বিষাদবৃক্ষ – ১৬

মিহির সেনগুপ্ত

ষোলো

এ বাড়ি ছাড়িয়া কোথায় যাইব
কেন-বা যাইব বলো।
শিশুকাল হতে বাড়ির মায়াতে
কত না শুনিতে হলো।
এরই লাগি নাকি জীবন আমার
হইয়া গিয়াছে মাটি,
এর মায়া যদি যাইত কাটিয়া
মানুষ হতাম খাঁটি।
অমানুষ কি মানুষ বলিয়া
যাহা কিছু বলো ভাই,
সেদিনের চেয়ে আজও এরে আমি
ভালোই বাসিতে চাই।

পঞ্চাশের মধ্যকালের এক সমাজ রাষ্ট্রীয় প্লবতার কারণে যখন অবশিষ্ট সংখ্যালঘুরা আবার দেশত্যাগ করতে শুরু করে তখন আমার বাবা এই পদ্যটি লিখেছিলেন আমাদের পরিবারের বেশিরভাগই একান্নর দাঙ্গার সময়ই দেশ ছেড়ে ছিলেন। বাবা, জ্যাঠামশাই বাকিদের দেশত্যাগের বিষয়ে পরে আর সচেষ্ট হননি। শুধু যখন কোনো হিড়িক উঠত তখন সাময়িকভাবে একটু দোদুল্যমান হতেন। যে সময়টার কথা বলছি তখন সেই রকম একটি অবস্থা বিরাজমান। সময়টা উনিশশ আটান্ন সালের অক্টোবর মাস। ইস্কান্দার আলি মির্জা সাহেব পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট তখনও। জনাবের শাসনকালেই দেশে এক প্রচণ্ড দুর্ভিক্ষ হয়। দুর্ভিক্ষের কথা পরে বলছি। এই উপলক্ষ্যে জেনারেল মহ. আইয়ুব খান আটান্ন সালের সাতাশে অক্টোবর তারিখে এক রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানে প্রেসিডেন্ট জে. মহ. ইস্কান্দার আলি মির্জাকে অপসারিত করে দেশের ক্ষমতা দখল করেন। এর কিছুদিনের মধ্যেই আবার সংখ্যালঘুদের দেশত্যাগের হিড়িক শুরু হয়ে যায়, যদিও এবারের ঘটনার পেছনে আগের মতো দাঙ্গার প্রকোপ থাকে না। এবারকার কায়দাটি ছিল অন্য ধরনের।

আইয়ুব খানের ক্ষমতা দখল ব্যাপারটি ঘটেছিল প্রায় পাচপেঁচি ছিনতাইকারীর কায়দায়। খানসাহেব তখন জেনারেল। অক্টোবরের ওই সাতাশ তারিখের রাত্রে নাকি জেনারেল তাঁর রিভলভারের নলটি প্রেসিডেন্ট মির্জাসাহেবের পশ্চাতে ঠেকিয়ে একেবারে করাচির বিমানবন্দরের একটি বিশেষ বিমানে বসিয়ে দেন। তাঁর হাতে লন্ডনস্থ একটি অভিজাত হোটেলের ঠিকানা এবং বুকিং সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় রসিদপত্র দিয়ে বলেন, জনাব বহুকালাবধি পরহেজগারে জীবনপাত করেছেন। পাকিস্তান এবং ইসলাম এ কারণে তাঁর সবিশেষ শুকর গুজার করছে। অধুনা সেনাবাহিনী মনে করছে জনাবের এখন বিশ্রামের প্রয়োজন। জনাব যদি কিছু মনে না করেন, তবে দেশ এবং ইসলামের স্বার্থে সেনাবাহিনী তাঁকে সব দায়িত্ব থেকে মুক্তি দিতে ইচ্ছুক। অতঃপর তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রাক্তন হয়ে গেলেন। অবশ্য যদি পুনরপি ‘অধুনা’ হবার প্রচেষ্টায় কোনো কলকাঠি নাড়তে জনাব সচেষ্ট হন তবে এই রিভলভারের নলটি তার গুহ্যদেশে ঢুকিয়ে জেনারেল প্রেসিডেন্ট স্বয়ং ঘোড়াটি টিপে দিতে বাধ্য হবেন। এখন জনাবের যেমন মর্জি। ব্যস রক্তপাতহীন বিপ্লব সমাধা হয়ে গেল। গণমাধ্যমের যতটুকু সে যুগে ব্যবহারে ছিল, তাতে এই সংবাদ ঘোষিত হলো। তাতে আরও বলা হলো, দেশের অতঃপরের প্রেসিডেন্ট জে. মহ. আইয়ুব খান। অতএব পাকিস্তান রাষ্ট্রের শত্রুরা সাবধান, মুনাফালোভী, দুর্ভিক্ষপয়দাকারী, চোরাকারবারি, ঘুষখোর আমলা সবাই সাবধান। অতঃপর এ দেশে ফৌজি কানুন মোতাবেক সব অপরাধের বিচার হবে। প্রাক্তন সংবিধান বাতিল।

আমাদের পিছারার খালের দুপাশের গাঁও-গেরস্থালিতে কদাচিৎ খবরের কাগজ পৌছাত। রেডিও ট্রানজিস্টারও তখনও সেখানে পৌঁছোয়নি। রক্তপাতহীন এই বিপ্লবে দু’একদিন পরে আমাদের বাড়ির উঠোনে, ছাতের ওপর এবং আগানে-বাগানে কয়েক আন্ডিল ইশতেহার পড়ল। রক্তপাতহীন বিপ্লবের বাণী বহনকারী ইশতেহার। তাতে নানাবিধ ভালো ভালো প্রতিশ্রুতির সঙ্গে একটি অতিরিক্ত সুসংবাদ ছিল এই যে, জেনারেল প্রেসিডেন্ট অচিরেই দেশবাসীকে প্রকৃত গণতন্ত্র উপহার দেবেন। ইতিপূর্বের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা যে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে বিশ্বাসী এবং নির্বাচিত, জেনারেল প্রেসিডেন্ট মনে করেন না যে সেই গণতন্ত্রের জন্য দেশবাসী আদৌ উপযুক্ত। মানুষকে শিক্ষিত করতে গেলে অ আ ক খ থেকেই তো শেখাতে হবে। তিনি মনে করেন গণতন্ত্রেরও সেই বুনিয়াদি ক্রম পেরিয়ে তবেই সংসদীয় স্তরে উন্নীত হতে হবে এবং প্রেসিডেন্ট স্বয়ং সেই বুনিয়াদি গণতন্ত্রের বুনিয়াদ তৈরি করে দেবেন।

ফৌজি শাসন কায়েম হতেই দেখা গেল অবশিষ্ট ছিটেফোঁটা উচ্চবর্গীয়/বর্ণীয় সংখ্যালঘুরা উৎখাত হতে শুরু করেছে। আমাদের বন্দরের পালচৌধুরীরা ছিলেন বার্মাশেল কোম্পানির এজেন্ট। তাঁরা বেশ ধনী এবং প্রতিপত্তিশালী সওদাগর। তাঁদের খবরাখবর আমরা বেশ পেতাম। আমাদের নায়েবমশাই মধ্যস্বত্বলোপের পর এখানেই চাকরি নিয়েছিলেন। কিন্তু একদা ফৌজিরা অতর্কিতভাবে সেখানে হানা দিয়ে নানান দোষত্রুটি আবিষ্কার করে এবং ফলত সংস্থাটি বন্ধ হয়ে যায়। দেশের বিভিন্ন স্থানের হিন্দু বণিক প্রতিষ্ঠানগুলো এভাবেই উচ্ছেদ হতে থাকে। অনুরূপ ছাপা মারি মুসলমান বণিক সংস্থাগুলোর ওপরও যে হয়নি তা নয়, তবে সেগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ার কোনো খবর বা স্মৃতি আমার নেই। সিএসপি আখ্যাযুক্ত কদাচিৎ দু-একজন বাঙালি হিন্দু আমলা তখনও শাসন সংক্রান্ত পদাধিকারে ছিলেন। তাঁরাও হঠাৎ হঠাৎ হিন্দুস্থানে পাড়ি জমাতে লাগলেন। এদের একজনকে আমি দেখেছিও যিনি বরিশালের বিভাগীয় কমিশনার ছিলেন, নাম এ. কে. দত্ত চৌধুরী। তাঁকে ওখান থেকে পালিয়ে আসতে হয়েছিল।

ফৌজিরা তাদের এই প্রাথমিক দুর্নীতি দমন নামক হুটোপুটি বন্ধ করে থিতু হয়ে বসার কিছুকালের মধ্যেই তাঁদের কুর্তার বহর আটত্রিশ থেকে চল্লিশ এবং কোমরবন্ধের মাপ ছত্রিশ থেকে বেয়াল্লিশে গিয়ে দাঁড়ায়। বুনিয়াদি গণতন্ত্র তার নিজস্ব নিয়মে ‘দেউলা’ করতে থাকে। কিন্তু সে শুধু শহরে। আমাদের অজগাঁয়ে আমরা অন্য সমস্যায় ধ্বস্ত হতে থাকি। এখন জেনারেল প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা দখলের সময়কার সেই দুর্ভিক্ষটির কথা বলি।

আমার যতদূর মনে পড়ে এই দুর্ভিক্ষটি হয়েছিল আটান্ন সালেই, সঠিক মনে করতে পারছি না। তখন আমি সেভেন অথবা এইটে পড়ি। একটা সময়, চুয়ান্ন কি পঞ্চান্ন সালেও হাটে-বাজারে চাল বিকোত পাঁচ থেকে সাত টাকা কাঠি। বেতের তৈরি সেরের বত্রিশ সের। এই দাম আস্তে আস্তে বেড়ে দুর্ভিক্ষের সময় দাঁড়িয়েছিল চল্লিশ থেকে পঞ্চাশে। দুর্ভিক্ষের কার্যকারণ কী ছিল, তা জানার মতো বয়স বুদ্ধি তখনও হয়নি বলে কোনো স্মৃতি নেই। এ বিষয়ে একটিই স্মৃতি জ্বলজ্বলে যে তখন আমাদের বাড়িতে একটি লঙ্গরখানা বসেছিল। ওই লঙ্গরখানাটির স্মৃতিই আমার এই দুর্ভিক্ষ বিষয়ে কথনের একমাত্র উপজীব্য। বুড়িপিসিমাদের কাছে তেতাল্লিশের দুর্ভিক্ষের গল্পে এবং পরবর্তীকালে নানান সাহিত্য-সংবাদে জেনেছিলাম যে, তখন নাকি পঞ্চাশ লক্ষ লোক মরেছিল!

আমাদের বাড়ির ‘এস্টেটের’ বাসনপত্রগুলোর তখনও বিক্রিবাটা শেষ হয়নি। সরকারি লঙ্গরখানার রসুইকর্মের জন্য অতএব, যে বাসনপত্র, অর্থাৎ হাঁড়ি, ডেকচি, গামলা, বালতি, পরাত ইত্যাদি দরকার, তা ওই স্থানে আমাদের বাড়িতেই ছিল। তখন তালুকদারি নেই। জ্যাঠামশাই এবং নায়েবমশাই ইত্যাদি মহাজনেরা নানান কারুকার্য করে এই লঙ্গরখানার দায় আমাদের বাড়িতেই নিলেন। সেই বয়সেও আমার বুঝতে অসুবিধে হয়নি যে, এই ব্যবস্থাপনার পেছনে তাঁদের সাধারণ মনুষ্যদের স্বার্থ বা হিতচিন্তা কার্যকরী ছিল না। তাঁরা নিজ স্বার্থ সংরক্ষণেই এই দায় গ্রহণ করেছিলেন। রিলিফের টন টন চাল তখন আসছিল সুদূর আমেরিকা থেকে। আমেরিকা তখন জেনারেল প্রেসিডেন্টের ওপর বড় নেকনজরি ছিল। তাঁর তখন বৃহস্পতি তুঙ্গে। এ বিষয়ে তদানীন্তন সংবাদমালা নিয়ত দেশের এবং বিদেশের সংবাদপত্রে ছবিসহ বিদ্যমান। আমেরিকানদের হরবখত মদত আমরা ওই অজগাঁয়ে বসেই প্রত্যক্ষ করেছি। তাঁরা তার বৃহস্পতি। বুদ্ধি দিয়েই যাচ্ছেন। তাঁর উদ্ধারকল্পে তথা প্রতিষ্ঠাকামনায় টন টন চাল পাঠাচ্ছেন তাঁরা। জ্যাঠামশাই, নায়েবমশাই—এঁরা সেই চালের ব্যবস্থাপনায় যদি অধিকারী হন তবেই তা তাঁদের অনেক মুশকিল আসান হয়।

কিন্তু চাল এলেই তো শুধু হবে না। তার অনুষঙ্গ ভোজ্য কী? সাত সমদ্দুর তেরো নদীর ওপারের যে বৃহস্পতি আমেরিকা চাল পাঠাচ্ছে, সে তো জানে না যে, এখানের মনুষ্য ভোজন বিষয়ে কতটা রসিক। তাই শুধু চালের বন্দোবস্তে লঙ্গরখানার ভিখিরিতম মানুষটিও তৃপ্ত হয় না। হয়তো পৃথিবীর সব স্থানের মানুষের দুর্ভিক্ষাবস্থা একরকমভাবে মোকাবিলা করা যায় না। বিশেষত আমার পিছারার খালের আশপাশ অঞ্চলের মানুষেরা শুধু ভাত বা রুটি পেলেই যে তৃপ্ত হবে এমন কোনো পরম্পরা নেই। অথচ সময়টা দুর্ভিক্ষের। দুর্ভিক্ষ এ কারণে যে, চাল নেই। তারা জানে না তাদের এত চাল কোথায় গেল? আমাদের ওই স্থানটিতে চাল না থাকাই দুর্ভিক্ষ। গম বা অন্য শস্যাদি সেখানে কখনো চালের পরিপূরক নয়। দিনভর আটাময়দা বা অন্য ভোজ্য খেলেও তারা ভাবে সারাদিন উপোসেই থাকতে হলো। তাদের খাদ্যের অভ্যেস একান্তই চালধর্মী।

সকাল থেকে দূর-দূরান্তরের ‘হাভাতে’ মানুষদের মিছিল আসত তখন। আমি তাদের নাম লিখতাম, টিপছাপ নিতাম কাগজে, কতজন খেল, কতজন এলো এইসব হিসেবের। আমাদের দরদালানে লাইন দিয়ে বসিয়ে তাদের খাওয়ানো হতো। ভাতের সঙ্গে অনুষঙ্গ হিসেবে ডাল থাকত একমাত্র সহকারী ভোজ্য হিসেবে। ওই ডাল আনা হতো রিলিফের কিছু চালের বিনিময়েই। কিন্তু তার পরিমাণ এতই কম যে, ডালটাকে ডাল বলে চালানো খুবই কষ্টকর হতো। এক সের ডালে যদি বিশ সের জল দেয়া হয়, তাহলে যা দাঁড়ায়, এই ডালটি তা-ই হতো। এটি আবার কখনো খিচুড়ি হিসেবেও তৈরি হতো। সে আরও অনবদ্য। মানুষকে চালের মধ্যে ডালের অবস্থান বিষয়ে গবেষণা করতে হতো তখন। ভাগ্যিস, হলুদ বলে একটা মশলা তখনও তেমন মহার্ঘ ছিল না, তাই রংটা মানানসই করার চেষ্টা চলত। সেও তবু মন্দের ভালো। কিন্তু ডালই যেদিন ভাতের অনুষঙ্গ হতো, সেদিন তাকে ন্যাতাধোয়া জল থেকে পৃথককরণ বড় কষ্টকর হতো। আজকের দিনে এসব কথা কাউকে বলে বা লিখে বোঝানো সম্ভব নয়। শুধু একটা উদাহরণ বলি যে, ডাল বোধে একদিন ভুলবশত ন্যাতাধোয়া জলই বুভুক্ষু মানুষদের পরিবেশন করা হয়েছিল। অনেক পরে তা সবার নজরে পড়ে। সবাই সেই ন্যাতাধোয়া জলে ভাত মেখে মুখে দিতে না দিতেই ওয়াক তুলতে শুরু করেছিল। আমরা প্রথমে ভেবেছিলাম ডালে নুন পড়েনি। পরে মায়ের নজরে ব্যাপারটি ধরা পড়তে মা কেঁদে ফেলেছিলেন। যদিও ভুলটা তাঁর ছিল না। এই ভুলের সব দায়িকতা তথাপি নিজের ওপরই নিয়ে মা আকুল হয়ে আমাদের বাড়ির ঠাকুরঘরের সিংহপালঙ্কের সামনে বসে বলেছিলেন, ঠাকুর, আমার এই পাপ তুমি ক্ষমা করইও না যেন, আমাদের এয়ার লইগ্যা শাস্তি দিয়ো। এ পাপ আমার। কাকতালীয় হলেও মা এর শাস্তি একদিন পেয়েছিলেন, তা আমি নিজেই দেখেছি। সেদিন মা আর আমি এই ভুলের কথা, যাকে তিনি পাপ বলে জেনেছিলেন, তা স্মরণ করেছিলাম। মা সেদিন ভুলবশত তার বড় ছেলের পাতেই ন্যাতাধোয়া জল দিয়েছিলেন ডালের বদলে। তখনও এক দুর্ভিক্ষকাল, মধ্যষাটের দশকের খাদ্য আন্দোলন চলছে তখন। সে বর্তমান কাহিনির অনেককাল পরের অন্য এক আকাশের নিচের বার্তা।

আমেরিকার খয়রাতি চাল নিয়ে সেদিন দুর্ভিক্ষের মোকাবিলায় নেমেছিল পাকিস্তানি ফৌজি সরকার। দেশের অন্যান্য জেলার তখন কী অবস্থা তা জানার কোনো উপায় আমার ওই পিছারার খালের আশপাশের বা তার তামাম চৌহদ্দির মানুষেদের ছিল না। আমার তো নয়ই। আমি শুধু পিছারার খালের প্রান্তবর্তী জগতে মানুষদের অবস্থা, আমাদের বাড়ির ওই লঙ্গরখানার ‘লপসী’ গেলাবার সময় যেটুক দেখেছি, সে কথাই জানাচ্ছি। অবশ্য এ ক্ষেত্রে শুধুই পিছারার খালের কূলই নয়, বড় খালের বিস্তৃতির দুই পার্শ্ববর্তী বহু গ্রামের মানুষের দুর্ভাগ্যও দেখেছি তখন।

মার্কিন কাপড়ের চেহারা, রং এবং স্বভাব যেমন ‘কোরা’, মার্কিন চালের গতর এবং বর্ণও তেমনি। এই চালের চেহারায় যেটুকু সাহেবিয়ানা দেখেছি, তা হচ্ছে এর চাকচিক্যে এবং লম্বা গতরে। এ ছাড়া এর আর কোনো সাহেবি কৌলীন্য ছিল না। সবাই বলত, বিলাতি চাউল তো, দ্যাখথে শোনতেই যা সাহেব গো ল্যাহান। নাইলে, যা সোয়াদ, এয়ারে চাউল কইবে কোন হালায়? হায় বালামের দেশের মানুষ কি কখনো বালামের স্বাদের নস্টালজিয়া ভুলতে পারে? ফলত এই, ‘সাহেবি’ চেহারার চালের স্বাদ পেটের জ্বালা মেটালেও জিভে ‘তার’ আনে না। ভোক্তারা সবাই বলে, ক্যামনতারা য্যান ঠেহি, রবার্ট রবাট। চিবাই ঠিকই, ভাত বলইয়া মালুম অয় না। সোয়াদ কইতে কিচ্ছু নাই। বালাম বিষয়ে পণ্ডিতেরা যা করার কবেন, ‘আফইত্য নাই’। তবে আমাদের অভ্যেস ঋতু অনুযায়ী অন্নভক্ষণ। আমাদের ‘মাস মধ্যে মার্গশীর্ষ আপনি ভগবান’, অর্থাৎ অগেরান—অগ্রহায়ণ থেকে আমাদের চালের বিষয়ে ‘আইশ্যাদির’ শুরু। এ ব্যাপারে সেই কালে আমাদের কোনো বেচাল কেউ দেখেনি। আর ‘বেচাল চাল’ খাবার অভ্যেসও আমাদের সেকালে ছিল না। আমাদের অন্ন ভক্ষণের শুরুয়াত অগ্রহায়ণ থেকেই। সেই ‘ধানঘরের’ পর ‘নবান্ন’। গাঁয়ের বুড়িরা একসময় ভোরবেলা গাইতেন —

অগেরান মাসেতে সবে নব অন্ন খায়।
আমার ঘরে কিষ্ণ নাই বংশী কে বাজায়।

যদিও এই গান অতি পুরাতন, তথাপি পিছারার খালের জগতের ক্রমবিলীয়মানতার দিনগুলোতেও যখন এ রকমভাবে অবশিষ্ট বুড়িরা গাইত, মনে হতো, হায়! তাদের ঘরের কৃষ্ণ এখন কোন গোঠে গোচারণ করছে, কে জানে? অথচ বুড়িরা তখনও ‘অগেরান’ মাসের ‘নব অন্ন’ মেখে নিয়ম পালন করে যাচ্ছেন। ধানপানের তরিবৎ তাঁরাই তো করছেন। নবান্নে ‘আগুনি’র চাল না হলে তা শুদ্ধ হয় না। অঘ্রান থেকে আমাদের ‘আগুনি’ খাওয়ার ‘আইশ্য’। অঘ্রানে আগুনি, পৌষে পৌষালি, মাঘে তাবৎ ধান গোলায়।

পিঠাপায়েস মিষ্টান্ন ‘জড়জাপটে’ খেয়ে মানুষ তখন নতুন চালের গন্ধ ভুলে গেছে। তখন তো সব চালের একই নাম—আমন। আগুনি, সীতাশাল, ঝিঙ্গাশাল, বউআরি, নলডোগ, আউশ এবং কার্তিকদল—এইসব আমাদের ঋতুকাল অনুযায়ী ভোজ্য। অবশ্য যারা গেরস্থালিতে শ্রীযুক্ত, ঋদ্ধিযুক্ত, তাদের জন্যই এই ভোজ্যাচার। নচেৎ সাধারণ্যে সাধারণ চাল, সে চাল অর্থেও আবার চালবাজি অর্থেও। তার নাম ‘জয়না’, সে হাটে গেলে রয়না, আবার বাবুদের পেটে গেলে একেবারে সয়না। এ রকম এক ‘শোলোক’ এখানের চাষিলোকেরা কয়। জয়না শেষ হলে, লাল লাল ভেঁয়ো পিঁপড়ের ডিমের মতো আউশ চাল এসে যায় হাটবাজারে, গেরস্তের গোলায় তো বটেই, তখন সেই চালের ভাত, সেই চালের চিড়ে এবং সেই চালের ফেনভাত ‘মরিচপোড়া আর প্যাজপোড়া দিয়া য্যান অমের্ত’। আমাদের জিভের ‘তারের’ তরিকা এমন। সেখানে ‘রবার্টের’ মতো মার্কিন চাল ক্যামনে সোয়াদ জোগায়?

তা ছাড়া অন্য অনুষঙ্গ ভোজ্য ব্যাপার। মার্কিনি চাল এত কায়দার যে তার সঙ্গে নারকোল বাটা, খেসারির বড়া, শাপল চচ্চরি, শাপলার ঘণ্ট, ‘চাডকাডা শাগ’, আক্রা ডগার ঝোল, সজনে ফুলের পাতরি, মালঞ্চ শাগ, গিমা বেগুন, তেলাকুচার ডাঁটার সঙ্গে মুগডালের ছেচকি, লাউ বা ছাঁচি কুমড়োর খোসা ভাজা এবং অনুরূপ আরও অনন্ত ‘পদ’ যেন আদৌ খাপ খায় না। এ কারণে ভোক্তারা এই সাহেবি চালকে চাল বলেই যেন ভাবতে পারে না। আমাদের চালের স্বাদের সঙ্গে এই চালের স্বাদের তুলনাই হতে পারে না। এখানের এইসব চালের স্বাদ এবং ঘ্রাণ, এইসব বিভিন্ন অনুষঙ্গ যাদের জিভে, নাকে এবং মস্তিষ্কে গ্রথিত আছে, তারা কি এই মার্কিনি ‘রবার্ট’ চালের ‘সোয়াদে’ তুষ্ট হতে পারে?

বাড়িতে লঙ্গরখানার ব্যবস্থা তো কর্তামশাইরা করলেন। নিত্যদিন শয়ে-হাজারে মানুষ খাবে। কিন্তু তালুকদারি শেষ হবার পরে বাড়িতে তো আর সেই আগের মতো চাকরপাট, দাসদাসী, বেঠ বেগাররা নেই যে এই মোচ্ছব সামাল দেয়। কর্তারা শুধু চালের আমদানিটার দিকেই নজর রেখেছিলেন, ব্যাপক কর্মযজ্ঞের কথাটা তাঁদের মগজে আদৌ ছিল না। তাঁদের মাথায় পুরনো ধারণাটিই বলবতী ছিল–চাল যখন আছে বাকি ব্যাপারগুলো সাবেকি ধরনে, স্বাভাবিকভাবেই হবে। রান্না কে করে, জ্বালানি কে জোগায়। আর এত মানুষকে পরিবেশন করার ব্যবস্থাই-বা কী? এ তো আর একদিনের ব্যাপার নয়। এ ব্যবস্থা কতদিন চলবে কেউ বলতে পারে না। কিন্তু বাবা, জ্যাঠামশাই বা নায়েবমশাই এঁরা এর কিছুই ভাবলেন না। ভাবার মতো কাণ্ডজ্ঞান থাকলে তো!

আমার মা বাড়ির সোনাবউ। বরাবর বড় বৈঠকখানার আইশ্যজন-পইশ্যজনের হ্যাপা সামলে দিতেন। এখন তাঁর নিজের স্বামী-সন্তানদের নিয়েই তিনি পেরে ওঠেন না। একুনে আট-নটা পেটের অন্ন রান্না করেই তিনি জেরবার। তথাপি দেখলাম কর্তাদের ত্রাণ করতে তিনিই এগিয়ে এলেন। তিনিই তাঁর স্বামী-সন্তানদের অন্ন সংস্থান করছেন এ রকম একটি সূক্ষ্ম বোধও তাঁর মনে কাজ করছিল বলে বোধহয়। বিশ সেরি, ত্রিশ সেরি ডেগে, কড়াইয়ে রান্না করার মতো এক অমানুষিক পরিশ্রমের কাজ তিনি আরম্ভ করলেন। এমনকি এগুলো উনুন থেকে নামাবার, ভাতের মাড় গালবার জন্য বড় বড় ঝুড়িতে ঢালার সময়েও বিশেষ সাহায্য তিনি পুরুষদের কাছ থেকে পেতেন না। বাবা সাহায্য করতে তৎপর ছিলেন বটে, তবে তিনি এককালের বড়লোকের আলালী বেটা, এসব দৈহিক কর্মে অকর্মার তালুকদার। তাঁর সাধ্য কি এই ভীমবল্লভী কর্ম করেন। ফলে মায়ের ওপর চাপ পড়ল পাহাড়প্রমাণ। চাপ আমার ওপরও পড়ল।

তারপর জ্বালানি সমস্যা। জ্বালানি বলতে কাঠ। কাঠের উনুনে রান্নার ব্যবস্থা আমাদের ওখানে। আমি আর আমার পরের ভাইটা, ছোটন, কুডুল নিয়ে বনজঙ্গল থেকে কাঠ কেটে আনতাম। তখন আমরা দুজনেই গতর খাটানোর বয়সের সন্ধিক্ষণে এসে পড়েছি। তাই ওই বিপুল অন্নযজ্ঞের সমিধ সংগ্রহের দায়িত্ব আমাদের ওপর পড়ল। এ ব্যাপারে কিন্তু কর্তাদের আভিজাত্যে ফাটল ধরল না। আমার ওই সময়কার স্মৃতি বড় করুণ। তখন মোটামুটি জানা-বোঝার বয়সে পৌছেছি। আমার দেশে, যেখানে অসুমার ধান রূপশালী মহিমা নিয়ে বর্ষা, শরৎ এবং হেমন্তের মাঠে তার রূপ, রস, বর্ণ এবং ঘ্রাণে আমাদের আবহমানকাল তৃপ্তি দিয়েছে, যেখানের চাষির গলায় প্রেমের গান ছাড়া কোনো হুতাশ শুনিনি কোনো দিন, সেই দেশের চাষিরা আজ কোন সুদূর সাগরপারের কোন দেশ থেকে আসা অপরিচিত এবং অশ্রদ্ধার অন্ন মুখে তুলছে ভিখিরির মতো। সে অন্নে স্বাদ নেই, তৃপ্তি নেই, পরিবেশনে সামান্যতম শ্রদ্ধা বা সম্মান দূরস্থান, দয়া অথবা করুণাও নেই। সেই অন্ন তারা পেটের তাড়নায় খাচ্ছে এ যে কী হৃদয়বিদারক দৃশ্য, যারা তা দেখেনি, তাদের বোঝানো অসম্ভব।

কিন্তু তবুও তা অন্ন। পেটে গিয়ে মানুষকে দুদণ্ড সম্বিৎ দেয় অন্য ভাবনা ভাবতে। আমি এই সময়ের এই মানুষদের অনেককেই জানি, যারা এই অন্নগ্রহণের জন্য দ্বিতীয়বার আর আসেনি। দু-একজন অসম্মানের জ্বালা জুড়োতে গলায় দড়ি দিয়ে মরেছেও। অনুগ্রহণের এমতো অসম্মান তারা সহ্য করতে পারেনি। কত মানুষ যে সেই সময় তাদের বাড়িঘর জমি-জিরেত বিক্রি করে ছিন্নমূল ভিখিরি হয়ে গিয়েছিল তার পরিসংখ্যান কেউ করেননি। সে যুগে অন্তত আমরা দেখিনি। মানুষই-বা কত সংখ্যক মারা গিয়েছিল তার হিসেবও জানা নেই। দুর্ভিক্ষ অন্যান্য বিপর্যয়ের মতোই স্বাভাবিকভাবে অপবর্গীদের বিপত্তি ঘটায়। তখন এখানকার অপবর্গীদের রাষ্ট্রীয় কারণে দুটো সম্প্রদায়, সংখ্যালঘুরা ইতিপূর্বে বর্ণিত ঘটনাসমূহের কারণে তখন আধাগেরস্ত। তাঁদের এক পা ঘরে তো অপর পা বাইরে। কেউ দেশ ছেড়েছে, কেউ-বা ছাড়ব-কি-ছাড়ব-না এ রকম দোটানায়। সংখ্যাগুরু অপবর্গীদের অন্তত এই ব্যাপারটা ছিল না বলে এবং তাদের গেরস্থালি ঠিক এ রকম সংকটের সম্মুখীন না হওয়ার কারণে, দুর্ভিক্ষ সংখ্যালঘু অপবর্গীদের জন্যই যেন চরমতম আঘাত ছিল। সংখ্যাগুরুদের সমস্যা এই দুর্ভিক্ষকালে খুব একটা অসহনীয় হয়নি, এ রকমই পিছারার খালের আশপাশে আমি দেখেছি। আমার এই অভিজ্ঞতা নিতান্তই আঞ্চলিক এবং সে এক ক্ষুদ্র অঞ্চল। অতএব এর মাধ্যমে আমি অবশ্যই ঘটনাটিকে একটা পরিকল্পিত সাম্প্রদায়িক দুর্ভিক্ষ হিসেবে পুরোপুরি চিহ্নিত করতে চাইছি না। সংখ্যালঘু অপবর্গীদের দুর্ভিক্ষকালীন সমস্যা এবং সংখ্যাগুরু অপবর্গীদের অনুরূপ সমস্যার মধ্যে যে একটা ভিন্ন মাত্রা তখন কার্যগতিকে বাস্তব ছিল, সেই কথাটিই বলতে চাইছি। কারণ আমার পিছারার খালের ‘হিন্দু’ সীমান্তের অপরদিকে যে সংখ্যাগুরু অপবর্গীদের গ্রাম, সেখানে ওই সময় কোনো লঙ্গরখানা হয়নি। অথবা আমাদের বড় খালের অপর পারেও তাদের এলাকার দুর্ভিক্ষকে মোকাবিলার কোনো ব্যবস্থা আমার নজরে পড়েনি। থাকলে অবশ্যই পড়ত। সে যা হোক, আমাদের লঙ্গরখানায় যেসব মানুষ আসত, তারা সবাই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের এবং তারা ওই অখাদ্য অন্ন খাবার প্রত্যাশায় তাদের স্ত্রী-পুত্র-কন্যা ইত্যাদিসহ কত দূর দূর গ্রাম থেকে আসত। হায়! তাদের মধ্যে কিন্তু সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের একমাত্র ভিখিরিরা ছাড়া কোনো গেরস্ত মানুষকে দেখিনি। এরা বারবাড়ির অঙ্গনে ভিড় করে থাকত এবং সবার খাওয়াদাওয়া শেষ হলে আল্লারওয়াস্তে মোগো দুগ্‌গা ভাগ দেন বলে কাকুতি-মিনতি জানাত। আমার মা এদের জন্য কিছু ভাত আলাদা করে রেখে দিতেন। সবাই চলে গেলে আমাকে দিয়ে তাদের দেয়াতেন। সংখ্যাগুরুদের গ্রামে এ সময়ে যে আলাদা লঙ্গরখানা ছিল না তার প্রমাণ হিসেবেই এ কথাটি বললাম।

বাবা যে একটু কবি প্রকৃতির মানুষ, এ কথা আগেই বলেছি। এ কারণে তাঁর মাঝে মাঝেই নানারকম সন্তাপ-বিলাস দেখতাম। বলতেন, মানুষের দুর্ভিক্ষের অন্নে ভাগ বসাচ্ছি, এ যে কী দীনতা! প্রায়শই তাঁর এ রকম শোক উথলে উঠত এবং চোখে জলধারা। মা কদাচ বাবার এই উথলে ওঠা শোক বিষয়ে কিছু মন্তব্য করতেন। বরাবরই তিনি বাবার ছায়া প্রায়। তাঁর বাক্য মায়ের কাছে শেষ বাক্য। কিন্তু বাবার এবারের দুঃখবিলাসে মা খুবই তীক্ষ্ণ হলেন। জীবনে কোনো দিনই এ রকম আচরণ তাঁর দেখিনি। বাবা বলছিলেন, আমাগো ভাত পরেরাই কত খাইত। আর এহন? এহন দ্যাহ, আমরা মাইনষের দুর্ভিক্ষের অন্ন দিয়া নিজেগো প্যাট ভরাইতে আছি। এ তো পাপের অন্ন। বাবা এ রকমভাবেই সবকিছুর সহজ বিচার করতেন। কিন্তু মা এবার, এবং আবারও বলি এই একবারই তীব্র বাক্য ব্যবহারে বাবাকে স্তব্ধ করে দিয়েছিলেন। তিনি যে এ রকম বাক্য বলতে পারেন বা এ রকম কোনো অভিমান তাঁর চিন্তায় বা হৃদয়ে ছিল আগে কোনো দিন তা জানিনি। বুঝতেও চেষ্টা করিনি। তা ছাড়া মাকে বাবার মুখে কথা বলতেও তো দেখিনি কোনো দিন।

মা বলেছিলেন, এ ভাত তোমাগো লইগ্যা পাপের ভাত কিনা আমি জানি না। তয় আমার আর আমার পোলামাইয়ার লইগ্যা যদি এয়া পাপের অয়, তয় কাইল থিহা এর ব্যবস্থায় আমরা আর থাকুম না। তোমরা যা পারো করইও।

নিয়ত হাড়ভাঙা শ্রমে তার ধৈর্যচ্যুতি ঘটেনি। কিন্তু যে মানুষ নিজের স্ত্রী এবং অপরিণতবয়স্কা সন্তানদের সারাদিন ওই কঠোর পরিশ্রম করতে দেখেও একটা সহানুভূতির কথাও বলেন না, তাঁর এহেন দুঃখবিলাস মাকে সেদিন বেশ ক্রুদ্ধ করে তুলেছিল। সেদিন তিনি বাবাকে আরও অনেক কিছুই বলেছিলেন যা এতদিন বাদেও কানের কাছে ঝনঝন করে বাজছে। তিনি বলেছিলেন, এ ভাত খাইতে তোমাগো লজ্জা করে, মনে কষ্ট অয়, না? আর এতকাল যে অন্ন খাইছ, হেয়াতে কষ্ট বাস নায়? হেয়াও তো দুব্বিক্কের অন্ন। তয় হে দুব্বিক্ক আমাগো আছেলে না, য্যারগো আছেলে হ্যারগো লইগ্যা তহন তো ভাবো নায়?

বাবা এসব কথা শুনতে অভ্যস্ত ছিলেন না। যুগানুযায়ী তাঁর মনটা যে খুব অপরিচ্ছন্ন ছিল তা নয়। তবে তাঁর মানবিকতাবোধের কাঠামোটা ছিল প্রকৃতই সামন্তসুলভ। সে কারণে, কোনো দ্রব্য তিনি প্রার্থীকে দিয়ে তাকে কৃতার্থ করার দাম্ভিক আনন্দ বা তৃপ্তি উপভোগ করতেন, কিন্তু নিজের স্ত্রী-সন্তানদের শ্রম বিক্রয়ের সহজ সত্যটা তাঁর নজরে পড়ত না। মা মূলত গরিব ঘরের মেয়ে ছিলেন। বোধহয় অনেকটা পোড় খেয়েই বাবা জ্যাঠামশাইয়ের এই মানসিকতাটা বুঝতে পেরেছিলেন। এ কারণে তাঁর ওই রকম তীক্ষ্ণতা জীবনে একবার হলেও দেখেছিলাম।

মায়ের প্রতি বাবার ভালোবাসা বা সহানুভূতির ঘাটতি ছিল না। কিন্তু নিজের সন্তানের জন্ম দিতে দিতে আমাদের মায়ের শরীর নিতান্ত অস্থিচর্মসার এবং দুর্বল হয়ে পড়েছিল। তার ওপর ছিল দীর্ঘকাল অম্লশূল ব্যথার নৈমিত্তিক অসহ্য যন্ত্রণা। প্রতিদিনই অবেলায় খেয়ে খানিকক্ষণ বাদেই প্রচণ্ড ব্যথার প্রকোপে তাঁকে চিৎকার করতে দেখতাম। মুঠো মুঠো খাবার সোডা গিলে তাঁকে ব্যথা প্রশমন করতে হতো। একটা সময় অবশ্য বাবা ক্যালবিসমা বলে একটা ওষুধের নিয়মিত ব্যবস্থা করেছিলেন।

সকল অধ্যায়

১. বিষাদবৃক্ষ – ১
২. বিষাদবৃক্ষ – ২
৩. বিষাদবৃক্ষ – ৩
৪. বিষাদবৃক্ষ – ৪
৫. বিষাদবৃক্ষ – ৫
৬. বিষাদবৃক্ষ – ৬
৭. বিষাদবৃক্ষ – ৭
৮. বিষাদবৃক্ষ – ৮
৯. বিষাদবৃক্ষ – ৯
১০. বিষাদবৃক্ষ – ১০
১১. বিষাদবৃক্ষ – ১১
১২. বিষাদবৃক্ষ – ১২
১৩. বিষাদবৃক্ষ – ১৩
১৪. বিষাদবৃক্ষ – ১৪
১৫. বিষাদবৃক্ষ – ১৫
১৬. বিষাদবৃক্ষ – ১৬
১৭. বিষাদবৃক্ষ – ১৭
১৮. বিষাদবৃক্ষ – ১৮
১৯. বিষাদবৃক্ষ – ১৯
২০. বিষাদবৃক্ষ – ২০
২১. বিষাদবৃক্ষ – ২১
২২. বিষাদবৃক্ষ – ২২
২৩. বিষাদবৃক্ষ – ২৩
২৪. বিষাদবৃক্ষ – ২৪
২৫. বিষাদবৃক্ষ – ২৫
২৬. বিষাদবৃক্ষ – ২৬
২৭. বিষাদবৃক্ষ – ২৭
২৮. বিষাদবৃক্ষ – ২৮
২৯. বিষাদবৃক্ষ – ২৯
৩০. বিষাদবৃক্ষ – ৩০
৩১. বিষাদবৃক্ষ – ৩১
৩২. বিষাদবৃক্ষ – ৩২
৩৩. বিষাদবৃক্ষ – ৩৩
৩৪. বিষাদবৃক্ষ – ৩৪
৩৫. বিষাদবৃক্ষ – ৩৫
৩৬. বিষাদবৃক্ষ – ৩৬
৩৭. বিষাদবৃক্ষ – ৩৭
৩৮. বিষাদবৃক্ষ – ৩৮
৩৯. বিষাদবৃক্ষ – ৩৯
৪০. বিষাদবৃক্ষ – ৪০
৪১. বিষাদবৃক্ষ – ৪১
৪২. বিষাদবৃক্ষ – ৪২
৪৩. বিষাদবৃক্ষ – ৪৩
৪৪. বিষাদবৃক্ষ – ৪৪
৪৫. বিষাদবৃক্ষ – ৪৫
৪৬. বিষাদবৃক্ষ – ৪৬

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন