ঘটু – সৌভিক চক্রবর্তী

সৌভিক চক্রবর্তী

ঘটুকে নিয়েই গোলমালটা বাধল৷ ঠিক ঘটুকে নিয়ে নয়, ঘটু কার কাস্টডিতে থাকবে সেটা নিয়ে৷

বাকি আর সব কিছুই মোটামুটি একটা ভাগ করা গিয়েছে৷ ফ্ল্যাটটা সৌম্য কিনেছিল, সৌম্যই থাকবে৷ অতএব ভাগাভাগির প্রশ্ন নেই৷ ফ্রিজ, টিভি, মাইক্রোওভেন আর ওয়াশিং মেশিন ঊর্মির কেনা৷ এগুলো সবই সে নিয়ে যাবে৷ ঊর্মি যে নিয়ে যেতে চেয়েছিল এমনটা নয়৷ সৌম্যই বলেছিল, তোর সব কিছু তুই নিয়ে যাস৷

ঊর্মি বলেছিল, সব বলতে?

যেগুলো তুই কিনেছিস সেগুলো৷ তা ছাড়া তোর নিজের ব্যবহারের যা কিছু আছে সেগুলোর কথাও বলছি৷ নেলপালিশ কিংবা স্যানিটারি ন্যাপকিন আমার কোনও কাজে আসবে না৷

অসভ্যের মতো কথা বলবি না৷

সরি৷

সব কিছু নিয়ে যেতে পারব না৷ তুই ফেলে দিস৷ পুড়িয়েও দিতে পারিস৷ যা খুশি৷

দু’জনেই চুপ করে গেছিল৷ কিছুক্ষণ পর সৌম্য বলেছিল, আমরাই যখন আলাদা হয়ে যাচ্ছি তখন যার জিনিস তার কাছে থাকাই ভাল৷ তোকে কিছু ভাবতে হবে না৷ আমি লোক লাগিয়ে সব মালপত্তর তোর বাড়িতে পৌঁছে দেব৷

তিন বছর আগে সৌম্য আর ঊর্মি যখন সৌম্যর বাগুইহাটির ফ্ল্যাটে থাকা শুরু করল তখন ওরা ঠিক করেছিল, সৌম্য ফ্ল্যাটের ইএমআই দেবে আর ঊর্মি দরকারি জিনিসপত্রগুলো কিনবে৷ সংসার খরচের জন্য দু’জনের মাইনের কিছুটা করে দিয়ে একটা ফান্ড তৈরি করা হবে৷

ভাগাভাগি করতে তাই খুব একটা জটিল অঙ্ক কষতে হয়নি৷ কিন্তু ঘটুকে কিছুতেই ভাগ করা যাচ্ছে না৷ এই নিয়ে আরও একপ্রস্থ ঝগড়া হয়েছে৷

ঊর্মি ট্রলিব্যাগে জামাকাপড় গোছাচ্ছিল৷ সৌম্য মেঝেতে বসে এক মনে সিগারেট খাচ্ছিল৷ এমনিতে ঊর্মি সিগারেট খাওয়া পছন্দ করে না৷ কিন্তু কাল থেকে যখন আর একসঙ্গে থাকা হবে না তখন এই পছন্দ-অপছন্দগুলোর কী দাম? ঊর্মি ঘাড় ঘুরিয়ে একবার দেখেওছে৷ কিন্তু কিছু বলেনি৷ টিভি, ফ্রিজ ইতিমধ্যেই ঊর্মির বাড়িতে পাঠানো হয়ে গেছে৷ তাই ঘরটা বেশ ফাঁকা ফাঁকা লাগছে৷ সৌম্য ভাবছিল, ঘরে যে এত জায়গা আছে আগে বোঝা যায়নি৷ ঘটু বসেছিল সৌম্যর পাশেই৷

ব্যাগ গোছাতে গোছাতেই ঊর্মি জিজ্ঞেস করেছিল, ঘটুর ব্যাপারে কিছু ভেবেছিস?

সৌম্য নিস্পৃহ গলায় বলেছিল, কী ভাবব?

ঘুরে তাকিয়েছিল ঊর্মি, ঘটু কার সঙ্গে থাকবে?

খুবই স্বাভাবিক ভঙ্গিতে সৌম্য বলেছিল, কার সঙ্গে আবার? আমার সঙ্গে থাকবে৷

তোর এরকম মনে হওয়ার কারণ?

কারণ কিছু নেই৷ এমনিই৷

আমি যদি বলি, আমার কাছে থাকবে?

বললে বল৷ কত কিছুই তো বলিস৷ সব কথা আমি ধরি না৷

আমি ইয়ার্কি মারছি না সৌম্য৷

আমিও না৷

ঘটুকে কাল আমি নিয়ে যাব৷

প্রশ্নই ওঠে না৷

ঘটু কি তোর একার?

আমি কখন বললাম সেটা?

তাহলে আমিও ঘটুকে নিয়ে যেতে পারি৷

সম্ভব নয়৷ ওর এখানে থেকে অভ্যেস৷ দুম করে নতুন জায়গায় মানিয়ে নিতে পারবে না৷

সেটা আমি বুঝে নেব৷ আমি ঘটুকে ছাড়া থাকতে পারব না৷

আমিও না৷

তা হলে?

তুই এখানেই থেকে যা৷ দু’টো ঘর আছে তো৷ যে যার মতো থাকব৷

সম্ভব নয়৷

তা হলে ঘটুকে বরং অর্ধেক করে ফেলি৷ তোর হাফ৷ আমার হাফ৷ তুই কোন দিকটা নিবি? ল্যাজা না মুড়ো?

অসভ্যের মতো কথা বলবি না সৌম্য৷

সরি৷

কোনও সমাধান পাওয়া যায়নি৷ ঘটুকে নিয়ে ঊর্মি পাশের ঘরে ঘুমোতে চলে গেছিল৷

ঊর্মির পিসতুতো বোন উকিল৷ তাকে ডেকে আনা হল৷ সে পরামর্শ দিল, এই সামান্য ব্যাপারে কোর্ট-কাছারি করলে লোক হাসবে৷ তার চেয়ে বরং সাত দিন- সাত দিন করে ঘটু দু’জনের কাছেই থাকুক৷ ঘটু দু’জনের সঙ্গেই থেকেছে৷ আশা করা যায় তার অসুবিধা হবে না৷ শেষমেশ এই শর্তেই রাজি হল সৌম্য আর ঊর্মি৷

ঘটু এখন সৌম্যর কাছে থাকবে৷ সাত দিন পর ঊর্মি এসে তাকে নিয়ে যাবে৷ ঊর্মির ভাগের সাত দিন ফুরিয়ে গেলে ফের সৌম্যর পালা৷ এ ভাবেই চলবে আপাতত৷

ঘটুর ভাল নাম ঘটোৎকচ রায়চৌধুরী চক্রবর্তী৷ নামটা মোটামুটি ভাল হলেও পদবিটা যে খুব কুৎসিত সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই৷ কিছু করার ছিল না৷ সৌম্যর পদবি চক্রবর্তী, ঊর্মির রায়চৌধুরী৷

ঘটুর একটা ফেসবুক প্রোফাইলও আছে৷ সেখানে তার যা মনে হয় সে পোস্ট করে৷ কিছুদিন আগে সে লিখেছিল :

তেলাপোকা খেতে খুবই খারাপ৷ খুব খিদে পেলেও তেলাপোকা খাওয়া উচিত নয়৷ পোকামাকড় না খাওয়াই ভাল৷ তবে মাঝে মাঝে গঙ্গাফড়িং খাওয়া যেতে পারে৷ বেশ খেতে৷

তারও কিছুদিন আগে ঘটুর জন্মদিন ছিল৷ এক প্লেট বিফ স্টেকের সামনে বসে আছে এমন একটা ছবি পোস্ট করে সে লিখেছিল :

হর কুত্তে কা জনমদিন আতা হ্যায়৷

তাতে হাজার ছাব্বিশটা লাইক আর দু’শো তিরিশটা কমেন্ট পড়েছিল৷

ঘটুর জন্মদিন আর সৌম্য-ঊর্মির একসঙ্গে থাকা শুরু একই দিনে৷ তাই ওই দিনটা বেশ ঘটা করেই পালিত হয়৷

তিন বছর আগের কথা৷ তখন দিনকাল বেশ ভালই ছিল তাই সৌম্য আর ঊর্মির এত ঝগড়াঝাঁটি হত না৷ তখন হাত ধরাধরি করে রোদে পুড়তে ভাল লাগত৷ বৃষ্টিতে ভিজতে ভাল লাগত৷ মোটকথা, একসঙ্গে থাকতে সব সময় ভাল লাগত৷

একদিন বিকালে প্যারামাউন্টে ডাব শরবত খেতে খেতে ঊর্মি সৌম্যকে বলেছিল, তোর ফ্ল্যাটটা আমার খুব পছন্দ হয়েছে৷ কিন্তু আমি তো ছাই ছুটিই পাচ্ছি না৷ ছুটি পেলে গুছিয়ে দিয়ে আসব৷

আরাম করে ডাবের শাঁস খেতে খেতে সৌম্য বলেছিল, গোছানোর কী আছে?

ঊর্মি বলেছিল, অনেক কিছু আছে রে হাঁদা৷ প্রথমেই পর্দা লাগাতে হবে৷

পর্দা কেন? জানলা খোলা থাকাই তো ভাল৷ বেশ আলো বাতাস আসবে৷

ওরকম জানলা খোলা ঘরে আমার লজ্জা করে৷

চারতলায় তো৷ পাখি ছাড়া দেখার কেউ নেই৷

তা হলেও৷ আগের দিন আমার খুব লজ্জা অস্বস্তি হচ্ছিল৷ আমি বারবার সচেতন হয়ে যাচ্ছিলাম৷

তা হলে এবার থেকে জানলা বন্ধ করে নেব৷

না, ক্লস্ট্রোফোবিক লাগবে৷

সৌম্য ভাবছিল, মহাপুরুষরা যে বলেছেন, মেয়েমানুষ খুবই যন্ত্রণার বিষয়, কথাটা মিথ্যে নয়৷ তবে তাঁরা একটা জিনিস বলতে ভুলে গেছেন, এই যন্ত্রণায় বড়ই আরাম৷

ঊর্মি বলেছিল, আমার খুব ইচ্ছে করছে একসঙ্গে থাকতে৷

আরও দু’গ্লাস ডাব শরবতের অর্ডার দিয়ে সৌম্য বলেছিল, তো থাকলেই হয়৷ আজই চল৷

না ওরকম এক-আধ দিনের জন্য নয়৷ বেশ অনেক দিন৷ এক বছর… দু’বছর… তিন বছর কিংবা আরও বেশি৷ বলতে বলতেই গালে রঙ লেগেছিল ঊর্মির৷

লজ্জা পেলে মেয়েদের দেখতে বড় সুন্দর লাগে৷ মেয়েরা যখন ভালবাসার কথা বলতে গিয়ে লজ্জা পায় তখন তাদের পরির মতো দেখায়৷ তার ওপর ঊর্মির তো আবার সুন্দরী বলে নামডাক আছে৷ তার দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে সৌম্য বলেছিল, থাক না একসঙ্গে৷ কে আটকাচ্ছে তোকে?

ঊর্মি একটু অবাক হয়েছিল, তুই সিরিয়াস?

সৌম্য তার চেয়েও বেশি অবাক হয়ে বলেছিল, সিরিয়াস নয় তো কী? এটা কি ফাজলামির বিষয়?

কবে থেকে শুরু করা যায় বল তো?

ভাল জিনিসে দেরি করা ঠিক হবে না৷ আজ থেকেই৷

আমার বাড়িতে কী বলব?

যা সত্যি তাই বলবি৷

মা-বাবা যদি ঝামেলা করে?

তুই আরও বেশি ঝামেলা করবি৷ তুই তো দারুণ ঝগড়া করতে পারিস৷

অসভ্যের মতো কথা বলবি না৷

সরি৷

একটা ছেলে খুব অগোছালো ভাবে জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারে৷ একটা মেয়ে কিন্তু সেটা পারে না৷ প্রত্যেকটি মেয়েই তার পিঠে একটা অদৃশ্য সংসার নিয়ে ঘোরে৷ সে যেখানেই যায় নিজের অজান্তে সেই সংসার পেতে ফেলে৷ সেই সংসারে দু’বেলা অনেকের পাত পড়ে৷ পৃথিবীর সবচেয়ে অগোছালো মেয়েটি পৃথিবীর সবচেয়ে গোছানো পুরুষটির চেয়ে একশো গুণ বেশী দায়িত্বশীল৷ এই অঙ্ক অনুসারেই সৌম্যর আপত্তি সত্ত্বেও ঊর্মি তাকে ঘাড় ধরে হাতিবাগান বাজারে নিয়ে গেল৷ হাতিবাগান বাজার, কয়েকটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর এবং ইলেক্ট্রনিক জিনিসের দোকান ঘুরে বাজার শেষ হওয়ার পর সৌম্য বুঝতে পারল প্রথমবার সংসার পাততে বিয়াল্লিশ হাজার একশো তেত্রিশ টাকা খরচ হয়৷ (ট্যাক্সি ভাড়া এর মধ্যে ধরা হবে না৷)

ওরা ট্যাক্সি করে ফিরছিল৷ একটু আগেই ঊর্মি টেলিফোনে তার মায়ের সঙ্গে ঝগড়া করেছে৷ তার চোখে জল৷ জলের একটা রেখা গাল বেয়ে ঠোঁটের কাছে এসে হঠাৎ থমকে গেছে৷ ঊর্মি এখনও একটু একটু কাঁদছে৷ সৌম্যর হাতটা শক্ত করে ধরে রেখেছে কিন্তু তাকিয়ে আছে রাস্তার দিকে৷ তার চোখের জলে সন্ধেবেলার কলকাতার ছায়া পড়েছে৷

সৌম্য কিছুতেই মনে করতে পারল না, কোথায় যেন পড়েছিল, প্রিয়তম নারীটি যখন কাঁদে তখন প্রেমিকের উচিত সেই অশ্রু ওষ্ঠে তুলে নেওয়া৷ কিন্তু এসব কথা বইতেই ভাল লাগে৷ বাস্তবে করতে গেলে অনেক সমস্যা হয়৷ সৌম্যর এ ব্যাপারে একটা খারাপ অভিজ্ঞতা আছে৷ সে পড়েছিল, কোনও কোনও জায়গায় নতুন জমিতে লাঙল দেওয়ার আগে মাটিকে পুজো করা হয়৷ বলা হয়, হে ধরিত্রী, আমরা তোমার কুমারীত্ব হরণ করতে চলেছি৷ কিন্তু আমরা অসহায়৷ তোমাকে কর্ষণ না করলে যে শস্য হবে না৷ আর শস্য না হলে সমগ্র মানবজাতি ক্ষুধায় মারা যাবে৷ তাই আমরা বাধ্য হচ্ছি৷ তুমি অপরাধ নিও না৷

ঊর্মিকে আদর করতে করতে প্রথমবার তার দেহে প্রবিষ্ট হওয়ার আগে ওই কথাগুলো মনে পড়ে সৌম্যর ভক্তিভাব জেগে উঠেছিল৷ সে চোখ বন্ধ করে মনে মনে বলছিল, হে সমগ্র মাতৃজাতির প্রতিভূ, আমি তোমার কুমারীত্ব হরণ করতে চলেছি… ইত্যাদি ইত্যাদি৷

চোখ খুলে সে দেখেছিল ঊর্মি তার দিকে কটমট করে তাকিয়ে আছে৷ খর গলায় ঊর্মি জিজ্ঞাসা করেছিল, কী ভাবছিস তুই? তোর ভাল লাগছে না?

ভয়ে সৌম্যর গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছিল৷ সেদিনের কথা মনে করে সৌম্য ঠোঁট দিয়ে চোখের জল মুছিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনাটা বাতিল করল৷ হঠাৎ ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষল ট্যাক্সিটা৷ সামনে একটা জটলা৷ সৌম্য নেমে দেখল, একটা রাস্তার কুকুর গাড়িতে চাপা পড়েছে৷ সে একটু এগোতেই জনতার মধ্যে থেকে একজন বলে উঠল, একটু আগে পিষে দিয়ে চলে গেল৷ তিনটে বাচ্চা ছিল৷ দু’টো গেছে৷ একটা আছে৷

সৌম্য বলল, কই সেটা?

একজন বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে এগিয়ে এল৷ রাস্তার কুকুর যেমন দেখতে হয় সেরকমই খুব সাধারণ বাদামি রঙের একটা ছানা৷ কপালে আর কানে কালো ছোপ৷ মাস দেড়েক বয়স হবে৷ খুবই ছোট৷ তবে চোখ দু’টো ভারী মায়াময়৷ মনে হয় যেন এখনই কথা বলে উঠবে৷ ভয়ে কাঁপছিল বাচ্চাটা৷

সৌম্যর মনে হল, বাচ্চাটার মধ্যে কিছু একটা অসাধারণত্ব আছে৷ এখন ঠিক বোঝা যাচ্ছে না৷ কিন্তু একটু কাল্টিভেট করলেই বোঝা যাবে৷ ততক্ষণে ঊর্মি পাশে এসে দাঁড়িয়েছে৷ হঠাৎই সে জনগণকে উদ্দেশ্য করে বলল, আমরা একে নিয়ে যাব৷ কারও কোনও আপত্তি আছে?

কেউ আপত্তি করল না৷ করার কথাও না৷ রাস্তার কুকুরের গায়ে গরম জল ঢেলে মজা আছে৷ রাস্তার কুকুর পুষতে কোনও মজা নেই৷ জনগণ সর্বদা মজার দিকে থাকে৷

ট্যাক্সি চলতে শুরু করল৷ সৌম্য বলল, ওর সঠিক জন্মদিন তো জানা নেই৷ আজকের দিনটাই ওর জন্মদিন হিসাবে ধরা হোক৷

ঊর্মি বলল, সংসারের প্রথম দিনেই আমাদের সন্তান লাভ হল৷

সৌম্য বলল, ওর নাম দিলাম ঘটোৎকচ৷ ওরফে ঘটু৷

ঊর্মি আপত্তি করল, ঘটোৎকচ কেন?

তোর নাম ঊর্মি কেন? শায়রা বানু নয় কেন? নামের কারণ থাকে না৷ এমনিই নাম দিলাম ঘটোৎকচ৷

না ঘটোৎকচ বাজে নাম৷ ভাল নাম দে৷

আচ্ছা তা হলে নেপো লিয়ন৷ সানির পূর্বপুরুষ নেপো৷

অসভ্যের মতো কথা বলবি না সৌম্য৷

সরি৷

ঊর্মি ছানাটাকে চটকাতে লাগল৷ কিছুটা যাওয়ার পর সে হঠাৎ সৌম্যকে একটা চুমু খেল৷ তার পর বলল, না ঘটোৎকচ নামটা খারাপ না৷ বেশ মানিয়েছে৷

আসলে তখন দিনকাল ভাল ছিল৷ তাই সব কিছুই ভাল লাগত৷

দুই.

সব গুছিয়ে দিতে চাইলেই কি আর গুছিয়ে দেওয়া যায়?

সকালে ব্রাশ করতে গিয়ে সৌম্য বুঝতে পারল, সে ঊর্মির ব্রাশ দিয়ে দাঁত মাজছে৷ তার ব্রাশটা ঊর্মির ব্যাগে৷ সৌম্য ভাবল, ঊর্মি গোছানো মানুষ৷ সে নিশ্চয়ই ব্রাশটা দেখে চিনতে পারবে৷ ঊর্মি ব্রাশটা নিয়ে কী করবে? ডাস্টবিনে ফেলে দেবে না কি অন্য কোথাও তুলে রাখবে?

ঘরে এসে ড্রয়ার খুলে সৌম্য দেখল, ঊর্মি তার এপিলেপসির ওষুধটা নিয়ে যেতে ভুলে গেছে৷ এই ওষুধটা ঊর্মিকে রোজ খেতে হয়৷ রাত ন’টায় ঊর্মির ফোনে অ্যালার্ম সেট করা থাকে৷ ওষুধটা খেতে গিয়ে সে খুঁজে পাবে না৷ ব্যাপারটা তাকে জানানো উচিত মনে করে সৌম্য ফোনটা হাতে নিল৷ কিন্তু তার মনে পড়ল, ফোন করা বারণ আছে৷ যাওয়ার আগে ঊর্মি নিষেধ করে দিয়ে গেছে৷

ওরা দু’জন পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ট্যাক্সির জন্য অপেক্ষা করছিল৷ কেউ কোনও কথা বলছিল না৷ শুধু চারতলার ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে প্রবল চিৎকার করছিল ঘটু৷ বিদায়বেলায় প্রগলভ হওয়ার নিয়ম নেই৷ তবে এই নিয়ম কেবলমাত্র মানুষের জন্যই প্রযোজ্য৷ ঘটুরা নিয়মের তোয়াক্কা করে না৷

তখনই ট্যাক্সিটা এসে পড়েছিল৷ ডিকিতে ঊর্মির ব্যাগগুলো তুলে দিয়েছিল সৌম্য৷ পেছনের সিটে বসে জানলার কাচ নামিয়ে ঊর্মি বলেছিল, শোন, আমাদের মধ্যে আর যোগাযোগ না থাকাই ভাল৷

সৌম্য বলেছিল, আচ্ছা৷

ঊর্মি বলেছিল, আমাকে আর ফোন-টোন করিস না৷ আমিও তোকে করব না৷

একেবারেই করব না?

না৷

খুব জরুরি দরকার হয় যদি?

যেমন?

যেমন ধর যদি হঠাৎ আমার কোনও অ্যাকসিডেন্ট হয়?

তা হলেও ফোন করার দরকার নেই৷

আচ্ছা৷

তিন বছর আগে একটা ট্যাক্সি করে ঊর্মি এ বাড়িতে এসেছিল৷ আজ একটা ট্যাক্সি ঊর্মিকে নিয়ে চলে যাচ্ছে৷ ছবির ফ্রেমটা একই থাকে, রঙগুলো একটু ওলটপালট হয়ে যায়৷ এমন কিছু বড় ব্যাপার নয়৷

সৌম্য ফোনটা রেখে দিল৷ ঘটুর জন্য খাবার গুছিয়ে রেখে সে বেরিয়ে পড়ল৷ ঘটু ছোটবেলা থেকেই ভীষণ বুঝদার বাচ্চা৷ দিনের বেলাটা সে একাই ঘরে থাকে৷ কোনও দিন ঝামেলা করেনি৷ তার কয়েকটা খেলনা আছে, সেগুলো নিয়ে নিজের মনেই খেলা করে৷ তার জন্য খাবার রাখা থাকে৷ ঠিক সময়মতো খেয়ে নেয়৷ সৌম্য ভাবে, ঘটুর মতো একটি সন্তান যে কোনও মা-বাবারই কাম্য৷ তবে সে আর ঊর্মি আলাদা হয়ে যাওয়ায় ঘটুর কষ্ট হবে৷ শিশুর সুস্থ ভাবে বড় হওয়ার পেছনে মা-বাবার বিরাট ভূমিকা থাকে৷

হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল সৌম্যর৷ ভীষণ ঠান্ডা হয়ে গেছে ঘরটা৷ বালিশের পাশেই চশমা, এসির রিমোট আর মোবাইল রাখা থাকে৷ সে হাত বাড়িয়ে আন্দাজে এসিটা বন্ধ করল৷ সৌম্য খেয়াল করল, ঘটু পাশে নেই৷ ঘটু তো এখানেই তার গায়ের সঙ্গে লেপ্টে শুয়েছিল৷ গেল কোথায়?

চশমা পরে সৌম্য উঠে বসল৷ মোবাইলে দেখল, দু’টো বাজতে দশ মিনিট বাকি৷ ঘরটাকে বিরাট বড় আর ফাঁকা মনে হল৷ খাটের একদম সোজাসুজি জানলার কাছে একটা বিনব্যাগ ছিল৷ বৃষ্টির দিনে ঊর্মি ছেলেমানুষ হয়ে যেত৷ তখন সে ওটায় বসে পা দোলাত৷ বিনব্যাগটাও ঊর্মির বাড়ি পাঠানো হয়েছে৷ সৌম্য দেখল, ঠিক সেই ফাঁকা জায়গাটায় বসে ঘটু তার দিকেই তাকিয়ে আছে৷ ঘটুর চোখ দু’টো অস্বাভাবিক রকমের জ্বলজ্বল করছে৷ সৌম্যর একটা গা ছমছমে অনুভূতি হল৷ সে ডাক দিল, ঘটু৷

ঘটু ওখানে বসেই উত্তর দিল, বলুন৷

সৌম্য জীবনে কোনও দিন এতটা চমকায়নি৷ তার মনে হল, হৃৎপিণ্ডটা গলার কাছে আটকে গেছে৷ সে যা শুনল, তা কি সত্যি? সে কি স্বপ্ন দেখছে? সৌম্য নিজের গায়ে একটা চিমটি কাটল৷ টেনশনে বেশি জোরে হয়ে গেছে চিমটিটা৷ বেশ ব্যথা লাগল৷ তা হলে কি সে হ্যালুসিনেট করছে?

বিছানায় বসেই সৌম্য একটা সিগারেট ধরাল৷ ঘটু এখনও একই জায়গায় বসে আছে৷ এখনও তার চোখ জ্বলজ্বল করছে৷ সিগারেটে দু’টো টান দিয়ে সৌম্যর মাথাটা একটু পরিষ্কার হল৷ সে খুব সন্তর্পণে ডাকল, ঘটু৷

ঘটু বলল, বারবার ঘটু ঘটু করার কিছু নেই৷ যা বলতে চান বলে ফেলুন৷

সৌম্যর গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গেল৷ না আর কোনও সন্দেহ নেই৷ স্বপ্ন নয়, নির্জলা বাস্তব৷ ঘটু পরিষ্কার উচ্চারণে কথা বলছে৷ সৌম্য প্রথম থেকেই জানত, ঘটুর মধ্যে একটা অসাধারণত্ব আছে৷ কিন্তু তা বলে এতটাও সে আশা করেনি৷ সে জিজ্ঞেস করল, আমি কি ঠিক শুনছি?

ঘটু বলল, ঠিকই শুনছেন৷

সৌম্য বলল, তুই কথা বলছিস কী ভাবে?

ঘটু বলল, দয়া করে তুই তোকারি করবেন না৷

সৌম্য থতমত খেয়ে বলল, সরি৷ আসলে আমার মনমেজাজ ভাল নেই, তাই ভুল করে বলে ফেলেছি৷ আমি কাউকেই তুই তোকারি করি না৷ কিন্তু আজ একজন রিকশাওয়ালা, একজন চায়ের দোকানদার এবং অফিসের একজন সিকিউরিটি স্টাফকে তুই করে বলে ফেলেছি৷ আর এখন আপনাকে বললাম৷ খুবই অন্যায় হয়েছে৷

ইটস ওকে৷ মন খারাপ থাকলে মানুষ খিটখিটে হয়ে যায়৷ তা মন খারাপ কেন?

ঊর্মির জন্য৷ সে তো চলে গেছে৷ আর আসবে না৷

চলে গেছে কেন?

আপনি জানেন না?

উল্টে প্রশ্ন করবেন না৷ জবাব দিন৷ ঘটু ধমক দিল৷

আমরা দু’জন একসঙ্গে মানিয়ে চলতে পারছিলাম না৷ খালি ছোটখাটো ব্যাপারে ঝগড়া হচ্ছিল৷ তাই আমরা আলাদা থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম৷ কিন্তু মানুষ তো অভ্যাসের দাস৷ ঊর্মি আমার অভ্যাস হয়ে গেছিল৷ ওকে ছাড়া থাকতে খুব অসুবিধা হচ্ছে৷

বলতে বলতেই সৌম্যর গলা ধরে এল৷ ঘটু বসেছিল৷ এবার শুয়ে পড়ল৷ শুয়ে শুয়েই বলল, আপনার কি কান্না পাচ্ছে?

সৌম্য বলল, একটু একটু৷

কাঁদবেন?

হ্যাঁ, কিন্তু আপনার সামনে লজ্জা করছে৷

নো ইস্যু৷ বাথরুমে চলে যান৷

ঊর্মি চলে যাওয়ার চারদিন পর বাথরুমে গিয়ে সৌম্য কাঁদল৷ চারদিনের জমা কান্না যেন হুড়মুড় করে বেরিয়ে এল৷

চোখেমুখে জল দিয়ে ঘরে ফিরে সৌম্য দেখল, ঘটু একই ভাবে শুয়ে আছে৷ সে ঘটুকে জিজ্ঞেস করল, জেগে আছেন?

ঘটু বলল, আছি৷ কেমন হল কান্না?

কান্না কেমন হল, এ ভাবে প্রশ্ন করা উচিত নয়৷ খুবই কুৎসিত শুনতে লাগে৷ কথাটা সৌম্যর কানে খট করে লাগল৷ তার একবার কোষ্ঠ হয়েছিল৷ ছোটমামা কী একটা ওষুধ খাইয়ে বলেছিল, বাথরুমে ঢোক৷ আমি বাইরে অপেক্ষা করছি৷

সৌম্যর পেট পরিষ্কার হয়ে গেছিল৷ বাথরুম থেকে বেরনোর পর ছোটমামা জিজ্ঞেস করেছিল, কেমন হল পায়খানা?

কথাটা মনে পড়ায় সৌম্য বিরক্ত হল৷ কান্না আর পায়খানা কি এক জিনিস! বিরক্তি চেপে সে বলল, ভালই৷

ঘটু বলল, এখন একটু আরাম লাগছে?

সৌম্যর সত্যিই বেশ আরাম লাগছিল৷ মনে হচ্ছিল, বুকের কোষ্ঠটা ক্লিয়ার হয়ে গেছে৷ ঘটু বলল, যার জন্য মন খারাপ করে কাঁদলেন, তাকে বিষয়টা জানিয়েছেন?

সৌম্য বলল, না৷

কেন?

কী ভাবে জানাব?

ফোন করে জানাবেন৷

ফোন করা নিষেধ আছে৷ তা ছাড়া আমার কষ্ট হলেই তাকে জানাতে হবে?

ঠিক৷ তবে আপনার কি একেবারেই জানাতে ইচ্ছা করছে না?

তা একটু করছে বটে৷

ফোনটা করেই ফেলুন৷

এত রাতে?

অসুবিধা নেই৷ সে জেগেই আছে৷

আপনি কী ভাবে জানলেন?

এই প্রশ্নের উত্তর দিতে চাইছি না৷

তিনবার রিং হতেই ফোন ধরল ঊর্মি, বল৷

সৌম্য বলল, কেমন আছিস?

খুবই বিরক্ত গলায় ঊর্মি বলল, এটা জানতে এত রাতে ফোন করেছিস? কী বলার আছে বল৷

তেমন কিছু বলার নেই৷ মন খারাপ লাগছিল তাই ফোন করলাম৷

ওপারে একটু নীরবতার পর উত্তর এল, আচ্ছা৷

সৌম্য বলল, তুই এখনও জেগে আছিস কেন?

তুই কখন ফোন করবি সেই অপেক্ষায় জেগে ছিলাম৷ তোর কথা শেষ হলে ঘুমিয়ে পড়ব৷

অপমান করছিস কেন?

তোকে তো ফোন করতে বারণ করেছিলাম৷

আমি করতে চাইনি৷

কে তোকে মাথার দিব্যি দিল?

ঘটু৷

ঘটু তোকে বলল, আমাকে ফোন করতে?

হ্যাঁ৷

সৌম্য আমি তোকে ফাইনালি বলছি, আমাকে আর ফোন করবি না৷ আমাদের মধ্যে আর কোনও সম্পর্ক নেই৷ এটা বুঝে নে৷ ফারদার এই সব অবান্তর কথা বলে সিমপ্যাথি আদায়ের চেষ্টা করবি না৷ ফোন রেখে দিল ঊর্মি৷

ফোনের ব্যাপারটা ঘটুকে বলতে গিয়ে সৌম্য দেখল, ঘটু কোন ফাঁকে ঘুমিয়ে পড়েছে৷ সে বসে বসে ভাবতে লাগল, কুকুর মানুষের মতো কথা বলে এমন ঘটনা সে আগে কখনও শোনেনি৷ কিন্তু এই পৃথিবীতে অনেক কিছুই ঘটে যার ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না৷

তিন.

ঊর্মি ঘটুকে নিয়ে চলে যাওয়ার পর চতুর্থ রাতে ফোনটা এল৷

একা একা থাকার কিছু সুবিধে আছে৷ কোনও পিছুটান নেই৷ কাউকে কৈফিয়ত দেওয়ার নেই৷ সৌম্যর হস্টেল জীবনের কথা মনে পড়ছিল৷ তখন বেনিয়মটাই নিয়ম ছিল৷ খাওয়া-শোয়ার কোনও ঠিক ছিল না৷ কত রাত হিন্দু হস্টেলের ছাদে বসে আড্ডা দিয়েই কেটে গেছে৷ কলেজ স্কোয়্যার থেকে ঠান্ডা হাওয়া আসত৷ প্রেসিডেন্সি কলেজের সামনের রাস্তা ভেসে যেত সোডিয়াম ভেপার ল্যাম্পের হলদে আলোয় আর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বারভাঙা ভবনের কান ঘেঁষে চাঁদ উঠত৷ ছাদের ওপর আয়েসি বেড়ালের মতো গড়াগড়ি খেত জ্যোৎস্না৷ দু’রকম আলো আর বাতাসের ককটেল গলা পর্যন্ত খেয়ে তারা ছাদেই শুয়ে পড়ত৷ প্রচণ্ড নেশা হত৷ পৃথিবীর কোনও হুইস্কির সাধ্য নেই তার সাথে পাল্লা দেয়৷

ঊর্মি চলে যাওয়ার পর এই দেড় সপ্তাহে সৌম্য চেষ্টা করেছিল তার পুরনো জীবনে ফিরে যেতে৷ কিন্তু সুর লাগছিল না কিছুতেই৷ আসলে সব কিছুরই একটা সময় থাকে৷ একই নদীর জলে দু’বার স্নান করা যায় না৷ একই মুহূর্তের জন্ম পৃথিবীতে কখনওই দু’বার হয় না৷ সব মিলিয়ে সৌম্যর খুব অস্থির লাগছিল৷ তাই আজ সে খানিকটা মাতাল হয়ে গেছে৷ ঊর্মি বা ঘটু কেউই মাতাল হওয়া পছন্দ করে না৷ ঊর্মি গালাগাল করে আর ঘটু কামড়াতে আসে৷ কিন্তু এখন বাড়িতে কেউই নেই৷ তাই বিকেলে যখন রুচিরা বলেছিল, মদ খেতে যাবি? আমি খাওয়াব, সৌম্য আপত্তি করেনি৷

অফিসের অনেকের ওপরেই রুচিরার ব্যথা আছে৷ সৌম্য সেই অনেকের একজন৷ তবে রুচিরা আজ অনেক করেছে৷ গাড়ি করে সৌম্যকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে গেছে৷ সৌম্যর পা টলছে দেখে সে রাতেও থেকে যেতে চেয়েছিল কিন্তু সৌম্য তাকে গেট লস্ট বলায় সেটা আর হয়ে ওঠেনি৷

যে মদ খাওয়ায় তাকে কখনওই গেট লস্ট বলা উচিত নয়৷ বিশেষত সে যদি সুন্দরী মহিলা হয় তা হলে এটা ক্রিমিনাল অফেন্স৷ সৌম্য ভাবছিল, রুচিরা নিশ্চয়ই এর শোধ নেবে৷ রুচিরার হাতে অনেক ক্ষমতা৷ সে এর আগে তিনজনের চাকরি খেয়েছে৷ এবার সৌম্যরটা খাবে৷ কেউ কেউ আছে যাদের প্রিয় খাদ্য অন্যের চাকরি৷ সৌম্যর একটু ভয় করছিল৷ তখনই ঊর্মির ফোনটা এল৷ তিনবার রিং হতেই সৌম্য ফোন ধরল, হ্যালো৷

ঊর্মি বলল, ঠিক আছিস?

সৌম্য বলল, ঠিক থাকব না কেন?

তোর তো মদ খাওয়ার অভ্যেস নেই, তাই জানতে চাইলাম৷

সৌম্য চুপ করে গেল৷ ঊর্মি জানল কী ভাবে? নিশ্চয়ই গলার আওয়াজ শুনে বুঝতে পেরেছে৷ গলাটাকে যথাসম্ভব পরিষ্কার করে সৌম্য বলল, মদ খাইনি তো৷

একদম মিথ্যে কথা বলবি না৷ তাও আবার রুচিরার সঙ্গে? তোকে বলেছি না ওর সঙ্গে মিশবি না৷ তর সইছে না তাই না?

সৌম্যর আক্কেল গুড়ুম হয়ে গেল৷ তবু সে তার ভেতরের পুরুষটাকে অনেক কসরত করে জাগিয়ে তুলল, খেয়েছি বেশ করেছি৷ কার বাপের কী?

অসভ্যের মতো কথা বলবি না৷

সৌম্যর ভেতরের পুরুষটা বড়ই ঘুমকাতুরে৷ ফের ঘুমিয়ে পড়ল৷ সৌম্য মিনমিন করে বলল, সরি৷

ঊর্মি বলল, দু’দিন যেতে না যেতেই সাপের পাঁচ পা দেখেছিস?

সৌম্য বলল, আর খাব না৷

মনে থাকে যেন৷

থাকবে৷

শরীর কেমন আছে?

ভালই৷ তুই হঠাৎ ফোন করলি?

আমি করতে চাইনি৷ ঘটু বাধ্য করল৷

চার…

ঊর্মি চলে যাওয়ার তেরো দিনের মাথায় অফিস থেকে ফেরার সময় বাড়ির গলিতে পা দিয়েই সৌম্য দেখল, গত তিন বছরের মতো ঘটু ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছে৷

ঘটুর তো এ সময় ঊর্মির বাড়ি থাকার কথা৷ তা হলে? সৌম্যর মনে পড়ল, ঊর্মির কাছে একটা ডুপ্লিকেট চাবি ছিল৷ সেটা ফেরত নেওয়া হয়নি৷

ঘরে ঢুকে সৌম্য দেখল, ফ্রিজ, টিভি সবই আগের যায়গায় ফিরে এসেছে৷ ঘরটাকে আগের মতোই ছোট লাগছে৷ এর মানে সে অফিস যাওয়ার পর থেকেই এই কর্মকাণ্ড শুরু হয়েছে৷ ঊর্মি রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে খুব স্বাভাবিক গলায় বলল, মাসিকে বারণ করেছিলি কেন? আমি কাল থেকে আসতে বলে দিয়েছি৷ নুডলস বানিয়েছি৷ খেয়ে বাজারে যা৷

সৌম্যও খুব স্বাভাবিক ভাবে সিগারেটের প্যাকেটটা ডাস্টবিনে ফেলে দিল৷ গোটা ছয়েক ছিল৷ যাক গে৷ ঊর্মির দিকে তাকিয়ে সে বলল, এ ক’দিনে তুই কি একটু মোটা হয়েছিস? তোর জামাটা গায়ে আঁটছে না মনে হচ্ছে৷

অসভ্যের মতো কথা বলবি না৷

সরি৷

*****

তেরো দিন সেপারেশনের পর ওরা দু’জন আবার একসঙ্গে থাকা শুরু করেছে৷ সবই আগের মতো চলছে, শুধু দু’টো ব্যাপার নতুন হয়েছে৷

এক, দু’জনেই আলাদা আলাদা করে চেষ্টা করছে, কিন্তু ঘটু কারও সঙ্গেই কথা বলছে না৷ ভৌ ভৌ করছে৷

দুই, আগে ওরা ঘটুর সামনেই পরস্পরকে আদর করত৷ এখন আর করে না, লজ্জা পায়৷

মা-বাবার আদর বা ঝগড়া কোনওটাই সন্তানের দেখা উচিত নয়৷

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন