সৌভিক চক্রবর্তী
আজও কোনও একটা হতভাগা হেগে ভালো করে জল না দিয়ে চলে গেছে৷ চড়াৎ করে মাথাটা গরম হয়ে গেল রতন পালের৷ দুমদুম করে পা ফেলে সিঁড়ি দিয়ে নেমে উঠোনের মাঝখানে এসে দাঁড়াল সে৷
এখন ভাল করে সকাল হয়নি৷ কলপাড়ে দু’টি মাত্র বউ৷ খানিকক্ষণ আগে সে যখন উঠোনে ঝাঁটা লাগাচ্ছিল তখনও কেউ ওঠেনি৷ শুধু সীতারাম নস্কর গ্যাঁটম্যাট করে মর্নিংওয়াকে বেরিয়ে গেছিল৷ রতন পালের খুব ইচ্ছে করছিল নস্করের কপালে ঝাঁটা মারতে৷ গত বিশ বছর ধরে এই ইচ্ছাটাকে পুষে রেখেছে সে৷ একদিন ঠিকই মারবে৷ আর একটু সাহসের দরকার৷
বউ দুটো খুব কলকলাচ্ছে৷ গায়ের কাপড় ঠিক নেই৷ রতন পাল ঠাহর করে দেখল একটা বউয়ের গায়ে খুব রং৷ যেন হলুদ মেখেছে৷ দুলাল ঘোষের দ্বিতীয় পক্ষ৷ আর একটা সামন্তদের আইবুড়ো বোনটা৷ আধবুড়ি মাগি খুব ঝগড়ুটে৷ গলা খাঁকরানি দিয়ে রতন কটমট করে তাকাল ওদের দিকে৷ রতনকে দেখে বউ দুটোর কলকলানি বেড়ে গেল৷ সে যে এই বাড়ির মালিক তা নিয়ে যেন কোনও মাথাব্যথা নেই ওদের৷ শুধু ওরা কেন? মালিক বলে কেউই যে তাকে খাতির করে এমনটা নয়৷ বরং সুযোগ পেলেই তার বুকে চেপে দাড়ি ওপড়ায় সবাই৷ সে রোজই ভাবে আর নয়৷ এবার বাড়ি বেচে দেব৷ বুঝুক শালারা৷ একদিন ঠিকই বেচে দেবে বাড়িটা৷ আর একটু সাহসের দরকার৷
রতন পালের রক্তে এই সাহস বস্তুটার বড্ড অভাব৷ মাঝে মাঝেই সে ভাবে একটু সাহস থাকলে আজ কোথায় চলে যেত৷ হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষায় সেবার ব্যাপক টোকাটুকি হচ্ছে৷ সবাই বই খুলে কিংবা চোতা বের করে বাঘের মতো লিখছে৷ কিছুতেই টুকলি করার সাহস পেল না সে৷ যা হওয়ার তাই হল৷ বাবা বেধড়ক ঠ্যাঙাল৷ বলল, আর পড়ে তোর কাজ নেই৷ চাকরি খোঁজ৷
কাজ একটা জুটেও গেল৷ নৈহাটির মেসো ধরে-করে ঢুকিয়ে দিল ফুড কর্পোরেশনে৷ রতন দেখত রোজ চোখের সামনেই পুকুর চুরি হয়৷ ওর সঙ্গেই আর যারা গ্রুপ সি, গ্রুপ ডি ছিল সবাই পেল্লায় বাড়ি হাঁকিয়ে নিল পাঁচ বছরের মধ্যে৷ কাজটা এমন কিছু কঠিন না৷ চাল, ডাল, চিনি, নুনের বস্তায় ফুটো করে মাল বের করে নিয়ে বেচে দেওয়া৷ দোকান ধরাই ছিল৷ লোভে পড়ে রতন দু’একবার চেষ্টাও করেছিল৷ পারেনি৷ বড্ড বুক ধড়ফড় করত৷ রতন যে খুব সৎ লোক এমনটা নয়৷ তারও ইচ্ছা করত কাঁচা পয়সা রোজগার করতে৷ রতনদের সঙ্গেই কাজ করত সাধন কুণ্ডু৷ ওস্তাদ লোক৷ জীবনে কোনওদিন সে বাস-ট্রেনের টিকিট কাটেনি৷ বাকিরা যখন চুরির মাল অন্যের দোকানে বেচে সন্তুষ্ট ছিল সাধন কুণ্ডু তখন নিজেই একটা মুদি দোকান খুলে ফেলেছিল বাড়ির পাশে৷ তার বউ দোকানটা চালাত৷ অন্যেরা হিংসায় জ্বলে পুড়ে মরলেও রতন কিন্তু মনে মনে তারিফ করত সাধন কুণ্ডুর দুর্জয় সাহসের৷ সাধনের আশেপাশে সে ঘুরঘুর করত৷ যদি একটু সাহসী হওয়া যায়, যদি দু’ পয়সা পাওয়া যায় মন্দ কী! সাধন কুণ্ডুও রতনকে স্নেহ করত৷ মাঝে মাঝেই মুড়ি বাদাম খাওয়াত৷ এ সবের মধ্যেই একদিন হঠাৎ পুলিশ এসে সাধন কুণ্ডুকে ধরে নিয়ে চলে গেল৷ রতন সঙ্গে সঙ্গে থাকত বলে তাকেও একদিন থানায় ডেকে অনেকক্ষণ জেরা করল৷ বাপ রে! পুলিশের গলার কী আওয়াজ৷ থানা থেকে ফিরতেই তাড়সে জ্বর এল রতনের৷ জ্বর থেকে উঠে রতন আরও গুটিয়ে গেল৷ দিনরাত ভয় লাগত এই বুঝি পুলিশ ধরে নিয়ে যাবে৷ বাড়ির বাইরে যাওয়ার সাহস পেত না৷ সে সময় চাঁপা খুব করেছিল৷
চাঁপার কথা ভাবলেই বড় অপরাধবোধ হয় রতনের৷ তখন যদি একটু গোঁ ধরে থাকত তাহলে হয়তো আজ জীবনটা তার অন্য রকম হত৷ রতন আড়চোখে তিনতলার একটি বিশেষ দরজার দিকে তাকায়৷ না, চাঁপা এখনও ওঠেনি৷
রিটায়ার করার পর থেকেই ঘুমটা খুব কমে গেছে৷ আগে কম বয়সে বিছানায় পড়লেই রাজ্যের ঘুম ঝাঁপিয়ে আসত৷ আর এখন অনেক রাত অবধি এপাশ ওপাশ করতে হয়৷ বউ খুব জোরে নাক ডাকে বলে বছর কয়েক হল রতন আলাদা একটা ঘরে শোয়৷ মশারির চারপাশে বিনবিন করে মশা ঘোরে৷ জানলা দিয়ে সে তাকিয়ে থাকে পগারের দিকে৷ ওখানে একটা পেঁপে গাছ উঠেছে৷ ছেলে আর ছেলে বউয়ের টুকরো টাকরা কথোপকথন শুনতে পায়৷ বেশিদিন হয়নি ছেলের বিয়ে হয়েছে৷ রতন যতক্ষণ জেগে থাকে ওদের কথা কানে আসে৷ ঘুমোয় না না কি? আজকালকার ছেলেমেয়েদের ধরনধারন আলাদা৷ ওরা যখন হাসাহাসি করে রতনের মনটা উদাস হয়ে যায়৷ রতন জানে, এসব তার শোনা উচিত নয় তবুও সে শোনে৷ চাঁপার জন্য বড্ড মন কেমন করে৷
নয় নয় করে চাঁপারও তো প্রায় পঞ্চান্ন-ছাপান্ন বছর বয়স হল৷ এখনও সে বড় সুন্দর৷ রতন দু’-একবার বলতে গেছে, আমার মতো একটা মানুষের জন্য তুমি বিয়েই করলে না চাঁপা?
চাঁপা উত্তর দিত না৷ হাসত৷ তা সে কত কালের কথা৷ এ বাড়িতে এসে তবু সময়টা কাটে৷ রাতে ঘুম না এলে রতন হাতে একটা পেনসিল ব্যাটারির টর্চ নিয়ে সারা বাড়ি টুকটুক করে ঘুরে বেড়ায়৷ দেখে কে কোথায় নোংরা করে রেখেছে৷ ভোরে উঠে সে নিজেই সব ঝাঁটপাট দেয়৷ ঝুল ঝাড়ে৷ রতন বোঝে, বাড়িটার ওপর কারওর মায়া নেই৷ তবু কেউ ছাড়বে না৷ সব জোঁকের মতো শুষে নিতে জানে৷ আর দীর্ঘদিন ধরে থাকতে থাকতে সবার সাহস একেবারে মাত্রাছাড়া হয়ে উঠেছে৷ ওই সীতারাম নস্কর হল নষ্টের গোড়া৷ সেই সবাইকে বুঝিয়েছে, রতন পাল যতই বাড়ি বেচে দেওয়ার ভয় দেখাক এ বাড়ি বেচা অত সোজা নয়৷ অনেক শরিকি সমস্যা আছে৷ তারপর থেকেই লোকের ভয়টা কমে গেছে৷ আগে ঝগড়াঝাঁটি হলে রতন যখন বলত, কালই এ বাড়ি আমি বেচে দেব, লোকজন ভয় খেত৷ অনেকদিন আগে এই নস্করই ঝগড়ার পর গলায় গামছা দিয়ে এসে হাত জোড় করে বলেছিল, দাস মশাই, বাড়ি আপনার৷ আপনি বেচতেই পারেন কিন্তু বউ-বাচ্চা নিয়ে আমরা কোথায় যাব? অন্তত বিশটা পরিবার আপনার এই বাড়িতে ভাড়া থাকে৷ তারা যে সব পথে বসবে৷ দয়া করুন পাল মশাই৷
আর এখন সেই যেন সবার দয়ার পাত্র৷ আসলে সবাই বুঝে গেছে বাড়িটার ওপর রতন পালের বড্ড টান৷ সেই সুযোগটাই নিচ্ছে৷ নয়তো রতনের মতো বাপের বয়সি একটা লোককে দেখেও মেয়ে দুটোর কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই! গায়ের কাপড়টা অবধি ঠিক করার প্রয়োজন বোধ করছে না৷ সমানে ঢলাঢলি করে হেসে যাচ্ছে৷
বাথরুম পায়খানা পরিষ্কার না থাকলে রতনের বড় ঘেন্না করে৷ ভাড়া বাড়িতে যা হয়, একটা বাথরুম অনেকে মিলে ব্যবহার করে৷ তার ওপর সবাই ভাবে পরের জন জল ঢালবে৷ নোংরা হয়ে থাকে৷ সকালে উঠেই তাই রতন প্রথমে ভাল করে দোতলার একটা বাথরুম ধুয়ে তকতকে করে রাখে৷ তারপর উঠোনটায় ঝাঁটা লাগিয়ে চান করতে ঢোকে৷ বেশ কিছুদিন ধরেই রতন লক্ষ্য করেছে সে যখন উঠোন ঝাঁট দেয় সেই ফাঁকে কেউ একটা বদমাইশি করে৷
কাল রাতে ছেলে আর বউয়ের সাথে একপ্রস্থ ঝগড়া করে এ বাড়িতে চলে এসেছিল সে৷ সারারাত ভালো ঘুম হয়নি৷ তার ওপর সকালে উঠেই এই৷ রতনের সবটা সন্দেহ গিয়ে পড়ল সামন্তদের আইবুড়ো বোনটার ওপর৷ গলাটা ঝেড়ে জিজ্ঞাস করল, আমি যখন ঝাঁট দিচ্ছিলাম তোমরা কেউ দোতলায় গেছিলে?
অন্য বউটা উত্তর না দিলেও ক্যাটক্যাট করে উঠল সামন্তদের বোন লক্ষ্মী৷ বলল, একতলায় ভাড়া থাকি বলে দোতলায় যাওয়ার নিয়ম নেই না কি? কেন হয়েছেটা কী?
লক্ষ্মীর গলার আওয়াজে প্রথমটায় একটু থতিয়ে গেছিল রতন৷ তার মনে হল এসব কুঁদুলে মেয়েছেলের সঙ্গে মুখ না লাগানোই ভাল৷ তবু সে কতকটা মুখ ফসকেই বলে বসলো, না তোমায় বলছি না৷ কেউ একটা প্রায়ই ওপরের পায়খানাটায় জল না দিয়ে নোংরা করে রাখে, আমি যখন উঠোনে ঝাঁট দিই সেই ফাঁকে৷ তাই বলছিলাম তুমি কি কাউকে দেখলে?
রতনের কথা শেষ হতে না হতেই লক্ষ্মী তারস্বরে চেঁচাতে শুরু করল৷ অন্য বউটা তখন মুখে কাপড় চাপা দিয়ে হাসছে৷ বাপের বয়সি রতন পালকে একেবারে তুলোধুনে দিল লক্ষ্মী৷
ঝগড়াঝাঁটি এ বাড়ির রোজকার ব্যাপার৷ বাড়িতে কুড়ি-বাইশ ঘর ভাড়াটে থাকবে অথচ ঝগড়া হবে না এমনটা হয় না কি? আর যে কোনও ঝগড়ার সূত্রপাত হয় এই কলতলাটা থেকেই৷ এ বাড়ির বাসিন্দারা তাই প্রাতঃকালীন খেউড়ে বরাবরই অভ্যস্ত৷ তবে আজকের ঝগড়াটা যেন অন্যরকম৷ এক পক্ষই চেঁচাচ্ছে৷ অন্য পক্ষ চুপ৷ এমনটা সাধারণত হয় না৷ দমাস দমাস করে জানলা-দরজা খুলে লোকজন বেরিয়ে এল৷ কেউ বারান্দায়, কেউ উঠোনে৷ রতন আড়চোখে দেখল চাঁপার ঘরের জানলাটাও খুলে গিয়েছে৷ কী লজ্জা! বুড়ো বয়সে হেনস্থা হতে আর ভাল লাগে না৷ সে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে অপরাধীর মতো৷
মাতব্বর গোছের জনা কয়েক লোক সালিশি করতে আসে৷ লক্ষ্মীর বয়ানে ঘটনাটি পল্লবিত হয়ে দাঁড়ায় এই যে, সক্কাল সক্কাল হারামি বুড়ো তাকে বলেছে সে নাকি দোতলার পায়খানায় হেগে জল দেয়নি৷ তার বিয়ে হয়নি বলেই বুড়োর এত সাহস৷ কই দুলাল ঘোষের বউও তো ছিল৷ তাকে তো বলেনি৷ তারা গরিব হতে পারে, তাই বলে নিজের যা আছে তাই নিয়েই সন্তুষ্ট থাকে, অন্যের পায়খানায় হাগতে যাবে এমন প্রবৃত্তি নেই তার৷ এই অপমান সে সহ্য করতে পারছে না৷ নেহাত উপায় নেই৷ আজ যদি তার স্বামী থাকত তা হলে এই ভাড়াবাড়ির কপালে লাথি মেরে বেরিয়ে যেত৷
রতন কিছু বলবার আগেই সামন্তদের ছোটভাই গুলে তার গলার কাছটা খামচে ধরে৷ মধ্যমগ্রাম স্টেশনে ডিজেল অটো চালায় গুলে৷ দানব স্বাস্থ্য৷ ইদানীং পার্টিতে নাম লিখিয়ে গলার আওয়াজটাও বাজখাঁই হয়েছে৷ সে বলে, শালা মালিক বলে যা খুশি তাই৷ ঘরের মা-বোনের দিকে কু নজর দিচ্ছ! ধাঁই করে হাত চালিয়ে দেয় গুলে৷ সকলে হাঁ হাঁ করে ওঠে৷ অজ্ঞান হওয়ার আগে রতন পালের চোখ চলে যায় তিনতলার একটা বিশেষ জানলার দিকে৷ চাঁপা কি দেখল? রতন বুঝতে পারে না৷
দুই.
হৃদয়পুর স্টেশনে নেমে রাইটার্স বিল্ডিংয়ের কথা বললে যে কেউ দেখিয়ে দেবে৷ স্টেশন থেকে হাঁটা পথে বড়জোর মিনিট তিনেক৷ কী করে যে বাড়িটার নাম রাইটার্স বিল্ডিং হল তা কেউ জানে না৷ এমন কি রতনও না৷ রতনের বাপ সিপিএম করত৷ তার ওপর বাড়ির লাল রং আর ভিড় দেখে হয়তো কোন রসিক এ নাম দিয়েছিল৷ রতন জন্মাবধি এই নাম শুনে আসছে৷
অনেক কাল আগের কথা৷ দেশ ভাগের পর তখন পিলপিল করে লোকজন চলে আসছে এদিকে৷ বেশির ভাগই হাভাতে মানুষজন৷ একটুখানি মাথা গোঁজার জন্য কাড়াকাড়ি পড়ে যাচ্ছে৷ রতনের বাপ ছিল দূরদর্শী মানুষ৷ হৃদয়পুরের জমিটা ফাঁকাই পড়েছিল৷ খুব তাড়াতাড়ি খান কতক ঘর বানিয়ে ভাড়া বসিয়ে দিল৷ তারপর ক্রমে একতলা, দোতলা৷ তিনতলাটা রতন নিজেই করেছিল৷ এখন কুড়ি-বাইশ ঘর ভাড়াটে থাকে বাড়িটায়৷ এরাও সেই প্রথম থেকে ভাড়া আছে৷ বংশপরম্পরায় ভোগ করছে বাড়িটা৷ এর মধ্যে অনেকেই জমি কিনেছে, কেউ কেউ বাড়িও করেছে৷ তবু এ বাড়ি ছেড়ে দেয়নি৷ গত পনেরো বছরে নতুন ভাড়াটে এসেছে বলে তো রতনের মনে পড়ে না৷ এরা আজ থেকে বিশ বছর আগে যা ভাড়া দিত এখনও তাই ভাড়া দেয়৷ রতন বহুবার ভাড়া বাড়ানোর চেষ্টা করেছে৷ লাভ হয়নি৷ প্রথম প্রথম ভাড়া বাড়ানোর কথা উঠলে সবাই বলত, সে তো বটেই৷ আপনার দিকটাও তো দেখতে হবে পালমশাই৷ না না আপনি বাড়ান৷
তারপর মাসের শেষে একই ভাড়া দিয়ে হাত কচলে বলত, এ মাসটায় বড় দুর্ভোগ যাচ্ছে৷ সামনের মাস থেকে… দেখবেন৷ আপনাকে ডোবাব না পালমশাই৷
মাসের পর মাস চলে যেত কিন্তু দুর্ভোগ কমত না৷ রতন কোনওদিনই খুব হাঁকডাকের মানুষ নয়৷ বাপের কোনও গুণই পায়নি সে৷ বাবা বেঁচে থাকতে একটুও বেচাল হয়নি এরা৷ শেষের দিকে রতন হাল ছেড়ে দিয়েছিল৷ যেমন চলছে চলুক৷
এ বাড়িতে সবচেয়ে বেশি ভাড়া দেয় চাঁপা৷ দেড় হাজার টাকা৷ আর বাকি সবার থেকে ভাড়া বাবদ রতন পায় একুশশো ঊনপঞ্চাশ টাকা৷ সীতারাম নস্কর দোতলার তিনটে ঘর নিয়ে থাকে৷ সে ভাড়া দেয় একশো ঊনপঞ্চাশ টাকা৷ মাসে শেষে রতনের হাতে দেড়শো টাকা ধরিয়ে এক টাকা ফেরত নেওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে থাকে৷ আজ বিশ বছর ধরে এটাই হয়ে আসছে৷ নস্কর যখন এক টাকা ফেরত চায় রতনের ইচ্ছা করে ঠাস করে একটা চড় মারতে৷
রতন বহুবার চাঁপাকে বলেছে তুমি এত টাকা ভাড়া দিও না৷ সবাই যা দেয় তাই দিও৷ চাঁপা শোনে না৷ রতন খেয়াল করে দেখেছে চাঁপা আসলে তার কোনও কথাই শোনে না৷ ছেলেবেলা থেকেই ভীষণ একগুঁয়ে৷
চাঁপারা বাঙাল৷ ময়মনসিং জেলার লোক৷ দেশ ভাগের সময় মামা আর মামির সঙ্গে এপারে এসেছিল৷ রতনের বাপ চাঁপার মামাকে ডেকে এনে থাকতে দিয়েছিল৷ নিঃসন্তান মামা-মামি বড় আগলে রাখত চাঁপাকে৷
রতনের তখন উঠতি বয়েস৷ তার ওপর নতুন চাকরি৷ বুকে হাজারো স্বপ্ন, চোখে রং৷ মাসের শেষে বাবা তাকে ভাড়া আদায় করতে পাঠাত৷ একদিন ফট করে চোখে লেগে গেল চাঁপাকে৷ রতনের থেকে বোধ হয় বছর তিন-চারেকের ছোট হবে চাঁপা৷ শাড়ি পরে ইস্কুলে যেত৷ সাড়ে দশটা নাগাদ পড়িমরি করে অফিস থেকে বেরিয়ে সাইকেল চেপে রতন চলে আসত স্টেশনের কাছে৷ স্টেশনের পাশেই চাঁপার ইস্কুলে যাবার রাস্তা৷ ভ্যান রিকশা চললেও হেঁটেই যাতায়াত করত সে৷ রতন কতবার বলেছে, তোমাকে একটু এগিয়ে দিই৷ উঠবে সাইকেলে?
কোনও দিন ওঠেনি চাঁপা৷ চাঁপার পাশাপাশি সাইকেল হাঁটিয়ে নিয়ে যেত রতন৷ তার পর মফস্বলে যা হয় কথাবার্তা, গা-টেপাটেপি শুরু হল৷ একদিন চাঁপা বলল এভাবে আর এসো না, নিন্দে হয়৷
বেগতিক দেখে রতন মাকে ধরল৷ চাঁপাকে বিয়ে করতে চায় সে৷ রতন জানত বাবা কিছুতেই মানবে না৷ মানলও না রতনের বাপ৷ স্পষ্ট জানিয়ে দিল, ভাড়াটের সঙ্গে ছেলের বিয়ে কিছুতেই নয়৷ তার ওপর চাঁপারা হাঘরে, বাঙাল৷ বাঙালদের সঙ্গে কখনই কুটুম্বিতা করতে নেই৷ রতনের অত সাহস ছিল না যে বাপের মুখের ওপর কথা বলবে৷ মনমরা হয়ে থাকত দিনরাত৷ ছেলের এই উদাসী দশা দেখে তড়িঘড়ি রতনের বিয়ে বসিয়ে দিল তার বাপ৷ এই বার রতন গোঁ ধরেছিল, কিছুতেই সে বিয়ে করবে না৷ বাপ হুমকি দিল ত্যাজ্যপুত্র করবে৷ সব সম্পত্তি দেবোত্তর করে দেবে৷ এবার ভয় পেয়েছিল রতন৷
বিয়ের পর বহুদিন ও বাড়িমুখো হয়নি সে৷ চাঁপার কথা প্রায় ভুলতেই বসেছিল৷ বাবা মারা যাওয়ার পর আবার যাতায়াত শুরু হল৷ প্রথম দিন চাঁপাকে দেখে বড্ড অবাক হয়েছিল রতন৷ আরও অবাক হয়েছিল চাঁপার সিঁথি দেখে৷ সীতারাম নস্করকে ধরেছিল সে, নস্কর, চাঁপা কি বিধবা নাকি? কবে হল?
খ্যাঁক খ্যাঁক করে হেসে নস্কর বলেছিল, বিধবা? বিয়েই হয়নি৷ ও মেয়ের দোষ আছে বুঝলেন? একের পর এক পাত্র ফেরত পাঠিয়েছে৷ সুন্দরী বলে খুব দেমাক৷ আসল কথাটা অন্য, এক ভাতারে খিদে মিটবে না যে৷ চাকরি কচ্ছে, মাথার ওপর গার্জেন নেই কেউ৷ নষ্ট হওয়ার এমন সুযোগ কেউ ছাড়ে? জোর বেঁচে গেছেন মশাই, আপনার তো আবার একটু ইয়ে ছিল৷
বড় দমে গেছিল রতন৷ চাঁপাকে এরকম ভাবতে খুব কষ্ট হয়েছিল৷ পরে বুঝেছে লোকে কেন চাঁপার নামে কুচ্ছো গায়, আসলে নস্কর থেকে শুরু করে দুলাল ঘোষ পর্যন্ত অনেকেই চাঁপার দরজার বাইরে অনেক দিন পর্যন্ত ঘুরঘুর করেছে৷ মোটে পাত্তা পায়নি, তাইতেই এত রাগ৷
অবশ্য রতনও যে চাঁপার কাছে খুব পাত্তা পেয়েছে এমন নয়৷ চাঁপা রতনের ঘরটা গুছিয়ে রাখত, শীতকালে গরম জল করে দিত আর কখনও কখনও খাওয়ার পাতে দু’-একটা নতুন পদ৷ ব্যস ওই পর্যন্তই৷
অনেক দিন আগে রতন একবার চেষ্টা করেছিল৷ রাত অবধি বসেছিল চাঁপার ঘরে৷ রতনের সেদিন কেমন একটা জেদ চেপে গেছিল৷ তাছাড়া ময়লা ধরা বাল্বের হলদে আলোয় বড় উজ্জ্বল দেখাচ্ছিল চাঁপাকে৷ এক সময় চাঁপার হাতটা খপ করে ধরে ফেলেছিল রতন৷ বলেছিল চাঁপা…৷
হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে নিচু গলায় চাঁপা বলেছিল, ছিঃ৷ তোমার না বউ আছে৷ আর কখনও এমন কোরো না৷ যাও ঘরে যাও৷ শুয়ে পড়ো৷
রতনের রক্তে সাহস বস্তুটার বড় অভাব৷ একটাও উত্তর করতে পারেনি৷ চুপচাপ ঘরে এসে শুয়ে পড়েছিল বিছানায়৷
ব্যস ওই শেষ৷ তারপর রতনও কোনও দিন চায়নি৷ চাঁপাও সে প্রসঙ্গ আর তোলেনি৷ সময়ের নামে সময় কেটেছে৷ আজ পর্যন্ত যতবার রতন এ বাড়িতে এসে থেকেছে চাঁপা ঘরদোর গুছিয়ে দিয়েছে৷ কাজের মেয়েটার হাত দিয়ে তরকারি পাঠিয়েছে৷ তার বেশি এতটুকু আগ্রহ দেখায়নি কখনও৷ তবুও রতন বিশ্বাস করতে ভালবাসে তার জন্যই চাঁপা আইবুড়ো হয়ে কাটিয়ে দিল জীবনটা৷
বিছানায় শুয়ে শুয়ে হাবিজাবি ভাবছিল রতন৷ মেসোমশাই ঘুমোচ্ছেন নাকি?, ডাকটা শুনে তন্দ্রা কেটে গেল৷
না ঘুমোচ্ছি না৷ বলো৷
রতনের ছেলে প্রতাপ আর প্রতাপের শালা নীলমণি চেয়ার টেনে বসল৷ বসতে বসতেই নীলমণি বলল, পুলিশ গুলেকে হেবি রগড়ানি দিয়েছে৷ আপনার থুতু যদি ওকে দিয়ে না চাটাই তো আমার নাম নীলমণি পোদ্দার নয়৷ আপনি যেদিন সুস্থ হবেন ও বাড়ি যাবেন৷ সবার সামনে গুলে আপনার জুতো মুখে ঘুরবে৷ এই আমি বলে রাখলাম৷
সেদিন জ্ঞান ফিরতেই রতন প্রথম যে গলাটা শুনেছিল সেটা চাঁপার৷ না৷ কোনও হা হুতাশ নয়৷ কঠিন গলায় চাঁপা বলেছিল, কালকেই এ বাড়ি তুমি বেচে দেবে৷ আমার দিব্যি রইল৷
গুলের চড়টা যতটা না গালে লেগেছিল তার চাইতে অনেক বেশি লেগেছিল সম্মানে৷ বুড়ো বয়সে এতখানি হেনস্থা হতে হবে ভাবতেও পারেনি রতন৷ সন্ধেবেলা বাড়ি ফেরার আগে পর্যন্ত আগলে রেখেছিল চাঁপা৷ একটু ধাতস্থ হওয়ার পরে নস্কররা দল বেঁধে এসেছিল৷ পুরনো গলাগুলো ফিরে এসেছিল যেন৷ হাত জোড় করে নস্কর বলেছিল, পালমশাই, আপনি যেন আমাদের ভুল বুঝবেন না৷ আমরা সবাই মিলে খুব শাসন করে দিয়েছি গুলেকে৷ চাঁপা ভাগিয়ে দিয়েছিল ওদের৷ রতনকে বলেছিল, কথাটা মনে থাকে যেন৷ আমি জানি তোমার বউ-ছেলে অনেক দিন থেকেই এ বাড়ি বেচে দেওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছে৷ কেন রেখে দিয়েছ বাড়িটা? ক’টাকা আয় হয় তোমার এখান থেকে?
মাথাটা নিচু করে চড় খাওয়া গালটায় হাত বোলাতে বোলাতে রতন বলেছিল, আর তুমি? তুমি কোথায় যাবে?
চোখে চোখ রেখেছিল চাঁপা, আমার জন্য বাড়ি বেচতে পারছ না তুমি? নিজেকে এভাবে বোকা বানিও না৷ এ বাড়ি তোমাকে গ্রাস করেছে৷ তোমার রক্তে বাসা বেঁধেছে এই রাইটার্স বিল্ডিং৷ তুমি বাড়ি বেচতে চাও না এটা তোমার রোগ৷ রাত-বিরেতে টর্চ নিয়ে ঘুরে ঘুরে কী দ্যাখো? কোথাও ঝুল পড়েছে কি না? ফাটল ধরেছে কি না? ভাড়া নেওয়ার দিন অমন বাবু সেজে কেন আসো? জানি না ভেবেছ? এই বাড়ি আসলে তোমার বাতিক৷
রতন চুপ করেছিল৷ চাঁপা বলে যাচ্ছিল, আমার কথা ভেবো না৷ আমিও তো প্রাইমারি স্কুলে পড়াই৷ একা মানুষ৷ খরচ করার জায়গা নেই৷ চাইলে এর চেয়ে অনেক ভাল জায়গায় ভাড়া থাকতে পারি৷ যাইনি, তার কারণ অভ্যাস৷ আমি ঠিক ব্যবস্থা করে নেব৷ ওরা তোমাকে হেলাফেলা করে আমি বহুদিন ধরেই দেখছি৷ আর না৷ এত বড় অপমানের পর… আমি দু’-একদিনের মধ্যেই এখান থেকে উঠে যাব৷ তার পরও যদি তুমি এ বাড়ি বিক্রি না করো আমার সঙ্গে আর দেখা করতে এসো না৷
কী ভাবছেন মেসোমশাই? বললাম তো গুলে আপনার জুতো মুখে নিয়ে ঘুরবে৷ রতনকে চুপ থাকতে দেখে নীলমণি বলে ওঠে৷
রতন হাত তুলে নীলমণিকে থামায়৷ বলে, না না ওসবের দরকার নেই৷ বাড়িটা যখন বেচে দেব বলে মনস্থির করেছি তখন আর জল ঘুলিয়ে লাভ কী?
প্রতাপের চোখ চকচক করে ওঠে৷ সে বলে, ঠিক বলছ তো বাবা? এর আগে তো কতবার হ্যাঁ বলে শেষে কাটিয়ে দিয়েছ৷ পার্টি কিন্তু রেডি হয়ে বসে আছে৷ আমি কথা দিয়ে দেব৷ তখন যেন কথা ঘুরিও না৷
নীলমণি বলে, মেসোমশাই যা একখানা ফ্ল্যাট উঠবে না! আপনি শুধু দেখবেন৷ আমি সব দাঁড়িয়ে থেকে করাব৷
রতন ওদের দিকে তাকায়৷ তার মনে হয় যেন দুটো লোভী বেড়াল বসে বসে থাবা চাটছে৷ ভীষণ বিরক্ত লাগে৷ সে চুপ করে থাকে৷ প্রতাপ আবার বলে, তাহলে দলিলপত্তর সব রেডি করি বাবা?
রতন মাথা নাড়ে৷ বলে, তোরা যা এখন৷ আর তোর মাকে একটু ডেকে দিস৷
চলে যেতে যেতে ছোপ ধরা দাঁত বের করে একগাল হাসে নীলমণি৷ বলে, যাক অ্যাদ্দিনে মেসোমশাইয়ের সুবুদ্ধি হল৷
তিন.
শিবরাম বিশ্বাস বাড়িটা কিনতে চেয়েছে৷ বারাসাত, হৃদয়পুর, মধ্যমগ্রাম অঞ্চলের এক নম্বর দালাল শিবরাম৷ এপারে এসে কিছু কিছু বাঙাল খুব পয়সা করেছে৷ শিবরাম তাদেরই একজন৷ বাঙালদের এই পয়সা করার ব্যাপারটা রতন কিছুতেই মন থেকে মেনে নিতে পারে না৷ তাই ছেলে যখন শিবরাম বিশ্বাসের কথা বলল রতন মৃদু আপত্তি করেছিল, কেন অনাদি সাহাকে দে না৷ চেনাশোনা লোক৷
বউ ঝামরে উঠেছিল, রাখো তোমার চেনাশোনা৷ তোমার দৌড় জানা আছে৷ ভাড়াটের হাতে যে মার খায় তার কথার কী দাম!
ছেলে মাকে থামায়, আঃ চুপ করো৷
রতনের দিকে একটু এগিয়ে এসে প্রায় ঘুষ দেওয়ার ভঙ্গিতে বলে, বাবা জমি বাড়ির দাম ছাড়াও দু’-দুটো ফ্ল্যাট দেবে শিবরাম বিশ্বাস৷ থ্রি বিএইচকে৷ তিনটে বেডরুম দুটোতেই৷ নীলমণি খোঁজ নিয়ে দেখেছে এত কিছু আর কেউ দেবে না৷
প্রতাপের শালা নীলমণিকে একটুও পছন্দ করে না রতন৷ এক্কে নম্বরের ফোরটোয়েন্টি৷ রতন মনে মনে ভাবে নিশ্চয়ই নীলমণি শিবরামের সঙ্গে তলে তলে কিছু একটা সাঁট করছে৷ মরুকগে যাক৷ বাড়িটাই যখন বেচে দিচ্ছে তখন আর এসব নিয়ে মাথা ঘামাতে চায় না সে৷ বেশি ভাবলেই বুকটা কেমন ধড়ফড় করে, হাতগুলো ঝিনঝিন করে৷ প্রেশার বেড়ে যায়৷ গত কয়েক দিনে রতন বহুবার চেষ্টা করেছে এই বাড়ি বিক্রির ব্যাপারটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে৷ পারেনি৷
আজ প্রায় দু’হপ্তা হতে চলল রতন ও বাড়িতে যায়নি৷ খবর পেয়েছে, চাঁপা নাকি বাড়ি ছেড়ে দিয়েছে৷ একটু দূরেই একটা এক কামরার ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছে৷ একা মানুষ, একগাদা ঘর নিয়ে করবেটা কী?
বয়স হলে মানুষ একটু দার্শনিক হয়ে পড়ে৷ আসলে কিছুই না এত দিনকার অভিজ্ঞতা তার মাশুল গুনতে শুরু করে৷ ইদানীং রতনও নানা কিছু ভাবে৷ গুলের চড়টা একেবারে শিকড় সমেত নাড়িয়ে দিয়ে গেছে৷ সকালে চায়ের কাপ হাতে রতন উঠোনে বসে থাকে৷ কখনও একটু কাগজ পড়ে, কখনও উঠোনের নিম গাছটার দিকে তাকিয়ে থাকে৷ গাছটার বয়স রতনের সমান৷ রতনের জন্মের দিন ঠাকুরদা না কি গাছটা পুঁতেছিল৷ বাড়িতে নিমগাছ থাকা ভাল৷ পাতার ফাঁক দিয়ে ঝিরিঝিরি রোদ আসে৷ রতন তাকিয়ে থাকে৷ প্রতাপ চেয়েছিল গাছটা বিক্রি করে দিতে৷ প্রতাপের বিয়ের সময় একটু ধার হয়েছিল৷ তখন বলেছিল, বাবা নিমগাছটা বেচে দিই? শোধ হয়ে যাবে৷
রতন অবাক হয়ে তাকিয়েছিল৷ এরা সব উড়িয়ে পুড়িয়ে দিতে চায়৷ আগলানো জিনিসটা নেই এদের রক্তে৷ রতন মাঝে মাঝে আপশোস করে, ছেলেটাকে মানুষ করা গেল না৷ মায়ের অন্ধ আদরে নষ্ট হয়ে গেল প্রতাপ৷ পয়সা ছাড়া কিছুই চিনল না৷ বলতে গেলে আবার মা ছেলের হয়ে ঝগড়া করে৷ ইচ্ছে করত মা-ছেলে দুটোকেই জুতোপেটা করতে৷ কিন্তু সাহসের অভাবে আর হয়ে উঠল না৷
গাছটার দিকে তাকিয়ে রতন নিজের ভেতরেই খলবল করে হাতড়ায়৷ তল আর পায় না৷ আজ বহুদিন ধরে চাঁপাকে সে লুকিয়ে রেখেছিল নিজের মধ্যে৷ সে যে চাঁপাকে ভালবাসে চাঁপা ছাড়া আর কাউকে বুঝতে দেয়নি৷ সেদিন অজ্ঞান হওয়ার পর চাঁপা নাকি হুড়মুড় করে নেমে এসছিল তিনতলা থেকে৷ কোলে মাথা নিয়ে জলের ঝাপটা দিয়েছিল৷ প্রথম প্রথম গুলে একটু তড়পাচ্ছিল৷ চাঁপা কিছু বলেনি, শুধু এক দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল গুলের দিকে৷ বেশিক্ষণ সইতে পারেনি গুলে৷ চুপচাপ সরে পড়েছিল৷ কেউ কেউ হয়তো সন্দেহ করেছে সেদিন৷ করুক গে, রতনের বয়ে গেছে৷
চাঁপাও চলে গেল৷ রতন বুঝে পায় না এখনও তার কিসের টান বাড়িটার ওপর৷ যতবারই ভাবে আর কদিনের মধ্যেই রাইটার্সের দখল নেবে শিবরাম বিশ্বাসের লোক বুকের ভেতরটা হু হু করে ওঠে৷ দেওয়ালগুলোকে ভেঙে ফেলবে৷ একটা একটা করে উপড়ে নেবে দরজা-জানলা৷ দুলাল ঘোষের দ্বিতীয় পক্ষের বউটার গায়ে খুব রং৷ নস্করের ছোট ছেলের বউ বোধহয় পোয়াতি৷ ওরা যদি উঠতে না চায় শিবরাম বোধহয় গুন্ডা লাগিয়ে তুলে দেবে৷ দালালদের অনেকরকম কানেকশন থাকে৷ উঠোনের চৌবাচ্চাটা কি রাখবে ওরা? মনে হয় না৷ ফ্ল্যাটবাড়ি দেখতেই অন্য রকম৷ খুব বুদ্ধি খাটিয়ে বানানো৷ আগেকার দিনের মতো এখানে একটা ঘর, ওখানে একটা ঘর, এরকম এলোমেলো নয়৷ গুলেকে চোখের সামনে বড় হতে দেখেছে, আর সেই গুলেই কি না গায়ে হাত তুলল! রতন যে ঘরে থাকত সেখানে একটা ছবি আছে৷ ননীচোরকে হাতেনাতে ধরেছেন মা যশোদা৷ খুব সুন্দর ছবি৷ ওটা নিয়ে আসতে হবে৷ আর একটা অ্যাশট্রে৷ অনেক দিন আগে তারাপীঠ থেকে কিনেছিল৷ রতন বিড়ি-টিড়ি খায় না৷ ওর মধ্যে কলম রাখত৷ বড় সাধের জিনিস৷ ওটাও নিয়ে আসতে হবে৷ কী রং করবে ওরা? এখন তো লাল রং৷ মধ্যে মধ্যে সাদা৷ আসল রাইটার্স বিল্ডিঙের রং৷ মাসের পয়লা তারিখে আর পাটভাঙা পাঞ্জাবি পরবে না রতন৷
পয়লা তারিখটার জন্য সারা মাস অপেক্ষা করত রতন৷ ভাড়া নয়, ভাড়া নয়৷ ক’টা টাকাই বা আদায় হতো? তবু রতন খুব সাজত৷ নিজের ঘরে বসে থাকত, সবাই এক-এক করে ভাড়া দিয়ে যেত৷ নিজেকে কেমন যেন রাজা বাদশা মনে হত তার৷ এ সবই তার নজরানা৷ সন্ধেবেলা বাড়ি ফেরার সময় স্টেশনের পাশের দোকান থেকে এক খিলি পান কিনত৷ বরফের ওপর সাজানো রুপোলি তবক দেওয়া মিঠে পাতি পান৷ মুখে দিলেই গলে যায়৷ দাঁতের চাপে পট করে এলাচ দানা ফাটে৷ ভুরভুর করে সুগন্ধ৷ বারো টাকা দাম৷ নিজের পেছনে খরচ করার লোক নয় সে৷ শুধু ওই একটা দিন৷ বাকি দিনগুলোর ছাপোষা রতন সেদিন যে পালবংশের শেষ সম্রাট৷
বাড়িটার সঙ্গে চলে যাবে তার সাম্রাজ্যও৷ যাক৷ আর এত ঝক্কি নিতে পারবে না সে৷ বয়স হয়েছে, শরীরও দেয় না৷ নিত্যনতুন অশান্তি৷ তার ওপর ছেলে আর বউ রোজ তাগাদা করে৷ বউয়ের ইচ্ছা হয়েছে ফ্ল্যাটে থাকবে৷ ওরা যা চায় তাই হোক৷ রতন আর ভাববে না৷ মনকে শক্ত করে সে৷ সবই অনিত্য৷
প্রতাপ আর নীলমণি হন্তদন্ত হয়ে আসে৷ হাতে একতাড়া কাগজ৷ প্রতাপ বলে, বাবা কথাবার্তা সব ফাইনাল হয়ে গেছে৷ দু’লাখ টাকা অ্যাডভান্স করেছে বিশ্বাস৷ এখন শুধু তোমাকে কয়েকটা সই করতে হবে৷ দলিলপত্রগুলো তোমার ঘরে রাখলাম৷ দেখে শুনে নাও৷ কাল সবাই বসব৷ বিশ্বাসও আসবে৷ তখন সই করলেই হবে৷
রতন মাথা নাড়ে৷ কাগজপত্র রতনের ঘরে রেখে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে যায় ওরা৷ যাওয়ার সময় নীলমণি দাঁত বের করে হাসে৷
ঘরে এসে রতন বিছানার ওপর বসে৷ প্রতাপ টেবিলের ওপর রেখে গেছে দলিল৷ তবে আসল নয় জেরক্স৷ বাপের কাছে আসল দলিল রেখে বেরিয়ে যাবে এত বোকা নয় প্রতাপ৷ রতনের হাসি পায়৷ সে তো মনস্থির করেই নিয়েছে বাড়িটা বেচে দেবে৷ বলেওছে অনেকবার৷ তাহলে এখনও সন্দেহ করে কেন এরা! ওদের হাত থেকে রেহাই নেই৷
দলিলগুলো দেখার প্রয়োজন বোধ করে না সে৷ আজ খবরের কাগজ পড়া হয়নি৷ কাগজ নিয়ে মন দিয়ে খবর পড়তে শুরু করে রতন৷ খবর পড়লে মন ভাল হয়৷ নানারকমের কাহিনি৷ পড়তে পড়তে ভেতরের পাতায় একটা ছবিতে চোখ আটকে যায়৷ বুকটা ছ্যাঁত করে ওঠে৷ রাইটার্স বিল্ডিঙের সংস্কার হবে তাই কোনও কোনও জায়গা ভাঙা পড়ছে৷ একটা মুশকো লোক মাথার ওপর বিরাট এক হাতুড়ি তুলে দাঁড়িয়ে আছে৷ এই মারল বলে৷ দেওয়ালটা প্রায় ভাঙা শেষ৷ আর একটুখানি বাকি৷ ওই একটা ঘায়েই সেটুকুও খসে যাবে৷ ভয় লাগে রতনের৷ ভেঙে ফেললে সব বাড়িকেই একরকম দেখতে লাগে৷ আসল রাইটার্স আর নকল রাইটার্সে তখন কোনওই ফারাক থাকে না৷
হঠাৎই চিনচিনে একটা ব্যথা শুরু হয় রতনের বুকে৷ ভয়টা একটু একটু করে ছড়িয়ে পড়ে সারা শরীরে৷ আর ভয় পেতে পেতেই চিরকেলে ভীতু রতন দাস জীবনে প্রথমবার একটা সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে৷
সীতারাম নস্করের মনটা ক’দিন থেকেই ভাল নেই৷ রাইটার্স বিল্ডিংয়ের পাট ওঠাতে হল বলে৷ গুলেটাই দায়ী এর জন্য৷ ক’দিন আগে রতনের ছেলে প্রতাপ লোকজন নিয়ে এসে বাড়ি মাপজোক করে গেছে৷ যাওয়ার আগে হুমকি দিয়ে গেছে এ মাসের মধ্যে বাড়ি খালি না করে দিলে শিবরাম বিশ্বাসের গুন্ডারা পেঁদিয়ে তুলে দেবে৷ নস্কর কথা পেড়েছিল কিন্তু অন্য ভাড়াটেরা কেউই মামলা মোকদ্দমা করতে রাজি নয়৷ সবাই নিজের নিজের বাড়ি করে ফেলেছে অনেকদিন আগেই৷ শুধুমুধু শিবরাম বিশ্বাসের সঙ্গে লাগতে যাওয়ার কোনও মানে হয় না৷ সবারই প্রাণের ভয় আছে৷ তার ওপর গতকাল রাতে দুটো ছেলে এসে রতনের খোঁজ করছিল৷ নস্কর ঠিক বুঝেছে রতনের খোঁজ করার অছিলায় বিশ্বাসই লোক পাঠিয়েছিল৷ রতন যে আজ দু’হপ্তার ওপর এ বাড়িতে আসে না কে না জানে? একটু চমকে দেওয়া আর কী!
এতদিনের বাড়ি, ছাড়ো বললেই ছাড়া যায় নাকি! কিন্তু উপায় নেই৷ ধুরধুর, কিছুই ভাল লাগে না৷ ব্যাজার মুখে মর্নিংওয়াকে যাচ্ছিল নস্কর৷
বাড়ি থেকে বেরিয়েই সামনে পুলিশ দেখে বড় ঘাবড়ে গেল সে৷ পুলিশকে বেজায় ভয় খায় নস্কর৷ তার গলা শুকিয়ে এল৷ গুন্ডা অবধি ঠিক ছিল, এখন বিশ্বাস পুলিশ পাঠিয়েছে৷ এক্ষুনি হয়তো সব মালপত্তর ঘর থেকে টেনে টেনে ফেলবে৷
পুলিশ দু’জন নস্করের দিকে এগিয়ে এল৷ একজন বলল, আপনি এখানে থাকেন?
নস্কর ভয়ে ভয়ে উত্তর দিল, আজ প্রায় তিরিশ বছর আছি এ বাড়িতে৷
নাম কী?
আজ্ঞে সীতারাম নস্কর৷ এ বাড়ির মালিক পালমশাই আমার বন্ধু মানুষ৷
একবার থানায় যেতে পারবেন?
থানায়? কেন? কী ব্যাপার?
রতনবাবুকে গতকাল সন্ধে থেকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না৷ ওনার বাড়ির লোক মিসিং ডায়েরি করেছেন৷
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন