দশমীর সন্ধে – সৌভিক চক্রবর্তী

সৌভিক চক্রবর্তী

এক.

রোজ ভোর রাতে ঘুম ভেঙে যায় মুনিয়ার৷ জানলা দিয়ে হু হু করে আশ্বিনা বাতাস আসে৷ ঘর ম ম করে ছাতিম ফুলের বাসে৷ মুনিয়ার বুকটাও হু হু করে ওঠে৷

সোনামন উপুড় হয়ে ঘুমোচ্ছে৷ চাঁদের আলো এসে পড়েছে তার মুখের এক পাশে৷ টলটল করছে মুখখানা৷ মুনিয়ার কান্না পায়৷ সে দরজা খুলে উঠোনে এসে দাঁড়ায়৷ জোছনায় থইথই করে উঠোনটা৷ মুনিয়ার পায়ের শব্দে গোলাঘরের পাশ দিয়ে খড়মড় করে পালায় একটা ভামবেড়াল৷ বোধ হয় হাঁস ধরতে এসেছিল৷ ভামবেড়ালের গায়ে গোবিন্দভোগ চালের গন্ধ৷ মুনিয়ার গা গুলোয়৷ উঠোনের এক পাশে ঝাঁকড়া মতো শিউলি গাছ৷ টুপটাপ ফুল ঝরে পড়ে৷ সদর দরজার তলাটা ক্ষয়ে গেছে বর্ষায়৷ দমকা হাওয়ায় পাল্লাদুটো খটখট করে ওঠে৷ বুড়ো ভঞ্জমামা সারারাত ঘুমোয় না৷ ঘরে বসে খুকখুক করে কাশে৷ সে হাঁক দেয়, ‘কে কে?’

মুনিয়া বলে, ‘কেউ না৷ আউলা বাতাস৷ ঘুমাও মামা৷’

‘তুই ঘুমাসনি? জামাই আসছে বুঝি?’

‘নাহ৷’

‘কবে আসছে সে? পত্র দেয় তোরে?’

‘কবে আসবে বলেনি কিছু৷ তবে আসার তো সময় হয়ে গেছে৷ দেখি কবে আসে৷ তুমি ঘুমাও৷’

সনাতনের আসার সময় হয়ে গেছে৷ বৃষ্টির ফোঁটায় যখন আর তেজ থাকে না, বাদলমেঘ পালাই পালাই করে, নদীর চরে কাশফুল আসে কেঁপে, ছাতিম শিউলির বাসে বাতাসে মাতলা ভাব ধরে, বারোয়ারিতলায় বাঁশ পড়ে তখন সনাতন আসে৷ গত সাত বছর ধরে তাই হয়ে আসছে৷ মানুষটা আসে রাতেভিতে, শেষ ট্রেনে৷ মাঝরাতে কড়া নড়ে ওঠে দরজায়৷ সনাতন চাপা গলায় ডাকে, ‘মুনিয়া, মুনিয়া জেগে আছ?’

মুনিয়ার ঘুম ভেঙে যায়৷ কিন্তু তারও আগে উঠে পড়ে বিশু কামলা৷ সে এক গাল হেসে দরজা খোলে৷ তার পরেই দৌড় দেয় ভেতর বাড়িতে৷ ঘরের ভেতর আলো জ্বলে ওঠে৷ বাবা আর মা এসে দাওয়ায় দাঁড়ান৷ বাবা বলেন, ‘সনাতন এলে না কি?’

সনাতন গিয়ে পায়ের ধুলো নেয়৷

‘যাও স্নান করো৷ রান্না বসছে৷’

টগবগ করে জল ফোটে, তাতে নাচতে থাকে হাঁসের ডিম৷ মুনিয়া হাঁটুতে মাথা গুঁজে বসে থাকে৷ বোন তানিয়া খোঁচা মারে, ‘দিদি রে, জামাইবাবু কী এনেছে তোর জন্যে?’

‘জানি না৷ যা তো৷’

‘লজ্জাবতী আমার৷’

মুনিয়া ছুট্টে পালায়৷ এক বছর পরে মানুষটা এসেছে৷ একটা গোটা বছর পরে! বড় আনন্দ, বড় কষ্ট৷ বাবার কোলে লেপ্টে থাকে সোনামন৷ তানিয়া হাত বাড়ায়, ‘সোনামন আয়, ঘুম ঘুম৷’

সোনামন আর কোত্থাও যাবে না বাবার কোল ছেড়ে৷ সনাতন বলে, ‘মা গো, কেমন আছ?’

বাবার গালে নাক ঘষে সোনামন, ‘ভাল আছি৷ তুমি কেমন আছ বাবা?

‘আমিও ভাল আছি মা৷’

‘আর যাবে না তো বাবা?’

শিশুদের কাছে মিথ্যে বলতে নেই৷ সনাতন চুপ করে থাকে৷ না গিয়ে যে উপায় নেই তার৷

বিয়ের পরে আজ সাত বছর ধরে মুনিয়া বাপের বাড়িতে রয়েছে৷ সোনামনের বয়স ছ’বছর হতে চলল৷ খুব যত্নেই আছে মুনিয়া আর সোনামন তবু সনাতনের বড় কষ্ট হয়৷ সোনামন ঘুমিয়ে পড়লে সনাতনের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে মুনিয়া বলে, ‘এবার আমাকে নিয়ে চলো৷ এবারই শেষ৷ আর আমি থাকব না এখানে৷’

‘আমি তো নিয়ে যেতেই চাই৷ কিন্তু কোথায় রাখব তোমাদের?’

‘তুমি যেখানে থাকো সেখানেই থাকব৷’

‘সেখানে থাকতে পারবে না মুনিয়া৷ আমায় আর একটু সময় দাও৷ একটু গুছিয়ে নিতে দাও৷’

‘তোমার মাথাটা ঠান্ডা হলে তো কবেই গুছিয়ে নিতে পারতে৷ আমার আর দুঃখ থাকত না’, মুনিয়া ফুঁপিয়ে কাঁদে৷ তার চোখের জল এসে পড়ে সনাতনের গালে৷ মানুষের চোখের জলে খুব তাপ, সনাতনের গাল পুড়ে যায়৷

দুই.

মুনিয়া ভুল কিছু বলেনি৷ সনাতনের খ্যাপামির কথা এ গাঁয়ের কোলের বাচ্চাটাও জানে৷ সনাতনের বাবা-মাকে যখন একইসঙ্গে কলেরায় নিল সনাতন তখন খুবই ছোট৷ তাকে বাড়িতে এনে তুলেছিলেন মুনিয়ার বাবা গৌরকিশোর৷ সনাতনের বাবা ষষ্ঠীদাস ছিলেন গৌরকিশোরের ব্যবসার পার্টনার৷ তাঁরা দু’জনে মিলে চালের আড়ত খুলেছিলেন গঞ্জের বাজারে৷ সে ব্যবসা আজ ফুলেফেঁপে উঠে একেবারে হইহই কাণ্ড৷ গৌরকিশোর আজও মাঝে মাঝেই মাথা নাড়িয়ে বলেন, ‘ষষ্ঠীদাদা দেখে যেতে পারল না৷ বড় আফশোস, বড় আফশোস৷’

ছোটবেলাতেই সনাতনের খ্যাপামির লক্ষণ প্রকাশ পেয়েছিল৷ দেখা গেল, পুজোর বাঁশ পড়লেই সনাতন অন্য মানুষ হয়ে যায়৷ সে তখন কেমন একটা ঘোরের মধ্যে থাকে৷ লেখাপড়া করে না, খায় না, ঘুমোয় না৷ দিনরাত বারোয়ারিতলায় বসে থাকে৷ তাকে জোর করে তুলে আনতে গেলে হাত পা ছুঁড়ে কাঁদে, মাথা খোঁড়ে৷ তার পরে দেখতে দেখতে এসে পড়ে পুজো৷ দূর-দূরান্ত থেকে ঢাকিরা এসে দাঁড়ায় মুনিয়াদের বাড়ির দরজায়৷ তাদের জলখাবার দেওয়া হয়৷ সব্বার জন্যে একটা করে নতুন গামছা৷ ঘর থেকে ডালায় করে আসে চাল, ডাল, সব্জি, মশলা৷ গাওয়া ঘিয়ে তেজপাতা ফোড়ন দিয়ে তারা চালেডালে খিচুড়ি চড়িয়ে দেয়৷ সেই গন্ধে একেবারে উথালিপাথালি করে ওঠে চারপাশ৷

সনাতন ঘুরঘুর করে ঢাকিদের আশেপাশে৷ তার হাতে ঢাকের কাঠি৷ বোধন হতেই ঢাক বেজে ওঠে ড্যাং কুড়াকুড়, ড্যাং কুড়াকুড়৷ কাঁসর বাজে, কাঁইনানা, কাইনানা৷ সেই সব শব্দ ঢুকে যায় সনাতনের মাথার ভেতরে৷ সে কেবল ছুটে বেড়ায়, এক দণ্ডও যেন বসার উপায় নেই তার৷ ষষ্ঠী, সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী দেখতে দেখতে পার হয়ে যায়৷ দশমীর দিন সকাল থেকেই মণ্ডপের এক পাশে ঝিম ধরে বসে থাকে সনাতন আর ভাসানের সময় এলেই দেবীর পা আঁকড়ে ধরে৷ সে কিছুতেই ঠাকুর ভাসান দিতে দেবে না৷ জোর করে সরিয়ে নিয়ে আসা হয় তাকে৷ সে তখন পাগলের মতো কাঁদতে শুরু করে৷ কান্না বড় ছোঁয়াচে৷ মুহূর্তের মধ্যে তা ছড়িয়ে যায় গাঁয়ের বাতাসে৷

একটা বয়স অবধি এসব পাগলামি সবারই কমবেশি থাকে৷ বয়সের নিয়মে কমেও যায় আবার৷ মুনিয়ার সঙ্গে বিয়ের পরে গৌরকিশোর সনাতনকে ডেকে বলেছিলেন, ‘তুমি নিশ্চয়ই জানো তোমার বাবা আর আমি দু’জনে মিলে আড়তের ব্যবসা শুরু করেছিলাম৷ সে সময় বড় গরিব ছিলাম আমরা৷ ঘর বাড়ি, গয়না বাঁধা দিয়ে ব্যবসা শুরু করেছিলাম৷ তার কিছুকাল পরেই একদিনের নোটিশে তোমার বাবা মারা যায়৷ ব্যবসার এই বাড়বাড়ন্ত ষষ্ঠীদাদা দেখে যেতে পারেনি৷ এ সবই তোমার জানা কথা তবু আবার বলছি৷’

সনাতন মাথা নিচু করে শুনছিল৷ গৌরকিশোর বলে যাচ্ছিলেন, ‘হিসেব মতো তুমিও এই ব্যবসার অংশীদার৷ এতদিন ব্যবসার কাজে তুমি আমাকে টুকটাক সাহায্য করেছ৷ কিন্তু এখন তোমার সংসার হয়েছে৷ আমি তোমাকে তোমার বাবার অংশ বুঝিয়ে দিতে চাই৷’

সনাতন হাত জোড় করে বলেছিল, ‘কাকাবাবু আমি এ বাড়িতে ছেলের মতো মানুষ হয়েছি৷ কোনও দিন অনাদর টের পাইনি৷ তাই এসব ব্যবসার ভাগ বলে আমাকে লজ্জা দেবেন না৷ তা ছাড়া আমি অন্যত্র থাকতে চাই৷’

সনাতনের বিবেচনায় মনে মনে খুশি হয়েছিলেন গৌরকিশোর৷ জামাই মানুষ বাড়িতে থাকলে ভাল দেখায় না৷ তিনি ভেবেছিলেন কিছুটা দুরে নদীর ধার ঘেঁষে তাঁর যে জমি রয়েছে সেখানেই মুনিয়ার জন্যে নতুন ঘর তুলে দেবেন৷ গঞ্জে একটা নতুন আড়ত খোলার কথা চলছে সেখানে সনাতন বসবে৷ তিনি বলেছিলেন, ‘তা কোথায় থাকবে ভাবছ?’

‘শহরে যাব কাকাবাবু৷’

চমকে উঠেছিলেন গৌরকিশোর, ‘শহরে যাবে? কেন? এখানে কী সমস্যা?’

‘সমস্যা কিছুই নেই৷ শহরে যেতে মন চায়৷’

‘কী কাজ করবে সেখানে?’

‘আপনি তো আমাকে লেখাপড়া শিখিয়েছেন কাকাবাবু৷ কিছু একটা খুঁজে নেব ঠিক৷ বিয়ের পরে আপনার ঘাড়ে বসে আর খাব না৷’

চিন্তায় পড়ে গেছিলেন গৌরকিশোর, ‘সে তো বুঝলাম কিন্তু শহরে গিয়ে বউ নিয়ে উঠবে কোথায়? একটা থাকার জায়গা ঠিক করি তবে?’

‘মুনিয়া এখন কিছুদিন এখানেই থাক৷ আমি একটা কিছু ব্যবস্থা করে তাকে নিয়ে যাব৷’

হাঁফ ছেড়েছিলেন গৌরকিশোর৷ হাঁফ ছেড়েছিল মুনিয়ার মাও৷ মুনিয়া বড় আদুরে মেয়ে৷ তাকে চোখের আড়াল করতে হবে না, এটাই শান্তি৷

কান্নাকাটি করলেও ব্যাপারটা মুনিয়ার খারাপ লাগেনি৷ সনাতন তাদের আশ্রিত বলে বিয়ের সময় অনেকে অনেক কটুকাটব্য করেছিল৷ কেউ কেউ বলেছিল, ‘নিশ্চয়ই মেয়ের কোনও দোষ আছে৷ নয়তো ওই হাঘরে পাগলের সঙ্গে বিয়ে দেয়!’

শহরে যাওয়ার কথা শুনে মুনিয়ার তাই মনে হয়েছিল, সনাতনের মাথাটা বুঝি ঠান্ডা হয়েছে৷ তা ছাড়া বিয়ের পরে নিজের ঘর সংসার করতে কোন মেয়ে না চায়? যাওয়ার সময় মুনিয়ার চিবুক ধরে সনাতন বলেছিল, ‘কেঁদো না মুনিয়া৷ আমি নিয়মিত চিঠি দেব৷ সময় পেলে ঘুরেও যাব৷ তুমিও চিঠি লিখো আমায়৷’

তিন.

সনাতন গেছিল জুলাইয়ের শুরুতে৷ কিন্তু সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি বিশ্বকর্মা পুজোর দিন চারেক আগে সে শুকনো মুখে ফিরে এল৷ মুনিয়াকে বলল, ‘চাকরি ছেড়ে এলাম৷ পুজোয় মোটে দু’দিন ছুটি৷ দেখলাম, সব জায়গায় বাঁশ পড়ে গেছে৷ মনটা বড় উচাটন হল৷’

বোঝা গেল, বয়স হলেও সনাতনের খ্যাপামি একটুও কমেনি৷ লক্ষ্মীপুজো পার করে ফিরে যাওয়ার সময় মুনিয়ার গা ছুঁয়ে সনাতন দিব্যি দিল, ‘আর কিছুতেই চাকরি ছাড়ব না৷ আশা করি সামনের বার তোমায় নিয়ে যেতে পারব৷’

পরের বছর অক্টোবরের চার তারিখ সোনামন হল৷ মেয়েকে দেখতে সেই যে সনাতন এল, কালীপুজো পার করেও ফিরল না৷ জানা গেল, সে ফের চাকরি ছেড়ে এসেছে৷ সেবার যাওয়ার আগে সনাতন মুনিয়ার মাথায় হাত দিয়ে দিব্যি দিল, ‘এবার আর কিছুতেই পাগলামি করব না দেখো৷ এখন আমি মেয়ের বাবা৷ কত দায়িত্ব বলো তো৷ পুজো পুজো করে নাচলে হবে!’

এই নিয়ে আট বছরে পা দেবে সনাতনের ফিরে আসা৷ বারবার চাকরি ছাড়ায় সে কিছুই প্রায় জমিয়ে উঠতে পারেনি৷ লাভের মধ্যে লাভ হয়েছে, লজ্জায় সে বাড়ি আসা প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে৷ আগে মানুষটা যাও দু’-তিন মাস অন্তর আসত, গত চার বছর ধরে পুজোর সময় ছাড়া একবারও আসেনি৷ এভাবে থাকা যায়? মানুষটার জন্যে বড্ড মন পোড়ে৷ দিন রাত লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদে মুনিয়া৷ তবে সনাতন প্রতি মাসে চিঠি পাঠায়৷ সঙ্গে কিছু কিছু টাকা৷ সব চিঠির একই বয়ান—

মুনিয়া,

এর চেয়ে বেশি টাকা পাঠাতে পারলাম না৷ শহরে ঘর দেখে ফেলেছি৷ আর কটা দিন ধৈর্য ধরো৷ আমি ভাল আছি৷ সোনামন কেমন আছে? চিঠিতে তার কথা বেশি বেশি করে লিখবে৷ টাকাগুলো খরচ কোরো৷ মনে রাখবে এটা তোমার স্বামীর রোজগার৷ তোমার নিজের জিনিস৷ ভাল থেকো৷

সনাতন,

সোনামনের মেজাজ এখন দারুণ ভাল৷ সে উঠোনে ঘুরে ঘুরে ‘বুলবুল পাখি ময়না টিয়ে’ গাইছে৷ তার বাবা ফিরে এসেছে৷ যদিও খুব কম দেখা হয় তবু বাবা লোকটাকে খুবই পছন্দ করে সোনামন৷ বাবা বাড়ি ফিরলেই তাকে আর পড়তে হয় না৷ সে তখন সারাদিন বাবার কাঁধে চেপে ঘোরে৷ এই সময়টা তাকে কেউই বিশেষ বকে-টকে না৷ বাবার পাশে বসে সে ঠাকুর বানানো দেখে, ‘বাবা৷’

‘মাগো৷’

‘তুমি ঠাকুর বানাতে পারো?’

‘না৷’

‘কেন পারো না বাবা?’

‘এইটা তো আমি শিখিনি৷’

‘না শিখলে ঠাকুর বানানো যায় না?’

‘না শিখলে কিছুই বানানো যায় না মা৷ সবই শেখার জিনিস৷ অভ্যাসের জিনিস৷’

‘তুমি তা হলে কী পারো বাবা?’

‘আমি শুধু তোমায় আদর করতে পারি মা৷ সবই শেখার জিনিস৷ অভ্যাসের জিনিস’৷

‘তুমি আদর করা কোথা থেকে শিখেছ?’

‘তোমার দাদুর কাছে শিখেছি, দিদিমার কাছে শিখেছি, তোমার মায়ের কাছে শিখেছি, এই গ্রাম, এই গ্রামের জল মাটি হাওয়া আর ওই যে দুগগা ঠাকুর, সবাই মিলে আমায় আদর করতে শিখিয়েছে৷’

‘তাই তুমি ভাসানের সময় ঠাকুরকে ধরে কাঁদো?’

‘হ্যাঁ গো মা৷’

‘আমিও আদর শিখব বাবা৷’

সনাতন দু’হাত বাড়িয়ে দেয়৷ বাবার গলা ধরে ঝুল খায় সোনামন৷ সে খুবই তৃপ্ত৷ কারণ সে আদর করতে শিখছে৷

চার.

সকাল থেকে বারোয়ারিতলায় ঝিম ধরে বসে আছে সনাতন৷ এখন বিকেল, তবু বাবার কাছে যেতে খুব একটা সাহস পাচ্ছে না সোনামন৷ দশমীর দিনটায় বাবা কেমন পাগল পাগল করে৷ বাবা তাকে দেখেছে কিন্তু কাছে ডাকেনি৷ সোনামনের খুব অভিমান হয়েছে৷ সে ঠিক করে ফেলেছে, বাবা ডাকলে সে কিছুতেই কাছে যাবে না৷

গাঁয়ের মেয়েরা একে একে বারোয়ারিতলায় জমা হচ্ছে৷ তারা লাল পাড় সাদা শাড়ি পরেছে৷ তাদের হাতে বরণডালা৷ ভাসানের তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে৷ মুনিয়া বলল, ‘যা তো সোনামন, বাবাকে বল মা ডাকছে৷ এখনই যেন আসে৷ বলবি খুব জরুরি কথা৷’

দরজাটা ভেজিয়ে এসে সনাতনের মুখোমুখি দাঁড়ায় মুনিয়া, ‘তোমাকে কটা কথা বলার আছে৷’

‘এখনই বলতে হবে?’

‘হ্যাঁ৷’

‘আমার মন ভাল নেই মুনিয়া৷ পরে বললে হয় না?’

‘না৷’

‘বেশ তবে বলো৷’

‘তোমাকে আর শহরে যেতে হবে না৷ প্রতিবার এই এক যন্ত্রণা আমার আর সহ্য হয় না৷ শুধু আমার না, মেয়েটারও তো কষ্ট৷’

‘আজ থাক না মুনিয়া৷ কাল বোলো এ কথাগুলো৷’

‘যা বলছি শোনো৷ আর শহরে যাওয়ার দরকার নেই৷ আমি কিছুটা জমি কিনে ফেলেছি৷ সেখানে ঘর তুলবে৷ গাঁয়ে একটা প্রাইমারি ইশকুল হচ্ছে, সেখানে চাকরি নাও৷ এই গ্রাম ছেড়ে, গ্রামের পুজো ছেড়ে তুমি থাকতে পারবে না৷ এ রকম ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে আছো কেন?’

‘তুমি জমি কিনেছ? সত্যি? কী ভাবে?’

‘সাত বছর ধরে প্রতি মাসে তুমি আমাকে যা টাকা পাঠিয়েছ সেগুলো জমিয়েছি৷ পরিমাণটা নেহাৎ খারাপ দাঁড়ায়নি৷ হ্যাঁ, আরও আগেই জমি কেনা যেত যদি বাবার কাছে চাইতাম৷ বাবা বারবার বলেছে, এখানে সব ব্যবস্থা করে দেবে৷ তোমার কথা ভেবে আমি রাজি হইনি৷ কথাগুলো আজই বলা দরকার ছিল তাই বললাম৷ বউয়ের টাকায় কেনা জমিতে থাকতে তোমার আপত্তি নেই তো?’

সনাতন মাথা নাড়ে৷ সে কথা বলতে পারছে না৷ তার বুকে একটা হাত রাখে মুনিয়া৷ সনাতন শিউরে ওঠে৷

প্রতিবারের মতো এবারও জলে ভাসানোর আগে প্রতিমার পা ধরে সনাতন ডুকরে ওঠে৷ তার পরে চিবুকটা ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলে, ‘সাবধানে যেও মা গো৷ আবার এসো৷ আমরা অপেক্ষা করব৷’

সবার চোখে তখন চিকচিক করছে জল৷ এক বছরের জন্যে মেয়ে চলেছে তার শ্বশুর ঘরে৷ বাপের বাড়ির লোকেরা তো কাঁদবেই৷ শুধু সোনামন অবাক হয়ে যায়৷ সে শুনেছে, তার বাবা আর শহরে যাবে না৷ এবার থেকে তাদের সঙ্গেই থাকবে৷ এটা তো খুবই আনন্দের বিষয়৷ তা হলে বাবা এত বেশি বেশি কাঁদছে কেন? সে ভাবে, নাহ, বাবাটাকে নিয়ে পারা যায় না৷ এখন থেকে তো কাছাকাছি থাকবে, খুব শাসন করে দিতে হবে৷

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন