নদীর নামটি আত্রেয়ী – সৌভিক চক্রবর্তী

সৌভিক চক্রবর্তী

নদীর নামটি আত্রেয়ী

তুই মিষ্টি খেতে ভালবাসিস?

মিষ্টি?

হ্যাঁ৷ তাই তো বললাম৷

সেটা পরিস্থিতির ওপরে ডিপেন্ড করছে৷

মানে!

মানে ধরো, যদি বিজয়ার পরে বড়মাসির বাড়িতে মিষ্টি খাওয়া হয়, তা হলে ভালবাসি না৷ আর যদি এই হিমঝরা সন্ধেবেলায় নিউ জার্সিতে তোমার অ্যাপার্টমেন্টে বসে মিষ্টি খাওয়া হয়, তা হলে ভালবাসি৷

ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা বলা স্বভাবে দাঁড়িয়ে গেছে৷ সোজা কথায় কিছু বলতে পারিস না?

পারি তো৷ শুনবে?

না থাক৷ আমার আর শুনে কাজ নেই৷ তুই পা তুলে বোস৷ ঠান্ডা লাগবে৷

তোমার এত দামি সোফায় আমার এই চাষার পা তুলে বসলে সেটা খুব খারাপ দেখতে লাগবে৷

খারাপ লাগা, ভাল লাগা এ সব নিয়ে তুই আবার মাথা ঘামাচ্ছিস কবে থেকে?

আমারও তো বয়েস হচ্ছে, রাত-বিরেতে কাশি৷ কাশির দমক থামলে কিন্তু…

বাঁচতে ভালবাসি৷

বাঁচতে তোমার ভাল লাগে শ্রীতমাদি?

জানি না রে৷ কখনও ভেবে দেখিনি৷ ইনফ্যাক্ট ভেবে দেখার সময় পাইনি৷ সেই কবে থেকে যন্ত্রের মতো দৌড়চ্ছি৷ দৌড়তে দৌড়তে হাঁফ ধরে গেছে কত দিন আগে৷ কিন্তু দম ফেলার সময় নেই৷ যে দিন সময় পাব সে দিন বসে সবার আগে এটাই ভাবব, বাঁচতে ভালবাসি কি না?

তা হলে বললে কেন?

ও তো কথার কথা৷

কথার কথা জিনিসটা কিন্তু খুব একটা সোজা নয়৷

জানি৷ তাও বলে ফেলি মাঝে মাঝে৷ তোর খিদে লেগেছে?

না এখনও লাগেনি৷ রাতে কী খাওয়াচ্ছ?

স্মোকড চিকেন উইদ ব্ল্যাক বিনস, সসেজ আর ম্যাশড পোট্যাটো৷

ম্যাশড পোট্যাটো মানে তো আলু সেদ্ধ?

গাঁইয়ার মতো কথা বলবি না৷

আমি গাঁইয়া তো তোমার কী? তোমার নতুন প্রেমিক বুঝি বিরাট আমেরিকান?

অবশ্যই! নয়তো আমি থোড়াই পাত্তা দিতাম!

বাহ! তোমার তো দারুণ উন্নতি হয়েছে৷ ভেরি গুড৷ কই তার ছবি দেখাও৷ এ মা, এ তো মোটেই আমেরিকান নয়৷ এ তো পাতি ইন্ডিয়ান৷ মানকুন্ডুর ছেলে বলে মনে হচ্ছে৷

মানকুন্ডু বললি কেন?

দ্যাখো মানকুন্ডুতে তো পাগলাগারদ ছিল৷ ওখানকার জলে পাগলামির বীজ আছে৷ তাই মানকুন্ডুর ছেলেমেয়েদের চোখেমুখে একটা ক্যালানে, খ্যাপাটে ভাব থাকে৷ যেমন তোমার প্রেমিকের আছে৷

ফর ইয়োর কাইন্ড ইনফরমেশন অনুব্রত বর্ন অ্যান্ড ব্রট আপ ইন ক্যালিফোর্নিয়া৷ তবে ওর বাবা ছোটবেলায় ভদ্রেশ্বরে থাকত৷

দেখেছ? দেখেছ? কেমন মিলিয়ে দিলাম? ভদ্রেশ্বর আর মানকুন্ডু গায়ে গায়ে৷ আমার চোখকে ফাঁকি দিতে পারবে না৷ হাসছ যে বড়? তবে তোমার এই প্রেমিককে কিন্তু অত্যন্ত বাজে দেখতে৷ দাঁত উঁচু, ঝাঁটা গোঁফ, বয়সে তোমার দ্বিগুণ৷

এক চড় মারব বাঁদর ছেলে৷ তুই নিজে যেন একেবারে কন্দর্পকান্তি!

তাতে কী হল? একটা মোটা লোক বুঝি আর একটা মোটা লোককে মোটা বলতে পারে না?

না পারে না৷ খালি বাজে কথা৷

আচ্ছা বাদ দাও৷ কী করে তোমার প্রেমিক?

হি ইজ আ ম্যাথেমেটিশিয়ান৷

গণিতজ্ঞ? ওই জন্যেই চুলগুলো ও রকম খাড়া খাড়া৷ মাথার ভেতরে রাশি রাশি এক্সপোনেনশিয়াল জট পাকিয়ে গেছে৷

তুই এক্সপোনেনশিয়ালও জানিস?

এ আবার কেমন কথা? বাংলা পড়েছি বলে অঙ্কের টার্ম জানতে নেই?

ঘাট হয়েছে বাবা৷ কিন্তু তুই হঠাৎ আমার প্রেমিককে নিয়ে এত জাজমেন্টাল হয়ে পড়লি কেন?

ব্যাপারটা তো ভাইসি ভার্সা শ্রীতমাদি৷

মানে?

ন্যাকামি কোরো না প্লিজ৷ প্রিয়তম নারীটিকে ন্যাকামি করতে দেখলে আমার অসহ্য হয়৷

কী বলতে চাইছিস পরিষ্কার করে বল৷

আমি সংযুক্তার কথা বলছি শ্রীতমাদি৷ আমি তোমায় সংযুক্তার ছবি পাঠিয়েছিলাম৷ তুমি তখন আমাকে বলেছিলে, এই মেয়েটাকে অবিকল শাঁকচুন্নির মতো দেখতে৷ দেখেই মনে হয় কোনও শিক্ষা-দীক্ষা নেই৷ আনকালচার্ড আরবানাইজড বাগার৷ শুধু গায়ের রং দেখে মজে গেলি পিপলু? তোর এই অধঃপতন আমি সহ্য করতে পারছি না৷ দূর হয়ে যা চোখের সামনে থেকে৷ এই বলে তুমি আমায় ব্লক করে দাওনি?

সে তো দু’দিনের জন্যে৷

দু’দিন হোক আর দশ দিন৷ ব্লক তো করেছিলে৷ শুধু তাই নয়, সংযুক্তার সঙ্গে আমার যে সম্পর্কটা হতে হতে হল না, তার পেছনে কলকাঠি কে নেড়েছিল জানি না ভেবেছ?

কী জানিস তুই?

সংযুক্তা আমাকে তোমার চ্যাটগুলো দেখিয়েছিল৷ তুমি অবশ্য জানতে যে সংযুক্তা আমাকে সব দেখিয়ে দিতে পারে৷ তার পরেও তুমি ভাঙচি দিতে কসুর করোনি৷ তুমি এক বারও ভাবনি যে আমার কী রিঅ্যাকশন হতে পারে৷ কেন ভাবনি আমি জানি৷

কেন?

কারণ আমি তোমার কনফিডেন্সের লোক৷

সব জেনে বসে আছিস দেখতে পাচ্ছি৷

আছিই তো৷ তোমাকে তো আমি হাড়ে হাড়ে চিনি শ্রীতমাদি৷

বেশি চিনেই তো সর্বনাশটা হয়েছে৷ এতটা চিনতে দেওয়া ঠিক হয়নি, এখন বুঝতে পারছি৷

বুঝতে পেরেছ যখন শুধরে নাও৷

উপায় নেই পিপলু৷ আর উপায় নেই৷ সেটা জানিস বলেই আমাকে এতগুলো কথা শুনিয়ে দিলি৷

সরি৷ তবে সংযুক্তাকে কাটিয়ে দিয়ে তুমি ভালই করেছ৷ আমি থাকতে পারতাম না ওর সঙ্গে৷

সে তুই কারও সঙ্গেই থাকতে পারবি না৷ নিজেকে যারা অতিরিক্ত ইমপরট্যান্স দেয় তারা কারও সঙ্গেই থাকতে পারে না৷

যেমন তুমি?

আমি আবার কবে নিজেকে বেশি ইমপরট্যান্স দিলাম?

সে বলতে পারব না, কিন্তু তুমি কেন কারও সঙ্গেই বেশি দিন থাকতে পারছ না?

তোর খুব মজা লাগে তাই না রে?

মজা লাগে মানে? বিরাট মজা লাগে৷ তোমার ব্রেক আপের খবর পেলে আমি তো সত্যনারায়ণের সিন্নি চড়াই৷ জানো না?

এসে থেকে ঝগড়া করছিস কেন পিপলু? এ রকম অসভ্য কেন তুই?

আচ্ছা আর কিছু বলব না যাও৷ এসো পায়ে হাত বুলিয়ে দিই৷ পা দু’টো এগিয়ে দাও৷

অমনি নরম জায়গাটায় ঘা দিয়ে দিলি৷ এসব শয়তানিগুলো তো খুব রপ্ত করেছিস৷

তোমার মনে আছে শ্রীতমাদি?

মনে থাকবে না? বলিস কী তুই৷ আমি কী ট্যালা ছিলাম তাই না?

সে এখনও আছ৷

চুপ কর তুই৷ আমি এখন অনেক দেখেশুনে হাঁটাচলা করি৷ ছোটবেলার মতো দুমদাম পড়ে যাই না৷

আচ্ছা সেদিন তুমি কী ভাবতে ভাবতে হাঁটছিলে বলো তো? ভাবলে আজও আমার হাসি পায়৷ আমি তো মেন বিল্ডিংয়ের সিঁড়ির ওপরে বসে আছি৷ হঠাৎ দেখি একটা সুন্দরমতো মেয়ে আকাশপানে তাকিয়ে হন হন করে হাঁটছে৷ আমি সবে ভেবেছি, এই রে! নির্ঘাৎ পড়বে৷ তুমি যেন আমার মনের কথাটা শুনতে পেলে আর পায়ে পায়ে জড়িয়ে আশ্চর্য হাস্যকর ভাবে আছাড় খেলে৷

চুপ করবি তুই?

আমি তো দৌড়ে গেছি তুলতে৷

মিথ্যে কথা৷ তুই তখন সিঁড়িতে বসে হো হো করে হাসছিলি৷ আমি তোর দিকে তাকাতে তার পরে এগিয়ে এলি৷ তোকে হাসতে দেখে আমার তো তখন বিরাট রাগ ধরে গেছে৷ মনে হচ্ছে এক চড় মারি৷ কিন্তু পায়ে এত ব্যথা করছে যে চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে আসার উপক্রম৷ তুই আমার কাছে এসে গম্ভীর মুখে বললি, বিশ্বাস করুন আপনাকে দেখে হাসিনি৷ আমার হঠাৎ ওই কথাটা মনে পড়ে গেল৷ আমি বললাম, কোন কথাটা? তুই বললি, একজন লোকের এক হাতে সাজিমাটি আর অন্য হাতে কুলপি বরফ৷ এবার সে লোকটা কুলপি খেতে গিয়ে ভুল করে সাজিমাটি খেয়ে ফেলেছে৷ বলেই তুই আবার হাসতে লাগলি৷ হাসতে হাসতে তোর চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে গেল৷ তুই পেট চেপে ধরে আমার পাশে মাটিতে বসে পড়লি৷ তোকে ওভাবে হাসতে দেখে আমিও তখন হাসছি৷ লোকজন এসে দেখল, তিন ব্যাচ জুনিয়র একটা ছেলে আমার পায়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আর আমরা দু’জনে পাগলের মতো হাসছি৷ ভাব তো কী বিশ্রী ব্যাপার৷

বিশ্রীর কী আছে?

আছেই তো৷ তার পরেই তো তোর হাতের প্রেমে পড়ে গেলাম৷ ওরকম নরম হাত কোনও পুরুষ মানুষের হয়? তুই যখন আমার পায়ে হাত বোলাচ্ছিলি, আমার মনে হচ্ছিল কেউ যেন ব্লটিং পেপার দিয়ে আমার সমস্ত বেদনা শুষে নিচ্ছে৷ আমি যেন কেমন একটা! হাত দেখে কেউ প্রেমে পড়ে বল তো?

না পড়ার কী আছে? তথাগত একবার মুক্তি পেতে পেতেও পাননি, তাঁকে ফের জন্মাতে হয়েছিল৷ কারণ তখনও পর্যন্ত কারও নাক দেখে প্রেমে পড়ার অভিজ্ঞতা ছিল না তাঁর৷ আর অভিজ্ঞতার ভাঁড়ার পূর্ণ না হলে যে নির্বাণ হয় না৷ তাই তথাগত যদি নাক দেখে প্রেমে পড়তে পারেন তা হলে হাত দেখে র‌্যাদার হাতের স্পর্শ পেয়ে তোমার প্রেমে পড়া জায়েজ৷

বলছিস?

একদম৷

বেশ হাত দু’টো দে তা হলে৷

হাত নিয়ে কী করবে শ্রীতমাদি?

চোখে মুখে মাখব৷ এক লক্ষটা চুমু খাব আর…

তোমার প্রেমিক যদি জানতে পারে?

জানলে জানবে৷ আমি তো আর কোনও মানুষের সঙ্গে প্রেম করছি না৷ আমি দু’টো হাত, আরও স্পেসিফিক্যালি বলতে গেলে দু’টি করতলের সঙ্গে সোহাগ করছি৷ হাতকে ভালবাসাও কি দোষের?

তুমি কায়দা করে আমাকে সত্যবদ্ধ করিয়ে নিতে চাইছ৷

কীভাবে?

তুমি জানো না, যে হাতে নীরার মুখ ছোঁয়া হয়, সে হাতে পাপ করতে নেই? যে ওষ্ঠ বলে নীরাকে ভালবাসি, সে ওষ্ঠে আর কোনও মিথ্যে মানায় না?

জানি৷ হলিই বা সত্যবদ্ধ৷ ক্ষতি কী?

ক্ষতি আছে৷ যে হাত নীরার মুখ ছুঁয়েছিল সে হাতে আর কখনও পাপ করেননি কবি৷ কিন্তু আমি তো এ হাতে আরও পাপ করব ভবিষ্যতে৷ আমি তো আর কবি নই৷

তুই কবি নোস?

কখনওই না৷ আমি গল্পকার৷ সাহিত্যের দুনিয়ায় দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক৷ সমারসেট মম কী বলেছেন জানো?

কী বলেছেন?

বলেছেন, একজন কবি যখন হাঁটেন তখন একজন গল্পকার তাঁকে দেখে রাস্তা ছেড়ে দাঁড়ায়৷ তাই কবিদের দেখলেই আমি রাস্তার এক পাশে সরে দাঁড়াই৷ যেখানে রাস্তা সরু সেখানে খানা খন্দেও নেমে দাঁড়াতে হয় কখনও কখনও৷ এই করতে গিয়ে আমার বহু প্যান্ট নোংরা হয়েছে৷ কিন্তু কী করব বলো? মমের মতো লোকেদের কথা তো আর ফেলে দেওয়া যায় না৷ ওঁরা মুর্শিদ৷ তাই না?

বাজে কথার শিরোমণি তুই একটা৷

আচ্ছা বাদ দাও৷ কিন্তু যে কথাটা বলার জন্যে টিকিট পাঠিয়ে, ভিসা করিয়ে আমাকে এভাবে কলকাতা থেকে নিউ জার্সিতে উড়িয়ে নিয়ে এসেছ, সেটা কিন্তু এখনও বললে না৷ এসে পৌঁছেছি তাও প্রায় চব্বিশ ঘণ্টা হতে চলল৷

তার মধ্যে তো জেট ল্যাগের দোহাই দিয়ে কুড়ি ঘণ্টা ঘুমিয়েছিস পিপলু৷

মানলাম৷ কিন্তু এ বারে তো বলো৷

বলব৷ বলব বলেই তো নিয়ে এলাম তোকে৷ কিন্তু আর একটু সময় দে আমাকে৷ খুব সোজা কথা নয়৷

দিলাম৷ আচ্ছা ওই জানলাটা খুলে দেওয়া যায় না? কী আছে ওদিকে?

নদী৷ আমার সঙ্গে নদীর ধারে একটু হাঁটবি পিপলু?

হাঁটব তো৷ বড় সুন্দর তোমার এই অ্যাপার্টমেন্টটা৷ একদম নদীর গা ঘেঁষে৷

অনেক খুঁজে খুঁজে তবে পছন্দ হয়েছে জায়গাটা৷ ভাড়াটা একটু বেশিই দিতে হয় সে জন্যে৷ কিন্তু পয়সা তো খরচ করার জন্যেই বল?

ঠিক৷

নদীটার নাম জানিস পিপলু?

জানি৷ হাডসন৷

কী করে জানলি?

সবাই জানে নিউ ইয়র্ক আর নিউ জার্সির পলিটিক্যাল বর্ডার হাডসন রিভার৷

নদীটার জন্ম কোথায় জানিস?

না, এতটাও ভূগোলবিদ নই আমি৷

সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় সাড়ে চার হাজার ফুট ওপরে আদিরনডাক পাহাড়ের ওপরে একটা হ্রদ আছে৷ তার নাম লেক টিয়ার অব দ্য ক্লাউডস, মানে মেঘের অশ্রু৷ সেখানেই জন্ম এই নদীটার৷ কী সুন্দর না নামটা?

হুঁ৷ মেঘের অশ্রু৷

একটু পরেই দেখবি আলোর মালায় সেজে উঠবে নিউ ইয়র্ক শহর৷ তোর ভাল লাগছে হাঁটতে?

যে কোনও নদীর ধারে হাঁটতেই আমার ভাল লাগে৷ তোমার মনে আছে বালুরঘাটের কথা? নদীটার নাম কী ছিল বলো তো?

আত্রেয়ী৷ সেই প্রথম বার আমার অত কাছ থেকে নদী দেখা৷ নদী তো তার আগে কত দেখেছি৷ কিন্তু ওভাবে কখনও নিবিড় ভাবে নদীকে বুঝিনি৷ আমার উঠতেই ইচ্ছে করছিল না৷ তুই কী সব গাঁজাখুরি গল্প শুনিয়ে জোর করে তুলে নিয়ে এলি৷

গাঁজাখুরি নয় গো, সত্যি৷ জ্যোৎস্না রাতে পরীরা নেমে আসে আত্রেয়ী নদীর ধারে৷ তারা নদীতে মাছ ধরে৷ নদীর ধারে উনুন জ্বালিয়ে তুলাইপাঞ্জি চালের ভাত আর মাছ ভাজা খায়৷ তার পরে জামাকাপড় খুলে উদোম হয়ে স্নান করে৷ সেই অপার্থিব স্নানদৃশ্য মানুষের দেখার নিয়ম নেই৷

নদীর স্রোতের মধ্যে অদ্ভুত একটা ব্যাপার আছে জানিস? এখানে বেশির ভাগ সময়টাই তো একা৷ তখন ওভেনে রান্না চড়িয়ে জানলা দিয়ে নদীর দিকে তাকিয়ে থাকি৷ তাকিয়ে থাকতে থাকতে যত পুরনো দিনের কথা ছবির মতো চোখের সামনে চলে আসে৷ মনে হয়, ঘটনাগুলো সব চোখের সামনে ঘটছে৷ হাত বাড়ালেই ধরতে পাব৷ সেদিন কী দেখলাম বল তো?

কী দেখলে?

সেই দোলের দিনটা৷ আমার তো রঙে অ্যালার্জি হয়৷ আর তুই রং মাখাবিই মাখাবি৷ কিছুতে কথা শুনছিস না৷ শেষে আমি খুব রেগে গেলাম তোর ওপরে৷ তার পরে কী করেছিলি তোর মনে আছে?

তোমাকে জাপটে ধরে কামড়ে দিয়েছিলাম ঘাড়ে৷ বলেছিলাম, এই নাও ন্যাচারাল কালার৷ এতে অ্যালার্জি হয় না৷

তুই একটা জানোয়ার৷ সেই দাগ ঢাকতে আমাকে ঘাড়ে আবির মাখতেই হল৷ পরের তিন দিন হাই নেক পরতে বাধ্য হলাম৷ প্যাচপ্যাচে গরমে হাইনেক পরে ঘুরে বেড়াচ্ছি৷ কী আনন্দের বিষয়!

আমার জন্যে তোমায় কত জ্বালাতন পোহাতে হয়েছে বলো?

সে আর বলতে? এত দূরে চলে এসেও তো রেহাই পাইনি৷ এখনও ছিনে জোঁকের মতো সেঁটে রয়েছিস৷ কিছুতেই তোকে ঘাড় থেকে নামাতে পারছি না৷

ঘাড় থেকে নামাতে চাও তাই না? তাই জন্যে বুঝি সেদিন না জানিয়ে কলকাতা থেকে চলে এসেছিলে? একটা খবর অবধি দাওনি৷ লোকের মুখে খবর পেয়েছি৷ টানা এক বছর কোনও যোগাযোগ রাখনি৷ তার পরে তোমার যখন ইচ্ছে হয়েছে যোগাযোগ করেছ৷ তুমি তো জানতে, তুমি ডাকলে আমি না করতে পারব না৷ সেটার সুযোগ নিয়েই এক বছর ধরে প্রত্যেক দিন… কতবার মনে হয়েছে, আমেরিকায় এসে তোমায় খুঁজব৷ কিন্তু গল্প লিখে আর টিউশন পড়িয়ে ক’টা টাকা হয় বলো? টিকিট কাটার সামর্থ্য ছিল না৷ অবশ্য এখনও নেই৷

চুপ কর প্লিজ৷

চুপ করার তো কিছু নেই৷ আমি জানি আমি তোমার ঘাড়ে উঠে বসে আছি৷ তুমি টাকা না পাঠালে আমার নতুন জিন্স কেনা হত না৷ পারফিউম মাখা হত না৷

কী বলছিস এগুলো? ওগুলো তো গি�৷ গি� নিয়ে এভাবে কেউ কথা শোনায় পিপলু? তুই কি সিনিক হয়ে গেছিস না কি?

হ্যাঁ হয়ে গেছি৷ সিনিক হওয়াটাই তো স্বাভাবিক৷ তুমি আমার টিকিট করে দাও৷ আমি চলে যাব৷

চলে যাওয়ার চেষ্টা করে দ্যাখ৷ ঠ্যাঙ ভেঙে ফেলে রেখে দেব৷ এটা তোর কলকাতা না, নিউ জার্সি৷ কোনওরকম ট্যাঁ ফো করতে পারবি না৷ যদি বেশি বাড়াবাড়ি করিস খুন করে নদীতেও ফেলে দিতে পারি৷

এটা বেটার অপশন৷

বেটার অপশন?

হ্যাঁ৷ নদীর জলে চাঁদের আলো পড়তে দেখেছ? কেমন টুকরো টুকরো হয়ে যায় না চাঁদটা? ওই টুকরোগুলো কী জানো?

কী?

ভালবাসতে গিয়ে যাদের মৃত্যু হয়েছে তারা ওরকম আলো হয়ে ভেসে বেড়ায় নদীতে৷ তোমায় একটা গল্প বলি শোনো৷ আমার এক কাকা ছিল৷ আমরা বলতাম সোনাইকাকা৷ সোনাইকাকা একটা মুসলমান মেয়েকে ভালবেসেছিল৷ কিন্তু সেটা হঠাৎ জানাজানি হয়ে গেল৷ আমাদের ফ্যামিলি আবার গোঁড়া ব্রাহ্মণ৷ তার ওপরে খুব ইনফ্লুয়েন্সিশাল৷ রাতারাতি মেয়েটার বিয়ে দিয়ে দেওয়া হল অন্য একটা মুসলমান ছেলের সঙ্গে৷ বিয়ের দু’ দিন পরে মেয়েটা বিষ খেল৷ সোনাইকাকা রোজ সকালবেলা আমাদের ভাইবোনেদের পড়াত৷ পড়াতে পড়াতে নানারকম ধাঁধা জিজ্ঞেস করত৷ সেদিন সবে একটা ধাঁধা বলেছে, তখনই সোনাইকাকার এক বন্ধু সাইকেলে করে এসে মেয়েটার মৃত্যুর খবর দিল৷ পরে শুনেছি, সোনাইকাকা প্ল্যান করেছিল, মেয়েটাকে নিয়ে পালাবে৷ কিন্তু মেয়েটা আর ধৈর্য্য রাখতে পারেনি৷ তার আগেই…৷ তো সেই কথা শুনে সোনাইকাকা আমাদের বলল, তোরা ধাঁধার উত্তরটা ভাব, আমি আসছি৷ এই বলে সেই যে গেল, এক ঘণ্টা হয়ে গেল, দু’ ঘণ্টা হয়ে গেল, ফিরল না৷ সারা বাড়িতে হইচই পড়ে গেল৷ কোথাও নেই সোনাইকাকা৷ সোনাইকাকার বন্ধুরা খুঁজতে বেরল, আশেপাশের পুকুরে জাল দেওয়া হল, কোথাও কিছু নেই৷ সারাটা রাত বাড়ির সবাই জেগে রইল৷ আমাদের বাচ্চাদের যদিও ঢালা বিছানায় শুইয়ে দেওয়া হয়েছিল৷ তাও কি ঘুম আসে? আমরাও চোখ মিটমিট করে জেগে রইলাম৷ রাত কেটে ভোরের আলো ফুটে গেল৷ তবু সোনাইকাকা ফিরল না৷

তার পর?

পরের দিন সকালবেলা পুজো দেওয়ার জন্যে ঠাকুরঘরে ঢুকতেই ঠাম্মা মাথায় জোর ধাক্কা খেল৷ সোনাইকাকা ঝুলছে ঠাকুরঘরের সিলিং থেকে৷ এই ঘরটাই কেউ খুঁজে দেখেনি৷ সোনাইকাকা সেদিন যে ধাঁধাটা দিয়েছিল সেটা হল, ‘বন থেকে বেরল টিয়ে/ সোনার টোপর মাথায় দিয়ে৷’ এর উত্তরটা আজও আমার জানা হয়নি৷ কবে থেকে আমি এই উত্তরটা খুঁজে বেড়াচ্ছি৷ তুমি যদি আমাকে খুন করে নদীতে ফেলে দাও তা হলে সোনাইকাকার সঙ্গে আমার দেখা হয়ে যাবে আর উত্তরটা আমি জেনে নিতে পারব৷ এই কী হল? তুমি কাঁদছ কেন? কেঁদো না প্লিজ৷ আই অ্যাম সরি৷ এক্সট্রিমলি সরি ফর মাই বিহেভিয়ার৷

পিপলু যারা ভালবাসতে গিয়ে মারা যায় তারা তো আলো হয়ে ভেসে বেড়ায় নদীতে৷ আর যারা দু’টো মানুষের অসময়ের ভালবাসার বলি হয়? যারা এই পৃথিবীর আলো দেখার আগেই হারিয়ে যায় তাদের কী হয় পিপলু?

তারা ঝোপেঝাড়ে জ্বলতে থাকে জোনাকির মতো৷ প্লিজ আর কেঁদো না৷ এবারে শরীর খারাপ করবে৷

আমাকে এমন একটা ঝোপের কাছে নিয়ে যাবি পিপলু, যেখানে জোনাকিরা আলো হয়ে থাকে? আমাকে যে একটি বার সরি বলতে হবে৷ আমাকে তোর কাছেও সরি বলতে হবে৷ সে জন্যেই তোকে এখানে নিয়ে এসেছি৷ পিপলু৷ সরি পিপলু, সরি৷ প্লিজ ফরগিভ মি৷

কী বলছ তুমি? আমি কিছুই বুঝতে পারছি না৷

আমি এমনি এমনি তোকে না জানিয়ে আমেরিকা চলে আসিনি পিপলু৷ আসলে আমি বুঝতে পেরেছিলাম, তোর দেওয়া সবচেয়ে সুন্দর উপহারটা আমি কিছুতেই রাখতে পারব না৷ আমাকে সেটা নষ্ট করে দিতে হবে৷ আর কলকাতায় বসে সেটা করার চেয়ে আমেরিকায় বসে করা আমার পক্ষে সহজ হবে৷ আমার সব গুলিয়ে যাচ্ছে৷ প্লিজ হেল্প মি৷

আমি যখন বুঝতে পারি তখন ও ছয় সপ্তাহের৷ আমেরিকায় আমার এক ডাক্তার বন্ধু আছে৷ সে ছোট্ট একটা অপারেশন করেছিল৷ তোর দেওয়া উপহারটা আমি নষ্ট করে দিতে বাধ্য হয়েছিলাম সেদিন৷ সরি পিপলু৷

আমাকে এতদিন বলনি কেন? অবশ্য ভালই করেছ বলনি৷ শুনে আমি কী করতাম? জন্ম দিলেই যদি বাপ হওয়া যেত তা হলে তো হয়েই যেত৷ বাপ হওয়ার মতো কোন যোগ্যতাটা আছে আমার?

আমারও সেদিন মা হওয়ার যোগ্যতা ছিল না৷ তাই বাধ্য হয়ে৷ যদি ও ঠিক সময়ে জন্মাত, তা হলে আজ ওর এক বছরের জন্মদিন৷ এই দিনটা আমার পক্ষে একা থাকা সম্ভব হত না৷ তাই বাধ্য হয়ে তোকে ডেকে এনেছি৷ আমাকে ক্ষমা কর পিপলু৷ গত দেড় বছর ধরে এই যন্ত্রণা আমি একা একা বয়ে বেড়াচ্ছি৷ এবারে আমার কষ্টের ভাগ নে প্লিজ৷ আমি আর পারছি না৷

কেঁদো না৷ চলো ঘরে চলো৷

একটা প্রমিস করবি পিপলু?

না৷

প্লিজ পিপলু৷ আই বেগ ইউ৷ আমাকে আর একবার এই উপহারটা দিবি প্লিজ? বিশ্বাস কর, আমি এবার ঠিক যত্ন করে রাখব৷ নষ্ট করব না৷

মানে?

আমাকে বিয়ে করবি পিপলু?

এই দাঁড়াও দাঁড়াও৷ কী সব বলছ তুমি?

আই অ্যাম সিরিয়াস৷ অনেক হয়েছে পিপলু৷ গত আট বছর ধরে তোর আর আমার এই টম অ্যান্ড জেরি খেলাটা চলছে৷ এবারে শেষ কর প্লিজ৷

আরে পাগল হয়ে গেলে না কি? মাথা ঠান্ডা করো৷ আমি একটা বেকার ছেলে৷ বিয়ে করব কি গো? তার ওপরে তোমার মতো বিদুষী পাত্রী! বদহজম হয়েই মরে যাব৷ আমার এখনই গা গোলাচ্ছে৷

কেন বউয়ের পয়সায় খেতে তোর সম্মানে লাগবে?

মোটেই না৷ আমি তো চিরকাল এটাই স্বপ্ন দেখে এসেছি যে বউয়ের পয়সায় বসে বসে খাচ্ছি৷ কিন্তু এখানে আমায় থাকতে দেবে না কি? আমি এক মাসের ভিসা নিয়ে এসেছি শ্রীতমাদি৷

আমিও এ মাসের শেষে কলকাতা যাব৷ এদিকের কাজ শেষ৷

মানে? কেন? তোমার পোস্ট ডক?

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে আমি পড়ানোর চাকরি পেয়েছি৷ এখন গিয়ে জয়েন করব৷ মাঝে দু’বার এসে পোস্ট ডক শেষ করব৷ তোর আপত্তি আছে?

না তা নেই৷ কিন্তু তোমার মানকুন্ডুর গণিতজ্ঞ?

ওটা ভুয়ো৷ উনি আমার বাড়িওয়ালা৷

কিন্তু আমার সংযুক্তাটা তো সত্যি সত্যি কাটেনি এখনও৷

তবে রে! মুড়ো ঝ্যাঁটা চেনো? খ্যাংরা? পিঠে ভাঙব তোমার৷

এ কী মুখের ভাষা৷ ছি ছি!

আমায় ক্ষমা করেছিস পিপলু?

এ কথা বোলো না৷ দোষ যা হয়েছে তা তো দু’জনেরই৷ তুমি কেন একা ক্ষমা চাইবে বলো? একটা কথা বলবে?

ও কী ছিল? ছেলে না মেয়ে?

মেয়ে৷

আমাদের প্রথম সন্তান৷ ওর একটা নাম দাও৷

তুই দে৷

ওর নাম হোক আত্রেয়ী৷ নদীর নামে নাম হলে কন্যা সুখী হয়৷

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন