সৌভিক চক্রবর্তী
‘যাও কোমর জলে গিয়ে পুবমুখো হয়ে দাঁড়াও৷ আহা ওটা পুবদিক নয়৷ ওটা দক্ষিণ৷ সূর্য কোন দিকে দেখতে পাচ্ছ না? এত বড় ছেলে তালজ্ঞান একেবারে নেই দেখতে পাচ্ছি৷ অমন হড়বড় করছ কেন? মন শান্ত রাখতে হয় এ সময়ে৷’
ঠাকুরমশাইয়ের কথা শুনে নেমে যাচ্ছি কোমর জলে৷ নদীতে আজ বড় কুয়াশা৷ যত দূরে চোখ যায় সবই কেমন ঝাপসা ঝাপসা৷ দু’হাতের অনামিকায় কুশের আংটি পরিয়ে দিয়েছেন ঠাকুরমশাই৷ তিনি বলছেন, ‘বলো, ওঁ ব্রহ্ম তৃপ্যতাম ওঁ বিষ্ণু স্তৃপ্যতাম ওঁ রুদ্র স্তৃপ্যতাম ওঁ প্রজাপতি স্তৃপ্যতাম৷ তার পরে অঞ্জলি ভরে জল দাও৷’
ঠান্ডা লাগছে, গা শিরশির করছে৷ ঠাকুরমশাই বললেন, ‘এ বার বলো, ওঁ দেবা যক্ষাস্তুথা নাগা গন্ধবর্বাপ সরসোহসুরাঃ৷’
দূরে একটা নৌকোর ছই দেখা যাচ্ছে৷ বৈঠা যখন জলে পড়ে তখন অদ্ভুত একটা শব্দ হয়৷ ‘ছপ ছপ’ শব্দটা ভুল৷ ওটা অনেকটা যেন ‘গ্লপচ গ্লপচ’৷ শব্দ নিয়ে আমাদের অনেক ভুল ধারণা আছে৷ আমরা বলি ‘শোঁ শোঁ’ করে ঝড় হচ্ছে৷ অনেক দিন আগে বাবার হাত ধরে বিলমাঠে হাঁটছিলাম৷ ধান কাটা শেষ হয়েছে সদ্য৷ যত দূর চোখ যায় ধু ধু করছে ফাঁকা মাঠ৷ মাঝে মাঝে কয়েকটা বড় গাছের জটলা৷ তখনই ঝড় এল৷ বাবার সঙ্গে মাটিতে উবু হয়ে বসে পড়লাম৷ পিঠের ওপর দিয়ে দাপিয়ে ছুটছে ঝড়৷ বাবা বলেছিল, ‘রুখুবাবা, ঝড়ের কেমন শব্দ দেখেছিস?’ অবাক হয়ে সেদিন দেখেছিলাম, ‘শোঁ শোঁ’ নয়, ঝড় বয় ‘হায় হায়’ শব্দে৷
ঠাকুরমশাই ধমকে ওঠেন, ‘এই ছেলে তর্পণ করতে এসে কী আকাশপাতাল ভাবছ? মন্ত্র বলো৷’
কী ভাবছি কেমন করে বোঝাই ঠাকুরমশাইকে? শুনতে পাচ্ছি বাবা ডাকছে, ‘রুখুবাবাআআ…রুখুবাবাআআআ…এসে গেছি রে৷’
মহালয়া মানেই বাবা আর বাবা মানেই মহালয়া৷ মহালয়ার আগের দিন রাত থেকেই উত্তেজনায় ফুটতাম৷ গভীর রাতে বাবা আসবে আর সঙ্গে নিয়ে আসবে পুজোর জামাকাপড়৷ বাবা কী যেন একটা বিচ্ছিরি চাকরি করত কলকাতায়৷ সারা বছরই তেমন ছুটিছাটা নেই৷ মহালয়ার দিনেও না৷ গভীর রাতে এসে রাতটুকু কাটিয়ে পরের দিন সকাল সাড়ে সাতটার ফেরি ধরত বাবা৷ তার পরে আসত আবার সেই সপ্তমী পুজোর দিন৷
বড়আম্মার বয়স তিরানব্বই বছর৷ বড়আম্মা মানে বাবার ঠাম্মা৷ সে চোখে দেখে না, কিন্তু কানে শোনে পরিষ্কার৷ মহালয়ার আগের দিন সন্ধে হতে না হতেই শুরু হয়ে যেত তার ছটফটানি৷ ঘণ্টায় ঘণ্টায় হাঁক দিত, ‘বিশুরে, কয়টা বাজে? পোলাডা এত দেরি করে ক্যান?’
বিশু অর্থাৎ ঠাকুরদাদা বলত, ‘এখনই চেতাও ক্যান? সবে আটটা৷ পলু আসতে মধ্যরাত৷’
‘রেডিওটা কেমন ঘড়ঘড় করে৷ ব্যাটারি বদলানো লাগব৷’
‘সর্বক্ষণ কানে রেডিও চাইপা বইসা থাকলে ব্যাটারি তো ফুরাইবোই৷ হেরও তো একটা প্রাণ আছে না কি৷ ব্যাটারি তো অমর কোনও বস্তু না৷’
‘আমি রেডিও বাজাই বলে তোর এত জ্বলে ক্যান? তরে মানুষ করতে পারি নাই৷ বান্দর৷’
ঠাকুরদা চুপ করে যায়৷ কিছুক্ষণ পরে বড়আম্মা ফের ডাকেন, ‘বিশুরে, আগের বারে পলুরে কইছিলাম ব্যাটারি আনতে৷ মনে কইরা ঠিক আনব বল?’
‘চুপ করো তো মা৷ খালি ব্যাটারি আর ব্যাটারি? সগ্গে যাওয়ার সময়ে তোমার লগে এক ডজন ব্যাটারি দিয়া দিমু৷’
একটু একটু করে রাত বাড়ে৷ গাছের পাতা ইকড়িমিকড়ি ছায়া ফেলে উঠোনে৷ থেকে থেকে হাওয়া দেয়৷ সেই হাওয়ায় পাতা নড়ে আর উঠোনের নকশাগুলো ভেঙে ভেঙে যায়৷ দূর থেকে ভেসে আসে গান, ‘শেষে লগাটি হারিয়ে হাবুডুবু খেয়ে, মাঝ পাথারে পড়বা/ তুমি ভেবেছ কি মনে বিনা সাধনে ভবের নৌকায় চড়বা, ভবের নৌকায় চড়বা?’ গাইতে গাইতে সাইকেল চালিয়ে চলে যায় বৈকুণ্ঠকাকা৷ সুরগুলো আটকে থাকে পথের ধারে ঝোপেঝাড়ে৷ জোনাকিদের সঙ্গে তারাও জ্বলজ্বল করে৷
মা ডাকে, ‘রুখু খেতে আয়৷’ ঘুমে চোখ জুড়ে আসে৷ তবু জোর করে চোখ খুলে রাখার চেষ্টা করি৷ ছোটপিসি দলা করে খাইয়ে দেয়৷ খেতে খেতেই তার কোলে ঢুলে পড়ি অথচ বিছানায় শুলেই ঘুম কেটে যায়৷ জানলা দিয়ে তাকিয়ে থাকি বাগানের দিকে৷ রাত বাড়ে, রান্নাঘরে বাসন গোছানোর শব্দ পাই৷ মা আর ছোটপিসির টুকরো টুকরো কথা কানে আসে৷ ঠাকুরদাদা গলা ঝাড়ে৷ বড়আম্মা ডাক দেয়, ‘পোলাডা আইল রে? রাত কত হয়?’
মা ঘরে এসে খাটে বসে৷ গায়ে হাত রেখে দেখে ঘুমিয়েছি কি না? মটকা মেরে পড়ে থাকি৷ মা শোয় না, ঠায় বসে থাকে৷ যতক্ষণ না বাবা আসবে এ ভাবেই বসে থাকবে৷ মসজিদে এশার নমাজের আজান হয়৷ সেই শব্দের রেশ মিলিয়ে যেতে না যেতেই বেশ অনেকটা দূর থেকে বাবার গলা ভেসে আসে, ‘রুখুবাবাআআ…রুখুবাবাআআআ…এসে গেছি রে৷’
লাফ দিয়ে উঠে মাকে ডিঙিয়ে সদর দরজা খুলে ছুটতে শুরু করি৷ দু’হাতের ব্যাগগুলো মাটিতে ফেলে বাবা দু’হাত ছড়িয়ে দাঁড়ায়৷ চোখ বুজে ঝাঁপ দিই৷ মা, ঠাম্মা, ঠাকুরদাদা, ছোটপিসি সবাই বেরিয়ে আসে৷ মা আর ছোটপিসি ব্যাগগুলো তুলে নেয়৷ বাবার গলা ধরে ঝুলতে থাকি৷ বড়আম্মা চেঁচায়, ‘বিশুরে, এত চিল্লাফাল্লা ক্যান? পলু আইল? পলু? বিশুরে, ও বিশু, সাড়া দিস না ক্যান বান্দর?’
বাবার গায়ে হাত বোলায় বড়আম্মা৷ হাত দিয়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে বৃদ্ধ ঠাকুমা প্রবাসী নাতির কুশলপরিচয় বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করে৷ তার ঝাপসা দু’চোখের কোণে টলটল করে জল৷ বড়আম্মা বলে, ‘আরও রোগা হইছস তুই৷ এই বারে বৌমারে লইয়া যা৷ তর পোলাডারে ছাড়ুম না৷ অরে রাইখ্যা দিমু বাইন্ধা৷ ব্যাটারি আনছস পলু? রেডিওটা কেমন ঘড়ঘড় করে৷’
বাবা নতুন দু’টো ব্যাটারি বড়আম্মার হাতে ধরিয়ে দেয়৷ ছেলেমানুষের মতো খুশি হয়ে ওঠে বুড়ি৷
স্নান সেরে বাবা দাওয়ায় এসে বসে৷ একটা এমারজেন্সি লাইট এনে রাখা হয়৷ বাবাকে ঘিরে থাকে সবাই৷ ব্যাগ থেকে একে একে সবার জন্যে পুজোর জামাকাপড় বার করে বাবা৷ বলে, ‘সবার একটা৷ শুধু রুখু আর বোনুর জন্যে দু’টো করে৷’
মা তখন রান্নাঘরে আনাজ কাটে, হাঁড়িতে চাল ছাড়ে৷ ঠাকুরদা বলে, ‘যা পলু, বৌমার লগে কথা ক৷ আমরা আছি৷ তুই কথা কইয়া আয়৷’
উঠোনের শিউলি গাছ থেকে টুপটুপ ঝরে পড়ে ফুল৷ দাওয়ায় আসনপিঁড়ি হয়ে খেতে বসে বাবা৷ মা ভাত বেড়ে দেয়৷ ঠাম্মা আর ছোটপিসি হাওয়া করে৷ শিউলি ফুলের সঙ্গে মিশে যায় গরম ভাতের গন্ধ৷ এ গন্ধের সঙ্গে পৃথিবীর আর কোনও সুগন্ধের তুলনা চলে না৷
তার পরে শেতলপাটি বিছিয়ে সবাই উঠোনে গোল হয়ে বসি৷ বড়আম্মাকে ধরে ধরে এনে বসানো হয় একটা চেয়ারে৷ মাঝখানে রাখা হয় রেডিওটা৷ রেডিওর চারপাশে ছোটপিসি শিউলি ফুল দিয়ে সাজায়৷ নব ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চ্যানেল ধরে ঠাকুরদাদা৷ এমারজেন্সিটা নিভিয়ে দেওয়া হয়৷ মরা রাতের আলো ছড়িয়ে থাকে উঠোনময়৷ আশ্চর্য এক হাওয়া তার জলহাত বুলিয়ে দেয় গালে কপালে আর ঠিক তখনই নতুন ব্যাটারি পেয়ে চাঙ্গা হয়ে ওঠা বড়আম্মার সাধের রেডিও গান ধরে, ‘বাজল তোমার আলোর বেণু/ মাতল রে ভুবন…৷’ সে কেমন এক আশ্চর্য সুর৷ বছর বছর শুনি তাও পুরনো হয় না৷ বুঝতে পারি আনন্দ আর বেদনা হাত ধরাধরি করে এসে দাঁড়িয়েছে সদর দরজার পাশটিতে৷ তাদের অভ্যর্থনা করতেই যেন জলদমন্দ্র স্বরে একটা লোক বলে ওঠে, ‘আশ্বিনের শারদ প্রাতে বেজে উঠেছে আলোকমঞ্জীর, ধরণীর বহিরাকাশে অন্তর্হিত মেঘমালা…৷’
বুঁদ হয়ে বসে থাকে কয়েকটা মানুষ৷ তারা চায় সারা জীবন ধরে চলুক এই মহিষাসুরমর্দিনী৷ কারণ এটা শেষ হলেই ঘরের ছেলেটা রওনা দেবে ফেরিঘাটের দিকে৷ লোকে দেখবে, নদীর পাড় দিয়ে ছুটছে একটা বাচ্চা ছেলে আর নৌকোয় দাঁড়িয়ে একটা মাঝবয়সি লোক চেঁচাচ্ছে, ‘রুখুবাবাআআআ…সপ্তমীতে আসব রে রুখুবাবাআআআ…ছুটিস না, পড়ে যাবি যে…’
ঠাকুরমশাই রেগে যাচ্ছেন, ‘আরে হলটা কী? বলো, সবের্ব তে তৃপ্তিমায়াস্তু মদ্দত্তেনাম্বুনা সদা৷’
কিছু বলার নেই৷ কিচ্ছু বলার নেই৷ বাচ্চা ছেলেটা এখন নদীর পাড় ধরে ছুটছে৷ এখনই আটকাতে না পারলে নৌকোটা ঝড়ে পড়বে৷ ঝড় আসে ‘হায় হায়’ শব্দে৷
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন