সৌভিক চক্রবর্তী
মুনিয়াকে খারাপ দেখতে৷ খারাপ বললে কম বলা হয়, মুনিয়াকে কুৎসিত দেখতে৷ একটা মানুষকে দেখতে যতটা খারাপ হতে পারে মুনিয়া তার চেয়েও খারাপ৷
বছর খানেক আগে মুনিয়ার মামা একদিন হঠাৎ বলেছিল, ‘তোর জন্যে পাত্র দেখেছি মুনিয়া৷’
তার চোখের সামনেই বাবা যখন মায়ের পিঠের ওপরে পা চাপিয়ে মায়ের গায়ে কেরোসিন তেল ঢেলে দেশলাই ঠুকে দিয়েছিল, তখনও এতটা অবাক হয়নি মুনিয়া৷ মামার কথাটা শুনে সে পুরো ভক হয়ে বসে রইল৷
কুটনো কোটা থামিয়ে মামি বলেছিল, ‘পাত্র? এই বাঁদরিকে যে বিয়ে করতে চাইছে সে কি মানুষ? না কি বাঁদর?’
মামির কথায় পাত্তা না দিয়ে বাইরে তাকিয়ে উদাস হয়ে গেছিল মামা৷ বলেছিল, ‘আমি কোনও কথা লুকোইনি৷ সব ক্লিয়ার করে বলে দিয়েছি৷ বলে দিয়েছি, মেয়েকে দেখতে ভাল না আর আমি কিছু দিতেথুতে পারব না৷ থাকলে নিশ্চয়ই দিতাম৷ তোর মামি তিন বার বিয়োলো, তিনবারই মেয়ে৷ সে আমার কপাল৷ তার ওপরে তুই এসে জুটলি৷ বয়স্থা মেয়ে, তোকে তো আইবুড়ো ফেলে রাখতে পারি না৷ তবে আমি বলেছি, মেয়ে দেখতে খারাপ হতে পারে কিন্তু কাজেকম্মে ফাস্টো কেলাস৷ রান্না করা থেকে নর্দমার ময়লা পরিষ্কার, হেন কাজ নেই মুনিয়া পারে না৷’
মামি বলেছিল, ‘সবই তো বুঝলাম৷ কিন্তু ছেলে কী করে?’
একটু চুপসে গিয়ে মামা বলেছিল, ‘দ্যাখ মুনিয়া, যে যেমন কপাল করে আসে৷ তোর কপালে তো আর সিনেমার হিরো জুটবে না, যা পাবি তাই মেনে নিতে হবে৷ ছেলে এমনিতে ভাল কিন্তু মাথায় একটু শর্ট আছে বুঝলি৷ মানে ওই হাবা টাইপ৷ আর হ্যাঁ, ছেলেটা বোবা-কালা৷ তা সে বোবা-কালা বর তো ভাল৷ তোকে কিছু বলতে পারবে না, আর তুই যখন তখন আশ মিটিয়ে খিস্তি করতে পারবি৷’
নিজের রসিকতাতেই হো হো করে হেসে উঠেছিল মামা৷ তা এমন পাত্রেও মুনিয়ার আপত্তি ছিল না৷ হোক না বোবা-কালা, একটা গোটাগুটি মানুষ তো বটে৷ আসলে তারও যে বিয়ে হতে পারে এটা ভেবেই সে বড় আশ্চর্য হয়ে গেছিল৷
ছেলের দুই দাদা মেয়ে দেখতে এসেছিল৷ ঘর থেকে বেরিয়েই তাদের একজন চড় মেরে মুনিয়ার মামাকে মাটিতে ফেলে দিয়ে বলেছিল, ‘শালা, এই তোমার খারাপ দেখতের নমুনা? আমাদের ভাই বোকা-হাবা হতে পারে, তবে সে মানুষ৷ তার সঙ্গে পেতনির বিয়ে দেব না৷
সেদিন মুনিয়া বুঝেছিল, একটা মানুষকে দেখতে যতটা খারাপ হতে পারে সে তার চেয়েও খারাপ৷
এই ঘটনার পরে মুনিয়া খেতে বসলেই মামি তার পাতে খানিকটা করে ফলিডল ঢেলে দিত৷ প্রাণের ভয়ে সে একদিন লালগোলা প্যাসেঞ্জারে চেপে শেয়ালদায় এসে নেমেছিল৷ একটা এনজিও তাকে নিয়ে যায়৷ হপ্তাখানেক একটা হোমে রেখেছিল তারা৷ তারাই এই কাজটা জুটিয়ে দিয়েছে মুনিয়াকে৷
এ বাড়িতে মোট ছ’টা কুকুর আছে৷ মুনিয়ার কাজ তাদের দেখভাল করা৷ কুকুরগুলো খুবই ভদ্র৷ নিজের নিজের খাবারটাই খায়, অন্যের খাবারে মুখ দিতে যায় না নেড়ি কুত্তাদের মতো৷ মুনিয়া বোঝে, আসলে জাত কথা বলে৷
এ বাড়ির মানুষগুলোও তেমন জাতের৷ এত ভদ্র মানুষ জীবনে দেখেনি মুনিয়া৷ আর সত্যি বলতে অরণিদাদার মতো সুন্দর মানুষও এর আগে কখনও দেখেনি সে৷ ক্যালেন্ডারে সাদা জোব্বা পরা যিশু খ্রিস্টের ছবি থাকে না, সেই যিশুকে যদি হাফপ্যান্ট পরিয়ে মন্টার সেলুনে নিয়ে গিয়ে চার আনা-আট আনা ছাঁট দিয়ে দেওয়া হয়, তা হলে অবিকল অরণিদাদার মতো লাগবে৷
প্রথম দিন অরণিদাদাই দরজা খুলেছিল৷ তখন কাকু বা কাকিমা বাড়িতে কেউ ছিল না৷ অরণিদাদা বলেছিল, ‘নমস্কার, আপনি মুনিয়া তো? আসুন, ওই সোফাটায় বসুন৷ আমি আপনাকে জল দিচ্ছি৷ মা এখনই চলে আসবে৷’
জল খেতে খেতে জলের মধ্যে দিয়ে মানুষটাকে দেখছিল মুনিয়া৷ মানুষটা বলেছিল, ‘আমার নাম অরণি৷ আপনি আপাতত এখানেই বিশ্রাম করুন৷ আর মুখটা ওভাবে ঢেকে রেখেছেন কেন? আরাম করে নিজের মতো বসুন৷’
মুনিয়ার সারা মুখে অসংখ্য আঁচিল৷ ডান চোখের ওপরে বড় একটা আব চোখটাকে ঢেকে ফেলেছে৷ সাধারণত হাসলে মানুষকে ভাল লাগে৷ কিন্তু মুনিয়াকে লাগে না৷ সে হাসলে তার দু’পাটি উঁচু দাঁত কালো মাড়ি সমেত বাইরে বেরিয়ে এসে তাকে আরও কদাকার করে তোলে৷ এমন মুখ কি ওই যিশুর মতো মানুষটাকে দেখানো যায়? মুখ নিচু করে মুনিয়া শুধু বলতে পেরেছিল, ‘আমাকে আপনি করে বলবেন না৷’
একটু হেসে অরণিদাদা বলেছিল, ‘বেশ৷ তুমি কেমন আছ মুনিয়া?’
এর পরে যদি মুনিয়া যদি কেঁদে ফেলে তাকে কি দোষ দেওয়া যায়? চোখের জলের সঙ্গে মানুষকে কেমন দেখতে তার কোনও সম্পর্ক নেই৷
এ বাড়িতে এসে ভালই ছিল মুনিয়া৷ তার তেইশ বছরের জীবনে কখনও এত ভাল থাকেনি সে৷ কেউ মারে না, অকথা-কুকথা বলে না, চার বেলা ভাল-মন্দ খাওয়া-নরম বিছানা; আর কী লাগে মুনিয়ার মতো একটা মানুষের ভাল থাকার জন্যে!
কিন্তু ভাল থাকাটা নষ্ট করল অরণিদাদাই৷ মানুষটা বড় বেখেয়ালি৷ ওভাবে কেউ দরজা খুলে রাখে? দেখতে খারাপ হলেও মুনিয়া তো রক্ত-মাংসের মানুষ৷ অরণিদাদা, তুমি এত বুঝদার মানুষ, অথচ এটুকু বুঝলে না? দেখতে খারাপ মানুষের বুঝি কষ্ট হয় না? আর ওই মেয়েটাই বা কেমন? হায়াপিত্তি নেই৷ তুই তো দেখবি, দরজা খোলা কি না? সুন্দরপানা ছেলে দেখলি আর ঝাঁপ দিয়ে পড়লি!
সেই দুপুরে দরজার পাশে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়েছিল মুনিয়া৷ ঘরের ভেতরে অরণিদাদা আর মেয়েটা৷ কেমন সাপের মতো দেখাচ্ছিল ওদের৷ সাদা রঙের সাপ, শঙ্খ লেগেছে যেন৷ অরণিদাদা ফিসফিস করে বলছিল, ‘রানি, রানি, আরও আদর করো রানি৷’
পা কাঁপছিল মুনিয়ার৷ সে যত দেখছিল তার তলপেটটা কেমন ফাঁকা হয়ে যাচ্ছিল৷ সে কাঁদছিল আর অভিশাপ দিচ্ছিল মেয়েটাকে, ‘মর মর রাক্ষসী৷ স্টোভ ফেটে পুড়ে যা৷ না, মরিস না, বেঁচে থাক৷ আমার মতো দেখতে হয়ে বেঁচে থাক৷’
তার পর থেকেই শরীরে বড় জ্বালাপোড়া হয় মুনিয়ার৷ কেমন একটা দমচাপা কষ্টে গলা ধরে থাকে৷ কিছু খেতে গেলেই বমি পায়৷ কষ্টের এই কাঁটাটা সন্না দিয়ে টেনে তোলা যায় না৷
মেয়েটা মাঝে মাঝেই আসে৷ যিশুর মতো দেখতে অরণিদাদা কখনও দরজা বন্ধ করে, কখনও বা ভুলে যায়৷ মুনিয়ার অভিশাপ কাজ করে না৷ মেয়েটাকে আরও সুন্দর দেখায়৷ অগত্যা বাগানের মালি রতু শেখের কাছে মাঝে মাঝে শরীরটা ছেড়ে দেয় মুনিয়া৷
রতু শেখ ভাল লোক না৷ সে মদ খায়, গায়ে পচা মাছের মতো গন্ধ৷ তার ছুঁচলো নখ বসে যায় মুনিয়ার পিঠে, বুকে৷ মুনিয়ার খুব ঘেন্না লাগে, ব্যথা লাগে৷ তবু সে কিছু বলে না৷ কারণ রতু শেখ তার দেওয়া শর্তে রাজি হয়েছে৷ পশুর মতো রমণ করতে করতে রতু শেখ তার শ্লেষ্মা জড়ানো ঘড়ঘড়ে মাতাল গলায় বলে, ‘রানি, রানি, আরও আদর করো রানি৷’
মুনিয়া জানে, প্রত্যেকটি মেয়ের জীবনেই একবার না একবার রানি হওয়ার সুযোগ আসে৷ কারও ক্ষেত্রে সেটার স্থায়িত্ব অনেক বেশি, কারও খুব কম৷ মুনিয়া দ্বিতীয় দলে৷
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন