বিষাদবৃক্ষ – ১৭

মিহির সেনগুপ্ত

সতেরো

আমাদের বাড়ির নির্মাণ, তার গেরস্থালির সৌষ্ঠব, সৌকর্য, যেমন আস্তে আস্তে গড়ে উঠেছিল এক সুদীর্ঘ সময় ধরে, তার বিলয়ও তেমনই এক মন্দাক্রান্তা ছন্দ ধরেই হচ্ছিল। আর এর সঙ্গেই পিছারার খালের আশপাশের উত্থান এবং বিলয় যেন এক নির্ধারিত ক্রমে ঘটছিল। আমাদের গেরস্থালির ব্যাপকতার জন্য তার স্থায়িত্ব শেষ হয়েও যেন শেষ হচ্ছিল না, বাকি পরিবারগুলোর ব্যাপকতা ওই মাপের ছিল না বলে তাদের শেষ হয়ে যাওয়াটা চটজলদি নজরে পড়ছিল।

আমরা আমাদের প্রাচীন অবস্থান থেকে একটু একটু করে খসে পড়ছিলাম এবং দুর্ভিক্ষ-পরবর্তীকালে বাড়ির তাবৎ আভিজাত্যের সেই সময়কার খোলসটুকুও পরিত্যাগ করে একদিকে এক ধ্বংসের গহ্বর, অন্যদিকে পিছারার খালের ক্ষীণ সোঁতাটুকুই শুধু অবলম্বনীয় হয়ে দাঁড়াল। হয় ওই ধ্বংসের গহ্বরে আমাকে আমার অনুজ-অনুজাদের নিয়ে বিলীন হতে হবে, অথবা পিছারার খালের ওই অবশিষ্ট ক্ষীণ ধারাটি আশ্রয় করে বড় খালে এবং তারপর আরও বড় খাল বা নদীকে অবলম্বন করতে হবে। ওই ক্ষীণ সোঁতাটুকুই আমাকে যেন তখন হাতছানি দিল নতুন এক নির্মাণের দিকে। বাবার অবস্থা তখনও ভবভূতির অনুভূতিতে আচ্ছন্ন —’যদুপতে কাঃ সা মথুরাপুরী? রঘুপতে কাঃ গতোত্তরা কোশলা’ এবং তাদের পক্ষে সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমি তো তখন কিশোর, আমার তো সেই অনুভূতি বা নৈরাশ্য আশ্রয় করে বসে থাকলে চলবে না। তাই পিছারার খালের সোঁতাকেই অবলম্বন করলাম। এই সোঁতাই একসময় বড় খালের আপেক্ষিক বৃহৎ বিশ্বে আমাকে পৌঁছে দিল। তারপর একসময় সেই বড় খালটি সামনের এক নদীতে আমাকে পৌঁছে দিল, বড় খালটাও পিছারার খাল হয়ে গেল এবং এই ক্রমতা চলতেই থাকল। তবে বড় খাল থেকে সামনের ওই প্রায় স্বপ্নের নদীতে পৌঁছোতে আমার বেশ কয়েক বছর স্রোতের প্রতিকূলে সাঁতার কাটতে হয়েছিল। এখন ওই পিছারার সোঁতা ধরে বড় খালে পৌঁছানোর গল্পই বলি।

পিছারার খালটি যেখানে বড় খালে গিয়ে মিশেছে, তার উলটোপারের ছৈলাগাছের ঝোপটি পেরোলেই ছিল আমার দাদিআম্মার বাড়ি। জাওলা বা কাউফ্লা আর সুপারিগাছের ঘন বুনোটের আক্রর ফাঁক দিয়ে গোলপাতার ছাউনি আর হোগোলের বেড়ার যে কুটিরটি আমরা বড় খালে চিংড়িমাছ হাতড়ে বেড়াবার সময় দেখতাম, সেটিই ছিল দাদিআম্মার ঘর। তখন এ রকম চিংড়ি হাতড়ে বেড়ানোর সময়ই একদিন তাঁর সঙ্গে আমার দেখো হয়ে গেল। আমরা বড় খালের এবং পিছারার খালের দুকূলের হিন্দু-মুসলমান ছেলেরা ভাদ্র-আশ্বিনের জলে ডুব দিয়ে দিয়ে চিংড়িমাছ ধরতাম। দাদিআম্মা তখন ওই ছৈলাগাছের ঝুপড়িতে দাঁড়িয়ে ‘ছাবি’ দিয়ে চিংড়ি বা কুচোকাচা মাছ ধরতেন। সাদা ধবধবে চুল, পরিষ্কার সাদা নরুণপাড় কাপড় পরা, বেশ উজ্জ্বল গায়ের রং এবং অসামান্য অভিজাত চেহারার এই মহিলাকে আমরা রোজই দেখতাম। তাঁর চেহারার সঙ্গে ছাবি নিয়ে মাছ ধরার ব্যাপারটির একটা বিরোধ আমার নজরে পড়েছিল। চিংড়িমাছ ধরার কৌশল বিষয়ে আমি আদৌ দক্ষ ছিলাম না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা হাতড়ে হাতড়ে অন্য সাথিরা যখন তাদের কোঁচড় ভরিয়ে ফেলত, আমার কোঁচড়ে তখন প্রায় কিছুই থাকত না। এ ব্যাপারে যে একটা সূক্ষ্ম কৌশল আছে, তা আমি জানতামই না। সাথিরা সবাই তা জানত এবং এ কারণে আমাকে তারা বড়ই করুণা করত। তারা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করত, অরা কি এসব পারে? না এয়া অরগো কাম? অরা তো বড় ঘরের ছাওয়াল। এবং এর সঙ্গে ওদের একটা আহাভাবও থাকত, যা আমাকে নিয়ত বিদ্ধ করত যেন। ভাবতাম, আমি কেন ওদের মতো ঘরে জন্মাইনি? আমি কেন ওদের মতো এইসব কাজের অন্ধিসন্ধি জানি না? আমি কেন ওদের থেকে আলাদা? আমি এত অপদার্থ কেন?

এ রকম সময় একদিন, বেলা তখন প্রায় ঢলে পড়ছে। সাথিরা অনেকটাই আমাকে ফেলে এগিয়ে গেছে, ছৈলাগাছের গূঢ়স্থান থেকে দাদিআম্মা আমায় ডাকলেন। এর আগে তাঁর সঙ্গে পরিচয় বা বাক্যালাপ কোনো দিন হয়নি। তাঁকে ওখানে দেখতাম এই পর্যন্ত। ওই দিন একলা পড়ে গিয়েছি বলেই তিনি বোধহয় ডেকেছিলেন। জিজ্ঞেস করলেন,

: কিছু ধরতে পারছ?

: না, এট্টাও পাই না। আমি ঠিক পারি না।

: ক্যান, পারো না ক্যান?

: কায়দাটাই বোজতে পারি না। ধরতে যাই, ফটফট বেবাক সরইয়া যায়। আমি খালি হাতড়াই।

: খালি হাতড়াইয়া লাভ আছে? থাহ কোতায়? কোন বাড়ির পোলা?

পরিচয় দিতে বুড়ির হাত থেকে হঠাৎ ছাবির দড়িটি খসে যায়। ‘ছাবি হঠাৎ-স্বাধীনতায় খালের ঘোলা জলে আস্তে আস্তে তলিয়ে যায়। তিনি শুধু একটা চাপা আর্তনাদ করে ওঠেন—’হায় আল্লাহ’! তাঁর এমতো আচরণের কারণ বুঝতে পেরেও আমি মাছ হাতড়ানোর কাজ বন্ধ করি না। কেননা এ রকম হুতাশ পিছারার খাল অতিক্রম করার সময়ে অনেক শুনেছি এবং বড় খালে পৌঁছনোর তাগিদে সব ঝেড়ে ফেলে দিয়েছি। বুড়ি যেন হঠাৎ এক প্রগাঢ় আবির্ভাবে, কোনো প্রাচীন আভিজাত্যে মূর্ত হয়ে উঠে আমাকে হুকুম করেন-

: উডইয়া আয়। তোর লগে মোর বাত আছে।

: কী বাত?

: আগে উডইয়া আয়, কমু হ্যানে।—আমার উঠে না আসার ক্ষমতা থাকে না যেন। সিক্তবসন আমি তাঁর পেছনে পেছনে জাওলা, সুপারি, কলাগাছের ঘেরাটোপের আড়ালের সেই গোলপাতার কুটিরে পৌঁছোই।

দাদি পেছনে তাকান না। সোজা ঘরের অভ্যন্তরে গিয়ে একটি গামছা আর লুঙ্গি নিয়ে বেরিয়ে এসে বলেন, গা, হাত, পা মোছ আর এই লুঙ্গিডা পর। মুই আইতে আছি। সামনের দলুজে একটি মোটা পাটি পেতে সেখানে বিশ্রাম করার ইঙ্গিত দিয়ে বুড়ি ভিতরে চলে গেলেন। আমি তার আদেশমতো সব করে পাটির ওপর বসলাম। বুড়িপিসিমা, নগেনজেঠিমাদের পর এ রকম আভিজাত্যপূর্ণ আদেশ এই বয়সি কোনো মহিলার কাছ থেকে পাইনি বলে, এ আমার বেশ লাগল। মন্ত্রমুগ্ধের মতো আমি তাঁর প্রতিটি নির্দেশের রণন যেন শরীরের সমস্ত কোষে অনুভব করলাম। আমার অসম্ভব ভালো লাগছিল। তখন আশ্বিনের শুরু। কিন্তু আকাশে একফোঁটাও মেঘ ছিল না। বুড়ির উঠোনে তাঁর পোষা রাওয়া আর মুরগিগুলো অকাতরে স্বাভাবিক অসভ্যতা করে বেড়াচ্ছিল। তাঁর নাতিনাতনিরা একেকজন এসে আমাকে দেখে যাচ্ছিল এবং তখন জীবন বড়ই মোহময় হয়ে খুবই করুণ এবং তাচ্ছিল্যের চোখে আমার পেছনে ফেলে আসা অট্টালিকাপ্রতিম বাড়িটার শীর্ষ কার্নিসটা তির্যক দৃষ্টিতে দেখছিল। তখন বুড়ি একখানা প্রাচীন তামার রেকাবিতে কিছু মিষ্টান্ন, দেশজ কিছু কাটা ফল এবং একটা কাঁসার গেলাসে এক গেলাস ডাবের জল নিয়ে এসে বললেন—এগুলা খাও। এ খাবার খাইলে য়িন্দুগো জাইত যায় না। মুই জানি। আমার পেটে তখন অনন্ত বুভুক্ষা। আমি গোগ্রাসে সবই খেলাম। বুড়ি বললেন, এহন খানিকক্ষণ জিরাও, বেলা পড়লে বাড়ি যাবা হ্যানে। আমি শুধোই, কী য্যানো কতা আছে কইছেলেন হেয়া তো কইলেন না? তিনি বললেন, কমু, তয় আইজ নয়। হায় আল্লাহ! মাইনষের ভাইগ্যে তুমি যে কী লেইখ্যা রাহো, হেয়ানি মাইনষে বোজতে পারে?—আমি তাঁর আচরণের সংগতি খুঁজে পাচ্ছিলাম না। এ কথা সত্য যে, এইসব মানুষের কাছে আমি যে-বাড়ির ছেলে তার এইভাবে প্রকাশ এক আশ্চর্যের ব্যাপার। তারা কখনো এ ঘটনাগুলো স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেন না। কিন্তু ওই বুড়ি ও রকম এক আভিজাত্যে হঠাৎ কেমন করে পৌঁছে গিয়ে আমাকে ওভাবে আদেশ করতে পারেন। এ ধন্দ ওই বয়সেও আমার মধ্যে ছিল। সে যাই হোক, এই বুড়ি অতঃপর আমার দাদিআম্মা হলেন এবং তাঁর সঙ্গে এক প্রগাঢ় আত্মীয়তায় আমি বাঁধা পড়লাম।

এরপর থেকে যখনই ওই ছৈলাগাছের শেকড়ের কাছটিতে পৌঁছতাম তখনই দাদিআম্মাকে দেখতাম ছাবি নিয়ে ঘুষা ধরার কৌশল করছেন। ছাবি হচ্ছে ছোট মাছ ধরার এক ধরনের অবলম্ব। একটুকরো বর্গাকৃতি ন্যাকড়ার ফালিকে দুটি বাঁশের কঞ্চি বেঁকিয়ে একটা বড় মুখ থলির মতো করা হয়। বাঁশের কঞ্চি দুটি একটা যোগচিহ্নের ধনুক যেন। ন্যাকড়ার মাঝখানে থাকে ‘গাঙের’ একদলা মাটি আর তার ওপরে ছড়িয়ে দেয়া হয় কিছু তুষ বা কুঁড়ো। কঞ্চি দু’টির সন্ধিতে একটি রশি বেঁধে তাকে জলে ডুবিয়ে রাখতে হয়। এ কাজে মেয়েরাই সাধারণত দক্ষ। ওই তুষকুঁড়োর লোভে ঘুষা চিংড়ি এবং ছোট ছোট নানান মাছ ওই ছাবির মধ্যে এসে জড়ো হয়। তখন আস্তে আস্তে রশিটি গুটিয়ে তুলে এনে মাছগুলো সংগ্রহ করা হয়। এই হচ্ছে ছাবির কৃৎকৌশল। সে যা হোক, দাদিআম্মার সঙ্গে সম্পর্ক হওয়ার পর ওই ছৈলাগাছের আশপাশে আমার হাতড়ানো অসম্ভব বেড়ে গেল। সাথিরা যখন হাতড়াতে হাতড়াতে দৃষ্টির বাইরে চলে যেত, আমি ওই স্থান থেকে যেন বেরোতেই পারতাম না। সবসময় দাদিআম্মা ওখানে থাকতেন না বলেই এমনটি হতো। বুড়ি নিজেও আমার এই খেলাটি বুঝে থাকবেন। তিনি এসেই আদেশ করতেন—উডইয়া আয়, ঘরে চল। আমি তাঁর এই আদেশের বশংবদতা স্বীকার করে নিয়েছিলাম। এসব স্মৃতি এখন বা বহুকাল ধরেই যেন হাঁসের ডিমের কুসুমের মতো লালচে হলুদ রং হয়ে বা স্বপ্নের জ্যোৎস্নার মতো এক অশরীরী নাজুক বিহ্বলতায় আমার শরীর মন তথা গোটা অস্তিত্বকে সারা জীবন জড়িয়ে থাকল। এই সম্পর্কে এখনও আমার প্রাণের মধ্যে অনুভূতির স্তরে স্তরে এক বেদনার মতো দোলন দিয়ে যায়। এ কারণেই এই আধপোড়া প্রৌঢ়ান্তকালেও ওই কুসুম লাল হলুদ রংটির আভাস ধরেই পথ হাঁটি। সেই সময়টিতেও এ রকমই পথ অতিক্রম আমার নিয়ত দেখা স্বপ্নের মতোই অনিবার্য ছিল। সেই পথের প্রান্তে এক সমুদ্রতীরে অনন্তকালীন মানুষ, যাদের নাম উদ্বাস্তু, তারা যেন মুসার অনুগামীদের মতো ভিড় করে দাঁড়িয়ে থাকে একটা অলৌকিকতার অপেক্ষায়। যে অলৌকিকতা তাদের এক নিরাপদ উপকূলে পৌঁছে দেবে এবং তারা লাভ করবে এক সুস্থিত ভূখণ্ড, এই বিশ্বাসে। কিন্তু হায়। কোনো দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নবি কখনোই তার অলৌকিক দণ্ডটি নিয়ে আমার অথবা অপেক্ষমাণ ওই উদ্বাস্তুদের সামনে এসে দাঁড়ান না। সামনের সমুদ্র ফুঁসতেই থাকে আর পেছনে যেন ফেরাউনের সৈন্যদের কোলাহল ক্রমশ নিকটবর্তী হয়।

দাদিআম্মা বলতেন, বোজলা কিনা আমরা বাঙালিরা আসলেই টেপ্‌পোনা। ভাসইয়া বেড়ানোই মোরগো নসিব। হে কারণে দ্যাহ মুই ভাসতে ভাসতে এই বড় খালধারে এট্টু মাডি পাইলাম। এহানে মোর এট্টু শেহড় গজাইলে। তয় এ শেহড়ও থাকপে না। যদি জিগাও, ক্যান? তো মোর ধারে হ্যার জবাব আছে পুরা একখান কেতাব। তো হে কেতাব ল্যাহা ছাপা নাই, থাকেও না। হে কেতাব কেরমশ বাড়তেই থাহে—যদি তুমি বেয়াক পরনকতার কতাগুলা তোমার পোলারে দেও, তোমার পোলায় যদি হ্যার পোলারে দে, হেই পোলায় যদি হের আওলাদগো দিতে দিতে আউগ্‌গায়। কিন্তু হেয়া তো অয়না শেহড় যহন ছেড়ে তহন পরনকতাও আস্তে আস্তে হুগাইতে থাহে আর এই আলেহা পুথির গতর অয় দুবলা। তহন হেয়ার মইদ্যে হক কতা থাহে না কিচ্ছু—খালি ঝুডা কতা, মিছা কতার আপ্যাচলা প্যানাই থাহে।

এ রকম বিন্যাসে দাদিআম্মার কথন। বুড়িপিসিমাদের ব্রতকথার কিলিকিলি বাওনজির গল্পের, তাদের স্বপ্ন দেখার এবং স্বপ্ন নষ্ট হওয়ার এক অলিখিত প্রতিবিনির্মাণ পাই যেন দাদিআম্মার কথনে। বুড়ির তহজিব তমুদ্দুন বড় গভীরে প্রোথিত। দাদিআম্মার মানসজগৎ আমার বুড়িপিসিমাদের আচরিত ব্রতপার্বণের তথা আকাঙ্ক্ষার জগৎ থেকে যেন অনেক প্রগাঢ়। কিন্তু উভয়ক্ষেত্রেই একটা মিল সেখানে আমি পাই।

দাদিআম্মা পিছারার খালের ইতিপূর্বের যাপিত জীবনের শূন্যতা অনেকটাই ভরাট করে এক নতুন চরৈবেতির উপত্যকায় যেন পৌঁছে দেন। আমার জীবন এভাবে ক্রমশ এক নতুন সার্থকতার আনন্দ উপভোগে অর্থময় হয়। পিছারার খালের দুপারের শূন্যতা বড় খালের ধারের সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের ঘনবসতির জমজমাটে যেন এক অন্য উষ্ণতা পেতে শুরু করে। পিছারার খালের আশপাশ-গ্রামের শূন্য হওনে আমার যে মানসিক অবসাদ শুরু হয়ে আমাকে এক নিঃসীম নিঃসঙ্গতার প্রান্তরে পৌঁছে দিয়েছিল সেই নিঃসঙ্গতা ক্রমশ দূর হয়ে আমাকে দাদিআম্মার জগতের স্বজনে স্থাপিত করে পিছারার খালের বিশ্বের নির্জনতা ভুলিয়ে দিল। আমাদের গোটা সমাজে যদি এই অবাধবহুতা বহুকাল আগেই শুরু হয়। হায়!

আমার ঘুষা চিংড়ি ধরার কৌশল তখন প্রায় শেষ। দাদিআম্মার বাড়িতে তখন প্রায় প্রত্যহই আমার ফলারের আয়োজন মজুত থাকে। ছৈলাগাছের আনাচকানাচে পৌঁছলেই উডইয়া আয় এই ডাক শুনি। নিয়মিতভাবে আমিও উডইয়া যাই তাঁর পেছন ধরে। আমার সঙ্গে আরও বেশ কয়েকটি পোলাপান থাকে, তাদের কেউ হিন্দু, কেউ মুসলমান। আমরা হিন্দুরা তাদের বলি, শ্যাখ। দাদিআম্মার আপ্যায়নে শ্যাখ-হিন্দুর তফাত থাকে না। সবার পাতেই তার ফলারের সামগ্রী পড়ে। এমতো সময় একদিন দাদি জিজ্ঞেস করেন, হারাদিন থাকবি তো? বললাম, হুঁ।

: খাবি কী?

: যা দেবা।

: পাহানইয়া না আপাহানইয়া? বলে বুড়ি মুচকি হাসেন।

: যেমন তোমার দেল চায়। আমার কোনো আফইত্য নাই।

: তয় আইজ পাহানইয়াই খা। কিন্তু এ কতা পাচ কান করিস না? পাচ কান অইলেই জাইত যায়। না অইলে যায় না। আসলে মোরগো কোনো জাইত নাই। না মুই শরিয়তি মোমেন মোছলমানের বেওয়া, না তুই নিয়মের য়িন্দু। মোরগো হিসাব কিতাব বেয়াক আলাক।

: হেয়া কেমন? এ প্রশ্নের উত্তরে বুড়ি এক পরণকথা বলে। সে পরণকথা তার প্রাচীন হৃদয়ের গভীরে ছিল এতকাল, যেন বহু-বহুকাল ধরে, যা এখন কথনে গতি পায়। সে পরণকথা এখন আমাদেরকে এক প্রদোষকালীন প্রাকৃত অবস্থার সারবত্তাকে অবলম্বন করতে বলে। অথবা দাদিআম্মা, তার দলুজে বসা আমাদের কচিকাচার দঙ্গল, সামনের বয়ে যাওয়া খাল, হিজল, ছৈলা, কাউয়া, সুপারি আর কলাগাছের সারি, দূরের জাহাজঘাটা, নদী, আশ্বিনের অহরাহ্ণের অলস কাঁচা হলুদ রোদ্দুর আর ওই আবেষ্টনীর ফাঁক থেকে উঁকি মারা চৌধুরীদের সিং-দরজায় জোড়া সিংহ, ভগ্ন দেউলের চূড়া, সবই যেন এক প্রাকৃত প্রদোষের প্রদর্শনী হয়। ছবি হয় যেন। তারপর দাদিআম্মা সেই ছবিতে কথা কিংবদন্তির শব্দ বুনোট করে আরও গভীর গহন এক প্রাকৃতের ইতিকথার পরণকথার ঝাঁপি নিয়ে বসেন এবং বলতে থাকেন, তয় শোন। কিন্তু অতীব আশ্চর্যময় এক অনুভবে আজও ভাবি, আমাদের সেই শ্রোতামহলের মধ্যে দেশের তৎকালীন বিভেদের বাষ্প কিছুমাত্র প্রভাব বিস্তার লাভ করত না তখন। কোনো হিংসার স্ফুলিঙ্গ ওই সবুজ বনে কোনো কোমল পত্রিকার ওপর এসে পড়ে কোনো দগ্ধতার ক্ষত সৃষ্টি করেনি। ইতিপূর্বে কথনের তাবৎ তিক্ততার অভিজ্ঞতা ভুলে আমরা বড় খালের উজান বেয়ে চিংড়ি মাছ ধরার এক অনুপম কামারাদারি এবং দাদিআম্মার পরণকথার বুনোটে দিব্য একটি একক সত্তায় পরিণত হলাম যেন। দাদিআম্মার পরণকথায় এক মহামিলনের সূত্র ছিল হয়তো। তিনি বড় সুন্দর এবং স্বাভাবিকতায় সেই পরণকথা বলতেন যা ইতিপূর্বের বলা বুড়িপিসিমাদের ব্রতকথার থেকেও গাঢ় এবং মহিমান্বিত

চন্দ্রদ্বীপ নরেশ রায় রামচন্দ্র দেব, যিনি কৌলিক পরিচয়ে রামচন্দ্র বসু। তাঁর পুত্র কীর্তিনারায়ণ ঢাকায় মুসলমান নবাবের যাবনী খাদ্যের ঘ্রাণ গ্রহণে নাকি জাতিচ্যুত, সমাজচ্যুত হন। ইতিহাসকথন এই যে, মহাশয় একজন দীর্ঘ দেহকাণ্ডের অধিকারী অসামান্য বল্লম এবং তলোয়ারবাজ যোদ্ধা ছিলেন। সপ্তদশ শতকের পর্তুগিজ হার্মাদ এবং মগদের দৌরাত্ম্যকালে তিনি চন্দ্রদ্বীপ লেঠেলদের সাহচর্যে এইসব হার্মাদ, মগদের সঙ্গে যুদ্ধ করে এক অসামান্য সামরিক কীর্তির অধিকারী হলে নবাব খাতির করে তাঁকে তার ঢাকাস্থ শিবিরে আপ্যায়ন করেন। তখন নাকি যাবনিক খাদ্যের ঘ্রাণ গ্রহণ করার জন্য তিনি জাতি এবং সমাজচ্যুত হন। কিংবদন্তিটির অন্য রূপও আছে। মহাশয় নাকি এক যবনীর রূপে আকৃষ্ট হন। সেই যবনী কীর্তিনারায়ণের হৃদয়মন জয় করেছিল বলেই নাকি তিনি জাতি এবং সমাজ ত্যাগ করেন। ফলত তাঁকে সিংহাসন হতেও বঞ্চিত হতে হয়। এই ঘটনা নিয়ে জ্ঞাতিবিরোধ তুঙ্গে উঠলে মহাশয় প্রথমে মাধবপাশার বাদলা গ্রামে বসবাস শুরু করেন, পরে সেখানেও টিকতে না পেরে আমাদের গ্রামের সীমান্তে একটি স্থানে তাঁর বসতি হয়। তবে নবাবের সহায়তা থাকার জন্য তিনি তার প্রাপ্য ভূসম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হন না। যদিও সিংহাসন তাঁকে ত্যাগ করতেই হয়। কীর্তিনারায়ণ মগ, পর্তুগিজদের সঙ্গে সংগ্রামেই নিহত হন। আমাদের গ্রামের সীমান্তেই তাঁর এবং তাঁর প্রিয় ঘোড়াটিকে সমাধিস্থ করা হয়, এমন লোকশ্রুতি। কীর্তিনারায়ণ কোনো ইসলামি নাম গ্রহণ করেননি। জনশ্রুতি এই যে, তিনি হিন্দু এবং মুসলমান উভয় ধর্মের আচারই পালন করতেন।

এখন এই পরণকথা শোনাবার পর দাদিআম্মার দাবি যে, তিনি ওই কীর্তিনারায়ণের বংশজা। কীর্তিনারায়ণ ইসলামি নাম না নিলেও তার পুত্র মামুদ হাসান নাম গ্রহণ করে পিতৃকুলনাম পরিত্যাগ করেছিলেন। কিন্তু তৎসত্ত্বেও এই পরিবার হিন্দুয়ানিকে সম্পূর্ণ ত্যাগ কোনো দিনই করতে পারেনি। কীর্তিনারায়ণ থেকে পঞ্চম পুরুষে এসেও যখন তাদের ইসলামিকরণ সম্পূর্ণ হয় না তখন তাঁরা তাঁদের ইসলামি নামের সঙ্গে ‘বাকলাই’ উপাধিটি ব্যবহার করতে থাকেন এবং অদ্যাবধি তা চালু আছে। এই পরিবারের একজন মহিলা, যাঁর নাম ছিল ফুলবানু, তিনি রীতিমতো হিন্দু আচার পালন করতেন এরকম আমরা শুনেছি।

দাদিআম্মা বলেন, তয় বোজো হেই বংশের মাইয়া অইয়া, মুই যদি এই ফাডা ঘরে পড়ইয়া থাকতে পারি, তয় তোমার চিংড়িমাছ হাতড়ানইয়া ব্যাফারডাও তো মানইয়া লওন লাগে। হোনছ কি না জানি না, তয় এই এমন বাহারইয়া গেরাম কীর্তিপাশা, হেয়া কৈলম ওই কীর্তিনারায়ণের নামেই রাহা অইছেলে। বেয়াকই আল্লা মাবুদের মর্জি। হেনায় যা মর্জি করেন, হেয়া ছাড়া তো অইন্য কিছু হওয়া সম্ভব না। আল্লা মেহেরবান।

আমি এই বংশের একজন মানুষকে দেখেছি। তাঁর নাম মজিদ বাকলাই। তিনি এক অদ্ভুত রোগে রুগ্‌ণ। আমাকে বলেছিলেন একদিন, মুই এই বেয়াক জমিন জায়দাদ কিনইয়া লমু। এমনকি তোমাগো বাড়িড়াও।

আমি জানতে চেয়েছিলাম—কেন?

না, এগুলা তা একসময় আমাগোই আছেলে। এ্যার বেয়াক মোর চাই। ট্যাহার চিন্তা নাই। য্যাতো লাগে দিমু হ্যানে।

কীর্তিনারায়ণ এ অঞ্চলে ব্যাপক ভূসম্পত্তির মালিক ছিলেন। তাই বোধহয় তার এরকম আকাঙ্ক্ষা।

.

এ গল্প আরও অনেক দীর্ঘ। হয়তো এসব নিতান্ত গল্পই। দাদিআম্মার কথনে তা প্রায় এক দিনান্তকালেও সমাপ্ত হতে চায় না। যখন তিনি তাঁর কথন শেষ করেন, বুঝতে পারি অকথিত কাহিনি আরও অনেক রয়ে গেছে। এ তো শুধু একটা পরিবারের আখ্যান নয়। এ অ্যাখান আমার এই অঞ্চলের সমাজ গঠনের। হিন্দু এবং মুসলমানের রক্তের মিশ্রণের এক অপূর্ব সমাচার। সেখানে ভেদ-বিভেদের আগুন উভয় সমাজের মাঝখানে লেলিহান হয়ে দাঁড়ায় না। সেখানে শুধু দাদিআম্মারা পরণকথা বলেন আর তাঁদের নপ্তারা শোনে। শোনে আর সমসাময়িক সংঘটন দেখে বিস্মিত হয়ে বিষণ্ন হয়ে ভাবে, তাহলে এরকম কেন হলো? গল্প শেষ হতে হতে দিনের আলো ম্লান হয় কিন্তু আকাশে তারারা তথাপি অতি দূরের হলেও আলোর দীপ্তি নিয়ে ফুটে ওঠে। দূরে কোথায় যেন কোনো এক ঝোপে শেয়াল ডাকে। সন্ধ্যাশেষের জোয়ারের জলের শব্দ শুনি হোগল, ছৈলাগাছের গোড়ায় আছড়ে পড়ার কলোচ্ছ্বাসে। ডিঙি-নৌকোগুলোর বৈঠার ঠকাসঠক শব্দ, তারা গঞ্জের কাজ সেরে ঘরে ফিরছে। সবাই যেন নিরুদ্বেগ ভূখণ্ডে আশ্রয় চায়। জীবন তখন এক নিবিড় স্বপ্নের প্রাকৃত আবরণকে গায়ে জড়িয়ে কীর্তিনারায়ণের ঘোড়ার খুরের শব্দ কান ভরে শোনে। তাঁর হাতের বল্লম আর তলোয়ারে রুপালি ঝিলিক যেন দেখতে পাই, যখন আলপথে নৈশনক্ষত্র দ্যুতিতে ফিরে আসতে থাকি। নিজেদের ভগ্ন প্রাসাদটাকে যেন তখন কীর্তিনারায়ণের দুর্গ বলে মনে হয়, আর আশপাশের উঁচু জমিগুলো তাঁর আর তাঁর ঘোড়ার কবরের মতো।

এরপর একদিন দাদিআম্মা আমাকে ফতোয়া দিলেন, তোর ইস্কুলে পড়ন লাগবে। এহানে এটা ইস্কুল আছে। তুই হেই ইস্কুলে পড়বি। তোর মুরুব্বিগো স্বভাব নষ্ট অইছে, বুদ্ধি ভষ্ট অইছে। হেরা তোরে ইস্কুলে দে নায়। আমি তোর ব্যবস্থা করইয়া দিতাছি খাড়া।

দাদিআম্মার বাড়িতে তাঁর দুটি কিশোর নাতি ও একটি নাতনি ছাড়া কোনো বয়স্ক মানুষ ছিল না। কিছু জমিজায়গা তাঁর ছিল, সে কারণে অন্নাভাব ভোগ করতে হতো না। সচ্ছল না হলেও ওই সময়কার গ্রামীণ মানুষদের চাহিদা অনুযায়ী তাঁরা দিব্য ছিলেন। তাঁর সংসারে চতুর্থ নাতি হিসেবে একসময় আমি প্ৰতিষ্ঠা পাই অবশ্য এ কথা আমার বাড়ির ‘গার্জেনরা’ জানতেন না, জানাবার মতো হিম্মতও আমার হয়নি। কেননা, কোনো মুসলমান বাড়িতে আমি আউশ চালের ফ্যানাভাত বা এটা-ওটা খাই—এ কথা টের পেলে জ্যাঠামশাই হেঁটোয় কণ্টক, ওপরে কণ্টক প্রয়োগে বুনো শেয়ালদের দিয়ে খাওয়াতেন। বাবার কাছ থেকে এ ব্যাপারে ভীতির ততটা সম্ভাবনা ছিল না। তথাপি শ্যাহের ভাত খাওয়া বিষয়ে তিনিও যে খুব একটা ছাপপত্র দিতেন এমন বুঝি না।

দাদিআম্মার নাতনি শিরি ছিল আমার সমবয়সি। তার ভাই দুজনের একজন আট অপরজন দশের কোঠায়। আমরা দুজনে তখন এগারো-বারো বছরের। ও আমাকে ভাইজান বলে ডাকত, আমি বুনডি বলে। ওর এক ফুফাতো ভাই দুলাল ও আমাদের উভয়ের সমবয়সি। দুলাল বয়সে একটু বড় ছিল। ও আমাকে প্রায়ই বলত, ও শিরিকে বড় হয়ে বিয়ে করবে এরকম নাকি কথা আছে। ওদের মধ্যে এরকম বিয়ে হতো।

.

আমরা তিনজনে একদিন দাদিআম্মার দলুজে বসে গল্প করছি। তখন আউশের খন্দ উঠে গেছে। আশ্বিন-কার্তিকের এই সময়টায় সকালে আউশের ফ্যানাভাত, দুপুরে আউশের ভাত আর পানিকচুর তরকারি, আবার রাতেও আউশের ভাত আর খেসারির ডাল ছিল আহার্য। আউশের একটা মিঠে গন্ধ তখন সবারই বাড়ির আশপাশে ছড়িয়ে থাকত। এখনও যেন চোখ বুজলে সেই গন্ধটা টের পাই। টের পাই আউশের চিড়ে, নারকোল কোরা আর গুড় দিয়ে মাখানো সেই দ্রব্যটির স্বাদ ও গন্ধ।

শিরি বলছিল, ভাইজান, কাইলকা তোমার এহানে পাহানইয়া নাস্তা খাওন লাগবে। দুলাল বলেছিল, খা না একদিন, বেয়াকে একলগে খাইয়া দেহি তোর জাত ক্যামনে যায়। মনের মধ্যে ততদিনে জাতের নির্বোধ জানোয়ারটা অনেকটাই কমজোরি। তা ছাড়া ওরা জানে না যে ইতোমধ্যে আমি পাহানইয়া খাবার খেয়ে বসে আছি। দাদিআম্মা সে কথা ওদের বলেননি। নাস্তা না জলখাবার তখন আমাদের বাড়িতে হতো না। সংস্থান ছিল না। অভাব তখন আষ্টেপৃষ্টে। অতএব আমন্ত্রিত হয়েও পেটে বুভুক্ষা পুষে রাখার মতো জাতিঅন্ত প্রাণ হতে পারিনি। আবার জাত কীভাবে যায় সেটা দেখার কৌতূহলও একেবারে ছিল না তা নয়। অতএব পরদিন ভোর-সবেরে দাদিআম্মার বাড়ি পৌঁছোই। আমাদের তিনজনের চক্রান্তের কথা দাদিআম্মা জানতেন না। তিনি জিজ্ঞেস করলেন —

: অ্যাতো বেনইয়া কালে আইলি যে? বেয়াকে আছে তো ভালো?

: হ ভালো আছে। আইলাম। তুমি আইজ নাস্তায় পাহাবা কী?

: ক্যান? তুই খাবি?

: হ, আমি ঠিক করছি আইজ এহানে নাস্তা খামু। পাহানইয়া নাস্তা—আউশ চাউলের ফ্যানাভাত বুইনডিগো লগে।

: ক্যান?

: বুনডিরা আমারে দাওয়াত দিছে। অরা দ্যাখতে চায় জাত ক্যামনে যায়। আমি যে আগেই তোমার ধারে পাহানইয়া খাওয়া খাইছি হেয়া ওরা জানে না।

দাদিআম্মা সব শুনে হেসে কুটিপাটি। তক্ষুনি কোমর বেঁধে নাস্তা বানাতে লেগে গেলেন। বড় বাহারের নাস্তা বানিয়েছিলেন তিনি সেদিন। পায়েলইয়া মরিচ ঘুষা চিংড়ি আর নারকোল একসঙ্গে বেটে তার বড়া আর আউশের ফ্যানাভাত। সে স্বাদ বোধহয় মরার আগের দিন পর্যন্ত থাকবে। আমরা পাঁচজনে পাশাপাশি বসে হাপুসহুপুস করে খেলাম। কিন্তু জাইত যে কোনহান দিয়া গেল টের পাইলাম না। এরপর থেকে প্রায়ই ওখানে খেতাম।

কিন্তু আজও যে গ্লানি অন্তরে বহন করি তা হলো এই যে, আমি কোনো দিনই দুলাল, শিরি বা তাদের ভাইদের নিয়ে আমার বাড়িতে গল্পও করতে পারিনি, একসঙ্গে বসে পাহানইয়া বা আপাহানইয়া কোনো খাদ্যও গ্রহণ করতে পারিনি। এর কারণ ছিল দুটি। একটি হচ্ছে বাড়িতে কোনো বন্ধুকে নেমন্তন্ন করে খাওয়ানোর মতো স্বাধীনতা আমার ছিল না। আরেকটি হলো, তাদের খাওয়ানোর মতো সামান্যতম আর্থিক সংগতিও আমাদের ছিল না। এ কারণে আজও এক গভীর বেদনাবোধ এবং গ্লানি উপলব্ধি করি। এ ব্যাপারে জাতের ব্যাপারটি যে একেবারে ছিল না, তা বলি না। তবে সেটাই সবচেয়ে বড় বাধা ছিল না। ওরা অবশ্য তখন ব্যাপারটাকে জাতিগত সমস্যা বলেই মনে করত।

দাদিআম্মা তাঁর যুগের তুলনায় অনেক আধুনিকমনস্ক। তাঁর মতো উদার মানসিকতাসম্পন্ন মহিলা খুব কমই দেখেছি। বোরখা-টোরখার বালাই তাঁর ছিল না। তাঁর ঘর-গেরস্থালি ছিল অদ্ভুত পরিচ্ছন্ন। দলজে উঠলেই তা বোঝা যেত।

পরিণত বয়সে শিরি আর দুলালের ঢাকার বাসায় দীর্ঘকাল বাদে গিয়েছি। তারা অনেক লেখাপড়া করে শহরের আধুনিক মানুষ হয়েছে। পরবর্তীকালে ওরা সত্যিই বিয়ে করেছিল। আমরা ছোটবেলার অনেক স্মৃতি রোমন্থন করে দারুণ আনন্দ করেছিলাম সেবার। কিন্তু একটা জিনিস আমাকে অবাক করে দিয়েছিল। শিরি অসম্ভব ধর্মবাতিকগ্রস্ত হয়েছে দেখলাম। বাইরে যাওয়ার সময় আপাদমস্তক কালো বোরখায় ঢেকে সে বের হয়। দুলাল বলেছিল, ও অসম্ভব মৌলা হয়েছে। আমার কীরকম অবাক লাগছিল। ওরা দুজনেই ভোর রাতে উঠে নামাজ আদায় করে আবার বেলা অবধি ঘুমোয়। শিরির পড়াশোনার বিষয়ও ওই ধর্মীয় ধারায়ই। চমৎকার রেজাল্টও করেছিল। মাঝে মাঝে ইসলামি মহিলাদের জমায়েতে ও ভাষণ দেয়। ওই নিয়েই থাকে। দুলাল আবার বলেছিল, ও খুব মৌলা হয়েছে, জানিস। আমি জানতে চাইছিলাম—আর তুই?

: আমি? আমি সারাদিন ডাক্তারি করি, বাড়ি ফিরে ওর নির্দেশমতো খোদার দরবারে মোনাজাত করি।

: দুটো ব্যাপার মেলাতে পারিস?

: মেলাতে চাওয়ার মতো সময় কোথায়?

আমি বলেছিলাম, তোরা দুজনেই অন্যরকম হয়ে গেছিস। যেন আমি বা আমাদের সম্প্রদায়ের মানুষেরা ছোটবেলায় ওইসব দিনে যেমন চুতমার্গী ছিলাম, তোরা এখন তাই হতে চাচ্ছিস। আমি ঠিক মেলাতে পারছি না।

: মেলাতে চাইছিস কেন?

: দাদিআম্মার কথা মনে পড়ে।

: তিনি কিন্তু খুবই নিষ্ঠাবতী শরিয়তী মহিলা ছিলেন।

: সে অন্যরকম। তাঁরটা বুঝেছিলাম, তোদেরটা বুঝতে পারছি না। দুলাল আমার ধন্দটা বুঝতে পেরেছিল, তবু বলল, তুই এসব ব্যাপার কিছু জানিস?

: কিছু জানি। নামাজ উত্তম ব্যায়াম জানি, ওজু করা স্বাস্থ্যসম্মত শুদ্ধাচার তা জানি। আরও অনেক কিছুই আমি দাদিআম্মার কাছে এবং বড় হয়ে বইপুস্তক পড়ে জেনেছি। কিন্তু দাদিআম্মার ধর্মাচরণ এক, তোদেরটা সম্পূর্ণ আলাদা। আমি ঠিক বোঝাতে পারব না।

এরকম অনেক আলোচনা ঢাকায় বসে ওদের সঙ্গে আমার হয়েছিল। দাদিআম্মার স্মৃতি আমার মন থেকে কোনো দিন মুছে যায়নি। কিন্তু শিরি আর দুলালের বর্তমান যাপিত জীবন, তাদের আনুষ্ঠানিক ধর্মপালনের তীব্রতা, অধুনাকার গণতন্ত্রকামী এবং মানবিক ধর্ম অনুসারী বাংলাদেশি সাধারণ মানুষদের সঙ্গে তাদের আচার-আচরণের অসম্পৃক্তি আমাকে বড় বিমর্ষ করেছিল।

জীবন অনেক দূর পথ অতিক্রম করেও এখনও এক পিছারার খাল খোঁজে যেন। মাথার চুলে সবিতৃচ্ছটা প্রকট, লোলচর্ম, ক্ষীণদৃষ্টি। তথাপি এখনও আমার স্বপ্নের রাস্তা এক ক্ষীণ স্রোতঃস্বিনীর রেখা ধরে ক্রমশ বড় খালের দিকে যেতে চায়। সেই বড় খালের মোহনার এক ছৈলাগাছের গোপন থেকে শুভ্রবস্ত্রা এক রমণী ছবি নিয়ে চিংড়িমাছ ধরে। যখন স্বপ্ন আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে সেখানে পৌঁছায়, সে বলে— উডইয়া আয়, আর কত ভাসবি? দূরে অস্পষ্ট একফালি ম্রিয়মান ডুবন্ত চাঁদের প্রচ্ছায়ায় কীর্তিনারায়ণ আর তাঁর ঘোড়ার কবরের আভাস দেখা যায়, আর একটা ভাঙা অট্টালিকার চূড়া, যেখানে একটা বিদঘুটে নিশাচর প্রহরঘোষক পাখি তীব্র চিৎকার করে ডাকে, যেন বলে–গেল যা গেল যা দুচ্ছাই দুচ্ছাই।

স্বপ্ন স্তিমিত হয়ে ঘুম একটু গাঢ় হলে পৃথিবী আবার যেন ক্রমশ তরুণা হতে থাকে। স্বপ্ন আবার শরীরী হয়ে দুটি কিশোর আর একটি কিশোরীকে অঘ্রানের সন্ধ্যার আলপথে দৌড় করায়। তখন আবার কীর্তিনারায়ণের ঘোড়ার খুরের শব্দ শোনা যায়। আবার দাদিআম্মা আমাদেরকে নিয়ে তার দলুজে পরণকথায় বসেন, বলেন, কীর্তিনারায়ণ তো হেই মগ, হার্মাদেগো লগে কোদাকুদি করতে যাইয়া এন্তেকাল ফরমাইলেন, বোজজোনি? কও, ইন্না লিল্লাহে রাজেউন। আমরাও বলি, ইন্না লিল্লাহে রাজেউন।

সকল অধ্যায়

১. বিষাদবৃক্ষ – ১
২. বিষাদবৃক্ষ – ২
৩. বিষাদবৃক্ষ – ৩
৪. বিষাদবৃক্ষ – ৪
৫. বিষাদবৃক্ষ – ৫
৬. বিষাদবৃক্ষ – ৬
৭. বিষাদবৃক্ষ – ৭
৮. বিষাদবৃক্ষ – ৮
৯. বিষাদবৃক্ষ – ৯
১০. বিষাদবৃক্ষ – ১০
১১. বিষাদবৃক্ষ – ১১
১২. বিষাদবৃক্ষ – ১২
১৩. বিষাদবৃক্ষ – ১৩
১৪. বিষাদবৃক্ষ – ১৪
১৫. বিষাদবৃক্ষ – ১৫
১৬. বিষাদবৃক্ষ – ১৬
১৭. বিষাদবৃক্ষ – ১৭
১৮. বিষাদবৃক্ষ – ১৮
১৯. বিষাদবৃক্ষ – ১৯
২০. বিষাদবৃক্ষ – ২০
২১. বিষাদবৃক্ষ – ২১
২২. বিষাদবৃক্ষ – ২২
২৩. বিষাদবৃক্ষ – ২৩
২৪. বিষাদবৃক্ষ – ২৪
২৫. বিষাদবৃক্ষ – ২৫
২৬. বিষাদবৃক্ষ – ২৬
২৭. বিষাদবৃক্ষ – ২৭
২৮. বিষাদবৃক্ষ – ২৮
২৯. বিষাদবৃক্ষ – ২৯
৩০. বিষাদবৃক্ষ – ৩০
৩১. বিষাদবৃক্ষ – ৩১
৩২. বিষাদবৃক্ষ – ৩২
৩৩. বিষাদবৃক্ষ – ৩৩
৩৪. বিষাদবৃক্ষ – ৩৪
৩৫. বিষাদবৃক্ষ – ৩৫
৩৬. বিষাদবৃক্ষ – ৩৬
৩৭. বিষাদবৃক্ষ – ৩৭
৩৮. বিষাদবৃক্ষ – ৩৮
৩৯. বিষাদবৃক্ষ – ৩৯
৪০. বিষাদবৃক্ষ – ৪০
৪১. বিষাদবৃক্ষ – ৪১
৪২. বিষাদবৃক্ষ – ৪২
৪৩. বিষাদবৃক্ষ – ৪৩
৪৪. বিষাদবৃক্ষ – ৪৪
৪৫. বিষাদবৃক্ষ – ৪৫
৪৬. বিষাদবৃক্ষ – ৪৬

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন