমন ‘কায়দা’ মানে হচ্ছে ‘ভিত’ বা Foundation বাড়ির ভিতও কায়দা। ‘মালাউন’ শব্দ নিয়েও যথেষ্ট ঔৎসুক্য ছিল মনে কিন্তু মানেটা জানলাম লিবিয়ায়— এর মানে হচ্ছে ‘অভিশপ্ত’। এবং এটাও জেনেছিলাম যে এটা হচ্ছে অত্যন্ত কদর্য একটি গালি। এ গালিটা কেউ কাউকে দেয় না, কারণ মানুষের কারো পক্ষে জানা সম্ভব নয় কে সৃষ্টিকর্তা কর্তৃক অভিশপ্ত।
আর একটা শব্দ শুনে অবাক হয়েছিলাম ‘জিয়ারৎ’-এর মানে হচ্ছে ভ্ৰমণ। আমি আপনার বাড়ি বেড়াতে যাব সেটাও জিয়ারৎ। হাসপাতালে রোগী দেখতে যাওয়াও জিয়ারৎ। ওরা অবশ্য ‘ৎ’ উচ্চারণ করে না। ওরা বলে “জিয়ারা।
‘মৌলভী স্যারের কথায় ফিরে আসি। স্যার প্রতিদিন আমাদের জোহরের নামাজ পড়াতে স্কুলের সন্নিকটে আমবাগান মসজিদে নিয়ে যেতেন এবং ক্লাস ফাইভে ওঠার পর পালা করে আমাদের কয়েকজনের ওপর অর্পিত হয়েছিল ‘আজান’ দেয়ার দায়িত্বও। আজও ভুলিনি মৌলভী স্যারের সেই কমদামী গোল গোল কাঁচের ভেতরকার মায়াময় চোখদুটোর চাহনী। ভাল কথা, স্কুলের পেছন দিকে একটি নিমগাছ ছিল তখন, তার ডালের মার যেমন খেয়েছি স্যারের হাতে, তেমনি তার ডাল দিয়ে মেসওয়াক করাও শিখেছিলাম স্যারের কাছ থেকে। হেড স্যারের নামটা কিছুতেই মনে করতে পারছি না। খুব সম্ভবত মনসুর বা ওই ধরনের কিছু। গম্ভীর মানুষটা সব সময় ফুল প্যান্ট আর হাওয়াই শার্ট পরে থাকতেন। মুখ ভরা বসন্তের দাগও তার মিষ্টি চেহারাকে পারেনি এতটুকু বিকৃত করতে। ‘লেখাপড়া করে যে গাড়ি ঘোড়া চড়ে সে’, লাইন দুটো স্যার প্রায়ই আমাদের ক্লাসে কোরাসে বলতে নির্দেশ দিতেন। বাড়ি ছিল পশ্চিম বঙ্গের কোথাও। কথাতেই প্রকাশ পেত সেটা। আমরা ভয় পেতাম, কিন্তু মনে পড়ে না কোনোদিন স্যার কাউকে মেরেছেন বা বকাবকি করেছেন।
সুন্দর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ ছিলেন তিনি।
স্যারদের খুশি করার জন্য আমরা প্রতিযোগিতা করে ফুলের মালা নিয়ে যেতাম স্কুলে। ভোরে ঘুম থেকে উঠে দৌড়তাম সেই পাহাড়তলি পর্যন্ত বকুল ফুল কুড়াতে। স্যারদের মুখে ফুল পাওয়ার পর যে হাসি ফুটে উঠতো, তাতেই মন ভরে যেতো আমাদের। সবচেয়ে বেশি খুশি হতেন মৌলভী স্যার। তাঁর কাছেই জেনেছিলাম রসুল (সা.)-এর অতি প্রিয় ছিল ফুল।
স্কুলটা আকারে ছোট থাকলেও চারপাশ ঘিরে খেলাধুলার জন্যে বেশ বড়সড়ো উন্মুক্ত যায়গা থাকায় আমাদের আনন্দের শেষ ছিল না। দৌড়ছুট লেগেই থাকতো। তার ওপর এর গন্ডির বাইরেও উন্মুক্ত চাটান ছিল, তার পেছনে রেল লাইন, তারও পেছনে একটি পুকুর। সারা এলাকার একমাত্র ঘাটবাধানো পুকুর। সুতরাং মজা করার মত পরিবেশ আমাদের হাতছানি দিয়ে ডাকতো সারাক্ষণ, স্কুল মানেই (পড়াটুকু বাদ দিয়ে) অফুরন্ত আনন্দের আধার!
এই আনন্দে হঠাৎই ছেদ পড়লো একদিন। সকালে বইখাতা বগলে নিয়ে স্কুলে এসে দেখি— বন্ধ। বন্ধ মানে স্যারেরা বাইরে দাঁড়িয়ে আর পুরো স্কুলে শুধু পুলিশ আর পুলিশ, পুলিশের দখলে স্কুল। ক্লাস হবে না। কবে হবে তা স্যারও জানেন না।
ব্যাপার কী?
তখন জানতাম না বা বুঝতাম না।
পরে জেনেছি, বুঝেছি।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন