সৌভিক চক্রবর্তী
শশাঙ্কবাবু টিভিতে সিনেমা দেখছেন কিন্তু তাঁর কোলের ওপরে একটা মোটা খাতা খোলা৷ তাঁর হাতে কলম৷ সিনেমা দেখতে দেখতে দেখতে মাঝে মাঝে তিনি সেই খাতায় নোট নিচ্ছেন৷ তিনি আসলে একটা গম্ভীর প্রবন্ধ লিখছেন৷ প্রবন্ধের শিরোনাম ‘ভারতীয় সিনেমায় ইটের পাঁজা, তরিতরকারি, স্টেশনারি দ্রব্য ও অন্যান্য আসবাব প্রসঙ্গ’৷ খুবই জটিল বিষয়৷
শশাঙ্কবাবু গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ৷ জটিল বিষয়েই তাঁর আগ্রহ৷ হালকা জিনিসপত্র তিনি পছন্দ করেন না৷ তিনি লক্ষ করেছেন, সিনেমায় মারপিটের দৃশ্যগুলোতে ভিলেনরা নায়কের হাতে মার খেয়ে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ইটের দেওয়াল, শাকসব্জি ভর্তি ভ্যানগাড়ি, বিভিন্ন স্টেশনারি দোকান এবং চেয়ার টেবিলের ওপরে আছাড় দিয়ে পড়ে৷ এই ব্যাপারটা তাঁর খুবই ইন্টারেস্টিং লেগেছে৷ তিনি ইতিমধ্যেই আড়াইশো সিনেমা দেখে ফেলেছেন৷ তাঁর ধারণা আরও গোটা পঞ্চাশ সিনেমা দেখার পরে একটা সিদ্ধান্তে আসা যাবে৷ তাই এখন তিনি শুধুই নোট নিচ্ছেন৷ মোট তিনশোটা সিনেমা দেখা শেষ করে প্রবন্ধটা লিখতে শুরু করবেন৷
রোজ সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফিরে তিনি দু’ঘণ্টা সিনেমা দেখেন৷ এই সময় তাঁকে বিরক্ত করা বারণ৷ আজ তিনি একটা বাংলা ছবি দেখছেন৷ নায়কের ঘুসিতে ভিলেন একটা ভ্যানের ওপরে গিয়ে পড়েছে৷ সব তরিতরকারি ছত্রখান হয়ে পড়ে আছে রাস্তায়৷ তিনি জায়গাটা পজ করে দ্রুত হাতে নোট নিতে শুরু করলেন, ‘রাস্তায় যে সব সব্জি দেখা যাচ্ছে তার মধ্যে আছে বাঁধাকপি (ছোট সাইজ), গাজর, পালং শাক, কুমড়ো (লম্বা কুমড়ো, এই কুমড়োয় জল ভাব বেশি, মিষ্টি কম), টমেটো, পোকা বেগুন…’
এই পর্যন্ত লিখেই তিনি থামতে বাধ্য হলেন৷ ঘরের ভেতর কথাবার্তার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে৷ তিনি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন, তাঁর দশ বছরের ছেলে বুবাই টেবিলের ওপর ঝুঁকে পড়ে একটা গঙ্গাফড়িংয়ের সঙ্গে কথা বলছে৷ তিনি বুবাইয়ের কথাগুলো শোনার চেষ্টা করলেন৷ বুবাই গঙ্গাফড়িংটাকে বলছে, ‘কী বলতে চাও পরিষ্কার করে বলো৷ আমার অত ধানাইপানাই ভাল লাগে না৷ বাবাকে কী বলব? বাগানে ব্লিচিং পাউডার না দিতে? আচ্ছা বেশ বলব৷’
শশাঙ্কবাবু টিভি বন্ধ করে বুবাইয়ের পেছনে এসে দাঁড়ালেন, ‘বুবাই৷’
বুবাই তার বাবাকে খুবই ভয় পায়৷ ভয় পাওয়ার সঙ্গত কারণ আছে৷ শশাঙ্কবাবু মনে করেন, কোনও অবস্থাতেই বাচ্চাদের আশকারা দিতে নেই৷ তাতে তারা বাঁদর হয়ে যায়৷ কিন্তু মায়েরা আশকারা দেওয়ায় ওস্তাদ৷ তাই ছেলেপুলের শাসনের ব্যাপারটায় নজর রাখা একজন সৎ বাবার অবশ্য কর্তব্য৷ সে জন্য তিনি প্রতি পনেরো দিন অন্তর তাঁর দুই ছেলেকে ধরে কিছুক্ষণ ধোলাই দেন৷ ছেলেরা দোষ না করলেও তিনি দোষ খুঁজে বার করতে পারেন৷ এ ব্যাপারে তাঁর মধ্যে একটা প্রচ্ছন্ন গর্ব আছে৷ তাঁর বড় ছেলে টুকাই এ বছর কলেজে উঠেছে৷ সে এখন হস্টেলে থাকে৷ তাই ইদানীং পাক্ষিক ধোলাইটা বুবাই একাই খাচ্ছে৷ বাবার গলার আওয়াজে সে চমকে উঠে বলল, ‘কী বাবা?’
‘তুমি এখানে কী করছ? তোমার মা কোথায়?’
‘মা একটু বেরিয়েছে৷’
শশাঙ্কবাবুর মেজাজটা আরও গরম হয়ে গেল৷ তাঁর স্ত্রী চন্দ্রিমা বড়ই আড্ডাপ্রবণ৷ কোনও গম্ভীর জটিল বিষয়ে তার আগ্রহ নেই৷ তিনি কয়েকবার এই প্রবন্ধটা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে দেখেছেন চন্দ্রিমা হাত আড়াল করে হাই তুলছে৷ আজও সে আড্ডা দিতে বেরিয়েছে৷ সে নিশ্চয়ই এখন পাশের বাড়িতে গিয়ে বেড়ালদের আদর করছে আর তালের বড়া আরও নরম করার নতুন পদ্ধতি শিখছে৷ তিনি বুবাইকে বললেন, ‘তোমাকে আমি বলেছিলাম, আমি যখন প্রবন্ধ লিখব আমায় বিরক্ত করবে না৷ তুমি কথা শোনোনি৷’
বুবাই গঙ্গাফড়িংটাকে দেখিয়ে বলল, ‘সরি বাবা৷ আসলে ও উড়তে উড়তে এ ঘরে চলে এল৷’
‘তুমি আবার পোকাদের সঙ্গে কথা বলা শুরু করেছ?’
‘আমি বলতে চাই না বাবা৷ ওরা নিজে থেকেই বলে৷’
‘বুবাই তুমি যথেষ্ট বড় হয়েছ৷ তোমাকে বুঝতে হবে পোকারা কথা বলতে পারে না৷ তুমি যেটাকে কথা বলা ভাবছ সেটা তোমার কল্পনা৷ বুঝতে পেরেছ?’
‘হ্যাঁ বাবা৷’
‘যাও পড়তে বোসো৷ আর যদি তোমায় উঠতে দেখি তা হলে চড় মেরে হালুয়া টাইট করে দেব৷’
বুবাই চলে যাওয়ার পরে শশাঙ্কবাবু কিছুক্ষণ ফড়িংটার দিকে তাকিয়ে রইলেন৷ তিনি বুঝতে পারলেন, তাঁর মাথা দাউদাউ গরম হয়ে যাচ্ছে৷ হঠাৎই তিনি একটা মোটা ডিকশনারি তুলে ধাঁ করে ফড়িংটার ওপর বসিয়ে দিলেন৷
বিষয়টা হল, বুবাই পোকাদের কথাবার্তা বুঝতে পারে৷ ঘটনাটা ঘটেছিল গত বছর কালীপুজোর ঠিক আগের রাতে৷ বাজি পোড়ানোয় বুবাইয়ের প্রবল উৎসাহ৷ সে বিছানার ওপরে বসে বাজি গোছাচ্ছিল আর লাইটের সামনে কতগুলো শ্যামাপোকা উড়ে বেড়াচ্ছিল৷ হঠাৎই দু’টো শ্যামাপোকা উড়তে উড়তে বুবাইয়ের হাতে এসে বসল৷ বুবাই স্পষ্ট শুনল তারা বলছে, ‘বুবাই তুমি তো ভাল ছেলে৷ তুমি এত বাজি পোড়াও কেন? তুমি তো জানো আগুন দেখলে আমরা ঠিক থাকতে পারি না৷ আগুনের মধ্যে ঝাঁপ দিয়ে পড়ি৷ আমাদের ব্যথা লাগে, কষ্ট হয়৷ তুমি আর বাজি পুড়িও না৷’
শ্যামাপোকাদের কথা শুনে সেবার একটাও বাজি পোড়ায়নি বুবাই৷ সেই শুরু, তার পর থেকেই সে খেয়াল করে দেখেছে পোকারা তার সঙ্গে কথা বলে৷ মাঝে মাঝেই তারা নানারকম খবর দেয় তাকে৷ একবার একটা কাঠ পিঁপড়ে তাকে বলেছিল, ‘কাল খুব বৃষ্টি হবে৷’ বুবাই পাত্তা দেয়নি কিন্তু পরের দিন সত্যি সত্যিই তুমুল বৃষ্টি হল৷ পাড়ার মোড়ে একহাঁটু জল জমে গেল৷
বুবাই যে পোকাদের সঙ্গে কথা বলে এটা বাড়ির কেউই বিশ্বাস করত না৷ কিন্তু একটা ঘটনার পর থেকে বুবাইয়ের মা ব্যাপারটা অল্প অল্প বিশ্বাস করতে শুরু করেছে৷ ঘটনাটা হল, বুবাইদের বাড়িতে মশারি টাঙিয়ে শোয়ার রেওয়াজ নেই৷ একদিন রাতে শোয়ার সময় বুবাই তার মাকে বলল, ‘মা আজ ভোরবেলায় বাবাকে একটা ডেঙ্গির মশা কামড়াবে৷ ওরা আমাদের তিনজনকেই কামড়াবে বলেছিল কিন্তু আমি অনেক দরাদরি করে একে নামিয়েছি৷ বাবাকে যাতে ছেড়ে দেয় সে জন্য খুব রিকোয়েস্ট করেছিলাম৷ ওরা শোনেনি৷ বাবার ওপরে ওদের খুব রাগ৷ বাবাকে ওরা কামড়াবেই৷ বাবাকে বলো আজ মশারির মধ্যে শুতে৷’
বিষয়টা শুনে শশাঙ্কবাবু গম্ভীর হয়ে গেছিলেন৷ স্ত্রীকে বলেছিলেন, ‘আমার ছেলে যে দিন দিন পীর হয়ে উঠছে বুঝতে পারছিলাম৷ কিন্তু তুমি যে তার এক নম্বর শিষ্য হয়েছ এইটা বুঝতে পারিনি৷ ছেলেকে তো আর নাম ধরে ডাকা যাবে না দেখতে পাচ্ছি৷ পোকাদের কথা শুনে সে ভবিষ্যৎদ্রষ্টা হয়েছে৷ তাকে তো পোকাবাবা বলতে হবে৷ আর এই বাড়িটা হবে পোকাবাবার মাজার৷ ফারদার যদি তুমি আমাকে এ সব গাঁজাখুরি কথা বলো তা হলে কিন্তু বিরাট সমস্যায় পড়ে যাবে৷’
মশারি ছাড়াই শুয়ে পড়লেন শশাঙ্কবাবু৷ দু’দিন পরে তাঁর ধুম জ্বর এল৷ রক্ত পরীক্ষা করে দেখা গেল ডেঙ্গি৷ ছ’ দিন হাসপাতালে কাটিয়ে তিনি বাড়ি ফিরলেন৷ বুবাই ভেবেছিল, বাবা তাকে খুব মারবেন৷ কিন্তু শশাঙ্কবাবু কিছুই বললেন না৷ গম্ভীর হয়ে রইলেন৷ পরের দিন বাড়িতে পেস্ট কন্ট্রোলের লোক এল৷ তারা সারা বাড়িতে, বাড়ির চারপাশে এবং বাগানে পোকা মারার ওষুধ ছড়াল৷ বিকেলের দিকে সেই শ্যামাপোকা দু’টো বুবাইকে খবর দিল, ওষুধ ছড়ানোয় সব মিলিয়ে মোট লাখ খানেক পোকা মারা গিয়েছে৷ তাদের মধ্যে বেশির ভাগই পিঁপড়ে৷ তারা জানাল, এই ঘটনায় পোকারা খুবই ভয় পেয়েছে৷ তারা আর বুবাইদের বাড়ির ত্রিসীমানায় আসতে চাইছে না৷
সে রাতে মায়ের বুকে মুখ গুঁজে অনেকক্ষণ ধরে কেঁদেছিল বুবাই৷
দেখতে দেখতে দুর্গাপুজো শেষ হয়ে ফের কালীপুজো এসে পড়েছে৷ বাগানের শিউলি গাছগুলো এখনও ঝেঁপে ফুল দিচ্ছে৷ ভোরবেলায় উঠলে দেখা যায় বাগানটা পুরো সাদা হয়ে রয়েছে৷ বুবাই বরাবারই ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে পড়ে৷ তার পরে কিছুক্ষণ বাগানে হাঁটাহাঁটি করে পড়তে বসে৷ আজও সে এক আঁজলা শিউলি ফুলের গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে হেঁটে বেড়াচ্ছিল, হঠাৎই একটা শ্যামাপোকা তার বুড়ো আঙুলের ওপর এসে বসল৷ এ সময় প্রচুর শ্যামাপোকা দেখতে পাওয়া যায়৷ তবে পোকাটাকে দেখেই বুবাই বুঝল, এ তার সেই বন্ধু শ্যামাপোকা দু’টোর একটা৷ সে বলল, ‘সুপ্রভাত৷’
পোকা কোনও উত্তর দিল না৷ বুবাই বলল, ‘তুমি আজ একা কেন? তোমার বন্ধু কোথায়?’
পোকা মনমরা হয়ে বলল, ‘বন্ধু নেই৷ কাল পুড়ে গেছে বাজির আগুনে৷ আমার মন ভাল নেই কিন্তু তোমাকে একটা জরুরি কথা বলতে এলাম৷’
বুবাইয়ের মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল৷ সে কেঁদে ফেলল৷ তাকে কাঁদতে দেখে পোকা বলল, ‘শোনো এটা কান্নাকাটির সময় নয়৷ তোমার বাবার খুব বিপদ৷ বাবাকে বোলো আজ যেন একা একা বাড়ি না ফেরে৷’
‘কেন? বাবার কী হবে?’
‘অত কথা বলার সময় নেই৷ তোমায় যেটা বললাম মনে রেখো’, পোকা উড়ে গেল৷
চিন্তায় পড়ে গেল বুবাই৷ বাবার জন্য তার খুবই টেনশন হচ্ছে৷ সে জানে, পোকারা ফালতু কথা বলার লোক নয়৷ কিন্তু তার এই কথা তো বাবা বিশ্বাস করবেন না৷ উল্টে মেরে দিতে পারেন৷ অনেকক্ষণ চিন্তা করে বুবাই সিদ্ধান্ত নিল, বাবা যাই বলুন না কেন বাবাকে সাবধান করে দেওয়া তার কর্তব্য৷ বাবাকে সে ভয় পায় ঠিকই কিন্তু ভালও বাসে৷ বাবার যদি কিছু হয় সে খুব কষ্ট পাবে৷ বাবা যেবার ডেঙ্গি হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ছিল, বুবাই খুব কেঁদেছিল৷ তার বাবাটা রাগী বটে কিন্তু খারাপ নয়৷
শশাঙ্কবাবু খবরের কাগজ পড়ছিলেন৷ বুবাই তাঁর পাশে গিয়ে দাঁড়াল এবং ভয়ে ভয়ে গোটা ব্যাপারটা বলল৷ শশাঙ্কবাবু কাগজটা ভাঁজ করে উঠে দাঁড়ালেন এবং ছেলের গালে প্রচণ্ড এক চড় বসিয়ে দিলেন৷ স্ত্রীকে ডেকে বললেন, ‘ছেলের মাথা খারাপের লক্ষণ দেখা দিয়েছে৷ আজ অফিস থেকে ফিরে ওকে সায়কিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে যাব৷ ছেলেকে নিয়ে তৈরি হয়ে থাকবে৷ তোমার আশকারায় ছেলের মাথার স্ক্রু আলগা হয়ে গেছে৷ তুমি সামনে দাঁড়িয়ে দেখবে ডাক্তার কেমন করে ওই ঢিলা স্ক্রু টাইট দেয়৷ কাঁদবে না, ডোন্ট ক্রাই৷ মা-ছেলেতে মিলে কান্না জুড়েছ! এটা কি কোনও দুঃখের সিনেমা?’
ছেলেকে ভবিষ্যৎদ্রষ্টার ভূমিকায় দেখে সকাল থেকে মেজাজ গরম ছিল কিন্তু বোনাসের টাকাটা হাতে পেয়ে শশাঙ্কবাবুর মনটা ভাল হয়ে গেল৷ শশাঙ্কবাবু যে অফিসে চাকরি করেন সেখানে পুজোর বোনাস দেওয়া হয় কালীপুজোর সময়ে৷ বোনাসের টাকা ছাড়াও এবার তিনি সারা বছরের ওভার টাইমের একটা টাকা পেয়েছেন৷ টাকার অঙ্কটা সব মিলিয়ে বেশ মোটাসোটা৷ এর পরে তাঁর মনটা মারাত্মক টাইপের ভাল হয়ে গেল যখন এক সহকর্মী তাঁকে একটা ডিভিডি এনে দিলেন৷ এই ডিভিডিতে সাত-সাতটা ঝাড়পিটের ছবি আছে৷ সিনেমাগুলো দেখার জন্য শশাঙ্কবাবু ছটফট করতে শুরু করলেন৷ কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও বেরতে বেরতে সাড়ে পাঁচটা বেজে গেল৷ আটটার সময় বুবাইয়ের জন্য ডাক্তারের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট৷ ডাক্তার অবশ্য বাড়ির কাছেই বসেন৷ যেতে বেশি সময় লাগবে না৷
গোটা রাস্তায় খুব জ্যাম৷ বাস গোটা পথটাই প্রায় ঠোক্কর খেতে এল এল৷ শশাঙ্কবাবু যখন নামলেন তখন সোয়া সাতটা বেজে গেছে৷ বাসস্ট্যান্ডে একটাও রিক্সা নেই, চারদিক অন্ধকার, লোডশেডিং৷ টাকার বান্ডিলটা প্যান্টের চোরা পকেটে ঢুকিয়ে দ্রুত হাঁটা দিলেন তিনি৷ সোজা রাস্তায় হাঁটতে গেলে অনেকটা সময় লাগবে তার চেয়ে মিত্তিরদের পোড়ো বাড়ির পাশ দিয়ে শর্টকাট হবে৷ রাস্তাটা বড় জঙ্গুলে৷ ইদানীং পৌরসভা থেকে বড় বড় আলো লাগানো হয়েছে৷ দু’বছর আগেও ভূতের ভয়ে লোকে রাস্তাটা এড়িয়ে চলত৷ কিন্তু এই লোডশেডিংয়ে তো সে সব আলো কোনও কাজেই লাগবে না৷ এ সব ভেবে শশাঙ্কবাবু একটু থমকালেন কিন্তু তার পরেই সব দ্বিধা ঝেড়ে মেন রাস্তা থেকে নেমে গলিপথে ঢুকে গেলেন৷
বেশ খানিকটা এগিয়ে আসার পরে তাঁর মনে হল, কাজটা ঠিক হয়নি৷ রাস্তাটা এত অন্ধকার যে এক হাত দূরের জিনিসও দেখা যাচ্ছে না৷ ঝিঁঝিঁর ডাকে নৈঃশব্দ্যটা যেন চেপে বসছে গলায়৷ তিনি ঠিক করলেন, আর এগোবেন না৷ পিছিয়ে গিয়ে মেন রাস্তায় উঠবেন৷ কিন্তু পেছন ঘুরতেই কোমরে একটা আলতো খোঁচা খেলেন শশাঙ্কবাবু৷ খোঁচাটা মৃদু হলেও জিনিসটা যে ধারালো সেটা স্পষ্ট বুঝলেন তিনি৷ ঘোরটা কাটিয়ে ওঠার আগেই দু’টো লোক তাঁকে ঘিরে ধরল৷ দুঃসহ অন্ধকারেও তাদের হাতের ইস্পাতের ফলাগুলো চকচক করছে৷ একজন চাপা গলায় বলল, ‘টাকাটা দিয়ে দিন৷ তার পরে ভালয় ভালয় বাড়ি চলে যান৷’
শশাঙ্কবাবু বুঝতে পারলেন, তাঁর পা কাঁপছে৷ গলা শুকিয়ে যাচ্ছে৷ তীব্র এক মৃত্যুভয় তাঁর পা বেয়ে উঠে আসছে কোমর বরাবর৷ একটা লোক তার হাতের ফলাটা শশাঙ্কবাবুর গালে ছুঁইয়ে দিয়ে বলল, ‘জলদি করুন৷’
গাল কেটে রক্ত বেরচ্ছে৷ আর কোনও উপায় না দেখে শশাঙ্কবাবু পকেটে হাত ঢুকিয়ে টাকার বান্ডিলটা বার করে আনলেন আর ঠিক তখনই দপ করে রাস্তার আলোগুলো জ্বলে উঠল৷ সেই আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে গেল তাঁর৷ সামলে নিয়েই তিনি এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখলেন; আলোর কাছ থেকে নেমে এসে ঝাঁকে ঝাঁকে শ্যামাপোকা লোক দু’টোর নাকে মুখে চোখে ঢুকে পড়ছে আর তারা পোকাদের কবল থেকে বাঁচতে অন্ধের মতো এদিক ওদিক হাতড়াচ্ছে৷ তিনি দেখলেন এই সুযোগ৷ সামনের লোকটাকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে প্রাণপণে ছুটতে শুরু করলেন৷ ওই তো বড় রাস্তা… আর একটু… আর একটু৷
বাড়ি ফিরে শশাঙ্কবাবু স্নান করে সোজা ঘরে ঢুকে লিখতে বসে গেলেন৷ স্ত্রীকে বললেন, ‘বুবাইকে এখনই ডাক্তার দেখানোর দরকার নেই৷ আর আমাকে এখন ডিস্টার্ব করবে না৷ খুবই জটিল একটা বিষয় নিয়ে কাজ করছি৷ ও রকম হাঁ করে দেখছ কী? হাঁ করা লোকজন আমি একদম পছন্দ করি না৷’
শশাঙ্কবাবু নতুন একটা খাতা বার করলেন৷ নতুন প্রবন্ধটার নাম দিলেন, ‘শ্যামাপোকার উপকারিতা ও অন্যান্য প্রসঙ্গ’৷ সিনেমার প্রবন্ধটা এখন ক’দিন পরে লিখলেও চলবে৷
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন