বিষাদবৃক্ষ – ২৫

মিহির সেনগুপ্ত

পঁচিশ

এবার আবার মূল কথায় ফেরা যাক। আমাদের ওইসব গ্রামে অতি শৈশবের ক্ষীণ স্মৃতি ছাড়া কোনো রাজনৈতিক কার্যকলাপের কথা স্মরণ হয় না। একমাত্র ইউনিয়ন বোর্ডের বা সংসদীয় নির্বাচনের সময় ছাড়া কোনোরকম রাজনৈতিক উত্তেজনা কখনো দেখিনি। রাজনৈতিক দল বলতে মুসলিম লিগকেই আমরা জানতাম। কংগ্রেস নামটির সঙ্গে সামান্য পরিচয় ছিল। কিন্তু কোনো দলেরই কোনোরকম কাজকর্ম কখনো দেখিনি। না সামাজিক, না রাজনৈতিক। শুধু ইউনিয়ন বোর্ডের নির্বাচনের সময় দেখতাম প্রার্থীরা কেউ আওয়ামী লীগের, কেউ-বা মুসলিম লিগের এবং হিন্দু প্রার্থী হলে কেউ কেউ কংগ্রেসের প্রতীক-চিহ্ন ব্যবহার করছেন। গ্রামীণ সাধারণ মানুষেরা নির্বাচন ব্যাপারটাকে প্রায় উৎসবের মতো মনে করত। রং-বেরঙের পোস্টার, টিনের চোঙায় মুখ লাগিয়ে ক্যানভাসিং এবং বিরুদ্ধ প্রার্থীর সম্বন্ধে ছড়া আর সরস গানের নিনাদে গ্রামগুলো তখন বেশ সরগরম থাকত।

কমিউনিস্ট পার্টি নাম খুব কমই শোনা যেত। দু-একজন লোককে জানতাম যে তাঁরা কমিউনিস্ট আদর্শে বিশ্বাসী। তবে এই মতাদর্শটা কী তা সঠিক জানা ছিল না। আওয়ামী লীগ, ভাসানী ন্যাপ ইত্যাদি পার্টির কথা কীর্তিপাশার বাজারে খুব শুনতাম। সাধারণ মুসলমান জনেরা মুসলিম লিগের অনুগামীই বেশি ছিল। তারা জানত মুসলিম লিগই পাকিস্তান কায়েম করেছে।

একটা ব্যাপার খুবই আশ্চর্যের যে, আমাদের এই অঞ্চলের চাষিদের কোনো দিন কৃষক আন্দোলন করতে দেখিনি। অথচ গোটা এলাকায় ভূমিহীন চাষি, প্রান্তিক চাষি এবং কৃষি-শ্রমিকদেরই প্রাধান্য। শৈশবের গল্পমারফত তেভাগা, হাজং ইত্যাদি আন্দোলনের কথা শুনেছি, কিন্তু তার প্রভাব আমাদের এলাকায় কিছু নজরে আসেনি।

স্কুলে পড়ার সময় একজন মানুষ পেয়েছিলাম, যাঁর মাধ্যমে রাজনীতি, আন্দোলন বা দেশ-বিদেশের নানান খবর জানতে পারতাম। ভদ্রলোকের নাম যতীন কর্মকার। কীর্তিপাশার বাজারে যতীনবাবুর একটি সুদৃশ্য বইয়ের স্টল ছিল। এটাই ছিল তাঁর রুজি-রোজগারের উৎস। স্কুলপাঠ্য বই, খাতাপত্র ইত্যাদি ছাড়াও সেখানে পাওয়া যেত নানা বিষয়ের ওপর বইপত্তর, খবরের কাগজ এবং ম্যাগাজিন। আমাদের কাছে এই স্টলটির মাহাত্ম্য ছিল অসম্ভব রকমের। সেসব দিনে আমাদের সবচেয়ে যেটার অভাব ছিল, তা হচ্ছে পড়াশোনার ব্যাপারে উপযুক্ত সঞ্চালকের সহায়তা। পাঠ্যক্রম ছাড়া কী কী আমাদের পড়া উচিত, কীভাবে পড়া উচিত তথা সাহিত্য ইত্যাদি নিয়ে আলাপ-আলোচনা-বৈঠক এইসব আমাদের আদৌ ছিলই না। যতীনবাবুর স্টলটি সামান্য হলেও আমাদের এই অভাব বেশ খানিকটা পূরণে সহায়তা করেছিল। এখানে আমাদের নিয়মিত আড্ডা হতো। যতীনবাবু ছিলেন একজন অসামান্য শীলিত রুচির মানুষ। অত্যন্ত চমৎকারভাবে তিনি তাঁর সামাজিক দায়িত্ব পালন করতেন। তাঁর এই দায়িত্ব পালনের পদ্ধতিটি ছিল একান্ত নিজস্ব ধরনের। বস্তুত ওই সময়কালে আমাদের পরিবারস্থ অথবা সাজামিক অভিভাবকেরা এ ধরনের দায়িত্বের কথা আদৌ চিন্তাও করতেন না। যতীনবাবু ছিলেন এর ব্যতিক্রম। ঢাকা থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন পত্রপত্রিকা তিনি তাঁর স্টলে রাখতেন। আমরা সবাই তা পড়তে পারতাম। তিনি, শুনেছি, নাকি কমিউনিস্ট মনোভাবাপন্ন ছিলেন। তাঁর কাছে আমরা দেশ-বিদেশের নানান খবর, রাজনৈতিক আন্দোলনের কথা, রাশিয়া, চীন বা অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক দেশের গল্প ইত্যাদি শুনতাম।

সে সময় ঢাকা থেকে ‘সমকাল’ নামে একটি পত্রিকা বের হতো। সেটি পাক্ষিক না মাসিক, আজ আর তা মনে নেই। তবে পত্রিকাটি খুবই উচ্চমানের ছিল। যতীনবাবু আমাদের বয়সি বা আমাদের থেকে ছোট যারা, তাদের দিয়ে লিখিয়ে, আঁকিয়ে ‘সমকাল’-এ পাঠাতেন প্রকাশের জন্য। কখনো কখনো নিজে সংশোধনও করে দিতেন। আমাদের স্কুলের সঙ্গে শিক্ষা বিষয়ে জড়িত না থাকলেও তিনি সবরকম সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে উদ্যোগীর ভূমিকা নিতেন। নাতিউচ্চ, কটাচোখ, ফর্সা রং এবং পাতলা চেহারার এই মানুষটি খুবই স্নিগ্ধ স্বভাবের ছিলেন। আমরা তাঁর কাছ থেকে নানারকম বইপত্তর নিয়ে পড়তে পারতাম। তিনি ‘পড়ে ফেরত দিয়ো’, ‘বই পরিচ্ছন্ন রেখো’ এরকম নিয়মে আমাদের যথেচ্ছ বই দিতেন। নতুন এবং পুরনো সব বইয়ের একটি চমৎকার সংগ্রহ তাঁর ছিল। ওইসব বই পড়ে আমরা তাঁর স্টলে নানান আলোচনা-সমালোচনা করতাম। তিনিও তাতে যোগ দিতেন। এইসব আলোচনার মধ্যে রাজনীতির কথা, মার্শাল প্রেসিডেন্টের উদ্ভট বুনিয়াদি গণতন্ত্র, আমেরিকার কীর্তি-কাহিনি ইত্যাদি নিয়েও যথেচ্ছ বিচার-বিশ্লেষণ হতো। এর ফলে মানসিক বিকাশের দিক থেকে আমরা খুবই উপকৃত হতাম।

আমরা তখন দশম মানের ছাত্র, অনেক বিষয়ই কিছু বুঝি না। কিন্তু আলোচনার সময় বেশ উত্তেজনা বোধ করতাম। ‘একুশে ফেব্রুয়ারির’ সময় যতীনবাবু সে বিষয়ের তাৎপর্য নিয়ে পাঁচকথা আলোচনা করতেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় ওই দিনটি আমরা কখনোই স্কুলে উদ্যাপন করতে পারিনি। এটা যতীনবাবুর বিশেষ আফসোসের ব্যাপারই ছিল। স্কুলের মাস্টারমশাইরা প্রায় সবাই হিন্দু ছিলেন বলে প্রতিষ্ঠানবিরোধী বা রাজনীতিগন্ধী কোনো আলোচনা বিষয়ে তাঁরা ছিলেন অসম্ভব ভীত এবং স্পর্শকাতর। তবে যতীনবাবুকে সবাই শ্রদ্ধাসম্মান করতেন বলে আমরা তাঁর ওখানে নির্ভয়েই আড্ডা মারতাম।

এই সময় তফসির মিঞা কীর্তিপাশায় আসেন। তিনি ছিলেন পল্লি উন্নয়ন অফিসার। প্রথমদিকে তিনি ছিলেন আমাদের পিছারার খালের আশপাশ গ্রামগুলোর উন্নয়নের দায়িত্বে। সেখানে কিছুকাল কাটিয়ে এখানে এলেন তিনি। তাঁর কাজ ছিল হিন্দুদের পরিত্যক্ত বাড়িগুলো, যেসব তখন মুসলমান মাতব্বরদের দখলে, তার ঝোপঝাড়-জঙ্গল পরিষ্কার করানো, মজা পুকুরের পাঁক তুলে ফেলা বা কচুরিপানা পরিষ্কার, রাস্তাঘাটের আগাছা পরিষ্কার করিয়ে চলাফেরার উপযোগী রাখা ইত্যাদি। এ ছাড়া হাঁস-মুরগি পালন সংক্রান্ত বা কৃষিবিষয়ক কিছু পরামর্শ দিয়ে গ্রামীণ চাষিগেরস্তদের উন্নয়নের পথে নিয়ে যাওয়া। এসব করার জন্য সরকারি আদেশ মোতাবেক চার-পাঁচখানা গ্রামের ছেলেপুলেদের নিয়ে তফসির মিঞা একটি চাঁদতারা ক্লাব করেছিলেন। সেখানে জমায়েত হয়ে আমরা তাঁর নেতৃত্বে কিছুদিন এটা-ওটা করেছিলাম। কখনো কখনো কিছু সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও এই ক্লাবের নির্ঘণ্ট ছিল। আইয়ুব শাহি বুনিয়াদি গণতন্ত্রের প্রথম পর্যায়ে এইসব চাঁদতারা ক্লাবের খুব হিড়িক পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু তাতে যে পল্লির উন্নয়ন কিছুমাত্র হলো, এমন নয়। তফসির মিঞা জানতেন যে, উন্নয়ন এভাবে হয় না। কিন্তু এটা যেহেতু তাঁর চাকরি, নিয়মরক্ষা তাঁকে করতেই হতো।

সে যা হোক, তফসির মিঞা মানুষটি ছিলেন চমৎকার। শান্ত, নির্বিরোধ আদ্যন্ত ভদ্রলোক এবং উপরন্তু সাহিত্য-শিল্পে রসগ্রাহী। কবিতা লেখার অভ্যেস ছিল। বাবা এবং যতীনবাবুর সঙ্গে তাঁর বেশ গাঢ় হৃদ্যতা জন্মেছিল। অচিরে তিনিও আমাদের আড্ডার স্টলের একজন নিয়মিত সদস্য হলেন। বাবাও তাঁর সঙ্গে সঙ্গে আসতেন। আমরা তাঁদের আলাপ-আলোচনা খুবই মন দিয়ে শুনতাম।

সফসির মিঞা বলতেন, দেখুন সরকারের তরফ থেকে আমাকে এখানে পাঠানো হয়েছে পল্লি অঞ্চলের স্বাস্থ্য, পরিচ্ছন্নতা, পশুপালন পদ্ধতি ইত্যাদি বিষয়ে গ্রামবাসী সাধারণদের সুশিক্ষা ও সুপরামর্শ দেবার জন্য। কিন্তু এই কাজের জন্য যে পরিকাঠামো এবং টিমওয়ার্ক দরকার, তার কোনো ব্যবস্থা নেই। আমার মনে হয়, যেখানে গ্রামের শিকড়টাই উপড়ে গেছে, সেখানে এ প্রচেষ্টার কোনো অর্থ নেই। যতীনবাবু বলতেন, ভূমির বণ্টনব্যবস্থা সুষম না হলে গ্রামীণ কোনো উন্নয়নই সম্ভব বলে আমার মনে হয় না। আপনার কাজকর্মে পরিত্যক্ত ভিটে দখলকারি এবং নতুন গজিয়ে ওঠা তালুকদারদের খানিকটা উপকার হয়তো হবে, কিন্তু তা কিছুদিনের জন্য মাত্র। এইসব আলোচনায় তফসির মিঞা খুব অপ্রস্তুত বোধ করতেন। কারণ ‘ছাড়া’ ভিটের দখলদাররা মুসলমান এবং তিনিও মুসলমান, তাই। যতীনবাবু বলতেন, আপনার বিব্রত হবার কারণ নেই। ভাববেন না আমি ছাড়াভিটের দখলদারি বলতে আপনার সম্প্রদায়ের ওপর কটাক্ষ করছি। আমি যে সম্প্রদায়ের মানুষ, তাদের মধ্যেও ভাড়াভিটের দখলদার আছে। হয়তো সংখ্যাগতভাবে কম। কিন্তু তাঁরা যদি সংখ্যাগুরু হতেন, তাঁরাও একই কাজ করতেন। প্রশ্নটা গ্রামীণ উন্নয়নের সফলতা সংক্রান্ত। এইসব আলাপ-আলোচনা তাঁদের মধ্যে চলত প্রায়শই। তবে সমস্যার সমাধান বিষয়ে কেউই কিছু পথের সন্ধান দিতে পারতেন না। সব আলোচনাই শেষতক গভীর নৈরাশ্যে ডুবে যেত। তফসির মিঞা বলতেন, এখানের সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক বুনিয়াদটাই ধসে গেছে। শুকনো গাছে পানি দিলে কি পাতা গজায়?

সকল অধ্যায়

১. বিষাদবৃক্ষ – ১
২. বিষাদবৃক্ষ – ২
৩. বিষাদবৃক্ষ – ৩
৪. বিষাদবৃক্ষ – ৪
৫. বিষাদবৃক্ষ – ৫
৬. বিষাদবৃক্ষ – ৬
৭. বিষাদবৃক্ষ – ৭
৮. বিষাদবৃক্ষ – ৮
৯. বিষাদবৃক্ষ – ৯
১০. বিষাদবৃক্ষ – ১০
১১. বিষাদবৃক্ষ – ১১
১২. বিষাদবৃক্ষ – ১২
১৩. বিষাদবৃক্ষ – ১৩
১৪. বিষাদবৃক্ষ – ১৪
১৫. বিষাদবৃক্ষ – ১৫
১৬. বিষাদবৃক্ষ – ১৬
১৭. বিষাদবৃক্ষ – ১৭
১৮. বিষাদবৃক্ষ – ১৮
১৯. বিষাদবৃক্ষ – ১৯
২০. বিষাদবৃক্ষ – ২০
২১. বিষাদবৃক্ষ – ২১
২২. বিষাদবৃক্ষ – ২২
২৩. বিষাদবৃক্ষ – ২৩
২৪. বিষাদবৃক্ষ – ২৪
২৫. বিষাদবৃক্ষ – ২৫
২৬. বিষাদবৃক্ষ – ২৬
২৭. বিষাদবৃক্ষ – ২৭
২৮. বিষাদবৃক্ষ – ২৮
২৯. বিষাদবৃক্ষ – ২৯
৩০. বিষাদবৃক্ষ – ৩০
৩১. বিষাদবৃক্ষ – ৩১
৩২. বিষাদবৃক্ষ – ৩২
৩৩. বিষাদবৃক্ষ – ৩৩
৩৪. বিষাদবৃক্ষ – ৩৪
৩৫. বিষাদবৃক্ষ – ৩৫
৩৬. বিষাদবৃক্ষ – ৩৬
৩৭. বিষাদবৃক্ষ – ৩৭
৩৮. বিষাদবৃক্ষ – ৩৮
৩৯. বিষাদবৃক্ষ – ৩৯
৪০. বিষাদবৃক্ষ – ৪০
৪১. বিষাদবৃক্ষ – ৪১
৪২. বিষাদবৃক্ষ – ৪২
৪৩. বিষাদবৃক্ষ – ৪৩
৪৪. বিষাদবৃক্ষ – ৪৪
৪৫. বিষাদবৃক্ষ – ৪৫
৪৬. বিষাদবৃক্ষ – ৪৬

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন