সৌভিক চক্রবর্তী
বাড়িওয়ালার কুকুরটা মারা গেছে৷ সকাল থেকে তাই নিয়ে খুব হইচই৷ তার ওপর কুকুরটা পোয়াতি ছিল৷ তাই আহা-উহুটা একটু বেশিই হচ্ছে৷
সুপ্রভ মরার মতো ঘুমোচ্ছে৷ আমি ওকে দু’বার ডাকলাম৷ কিন্তু ও বিশেষ পাত্তা দেয়নি৷ তাই আমি একাই পাতলা একটা চাদর গায়ে দিয়ে নীচে নেমে এসেছি৷ হালকা শীত আছে বাইরে৷ কুকুরটাকে ঘিরে ছোট একটা ভিড় জমেছে৷ আশেপাশের দু’-চারজন মাতব্বর এসে পড়েছে৷ যে কোনও ঘটনা ঘটলেই এই সব মাতব্বরেরা এসে হাজির হয় এবং নানা এক্সপার্ট কমেন্ট দেয়৷ আমার বাড়িওয়ালা অবিনাশ দত্ত খুব রাশভারী লোক৷ তার চেয়েও বড় কথা, বেশ পয়সাওয়ালা মানুষ৷ তাই সবাই তাঁকে খুব খাতির করে৷ দেখলাম মাতব্বরগুলি তাঁর কথা শুনে মাথা দোলাচ্ছে৷ আমি বুঝতে পারছিলাম না, বাড়ির কুকুর মারা যাওয়ার সঙ্গে এই ধরনের আলোচনার কী সম্পর্ক? তাও দাঁড়িয়ে রইলাম, বাড়িওয়ালাকে বোঝানো দরকার, ভাড়াটেরা তার আপনজন৷ নিজের বাড়িতে থাকতে গেলেও তো মানুষকে কত উটকো খরচ করতে হয়৷ বাড়িভাড়াটাও ঠিক তেমনই একটা ব্যাপার৷ আজ মাস ছয়েক হল এই বাড়িতে আছি, অবিনাশবাবু এখনও কোনওরকম বাড়িওয়ালা সুলভ আচরণ করেননি৷ তবু আমি তাঁকে ভয় পাই৷ আসলে যে কোন বাড়িওয়ালা সম্পর্কেই আমার মনে একটা ভয় ঢুকে গেছে৷
এই নিয়ে গত দু’ বছরে কলকাতা শহরে আমি মোট পাঁচবার বাড়ি বদলালাম৷ আমার কপালে ভাড়া বাড়ি সয় না৷ নানা কারণে আমাকে ভাড়া বাড়ি থেকে উৎখাত হতে হয় এবং আশ্চর্য ভাবে তার কোনওটাতেই আমার ভূমিকা থাকে না৷ একটা উদাহরণ দিই৷ এর আগে আমি হেদোর কাছে একটা বাড়িতে ভাড়া থাকতাম, সুপ্রভও থাকত আমার সঙ্গে৷ বাড়ির মালিক এক পিউরিটান বুড়ো৷ আমি বাড়ি ভাড়া নেওয়ার সময় তিনি বললেন, দেখো বাবা তোমাদের জোয়ান বয়স৷ এই বয়সে রক্ত গরম থাকে৷ তুমি বুঝতে পারছ তো আমি কী বলতে চাইছি?
আমি বললাম, হ্যাঁ কাকু৷
তিনি বললেন, না, তুমি কিছুই বোঝনি৷ আমি বলি, তুমি শোন৷
আমি বললাম, আচ্ছা বলুন৷
তিনি বলতে শুরু করলেন, দেখো বাবা, এই জোয়ান বয়সে কয়েকটা বিষয়ের ওপর খুব আকর্ষণ থাকে৷ যেমন ধরো রাজনীতি, মদ, গাঁজা ইত্যাদি৷ সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ থাকে মেয়েমানুষের প্রতি৷ এগুলো কিন্তু দোষের নয়৷ বুঝতে পারছ তো?
হ্যাঁ কাকু৷
বাহ, খুব ভাল৷ আমি কেন এগুলো বললাম বুঝলে তো?
না, এইটা বুঝিনি কাকু৷
আমি বলতে চাইছি, এগুলো কোনওটাই করা দোষের নয়, কিন্তু আমার বাড়ির ত্রিসীমানায় এগুলো করা চলবে না৷ বুঝতে পারছ?
আমি তাঁকে বললাম, আমি এবং সুপ্রভ দু’জনেই ভদ্র ঘরের সন্তান৷ আমাদের দু’জনেরই এ ধরনের কোনও দোষ নেই৷ তিনি বাড়ি ভাড়া দিলেন এবং ঠিক তার পরের দিন সুপ্রভর বান্ধবী অদ্রিজা রাত তিনটের সময় বাড়িওয়ালার ঘরের সামনে বমি করে দিল৷ সুপ্রভ বেহুঁশ৷ আমি আর বাড়িওয়ালা বুড়ো সেই বমি ধুলাম৷ আমি বললাম, সরি৷
তিনি কিছু না বলে ঘরে ঢুকে গেলেন৷ পরের দিন পুলিশ এসে আমাকে আর সুপ্রভকে মধুচক্র চালানোর সন্দেহে আটক করল৷ অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে রেহাই পেলাম শেষমেশ৷
এই ভাবেই আমাকে বাড়ি ছাড়তে হয় বারবার৷ এই বারের বাড়িটা খুঁজে বার করেছিল সুপ্রভ৷ আমি ওর পা ধরে বলেছিলাম, ভাইরে, তুই আগে থেকে সব বলে নে৷ বলবি, আমি আর তুই থাকব৷ মাঝে মাঝে তোর বান্ধবীও থাকবে৷ তোরা মদ, গাঁজা খাবি৷ মাঝে মাঝে বমি করবি৷ সব বলে নে সোনা ভাই আমার, কিচ্ছু লুকোস না৷ ডাক্তার, উকিল, আর বাড়িওয়ালার কাছে কিছু লুকোতে নেই৷
কুকুরটার নাম ছিল লুসি৷ লুসিকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে৷ পুরসভার গাড়ি এসেছে৷ দু’জন লোক লুসির দু’টো পা ধরে ময়লা ফেলার গাড়িতে তুলছে৷ লুসির মারা যাওয়ার ধরন দেখে আমার খটকা লাগল! এত রক্ত কেন? কীভাবে মরল লুসি? আমি অবিনাশবাবুর দিকে এগিয়ে গেলাম৷ তিনি তখনও উত্তেজিত ভাবে মাতব্বরগুলিকে কিছু একটা বোঝাচ্ছিলেন৷ আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, দাদা কী করে হল এটা?
অবিনাশবাবু তেরিয়া ভঙ্গিতে আমার দিকে ঘুরে তাকালেন, কোনটা কীভাবে হল?
আমি আরও ভয় পেয়ে বললাম, এই যে লুসির মৃত্যুটা৷
তিনি কয়েক সেকেন্ড আমার দিকে অপলকে তাকিয়ে রইলেন৷ তারপর গম্ভীর গলায় বললেন, আমার সঙ্গে ফাজলামি করার চেষ্টা কোরো না৷ সবাই জানে লুসি ছাদ থেকে পড়ে মারা গেছে৷
আমি অনেক চেষ্টা করেও অবাক হওয়া আটকাতে পারলাম না৷ এই বাড়ির ছাদে যথেষ্ট উঁচু পাঁচিল দেওয়া৷ লুসি স্প্যানিয়াল জাতের ছোট কুকুর৷ নিজে নিজে পাঁচিল টপকানো তার পক্ষে বেশ কঠিন৷ অবশ্য কিছু দেখে রেগে গিয়ে লাফটাফ দিলে অন্য কথা৷ কী এমন দেখল লুসি যে এতটা রেগে গেল? আমি বললাম, কখন হল এটা?
অবিনাশবাবু বললেন, কাল রাতে কোনও একটা সময় হয়েছে৷
কী করে হল এমন? ও ছাদে গেল কী করে? ও তো ঘরে থাকে রাত্রিবেলা৷ দরজা নিশ্চয়ই ভেতর থেকে বন্ধ থাকে, তা হলে?
এ সব উত্তর জানা থাকলে আমি নিশ্চয়ই ব্যাপারটা আটকাবার চেষ্টা করতাম৷ তাই না? তোমাকে আবার বলছি আমার সঙ্গে বেশি ইয়ার্কি করার চেষ্টা করো না৷
আমার বিরক্ত লাগল, এ কী রে ভাই! খামোখা খ্যাচখ্যাচ করছে! মনে মনে দুত্তেরি, নিকুচি করেছে, বলে ওপরে উঠছি৷ দেখি সিঁড়ির ল্যান্ডিংয়ে বাড়িওলার মেয়ে টিকলি চুপ করে বসে আছে৷ এবার আমার মন সত্যি সত্যি খারাপ হয়ে গেল৷
এমন সুন্দর ফুটফুটে মেয়ে খুব একটা দেখা যায় না৷ সাত-আট বছর বয়স হবে৷ কিন্তু মেয়েটার কিছু সমস্যা আছে৷ সে কারও সঙ্গে কথা বলে না৷ সে সারাদিন চুপ করে বসে থাকে, আর একটা খেলা খেলে৷ খেলাটা তার নিজের আবিষ্কার, কারণ এই খেলাটা আমি আগে কাউকে খেলতে দেখিনি৷ সে কাঁচি দিয়ে কাগজ কাটে, যতক্ষণ সে জেগে থাকে, ততক্ষণ কাগজ কাটতে থাকে৷ তার হাত থেকে কাঁচি কেড়ে নিলে সে কাঁদে না, চিৎকার করে না৷ শুধু নিজের হাতের নখ কামড়ে কামড়ে রক্তাক্ত করে ফেলে৷ অনেক চেষ্টা করে, তার বাবা-মা হাল ছেড়ে দিয়েছেন৷ তবে টিকলি কিন্তু বোবা নয়, সে কথা বলতে পারে৷ সে কখনও সখনও লুসির সঙ্গে কথা বলত৷ কিন্তু মানুষ দেখলেই চুপ৷ ডাক্তার দেখিয়ে, অনেক আদর করে, খেলনার লোভ দেখিয়েও তাকে দিয়ে মানুষের সাথে কথা বলানো যায়নি৷
আজও দেখলাম, টিকলি ল্যান্ডিংয়ে বসেই কাগজ কাটছে৷ আমি বললাম, ঘরে যাবে টিকলি?
টিকলি যথারীতি কোনও উত্তর দিল না, কিন্তু বড় বড় চোখ মেলে আমার দিকে তাকাল৷ চোখ দু’টো যেন ছল ছল করছে৷ আমি হাত বাড়াতেই সে আমার হাত ধরল৷ আমি তাকে ঘরে পৌঁছে দিলাম৷ লুসির বসার জন্য একটা ছোট্ট মতো বিন ব্যাগ ছিল৷ টিকলি চুপচাপ সেটার পাশে বসে আবার কাগজ কাটতে শুরু করল৷
আমার খুব ইচ্ছে করছিল, টিকলির পাশে গিয়ে একটু বসে থাকি৷ কিন্তু উপায় নেই৷ অফিস যেতে হবে৷ সুপ্রভ পিএইচডি করছে, পড়ে পড়ে ঘুমনো ওকে মানায়, আমকে না৷
অফিস থেকে বেরিয়ে চা খাচ্ছি, সুপ্রভর ফোন৷ ফোন ধরতেই সুপ্রভ উত্তেজিত গলায় বলল, কোথায় রে তুই? কতক্ষণে ফিরবি?
আমার এক কলিগ অসুস্থ৷ ভেবেছিলাম, আজ তাকে দেখতে যাব৷ তাই বললাম, দেরি হতে পারে, কেন?
না, না৷ দেরি করলে হবে না৷ দরকার আছে৷ জলদি আয়৷
তুই এত উত্তেজিত কেন? কী হয়েছে?
বাড়িওয়ালাটা মহা হারামি৷ ওর খুব বাড় বেড়েছে৷ কালই এ বাড়ি ছেড়ে দেব৷ ওর বাড়িতে আমি পেচ্ছাপ করি৷
বাড়ি ছাড়ার কথা শুনে আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে এল, গলা শুকিয়ে গেল৷ আবার বাড়ি বদল! আমার ডাক ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করল৷ আমি খুব সাবধানী গলায় বললাম, তুই এত রেগে যাচ্ছিস কেন?
গালাগাল দিয়ে সুপ্রভ বলল, রাগব না তো কি ইয়ে করব? একটু আগে এসে কী বলেছে জানিস?
কী বলেছে?
জিজ্ঞেস করছে, কাল রাতে আমি বা তুই ছাদে উঠেছিলাম কি না?
তাতে অসুবিধা কী? এটা এমন কী দোষের কথা?
বোকার মতো কথা বলিস না মিলন?
কেন, কী বললাম?
সবাই জানে, কাল রাতে লুসি ছাদ থেকে পড়ে মারা গেছে৷ এখন তুই বা আমি রাতে ছাদে উঠেছিলাম কি না এটা জানতে চাওয়ার তো একটাই মানে হয় যে আমি বা তুই লুসিকে ফেলে দিয়েছি৷ তাই না?
আমার বিরক্ত লাগল৷ যে কোনও সাধারণ বিষয় নিয়ে বাড়াবাড়ি করা সুপ্রভর স্বভাব৷ বাড়িতে দুর্ঘটনা ঘটলে মানুষজন আশেপাশের লোকজনের কাছে খোঁজখবর করবে এটাই তো স্বাভাবিক৷ এটাকে এত প্যাঁচালো করে ভাবার দরকার কী? এর আগে দু’বার আমাকে সুপ্রভর জন্য বাড়ি ছাড়তে হয়েছে৷ দালালকে টাকা দিতে দিতে আমি শেষ৷ কোনও পরিস্থিতিতেই আমি এখন বাড়ি ছাড়তে পারব না৷ তাতে যদি বাড়িওয়ালা বলে আমি লুসিকে মেরেছি, সে অপবাদও আমি মাথা পেতে নিয়ে মুখ বুজে থেকে যাব৷ আমি একটু কড়া গলায় বললাম, ওভার রিঅ্যাক্ট করিস না সুপ্রভ৷ উনি এমন কিছু দোষের কথা বলেননি৷
সুপ্রভ গলা ছড়িয়ে বলল, বেশ৷ তবে তুই থাক৷ আমি কালই চলে যাব বাড়ি ছেড়ে৷
তাই যাস৷, আমি ফোনটা কেটে দিলাম৷ মেজাজটাই খিঁচড়ে গেল৷ দূর৷
বাড়ি ফিরে এসে দেখি মাথা পর্যন্ত কম্বল মুড়ি দিয়ে সুপ্রভ শুয়ে রয়েছে৷ এতটাও শীত নেই৷ শরীরটরির খারাপ হল না কি? আমি বেশিক্ষণ রাগ করে থাকতে পারি না৷ বললাম, কী রে? এই ভাবে শুয়ে আছিস কেন?
কম্বল থেকে চোখ দু’টো বার করে সুপ্রভ মিনমিন করে বলল, খুব পেটে ব্যথা করছে৷ বমি পাচ্ছে৷
ওষুধ খেয়েছিস কিছু, ডাক্তারকে ডাকব?
না, না৷ অতটাও কিছু না৷ দুপুরে উল্টোপাল্টা খেয়েছিলাম৷ আমি কিছু খাব না রাতে৷ তুই খেয়ে শুয়ে পড়৷
খেয়ে এসে দেখলাম সুপ্রভ ঘুমিয়ে পড়েছে৷ বাইরে অল্প ঠান্ডা রয়েছে, কিন্তু ঘরটা গরম৷ তার ওপর কম্বল মুড়ি দিয়েছে৷ আমি হালকা করে ফ্যান চালিয়ে দিলাম৷ লাইট নিভিয়ে দরজা ভেজিয়ে দিয়ে আমার ঘরে চলে এলাম৷ বিছানায় শুতে শুতেই ঘুমিয়ে পড়েছি৷ ঘুম ভাঙল সুপ্রভর ডাকে৷ চোখ খুলেই আমার বুকটা ধড়াস করে উঠল৷ সুপ্রভ আমার মুখের ওপর ঝুঁকে পড়েছে প্রায়৷ রাস্তা দিয়ে আসা সোডিয়ামের লাইটের আলোটা ওর মুখের একটা দিকে পড়েছে৷ রাত্রিবেলা সোডিয়ামের আলো কারও গায়ে পড়লে একটা বিভ্রম সৃষ্টি হয়৷ মানুষকে অশরীরী মনে হয়৷ সুপ্রভকে অদ্ভুত দেখাচ্ছে৷ সে ফিসফিস করে বলল, একবার আমার ঘরে আসবি মিলন?
আমি ধড়ফড় করে উঠে বসলাম, কেন কী হয়েছে?
আমার ঘরে মনে হচ্ছে কিছু একটা ঢুকেছে বুঝলি?
ঘরে ঢুকেছে মানে? কী ঢুকবে? কোথা দিয়ে ঢুকবে? ঘরের দরজা জানলা তো সব আঁট করে বন্ধ করে রেখেছিস৷ মাছি অবধি গলতে পারবে না৷
না রে, সত্যি বলছি৷ তুই একবার আয় না ভাই৷
আমার বিরক্ত লাগল৷ মাঝরাতে ঘুম ভাঙিয়ে এ আবার কী উপদ্রব! কিন্তু সুপ্রভর ঘরে ঢুকতেই ধক করে একটা বোঁটকা গন্ধ নাকে ধাক্কা মারল৷ শুতে যাওয়ার সময় তো গন্ধটা পাইনি৷ আমি ঘরের জানলাগুলো হাট করে খুলে দিলাম৷ বাইরে থেকে এক ঝলক হিমেল হাওয়া ঢুকে ঘরের গুমোট ভাবটা অনেক কমিয়ে দিল৷ আমি বললাম, এভাবে সব বন্ধ করে শুলে তো মাথা গরম হবেই৷ যা ঘুমো এবার৷
সুপ্রভ আমার হাত দু’টো ধরে বলল, বিশ্বাস কর, আমি ভুল দেখিনি৷ স্পষ্ট টের পেলাম৷
কী টের পেলি?
তুই বোস, আমি বলছি৷
বাধ্য হয়ে বসলাম৷ সুপ্রভ বলতে শুরু করল, জানিস তো হঠাৎ আমার ঘুমটা ভেঙে গেল৷ চোখ খুলে কিছু দেখতে পাচ্ছি না এত অন্ধকার৷ কত রাত হয়েছে বুঝতে পারলাম না৷ হাতড়ে হাতড়ে মোবাইলটাও খুঁজে পেলাম না৷ কম্বলটা গা থেকে সরিয়ে সবেমাত্র পাশ ফিরেছি, গায়ে কী যেন একটা ঠেকল৷ নরম নরম৷ আমি প্রথমে ভেবেছি মনের ভুল৷ খাট থেকে নামতে যাব, আবার! আমি ভয়ে পা চালিয়ে দিয়েছি৷ বিশ্বাস কর, লাথিটা লেগেছে৷ আমি স্পষ্ট বুঝেছি৷ আমার ডান পা-টা টনটন করছে৷ লাথি খেয়ে কিছু একটা খাট থেকে নেমে গেল, বুঝতে পারলাম৷ তার পরেই তোকে এসে ডেকেছি৷ তুই আমার কথা বিশ্বাস কর৷
সুপ্রভকে দেখে আমার কেমন অস্বস্তি হল৷ কেমন যেন উদভ্রান্তের মতো করছে সুপ্রভ৷ আমি ওকে ধরে বসালাম, জল খাওয়ালাম, তার পর ওর সামনেই ঘরটা খুঁজে দেখলাম৷ কোথাও কিছু নেই৷ অবশ্য না থাকারই কথা৷ বললাম, দেখলি তো? শুয়ে পড়৷ শরীর খারাপ হলে এমন হয়৷ আমি যাই৷
সুপ্রভ আমার পথ আটকে দাঁড়াল৷ অনুনয়ের সঙ্গে বলল, মিলন, আমার খুব ভয় করছে রে৷ আজ রাতটা তুই আমার সঙ্গেই শুয়ে পড় প্লিজ৷
নিজের বিছানা ছাড়া আমার ঘুম আসে না৷ তা ছাড়া ঘুমের ঘোরে সুপ্রভ হাত-পা ছোঁড়ে৷ সারা দিন অফিস করার পর আর এই যন্ত্রণা ভাল লাগে না৷ তবু বাধ্য হয়ে শুলাম সুপ্রভর পাশেই৷ হুঁশিয়ারি দিলাম, তিরের মতো সোজা হয়ে শুবি৷ আমার গায়ে যদি টাচ হয় আমি কিন্তু উঠে যাব৷
একটা খট খট শব্দে আমার ঘুম ভেঙে গেল৷ চোখ খুলতেই মনে হল ভোর হয়ে গেছে৷ ঘরে প্রচুর আলো৷ একটু ধাতস্থ হতে বুঝলাম, ঘরের সব ক’টা আলো জ্বলছে৷ কিন্তু ও কী করছে সুপ্রভ? খাটের নীচে হাঁটু গেড়ে বসে দরজার খিল দিয়ে খোঁচাচ্ছে কেন? আমি উঠে বসলাম, এই সুপ্রভ, ও কী করছিস? কী যন্ত্রণা শুরু করলি বল তো?
সুপ্রভ আমার দিকে তাকাল, ওর চোখ দেখে আমি ঘাবড়ে গেলাম৷ মানুষের চোখে এমন বন্য ভাব সচরাচর দেখা যায় না৷ ঘড়ঘড়ে গলায় বলল, মিলন, ওটা লুসি ছিল৷ হারামিটা খাটের নীচে ঢুকে ঘাপটি মেরে আছে৷ অনেকক্ষণ থেকে ঘুর ঘুর করছে৷ বাগে পাচ্ছিলাম না৷ এবার কোণঠাসা করে ফেলেছি৷ তুই ও ঘর থেকে তোর দরজার খিলটা নিয়ে আয় তো৷ আজ পিটিয়ে মারব হারামিটাকে৷
আমি খাট থেকে নেমে সুপ্রভকে টেনে দাঁড় করালাম৷ জ্বরে ওর গা পুড়ে যাচ্ছে৷ ওকে চেপে ধরে জোর একটা ঝাঁকুনি দিলাম৷ চেঁচিয়ে বললাম, পাগলামি করছিস কেন? কী হয়েছে তোর? লুসি কোথা থেকে আসবে? আর তুই এরকম করলে আমারও তো হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে৷
চেঁচানোয় কাজ হল৷ হাত থেকে খিলটা ফেলে খাটে এসে বসল সুপ্রভ৷ আমার দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বলল, তুই আমার কথা বিশ্বাস করছিস না৷ তাই না মিলন?
আমি রেগে বললাম, কী বিশ্বাস করব? যে লুসি আজ সকালে মারা গেছে, সে তোর ঘরে ঢুকে পড়েছে? এটা কি একটা বিশ্বাসযোগ্য কথা?
আমি জানতাম তুই বিশ্বাস করবি না৷ শুধু তুই কেন, হয়তো কেউই বিশ্বাস করবে না? কিন্তু আমার কাছে প্রমাণ আছে৷
প্রমাণ?
সুপ্রভ পাজামা পরেছিল৷ ডান পা হাঁটু অবধি গুটিয়ে বলল, এই দেখ প্রমাণ৷ দেখলাম, ওর পায়ের ডিমে গভীর ক্ষত৷ কুকুরের কামড় আমি খুব চিনি৷ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, ধারালো ক্যানাইনের দাগ৷ আমার মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠল৷ বুঝলাম আমি ভয় পাচ্ছি৷ হাত-পা অসাড় করে দেওয়া ভয়৷
বাকি রাতটা কীভাবে কেটেছে বলতে পারব না৷ ভোরের দিকে সুপ্রভ ঘুমিয়ে পড়ল৷ ওর গায়ে হাত দিয়ে দেখলাম, গায়ে জ্বর নেই৷ সকাল হতেই অদ্রিজাকে ফোন করলাম৷ অদ্রিজা জানাল, সে এখন মামার বাড়িতে৷ সন্ধেবেলা ফিরবে৷ তখন আসবে৷ রাতে আমাদের এখানেই থাকবে৷
আমি হাঁফ ছাড়লাম৷ কিন্তু গত রাতের ব্যাপারটা কিছুতেই পরিষ্কার হচ্ছিল না৷ কখনও কখনও বিশেষ কোনও ঘটনা মানুষের মনে গভীর প্রভাব ফেলে৷ মানুষ তখন নানা অসংলগ্ন কাজ করে৷ লুসির মৃত্যু হয়তো সুপ্রভর মনে সেই রকমই প্রভাব ফেলেছে৷ তবে এই ট্রমাগুলো সাময়িক৷ বিশ্রাম নিলেই কেটে যায়৷ আমারও বিশ্বাস, সুপ্রভকে দুটো হাসির সিনেমা দেখালেই ও ঠিক হয়ে যাবে৷ কিন্তু পায়ে যে কামড়ের দাগ দেখলাম, সেটা তো মিথ্যে নয়৷ সেটা কীভাবে হল? ওকে কখন কামড়াল কুকুর? কাল রাতে যখন ফিরলাম তখনও তো কিছু বলেনি!
ঘুম থেকে ওঠার পর সুপ্রভ একদম নর্মাল হয়ে গেল৷ রোববার আমরা মাংস খাই, ও দিব্যি সাঁটিয়ে মাংস ভাত খেল৷ পায়ের কামড়ের কথাটা জিজ্ঞাসা করেছিলাম৷ বলল, ভাবিস না৷ ডাক্তারের সঙ্গে কথা হয়েছে৷ আজ সব বন্ধ৷ কাল থেকে ইঞ্জেকশন নেব৷
আমি আর ঘাঁটালাম না৷ দুপুর তিনটে থেকে অ্যাকাডেমিতে একটা নাটক ছিল৷ সেটা দেখার জন্য রওনা দিলাম৷
বেল বাজাতেই দরজা খুলল অদ্রিজা৷ তার চুল উসকোখুসকো৷ চোখ মুখ ফুলে আছে৷ পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, সে এতক্ষণ কাঁদছিল৷ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না নয়৷ রীতিমতো হাউমাউ করে কান্না৷ মানুষ তখনই ফুঁপিয়ে কাঁদে, যখন সে তার কান্না কাউকে দেখাতে চায় না৷ তাই ফুঁপিয়ে কাঁদলে কখনওই মানুষের চোখ মুখ ফোলে না বা বেশবাস বিস্রস্ত হয় না৷ কিন্তু অদ্রিজা তার কান্না গোপন করতে চায়নি৷ তার গালে এখনও চোখের জলের নোনা দাগ স্পষ্ট৷ আমি ঘাবড়ে গেলাম৷ গত রাতের ঘটনা আমি ইচ্ছে করেই তাকে জানাইনি৷ তা হলে কি সুপ্রভ আবার কিছু করল? আমি জিজ্ঞাসা করলাম, কী হয়েছে অদ্রিজা, কাঁদছিস কেন?
ধরা গলায় অদ্রিজা বলল, তুই হাত-পা ধুয়ে আয়৷ আমি তোর ঘরে বসছি৷
অদ্রিজা আমার ঘরে ঢুকে গেল৷ উঁকি মেরে দেখলাম, সুপ্রভর ঘর ভেতর থেকে বন্ধ৷
ঘরে ঢুকতেই অদ্রিজা আমাকে বলল, মিলন আমি আর সুপ্রভর সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে চাই না৷ সেটা তোকে বলার জন্যেই বসে আছি৷ নয়তো এতক্ষণে চলে যেতাম৷
কথাটা শুনে আমি যারপরনাই খুশি হলাম৷ মনে মনে বললাম, খুব ভাল সিদ্ধান্ত৷ সুপ্রভ বেঁচে গেল৷ কিন্তু ক্রন্দনরতা কোনও সুন্দরী মেয়েকে মুখের ওপর সত্যি কথা বলার নিয়ম নেই৷ যে বলে তাকে মৃত্যুর পরে ওপরে কাঁটা, হেঁটোয় কাঁটা দিয়ে গর্তে ভরে রাখা হয়৷ ভয়ানক শাস্তি৷ তাই আমি দুঃখিত স্বরে বললাম, কেন অদ্রিজা? কী হয়েছে? তুই এ কথা বলছিস কেন?
অদ্রিজা যা বলল তার সারমর্ম হচ্ছে, সে আর সুপ্রভ পাশাপাশি শুয়ে গল্প করছিল৷ তখনই সে সুপ্রভকে জড়িয়ে ধরতে গেছে আর সুপ্রভ তার পাশ থেকে উঠে গেছে৷ অদ্রিজার জেদ চেপে গেছিল তাই সে সুপ্রভকে জোর করেছে, আর তাতেই সুপ্রভ রেগে গিয়ে তাকে ঘর থেকে বার করে দিয়েছে৷ এ কথা শুনে আমি এত খুশি হলাম যে আর একটু হলে আমি নিজেই অদ্রিজাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে যাচ্ছিলাম৷ সুপ্রভর বিবেচনা বোধের ওপর শ্রদ্ধায় আমার মনটা ভরে গেল৷ অদ্রিজাকে যে আমি বিশেষ পছন্দ করি না তার অন্যতম কারণ মেয়েটা অতিরিক্ত কামতাড়িত৷ সুযোগ পেলেই জাপটাজাপটি৷ এ কী কথা? বেশ হয়েছে, সুপ্রভ রাজি হয়নি৷ সব সময় মানুষের মুড থাকে না কি? আমি উদাস গলায় বললাম, ওর শরীরটা তো ভাল নেই, তাই হয়তো একটু রুড বিহেভ করে ফেলেছে৷ তুই ধরিস না প্লিজ৷
অদ্রিজা বলল, সেটা কথা নয় মিলন৷ ওটুকু সেন্স আমার আছে৷ কিন্তু হি ইজ মেন্টালি সিক৷ মানসিক ভাবে অসুস্থ৷ ও আমাকে কী বলে বের করে দিয়েছে জানিস?
আমি বললাম, কী?
অদ্রিজা বলল, ও আমাকে বলেছে, বলল হাউ ডেয়ার ইউ টু টাচ আ প্রেগন্যান্ট মাদার?
এক-একটা কথা কানের কাছে বাজের মতো ফেটে পড়ে৷ তাতে কানে তালা লেগে যায়৷ পরে আর কিছুই শোনা যায় না৷ মাথার মধ্যে শুধু ওই কথাটাই ঘুরতে থাকে৷ আমারও ঠিক তাই হল৷ অদ্রিজা আরও কী সব বলে যাচ্ছিল কিন্তু আমি কিছুই শুনতে পেলাম না৷ শুধু দু’টো শব্দ আমার মাথায় গেঁথে যেতে লাগল ক্রমশ৷ প্রেগন্যান্ট মাদার, প্রেগন্যান্ট মাদার৷ আশ্চর্য এক সমাপতনের আশঙ্কায় আমার সারা শরীর অবশ হয়ে এল৷
পরের দিন থেকে পরিস্থিতি আরও খারাপ হল৷ বারান্দার একটা কোণে সুপ্রভ কয়েকটা কার্ডবোর্ড পেতে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে পড়ল৷ অনেক সাধ্য সাধনা করেও তাকে সেখান থেকে নড়ানো গেল না৷ তার একটাই কথা, আমার শরীর খারাপ, আমাকে বিরক্ত করিস না৷
সারাদিন সুপ্রভ কিচ্ছু খেল না৷ ওর অবস্থা দেখে আমার কান্না পাচ্ছিল৷ আমি আর থাকতে পারলাম না৷ ওর পাশে বসে ওর হাত দু’টো চেপে ধরলাম৷ হাত দু’টো অস্বাভাবিক রকমের ঠান্ডা৷ আমার কোলে মাথা রাখল সুপ্রভ৷ আমি ওর মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে কেঁদে ফেললাম৷ আমায় কাঁদতে দেখে সুপ্রভ বলল, মন খারাপ করিস না মিলন৷ আমি ভাল আছি, শরীরটা ঠিক হলেই উঠে যাব৷ আমাকে একা থাকতে দে৷ জোর করিস না৷
সুপ্রভর স্বাভাবিক গলা শুনে মনে জোর পেলাম৷ বললাম, বেশ তোকে জোর করব না৷ কিন্তু কুড়ি ঘণ্টার ওপর তুই কিছু খাসনি৷ একটু কিছু মুখে দে৷ আমি খাইয়ে দিচ্ছি৷
সুপ্রভ মৃদু হেসে বলল, এখন কিছু খেতে পারব না মিলন৷ প্রসবের পর মা কুকুর তার সন্তানের দেহে জড়িয়ে থাকা প্লাসেন্টা খেয়ে নেয়৷ ওতেই তার শরীরের পুষ্টি হয়৷ হাই প্রোটিন৷ আর একটু পরেই তো আমার প্রসব হবে৷ আমিও তাই খাব৷ জানিস প্লাসেন্টার বাংলা কিন্তু খুব সুন্দর৷ অমরা৷
আমি একটা পান খাব৷ প্রচুর লবঙ্গ, এলাচ আর মৌরি দেওয়া পান৷ আমার মাথা ধরে আছে কাল রাত থেকে৷ পান খেলে যদি ছাড়ে৷ কাল রাতেই সুপ্রভ’র বাড়ির লোক এসে ওকে নিয়ে গেছে৷ জোর করে গাড়িতে তোলার সময় ও দু’জনকে কামড়ে দিয়েছে৷ সুপ্রভর মা পাগলের মতো কাঁদছিলেন৷ একটু আগে সুপ্রভর বড় মামা ফোন করেছিলেন হাসপাতাল থেকে৷ কড়া ঘুমের ইঞ্জেকশন দিয়ে সুপ্রভকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে৷ যদিও মোটা দড়ি দিয়ে ওর হাত-পা বাঁধা৷
পানটা মুখে দিয়ে লুসির মৃত্যু আর সুপ্রভর এই ঘটনাটার মধ্যে যোগসূত্র খুঁজতে চাইছিলাম৷ কাঁধে কেউ একটা হাত রাখল৷ আমি দারুণ ভাবে চমকে উঠলাম৷ দেখি পাড়ার এক মাতব্বর৷ তিনি হাসিমুখে বললেন, খুব ভয় পেয়েছ তাই না? অবশ্য ভয় পাওয়াই স্বাভাবিক, তোমার বন্ধুর যা হল৷ খুবই খারাপ ব্যাপার৷
বিরক্তিতে আমার নাকটা কুঁচকে গেল, এসব মাতব্বরদের এক্সপার্ট কমেন্ট আমি একেবারেই পছন্দ করি না৷ চলে যাব বলে পা বাড়িয়েছি, তিনি বললেন রাগ কোরো না৷ ক’টা কথা বলব, খুবই জরুরি৷
বলুন৷
তুমি কি এখনও ওই বাড়িতেই থাকবে?
আমি কিছু ভাবিনি৷
পারলে বাড়িটা ছেড়ে দাও৷ তোমার ভালর জন্যই বলছি, এ ঘটনা আগেও ঘটেছে৷
ভালর জন্যই যদি বলছেন তো আগে বলেননি কেন?
আমার কাঁধে ফের হাত রেখে তিনি বললেন, মাথা গরম করার সময় নয় এটা৷ আমার কথাটা মন দিয়ে শোনো৷ ওই বাড়িতে অনেক গন্ডগোল আছে৷ এখন যিনি অবিনাশবাবুর স্ত্রী, তিনি টিকলির মা নন৷ টিকলির তিন বছর বয়সে টিকলির মা, ওই একরত্তি মেয়ে আর তাদের পোষা কুকুরটাকে ছাদ থেকে ফেলে দিয়েছিল৷ কুকুরটা মরলেও মেয়েটা আশ্চর্যজনক ভাবে বেঁচে যায়৷ কিন্তু কথা বলা বন্ধ করে দেয় পুরোপুরি৷ এর পরই একদিন টিকলির মা হঠাৎ পাগল হয়ে যায়৷ সে সবাইকে কামড়াতে আসত৷ তারপর ছাদ থেকে পড়ে গিয়েই তার মৃত্যু হয়৷ তোমাদের আগে একটি নেপালি দম্পতি বাড়িভাড়া নিয়েছিল৷ দিন কয়েক পরেই মেয়েটার মাথার বিকার দেখা দেয়৷ মেয়েটা স্বপ্নে দেখত একটা কুকুর তার গলা কামড়ে ধরছে৷ অবিনাশবাবু ওদের বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেন৷ ঘটনাটা চাপা পড়ে যায় সেবার৷ যাই হোক, এতকিছু আমার বলার কথা নয়৷ তবু বললাম৷ এখন যা ভাল বোঝো করো৷
আমাকে হতভম্ব করে দিয়ে তিনি হনহন করে চলে গেলেন৷ আমার মাথা যন্ত্রণাটা আরও বেড়ে গেল৷
বাড়ি ঢুকছি, দেখি, টিকলি একটা ছোট্ট কুকুরছানার সঙ্গে খেলছে৷ বুঝলাম, নতুন কেনা হয়েছে৷ ভালই হয়েছে৷ কী নিয়েই বা থাকবে মেয়েটা? ওরও তো একটা কথা বলার লোক দরকার৷ টিকলির জন্য ভীষণ মায়া হল আমার৷ আহা রে, এত ফুটফুটে একটা মেয়ে, অথচ কী দুর্ভাগা! কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষ দুর্ঘটনার সঙ্গে এই মেয়েটাকে জড়িয়ে ফেলে কী অনায়াসে? যারা সাদা চোখে স্বাভাবিক নয়, তাদের প্রতি মানুষ বড় নিষ্ঠুর৷
দু’-দু’টো প্যারাসিটামল খেয়েছি কিন্তু মাথা যন্ত্রণাটা কমছে না কিছুতেই৷ রাত প্রায় আড়াইটে৷ আমি ছাদে দাঁড়িয়ে আছি৷ মাথার ওপর ঝকঝকে আকাশ, অনেক তারা দেখা যাচ্ছে আজ৷ হিমেল হাওয়া বইছে একটা৷ আমি একটা সিগারেট ধরালাম৷ হঠাৎ হালকা শব্দ করে ছাদের দরজাটা খুলে গেল৷ সন্ধেবেলায় দেখা কুকুরছানাটা ছাদে উঠে এসেছে, আর তার ঠিক পেছনেই টিকলি৷ আমি বুঝতে পারলাম মাথার যন্ত্রণাটা ঘাড় বেয়ে সরীসৃপের মতো বেয়ে নেমে আসছে হাত বরাবর৷ কেমন একটা অবশ লাগছে সারা শরীর৷ দৃষ্টিটাও যেন একটু ঝাপসা হয়েছে৷
টিকলি আমার দিকে এগিয়ে এল খানিকটা৷ কুকুরছানাটা তাকে টপকে গিয়ে আমার পায়ে মাথা ঘষতে শুরু করল৷ আমি অতি কষ্টে বললাম, এত রাতে ছাদে থেকো না টিকলি৷ চলো তোমাকে ঘরে দিয়ে আসি আমি৷
স্পষ্ট উচ্চারণ করে টিকলি বলল, না ঘরে যাব না৷ এটা আমার নতুন পেট৷ ওর নাম রিকি৷ কিন্তু ও একদম আমার কথা শোনে না৷ খুব দুষ্টু৷
আমি কখন যে রিকিকে কোলে তুলে নিয়েছি বুঝতে পারিনি৷ আমার মনে হল চাপ দিয়ে কেউ আমার মাথাটা ফাটিয়ে দিচ্ছে৷ আমি অনেক কষ্ট করেও রিকিকে কোল থেকে নামাতে পারলাম না৷ হাত দু’টো অসাড় হয়ে গেছে৷
টিকলি বলল, ও খুব দুষ্টু, ওকে পানিশ করা দরকার৷
শরীরের সব শক্তি এক জায়গায় করে বললাম, পানিশ?
টিকলি বলল, হ্যাঁ৷ ওকে নীচে ফেলে দাও৷
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন