বিষাদবৃক্ষ – ১৫

মিহির সেনগুপ্ত

পনেরো

যে সময়টিকে নিয়ে এই কথা-কথন করছি, তখন পিছারার খালের সব গেরস্থালির নাভিশ্বাস। যাঁরা এই স্থান ত্যাগ করে চলে যাচ্ছেন তাঁরা তাঁদের সম্পদাদি বিক্রি করার উদ্যোগে ব্যস্ত। যাঁরা দেশত্যাগ করার কথা ভাবতে পারছেন না, যেহেতু তাঁদের হিন্দুস্থানে কোনো সহায়সম্পদ বা খড়কুটো আঁকড়ে ধরার মতোও কিছু নেই, তাঁরাও পেটের দায়ে অথবা তাঁদের যা কিছু আছে, তা লুট হয়ে যেতে পারে, এই আতঙ্কে সব বেচে দিয়ে নিঃস্ব রিক্ত এবং অগৃহস্থ হয়ে যাচ্ছিলেন। গ্রামীণ স্থিতিশীল মানুষেরা কোনো প্লবতার কারণে যখন অগৃহস্থতায় নিজেদের পরিণত করতে বাধ্য হয় তার থেকে করুণ অবস্থা নেই। গৃহস্থালির যেখানে স্থায়িত্ব, সেখানে গৃহস্থ স্বয়ং যদি উঞ্ছ হয়ে যায় তবে যে সংকট ঘটে, আমার পিছারার খালের চৌহদ্দির তৎকালীন সংকট সে রকমই দেখেছি। পৃথিবীতে ইতিপূর্বে এক ব্যাপক, সর্বগ্রাসী যুদ্ধ ঘটে গেছে। সেই যুদ্ধের দায় মেটানোর খাতিরে আমার এই মানুষেরাও দুর্ভিক্ষের করাল গ্রাসে তো পড়েইছিল কিন্তু তাও তাদের ততটা অগৃহস্থ করতে পারেনি। কারণ এই স্থানটি ছিল সভ্যতার গতিপথের একান্ত প্রত্যন্তে। এখানকার উপজ সামগ্রী অন্যান্য অঞ্চলের মতো এলাকার বাইরে নিয়ে যাওয়ার আধুনিক উপায় তখন তেমন ছিল না। প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকতাই এই সুযোগ এখানকার মানুষদের দিয়েছিল। তখন এ অঞ্চলে রেলপথ বা স্থলপথ ছিল না। নদীপথে ঝালকাঠি, বরিশাল ইত্যাদি অঞ্চল থেকে যেসব সামগ্ৰী জাহাজ, স্টিমারগুলোতে যেত তার মধ্যে ধান-চালই আসল। গৃহস্থের গোলাঘরের ভূগর্ভস্থ মট্‌কায় যে চাল মজুত থাকত তা যে সরকারি সংগ্রহকারীদের পক্ষে বিশেষ সুবিধেজনকভাবে সংগ্রহণের স্থান ছিল, তা নয়। এ বিষয়ে তেতাল্লিশের মন্বন্তরের গল্পকথা যা বুড়িপিসিমাদের কাছে শুনেছি, তার ভিত্তিতেই এ কথা বলছি। তবে এর প্রকোপ একেবারেই যে কিছু পড়েনি এখানে তাও নয়। কিন্তু পিছারার খালের চৌহদ্দিতে এই মন্বন্তরের মানুষ না খেয়ে মরেছে এ রকম কাহিনি আমরা শুনিনি। অনটন অবশ্য ছিল। হাট থেকে ‘ফরিয়া’দের মারফত চাল, ধান ইত্যাদি নাকি সংগ্রহ হয়েছিল। কিন্তু সে অনেক আগের কথা। আমরা তখনও জন্মাইনি।

স্বাধীনতা পরবর্তীকালীন একেকটি দাঙ্গার বিভীষিকা অথবা হিন্দু, মুসলমান এই সমাজ দুটির পারস্পরিক অবিশ্বাসের উদ্ভবের কারণেই আমার এই ভূমির মানুষদের গৃহস্থালির উৎসৃজন। উচ্চবর্ণীয় সংখ্যালঘু সমাজ তখন সেখানে মাটি আঁকড়ে পড়ে থাকার কথা চিন্তা করেনি। নিম্নবর্ণীয় সংখ্যালঘুদের সঙ্গে পাকিস্তানপন্থি সংখ্যাগুরুর সমঝোতা ছিল। কেননা, উভয়ই উচ্চবর্ণীয়দের দ্বারা শোষিত এবং উৎপীড়িত। আমার পিছারার খালের এলাকায় ‘উচ্চবর্ণীয়’ মুসলমান যে ছিল না বললেই চলে, এ কথা আগে বলেছি। মুসলিম লিগ, পাকিস্তান কায়েমের শুরুয়াতে এবং কায়েম হওয়ার কিছুকাল পর অবধি এই চমৎকার স্বার্থসিদ্ধকারী তুরুপের তাসটি বেশ ভালোভাবেই খেলেছিল। এ কারণে, আমার অঞ্চলটিতে বিভেদের আগুন হঠাৎই যেন প্রয়োজনাতিরিক্ত মাত্রা পায়। বিভেদের এই আগুন প্রায় তুষানলের মতোই ধীরে ধীরে বিস্তৃতি পেতে থাকে উচ্চবর্ণ থেকে নিম্নবর্ণ পর্যন্ত। সাম্প্রদায়িক রণকৌশলে এ বড় তাৎপর্যপূর্ণ এক কৌটিল্যপন্থা, এ বিষয়ে সন্দেহ নেই।

পিছারার খালের এলাকায়, এমনকি তামাম রাষ্ট্রকল্পেও, সংস্কৃতিগতভাবে আকর্ষণীয় কোনো মূলস্রোত তখনও গড়ে ওঠেনি। তখন সম্প্রদায়ই একমাত্র বাস্তব এবং তা সংখ্যাগুরুর আর সংখ্যালঘুর উভয়তই। সংখ্যাগুরু এ কারণে সদ্য আহৃত স্বাধীনতাকে বর্গনির্বিশেষে এক নৈরাজ্যপন্থা হিসেবেই গ্রহণ করে এবং তা সংখ্যালঘুদের ওপর যা কিছু করার অধিকার হিসেবে জারি করতে প্রয়াসী হয়। তাৎক্ষণিক প্রয়োজনটাকেই তারা পরমার্থ বোধ করে সংখ্যালঘুদেরকে অবলীলায় এক অন্ধ হাড়িকাঠে চাপিয়ে দেয়।

জারিগানের আসরে বয়াতিদের দেখেছি খোদ আল্লাহতায়ালা বা নবির বন্দনার আগেই লোকায়ত দেবী বিপদনাশিনীর বন্দনা করতে। অর্থাৎ অপবর্ণীয় মানুষদের ধর্মীয় আচারের পরম্পরা ওই পিছারার খালধারের মনুষ্যের মধ্যে সম্প্রদায় নির্বিশেষে প্রায় এক অভিন্নতায় বিরাজিত ছিল। তারা লোকায়ত দেবীদের যেমন মান্যতা দিত, তেমনি মান্যতা দিত পির-পয়গম্বরকে। উচ্চবর্ণীয়দের কথা স্বতন্ত্র। তাদের অধিকাংশই আবহমানকাল বর্ণবিদ্বেষী এবং অত্যাচারী। কিন্তু অপবর্ণীয়দের মধ্যে এই ভেদের আগুন আনল কে? এবং কেনই-বা তাদের প্রতি পরে বিশ্বাসঘাতকতা করা হলো—এটাই একটা বড় প্ৰশ্ন।

বিশ্বাসঘাতকতার কথাটি বলছি এ কারণে যে, আমরা জানতাম ‘শিডিউলড কাস্ট ফেডারেশন’-এর অন্তর্ভুক্ত অর্থাৎ তফসিলি জাতি ও উপজাতীয়রা পাকিস্তানপন্থিদের মিত্র। একমাত্র উচ্চবর্ণীয়রাই তাদের স্বাভাবিক শত্রু। পাকিস্তান কায়েমের প্রাক্কালে তাই এদের অনেকেই মুসলিম লিগের সঙ্গে সমমনস্ক ছিল। মুসলিম লিগ এবং পাকিস্তানপন্থিরা এ কথা লিখিতভাবেও রেখেছেন যে, তাদের বিরোধ শুধু উচ্চবর্ণীয় হিন্দুদের সঙ্গেই। তাঁরা চান যেন উচ্চবর্ণীয় হিন্দুরা এ দেশে না থাকেন। এসব কথা আমরা পাঁচের দশকের শুরুতেও বিভিন্ন জমায়েতে শুনেছি। কিন্তু একটা সময় এই প্রতিজ্ঞা আর থাকেনি। তখন উচ্চবর্ণীয় হিন্দুও হিন্দু আর নিম্নবর্ণীয় হিন্দুরাও হিন্দু বলেই চিহ্নিত হয়েছে এবং তাদের উচ্ছেদ করা হয়েছে। প্রয়োজনবোধে কোথাও কোতল করা হয়েছে।

বস্তুত ঘটনা তো দাঁড়িয়েছিল এক সম্প্রদায় আল্লাহকে গাল দেয় তো অন্য সম্প্রদায় ‘বুৎপরস্তীদের’ দেবদেবীকে ‘খামার দে’ এবং যখন মোল্লা মুসুল্লিরা বেশি শরিয়তের রাস্তা বাতলায়, তখন অপবর্গী মুসলমানেরা ‘আড়ালে আবডালে কালীমন্দির, শেতলা খোলা বা কামেশ্বরীর থানে কানে হাত দিয়ে বলে, “অফরাদ লইও না, মাগো, মা। মোরা কৈলম একছের ভবসাগরের ট্যাপ্পোনা। দয়া করো মা, দয়া করো।’—এসব আমাদের বাড়ির বাগাল ছিল যে নাগর আলি, তার আচরণে দেখেছি। কিন্তু সে আবার রোজার দিনে যথাসম্ভব রোজা থাকত। সন্ধ্যায় ডাবের জল এবং ‘লেয়া নাইরকোল’ দিয়ে তার সঙ্গে আমরা ‘এ্যাফতার’ করতাম আমাদের বড় খালধারের সেই কুলপতি বৃক্ষের নিচে অথবা পিছারার খালের কোনো নিভৃতে। আবার এও দেখেছি যে শুকনো ঋতুর সময়ে জলা জায়গাগুলো যখন শুকিয়ে কচুরিপানাগুলো মাটির সঙ্গে সমতল হতো, তখন সুপুরিগাছের তীক্ষ্ণ বল্লম দিয়ে ঠুকঠুক করে ধরে আনত ‘দুর’, যা কচ্ছপের সগোত্রীয় এক প্রাণী এবং যার মাংস ইসলামি মতে নাপাক, কেননা তাকে হালাল করা যায় না। নাগর আলির এ মাংসে বিশেষ অরুচি কোনো দিন দেখিনি। কিংবা শজারু শিকারেই কি তার অনাগ্রহ দেখেছি বা সেই অজবেসম্ভভ, নাপাক প্রাণীর মাংস ভক্ষণে? নাগর আলির মতো মানুষ পিছারার খালের জগতে নেহাত হাতেগোনা ছিল না। তারা এসব নাপাক কাম করত। নাগর আলিকে এও দেখেছি যে রাতে পাহারাদারি করার সময়, আমাদের বটকালীতলায় টিনের চালা খুলে নেয়ার প্রচেষ্টাকারীদের ‘চুতমারানির পোয়ারা, তোগো মা-মাসির ফলনাতা হরি’ বলে বল্লম নিয়ে ধাওয়া করতে। এই মানসিকতার কার্যকারণ বড় গভীর গবেষণার ক্ষেত্র। এ পথে কদাচিৎ কেউ গমন করেন। এ বিষয়ে কেউ যদি কিছু জানেন, তবে সে ওই মহাবৃক্ষ।

সকল অধ্যায়

১. বিষাদবৃক্ষ – ১
২. বিষাদবৃক্ষ – ২
৩. বিষাদবৃক্ষ – ৩
৪. বিষাদবৃক্ষ – ৪
৫. বিষাদবৃক্ষ – ৫
৬. বিষাদবৃক্ষ – ৬
৭. বিষাদবৃক্ষ – ৭
৮. বিষাদবৃক্ষ – ৮
৯. বিষাদবৃক্ষ – ৯
১০. বিষাদবৃক্ষ – ১০
১১. বিষাদবৃক্ষ – ১১
১২. বিষাদবৃক্ষ – ১২
১৩. বিষাদবৃক্ষ – ১৩
১৪. বিষাদবৃক্ষ – ১৪
১৫. বিষাদবৃক্ষ – ১৫
১৬. বিষাদবৃক্ষ – ১৬
১৭. বিষাদবৃক্ষ – ১৭
১৮. বিষাদবৃক্ষ – ১৮
১৯. বিষাদবৃক্ষ – ১৯
২০. বিষাদবৃক্ষ – ২০
২১. বিষাদবৃক্ষ – ২১
২২. বিষাদবৃক্ষ – ২২
২৩. বিষাদবৃক্ষ – ২৩
২৪. বিষাদবৃক্ষ – ২৪
২৫. বিষাদবৃক্ষ – ২৫
২৬. বিষাদবৃক্ষ – ২৬
২৭. বিষাদবৃক্ষ – ২৭
২৮. বিষাদবৃক্ষ – ২৮
২৯. বিষাদবৃক্ষ – ২৯
৩০. বিষাদবৃক্ষ – ৩০
৩১. বিষাদবৃক্ষ – ৩১
৩২. বিষাদবৃক্ষ – ৩২
৩৩. বিষাদবৃক্ষ – ৩৩
৩৪. বিষাদবৃক্ষ – ৩৪
৩৫. বিষাদবৃক্ষ – ৩৫
৩৬. বিষাদবৃক্ষ – ৩৬
৩৭. বিষাদবৃক্ষ – ৩৭
৩৮. বিষাদবৃক্ষ – ৩৮
৩৯. বিষাদবৃক্ষ – ৩৯
৪০. বিষাদবৃক্ষ – ৪০
৪১. বিষাদবৃক্ষ – ৪১
৪২. বিষাদবৃক্ষ – ৪২
৪৩. বিষাদবৃক্ষ – ৪৩
৪৪. বিষাদবৃক্ষ – ৪৪
৪৫. বিষাদবৃক্ষ – ৪৫
৪৬. বিষাদবৃক্ষ – ৪৬

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন