বিষাদবৃক্ষ – ৪৬

মিহির সেনগুপ্ত

ছেচল্লিশ

বাড়ি ফিরে এসে কিছুদিন বড় অবসাদ আর বিষণ্নতার মধ্যে কাটল। কিছুই আর ভালো লাগছিল না। পিছারার খালের জগতে তখন কোনো সঙ্গীসাথিই আর নেই। যাদের কোনো গতিই নেই তারাই শুধু আছে। সে কী ভীষণ নিঃসঙ্গতা এবং নৈরাশ্য! সহপাঠী-সহপাঠিনীদের পরীক্ষা তখনও শেষ হয়নি। তারা হোস্টেলে থেকে পরীক্ষা দিচ্ছে। পরীক্ষার পর বাড়ি আসবে। তখন হয়তো তাদের সাহচর্য পাব। আপাতত আমি নির্বান্ধব, নিষ্কর্মা। বইপত্তর পর্যন্ত নেড়ে দেখতে ইচ্ছে করে না। সবচেয়ে অসহনীয় হলো দুপুরবেলাটা। বাড়ির বিশালকায় থামগুলোর খিলানের খাঁজে জালালি কবুতরগুলো সারা দুপুর হুম হুম করে ডেকে আমার শূন্যতাবোধ যেন আরও বাড়িয়ে দেয়। বুকের মধ্যে সবসময় হু হু করে। প্রকাণ্ড আকারের প্রাচীন ঘরগুলো যেন গিলে খেতে আসে।

বিকেলে খালপারের দিকে একটু ঘুরতে যাই। তখন দু-একজন মুসলমান বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। দু-চারটে কথা বলি। নচেৎ সমস্ত দিনে কথা বলার সুযোগ বা ইচ্ছে হয়ই না। এইসব মুসলমান বন্ধুবান্ধব কেউই পড়াশোনা করার মধ্যে নেই। চাষবাস-গেরস্থালি নিয়েই তাদের জগৎ। একটা সময় যখন আমি স্কুলে যাওয়া শুরু করিনি, তারাই আমার দোসর ছিল। তাদের সাথেই তখন মেলামেশা, খেলাধুলো, গরু-চরানো। কিন্তু মাঝখানের এই স্কুল এবং কলেজজীবন আমাদের পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটা বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আগে তাদের সাহচর্যে যে অনাবিল আনন্দ পেতাম, এখন আর তা পাই না। ব্যাপারটা এরকম না হলেই হয়তো ভালো ছিল। তাহলে অন্তত আমার বৌদ্ধিক অভাববোধটা গড়ে উঠত না। আমিও তাদের মতো সহজসরল জীবনে অভ্যস্ত হয়ে তাদের সঙ্গে একাত্ম থাকতে পারতাম। এখন না ঘরকা, না ঘাটকা।

এইরকম কিছুদিন নিঃঝুম অকর্মা থাকার পর ভাবলাম, যখন কোনো ভবিষ্যৎ-পরিকল্পনা আমার নেই, তখন কিছু রোজগার করার চেষ্টা করি না কেন? স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের পড়িয়ে দুপয়সা রোজগার করতে পারলে সময়ও কাটে, সংসারের উপকারও হয়। কীর্তিপাশা, তারপাশা ইত্যাদি আশপাশের গ্রামের কয়েকজন ছাত্রছাত্রী জুটিয়ে নিলাম। এক ছাত্রের বাড়িতে পড়ানোর বিনিময়ে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে সকাল-সন্ধে ওই কাজ নিয়েই ব্যস্ত থাকলাম। ইতোমধ্যে সহপাঠী-সহপাঠিনীদের পরীক্ষা শেষ হয়ে গিয়েছিল। তারা সব গ্রামে ফিরে এসেছে। মাঝে মাঝেই তাদের কারও কারও বাড়িতে পড়াশোনার আড্ডা জমতে লাগল। কীর্তিপাশা স্কুলের একজন নবীন মাস্টারমশাই এই সময় আমাদের নিয়ে খুব উৎসাহের সঙ্গে আধুনিক বাংলা কবিতার একটি পাঠচক্র গড়ে তোলেন। আমরা তখনও পর্যন্ত ওখানে আধুনিক কবিতা পড়া দূরস্থান, কোনো আধুনিক কবির নামও

বিষাদবৃক্ষ ৩৬১

,

শুনিনি। সাহিত্যের প্রতি ভদ্রলোকের বিলক্ষণ ভালোবাসা ছিল। তিনি প্রায়শই ঢাকা যেতেন এবং সেখান থেকে জীবনানন্দ, বিষ্ণু দে, অজিত দত্ত তথা কল্লোলযুগীয় কবিদের রচনা নিয়ে আসতেন। কবি বলতে আমরা তখনও রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, কায়কোবাদ, সুফিয়া কামাল, জসীমউদ্দীন ইত্যাদিদের জানতাম এবং তাঁদের রচনাই পাঠ করেছি। নতুন আঙ্গিক এবং ভাবধারার কবিদের সঙ্গে আমাদের পরিচয় এই প্রথম। এইসব কবিদের কবিতা এবং তার আলোচনা আমাদের খুব গভীরভাবে নাড়া দিল। আমরা সবাই রাতারাতি কবি হবার চেষ্টা করতে লাগলাম। কিন্তু সে চেষ্টা খুব একটা ফলপ্রসূ হয়নি। আমাদের মধ্যে কেউই কোনো দিন কবি হতে পারেনি।

এইসব নিয়ে যত মাতামাতিই করি না কেন, উদ্দেশ্যহীন জীবনযাপনের গ্লানি এবং বিষণ্নতার হাত থেকে অব্যাহতি পাচ্ছিলাম না। গোটা জীবন সামনে পড়ে রয়েছে। মাথার ওপর বিরাট এক সংসার জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসে আছে। এই দেশে সামান্য শিক্ষাটুকু, যা অর্জন করেছি, তা অবলম্বন করে কোনো দিন আর্থিক সমস্যার অবসান হবে—এরকম সম্ভাবনা আদৌ ছিল না। তাই ছাত্র পড়ানো আর কাব্যচর্চা আমার দুর্ভাবনাকে কিছুমাত্র দূর করতে পারল না। বন্ধুবান্ধবরা আমার বিষয়ে আদৌ উদাসীন ছিল না। তারা প্রায়ই আমাকে কলকাতায় দাদাদের কাছে চলে যাওয়ার পরামর্শ দিত। কিন্তু আমি কিছুতেই মনস্থির করতে পারছিলাম না। সম্পূর্ণ নির্বান্ধব দেশে এতগুলো ভাইবোন এবং মা-বাবাকে অসহায় রেখে যাবার কথা ভাবতে পারছিলাম না। ভারত, পাকিস্তান দুদেশের পারস্পরিক সম্পর্ক দিনদিন আরও খারাপ হচ্ছিল। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে ভারতের তরফ থেকে কোনো অপছন্দের কাজ হলেই তার জন্য সংখ্যালঘুদের ওপর একটা অকারণ রাষ্ট্রীয় এবং সাম্প্রদায়িক চাপ সৃষ্টি হতো। এই ব্যাপারটা ওই প্রত্যন্ত গ্রামসমাজেও আমরা বেশ অনুভব করতাম। কারণে-অকারণে উত্ত্যক্ত করা হতো এবং ফলে আমাদের আতঙ্ক বেড়েই চলত। এমনকি খেলার মাঠে, কোনো যাত্রাপালার আসরে বা সামাজিক মিলনের যে কোনো স্থানেই আমরা এই সময়গুলোতে ভয়ে জুজু হয়ে থাকতাম। কোনোরকম মৌলিক অধিকার বা স্বাধীনতা আমাদের ছিল না।

কিছু পড়াশোনা করার জন্য এবং কিছুদিন শহরের জীবনযাপন করার জন্য আগের চাইতে অনেক বেশি করেই এই সময়টাতে আমি সংখ্যালঘু-জীবনের তিক্ততা আগের চাইতে অনেক বেশিভাবে উপলব্ধি করতে পারছিলাম। একদিকে নিজস্ব সমাজের চূড়ান্ত অবক্ষয়, আর্থিক দৈন্য এবং সাংস্কৃতিক অবনতি, অন্যদিকে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের অবহেলা, অসম্মান এবং চাপা ক্রোধ—এই উভয়প্রকার পরিস্থিতির যাঁতাকলে যতই নিষ্পিষ্ট হচ্ছিলাম, ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ততই হতাশা পেয়ে বসছিল। ক্রমশ এই অবস্থা সহ্যের অতীত হয়ে গেলে একদিন স্থির করলাম বাড়ি ছেড়ে, সবকিছু ছেড়ে চলে যাব। মাকে শুধু জানালাম আমি কিছুদিনের জন্য বরিশাল যাচ্ছি। আসলে আমি বাড়ি থেকে পালিয়ে গেলাম।

এই সময়টিতে বরিশালের দাদার দেয়া পরিচয়পত্রটি আমার বেশ কাজে লেগেছিল। বরিশাল গিয়ে দু-এক দিন এখানে-ওখানে থেকে ঠিক করলাম কিছুদিন লঞ্চে লঞ্চে ঘুরে বেড়াই না কেন? কিছুই তো কাজ নেই। গোটা বরিশাল জেলা নদীময়। কোথাও যেতে হলে জলপথ ছাড়া পথ প্রায় নেই। হাতে টিউশনির মাইনে বাবদ কিছু পয়সা ছিল। দু-একদিন লঞ্চে এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি করে খালাসি, সারেংদের সঙ্গে দিব্য একটা সম্পর্ক হলো। তাদের সঙ্গে এটা-ওটা কাজকর্ম করে দুবেলার খাবার সংস্থানটা করে নিতে পেরেছিলাম। বাড়ি থেকে আসার সময় ঝোলাটার মধ্যে জামাকাপড় এবং খান দু-তিন বইপত্তর নিয়ে এসেছিলাম। একেবারে তোফা ব্যবস্থা। সারাদিন ভেসে বেড়ানো। রাতে লঞ্চেই থাকা-খাওয়া, যেন লঞ্চেই চাকরি করি। খালাসিদের নানারকম কাজ। আবার টিকিট চেকারদেরও কাজ আছে। কয়েক দিনের মধ্যেই খালাসিদের ফাইফরমাস খাটা থেকে টিকিট চেকারদের শাগরেদি করার পদোন্নতিটা হয়ে গেল। এবার সারেং সাহেব নিজের থেকে আমার একটা হাত-খরচি মজুরি ঠিক করে দিলেন। ফলে দিনে দু-পাঁচ টাকা মবলগ রোজগার হতে লাগল। আমাকে আর পায় কে? এ একেবারে রীতিমতো চাকরি। জলে জলে বেড়ানোর একটা আলাদা মজা আছে। মাঝে মাঝে লঞ্চ বদল করি, নতুন গঞ্জ-শহর দেখে বেড়াই। এভাবেই নানা নদীপথ, বন্দর আমার দেখা হয়ে গেল।

কিন্তু জলে বেশি দিন বাস করা ডাঙার মানুষদের ধাতে সয় না। একসময় ডাঙার জন্য প্রাণ আঁকুপাঁকু করে। লঞ্চে দু-একবার গাভা, বানারিপাড়া, স্বরূপকাঠি এসব জায়গায় গিয়েছিলাম। বানারিপাড়া যেতে এক ধরনের বিশালাকায় লম্বা নৌকো দেখেছিলাম। তাতে পঞ্চাশ-একশ যাত্রী যাতায়াত করে। মাঝিরা দাঁড় বেয়ে চালায়। এই নৌকোর নাম গয়নার নৌকো। ইচ্ছে হলো এই নৌকোয় চেপে বরিশালের উত্তর অঞ্চলটা একটু বেড়াব। সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যবিহীন এই ভ্রমণ। পকেটে কিছু পয়সা জমেছে। অতএব চিন্তা নেই। লঞ্চের বন্ধুদের কাছ থেকে কয়েক দিনের জন্য বিদায় নিয়ে দিনকয়েক বড়দার শ্বশুরমশাইয়ের বাসায় থাকলাম। ভাবছিলাম কোথায় যাই। গয়না তো এক ঘাটে নিশ্চয়ই আমাকে পৌঁছে দেবে। সেখানের ঠিকানা কী? গয়না নৌকোটির সর্বশেষ ঘাট বানারিপাড়া। হঠাৎ মনে পড়ল সেখানে আমাদের স্কুলের এক মাস্টারমশাইয়ের কে যেন আত্মীয় থাকে। তাঁর নামটাও জানা ছিল। মাস্টারমশাইয়ের আত্মীয়ের আমার আত্মীয় হতে বাধা নেই। তাই এক সন্ধেয় খাওয়াদাওয়া সেরে গয়নায় উঠে পড়লাম।

এর আগে এ ধরনের নৌকোয় চাপিনি। আট-দশজন দাঁড়ি নৌকোটি চালিয়ে থাকে। গতি যান্ত্রিক জলযানের একান্তই মন্থর। মাথার ছাউনিটি বেশ নিচু। উঠে দাঁড়াবার উপায় নেই। বসে বা শুয়ে যাতায়াত করতে হয়। আজকাল আর এ ধরনের নৌকোর প্রচলন নেই।

গয়নায় শুয়ে ঘুম আসছিল না। দুই প্রান্তে দুটি ম্লান হ্যারিকেন জ্বলছিল। মাঝেমধ্যে আরোহীদের কথাবার্তা, এর সঙ্গেই তাল রেখে দাঁড়ের ছপাৎ ছপ শব্দ। গলুইয়ের ফাঁকটুকু দিয়ে দূরের লক্ষ যোজন আলোকবর্ষ পার হয়ে অজানা নক্ষত্রের দ্যুতি দেখা যাচ্ছে। মাঝে মাঝে কিসসাদার বুড়ো এবং দাঁড়িরা হুঁশিয়ার বলে চিৎকার করে উঠছে। দেশের পরিস্থিতি প্রায় অরাজক। কখন ডাকাতদল এসে চড়াও হবে বলা যায় না। কখনো আবার কিসসাদার বুড়ো দাঁড়িদের এবং যাত্রীদেরও একঘেয়েমি কাটানোর জন্য চড়া গলায় ‘রহিম বাশ্বার কিসসা বা ‘আন্ধা বন্ধুর কথা গান করছে। গলুয়ের কাছে একটি লোক অন্য জলযানকে সতর্ক করার জন্য ডিমডিম শব্দে নাগাড়া টিকাড়া বাজাচ্ছে। সব মিলিয়ে নিজের অস্তিত্বকে কেমন যেন অলীক বলে বোধ হচ্ছিল। শহরজীবনের যে স্বাদ কিছুকালের অভ্যেসের কারণে আমার মধ্যে বাসা বেঁধেছিল, তার তীব্রতা কাটিয়ে কিসসাদার বুড়ার গান, কাহিনি এবং এই প্রায় আদিম মানুষের মতো ভ্রমণ কি আমাকে আবার পেছনের দিকে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে? অথবা আমি আমার শিকড়ের সঙ্গেই আরও ক্রমশ সম্পৃক্ত হচ্ছি? এই নদী, যার বুকের ওপর দিয়ে আমি এখন যাচ্ছি সে কি আমাকে অন্যরূপে জীবনের অন্য কোনো উপকূলে নিয়ে যাবে? সবাই আমাকে এ দেশ ছেড়ে ভাগ্যের সন্ধানে অন্য এক দেশে চলে যেতে বলছে, আমি কি সেখানে যাব? এই দেশ, এই নদী, এর গাছপালা, এর প্রান্তর আমি বড় ভালোবাসি। এখানে সহস্র অপমান সত্ত্বেও একে ছেড়ে যেতে ইচ্ছে হয় না। যদি ছেড়ে যেতেই হয়, পিছারার খালের স্মৃতির মতো এর সব নদী, সব খাল এবং সব আয়োজনই একসময় আমার স্মৃতিই হয়ে থাকবে। আমি আর এই ভূমি, নদী, বৃক্ষ বা আকাশের কেউই থাকব না। আমি বা আমরা, যারা একদিন এইসব আয়োজন ভালোবেসে, ধানঘরে, নবান্ন, পৌষপার্বণ ইত্যাকার হাজারও উৎসবের মহিমান্যতায় নিজেদের শিকড়ের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে বেঁচে বর্তে, সুখে দুঃখে কলহে, বিষাদে বা শান্তি-অশান্তিতে ‘সর্বে লোকা সুখীনো ভবন্তু’ বোধে একাত্ম ছিলাম, অতঃপর আমরা আর তা থাকব না।

এইসব চিন্তনের প্রগাঢ়তায় শেষ নিশীথের নদীর শান্ত বাতাস আমাকে আলিঙ্গন করে যেন অলৌকিক এক তন্দ্রামগ্নতায় নিমজ্জিত করল। ঠিক ঘুম নয়, জাগরণ এবং তন্দ্রার মাঝামাঝি এক অবস্থান। আমার মনে হচ্ছিল আকাশের মেঘের আড়াল থেকে এক্ষুনি একটা ঘোর নাদ ধ্বনিত হবে, আমি শুনতে পাব, হে মুসা,

ভীত হবার হেতু নেই। তোমার সামনে যে বিস্তীর্ণ পাথার, তা তোমার পথরোধ করতে পারবে না। তুমি তোমার দণ্ডের সাহায্যে সমুদ্রকে আঘাত করো। সে তোমাকে পথ করে দেবে। তোমার পেছনে ফেরাউন তার সৈন্যসামন্ত নিয়ে তাড়া করছে। তারা অচিরেই জলমগ্ন হবে।

আমি মুসা এবং আমার হাতে একটি অলৌকিক দণ্ড আছে, এরকম এক বোধ আমার মস্তিষ্ক অধিকার করলে, আমি পরম প্রশান্তিতে ঘুমিয়ে পড়লাম। নৌকো চলতেই থাকল।

.

ঘুমের গভীর থেকে মাথা তুলে দাঁড়ায় এক বিশালকায় দেবোপম বৃক্ষ। সময়ের খালের জলে তাঁরই বিষণ্ন প্রচ্ছায়া। ঝুরঝুর করে বৃক্ষ তাঁর পাতা ঝরিয়ে যাচ্ছেন, যেন অঝোরে কাঁদছেন। যেন অসহায় এক প্রাচীন কুলপতি তাঁর অবাধ্য দুঃশাসনীয় গোষ্ঠীর আত্মঘাতী মাৎস্যন্যায়ী আচরণে মুহ্যমান। খালের দিকে বাড়ানো তাঁর শিকড়ের সঙ্গে সার সার নৌকো বাঁধা, নাকি বৃক্ষই তাদের আঁকড়ে ধরে আছেন এখনও। তীরে আশপাশ গ্রামবাসী মেয়ে, পুরুষ, শিশু, বৃদ্ধ। এই জনপদে তারা আর থাকবে না। থাকবে না এই কুলপতির ছত্রছায়ে। এই জনপদ আর তাদের নয়, এরকম এক বার্তা আশপাশের এইসব ধানখেত গোপাট, আম-জাম, নারকোল-সুপারি-তালের বাগিচায়। এই নদীখাল আর তার কিনারের হোগল, কাশ, ছৈলা অথবা কেয়ার ঝাড়, এইসব ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পুকুর-দিঘি, পরম্পরাগত, তাবৎ এই আত্মীয় আয়োজনের কিছুই আর নাকি তাদের নয়।

কখনো এই হাহাকারের জলছবি। আবার মুহূর্তে পটপরিবর্তন। অন্তরের বিষণ্নতার বাষ্প কোথাও উধাও! সেখানে তখন তাবৎ উজ্জ্বল উৎসবের উজাগরী উল্লাস। জরিনা, গুণাবিবি, রয়ানি কীর্তনের আসর অথবা পৌষসংক্রান্তির ‘নইল্লার ডাক’ বা বারো বাঘের ছড়ায় রমেন নটের ঢোলের বোলে সেই সুস্থিত প্রাচুর্যের প্রতিশ্রুতি। আর হর্ষোৎফুল্ল সেই কুলপতি মহাবৃক্ষের আন্দোলিত শাখা-প্রশাখার সুনিশ্চিত আশ্বাস—

ঠাকুর কুলায় বোল
ও গিরি ও গিরি
বাইর কইয়া দেও সোনার পিঁড়ি
সোনার পিঁড়িতে বইবে কেডা
বাঠাকুর আবার কেডা
বাস্তুঠাকুর দিবেন বর
ধানে চাউলে ভরবে ঘর
ধান দিবেন না দিবেন কড়ি
মাঝ খাড়ালে সোনার লড়ি…।

বাঠাকুর দুহাত উজাড় করে বর দিচ্ছেন। ঊষা ঠাকরুন নগেনজেঠিমাকে যেন বলছেন, কী বউ, কইছিলাম না আবার সব ঠিক অইয়া যাইবে? এহন দেখলি তো? ওই তো বকসিরা, চটকিরা, উকিল বাড়ইয়ারা বেবাকে আইয়া পড়ছে। যুগিপাড়া, নাপিতপাড়া, ভুঁইমালীরা, ধোপারা বেবাকে আইছে। যাউক আর কোনো উদ্বাগ নাই। যারা যারা গ্রাম শূন্য করে চলে গিয়েছিল, সবাই ফিরে এসেছে। আবার সব ভরপুর। বাস্তুদেবতা যেন জাগ্রত মহিমায় ভাস্বর এবং নবসজ্জায় সুস্থিত।

গয়নার নৌকোখানা যেন ছোট্ট একটা ডিঙি হয়ে পিছারার খালে গিয়ে ঢুকে পড়েছে। দুপারের লোকেরা বলাবলি করছে, ভাবছিল যাইবে গিয়া, ফিরইয়া আইছে। আইবে না, আইতেই অইবে। খালটির চেহারা সেই আগের মতোই। জোয়ারের ঘোলাজল, কর্কিনা মলান্তি আর ভাঁটা মাছগুলোর উজান ঠেলে চলা, শুকনো পাতাগুলোর ভেসে যাওয়া আর আমাদের হুটোপুটি। নগেনমশাইয়ের কামরাঙা বাগানটিও তেমনি বাহারিই আছে। পিছারার খালপারের বাঁশঝাড়, পাশের ঢোলকলমির জঙ্গল, আশপাশের বন-বাঁটালির জটলা, শটির বন আর তাদের অন্দর থেকে উঁকি মারা বিচিত্রবর্ণের ডাঁটো শটিফুল—সবাই যে যার জায়গায় হৃষ্টমনে আসন বিছিয়ে বসে গেছে যেন। এমনকি সেই অতিকায় বুড়ো থুথুরে যজ্ঞিডুমুরের গাছটা তার সারা গায়ে লাল লাল পাকা পুরুষ্ট ফলগুলো নিয়ে গোলাঘরের পেছন দিকটায় খালের কিনার ঘেঁষে যেমনটি ছিল, তেমনটিই পাহারাদারি করছে। একঝাঁক শালিখ আর চন্দনা মহাভোজ লাগিয়ে দিয়েছে সেখানে।

বুকের মধ্যে শৈশবের উৎসবি উচ্ছ্বাসগুলো কলকল করে উঠছে, যেন আনন্দেরা ঢাক ডগর বাজাচ্ছে মগ্নচৈতন্যে।

এই বিভিন্নমুখী অভিঘাতের বহুমাত্রিক কোলাজ কখনো ব্যথায়, কখনো উল্লাসে যেন আরও গভীরে নিমগ্ন করছে আমাকে। এইরকম আরও আরও গভীর ঘুমে তলিয়ে যেতে যেতে, আর কোনো দিন এই জঙ্গমবোধ থেকে জেগে না ওঠার এক আকুল প্রার্থনা বুকের অত্যন্ত গোপন তল থেকে স্বতোৎসারে উদগীথ হতে থাকলে আমি যেন কালরহিত, দেশরহিত এক অনির্বচনীয় সত্তায় বিলীন হতে থাকি এবং তা যেন এক অনুপম সত্যে প্রতিষ্ঠা পায়।

তথাপি যেহেতু সেই গয়নার নৌকাখানা চলতেই থাকে, তাই মগ্নতায়ও অনুভূত হয় এই কাঙ্ক্ষণীয় বোধের ক্ষণিকত্ব। অমনি আবার বুকের মধ্যে ঠেলে জেগে ওঠা এক হাহাকারে জানতে পারি যে, ওই মহাবৃক্ষ তাঁর অনন্ত বিবিক্তি নিয়ে অতঃপর আমাদের ধ্বস্ত করেই চলবেন, কারণ তাঁর নিষেধ আমরা গ্রাহ্য করিনি। তাঁর পাতা ঝরানোর দ্যোতনা, ছড়িয়ে দেয়া, জড়িয়ে ধরা শেকড়ের আর্তি আমাদের পরস্পর অসহিষ্ণু দুই সম্প্রদায়ের মানুষদের কিছুমাত্র বিবেকে বিবস্বান করেনি। তাঁর আচরণ থেকে আমরা কিছুমাত্র নিদর্শন গ্রহণ করিনি, যেমন করিনি পিছারার খালের প্রবহন থেকে। না, প্রকৃতির আচরণ থেকে কোনো প্রত্যাদেশ বা ‘অহি’ কেউই গ্রহণ করতে সক্ষম হইনি।

এই বিষণ্ণ ব্রতকথা যদিও ব্যক্তিক উত্থানপতনের কথায় অকিঞ্চিৎকর, কিন্তু এই বিষাদবৃক্ষ এবং বিষাদিনী নদীর সন্তানেরা সবাই তার অংশী। আমি শুধু কথক মাত্র। এই ব্রতকথা শেষ হয়েও শেষ হবে না, যতদিন না এই মহাবিষাদবৃক্ষের অভিশাপকাল শেষ হয়।

হয়তো একদিন আমাদের এই জনপদের কারও কোনো উত্তরপুরুষ, কোনো দিন এই মহাবৃক্ষের যে শিকড়ে নৌকোর কাছিগুলো বাঁধা ছিল, তার সন্ধান পাবার জন্য আকুল হয়ে খুঁজতে খুঁজতে এখানে এসে পৌঁছবে, যেমন সগর রাজার উত্তরপুরুষেরা যুগ যুগ প্রচেষ্টার পর পৌঁছতে পেরে শাপমুক্ত করেছিল তাদের পূর্বপুরুষদের, তেমনি। আর সেদিনই হয়তো এই অভিশাপের কাল শেষ হয়ে বুড়িপিসিমাদের আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হবে, বাঠাকুর আবার আপন মহিমায় প্রতিষ্ঠিত হবেন এক জ্যোতির্ময় বিকাশে।

অধ্যায় ৪৬ / ৪৬

সকল অধ্যায়

১. বিষাদবৃক্ষ – ১
২. বিষাদবৃক্ষ – ২
৩. বিষাদবৃক্ষ – ৩
৪. বিষাদবৃক্ষ – ৪
৫. বিষাদবৃক্ষ – ৫
৬. বিষাদবৃক্ষ – ৬
৭. বিষাদবৃক্ষ – ৭
৮. বিষাদবৃক্ষ – ৮
৯. বিষাদবৃক্ষ – ৯
১০. বিষাদবৃক্ষ – ১০
১১. বিষাদবৃক্ষ – ১১
১২. বিষাদবৃক্ষ – ১২
১৩. বিষাদবৃক্ষ – ১৩
১৪. বিষাদবৃক্ষ – ১৪
১৫. বিষাদবৃক্ষ – ১৫
১৬. বিষাদবৃক্ষ – ১৬
১৭. বিষাদবৃক্ষ – ১৭
১৮. বিষাদবৃক্ষ – ১৮
১৯. বিষাদবৃক্ষ – ১৯
২০. বিষাদবৃক্ষ – ২০
২১. বিষাদবৃক্ষ – ২১
২২. বিষাদবৃক্ষ – ২২
২৩. বিষাদবৃক্ষ – ২৩
২৪. বিষাদবৃক্ষ – ২৪
২৫. বিষাদবৃক্ষ – ২৫
২৬. বিষাদবৃক্ষ – ২৬
২৭. বিষাদবৃক্ষ – ২৭
২৮. বিষাদবৃক্ষ – ২৮
২৯. বিষাদবৃক্ষ – ২৯
৩০. বিষাদবৃক্ষ – ৩০
৩১. বিষাদবৃক্ষ – ৩১
৩২. বিষাদবৃক্ষ – ৩২
৩৩. বিষাদবৃক্ষ – ৩৩
৩৪. বিষাদবৃক্ষ – ৩৪
৩৫. বিষাদবৃক্ষ – ৩৫
৩৬. বিষাদবৃক্ষ – ৩৬
৩৭. বিষাদবৃক্ষ – ৩৭
৩৮. বিষাদবৃক্ষ – ৩৮
৩৯. বিষাদবৃক্ষ – ৩৯
৪০. বিষাদবৃক্ষ – ৪০
৪১. বিষাদবৃক্ষ – ৪১
৪২. বিষাদবৃক্ষ – ৪২
৪৩. বিষাদবৃক্ষ – ৪৩
৪৪. বিষাদবৃক্ষ – ৪৪
৪৫. বিষাদবৃক্ষ – ৪৫
৪৬. বিষাদবৃক্ষ – ৪৬

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন