বিষাদবৃক্ষ – ৬

মিহির সেনগুপ্ত

ছয়

আমাদের গ্রামের বক্সীবাবু ছিলেন আমাদের বড় স্কুলের হেডমাস্টারমশাই। তখনকার দিনের বিএ পাস। দশ গ্রামের মানুষের সম্মান পেতেন তিনি। তাঁর বাড়িঘর বাগানবিলাস, ঘাটলাওলা পুকুর—এত চমৎকার সাজানো যে একবার দেখলে আর ভোলা যায় না। তাঁর ছেলেমেয়েরা লেখাপড়ায় সব আদর্শস্থানীয়। বক্সীবাবুই ওই স্কুলের সর্বেসর্বা। তিনি স্কুলটিকেও রেখেছিলেন তাঁর বাড়ির বাগানটির মতো পরিচ্ছন্ন। পাশের মুসলমান গাঁয়ের তালুকদার সাহেব তাঁর দোস্ত। বাড়ির বাঁধানো পুকুরঘাটে বিকেলে তাদের নিয়মিত আড্ডা। তালুকদার বলতেন : বক্সীবাবু, মুই যদ্দিন আছি, আপনের কোনো চিন্তা নাই। আপনেরা এহানেই থাকবেন। স্কুলের কাম য্যামন চলতাছে, চলবে। বক্সীবাবু বলতেন, না চিন্তা আর কী? খালি মাইয়ারা বড় অইছে। চাইরদিগে যা শুনি মনে ভয় তো এট্টু লাগেই। তালুকদার বলতেন, না ভয়ের কারণ নাই। আপনের মাইয়া আমার মাইয়া জুদা না। ইনসাল্লা, যদি কোনো হারামির পোয় মোর মায়গো দিকে তাহায়, হ্যার ক্যালাডা দুফাঁক করইয়া দিমু।—বক্সীবাবু এ কথায় কতটা আশ্বস্ত হতেন সঠিক জানি না, অনুমান করতে পারি যে খুব একটা হতেন না। কারণ ইতোমধ্যে আশপাশের বেশ কয়েকটা বনেদি পরিবার, যেমন উকিলবাড়ি, চাটুজ্জেবাড়ি, গাঙ্গুলিবাড়ি সবাই কখন যেন বাড়ি তালাবদ্ধ করে বা কেউ কেউ কোনো তালেবর মিঞাসাহেবদের দেখাশোনা করার দায়িত্ব দিয়ে ওপারে কিছু ব্যবস্থা করতে গেছেন। অবশ্য তারা সবাই সপরিবারেই গেছেন। তাদের ছেলেপুলেরা বহু আগে থেকেই ‘কইলকাতায়’ চাকরিজীবী। সেখানে তাদের একটা অগতির গতি ঠাঁই ছিল। এমনকি নগেনমশাইও যখন বাড়িঘর বিক্রি করে গঞ্জে এবং সেখান থেকেও কোনো আঘাটায় উধাও হলেন তখন আমার কাছে সবকিছু যেন অন্ধকার বোধ হতে লাগল। কোথাও টিনের চালা, কাঠের ফ্রেমের সুন্দর বাড়িগুলোর ভিতগুলো পড়ে আছে। সামান্য পয়সায় কিনে অথবা জবরদখল করে সেইসব টিন, কাঠ, বাড়ির আশপাশের গাছপালা সব তুলে নিয়ে, কেটে নিয়ে ঘরের ভিতটাকে যেন একটা চিতার আকৃতি দিয়েছে। সেদিকে তাকালেই বুকের মধ্যে দুমড়ে ওঠে। আবার কোনো কোনো বাড়িতে ঘর আছে, কিন্তু সেখানে মানুষেরা নেই। মাটির ভিতগুলোর কোথাও ইঁদুর গর্ত করে মাটি টাল দিয়ে রেখেছে, কোনো স্থান দিয়ে হয়তো কোনো চোর সিঁদ কেটে ঢুকে ঘরের এটা-ওটা নিয়ে গেছে। সেই বাড়িগুলো হয়েছে আরও ভীতপ্রদ এবং করুণও। সেগুলোর পাশ দিয়ে যখন যাতায়াত করতাম বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠের ‘পদচিহ্ন’ গ্রামের ছবিটা ভেসে উঠত। রাতে সেসব ঘরে আর আলো জ্বলে না। তুলসীমঞ্চে সন্ধেবেলায় কেউ প্রদীপ জ্বেলে শঙ্খ বাজায় না, অথবা সকালে গাছের গোড়ায় জল দেবার কেউ নেই। একসময় এইসব কৃৎকর্ম দেখতে দেখতে ওই শৈশবেই তো একটা অভ্যেস হয়ে গিয়েছিল। ওইসব বাড়ির ছেলেপুলেরা খেলার মাঠে আর খেলতে আসে না নগেনমশাইয়ের বাড়ির চত্বরে। যেখানে আমাদের ‘দাড়িয়াবান্দা’, ‘হাডুডু’ ইত্যাদি খেলার ‘কোট’ ‘খাড়া’ থাকত, সেখানে রতনদা, কাঞ্চুদা, তৈয়ব, নাজির এরা হাঁক দিলে যেমন আর সব বাড়ি থেকে পিলপিল করে ছেলেরা এসে হাজির হতো, এখন দেখছি, তাদের সংখ্যা ক্রমশ কমে যাচ্ছে। তারা হঠাৎ হঠাৎ কোথাও উধাও হয়ে যাচ্ছে।

আগে নগেনমশাইয়ের বাড়ির ওই চত্বরে কাঞ্চুদা, রতনদায়েরা হাঁক দিত —

লোনতা দুই
লোনতা তিন—
লোনতা এক

এরকম ‘লোনতা দশ’ পর্যন্ত, এটা ছিল খেলতে আসার জন্য আওয়াজ। নগেনমশাইয়ের বাড়ির ভিতটা যখন ‘চিতা’ হলো, তার কিছুদিন পর থেকেই আমাদের ওই ক্রীড়াস্থানে ‘লোনতা’য় আর কেউ সাড়া দেয়নি।

তালুকদার তখন উঠতি। পৈতৃক জমিজমা যা ছিল, তা নিয়ে মধ্যবিত্ত-প্রায় একরকম সচ্ছল জীবনযাপন করছিলেন। চারটি ছেলে। বেশ পড়াশোনা করে দাঁড়িয়ে যাচ্ছিল। বড়টি তখন চাকরি করে। ভালো পরিবার। এ সময় তালুকদার বক্সীবাবুর সঙ্গে কী না কী কথাবার্তা করলেন জানি না। একদিন দেখা গেল, বক্সীবাড়ির ঘর-দরজা, বাগান পুকুর সব পড়ে আছে। তারা নেই। তদবধি তালুকদার সেই বাড়ির স্বত্বাধিকারে বহাল। বক্সীবাবুর বাড়ির সৌষ্ঠব তখন তার মঞ্জিলে। তার লাইব্রেরির বইপত্তর বড় স্কুলের বইপত্তরসহ আলমারি সব তার গরিবখানায় আস্তে আস্তে গস্ত। অজুহাত খুবই জোরদার। নচেৎ চোরে দাউরে নিয়া বেয়াক যদি নষ্ট করে?’ তবে সেসব বইপুস্তক ওই পরিবারের কলেজগামীদেরও কারও যে অধ্যয়নে আসেনি, তার সাক্ষী আমি অন্তত ছিলাম। তালুকদার এবং তার সন্তানেরা পড়ে পাওয়া আঠারো আনার দখলদারি লাভ করেছিল বটে, কিন্তু সংস্কৃতি বা রুচি শুধু অকস্মাৎ-লব্ধ সম্পদের সাহায্যে অর্জিত হয় না। তার জন্য নির্দিষ্ট ঐতিহ্য চাই অথবা এক কষ্টকর সাধনা। এই তালুকদারদের ক্ষেত্রে তার কোনোটাই ছিল না। তারা ভেবেছিলেন যে, বক্সীবাবুর আয়োজনসমূহ তুলে নিয়ে যদি তাদের মঞ্জিলে জমায়েত করেন, তাহলেই বক্সীবাবুদের ঐতিহ্যগত বা সাধনালব্ধ সংস্কৃতিতে ‘তালিবান এলেমবান’ হবেন। কিন্তু বক্সীদের ওই ব্যাপারটি ‘ন মেধয়া ন বহুনা শ্রুতেন লভ্য’। এর জন্য যে সাধনার নির্দিষ্ট অনেকগুলো সিঁড়ি পার হওয়া দরকার, সে কথা তাদের জানা ছিল না।

তালুকদারের তখন আর্থিক আয়ের উৎসও তরতর করে বাড়ছে। বক্সীদের নানান সম্পদ, জমিজিরাত, বাগানের নারকেল-সুপারির আয় তালুকদারের রোজগারে আনায় টাকা জুগিয়ে যাচ্ছে। এ সময়ে তারা একটি দোনলা বন্দুকও নিয়ে নেন। মেজ ছেলে বন্দুক নিয়ে যখন-তখন, যত্রতত্র পাখি শিকারে যায়। আমরা মাঝে মাঝেই বন্দুকের ‘গুড়ুম’ আওয়াজ শুনি। বড় খালধারের রাস্তা ধরে হাতে দু-চারটে হরিয়াল, ঘুঘু বা হট্টিটি পাখি ঝুলিয়ে তালুকদারের মেজ ছেলে আমাদের সবাইকে তাক লাগিয়ে চলে যায়।

এই সময় তার কলেজের পরীক্ষা শেষ। অখণ্ড অবসর। দু-একজন সহপাঠীর সাহচর্যে তাই স্কুলটি চালাবার দায়িত্ব নিয়েছে সে। কিছু একটা করা দরকার। তার বন্ধু হরমুজ আলিও এ ব্যাপারে খুব উদ্যোগী। তারা স্কুলটা নষ্ট হতে দিতে চায় না। কিন্তু ছাত্র নেই। হিন্দুরা দেশ ছাড়ছে নাগাড়ে। সাধারণ মুসলমান এবং নিম্নবর্গীয় হিন্দুদের সন্তানেরা কদাচিৎ স্কুলে আসে মাঠের কাজ শেষ হলে। মাসখানেক, মাসদুয়েক বড়জোর তাদের সময় বা উৎসাহ, তারপর স্কুলটা খাঁখাঁ করতে থাকে শ্মশানের মতো। তালুকদারের ছেলেরা এবং কিছু হিন্দু-মুসলমান মুরুব্বি শ্রেণির মানুষেরা অসম্ভব নস্টালজিয়াগ্রস্ত হয়েও এই শূন্যতা ভরাট করতে পারেন না। আগের অবস্থার পুনঃপ্রতিষ্ঠা কোনোমতেই সম্ভব হয় না। একসময় তাই ভগ্নোদ্যম হয়ে চাকরির চেষ্টায় তারা শহরে পাড়ি দেয়। আমার মতো হতভাগ্য ছেলেরাই শুধু পিছারার খালপারের চৌহদ্দিতে এক নিঃসীম শূন্যতার মধ্যে গুমরোতে থাকি আর পরিপার্শ্ব নিঃশব্দে নষ্ট হতে থাকে।

মনে আছে কিছুদিন আগেও এরা সবাই তফসির মিঞা নামে একজন পল্লি উন্নয়ন অফিসারের সহায়তায় চাঁদতারা ক্লাবের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আমরা হিন্দু-মুসলমান কিশোরেরা সেই ক্লাবের মেম্বার হয়ে বেশ কিছুদিন গ্রামগুলোর ডোবা, পুকুর, দিঘিগুলোকে কচুরিপানামুক্ত রাখার প্রচেষ্টা নিয়েছিলাম। কিন্তু যেসব বাড়ি তালাবদ্ধ, একজনও প্রাণী নেই, সেসব বাড়ির পুকুর, দিঘি, বাগান ইত্যাদি যে খুব বেশিদিন পরিষ্কার রাখা যায় না, এ কাণ্ডজ্ঞান অনেক পরে আমাদের হয়েছিল। অবশ্য এতে যাঁরা ওইসব সম্পত্তির সদ্য মালিক হয়েছিলেন, তাদের লাভ হয়েছিল মেলা। একসময় ক্লাব বন্ধ হয়ে যায়, তফসির মিঞা অপেক্ষাকৃত জনবহুল এলাকায় তার অফিস উঠিয়ে নেয়। এ ভদ্রলোক সত্যিকারের একজন উদারপ্রাণ মহৎ মানুষ ছিলেন। অন্য যাদের কথা বললাম, তাঁরাও কেউ খারাপ মানুষ ছিলেন না। তবে পরিস্থিতিটাই ছিল তখন অন্য ধরনের। সে জন্য তালুকদারের ছেলেদের বা তাদের অনুগামীদের সবাইকে দোষ দিতে পারি না। সদ্য আহৃত স্বাধীনতা হিন্দুসমাজের উচ্চবর্ণীয়দের প্রাক্তন ভেদাচারের যন্ত্রণা, যৌবনিক প্রদাহ প্রশমনের সহজ উপায় এবং সর্বোপরি প্রতিশোধস্পৃহাজনিত রিরংসা—যা প্রতিনিয়ত পত্রপত্রিকায় প্রচারিত সংবাদালেখ্য থেকে আহৃত, তার প্রকোপ এড়ানো এদের পক্ষে খুব সহজ ছিল না।

পিছারার খালের আশপাশের হিন্দুসমাজটি তখন একেবারেই ভেঙে গিয়েছিল। ফলে অবশিষ্ট হিন্দু অধিবাসীদের মধ্যে একটা নৈতিক অধঃপতন আস্তে আস্তে পরিলক্ষিত হতে থাকে। পারিবারিক শাসন আলগা, অভিভাবকেরা উদাসীন, ছেলেমেয়েদের শিক্ষাদীক্ষার কোনো ব্যবস্থা নেই, বিবাহের বয়স অতিক্রান্তা মেয়েদের বিয়ে-থা দেয়া হচ্ছে না। সে এক মাৎস্যন্যায়ী অবস্থা। এরকম সময়ে বন্দুকধারী কোনো সুঠাম সুবেশ যুবক যদি কোনো পরিত্যক্ত বাড়ির পুকুরঘাটের পার্শ্ববর্তী জঙ্গলে ভরদুপুরে পাখি শিকারের উদ্দেশ্যে বিচরণ করে, তবে গ্রামীণ যুবতীদের পক্ষে সহজ অবগাহন যেমন সম্ভব হয় না, তেমনি সম্ভব হয় না স্বকীয় অসহায় যৌবনের প্রদাহকে চোখের সামনের সুবেশ যুবকের আকাঙ্ক্ষার চাউনি থেকে, আশ্লেষ থেকে এবং সম্ভোগ থেকে রক্ষা করবার। আবার এ দাহ কদাচ জাতি বিচার করে। তাই যা ঘটবার তা ঘটেই, আর সেই সংঘটন জন্ম দেয় অন্য এক প্রদাহের, যাকে আমরা, বিশেষ করে এইসব ক্ষেত্রে, সাম্প্রদায়িক ব্যভিচার বলে এতকাল গণ্য করে এসেছি। তালুকদারের মেজ ছেলে অথবা তারই বয়সি অন্য কোনো মুসলমান যুবক যদি আমার গ্রামের কোনো যুবতীর সঙ্গে তার সম্মতিতে একদিন সহবাস করেই থাকে, তা হলেও ঘটনাটির বিন্যাস এরকমই হয়।

এরকম দু-একটি ঘটনা তখন আমি দেখেছি। কিন্তু যে যুবতীটি শহর থেকে আসা তথাকথিত মামাদের সঙ্গে সম্পর্ক করতে পারে, সে যদি কোনো মুসলমান যুবকের সঙ্গে একদিন সম্পর্ক করেই বসে, তাতে কী? কাজটি যে সামাজিক বিচারে অবৈধ, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু তা তো উভয়ত। কিন্তু তাতে যে অনেক কিছু, সে জ্ঞানও আমার ততদিনে হয়েছে। যুগ একটা ব্যাপার এবং তখন সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি ব্যাপারটাকে করে তুলেছিল আরও জটিল।

বক্সীবাবু ব্যাপারটি বুঝেছিলেন বলেই একদিন তালুকদারকে বাড়িঘর আগান-বাগান দেখার দায়িত্ব দিয়ে এক ভোররাতের আলো-আঁধারিতে সবার অলক্ষে গ্রামত্যাগ করেন। ভয় পেয়েছিলেন তিনি। কেলেঙ্কারির ভয়। তার মেয়ের বয়স তখন পনেরো। চারদিকের নানান ঘটনাবলির খবরে দুশ্চিন্তা মনে ছিলই। কিন্তু তখনও দেশছাড়ার কথা তিনি ভাবেননি। কারণ, অন্যান্য স্থানের মতো আমাদের পিছারার খালের চৌহদ্দিতে দাঙ্গা, খুনখারাপি বা অগ্নিসংযোগ ইত্যাদি ঘটেনি। যা হোক, একদিন এখানে একটি ঘটনা ঘটে। বক্সীবাবুর মেয়ের বয়সি একটি মেয়ে একটি মুসলমান ছেলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় ধরা পড়ে। স্থানটি নির্ধারিত হয়েছিল একটি ‘পাইত্রাবনে’। মেয়েটি যুগি সম্প্রদায়ের। ছেলেটির নাম আবুল। অতঃপর স্কুলের বিভিন্ন শ্রেণিতে রব ওঠে, আবুল যুগি পাইত্রাবনে। এখন এই ঘটনাটির সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণে গিয়ে সমাধানের কাণ্ডজ্ঞান কারও না হওয়ায়, বিষয়টি মাত্রা পেল—’মোছলমানের পোলা আবুল অমুক যুগির বয়স্থা মাইয়াডারে পাইত্রাবনে টানইয়া নিয়া বেইজ্জত করছে। এ হালার দ্যাশে আর জাত ধম্ম মান ইজ্জত কিছুই রইল না।’ এই সময়টিতে পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দুদের জাতধর্ম বড় ‘নাজুক’ ছিল। সামান্য কারণেই তা ভেঙে পড়ত। কারণ তারা সংখ্যালঘু।

অন্যপক্ষে মিঞাপুত্ররা, যারা উঠতি, তারা হিন্দুদের এই সামাজিক অবক্ষয়জনিত অবস্থাটির যথাসাধ্য সদ্ব্যবহার করতে কিছুমাত্র ত্রুটি করছিল না। এ কথায় কেউ আপত্তি জানালে উপায় নেই, কিন্তু মুসলমান সম্প্রদায় নিজস্ব সমাজে মেয়েদের সঙ্গে সহজ মেলামেশায় অভ্যস্ত ছিল না বলে হিন্দু মেয়েদের প্রতি বড়ই আকাঙ্ক্ষী ছিল। কারণ এরা আদৌ পর্দানশিন ছিল না এবং তাদের কাপড়চোপড় পরার ধরনটিও ছিল আলাদা। আর একবার এ কথাটি পাঠক-পাঠিকাদের উদ্দেশ্যে জানাই যে, এই পর্যবেক্ষণের পটভূমি আমার পিছারার খালের চৌহদ্দির জগৎটিই, যেখানে আমার দৃষ্টিকোণ মধ্যবিত্ত হিন্দুসমাজের মধ্যে বেড়ে ওঠা একটি কিশোরের এবং প্রতিবেশী মুসলমানসমাজের অধিকাংশ অত্যন্ত সাধারণ শ্রেণির। তাদের মধ্যে শিক্ষার প্রসার তখনও নিতান্ত সামান্য।

সে যা হোক, মানুষের যৌনতার আতিশয্যের নানাবিধ কারণের মধ্যে পোশাক-আশাকের ‘ঢঙ’ বোধহয় একটা প্রধান কারণ। অন্তত এ ক্ষেত্রে মুসলমান যুবকদের সেরকমই ভাব দেখেছি। পরে, একটু বড় বয়সে দু-একজন মুসলমান বন্ধুও আমাকে এ বিষয়ে বলেছে। হিন্দু বাঙালি মেয়েদের ‘ডেরেস দিয়া’ শাড়ি পরার জন্য তাদের যে অতিরিক্ত যৌন তাড়না ঘটে, তা তারা পরিষ্কারভাবেই আমাকে বলেছে। ব্যাপারটি বিপরীতক্রমেও এরকমই মনে হয়েছে আমার। কেননা আমিও তখন ওখানেই বয়ঃপ্রাপ্ততায় ‘দামড়া’ হচ্ছিলাম। আমার যৌনতাবোধের ইতিহাসও অনুরূপই। সেখানে মুসলমান মেয়েদের সালোয়ার-কামিজ জাতীয় পোশাক, যা হিন্দুদের সমাজে তখন ব্যবহারে ছিল না, আমার মতো হিন্দু ছেলেদের অসুবিধে ঘটাত। আমাদের গ্রামের প্রান্তিক অবস্থানে যে পোড়োবাড়িটি দাশের বাড়ি নামে খ্যাত ছিল, সেখানে উপনিবেশকারী মুসলমান পরিবারটির সাবেহা, রেহানারা তাদের পোশাকে আমার মতো হিন্দু কিশোর বা যুবকদের যৌনতায় সেসব দিনে যে অসম্ভব তাড়নার সৃষ্টি করত, সে কথা অস্বীকার করা সত্যের অপলাপ

বক্সীবাবু, ‘আবুলযুগি পাইত্রাবনে’ এমতো ধ্বনি শুনে, প্রথমেই ধাক্কা খেলেন এই ভেবে যে, তাঁর মেয়েও ওই বয়সি। অতএব, আর এখানে থাকা বোধহয় সংগত হয় না। তিনি বিচক্ষণ শিক্ষিত লোক। হয়তো বিচারবিবেচনায় অনেক কিছুই গ্রহণ করতে সক্ষম, কিন্তু পারিপার্শ্বিক অবস্থা তাঁর চিন্তাবিশ্বের সড়ে তো সহযোগিতা করবে না। বিশেষত নিমজ্জমান সমাজে মানুষ বড় অবুঝ হয়। তারা তখন কোনো সমস্যার কার্যকারণ বিচার করে না। তিনি বুঝেছিলেন নিশ্চয়ই যে, এই গ্রামীণ সুখ, সম্পদ এবং বর্ণাঢ্য জীবনযাপনের এখানেই ইতি। অতএব, ‘অন্য কোথা, অন্য কোনোখানে’ জীবনের তরি ভেড়াতে হবে। আবুল এবং ওই যুগি মেয়েটি তার স্কুলেরই ছাত্রছাত্রী ছিল। তার এতাবৎকালের শিক্ষকতার জীবনে এ ঘটনা একেবারেই নতুন, যা তাঁর চিন্তায় কখনোই আসেনি।

কিন্তু ঈদৃশ ঘটনা যুগের পর যুগ ধরে ঘটে আসছে। ইতিহাসে হিন্দু এবং মুসলমানের প্রেম বা যৌন সম্পর্কের ঘটনা বিগত প্রায় হাজার বছরের পারস্পরিক সহাবস্থানে কখনো ঘটেনি এরকম তথ্য আমার জানা নেই। আবার তার সবটাই যে জবরদস্তি, এরকম কথাও কোথাও পাইনি। এ ক্ষেত্রে প্রেম এবং যৌন সম্পর্ককেও প্রায় সমার্থক অর্থে ব্যবহার করার জন্য হয়তো অনেক আধুনিকপন্থিরা মূর্ছা যেতে পারেন, কিন্তু আমার কৈশোরক অভিজ্ঞতায় পিছারার খালের ব্রহ্মাণ্ডে বিষয়টির ভিন্নতা, সামাজিক ব্যবহারে অথবা চিন্তনে আমি কখনোই উপলব্ধি করিনি। দুটি বিষয়কেই একক ধারার রকমফের বলেই জ্ঞাত হয়েছি।

বক্সীবাবুর অবস্থাটা অন্য। যদি বলি, তিনি বিন্দুতে সিন্ধু দর্শন করে তাঁর ওই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন, তাও বলা যায়। আবার ওই সিদ্ধান্ত না নিলেও সেই সময় যে ব্যাপক আন্দোলন করে এমন কু-আচার রোধ করবেন, এমন ক্ষমতাই-বা তাঁর কোথায়? অতএব, সহজপন্থা, ‘য পলায়তি, স জীবতি’। বক্সীবাবু শুধু একজন শিক্ষক নন। তিনি বিপদে-আপদে মধ্যবিত্ত হিন্দুদের এমনকি মুসলমানসমাজের মানুষদেরও আশ্রয় ছিলেন। অতএব তাঁর দেশত্যাগ ব্যাপারটি একটি অতি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হিসেবেই সবাই গ্রহণ করল। তার দেশত্যাগের সঙ্গে সঙ্গে আমার পিছারার খালের জগৎ তার আধুনিকতার প্রবেশের পথটিই হারিয়ে ফেলল। আমাদের এই অঞ্চলটি দেশের অত্যন্ত গভীরে অবস্থিত হলেও তার একটি চমৎকার আধুনিক বিকাশক্রম ছিল। এই বিকাশধারাটি দেশভাগ তথা বিশেষ বিশেষ মানুষদের দেশত্যাগজনিত কারণে প্রতিহত না হলে যে একটি চমৎকার সাংস্কৃতিক স্থান হিসেবে পরিণত হতে পারত, সে বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই। বক্সীবাবুকে নিয়েই এত কথা বললাম বটে, কিন্তু তিনি যে একাই এই বিষয়ে দায়ী তা নয়। মধ্যবিত্ত অন্যান্য পরিবারগুলোও এই একই দোষে দোষী। এখানকার সাধারণ সমাজ কী হিন্দু, কী মুসলমান, এঁদের ওপর বড়ই নির্ভরশীল ছিল। এরা দেশ ছাড়লে তাদের স্থায়িত্বও অনির্দিষ্ট হয়ে পড়ে।

তালুকদারদের মতো মানুষেরা উকিলবাড়ি, বক্সীবাড়ি বা অনুরূপ অনেক বাড়ির সাজানো সম্পদ লাভ করে সাময়িক কিছুকাল ভোগ করেছিল বটে, কিন্তু সে ভোগ স্থায়ী হলো না। তাদের মধ্যে বক্সীবাবুদের মতো পারিবারিক রুচির পরম্পরা ছিল না। তা ছাড়া এইসব গৃহস্থেরা পুরুষানুক্রমে এই সম্পদ অর্জন এবং ভোগ করেছেন গৃহস্থসুলভ সংরক্ষণে। নতুন দখলকারীরা যেহেতু এই সম্পদ অর্জন করেনি, তাই তাদের ভোগে গৃহস্থের সংরক্ষণ ছিল না। তারা ফল ফুরোলে গাছগুলো কেটে বিক্রি করে। পুকুর সেচে সব মাছ ধরে নিয়ে সেসব স্থানে ধানের খেত করতে লাগল এবং এভাবে গোটা অঞ্চলটাই লক্ষ্মীছাড়া রূপ ধারণ করল। বড় খালপারের বৃক্ষদম্পতি এইসব দেখেশুনে কেমন যেন মৌন হতে থাকল।

সকল অধ্যায়

১. বিষাদবৃক্ষ – ১
২. বিষাদবৃক্ষ – ২
৩. বিষাদবৃক্ষ – ৩
৪. বিষাদবৃক্ষ – ৪
৫. বিষাদবৃক্ষ – ৫
৬. বিষাদবৃক্ষ – ৬
৭. বিষাদবৃক্ষ – ৭
৮. বিষাদবৃক্ষ – ৮
৯. বিষাদবৃক্ষ – ৯
১০. বিষাদবৃক্ষ – ১০
১১. বিষাদবৃক্ষ – ১১
১২. বিষাদবৃক্ষ – ১২
১৩. বিষাদবৃক্ষ – ১৩
১৪. বিষাদবৃক্ষ – ১৪
১৫. বিষাদবৃক্ষ – ১৫
১৬. বিষাদবৃক্ষ – ১৬
১৭. বিষাদবৃক্ষ – ১৭
১৮. বিষাদবৃক্ষ – ১৮
১৯. বিষাদবৃক্ষ – ১৯
২০. বিষাদবৃক্ষ – ২০
২১. বিষাদবৃক্ষ – ২১
২২. বিষাদবৃক্ষ – ২২
২৩. বিষাদবৃক্ষ – ২৩
২৪. বিষাদবৃক্ষ – ২৪
২৫. বিষাদবৃক্ষ – ২৫
২৬. বিষাদবৃক্ষ – ২৬
২৭. বিষাদবৃক্ষ – ২৭
২৮. বিষাদবৃক্ষ – ২৮
২৯. বিষাদবৃক্ষ – ২৯
৩০. বিষাদবৃক্ষ – ৩০
৩১. বিষাদবৃক্ষ – ৩১
৩২. বিষাদবৃক্ষ – ৩২
৩৩. বিষাদবৃক্ষ – ৩৩
৩৪. বিষাদবৃক্ষ – ৩৪
৩৫. বিষাদবৃক্ষ – ৩৫
৩৬. বিষাদবৃক্ষ – ৩৬
৩৭. বিষাদবৃক্ষ – ৩৭
৩৮. বিষাদবৃক্ষ – ৩৮
৩৯. বিষাদবৃক্ষ – ৩৯
৪০. বিষাদবৃক্ষ – ৪০
৪১. বিষাদবৃক্ষ – ৪১
৪২. বিষাদবৃক্ষ – ৪২
৪৩. বিষাদবৃক্ষ – ৪৩
৪৪. বিষাদবৃক্ষ – ৪৪
৪৫. বিষাদবৃক্ষ – ৪৫
৪৬. বিষাদবৃক্ষ – ৪৬

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন