বিষাদবৃক্ষ – ২৯

মিহির সেনগুপ্ত

ঊনত্রিশ

বাবার সঙ্গে মাস্টারমশাইয়ের কথাবার্তা হওয়ার দিন রাতের বেলা পড়াশোনা শেষ হলে স্যার আমাকে নিয়ে পাটাতন বা ‘টোঙ্গের’ ঘরে উঠলেন। আমরা ওখানেই রাতে ঘুমোতাম। একটা বাঁশের মই ছিল সেখানে ওঠার। আলোর ব্যবস্থা, যেসব ছাত্র ওখানে রাতে থেকে পড়াশোনা করত, তাদের নিজস্ব, আমি ছাড়া। আমার সব ব্যবস্থাই ছিল মাস্টারমশাইয়ের। বিজয় বলত—তুই পুইষ্যপুত্তুর কিনা হে কারণে এরকম ব্যবস্থা। তা সেই ব্যবস্থায় আমার বরাদ্দ একটি ‘টেমি’ এবং মাস্টারমশাইয়ের নিজস্ব প্রয়োজনে তাঁরও একটি ‘টেমি’। আমাদের পড়ানো এবং তাঁর নৈশ আহার শেষ হলে, তিনি নিজস্ব টেমিটি নিয়ে ‘টোঙ্গে’ উঠতেন। আমি পড়া শেষ হয়ে গেলে আলো নিবিয়ে উঠে যেতাম। সে সময় অবশ্য তিনি ঘুমোতেন না। ওই ক্ষীণ আলোয় বসে বসে হয় ব্যাকরণ কৌমুদী, নতুবা ইংরেজি কোনো গ্রামারের বই অথবা সংস্কৃত কোনো নাটক, কাব্য ইত্যাদি পড়তেন।

মাস্টারমশাইয়ের বাড়িতে কোনো ঘড়ি ছিল না। ছাত্ররাও সে যুগে ঘড়ি হাতে পরার মতো স্বাধীন বা বিলাসী হবার কথা ভাবতে পারত না, তা তাদের পারিবারিক অবস্থা যেমনই হোক। আমরা তখনও দণ্ডঘোষক পশু বা পাখির ডাকের মাধ্যমেই ‘রাত কত হলো’ খবর বুঝতাম, দিনের বেলা রোদের ছায়া বা সূর্যের অবস্থান দেখে। মাস্টারমশাইয়ের হুকুম ছিল যে, ‘কুকখায় তিন পাক দিলে শুইতে যাবা’। কুক্‌ক্খা বা কুক পাখি নাকি প্রতি প্রহরে একবার করে ‘পাক’ দেয়। প্রহর-ঘোষণার আর একটা মাধ্যম ছিল শেয়ালের ডাক। আমি অবশ্য কোনো দিনই কুকখা দুবার পাক দেয়া পর্যন্ত জেগে থাকতে পারতাম না। ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসত। এ জন্য বিরক্ত মাস্টারমশাই আমাকে জাগিয়ে রাখার একটি অভিনব দাওয়াই-এর ব্যবস্থা করেছিলেন। তখন লম্বা চুল রাখা স্টাইল ছিল। মাস্টারমশাই চুলের গোছার সঙ্গে একটি বেশ শক্ত সুতো বেঁধে আড়ার সঙ্গে অন্য প্রান্তটি বেঁধে রাখতেন। উদ্দেশ্য, বসা অবস্থায় ঝিমোলে চুলে টান পড়বে, ঘুম চটে যাবে এবং আমি আবার পড়তে শুরু করব। কিন্তু এ দাওয়াই একদিন ভুল প্রতিপন্ন হলো। এক ঊষাকালে মাস্টারমশাই যখন তাঁর নিয়মিত প্রাতঃ কাব্যোচ্চারণে বাঁশের মই বেয়ে ‘পাখি সব করে রব রাতি পোহাইল। কাননে কুসুমকলি সকলি ফুটিল’ ইত্যাদি আবৃত্তি করতে করতে নামলেন, দেখলেন ‘শিশু শিরে সূত্র বন্ধন যুক্ত অবস্থায় অক্লেশে ঘুমাইতেছে। তাহার কিছুমাত্র বিকার নাই।’ ‘তাহার আপন পাঠেতে’ মনোনিবেশেরও কিছুমাত্র উদ্যোগ নাই। রাত কাবার। আমি ওই অবস্থায়ই রাতটি পার করেছি। ঘুমের কিছুমাত্র বিঘ্ন হয়নি। মহাশয় সম্ভবত আসন্ন পরীক্ষাজনিত ত্রাসে আমার ‘কুকখার পাক পর্যন্ত’ পড়াশোনা করারও অতিরিক্ত প্রহর অতিক্রমে যৎপরোনাস্তি আনন্দ হৃদয়ে পোষণ করে একসময় ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু প্রত্যুষের দৃশ্য তাঁকে যে আনন্দিত করেনি সে কথা বলা বাহুল্য। ফলে আদেশ পরিবর্তিত হলো। কুকখার দুই পাকের পর তিনি যখন ‘টোঙ্গে’ উঠতেন, আমাকে সঙ্গে নিয়ে ওঠাই বিবেচকের কাজ বলে ধরে নিয়েছিলেন। আমাদের দেশের প্রাজ্ঞপুরুষেরা কিছু দেশজ ভাষায় আপ্তবাক্যের সৃজন করে গেছেন। তার মধ্যে একটি অনুপম বাক্য হচ্ছে-‘পোলাপানের হাতে লোয়া (লোহা), শয়তানে মারে গোয়া’। কথাটির তাৎপর্য ব্যাখ্যা না করাই শ্রেয়, ছুঁৎবাইগ্রস্তেরা হামলা করতে পারেন। তবে আভাসে বলি, বাচ্চাদের হাতে তীক্ষ্ণ লৌহাদি থাকলে ইবলিস (আলায়েসাল্লাম) তাদের ওপর সওয়ার হয়ে তাদের দিয়ে নাকি নানা ‘আকাম’ করায়। কথাটি যে যথার্থ, এ বিষয়ে সন্দেহ পোষণ করে সাধারণত গাধারা অথবা চিরকুমারেরা। কারণ গাধাদের বুদ্ধি নেই আর চিরকুমারদের জাগতিক কাণ্ডজ্ঞান পূর্ণ নয়। ইবলিস (আ.) কাণ্ডজ্ঞানহীন চিরকুমারদের যে কীভাবে কাজে লাগায়, তার ভূরিভূরি দৃষ্টান্ত আমার সঞ্চয়ে আছে। তবে চিরকুমার হলেও মাস্টারমশাই রসহীন ছিলেন না। তাঁর সঙ্গে একসঙ্গেই যদিও আমাকে ওপরে উঠতে হতো, তিনি কিন্তু তখন আমাকে পাঠ্যপুস্তক পড়ার জন্য নিপীড়ন করতেন না। তখন পাঠ্যবহির্ভূত বইপুস্তক নিয়ে তিনি গল্প জুড়তেন। এটা তাঁর পড়াবার একটা কৌশলও ছিল। তাঁর কাছে পাঠ্যপুস্তকের পড়াটাই একমাত্র পড়া বলে বিবেচিত হতো না। এভাবেই তাঁর কাছে আমার কিছু-কিঞ্চিৎ সংস্কৃত কাব্যনাটকের পাঠ রপ্ত হয়েছিল। আশ্চর্য ব্যাপার ছিল এই যে, কুপির ওই ম্লান আলোয় তিনি যখন এসব পাঠ ব্যাখ্যাতেন, তখন আমার ঘুম উধাও হয়ে যেত। আজ এই প্রায় বৃদ্ধকালে সেইসব মধুর স্মৃতি যেন বেদনার মতো বাজছে। বর্ষার রাতগুলোতে যখন তাঁর টিনের চালার ওপর বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটাগুলো চড়বড় করে পড়তে আরম্ভ করত, তখন তাঁরই শেখানো ‘মেঘদূতম’-এর শ্লোক ওই বারিপাতের ছন্দের সঙ্গে মিলিয়ে আমার কিশোরকণ্ঠের সুরে আবৃত্তি করতাম—

মার্গং তাবচ্ছৃণু কথয়তত্ত্বৎপ্রয়াণানুরূপং
সন্দেশং মে তদনু জলদ! শ্রোষ্যসি শ্রোত্রপেয়ম্‌।
খিন্নঃ খিন্নঃ শিখরিষু পদং ন্যস্য গন্তাসি যত্র
ক্ষীণঃ ক্ষীণঃ পরিলঘু পয়ঃ স্রোতসাঞ্চোপযুজ্য ॥

জলভারযুক্ত মেঘের গমন-পথটি কেমন হবে, শিপ্রাতটের কবি তা-ই তাকে বলে দিচ্ছেন। নববর্ষার নবীন জলদ মেঘ, সে তো পাতলা, হালকা মেঘের মতো চলতে পারবে না, তাকে অনেক হিসেব করে চলতে হবে কবি তাকে পথনির্দেশ করে দিচ্ছেন। তার এখন নবীন যৌবন। সে এখন যদৃচ্ছ ঊর্ধ্বগগনচারী হতে পারবে না। সোজাসুজি কোনো রাস্তাও তার নেই। তার রাস্তা সহজ নয়, তাকে এঁকেবেঁকে কত কসরত করেই না যেতে হবে। কখনো সে তার দেহভার কোনো উপত্যকায় খানিক বর্ষণে হালকা করে নেবে, কখনো-বা কোনো পর্বতদুহিতা নির্ঝরিণীর সুপেয় স্বাদু জলে কথঞ্চিৎ বল সংগ্রহ করে নেবে। এইসব শ্লোক আবৃত্তি করার সময় নানান চিন্তা আমার মনে জাগরূক হতো। এই যে মেঘ যেমন দক্ষিণ-সমুদ্র থেকে তার ভারী শরীর নিয়ে এতদূর এসে আমাদের টিনের চালায় চড়বড় করে তার দেহভার লঘু করল, তেমনি আরও অগ্রসর হয়ে সে যেন সত্যিই কোনো নির্ঝরিণীর জল পান করে বলশালী হয়ে স্বকার্যসাধনে গমন করতে পারে। আমার শঙ্কা হতো যে, এত শীঘ্রই সে বলক্ষয় করলে কীভাবে অতদূর পথের প্রান্তে অলকাপুরিতে গমন করবে?—মাস্টারমশাই আমার আবৃত্তি এবং আশঙ্কার কথা শুনে খুব খুশি হয়ে আরও অনেক শ্লোক আমাকে শেখাতেন। সেসব আর আজ স্মরণে নেই। তবে সেসব দিনে অতিরিক্ত খুশি হলে যে তিনি পকেট থেকে বার করে এক-আধ চাকা পাটালি উপহার দিতেন, তা দিব্যি মনে আছে। কাব্যরসের মিষ্টত্বের চাইতে পাটালির মিষ্টত্ব যে অধিক ধ্রুপদী এবং কালজয়ী, এর দ্বারা সে তত্ত্ব নিশ্চয় প্রমাণ হয়। মাস্টারমশাই নিজে গুড় খুব পছন্দ করতেন, আমাকেও প্রায়ই এই উপহারটি দিতেন। আমিও সেসব দিনে এর প্রকৃত গুণগ্রাহী ছিলাম। তবে যা-ই বলি না কেন, কাব্যরসের মিষ্টতার সঙ্গে গুড়ের মিষ্টতার কোনো নিকট-সম্বন্ধ আছে বলে ডাঙর বয়সে কোনো প্রমাণ পাইনি।

কথায় কথায় অনেক কথাই ব্যাপকভাবে আসছে। স্মৃতিচারণার এ এক ব্যামো। মূল কথা থাকল এক পাশে পড়ে, ‘বিষয়ান্তর এসে’ তাকে প্রায় অচ্ছুৎ করে তুলল। তখন সে যেন ‘বড়মিঞা’, তার তরিবৎ তখন প্রধান হয়ে ওঠে।

সেদিন টোঙ্গের ঘরে গিয়ে মাস্টারমশাই বলেছিলেন, তোর বাবার লগে তো আইজ কথা হইল। মনে হয়, মাঝে মাঝে তোর বাড়ি যাওন দরকার। ছোডো ছোডো ভাই-বুইনেরা, তোর মায়, এ্যারা তোর লইগ্যা রোজই ফোঁপায়। আমি কই তুই সপ্তাহে পাঁচ দিন এহানে থাক, বিষ্যুইদবার ইস্কুলের পর বাড়ি যাইয়া শনিবার আবার আবি। শুক্কুরবার ছুটির দিনডা ওগো লগে থাকলি। ভাই-বুইনগুলার ল্যাহাপড়াডাও এট্টু দ্যাখা লাগে।

মাস্টারমশায়ের কথায় আমার মাথা থেকে একটা বিরাট বোঝা নেমে গেল। তাঁর আশঙ্কা হয়েছিল বাড়ি গিয়ে সংসারের হালে আবার নিজেকে পুরোপুরি জড়িয়ে না ফেলি, তাহলে তো পড়াশোনার ইতি হয়ে যাবে। বাবার সঙ্গে কথা বলে তাঁর সে আশঙ্কা দূর হয়েছিল।

যা হোক, তাঁর অনুমতি নিয়ে সেবার দুদিন নয়, এক সপ্তাহের জন্যই বাড়ি গেলাম, বাবা যে ছাত্র পড়ানোর পরিকল্পনা করেছিলেন তা আমার মাথায় ছিল। আশপাশ-গ্রামের মুসলমান ছাত্রদের সঙ্গে যোগাযোগ করে সাত-আটজন ছাত্র পাওয়া গেল। তারা নিয়মিত পড়লে পঞ্চাশ-ষাট টাকা অনায়াসে পাওয়া যাবে। বাড়িতে ঘরের অভাব ছিল না। অনেক ঘরই খালি পড়ে ছিল। তার একটি ঘরে তারা রাতে এসে পড়াশোনা করবে। বাবা এবং যখন আমি বাড়িতে থাকব, আমি, তাদের দু-তিন ঘণ্টা পড়া দেখিয়ে দেব। এতে বাড়িরও একটা সুরক্ষার বন্দোবস্ত হলো। এইসব ছেলে ছোট, মাঝারি চাষিদের সন্তান। তারা আমাদের খুব ভালোবাসত এবং মানত। আগে যেসব লোকের কথা বলেছি, এরা তাদের থেকে একেবারেই আলাদা। স্বভাবে নম্র এবং ভদ্র। পড়াশোনা করার মতো যথেষ্ট আর্থিক সংগতি না থাকলেও এরা খুব আগ্রহী ছিল। এদের বাপ-চাচারাও মানুষ হিসেবে খুবই সরল সোজা ছিল এবং আন্তরিকভাবেই চাইত যে, তাদের সন্তানেরা কিছু পড়াশোনা শিখুক। এরা বেশির ভাগই নিম্নবর্গীয় সমাজের। উচ্চবর্গীয়দের সঙ্গে তাদের একটাই সমানাধিকার ছিল, তা ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের। মিলাদুন্নবির জমায়েত, জুমার নামাজ আদায়, ঈদের দিনের কোলাকুলি, এইসব ব্যাপারেই যা সমতা। নচেৎ শত ঢক্কানিনাদেও কি সারা মুসলিম জাহানে ‘আলবেরাদরির কোনো নজির দেখা যায়? আমার পিছারার খালের আশপাশের মুসলিম পরিবারগুলোর পূর্বজরা অমুসলিম অবস্থা থেকে যে কারণে ইসলামে শরিক হয়েছিল, অদ্যাবধি তার কোনো সুরাহা হয়নি। তারা বর্গে এবং বর্ণে যে স্থানে অবস্থিত ছিল এখনও সংখ্যাগুরুদের ক্ষেত্রে তার কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি। দেশভাগজনিত প্লবতার কারণে দু-একটি পরিবার হয়তো বর্গাগতভাবে ঊর্ধ্বগামী হয়ে অনেক অর্থব্যয়ে বর্ণগত কৌলীন্য লাভ করেছে, কিন্তু তা নিতান্তই ‘উল্লা তুল্লা’ থেকে ‘উদ্দিন’ পর্যন্ত, এর বেশি নয়। হিন্দু সমাজে অপবর্ণীয়দের অবস্থা নিঃসন্দেহে আরও বেশি জঘন্য। কিন্তু সেই জিগির তুলে, ইসলামের ঘোষিত সৌভ্রাতৃত্ব-নীতির ফাঁকা-বুলি কপচে, তার বর্তমান সামাজিক ভেদাচারের দিকে চোখ বন্ধ করে থাকাটা কম ভণ্ডামির পরিচায়ক নয়। এই পরিবস্থা ঐতিহাসিকক্রমে ‘হাদিস’সমূহের ব্যাখ্যার সময় থেকেই প্রকট। এ বিষয়ে অধমের কাণ্ডজ্ঞান নিতান্তই অনুবাদে সীমাবদ্ধ। তবুও বলছি, নারী-পুরুষের অধিকারের ক্ষেত্রে কিংবা বর্ণ-বর্গ বিভেদের নিরিখে কোথাওই এই বহুঘোষিত হাদিসি সাম্য বা সামাজিক ন্যায়ের ব্যাপারগুলো প্রশ্নের ঊর্ধ্ব নয়। এ কথা হাদিস রচনার যুগ থেকেই গ্রাহ্য ঐতিহাসিক সত্য। কিন্তু সেসব কথা আলোচনার ক্ষেত্র এটা নয়, নিরাপদ তো নয়ই। বরং সে সময়ের সংখ্যালঘুদের সমাজ বিষয়ে বক্তব্য শেষ করি।

একটা সমাজ ভাঙার পর যে তলানিটুকু থাকে, তার কোনো জীবনমুখী বহতা থাকে না। সমাজের একদার সাংস্কৃতিক, নৈতিক বা ব্যবহারিক স্বাভাবিক শুদ্ধতাবোধও এ সময় ক্রমশ নষ্ট হতে থাকে। সেই সমাজের মানুষদের আত্মসম্মান, সাহস, আত্মরক্ষার তাগিদে সংগ্রামী মনোভাব, স্বাভাবিক সম্ভ্রমবোধ সবই একে একে বিদায় নিতে থাকে। এভাবেই একে একে হ্রী শ্রী লক্ষ্মী. ঋদ্ধি এবং সিদ্ধি সমাজদেহ ছেড়ে চলে যায়। তলানিতে যে কটি প্রেতার্ত প্রাণী বসবাস করতে বাধ্য হয়, তারা হয়ে ওঠে লক্ষ্মীছাড়া উঞ্ছ স্বভাবের। তারা শুধু জৈবিক নিয়মে বেঁচে থাকে, আর তাদের হতাশার বীজে আরও প্রেতার্ত সমাজধর্মহীন কিছু অনাবশ্যক জীবের জন্ম হয়। তারা শুধু পূর্বজদের পাপের ঐতিহ্যেরই উত্তরাধিকারী হয়।

এই সময়টায় পিছারার খালের আশপাশের যে কজন হিন্দু অধিবাসী ছিল, তাদের ছেলেমেয়েরা সম্পূর্ণ উদ্ধৃবৃত্তিধারী হয়ে গিয়েছিল। বিশেষত একসময়কার মোটামুটি সচ্ছল এবং উচ্চবর্গীয় যারা, তারাই বেশি বেশি করে যেন লক্ষ্মীছাড়া জীবনের আবর্তে পড়ে পাক খাচ্ছিল। এদের এবং আমার নিজের পরিবারেও নানা ধরনের কুৎসিত আচরণ, ক্ষুধানিবৃত্তির নিকৃষ্টতম উপায় অবলম্বন, অনৈতিকতা এবং সম্ভ্রমহীন আচার-আচরণ তখন অত্যন্ত সহজেই ঘটে চলেছিল। এই সময়টাতে আমাদের কোনো সামাজিক শিক্ষাদীক্ষা ছিল না। অভিভাবকেরা ছিলেন অসম্ভব উদাসীন। শুধু আহার্যসংগ্রহ এবং সন্তানোৎপাদন আর কূটকচালতা নিয়েই ছিল তাদের জীবনযাপন। এমনকি বাড়িঘর, বাগান পুকুর ইত্যাদির দিকেও তাদের নজর ছিল না। বাগানের ফলন্ত গাছপালা কেটে বিক্রি করা, সুন্দর উদ্যানগুলোকে চষে চটিয়ে খেত করা, পুকুরগুলোকে সংস্কার না করা ইত্যাদি তাঁদের স্বভাব হিসেবে দাঁড়িয়ে গেল। তাদের জীবনযাপনে আর মধ্যবিত্ত মূল্যবোধ কিছুমাত্র অবশিষ্ট থাকল না। আগে হিন্দু এবং মুসলমান সমাজ পাশাপাশি আলাদাভাবে থেকেও একে অন্যকে নানাভাবে প্রভাবিত করত। এখন আর তা থাকল না। গ্রামের সাজানো-গোছানো রূপটি একেবারেই নষ্ট হয়ে গেল। মুসলমান গ্রামগুলোতে কিছুকাল তা যদিও খানিকটা ছিল, তাদের বিকাশোন্মুখ সামান্য মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো একসময় শহরের অধিবাসী হয়ে গেলে সেগুলোও লক্ষ্মীছাড়া হতে হতে শেষতক পিছারার খালটার মতোই শুকিয়ে গেল।

একটা সুন্দর জনপদ হতে মানুষের বহু বহু বছরের তপস্যা, তিতিক্ষা, আত্মদানের প্রয়োজন হয়। কিন্তু তা যখন ধ্বংস হতে শুরু করে, তখন কত দ্রুতই না তা সংঘটিত হয়। এই পিছারার খালটির ক্ষুদ্র জগৎটিরও নির্মাণ হয়েছিল বহুশত বৎসরের অক্লান্ত পরিশ্রম এবং সাধনায়। কত বিচিত্র জাতি, গোষ্ঠীর মানুষ, কত চণ্ডভণ্ড, মলঙ্গী, উচ্চ ও নিম্নবর্গের মানুষ যুগ যুগ ধরে এই জনপদটিকে নানান সম্ভারে সাজিয়ে তুলেছিল। এখন মাত্র কয়েকটি বছরের অবিমৃষ্যকারিতায় তা শ্মশান হয়ে গেল। কত তাঁতি, জোলা কামার, কুমোরের অহর্নিশ কর্মতৎপরতার শব্দ তাদের তাঁতের মাকুর ধ্বনিতে, হাপরের নেহাইয়ের বলিষ্ঠ শব্দতরঙ্গে পিছারার খালের আশপাশের হিন্দু-মুসলমান গ্রামগুলোকে জমজমাট করে রাখত, আজ সেখানে কোনো বন্যজন্তুও বসবাস করে না। কারণ তাদের বাস করার জন্যও কোনো আব্রু আর অবশিষ্ট নেই। নেই কোনো ঝোপঝাড় জঙ্গল, লতাগুল্ম, কোনো বাগিচা, পুকুর, খাল বা বিল। সব যেন আরব্য রজনির গল্পের ভোজবাজির মতো উধাও হয়ে গেছে।

যে সামাজিক অসাম্যের পাপে হিন্দু উচ্চবর্ণীয় সমাজ উৎখাত হয়েছে, তার কার্যকারণ বিশ্লেষণ কষ্টসাধ্য নয়। কিন্তু যারা এই ভূমিকে পবিত্র বোধে গ্রহণ করেছিল, তাদের সমাজ কী করল? সেখানে স্বপ্ন দেখার মানুষেরা কোথায় গেল? আমি মাত্র দশ বছরের একটা সামান্য সময়সীমার মধ্যে তাদেরও ভিটে ছাড়তে দেখলাম। হিন্দু সমাজের পাপের উত্তরাধিকার কি তাদের ক্ষেত্রেও অশেছিল। নচেৎ এই শূন্যতা কীভাবে সম্ভব?

সকল অধ্যায়

১. বিষাদবৃক্ষ – ১
২. বিষাদবৃক্ষ – ২
৩. বিষাদবৃক্ষ – ৩
৪. বিষাদবৃক্ষ – ৪
৫. বিষাদবৃক্ষ – ৫
৬. বিষাদবৃক্ষ – ৬
৭. বিষাদবৃক্ষ – ৭
৮. বিষাদবৃক্ষ – ৮
৯. বিষাদবৃক্ষ – ৯
১০. বিষাদবৃক্ষ – ১০
১১. বিষাদবৃক্ষ – ১১
১২. বিষাদবৃক্ষ – ১২
১৩. বিষাদবৃক্ষ – ১৩
১৪. বিষাদবৃক্ষ – ১৪
১৫. বিষাদবৃক্ষ – ১৫
১৬. বিষাদবৃক্ষ – ১৬
১৭. বিষাদবৃক্ষ – ১৭
১৮. বিষাদবৃক্ষ – ১৮
১৯. বিষাদবৃক্ষ – ১৯
২০. বিষাদবৃক্ষ – ২০
২১. বিষাদবৃক্ষ – ২১
২২. বিষাদবৃক্ষ – ২২
২৩. বিষাদবৃক্ষ – ২৩
২৪. বিষাদবৃক্ষ – ২৪
২৫. বিষাদবৃক্ষ – ২৫
২৬. বিষাদবৃক্ষ – ২৬
২৭. বিষাদবৃক্ষ – ২৭
২৮. বিষাদবৃক্ষ – ২৮
২৯. বিষাদবৃক্ষ – ২৯
৩০. বিষাদবৃক্ষ – ৩০
৩১. বিষাদবৃক্ষ – ৩১
৩২. বিষাদবৃক্ষ – ৩২
৩৩. বিষাদবৃক্ষ – ৩৩
৩৪. বিষাদবৃক্ষ – ৩৪
৩৫. বিষাদবৃক্ষ – ৩৫
৩৬. বিষাদবৃক্ষ – ৩৬
৩৭. বিষাদবৃক্ষ – ৩৭
৩৮. বিষাদবৃক্ষ – ৩৮
৩৯. বিষাদবৃক্ষ – ৩৯
৪০. বিষাদবৃক্ষ – ৪০
৪১. বিষাদবৃক্ষ – ৪১
৪২. বিষাদবৃক্ষ – ৪২
৪৩. বিষাদবৃক্ষ – ৪৩
৪৪. বিষাদবৃক্ষ – ৪৪
৪৫. বিষাদবৃক্ষ – ৪৫
৪৬. বিষাদবৃক্ষ – ৪৬

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন