বিষাদবৃক্ষ – ২৬

মিহির সেনগুপ্ত

ছাব্বিশ

১৯৬০ সালে মার্শাল প্রেসিডেন্ট বুনিয়াদি গণতন্ত্রের ফতোয়া জারি করেন। তাঁর তত্ত্ব অনুযায়ী ইউনিয়ন বোর্ডগুলো ইউনিয়ন কাউন্সিল নামে অভিহিত হয় এবং প্রেসিডেন্ট পদটির নাম হয় চেয়ারম্যান। খান সাহেবের বোধহয় মনে হয়েছিল যে, একই দেশে একাধিক প্রেসিডেন্ট থাকাটা উচিত নয়। তাই চেয়ারম্যান। এই সময়ে ইউনিয়ন কাউন্সিলের নির্বাচনও অনুষ্ঠিত হয়।

এই নির্বাচনে জ্যাঠামশাই একজন কংগ্রেস প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে উদ্যোগী হলে বাবা এবং অন্যান্য শুভানুধ্যায়ীরা তাঁকে নিষেধ করেন। বহুকাল ধরে বোর্ডের নির্বাচনের সময় তিনি তাঁর নিজস্ব প্রার্থী দাঁড় করিয়ে যেভাবে হোক বোর্ডটি দখল করতেন এবং পরিচালনক্ষমতাটি নিজের হাতে রাখতেন। নির্বাচিত ব্যক্তিটি বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কম বুদ্ধিসম্পন্ন, প্রায় অশিক্ষিত কোনো অবস্থাপন্ন মুসলমান হতেন এবং জ্যাঠামশাইয়ের হাতের পুতুল হয়েই থাকতেন। এই ইউনিয়ন বোর্ডের জন্য তিনি বহু মামলা-মোকদ্দমা, হই-হুজ্জোত বহুকাল ধরে করেছেন। এ জন্য এবং অন্যান্য বিভিন্ন কারণে তাঁর প্রচুর শত্রু হয়েছিল। বোর্ড থেকে কাউন্সিলে রূপান্তরের সময় ক্ষমতার অনেক রদবদল হয়। প্রেসিডেন্টের চাইতে চেয়ারম্যানের ক্ষমতার অনেক প্রসার ঘটে। ফলে উঠতি পয়সাওলা মুসলমানদের মধ্যে এই পদের জন্য বেশ প্রতিযোগিতা শুরু হয়। এই পর্বে আমি যে কাহিনিটি বলতে যাচ্ছি, তার উদ্দেশ্য হলো ওই সময়েও জ্যাঠামশাইদের মতো প্রাক্তন ভূস্বামীরা কী ধরনের আচরণ করতেন তার কিঞ্চিৎ নিদর্শন দেখানো।

বাবা এবং অন্যান্য শুভাকাঙ্ক্ষীরা আশঙ্কা করেছিলেন যে, এই নির্বাচনে ব্যাপক গণ্ডগোল হবে। মুসলমান প্রতিদ্বন্দ্বীরা একে অন্যের বিরোধী হলেও সাধারণভাবে জ্যাঠামশাইয়ের শত্রু ছিলেন। এ কারণে তাঁর সম্যক বিপদের কারণ ছিলই। এমনকি তখন যা পরিস্থিতি, তাতে তাঁর খুন হয়ে যাওয়াও অসম্ভব ছিল না। এ শুধু তিনি হিন্দু বলে নয়, এই পরিস্থিতি তিনিই সৃষ্টি করেছিলেন। কিন্তু কারও কথাই তিনি শুনলেন না। নির্বাচনে দাঁড়ালেন তিনি।

এই সময়টাতে আমাদের তালুকদারি নেই। তাই দাপটও সীমিত। থাকার মধ্যে ছিল জ্যাঠামশাইয়ের ক্ষুরধার তীক্ষ্ণ দুর্বুদ্ধি আর স্থানীয় সাধারণের মধ্যে তাঁর বিষয়ে অসুমার কিংবদন্তি। অবশ্য তার কিছু বাস্তব ভিত্তিও যে ছিল না তা নয়। তালুকদারি থাকাকালীন সময়ে তিনি বেশ কয়েকবার আক্রান্ত হয়ে অলৌকিকভাবে বেঁচে গেছেন। বড়দের কাছে শুনেছি ‘মহালে’ থাকার সময় একবার টিনের পায়খানাঘরের মধ্যে যখন তিনি প্রাতঃকৃত্যে রত, তখন জনৈক আততায়ী বল্লম ছুড়ে দুদিকের বেড়া এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিয়েছিল। তাঁর আঁ আঁ চিৎকারে কাছারির আমলারা ভেবেছিল তিনিও এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে গেছেন। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি সম্পূর্ণ অক্ষত শরীরে বাইরে বেরিয়ে এসে খুবই স্বাভাবিকভাবে নায়েবমশাইকে নির্দেশ দেন যেন অচিরেই তিনি আততায়ীর নামে খুনের চেষ্টার অভিযোগে থানায় একটি ডায়েরি করেন। এখন কথা হচ্ছে আততায়ীকে তো তিনি দেখেনইনি, তার নাম উল্লেখ করে কীভাবে ডায়েরি করা। কিন্তু এসব প্রশ্ন অবান্তর। শত্রুর অভাব নেই, কারও একজনের নাম দিলেই হলো। তাতে যদি রামের জায়গায় শ্যাম সোপর্দ হয়, কিছু আসে যায় না।

আবার একবার বাড়িতে থাকার সময় কোনো এক বিশেষ ফৌজদারি মামলায় পুলিশ গ্রেপ্তার করতে আসলে তিনিই ইঙ্গিতে জানিয়ে দেন যে, তিনি বাড়িতে নেই। পশ্চিমে কোথাও গেছেন। পুলিশদের আসতে দেখেই তিনি একটি কাঁথা জড়িয়ে বসে ঈশ্বরের নাম জপ করছিলেন। পুলিশদের ইশারায় জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, তিনি মৌনী আছেন। পুলিশ খালপারে পৌঁছবার আগেই মহাশয় বৈঠকখানা ত্যাগ করে পেছনের দরজা দিয়ে উধাও। প্রতিবেশী কোনো বিরুদ্ধবাদী ব্যক্তির প্ররোচনায় পুলিশের পুনরায় আসা সম্ভব।

মহাশয় সাতিশয় ধুরন্ধর। মানুষকে পথে বসাতে তাঁর মতো নিপুণ সামন্ত কারিগর ওদিগরে আর দ্বিতীয় ছিল না। তাই মানুষের তাঁর প্রতি আক্রোশ থাকা স্বাভাবিক। বাবা এই নির্বাচন উপলক্ষ্যে বাধ্য হয়ে তাঁর সুরক্ষার জন্য কিছু ব্যবস্থা নিয়েছিলেন, কিন্তু শুধু ভোটটি দেয়া ছাড়া এ ব্যাপারে তিনি আর কোনো উদ্যোগে থাকলেন না। নির্ধারিত দিনে ভোটপর্ব শেষ হলো। বাবা ভোট দিয়ে বাড়ি চলে এলেন। ভোট নির্বিঘ্নেই সমাধা হয়েছিল। জ্যাঠামশাই ওখানেই থেকে গিয়েছিলেন, কারণ ভোটের ফলাফল ওখানেই ঘোষিত হবার কথা।

সন্ধে ছটা নাগাদ তুমুল হট্টগোলের আওয়াজ পাওয়া গেল। ভোটকেন্দ্রটি পাশের গ্রামের একেবারে প্রত্যন্তে হলেও গণ্ডগোলের মারমার কাটকাট শব্দ আমাদের বাড়ি থেকে স্পষ্টই শোনা যাচ্ছিল। আমরা এমনিতেই আতঙ্কগ্রস্ত ছিলাম। হট্টগোলের তীব্রতায় উৎকণ্ঠা আরও বাড়ল। বাবা আমাদের নাপিত কাকা যদুনাথকে ডেকে পাঠালেন। তিনি হন্তদন্ত হয়ে এসে জানালেন যে, খবর পাওয়া গেছে মুসলমানেরা জ্যাঠামশাইকে ঘিরে ফেলেছে এবং ঘটনা যে কী ঘটবে বলা মুশকিল। বাবা এ সংবাদে খুবই চঞ্চল হয়ে পড়লেন এবং তৎক্ষণাৎ ঘটনাস্থলে যাবার উদ্যোগ করলে নাপিত কাকা আর গ্রামের অন্য কয়েকজন তাঁকে এ অবস্থায় ওখানে যেতে নিষেধ করতে লাগলেন। বাবা জানালেন যে, তাঁর পক্ষে এ ক্ষেত্রে চুপচাপ বসে থাকাটা নিতান্তই অসম্ভব। বরং কেউ যদি তাঁর সঙ্গে যেতে চায় যেতে পারে। এ প্রস্তাবে নাপিত কাকা আর কোবরেজ কাকা ছাড়া আর কেউ এগোলেন না। নাপিত কাকা জিজ্ঞেস করলেন—হাথইয়ার কিছু লমু?

: না।

: নীলু কি নারায়ণ ঠাকুরকে ডাকুম?

: না। দুটি প্রশ্নের জবাবেই বাবা ‘না’ বলে দেয়ায় কোবরেজ কাকা বললেন, খালি হাতে যাওয়া কি ঠিক হইবে? বাবা জানালেন যে, এ অবস্থায় হাতিয়ারবন্দ হয়ে যাওয়া নিরর্থকই শুধু নয়, বিপজ্জনক। হিতে বিপরীত হবার সম্ভাবনা। দ্বিতীয়, নীলু বা নারায়ণ যদিও বাবার খুব অনুগত, কিন্তু তাদের মুখের থেকে হাত আগে চলে। তা-ও বিপজ্জনক। প্রকৃত ঘটনাটা কী, জানা যাচ্ছে না। গণ্ডগোলটা জ্যাঠামশাই স্বয়ং করাচ্ছেন কি না তা-ও বোঝা যাচ্ছে না। ঘটনাস্থলে না গিয়ে কিছুই ঠিক করা সম্ভব নয়।

বাবা খুবই চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন তা বুঝতে পারছিলাম। কিন্তু তাঁর এভাবে ঘটনাস্থলে যাওয়াটা বাড়ির সবার আতঙ্কের কারণ হয়েছিল। বাড়িতে মা, বড়মা, ছোট ভাইবোনেরা ছাড়া ছিলাম আমি আর বাড়ির চাকর ফটিক। আমরা দুজনে বাড়ির সামনের দিকে নজর রাখছিলাম। যদিও বাড়ির ওপর হামলা হলে আমরা কিছুই করতে পারতাম না, তবুও বাড়ির লোকদের সাহস জোগাবার জন্য আমাদের যথাসম্ভব দৃঢ় থাকতে হচ্ছিল। পাড়ার দু-একজন সমবয়সি ছেলেদের ডেকে একটু দলভারী করে নিয়েছিলাম। দু-একজন সংবাদদাতা এর মধ্যে কখনো কখনো এসে নানারকম ভয়ংকর সব খবর দিয়ে যাচ্ছিল। কেউ বলছিল, সে শুনেছে কম করে দশটা খুন হয়েছে। কেউ বলল, মিঞারা আজ রাতে গোটা এলাকাই জ্বালিয়ে দেবে। একজন বলল, জ্যাঠামশাইকে একটা ঘরে আটকে রাখা হয়েছে এবং তাঁকে কেটে ফেলার মতলব করছে মিঞারা। এইরকম সব খবর আসছে আর বাড়ির মধ্যে আর্তনাদ তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। পাড়ার লোকরা ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করে পরিত্রাহি চেঁচাচ্ছে। ওদিকে কোলাহল এবং মারমার ধ্বনি তুঙ্গে। সব মিলিয়ে একটা নারকীয় পরিস্থিতি, যেন পঞ্চাশ/একান্নর পুনরাবৃত্তি এক্ষুনি ঘটতে চলেছে।

এইসব হুলস্থুলুর মধ্যে দেখা গেল জনা তিনেক লোক আমাদের বৈঠকখানার দিকে আসছে। তারা অত্যন্ত উত্তেজিত ভঙ্গিতে কথা বলতে বলতে আসছিল। ফটিক আর আমি তাদের লক্ষ রেখে বৈঠকখানার নিচে একটা গাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকলাম। তারা মাত্র তিনজন এবং তিনজনের মহড়া আমরা নিতে পারব, এরকম একটা প্রস্তুতি আমাদের ছিল। কিন্তু তারা কাছাকাছি পৌঁছলে বুঝলাম যে, তিনজনের একজন জ্যাঠামশাই। যাক তাহলে তিনি খুন হননি। তবে যথেষ্ট উত্তেজিত। কথাবার্তায় বুঝলাম, সঙ্গের দুজন লোক মুসলমান এবং জ্যাঠামশাইয়ের অনুগামী। তারা জ্যাঠামশাইকে বোঝাচ্ছিল যে, যদি তালুকদারের দোতলার ঘর থেকে জ্যাঠামশাইকে তারা সরিয়ে না আনত, তবে তিনি ‘নিয্যস’ খুন হতেন।

তালুকদারের নাম নান্নুমিঞা। ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল ত্রিমুখী। নান্নু তালুকদার একজন প্রতিদ্বন্দ্বী। এ ছাড়া একজন হলেন জ্যাঠামশাই এবং অপরজন সলিমুল্লাহ নামে জনৈক বিড়ি কারখানার মালিক। গঞ্জের কাছে তাঁর বিখ্যাত আলো বিড়ি ফ্যাক্টরি। বড় করে সাইনবোর্ড লাগানো আছে—’আলো বিড়ি ফ্যাক্টরি। উৎকৃষ্ট নেপানী তামাকে প্রস্তুত। প্রোঃ মহঃ সলিমুল্লাহ’। এমনিতে সজ্জন মানুষ। ব্যবসায় বিলক্ষণ দুপয়সার মালিক হয়ে দশচক্রে এবং সামাজিক প্রতিষ্ঠার লোভে ভোটে দাঁড়িয়েছেন। তবে তাঁর সঙ্গে তালুকদারের বিরোধ শুধু নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য নয়। গ্রামীণ ব্যবহার অনুযায়ী আঞ্চলিক ক্ষমতা এবং জমিজমা সংক্রান্ত অনেক গূঢ় কারণই ছিল। নান্নুমিঞা যে খুব একটা হার্মাদ মানুষ তাও নয়। বিশেষত বাবার সঙ্গে খাতির থাকায় জ্যাঠামশাইকে অসম্মান বা হেনস্থা করার মতো সাহস বা মানসিকতা তাঁর থাকার কথা নয়। কিন্তু জ্যাঠামশাইয়ের তাঁর ওপর বিলক্ষণ ক্রোধ, যদিও তাঁর স্বভাবানুযায়ী প্রকাশ্যে তার স্ফুরণ নেই। ক্রোধের কারণ ‘তালুকদার বকসী বাড়ি খায়’ এবং তা প্রায় জ্যাঠামশাইয়ের ‘বুকের ওপর বইয়া’। এ কারণে তাঁর সমস্ত রক্তে ব্যাপক ‘টাডানি’। কিন্তু এ সবই ওপরের ব্যাপার। গভীরে কী আছে, তা যদি কেউ জানেন তো জ্যাঠামশাই-ই। এ কারণে আগেই বলেছিলাম যে, গণ্ডগোলটা তাঁরই তৈরি করা কি না সে বিষয়ে সন্দেহের কারণ আছে। ইউনিয়ন কাউন্সিলের ক্ষমতা সহজে ছেড়ে দেয়ার পাত্র আর যেই হোন জ্যাঠামশাই নন, এরকম অভিজ্ঞতা আমাদের সবারই ছিল। ইউনিয়ন কাউন্সিল হাতে থাকলে মানুষ বাধ্য হয়ে তাঁর কাছে আসবে বিভিন্ন প্রয়োজনে। গ্রাম-গাঁয়ে জমি-জিরেত, এটা-ওটা নিয়ে হামেশা বিরোধ-বিসংবাদ লেগেই থাকে। তার সালিশি নিষ্পত্তির জন্য কাউন্সিলে আসতে হবেই। এখন আর তালুকদারি নেই। অতএব, হাতের-পাঁচ ইউনিয়ন কাউন্সিলটা ছেড়ে দেয়া আদৌ যুক্তিযুক্ত নয় তাঁর বিচারে

এইসময় পরিত্যক্ত ভদ্র হিন্দু গৃহস্থের ভিটেবাড়ি দখল নিয়ে হিন্দু-মুসলমানে, হিন্দুতে-হিন্দুতে এবং মুসলমানে-মুসলমানে হুজ্জোতি কম হয়নি। তালুকদার পাশের গ্রাম নৈকাঠির এক নম্বর জোতদার। তাঁর লোকবল, প্রতিষ্ঠা, সরকারি আমলাদের সঙ্গে যোগাযোগ নেহাত কম ছিল না। তথাপি জ্যাঠামশাইকে যে তিনি নিকেশ করার ষড়যন্ত্র করেছিলেন অথবা আদৌ কোনোরকম স্পর্ধা করার সাহস তাঁর হয়েছিল, এটা বিশ্বাস করা কঠিন। অথচ জ্যাঠামশাইয়ের সঙ্গে যে দুজন লোক এসেছে, তারা সে কথাই বলছে। এদের একজনের নাম জমিঞা, অপরজন মোদাচ্ছের। জনুর বাবা কাসেমকে জ্যাঠামশাই ওখানকার একটি ‘ছাড়া’ ভিটেয় বসত করিয়ে ছিলেন বলে জনু তাঁকে ধর্মবাপ বলে ডাকত। কাসেম নৈকাঠিতেই ছিল। এখন নতুন ভিটেতে উঠে এসে তারা সম্পন্ন গেরস্থালি পাতে। মোদাচ্ছেরকেও জ্যাঠামশাই অনুরূপ একটি বাড়িতে বসত করাবার ওয়াদা করে রেখেছিলেন বলে সেও তাঁর খুবই অনুগত। তবে জ্যাঠামশাই যে এদের দারিদ্র্যে কাতর হয়ে জমি-জিরেতসহ ছাড়া ভিটেবাড়িতে বসত করিয়েছিলেন তা আদৌ নয়। এ ব্যাপারে তাঁর নানাবিধ স্বার্থ এবং কুচক্রিপনা কাজ করছিল। তালুকদার যে ছাড়াভিটে ভোগদখল করছিলেন, তা তাঁর অহংবোধকে আঘাত করেছিল বলে তিনি ভেতরে ভেতরে তাঁর ওপর বিরূপ ছিলেন।

এখন জনু আর মোদাচ্ছের যে তাঁর খুন হওয়ার সম্ভাবনা বিষয়ে আলোচনা করছে এবং তালুকদারকে দায়ী করছে, এ বিষয়ে তাঁর কোনো প্রতিক্রিয়া প্রকাশ পাচ্ছে না। ভাবটা এরকম যে, এরা-এরাই বলুক। তাতে ‘কেইস জোরদার’ হবে। এদের গণনার প্রাথমিক পর্যায় শেষ হলে সাধারণ জনতাকে জ্যাঠামশাই নিজের লোক দিয়েই নিজের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করান, যাতে ব্যাপারটা পুরো ভণ্ডুল হয়। এদের কথায় আরও জানা গেল যে, ভোটে সলিমুল্লা জিতেছেন, তালুকদার পাঁচ ভোটে হেরেছেন আর জ্যাঠামশাই ভোট পেয়েছেন মাত্র তিনটে। একটা নিজের একটা বাবার, আরেকটা যদুনাথের। ব্যাপারটা বোধহয় তাঁর কাছেও অপ্রত্যাশিত ছিল না। জেতার জন্য তিনি দাঁড়াননি, তাঁর হিসেব অনেক সুদূরপ্রসারী ছিল, সেটা এখন বুঝতে পারছি। সেই হিসেবের অন্যতম ছিল তালুকদারকে ঘোল খাওয়ানো এবং নির্বাচন বানচাল করে একটা অচলাবস্থার সৃষ্টি করা। মামলাবাজ মনুষ্য এবং চন্দ্রদ্বীপস্থ ঈদৃশ ব্যক্তিদের স্বভাবে অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা তাঁর এইসব কর্মকাণ্ড সম্যক বুঝবেন।

জনুকে আমরা জনুদা বলে ডাকতাম। সরলসোজা সাদামাটা চাষি। আমাদের বাড়ির সবারই অসম্ভব অনুগত। আড়ালে থেকে শুনছিলাম জনুদা বলছে, বাবা আপনেরে ওই আজরাইলের পোয় টোঙ্গের ঘরে নেলে ক্যামনে? আর নেছেলেই-বা কেডা? মুই হ্যার ক্যাল্লার নলিডা এট্টু মাপমু। জ্যাঠামশাই জানালেন যে, তালুকদারই নাকি তাকে বলেছিলেন যে পাবলিক খুব ক্ষেপে গেছে তাঁর ওপর, তাই ওখানে থাকা তাঁর পক্ষে উচিত হবে না। তিনি তাঁর জনাদুয়েক কামলা দিয়ে প্রায় জবরদস্তি ওখানে পাঠিয়ে দেন। খুবই সরলভাবে জ্যাঠামশাই জানালেন যে, জনুরা যা বলছে তা ঠিক নয়। তিনি তো তালুকদারের ভালোই চান। তবে তিনি কেন জ্যাঠামশাইকে খুন করার কথা ভাববেন? অবশ্য তালুকদার জনু মোদাচ্ছেরদের অনেক ক্ষতিই করেছে, তবু তিনি তাঁকে সন্দেহ করতে পারেন না। সরলবুদ্ধি জনু তাঁর কথার প্যাঁচ বোঝে না। সে বলে, মোর যদ্দুর মন লয় ওই বউয়ার পোয় চাইছেলে আপনের গলার নলিডায় আড়াই পোচ লাগাইয়া খালধারে ফ্যালাইয়া রাখতে। মাইনষে ভাবতে গোণ্ডোগোলের মইদ্যে কেডা না কেডা এরকম করছে। বলাবাহুল্য মোদাচ্ছেরও এ কথায় সহমত প্রকাশ করল।

তাদের এইসব বার্তালাপের মধ্যে আমি আর ফটিক আড়াল থেকে বেরিয়ে এলাম, যেন বাড়ির ভেতর থেকেই আসছি লোকের সাড়া পেয়ে। জ্যাঠামশাই আমার সঙ্গে বিশেষ বার্তালাপ করেন না। ফটিককে বললেন, ভাইটিকে ডাক। ভাইটি অর্থে বাবা। ফটিক জানাল যে, তিনি যদুনাথ আর কোবরেজ মশাইকে নিয়ে নৈকাঠি গেছেন। এ কথায় জ্যাঠামশাই ভয়ানক ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। বললেন, জনু, মোদাচ্ছের তোমরা এক্ষুনি যাও। ভাইটি গেছে। বেবাক ভণ্ডুল হয়ে যাবে। ও হয়তো এতক্ষণে মারদাঙ্গা শুরু করে দিয়েছে। তাহলে কিন্তু কেস মাটি। এতক্ষণে কটা মাথা ফেটেছে বা খুন হয়েছে বলা মুশকিল। তারা বলল, আমরা একজন যামু আর একজন থাকমু। আপনেরে এল্হা ফ্যালাইয়া দুইজন যাইতে পারি না। কিন্তু জ্যাঠামশাইয়ের বক্তব্য দুজনকেই যেতে হবে। কারণ ভাইটি যদি ইতোমধ্যে ঝঞ্ঝাট মুসিবত কিছু পয়দা করে থাকে তো কেস চৌপাট। এতক্ষণে আমার অনুমান সঠিক প্রমাণিত হয়। মহাশয় তাঁর মস্তিষ্কে গোটা ব্যাপারটির একটি ছক তৈরি করে রেখেছেন। এখন সেই ছক মোতাবেক খেলা চলবে এবং আখেরে তালুকদারের হাড়ে দূর্বা গজাবে।

জনুদা আর মোদাচ্ছের রওনা হবার আগেই বাবা, নাপিত কাকা এবং আরও কয়েকজন লোক এসে পড়লেন। জ্যাঠামশাই বাবাকে বিলক্ষণ ভর্ৎসনা করে বললেন যে, এরকম একটা পরিস্থিতিতে তাঁর ওখানে যাওয়া খুবই গর্হিত হয়েছে। বাবা যদিও জ্যাঠামশাইয়ের মুখের ওপর কখনোই কথা বলেন না, কিন্তু সেদিন প্রায় বিতর্কই শুরু করলেন। জানতে চাইলেন, গণ্ডগোলটা কেন এবং জ্যাঠামশাইকে আটকে ছিলই-বা কে। জ্যাঠামশাই বললেন, হে কথা পরে কমু। কিন্তু তুমি সেহানে গেলা ক্যান? তোমার কি হিতাহিত কাণ্ডাকাণ্ডি জ্ঞান নাই? অরা যদি তোমারে বিসদৃশ এট্টা কিছু করত? বাবা শান্তভাবে জবাব দিলেন যে, তাঁর সঙ্গে ওরা কখনোই তেমন কিছু করবে না।

: কিন্তু তুমি আচুক্কা সেহানে গেলা ক্যান?

বাবা নিরুত্তর।

–মাইর ধইর কিছু করো নায় তো?

: না।

: বোজলা কী? তালুকদারের লগে দ্যাহা অইছে?

: হ। তালুকদারের দোষ নাই কোনো।

এ কথায় জনুদা ও মোদাচ্ছের সমস্বরে বলে ওঠে, তয় হ্যার বাড়িতে এনারে আটকাইলে ক্যা?

: পাবলিক খ্যাপছে দেইখ্যা। তালুকদারে জানে যে দাদার যদি ওহানে কিছু হয়, তয় হ্যারে আমি খালের চড়ায় পুঁইয়া ফ্যালামু।

বাবা অন্তর থেকে এমনিতে সোজা মানুষ। কিন্তু তাঁর দাদা এবং সমজের চাপে মাঝে মাঝে বিপরীত আচরণ করে বসতেন। জ্যেষ্ঠের ওপর তাঁর একটা অন্ধ ভালোবাসা ছিল। তাই তাঁর অন্যায় আচরণেও কখনো তিনি কিছু মন্তব্য করতেন না। উপরন্তু অন্য কেউ কিছু সমালোচনা করলে বাবা ঝাঁপিয়ে পড়ে নিজেও কিছু অন্যায় উগ্রকর্ম করে ফেলতেন। এটা অবশ্যই তাঁর চরিত্রে একটি বিশিষ্ট সামন্ত-লক্ষণ। তবে এই নির্বাচন উপলক্ষ্যে উদ্ভূত পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে বাবা পরিষ্কার বলে দিলেন যে, বর্তমান ঘটনাকে অজুহাত করে জ্যাঠামশাই যদি তালুকদারের কোনো অহিত করেন তবে তিনি তাঁর সঙ্গে সহমত হবেন না। বাবার মতে, তালুকদারের একটাই ত্রুটি, সে অত্যন্ত ভূমিলোভী। তবে সে দোষে এ ব্রহ্মাণ্ডে কেই-বা দুষ্ট নয়? বিশেষত দেশভাগ-পরবর্তীকালে এ ব্যাপারে ঠক বাছতে গাঁ উজাড় হয়ে যাবে। জ্যাঠামশাই বললেন, কিন্তু সে তো আমাকে খুন করার জন্যই নাকি আটকে রেখেছিল, অন্তত এরা তো তা-ই বলছে। বাবা বলেন, ও আটকে না রাখলেই তুমি মরতে। তুমি জানো না, আমি ভোট দিয়ে আসার সময় ওকে বলে এসেছিলাম তোমার প্রতি বিশেষ দৃষ্টি রাখতে। সে আমার কথা রেখেছে।

কিন্তু জ্যাঠামশাইয়ের মাথায় তখন অন্য প্যাচ। মুসলমান মানেই তাঁর দুশমন। বিশেষ করে ইউনিয়ন কাউন্সিলের ক্ষমতা ভোগে তাঁর ভূমিকা থাকবে না, এ তিনি কিছুতেই মেনে নিতে পারবেন না। বললেন, আমাকে মারা অত সহজ না। তবে এই গণ্ডগোলটা হয়ে ভালোই হয়েছে। দেখি এরা কী করে ইউনিয়ন কাউন্সিল চালায়। বাবা খুবই বিনয়ের সঙ্গে বললেন, দাদা অনেক হয়েছে এবার ছেড়ে দাও। দিনকাল পালটে গেছে। আমাদের সেই তালুকদারি দাপটের দিন আর নেই। চারদিকের অবস্থা তো দেখছই। জ্যাঠামশাই সংক্ষেপে উত্তর করলেন, ছেড়ে দেব? সম্ভব নয়। উপস্থিত সবাই বুঝল, সামনে এক অত্যন্ত জটিল এবং ভীতিপ্রদ অবস্থা তৈরি হতে চলেছে। বাঘ শিকারকে চিহ্নিত করেছে। এখন শুধু ঝাঁপ দেবার অপেক্ষা। বাঘের থাবায় তালুকদার, সলিমুল্লাহ বা অন্য কে বা কারা যে পড়বে, তার হদিশ কারওই জানা নেই।

জনু আর মোদাচ্ছেরকে তিনি বললেন যে, তারা যেন সেদিনই থানায় যায় এবং যেমন কথা হয়েছে সেই অনুসারে সব করে। পরের দিন সদরের কোর্টে তাদের সঙ্গে দেখা হবে। তারা এ কথা শুনে চলে গেলে বাবা জানতে চাইলেন—তাহলে কি তুমি তালুকদারকে জেলে পুরতে চাও? জ্যাঠামশাই হেসে বললেন, না না। তুমি এসব বুঝবে না। তালুকদার দেখবে’খন আজ ভোর রাত্রেই এসে পায়ে পড়বে। তবে ওই হিন্দুর ছাড়াভিটে দখল করে অনেক পয়সা হয়েছে তো, এবার একটু খরচ করতে হবে। চেয়ারম্যান হবার শখ হয়েছে, হুঃ।—সলিমুল্লাহ কত ভোটে জিতল? বাবার প্রশ্ন। —আরে সেটাই তো খেলা। আমি তো জানতামই যে, তিনটের বেশি ভোট আমি পাব না। সলিমুল্লাহ জিতেছে পাঁচ ভোটে। একে জেতা বলে? সুতরাং বুঝতেই পারছ তালুকদারের এ কারণে একটা কেস করা উচিত। তুমি কী বলো?—জ্যাঠামশাই প্যাচ খুলছেন। বাবা বললেন, সে কথা থাক। তবে you must not put him into any serious trouble like attempt to murder. ও কিন্তু আদৌ দাঙ্গাবাজ নয়। এ দেশে থাকতে হলে এইসব মানুষদের সঙ্গে সদ্‌ভাব রাখা বিশেষ প্রয়োজন। জ্যাঠামশাই জানালেন যে, যদিও এসব তাঁর জানা, তথাপি এইসব মানুষদের ওপর তিনি আদৌ কোনো ভরসা করেন না। স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে তিনি বললেন, তবে ভেবো না, তোমার সঙ্গে তার সম্পর্কের কথা আমার জানা আছে। সেদিন বাবা এবং জ্যাঠামশাইয়ের মধ্যে যেসব আলোচনা হয়েছিল তা আজও বেশ মনে আছে। জ্যাঠামশাই বলেছিলেন, আমি জানি দেশের অবস্থা কী এবং বিশেষ করে সংখ্যালঘুদের ভবিষ্যৎ যে কী, তা-ও বেশ ভালো করেই বুঝে নিয়েছি। সে কারণেই এইসব মানুষদের ওপর সামান্যতম ব্যবহারিক শিথিলতা দেখাতে আমি রাজি নই। এ দেশে সংখ্যালঘুরা কোনো দিন রাষ্ট্রীয়ক্রমে কিছুমাত্র গণতান্ত্রিক অধিকার ভোগ করতে পারবে না। সে প্রচেষ্টাও প্রথমাবধি তাদের মধ্যে দেখা যায়নি। দেশভাগ হবার পর থেকে মানসিকভাবে এরা আর এ দেশের মানুষ বলে নিজেদের ভাবছে না। ভারতের সংখ্যালঘু আর এখানের সংখ্যালঘুদের মধ্যে এটা একটা বড় পার্থক্য। সে অনেক ব্যাপার, কত আর বলব। তবে আমার উদ্দেশ্য এই যে, অন্যভাবে যখন পারছি না তখন বুদ্ধির জোরে যতটা পারি এদের সর্বনাশ করে যাব।

জ্যাঠামশাইয়ের ধারণা এবং ব্যাখ্যায় এ দেশে কোনো দিনই প্রকৃত গণতান্ত্রিক শাসনক্রম আসবে না। তাঁর ভাষ্যে ‘Perhaps it’s a lost land. They have already sold it to the American giants. We are lost no doubt but they are drowned totally . ‘

জ্যাঠামশাইয়ের বিশ্লেষণে হয়তো ভুল খুব একটা ছিল না, তবে তাঁর কর্মপদ্ধতি ছিল ভয়ংকর, তা মানুষের কোনো কল্যাণে কখনোই ব্যবহৃত হয়নি।

পিছারার খালের জগতে গ্রামীণ রাজনীতি এরকমই ছিল। আবার এটা জাতীয় রাজনীতির প্রচ্ছায়াও বটে। বাবার আফসোস ছিল এই যে, জ্যাঠামশাইয়ের মতো এমন একজন বুদ্ধিমান বিচক্ষণ লোক এরকম এক ক্ষুদ্র পরিবেশে জন্মে নষ্ট হলেন। তাঁর দুর্বুদ্ধিয়ানার ব্যাপক কর্মকাণ্ড সত্ত্বেও এ কথা অস্বীকার করা যায় না যে, উপযুক্ত ক্ষেত্র পেলে তিনি একজন নামকরা রাষ্ট্রপুরুষ হতে পারতেন। নিতান্ত গ্রামীণ প্রেক্ষাপটে তাঁর প্রতিভা প্রতিষ্ঠা পেল না। শুধু কম বুদ্ধিসম্পন্ন গ্রামীণ প্রতিস্পর্ধীরা তাঁর দুর্বুদ্ধির দাহে দগ্ধ হলেন। তাঁর প্রগাঢ় বুদ্ধি এবং কর্মক্ষমতা শুধু এ কাজে এবং মানুষের অনিষ্টের জন্যই ব্যয়িত হলো। কিন্তু এ বিচার আমার পিতৃদেবের। আমি আজও এ বিশ্বাসে স্থির যে, উপযুক্ত ক্ষেত্রে বিকাশ লাভ করলে তিনি একজন ছোটখাটো হিটলার হতেন এবং গোটা দেশের নিম্নবর্গীয় এবং মধ্যবর্গীয় হিন্দু ও মুসলমানদের concentration camp-এ না পাঠিয়েও শুধু পারস্পরিক বিরোধিতার মধ্যে ঠেলে দিয়ে ব্যাপক বিধ্বংস ঘটাতে সক্ষম হতেন। তারা বুঝতেও পারত না যে, তিনি তাদের ধ্বংসের কারণ। তারা একে অন্যের সঙ্গে মামলা-মোকদ্দমায় স্ববুদ্ধিদোষেই ধ্বংস হতো, যেমন পিছারার খালের জগতের মানুষেরা হয়েছে। তিনি সবকিছুর উদ্‌গাতা হয়েও ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকতেন। কিন্তু তাবৎ কর্মের সূত্রটি থাকত তাঁরই হাতে।

জ্যাঠামশাই শুনেছি কিছুকাল নাকি আইন কলেজে অধ্যয়ন করেছিলেন। অকালে পিতৃবিয়োগবশত শিক্ষাটা সম্পূর্ণ হয়নি। এটা আমাদের ওই অঞ্চলের ব্যাপক সাধারণের পুণ্যফল। ভাগ্যিস তিনি একজন পূর্ণাঙ্গ উকিল বা ব্যারিস্টার হননি। হলে অবস্থা যে কোথায় দাঁড়াত, ভাবলে বুকের রক্ত হিম হয়ে আসে।

আমার এই ধারণার উদাহরণ হিসেবে আমি তালুকদারের পরিণতির কাহিনিটি বলব। তাজ্জব বনে গিয়েছিলাম সেদিন জ্যাঠামশাইয়ের অনুমান দেখে। কী সাংঘাতিক ছক কষেছিলেন তিনি ইউনিয়ন কাউন্সিলের নির্বাচন ভণ্ডুল করার। অনুমান তাঁর অক্ষরে অক্ষরে মিলে গিয়েছিল। তালুকদার সত্যিই সেদিন ভোর রাত্রে এসে হাজির হয়েছিল ভীতসন্ত্রস্ত এবং অসহায়ভাবে। দরদালানের একটা থামে হেলান দিয়ে বসে প্রথমে বাবাকে ডেকেছিলেন তিনি। বাবা এবং আমরা সবাই নীচের তলায় থাকতাম আর জ্যাঠামশাইরা দোতলার একেবারে দক্ষিণ পার্শ্বের ঘরে। কথাবার্তার শব্দে মা এবং আমিও উঠে পড়েছিলাম। গতকালের ভীতি আমাদের তখনও প্রবল। তাই ব্যাপারটা কী তা জানার প্রয়োজন ছিল। জ্যাঠামশাইকে খুন করার চক্রান্তের গল্পটা তালুকদারের কানে পৌছেছিল। তিনি বাবাকে সকাতরে বলছিলেন, দাদা, আপনে কি এ কতা বিশ্বাস যায়েন যে মুই বড়দাদারে খুন করার মতলবে মোর বাড়িতে আটকাইয়া রাখছেলাম? বাবা বললেন, না, আমি এ কথা আদৌ বিশ্বাস করি না। আমি কি তোমাকে জানি না? তালুকদার বাবার কথা শুনে কীরকম যেন হয়ে গেলেন। বাবার হাত দুখানা নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে খানিকক্ষণ ধরে হেঁচকি দিয়ে কাঁদতে লাগলেন। বাবা তাঁর কাতরতার প্রকৃত কারণ বুঝতে পারছিলেন এবং সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন। তালুকদার বলছিলেন, দাদা, মোরা বুজি এহন ক্যাওই ক্যাওরে চিনি না, বুজি না। কী যে এক দেশভাগ অইলে, আর কী যে এক লোমের আজাদি পাইলাম, জানি না। আছিলাম হালইয়া চাষা, এহন অইছি তালুকদার। তমো লালসা যায় না। খালি হিন্দুগো ছাড়া-ভিডা খাওনের লালস। মোরা এহন হেই লালসে একে অন্যেরে হিংসা করি, সন্দেহ করি হা-আল্লা। বাবা বলছিলেন, ও কথা থাক। ও কথা বলে লাভ নেই। কাজের কথা বলি। যে যা-ই বলুক, আমি থাকতে তুমি প্রাণে মরবে না। এরা সবাই-ই আমাকে চেনে। তবে নিজে একটু বুদ্ধি খরচ করে চলতে চেষ্টা করো। পরের কথায় নেচো না। দাদির কথায়ও না। তিনি তোমার বিরুদ্ধে কোনো কেস করবেন না, সে ব্যবস্থা আমি করেছি। সব কথা তোমাকে বলতে পারব না, বললেও তুমি বুঝবে না। শুধু বুদ্ধিটা ঠিক রেখে চলবে।

কিন্তু বুদ্ধি তালুকদার ঠিক রাখতে পারেনি। বাবার সঙ্গে কথোপকথনের শব্দে বোধহয় জ্যাঠামশাইয়ের ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। দোতলার অলিন্দ থেকে তাঁর গম্ভীর কণ্ঠস্বর শোনা গেল, কে ওখানে?

: বড়দাদা, মুই তালুকদার।

: কখন এলে? কার সঙ্গে কথা বলছ?

: এই তো এহনই আইলাম। আইয়াই দাদারে উডাইসি। হেনার লগেই প্যানা পোটতে আছি।

: ভালো। তো ওদিকের খবর কী? সলিমুল্লাহ কী বলে?

: হে যা কয় কউক। মুই কী করুম কয়েন।

: তোমাকে কিছু করতে হবে না। যা করার আমি করব। তুমি তো জানোই ভোটে কারচুপি হয়েছে। নচেৎ জেতার কথা তো তোমারই। তাই মামলা একটা করতে হবে।

: কারচুপি তো অইছেই নাইলে দ্যাহেন, সলিমুল্লার যে ভোডগুলা বাতিল হওন জায়েজ, হেয়া এট্টাও অইলে না। আর মোর অতগুলা ভোট বেয়াক বাতিল ধরা অইলে, এডা কেমন বিচার?

: সেই কথাই তো বলছি। সেই কারণেই মামলা করা জরুরি। নাকি কও?

: মামলা করবে কেডা?

: কেন তুমি। নাকি ভয় পাচ্ছ?

: আপনে মাথার উপার থাকলে মুই ক্যারে ডরাই?

: ঠিক আছে। তুমি যাও। দেখি কী করা যায়। তালুকদার খুবই আশ্বস্ত হয়ে যাবার জন্য উঠে দাঁড়ায়। একটু ইতস্তত করে অলিন্দের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, বড়দাদা, আপনে কি মোরে অবিশ্বাস যায়েন? জনু, মোদাচ্ছের কাইল যেয়া কইলে, আল্লা জানে মোর হেরহম খাসলত কোনো দিন অইবে না। মুই জানি জমিদারি না থাকলে আপনেই মোগো রাজা। জ্যাঠামশাই এ কথায় বাড়ি কাঁপিয়ে এমন এক অট্টহাসি করলেন যে, অলিন্দের চৌখুপির কবুতরগুলো ভয়ে ঝটপট করে উড়ে গেল। বললেন, মিঞা, অন্যের মুখে ঝাল খাই না। আল্লার কুদরতে আমার চক্ষুজোড়া বেশ নজরদার। ভয় নেই। তুমি যাও। কালকের ঘটনার জন্য তোমাকে জেলে যেতে হবে না, কথা দিলাম, ইনশাল্লাহ। মুসলমানদের সঙ্গে কথা বলার সময় জ্যাঠামশাই এই ‘ইনশাল্লাহ’ শব্দটি প্রায়ই ব্যবহার করতেন, তবে ব্যঙ্গার্থে। তালুকদার আদাব আরজ করে চলে যাবার সময় বাবা আবার তাকে মনে করিয়ে দিলেন, ভাইটি, মামলা-ফ্যাসাদে যাবার আগে নিজের বুদ্ধি খরচ করে পাঁচবার ভেবো।

তালুকদার চলে গেলে বাবা জেঠামশাইকে বললেন, দাদা, মামলায় যেই জিতুক, তালুকদার তো শেষ হয়ে যাবে।

: ব্যাপারটা বুঝেছ তাহলে? কিন্তু ওকে তো আমি কোনো ফ্যাসাদে ফেললাম না, দেখতেই পাচ্ছ।

: এর থেকে বড় ফ্যাসাদ ওর আর কী হবে, আমি ভেবে পাচ্ছি না।

: সে ফ্যাসাদ তো ও নিজেই যেচে নিল, তুমি দেখলে। আমি জবরদস্তি তো কিছু করতে যাচ্ছি না।

: কিন্তু মামলা চালাতে গিয়ে ও তো শেষ হয়ে যাবে।

: শেষ হবে না। তবে হিন্দুদের ছেড়ে যাওয়া ভিটের রোজগারে ওর একটু গরম বেড়েছে। সেটা এবারে কিছু কমবে।

বাবা বুঝলেন, এই মামলা উপলক্ষ্য করে তাঁর দাদা পক্ষ-বিপক্ষ সবারই বিলক্ষণ ধনক্ষয় করাবেন, যে ধনের একটা মোটা অংশ তাঁর পকেটেই যাবে। এ ব্যাপারে তাঁর নীতিবোধের মাপকাঠিটি একেবারেই উনিশ শতকের, এমনকি বলতে গেলে মধ্যযুগীয় সামন্ত-সরদারদের মতো। অর্থোপার্জন তথা প্রতিশোধের কোনো পন্থাই তাঁর কাছে পরিত্যাজ্য নয়।

সকল অধ্যায়

১. বিষাদবৃক্ষ – ১
২. বিষাদবৃক্ষ – ২
৩. বিষাদবৃক্ষ – ৩
৪. বিষাদবৃক্ষ – ৪
৫. বিষাদবৃক্ষ – ৫
৬. বিষাদবৃক্ষ – ৬
৭. বিষাদবৃক্ষ – ৭
৮. বিষাদবৃক্ষ – ৮
৯. বিষাদবৃক্ষ – ৯
১০. বিষাদবৃক্ষ – ১০
১১. বিষাদবৃক্ষ – ১১
১২. বিষাদবৃক্ষ – ১২
১৩. বিষাদবৃক্ষ – ১৩
১৪. বিষাদবৃক্ষ – ১৪
১৫. বিষাদবৃক্ষ – ১৫
১৬. বিষাদবৃক্ষ – ১৬
১৭. বিষাদবৃক্ষ – ১৭
১৮. বিষাদবৃক্ষ – ১৮
১৯. বিষাদবৃক্ষ – ১৯
২০. বিষাদবৃক্ষ – ২০
২১. বিষাদবৃক্ষ – ২১
২২. বিষাদবৃক্ষ – ২২
২৩. বিষাদবৃক্ষ – ২৩
২৪. বিষাদবৃক্ষ – ২৪
২৫. বিষাদবৃক্ষ – ২৫
২৬. বিষাদবৃক্ষ – ২৬
২৭. বিষাদবৃক্ষ – ২৭
২৮. বিষাদবৃক্ষ – ২৮
২৯. বিষাদবৃক্ষ – ২৯
৩০. বিষাদবৃক্ষ – ৩০
৩১. বিষাদবৃক্ষ – ৩১
৩২. বিষাদবৃক্ষ – ৩২
৩৩. বিষাদবৃক্ষ – ৩৩
৩৪. বিষাদবৃক্ষ – ৩৪
৩৫. বিষাদবৃক্ষ – ৩৫
৩৬. বিষাদবৃক্ষ – ৩৬
৩৭. বিষাদবৃক্ষ – ৩৭
৩৮. বিষাদবৃক্ষ – ৩৮
৩৯. বিষাদবৃক্ষ – ৩৯
৪০. বিষাদবৃক্ষ – ৪০
৪১. বিষাদবৃক্ষ – ৪১
৪২. বিষাদবৃক্ষ – ৪২
৪৩. বিষাদবৃক্ষ – ৪৩
৪৪. বিষাদবৃক্ষ – ৪৪
৪৫. বিষাদবৃক্ষ – ৪৫
৪৬. বিষাদবৃক্ষ – ৪৬

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন