বিষাদবৃক্ষ – ৩৫

মিহির সেনগুপ্ত

পঁয়ত্রিশ

অনেক দিন আগের পুরনো কথার পসরা নিয়ে বসেছি। সব কথা একক একটি নির্দিষ্টক্রমে সাজানোর স্মৃতি-প্রবহন নেই আর। পেছনের দিকে যতদূর সম্ভব দৃষ্টি প্রলম্বনের চেষ্টা সত্ত্বেও এক অনিবার্য কুয়াশা তার তাবৎ অস্তিত্বকে আচ্ছন্ন করে এলায়িত বিশৃঙ্খলায় তাকে বিপর্যস্ত করে ফেলে। কখনো এমনও বোধ হয় এসব তো এই সেদিনের ঘটনা। এরই মধ্যে কি মহাকালের রথচক্র এতটা পথ অতিক্রম করেছে? কালের গতি অবশ্যই অতি কুটিল।

কিন্তু জীবন তো থেমে থাকে না। তার অবিরাম প্রবাহই কালের গতিকে অস্তিত্বমানতায় সত্যগ্রাহ্য করে তোলে। নচেৎ কালের আর কীই-বা অবয়ব আছে? জীবনের সেই চলমানতাকে আশ্রয় করে, তার কিছু-কিঞ্চিৎ পদচিহ্নের ছবি যারা ফুটিয়ে তুলতে চাই, তাদের প্রদোষকালীন কুয়াশাকে নবীনেরা অবশ্য ক্ষমা করবেন, এমতো প্রত্যাশা। আমরা কুয়াশাচ্ছন্নরা শুধু উচ্চারণ করতে পারি— তেহিনো দিবসা গতাঃ।

কিন্তু সে কথা উচ্চারণ করার সময় যখন দেখি বড় খালপারের ওই পিতামহ-পিতামহী সদৃশ বৃক্ষদম্পতি এখনও সজাগ সতর্ক—তখন এ উচ্চারণ স্তব্ধ হয়। এক অনির্বচনীয় কারণে মৌনমূক হয়ে তাকিয়ে থাকতে হয় সেই কুলপতি, কুলপত্নী দম্পতির দিকে। তাঁদের বয়স দুই শতক ছাড়িয়ে আর খানিকটা। তাঁরা বাক্য বলেন না। ইশারা-ইঙ্গিতে পাতা ঝরিয়ে শাখা কাঁপিয়ে নির্দেশ জারি করেন। ‘প্রাকৃতিক নির্বন্ধের মধ্যে আমি নিদর্শন রেখেছি তোমরা সেখান থেকে শিক্ষা গ্রহণ করো।’ ওই কুলপতি বৃক্ষদম্পতি তো আমাদের অতি-নির্দেশক প্রাকৃতিক নির্বন্ধ। আমরা কেন তাদের কথার বা ইচ্ছার মান্যতা দিচ্ছি না?

কোরান, পুরাণের কথা ছেড়ে দিলেও একটা সত্য তো জানতে মন চায়ই তাহলে কী? কিন্তু সেই দার্শনিক প্রশ্নের ক্ষেত্র এ নয় এবং অতঃপর আমরা এ বৃক্ষদম্পতিকে স্থিতিশীল মেনে নিয়েই পরবর্তী কথকতাতে যাব।

যে কথাগুলো এখন বলতে যাচ্ছি তার অধিকাংশই একান্ত ব্যক্তিগত জীবনের সংগ্রামের কথা। জগৎসংসারে এ কথায় হয়তো কারও তেমন কোনো প্রয়োজন নেই। তথাপি বলছি এ কারণে যে, একটি সাম্প্রদায়িক দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ছেলেকে কীভাবে সেদিন তার বাঁচার পথ তৈরি করতে হয়েছিল তার খানিকটা পরিরচয় হয়তো এ আলেখ্যে পাওয়া যাবে। সংখ্যালঘুরা তখন দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক। দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক অর্থে শহরে, নগরে এবং গ্রামে, সেসব দিনে কী বোঝাত তা ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ বিশদ জানবেন না। তখন শহর-নগরে শিক্ষিত, কলেজ-ভার্সিটির ডিগ্রিধারী হয়েও হিন্দু যুবকেরা কোনো সরকারি সংস্থায় কর্ম পাবার অধিকারী নয়। ব্যবসার ক্ষেত্রে তাদের ওপর নজরদারি, যেন তারা মুনাফার অর্থ হিন্দুস্থানে না পাঠাতে পারে, যদিও তখন তাদের গেরস্থালি এপার-ওপারে স্বাভাবিকভাবে বিভাজিত এবং অর্জিত অর্থের বিভাজন নৈতিকভাবেই অবশ্য-কর্তব্য। আলেখ্যের পাঠক/পাঠিকাদের উদ্দেশে জানাই তখনকার সামাজিক রীতি অর্থাৎ আত্মীয় প্রতিপালন, কর্তব্যকরণ ইত্যাকার বিষয়সমূহ অধুনাকার নিয়ম থেকে ভিন্নতর বোধে এবং অভ্যাসে/নিয়মে ছিল। যৌথতার মূল্যবোধ তখনও বাস্তব। অতএব, রাষ্ট্রীয় নিয়ম সে ক্ষেত্রে যে পর্যায়েই থাকুক, সামাজিক নিয়মের সঙ্গে তার ভিন্নতা ছিল। ফলে এই দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকেরা, এ বিষয়ে বিশেষ সংকটে আকুল ছিলেন। মনে রাখতে হবে, বিভাজিত মাতৃভূমির এই পূর্ব প্রান্তে পশ্চিম প্রান্তের মতো Re -patriation ব্যাপারটি ঘটেনি। শুধু কিছু বিশেষ পরিবার সম্পত্তি বদল করে নিজেদের স্বার্থ বজায় রেখেছিলেন। নচেৎ, তুমি কার, কে তোমার? ইত্যাদি।

হিন্দুজনেরা, যারা পঞ্চাশ-একান্নর গণহত্যা সত্ত্বেও এখানে মাটি কামড়ে পড়েছিল, তারা দাঙ্গার আতঙ্ককে গুরুত্ব না দিয়ে ‘লড়েই থাকব’—এরকম এক মানসিকতার অধিকারী ছিল। এর কারণ ছিল এই যে, পিছারার খালের জগতে দাঙ্গা বলতে যা বোঝায় তা বিশেষ ঘটেনি। সেখানে একটিও খুন দাঙ্গাজনিত কারণে হয়নি, হয়নি তেমন বলাৎকারও। শুধু অন্যান্য স্থানের গণহত্যা, ধর্ষণ, খুন, রাহাজানি, অগ্নিসংযোগ ইত্যাকার বিষয়ের ঘটনা তথা গুজবের জন্যই এ অঞ্চল শূন্য হতে থাকে। এ অঞ্চলের মুসলমান সম্প্রদায় যেহেতু বহুকাল থেকে হিন্দু সামন্ত এবং উচ্চবিত্তদের মুখাপেক্ষী ছিল এবং তাদের ইসলামে রূপান্তরিত হওন খুব দীর্ঘদিনের ঘটনা ছিল না, তাই তারা অন্য স্থানের মতো হিন্দুবিদ্বেষী হিসেবে প্রতিভাত হয়নি। তথাপি যে তাদের ভয়ে ভদ্র হিন্দু সমাজ ভীত হয়েছিল, তার কারণ নিহিত ছিল হিন্দু সমাজের নিজস্ব সমাজ-নিয়মে

কিন্তু সামাজিক জটিল নিয়মে এই সাধারণ মুসলমান শ্রেণিই বোধহয় ভদ্রহিন্দু গেরস্তদের দেশত্যাগজনিত কারণে আখেরে অধিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাদের রুজি-রোজগারের ওপর, চাষবাস-গেরস্থালির ওপর এক অকস্মাৎ অশনিঝঞ্ঝা বয়ে গেল যেন। এরা অর্থাৎ এই সাধারণ অপবর্গী মুসলমান, নমঃশূদ্র ইত্যাদিরাই ছিল আমার ওই অঞ্চলের ভূমিপুত্র তথা মধ্যস্বত্বভোগীদের প্রজাসাধারণ। রাষ্ট্রীয়কল্পে যেসব ঘটনা ঘটে গিয়েছিল, তারা তার মর্ম কিছুই বুঝতে পারেনি। ফলত, তারা এই দক্ষিণ-পূর্ব সমতট বঙ্গে প্রাক্তন বিশ্বাসেই বহুকাল স্থায়ী ছিল। তারা নিমকহারাম এবং নিমকহালাল, ইসলামের এই দুটি আদর্শকে এক অসম্ভব বিশ্বাসে হৃদয়ে পোষণ করত। কুখ্যাত বরিশাল রায়ট বা দাঙ্গায় এদের বিশেষ ভূমিকা ছিল না। অবশ্যই কিছু উগ্র মনুষ্যের কথা সর্বদাই স্বতন্ত্র। হিন্দু উচ্চবর্ণীয়দের প্রাক্তন কৃতকর্ম এবং উঠতি কিছু উচ্চাভিলাষী মুসলমানদের ষড়যন্ত্র এই দাঙ্গার জন্য দায়ী—এ কথায় কোনো মিথ্যাচার নেই। এই হিন্দুদের পরিত্যক্ত বাড়িঘর, জমিজেরাত ইত্যাদি সম্পত্তি দখল করা যত সহজসাধ্য ছিল, তার সংরক্ষণ অথবা ভবিষ্যৎ উন্নতির বন্দোবস্ত করা তত সহজ ছিল না। দখলকারীরা যতদিন সম্ভব এই সমস্ত বাগান, বাড়ি, পুকুর ইত্যাদির উপজসমূহ ভোগ করার পর যখন স্বাভাবিকক্রমে এসবের বিনষ্টি হলো, তার পুনর্নির্মাণ করতে সক্ষম হলো না। না হওয়ার কারণ এ ধরনের গার্হস্থ্য বিষয়ে তাদের শিক্ষার অভাব। এ কারণে একসময় এইসব উপজ-দখলকারীরা কর্মহীন হয়ে পড়ল। চুরি, ডাকাতি এবং নৈরাজ্যের আধিক্য এ সময় থেকেই ঘটতে লাগল। এই সময় থেকেই তারা, অর্থাৎ যারা ‘পড়ে পাওয়া চৌদ্দ আনার’ উপজে তার দখলকারী মালিককে সন্তুষ্ট করে নিজেরা কড়ায় আনা রোজগার করছিল, তাদের সোনার ডিমপাড়া হাঁসটি মরে গেল। আর তারা তখন তাদের পোষকদের ওপর লোভের তথা সহজ আয়ের থাবাটি উত্তোলন করল। তখন আর ধর্ম বা সম্প্রদায়ের ভেদ বিচার থাকল না। নিম্নবর্ণীয় হিন্দুদের মধ্যে যারা এদের সহযোগী হলো একমাত্র তারা ছাড়া বাকি সবাই দেশত্যাগে উদ্যোগী হলো। তাঁতিরা তাঁত বোনা বন্ধ করল, কারণ তাদের পুঁজি ডাকাতেরা লুট করে। কামারেরা লোহার কাজকর্ম ছেড়ে দিল, যেহেতু কাজ করিয়ে কেউ মজুরির পয়সা দেয় না, শুধু চোখ রাঙায়। এইভাবেই তাঁতি, কামার, ছুতোর, কুমোর ইত্যাকার যাবতীয় পেশার সাধারণ মানুষ দেশ ছাড়তে শুরু করল। কেন? না, তাদের আর থাকার উপায় নেই। তাদের পেশাবলম্বনকারীরা ছিল এই প্রত্যন্ত বাংলার গ্রামীণ বিশ্বের স্তম্ভস্বরূপ। একদা তারা, সম্প্রদায় নির্বিশেষে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পর্তুগিজ, মগ এবং অন্যান্য হার্মাদদের মুখোমুখি হয়ে লড়াই দিয়েছে তথা নিজেদের মান, মর্যাদা, গেরস্থালি রক্ষা করেছে। আজ তাদের নিজেদের মধ্যে বিরোধ। কেউ কিছুই বুঝতে পারছে না। কেন এমনটি হলো?

যে ডাকাতদের সহায়তায় মুসলমান সমাজের লোভী উচ্চবিত্তেরা নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধি করতে প্রয়াসী হয়েছিল, এখন তারা নিজেরাই এদের হাতে নিগৃহীত হচ্ছে। এ কারণে এরাও গ্রাম ত্যাগ করে একে একে শহর-নগরে প্রবাসী হচ্ছে। সুন্দর সাজানো এই গ্রামগুলোকে এইভাবেই আমি রিক্ত হতে দেখেছি এবং এই ধারা ক্রমান্বয়ীই হয়েছে।

আমার পরিবারের ব্যাপক জনগণ বহুকাল আগেই দেশত্যাগ করেছিল। রায়বাহাদুর দাদুর পরিবার মধ্যস্বত্বের শাঁস জলের ব্যাপক সারাৎসার নিয়ে দেশভাগের অনেক আগেই দেশান্তরী। তারা তাদের আখের গুছিয়ে নিয়ে যথাস্থানে ‘রায়বাহাদুর’। যে সময়ের কথা বলছি তখন আমরা ‘ব্যাঙ বাহাদুরও নই।’ মধ্যস্বত্ব লোপের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের অংশের আর্থিক ব্যবস্থা একটা কুৎসিত আকারে নখদন্ত বিস্তার করে আত্মপ্রকাশ করল। এই সময় এই পরিবারে আমাদের জন্ম, বাল্যকাল এবং কৈশোর। পরিবারের কেউ লন্ডনে পড়াশোনা করে, কেউ গ্রামে গরু চরায়, এরকম এক অবস্থা, যদিও তারা একই পরিবারের সন্তান। কিন্তু এসব তথ্য-তত্ত্ব চুলোয় যাক। বরং অন্য কথায় যাই। অন্য কথা এই যে, আমার বাবা বহুকাল আগের থেকেই নাকি জ্যাঠামশাইকে বলেছিলেন যে, পশ্চিমবঙ্গের কোথাও পারিবারিক একটা স্থিতিস্থাপনা প্রয়োজন। জ্যাঠামশাইও তালুকদারি থাকাকালীন সময়ে বর্ধমানের নীলপুরে বেশ কয়েক বিঘা জমির ব্যবস্থা করেছিলেন। উদ্দেশ্য, আমাদের দেশের বাড়ির মতোই বিরাট বিশাল আড়ম্বরে এক নারকেল, সুপারি, ধানমান, কলা, কচু সমন্বিত একটি সমৃদ্ধ গেরস্থালির পত্তন। জ্যাঠামশাই বলেছিলেন যে, সবকিছু গুছিয়ে দেশের সবাইকে বর্ধমানে পাঠিয়ে দেবার পরেও তিনি দেশেই থেকে যাবেন। দেশ তিনি ছাড়বেন না। যতদিন তা না হয়, ততদিন কলকাতার বাসায় পরিবারের ব্যাপক জনেরা থাকবে। কিন্তু জ্যাঠামশাইয়ের সেসব গোছানো আর কোনো দিনই হয়নি। সে জমির গতি কী হলো, তা-ও আমরা কেউ জানতে পারলাম না। জ্যাঠামশাই অবশ্য শেষ পর্যন্ত দেশেই থেকে গিয়েছিলেন। কিন্তু আমাদের মা-বাবা, ভাইবোনদের নিয়ে ভিখিরির মতো শূন্য হাতে পশ্চিমবঙ্গে চলে এসেছিলেন। অবশ্য তা অনেক পরের কথা এবং অন্য লড়াইয়ের বৃত্তান্ত।

টেস্ট পরীক্ষার পর যখন বাড়িতে কিছুদিন ছিলাম তখন বাবার সঙ্গে সাংসারিক কিছু কথাবার্তা বলার প্রয়োজন বোধ করলাম। কথাবার্তা বলতে আর কিছুই না, দেশের তদানীন্তন অবস্থা এবং তার প্রেক্ষিতে কর্তব্যাকর্তব্য। বোনেরা, ভাইয়েরা আস্তে আস্তে বড় হয়ে উঠছে। তাদের, বিশেষত বোনেদের বিষয়ে কী করা যায়, সংসারের প্রয়োজন দিন দিন বেড়ে চলেছে, জিনিসপত্রের দাম ক্রমশ আকাশছোঁয়া হচ্ছে। বাবার চল্লিশ টাকা মাইনের চাকরি। তা-ও অনিয়মিত। সব মাসে মাইনে পাওয়া যায় না। লোকেরা ধারকর্জ আর দিতে চায় না, তা ছাড়া দেবার মতো অবস্থার লোকই-বা কোথায়? বোনেদের বিষয়ে অন্য বিপদের চিন্তাও উপেক্ষা করার নয়। যদিও তারা এখনও ছোট কিন্তু দুবছর/চার বছর বাদে তো তারা বড় হবে। তখন এই হিংস্র জনপদে তাদের কীভাবে রক্ষা করব? অর্থাৎ সবদিক দিয়েই ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা এবং আতঙ্ক। এইসব নিয়ে বাবার সঙ্গে কথা বলে বুঝলাম যে, তাঁর নিজস্ব কোনো নির্দিষ্ট ধ্যান-ধারণা এ ব্যাপারে নেই। সম্ভবত তখনও তিনি তাঁর দাদার ওপর বিশ্বাস রেখে চলেছেন যে, তিনি নিশ্চয়ই কিছু একটা করবেন। তাঁর এমতো বিশ্বাসে আশ্বস্ত হতে পারলাম না। এর কিছুকাল আগে আবার কলকাতার যৌথ বাসাবাড়ি ভেঙে পরিবার ছত্রখান। ছত্রখান হবার প্রধান কারণ মধ্যস্বত্ব বিলোপ এবং তালুকদারির পয়সার আনাগোনা বন্ধ। যদিও সেখানে তখন যতজন লোকই থাকুক, দুইজন কাকা এবং আমার বড়দাদা মোটামুটি ভালো চাকরি করেন। বাসাবাড়ির ভাড়া সামান্য, যদিও তার আয়তন বিরাট। দিদিদের তিনজনের বিয়ে হয়ে গেছে। এক জেঠতুতো দিদি এবং এক বোনের তখনও হয়নি। খুব একটা অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। তবু ভূতের বোঝা কে বয়? এ ক্ষেত্রেও ভূত আমার বাবা এবং তার বোঝা আমরা পাঁচ দাদা। তাঁদের মধ্যে একজন রেলে কর্মরত। বাকিরা ছাত্র। শুনেছি বাড়িভাড়া বাকি পড়ার দায়ে এই বাসাটি অত্যন্ত অসম্মানজনক অবস্থায় উচ্ছেদ হয় এবং ভূতের বোঝারা ছাড়া বাকি সদস্য-সদস্যারা নিজ নিজ জনেদের নিয়ে সুবিধেজনক জায়গায় সুখের সংসার গড়তে চলে যান। শুধু ভূতের বোঝারা প্রায বায়ুভুক নিরাশ্রয় অবস্থায় সেই সহায়সম্বলহীন মহানগরীতে ভাসমান।

এতসব কথা বলার কারণ এই যে, আমাদের তৎকালীন মধ্যস্বত্বভোগী সমাজের বাবা-কাকা-জ্যাঠাদের কর্তব্যজ্ঞান, কর্মবিমুখতা, স্বার্থপরতা কোন স্তরে নেমে এসেছিল, তারই নমুনা দেখানো। তখন যে সময়, তাতে যৌথ সম্পত্তি থাকলেও যৌথ পরিবার ভেঙে পড়ছিল। এ ক্ষেত্রে তো যৌথ সম্পত্তিই লুপ্ত। অতএব ব্যক্তি-বিশেষকে দোষারোপ করে লাভ নেই। শুধু আশ্চর্য বোধ হয় এই ভেবে যে, শুধু খাস জমিগুলোর সুষ্ঠু ব্যবস্থা করার চিন্তাটা মাথায় থাকলেও, কী দেশের বাড়িতে, কী পশ্চিমবঙ্গে পরিবারটির দুর্গতির কারণ ছিল না। কিন্তু আমাদের মতো পরাশ্রয়ী মধ্যস্বত্বভোগী পরিবারগুলোর ক্ষেত্রে এই জাতীয় নিগ্রহ যেন নির্ধারিত ছিল।

এই সময়ে দেশের বাড়িতে আমাদের অবস্থা যত খারাপই হোক না কেন, মাথার উপর অন্তত প্রাচীন ছাদটি ছিল। আমার দাদাদের তা-ও ছিল না। তাঁরা তখন এ গলি, সে বস্তি করে করে খড়কুটোর মতো ভেসে বেড়াচ্ছিল। আমি তখন তার কিছুই প্রায় আন্দাজ করতে পারিনি। সে সময়ে নিতান্ত অল্পবুদ্ধি এবং বয়সও অল্প। উপরন্তু নিয়ত দারিদ্র্য এবং অনাহারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে করে আমার মন-মানসিকতা অত্যন্ত বিকৃত হয়ে পড়েছিল। তখনও আমি শহর-নগর দেখিনি। সেখানে অসহায়ভাবে জীবনযাপনের সংগ্রাম কেমন হয়, সে বিষয়ে বাস্তব কোনো জ্ঞানও জন্মেনি। জন্ম থেকে একটা বদ্ধ অবস্থার মধ্যে বসবাস করার জন্য, ব্যাপক জীবনের বৃহৎ বা মহৎ কিছু সংস্পর্শে না আসার কারণে, বিশেষত কোনো সৎশিক্ষা না পাওয়ায় আমার মধ্যে কোনো স্বাধীন বিচারবুদ্ধি বা সুষ্ঠু কাণ্ডজ্ঞানের জন্ম হয়নি। যথাসময়ে স্কুলে পাঠানো হয়নি বলে বাইরের জগতের কোনো শিক্ষাই তখনও আমার লাভ হয়নি। বাড়িতে যেসব ধর্মপুস্তক, পুরাণাদি ইত্যাদি পড়তাম আর পাড়া-প্রতিবেশী বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের কাছ থেকে চিরন্তনী উপদেশ পেতাম, সেসবই আমার চরিত্র এবং মানসিকতা গঠন করেছিল। বস্তুত ওই সময়টায় আমি একটা কুসংস্কারাচ্ছন্ন, ধর্মভীরু এবং অকারণ নীতিবাগিশ হিসেবেই বেড়ে উঠছিলাম। স্কুলে যাবার পরও আমার এই মানসিক বদ্ধতা দূর হয়নি।

এইসব কারণেই দাদাদের সেই দুর্দিনে, সেই অসহায় অবস্থায়, দেশ থেকে তাঁদের কত কুৎসিত চিঠিপত্রই না লিখেছি। পরে বুঝেছি আমাদের দেশের বাড়িতে যতই দুরবস্থা থাকুক না কেন, তাঁদের পক্ষে তখন কিছু করার কোনো উপায়ই ছিল না। কিন্তু আমি অযথা বাক্যবাণে তাঁদের মনে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছি এবং কষ্ট দিয়েছি। আসলে দেশের ওইরূপ মাৎস্যন্যায়ের জন্য একটা ব্যাপক নিরাপত্তাহীনতা, ভাইবোনদের ভবিষ্যৎ চিন্তা, নিজের পড়াশোনার অনিশ্চয়তা আমাকে যেন ক্ষিপ্ত করে তুলেছিল।

টেস্টের ফল প্রকাশে আর বিশেষ দেরি ছিল না। দেখতে দেখতে পরীক্ষা মিটে যাবে। পাস করলে কর্তারা আমাকে কলেজে ভর্তি করবেন কি না, করলেও শহরে থেকে পড়াশোনা করার দায় বহন করা তাঁদের ক্ষমতা তথা মন-মানসিকতানুযায়ী হবে কি না, না হলে আমি কীভাবে সেই ব্যয়ভার নির্বাহ করব, এইসব চিন্তায় বড় ব্যাকুল হয়ে পড়েছিলাম। এরই ফল দাদাদের কাছে লেখা ওইসব চিঠিপত্র। বাবা মনে মনে কী চিন্তা করতেন জানি না, তবে মা, এ প্রসঙ্গ উত্থাপন করলে উত্তর দিতেন, ‘ঠাকুর যা করেন তা-ই হবে।’ আমি ধার্মিক মনোভাবাপন্ন হলেও তাঁদের মতো ঠাকুরের ওপর নির্ভরশীল ততটা ছিলাম না। তাই বাস্তবের কথাটা আমাকে ভাবতে হচ্ছিল।

আজকাল বাবা-মায়েরা সন্তানদের শিশুকাল থেকেই কত যত্নে পড়াশোনার ব্যবস্থা করেন। সেই সময়কার মানসিকতা থেকে তা কত স্বতন্ত্র! এখন অবশ্য একটি-দুটি সন্তান, তাই তাঁদের পক্ষে তা সম্ভব হয়। তবে মানসিকতার পরিবর্তনও যে একটা ব্যাপার সে বিষয়েও সন্দেহ নেই। বোধকরি তখনকার দিনে, বিশেষত যে অবক্ষয়ের সময় বিষয়ে এ আলেখ্য রচনায় প্রয়াসী হয়েছি, তখন পিছারার খালের মতো জগতের মধ্যবিত্ত/মধ্যস্বত্বভোগী জীবদের প্রেতাকৃতি বংশজরা জীবনের রস বঞ্চিত হয়ে এরূপ উদাসীন, উদরসর্বস্ব এবং বিকৃত রুচির জীব হিসেবে পরিণত হয়েছিল। শুধু শিক্ষা শিক্ষণ নয়, স্বাস্থ্য, অন্নবস্ত্র, বাসস্থানের মেরামতাদিকরণ তথা গার্হস্থ্য, সমস্ত প্রকার কর্তব্যাকর্তব্য বিষয়েই সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যবিহীন হয়ে এক নিকৃষ্ট জৈবিকতা অবলম্বন করেছিলেন তাঁরা। এর মূল কারণ শুধু দেশভাগ, দাঙ্গা এবং তজ্জনিত আতঙ্কই নয়, এর অন্য অনেক কারণ ছিল। সব কথা লিখতে গেলে রচনা অকারণ গুরুভার হয়ে পড়বে। সে যা হোক, ভেবে দেখলাম, পরীক্ষা পাসের পর কলেজে পড়াশোনা কস্মিনকালেও হবার সম্ভাবনা আমার অন্তত নেই। যদি কৃতকার্য হই, তবে ঝালকাঠি বন্দরে অথবা বরিশাল শহরে গিয়ে চাকরির চেষ্টা করব। চাকরি পেলে সবাইকে নিয়ে একটা বাসা ভাড়া করে থাকব। সেখানে হয়তো অধিক লোকসমাগমে ডাকাতি, বলাৎকার ইত্যাদির ভীতির হাত থেকে খানিকটা রক্ষা পাব। নতুন স্থানে, নতুন মানুষজনের সাহচর্যে একাকিত্বের বিষণ্নতাও অনেকটা ঘুচবে। সেসব স্থানে অনেক হিন্দু এবং সজ্জনের বসবাস। গ্রামের নিত্য শূন্যতাবোধ, নিত্য অনিশ্চয়তার হাত থেকে বাঁচতে পারব। এমনকি অদৃষ্ট প্রসন্ন হলে আজ না হয় কাল প্রাইভেটে পরীক্ষা দিয়ে পরবর্তী শিক্ষার ধাপগুলো অতিক্রম করতে পারব। ঝালকাঠি বন্দরকে সেসব দিনে আমরা শহরই বলতাম এবং সেই তথাকথিত শহরের প্রতি একটা তীব্র আকর্ষণ এমনকি ভালোবাসাও ছিল। সেখানে কিছু পরিচিতজন ছিল সমবয়সি। তাদের কথাবার্তা, পোশাক-আশাক এবং জীবনযাপনপ্রণালি আমার মতো ছেলেদের কাছে বড় স্বর্গীয় বলে বোধ হতো। এইসব চিন্তায় মন বড়ই প্রফুল্ল হলো। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এও উপলব্ধি করলাম, শুধু ম্যাট্রিক পাস করা অপরিণত বয়সি একটি দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকের পক্ষে কোনো চাকরি জোটানো আদৌ সম্ভব হবে কি? বস্তুত প্রবল মানসিক হতাশা এবং নৈরাশ্যকে ভোলার জন্য এতক্ষণ আমার কল্পনাপ্রবণ মস্তিষ্কে এইসব স্বপ্নের আনাগোনা হচ্ছিল। এগুলো বাস্তবে সম্ভব নয় জেনেও তখনকার মতো বেশ উজ্জীবিত বোধ করলাম। আপাতত টেস্ট পরীক্ষা উত্তীর্ণ হওয়া এবং ফাইনালের জন্য প্রস্তুতিই প্রধান কাজ বলে গণ্য হলো। অবশ্যই তৎসহ ছাত্র পড়ানো এবং অন্যান্য সাংসারিক কাজকর্ম তো ছিলই।

অধুনা ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনার ক্ষতি হতে পারে এই ভেবে মা-বাবা তাদের কোনো সাংসারিক কাজে নিয়োগ করেন না। সেই যুগে, অন্তত আমাদের এলাকায় বিষয়টি ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত, আগে ঘর-গেরস্থালির কাজ, পড়াশোনার বিলাসিতা পরে। আমার বাবা প্রায়ই বলতেন, পড়ইয়া আমারে রাজা করবা? তার থিহা রান্ধনের কাষ্ট কাডইয়া আনো। খালের থিহা জল লইয়া আয়ো। অত পড়নের কী অইছে?—এসব কথা তখনকার দিনে পিছারার খালের জগতের বাবাদের প্রায় অমোঘ নির্দেশ ছিল। আমাকে আমার গোটা কৈশোর এবং বাল্যকাল তথা প্রাথমিক যৌবনকাল ধরে এই সমস্যার মোকাবিলা করতে হয়েছে। কখনো আমার এমনও মনে হয়েছে, পড়াশোনা করা যেন এক অপরাধ, যার জন্য গুরুজনেরা অবশ্যই শাস্তি দিতে পারেন। যেমন ধরা যাক ভোরবেলা উঠে খাতাপত্তর নিয়ে পড়তে বসেছি, এমন সময় মায়ের আদেশ—আইজ এট্টু বাজারে যাওন লাগবে। অথচ বাড়ির কর্তা তখন কাষ্ঠাসনে বসে গড়গড়ায় ধূম্রপানে নিমগ্ন। তিনি (তখনও) বাবু। তাঁর পক্ষে ঝোলা-খালুই (বরিশালে ‘খাড়ই’ বলে, যাতে মাছ আনা হয়) হাতে দেড় মাইল হেঁটে বাজারে যাওয়া নেহাতই অনভিজাত কৰ্ম। চাকরপাট তখন আর তেমন নেই যা দু-একজন আছে তারা চুরি-ছ্যাচরামি করে ‘এ্যাড়ের মালের দাম দ্যাড় কয়।’ সুতরাং ‘রইল সাধের পড়াশোনা, করো বিষয়ভাবনা।’ দেড় মাইল দূরে বাজার, সেখান থেকে সওদা আনো, তা-ও—– কিছু নগদ কিছু বাকি। টুকিটাকি দিও ফাঁকি।’ এই অবস্থায় সন্তান কতটাই-বা প্রকৃত মনুষ্য হিসেবে তৈরি হতে পারে?—তারপর নাকে মুখে গুঁজে স্কুলে যাও-না-যাও বয়েই গেল।

এখন তো ছেলেমেয়ে পড়া সেরে উঠলে বাবা বইপত্র ব্যাগে ভরে দেন তো মা ক্লাস সেভেনের ছেলে বা মেয়েকে পর্যন্ত চান করিয়ে, খাইয়ে দিয়ে, জামাকাপড় পরিয়ে স্কুলবাসে, গাড়িতে, রিকশায় তুলে দিয়ে টা টা-বাই বাই—বাবাই, ঠিকমতো হোমওয়ার্ক জেনে এসো কিন্তু। তারপর দল বেঁধে মায়েরা ছুটির আগেই বাবাই সোনাদের আনার জন্য স্কুলের কম্পাউন্ডে উন্মাদিনী যশোদা। সবাই একটা ব্যাপারে একমত যে, বাবাই সোনাদের বড় কষ্ট, আহা! এই ব্যাপারটিও যে খুব সামাজিক স্বাস্থ্যসম্মত, এমতো বোধ হয় না, তবে আমাদের পিছারার খালের তদানীন্তন সন্ততিরা আমাদের বাবা, কাকা, জ্যাঠাদের কাছে যে নিতান্ত আপদ হিসেবে গণ্য হচ্ছিলাম, তা বোধহয় আরও জঘন্য। কারণ আমাদের জন্মের জন্য আমরা বা আমাদের মায়েরা আদৌ দায়ী ছিলাম না। মূল দায়িত্ব অবশ্যই কর্তাদের ছিল। এই বিষয়ে একটি উদাহরণ দেয়ার লোভ সামলাতে পারছি না। আমাদের দেশের এক গোঁসাই ঠাকুরের স্ত্রী সদাই অন্তস্থা থাকতেন। কেউ যদি জিজ্ঞেস করত, গোঁসাই, দুলালের মায় আছেন ক্যামন? উত্তর অতিদ্রুত—ক্যামন আর? কোলে এউক্কা, ক্যাখে এউক্কা, এউক্কা তো দেখছই হবায় হোগাঘেষে (অর্থাৎ হামাগুড়ি দেয়) তমোও মাগির তলপ্যাট উচা। অর্থাৎ আরেকটি আপতপ্রায়। প্রশ্নকর্তা অতিরিক্ত প্রশ্ন করলে, বলতেন, দ্যাহ, ঘরের বউ খালি প্যাডে ঘুরইয়া বেড়াইবে হেয়া মুই ভালো ঠেহি না। অতএব, এ ক্ষেত্রে তদানীন্তন সামাজিক মানসিকতা বিশ্লেষণের অপেক্ষা রাখে না।

সকল অধ্যায়

১. বিষাদবৃক্ষ – ১
২. বিষাদবৃক্ষ – ২
৩. বিষাদবৃক্ষ – ৩
৪. বিষাদবৃক্ষ – ৪
৫. বিষাদবৃক্ষ – ৫
৬. বিষাদবৃক্ষ – ৬
৭. বিষাদবৃক্ষ – ৭
৮. বিষাদবৃক্ষ – ৮
৯. বিষাদবৃক্ষ – ৯
১০. বিষাদবৃক্ষ – ১০
১১. বিষাদবৃক্ষ – ১১
১২. বিষাদবৃক্ষ – ১২
১৩. বিষাদবৃক্ষ – ১৩
১৪. বিষাদবৃক্ষ – ১৪
১৫. বিষাদবৃক্ষ – ১৫
১৬. বিষাদবৃক্ষ – ১৬
১৭. বিষাদবৃক্ষ – ১৭
১৮. বিষাদবৃক্ষ – ১৮
১৯. বিষাদবৃক্ষ – ১৯
২০. বিষাদবৃক্ষ – ২০
২১. বিষাদবৃক্ষ – ২১
২২. বিষাদবৃক্ষ – ২২
২৩. বিষাদবৃক্ষ – ২৩
২৪. বিষাদবৃক্ষ – ২৪
২৫. বিষাদবৃক্ষ – ২৫
২৬. বিষাদবৃক্ষ – ২৬
২৭. বিষাদবৃক্ষ – ২৭
২৮. বিষাদবৃক্ষ – ২৮
২৯. বিষাদবৃক্ষ – ২৯
৩০. বিষাদবৃক্ষ – ৩০
৩১. বিষাদবৃক্ষ – ৩১
৩২. বিষাদবৃক্ষ – ৩২
৩৩. বিষাদবৃক্ষ – ৩৩
৩৪. বিষাদবৃক্ষ – ৩৪
৩৫. বিষাদবৃক্ষ – ৩৫
৩৬. বিষাদবৃক্ষ – ৩৬
৩৭. বিষাদবৃক্ষ – ৩৭
৩৮. বিষাদবৃক্ষ – ৩৮
৩৯. বিষাদবৃক্ষ – ৩৯
৪০. বিষাদবৃক্ষ – ৪০
৪১. বিষাদবৃক্ষ – ৪১
৪২. বিষাদবৃক্ষ – ৪২
৪৩. বিষাদবৃক্ষ – ৪৩
৪৪. বিষাদবৃক্ষ – ৪৪
৪৫. বিষাদবৃক্ষ – ৪৫
৪৬. বিষাদবৃক্ষ – ৪৬

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন