সৌভিক চক্রবর্তী
মার্কশিটটা হাতে নিয়ে থ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল পলাশ৷ আজ উচ্চমাধ্যমিকের রেজাল্ট বেরিয়েছে এবং সে তিনটে সাবজেক্টে ফেল করেছে৷ যদিও পলাশ ফেল করার মতোই পরীক্ষা দিয়েছিল৷ তবু পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর থেকে রেজাল্ট বেরনোর মাঝের এই দীর্ঘ সময় সে মনে মনে একটা কিছু মিরাকলের প্রার্থনা করছিল৷ পৃথিবীতে কত কিছুই তো ঘটে যার ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না৷ পলাশ খুব আশা করেছিল যে কোনও এক অলৌকিক উপায়ে সেও হয়তো পাশ করে যাবে৷ কিন্তু আর সবাই পাশ করলেও সে ফেল করেছে৷ তাও যেমন তেমন ফেল নয়, ভয়াবহ ফেল৷ বিমান সব ক’টা পরীক্ষায় পলাশের হাতে দেখে লিখেছিল৷ পলাশ বলেছিল, আমার দেখে লিখিস না, ফেল করবি৷
বিমান শোনেনি৷ সেই বিমান পর্যন্ত দিব্যি থার্ড ডিভিশনে পাশ করে গেছে৷ বিমানদের পরিবারে এই প্রথম কেউ উচ্চমাধ্যমিক পাশ করল৷ বিমানের জ্যাঠা তাই বিশাল এক কমলাভোগের হাঁড়ি নিয়ে স্কুলে ঢুকে পড়েছে৷ তার চারপাশে মাছির মতো ভিড় করেছে ছেলেরা৷ বিমানের জ্যাঠা চেঁচাচ্ছে, খাও বাবাসকল, খাও৷ পেট ভরে খাও৷ আরও দু’হাঁড়ি মিষ্টি আসছে৷ এই হাঁড়ি শেষ করতে না করতেই চলে আসবে৷
হাঁড়ি শেষ৷ সারা হাতে মুখে রস মেখে ছেলেরা পরের হাঁড়িগুলোর জন্য অপেক্ষা করছে৷ কে একজন চুপি চুপি তার রসের হাত পলাশের জামায় মুছে দিয়ে চলে গেল৷ পলাশ বুঝতেও পারল না৷ সে মার্কশিটটা হাতে নিয়ে ভবিষ্যতের ভয়াবহ দিনগুলোকে আঁচ করার চেষ্টা করছিল৷ আসলে কপালটাই খারাপ পলাশের, নইলে তার ভালমানুষ মা কি অমন ভাবে আগুনে পুড়ে মরত? মা চলে যাওয়ার পর থেকেই পলাশের শনির দশা শুরু হয়েছে৷ হঠাৎই মায়ের কথা মনে পড়ায় চোখে জল এল পলাশের৷ সবাই ভাবল, সে ফেল করেছে তাই কাঁদছে৷
পাড়ার সবাই পলাশের মাকে দুগগাঠাকুর বলত৷ সত্যিই বড় সুন্দর দেখতে ছিল মাকে৷ একমাথা কোঁকড়ানো চুল৷ তুলি দিয়ে আঁকা টানা টানা চোখ৷ আর মায়ের সেই অদ্ভুত সুন্দর হাসি৷ মা কখনওই বকত না পলাশকে৷ তবে বাবা খুব মারত৷ বাবা অবশ্য মাকেও মারত প্রায়ই৷ খুব সুন্দর ছবি আঁকত মা, আর গান গেয়ে ঘুম পাড়াত পলাশকে৷ মায়ের কাছেই তো পলাশ ছবি আঁকতে শিখেছিল৷ বড় ভাল ছিল মা৷ পলাশ বইতে পড়েছিল, ভাল মানুষেরা বেশিদিন পৃথিবীর এই ধুলো, ধোঁয়ার মধ্যে থাকতে পারে না৷ ঠিক তাই হল৷
পলাশের তখন ক্লাস নাইন৷ একদিন স্কুল থেকে ফিরে দেখল, বাড়ির সামনে খুব ভিড়৷ তাকে বাড়িতে ঢুকতে দেওয়া হল না৷ পাশের বাড়ির ময়নাপিসি তাকে নিয়ে গেল৷ সে শুনল, তার মা ইটভাটার চুল্লির মধ্যে পড়ে মারা গেছে৷ মাকে শেষবারের মতো দেখার জন্য আছাড়িপিছাড়ি হয়ে কেঁদেছিল পলাশ৷ কিন্তু দেখতে পায়নি৷ সে স্কুল থেকে ফেরার আগেই মায়ের ঝলসানো দলা পাকানো দেহটাকে সৎকার করে ফেলেছিল বাবা৷ বাবা না কি বলেছিল, ওর দেখার দরকার নেই৷ একে বাচ্চা মানুষ, তার ওপর মায়ের ন্যাওটা ছিল৷ মনে আঘাত পাবে৷
আজও হিসেবটা ঠিকমতো মেলাতে পারে না পলাশ৷ বাবা ইটভাটার ম্যানেজার ছিল৷ তাদের বাড়ি থেকে ইটভাটা অনেকটা দূর৷ বাবা রোজ দুপুরে খেতে আসত৷ যেদিন আসত না, সেদিন খাবার নিয়ে যাওয়ার জন্য লোক পাঠাত৷ সেদিন বাবা খেতে আসেনি৷ খাবার নিতে কোনও লোকও পাঠায়নি৷ মা তাই নিজেই বাবার খাবার নিয়ে ইটভাটায় গেছিল৷ বাবা কেন খেতে আসেনি সেদিন? অন্য কারুর হাত দিয়ে খাবার না পাঠিয়ে কেন নিজেই গেল মা? আর যদি বা গেল চুল্লিতে পড়লই বা কীভাবে? এসব নানা উত্তরহীন প্রশ্ন আজও তার মাথায় ঘুরপাক খায়৷ তবে এই হিসেব মিলুক আর না মিলুক, পলাশের জীবনের অন্যসব হিসেব খিচুড়ি পাকিয়ে গেল মা মারা যাওয়ার পরেই৷ ময়নাপিসির মা বলেছিল, মা মরলে বাপ আর তালুইমশাইতে কোনও তফাত থাকে না৷ কথাটা তখন বুঝতে পারেনি পলাশ৷ বুঝল মাস দু’য়েক পর যখন বাবা আর একটা বিয়ে করল৷ বিয়ের পর পরই বাবা তাকে জোর করে নতুন মায়ের বাপের বাড়িতে রেখে এল৷ সেটা অবশ্য খুব দূরে নয়, পাশের গ্রামেই৷ কিন্তু ওই বাড়ির লোকগুলো যেন কেমন৷ ওদের বাড়ির লাগোয়াই লেদ কারখানা ছিল৷ সারাদিন সেখান থেকে লোহা কাটার বিশ্রী শব্দ আসত৷ ওরা পলাশকে দিয়ে লোহা বওয়াত আর ছুতোনাতায় খুব মারত৷ খেতেও দিত না ঠিক মতো৷ স্কুলে যাওয়াও লাঠে উঠেছিল প্রায়৷ সব মিলিয়ে পলাশের তখন পাগল পাগল দশা৷ দিনরাত মায়ের কথা ভেবে লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদত৷ শেষে আর থাকতে না পেরে পালিয়ে চলে এসেছিল পলাশ৷ বাবা তাকে লাথি মেরে বের করে দিয়েছিল৷ চোখ লাল করে বলেছিল, নেমকহারাম কোথাকার৷ যারা খাওয়াচ্ছে, পরাচ্ছে, ইস্কুলে পাঠাচ্ছে তাদের নামেই কুচ্ছো গাইছিস? মায়ের রক্ত যাবে কোথায়? চুপচাপ চলে যা৷ যদি কোনও বেচাল দেখি গলা কেটে রেখে আসব৷
পলাশের খুব ইচ্ছে হয়েছিল পালিয়ে যায়, কিন্তু যেতে পারেনি৷ সাহস পায়নি মোটে৷ অবশ্যও আরও একটা কারণ ছিল৷ অন্তরাকে ছেড়ে কোথাও চলে যাওয়ার কথা ভাবতে খুব কষ্ট হয়েছিল তার৷
বছর খানেক পরে বাবা নিজেই একদিন পলাশকে বাড়ি ফিরিয়ে এনেছিল৷ আনন্দে, কৃতজ্ঞতায় চোখে এসে গেছিল পলাশের৷ বাবার ওপর সব রাগ, অভিমান হাপিস হয়ে গেছিল৷ পলাশের সমস্যা হল, সে কারও ওপরেই খুব বেশিক্ষণ রাগ করে থাকতে পারে না৷ কেউ একটু ভাল করে কথা বললেই সে গলে যায়৷ কেউ তাকে ভালবাসলে তার চোখে জল চলে আসে৷ অন্তরা তো বলে, পলাশদা তুই বড় ছিঁচকাঁদুনে৷ যা তো৷ পুরুষ মানুষ কোথায় একটু শক্তপোক্ত হবি তা না৷ পাগল কোথাকার৷
পলাশ উত্তর দেয় না৷ হাসে৷ মা চলে যাওয়ার পর এই একটাই তো ভরসার জায়গা পড়ে আছে৷ পলাশদের কয়েকটা বাড়ি পরেই অন্তরাদের বাড়ি৷ পলাশের মা বেঁচে থাকতে খুব আসত অন্তরা৷ সন্ধেবেলা মা, পলাশ আর অন্তরা উঠোনে মাদুর পেতে বসত৷ মাঝখানে রাখা থাকত একটা হ্যারিকেন৷ একটা দু’টো করে তারা ফুটত আকাশে৷ ঠান্ডা হাওয়ায় ভেসে আসত মাধবীলতার গন্ধ৷ গানের লড়াই খেলা হত৷ মা গাইত, ‘যাক, যা গেছে তা যাক…’
তার পর অন্তরাকে বলত, ‘ক’ দিয়ে গান ধর, এবার তোর পালা৷
অন্তরা গাইত, ‘ক্লান্তি আমার ক্ষমা করো প্রভু…’
গানের লড়াইতে যে পুরো গানটা গাইতে নেই, এটা ভুলে যেত অন্তরা৷ বিভোর হয়ে গাইত৷ মা আর পলাশও তার ভুল ধরিয়ে দিত না৷ পলাশের মনে হত সারারাত ধরে গাইতে থাকুক অন্তরা৷
নতুন মায়ের বাপের বাড়ি থেকে পালিয়ে মাঝে মাঝেই অন্তরার সঙ্গে দেখা করতে আসত পলাশ৷ জামা তুলে পলাশের পিঠ দেখে শিউরে উঠত অন্তরা, এভাবে মেরেছে? ওরা কি জানোয়ার? তুই আটকাসনি?
পলাশ বলত, ও বাবা! আটকাব কী করে? ওদের সঙ্গে গায়ের জোরে পারব না কি?
রেগে যেত অন্তরা৷ চিৎকার করত, তা বলে পড়ে পড়ে মার খাবি?
তো কী করব?
তুই উল্টে মারতে পারিস না?
ছি ছি! গুরুজন যে৷
গুরুজন বলে মাথা কিনে নিয়েছে? তোর বাবাটা তো এক নম্বরের শয়তান, কিন্তু তুই এত ক্যাবলা কেন পলাশদা? তোকে আমার অসহ্য লাগে৷
রেগেমেগে হন হন করে হেঁটে চলে যেত অন্তরা৷ কিছুটা গিয়ে আবার ফিরে আসত৷ কোঁচড় থেকে কয়েকটা তিলের তক্তি বার করে হেসে ফেলত, পিসি বানিয়েছে৷ সারাক্ষণ মিলিটারির মতো পাহারা দিচ্ছে৷ তার মধ্যেই চুরি করে নিয়েছি৷ আয় দু’জনে খাই৷
তিলের নাড়ু বা তক্তি পলাশ দু’চক্ষে দেখতে পারে না৷ কিন্তু অন্তরার দেওয়া তিলের তক্তি খেতে খেতে তার মনে হত, মানুষের শ্রেষ্ঠতম আবিষ্কার হচ্ছে তিলের তক্তি৷ এই খাবারকে এখনই জাতীয় খাদ্য করে দেওয়া উচিত৷ আর যারা এটা খেতে অস্বীকার করবে তাদের কোনও ক্ষমা নেই৷ সরাসরি কোর্টমার্শাল৷
বাবার বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার কারণটা অবশ্য খুব তাড়াতাড়ি ধরে ফেলেছিল পলাশ৷ পলাশের ভাই-বোন হবে, তাই নতুন মায়ের বিশ্রাম দরকার৷ লোহা তুলে পলাশের গায়ে এখন বেশ জোর হয়েছে৷ সে দিব্যি ঘরের কিছু কাজ করতে পারবে৷
পলাশের একটা ভাই হল৷ ছোট্ট মানুষটাকে দেখে আনন্দে কেঁদে ফেলল পলাশ৷ সে সারাদিন ভাইকে পাহারা দিত৷ কিন্তু নতুন মা একটু সুস্থ হতেই, তাকে ফেরত পাঠিয়ে দিল বাবা৷ আবার তার ভাই-বোন হবে৷ তাই মাস তিনেক আগে বাবা তাকে নিয়ে এসেছে৷ নতুন একটা কাজের লোক রাখা হয়েছে বটে, কিন্তু সেও বুঝে গেছে, পলাশ চাকরেরও অধম৷ এ বাড়িতে কাক-কুকুরের যতটুকু সম্মান আছে পলাশের তাও নেই৷ তাই সে তার নিজের কাজগুলো যথাসম্ভব পলাশকে দিয়ে করিয়ে নিতে চায়৷ মুখ বুজে সব কাজ করে পলাশ৷ বিদ্রোহ করার মতো সাহস নেই তার৷
কোনওমতে টেনেটুনে মাধ্যমিকটা পাশ করে গিয়েছিল পলাশ৷ বুঝতেই পেরেছিল, উচ্চমাধ্যমিকটা আর হবে না৷ কিন্তু পাশ করাটা দরকার ছিল৷ সে ভেবে রেখেছিল, পাশ করলেই বাড়ি ছেড়ে পালাবে৷ শান্তিনিকেতন চলে গিয়ে ছবি আকার কলেজে ভর্তি হবে৷ বুদ্ধিটা দিয়েছিল অন্তরা৷ সেই আশাতেও ছাই পড়ল৷
মার্কশিট হাতে বাড়ি ফিরতেই পলাশের পিঠে আস্ত একটা চ্যালাকাঠ ভাঙল পলাশের বাবা৷ তার পর দুই গালে জুতো মারতে মারতে বলল, কাঁড়ি কাঁড়ি পয়সা নষ্ট করে তোকে পড়িয়ে কী লাভ হল শুনি? আর পড়তে হবে না৷ কাল থেকে ইটভাটায় লেবারের কাজ করবি৷ তোর পেছনে এত খরচ করার এই প্রতিদান দিলি? মায়ের রক্ত যাবে কোথায়? নেমকহারাম কোথাকার৷
পলাশের খুব ইচ্ছে করছিল, বাবার জিভটা ছিঁড়ে দেয়৷ তারপর সেটাকে মাটিতে ফেলে পা দিয়ে মাড়িয়ে দেয় খুব করে৷ কিন্তু সে কিছুই করতে পারল না৷ তার রক্তে সাহস বস্তুটার বড়ই অভাব৷ সে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ৷ তার বলতে ইচ্ছে করছিল, পড়াশোনা বস্তুটা ছেলেখেলা নয়, তাকে সময় দিতে হয়৷ সময়টা সে আদৌ পেয়েছে কি? কিন্তু তীব্র অপমানবোধ আর ব্যর্থতায় তার মাথার ভেতরটা গুলিয়ে গেল৷ সে অনুভব করল, এই পৃথিবীতে তার প্রয়োজন বড়ই কম৷ পাশাপাশি আরও এক বছর নরকযন্ত্রণা ভোগ করার ভয় তাকে জাপটে ধরল আষ্টেপৃষ্ঠে৷ শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে যন্ত্রচালিতের মতো শ্মশানের দিকে হাঁটতে শুরু করল পলাশ৷
দুই.
লোহার পোল পেরিয়ে খালের ধার বরাবর বাঁদিকে বেশ কিছুটা হাঁটলে তবে শ্মশানের সীমানা শুরু৷ কয়েক বছর আগেও আশেপাশের সাত-আটটা গ্রামের লোক এখানে মরা পোড়াতে আসত৷ বড় বড় কাঠের চুল্লি জ্বলত দাউ দাউ করে৷ ঘি আর চামড়া পোড়া গন্ধে ভারী হয়ে থাকত এখানকার বাতাস৷ দাহকাজ শেষ করে শ্মশানবন্ধুরা স্নান করতে নামত খালে৷ সুন্দর করে ঘাট বাঁধানো ছিল৷ ছিল শ্মশানবন্ধুদের জন্য বিশ্রাম নেওয়ার ঘর৷ শ্মশানের বাইরেই ছিল কয়েকটা দোকান৷ দাহকাজে লাগে এমন সব জিনিস বিক্রি হত সেখানে৷ সব মিলিয়ে বেশ একটা জমজমাট ব্যাপার৷ কিন্তু হঠাৎ শ্মশানে এক পাগলির আবির্ভাব হল৷ খালের ধারে এক মহানিম গাছের তলায় সে আস্তানা গাড়ল৷ মরা পোড়াবার সময় সে চুল্লির কাছে এসে বসত৷ চুল্লির দিকে তাকিয়ে থাকত একদৃষ্টে আর হি হি করে রক্তজল করা শব্দে হেসে উঠত৷ আগুন বাড়লেই সে দু’হাতে তালি দিয়ে নাচতে শুরু করত আর বলত, এবার কলজেটা ধরছে, কলজে৷ টাটকা কলজে৷ কলজে পুড়ে তুকতুকে নরম হয়ে যাবে৷ বড় স্বাদ হবে৷ কে কে খাবি? আয় আয়৷
সেই স্বাদের কথা ভেবেই কি না কে জানে সে পাগলির ফোকলা মুখের কষ বেয়ে লালা গড়াত আর তার ওই ডাক শুনে রাজ্যের কাক ভিড় করত সেই খানে৷ তাদের ‘খা খা’ ডাকে তালা ধরে যেত কানে৷ চুল্লির অনেকটা ওপরে গোল হয়ে চক্কর কাটত এক পাল শকুন৷ সে বড় ভয়ের দৃশ্য৷
একদিন পাগলির কী খেয়াল হল, চুল্লির মধ্যে থেকে আধপোড়া একটা হাত নিয়ে দৌড় লাগাল৷ লোকজন এমনিতেই পাগলির কাণ্ডে বিরক্ত ছিল তার ওপর এই ঘটনা তাদের একেবারে খেপিয়ে তুলল৷ কয়েকজন শ্মশানবন্ধু ছুটে গিয়ে তাকে কাছের একটা ঝোপের আড়াল থেকে টেনেহিঁচড়ে বার করল৷ সে তখন দু’টো শকুনকে পরম যত্নে হাতটা খাওয়াচ্ছিল৷ নিজেও খাচ্ছিল একটু একটু করে৷ ওখানেই তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলল সবাই৷ এই ঘটনার পর থেকেই শ্মশানটায় শ্মশানকোকিল ডাকতে শুরু করল৷
প্রথমটায় কেউ বুঝতে পারেনি৷ ঘোষপাড়ার ছেলেদের একটা দল ছিল৷ তারা সবার সঙ্গেই শ্মশানবন্ধু হত৷ তাদেরই একজন হাবু, প্রথম শুনল শব্দটা৷ তখন বেশ রাত হয়েছে৷ দাহকাজ শেষ করে ওরা খালের জলে স্নান করতে নেমেছে৷ হাবু বলল, বুড়োদের মতো গলায় কে কাশল রে?
ছেলেদের দলে বুড়ো আসবে কোত্থেকে? বাকিরা হাবুকে বলল, তুই ভুল শুনেছিস৷
হাবু জোর গলায় বলল, না রে আমি ঠিক শুনেছি৷ বুড়োদের গলায় কফ জমলে যেমন ঘড় ঘড় করে শব্দ হয়৷ তেমন গলায় কেউ কাশল৷ ওই তো আবার কাশছে৷ স্পষ্ট শুনছি৷
বাকিরা কেউ কিছু শুনতে পেল না৷ তারা ভাবল, হাবুর বোধ হয় নেশাটা একটু বেশিই ধরেছে৷ হাবুকে নিয়ে খুব আমোদ করল তারা৷ কিন্তু স্নান সেরে বাকিরা উঠে এলেও হাবু উঠল না৷ পরদিন দুপুরে তার দেহ ভেসে উঠল খালে৷
হাবুর পর সনাতন বসাক৷ দীনেশপল্লিতে তিনদিন ধরে যাত্রা হবে৷ কলকাতা থেকে দল এসেছে৷ সিনেমার একজন নায়িকাও আছে সেই দলে৷ তাকে নিয়ে জোর গুজব রটেছে৷ কেউ বলছে, সে নাকি ঘোড়ায় চড়েই স্টেজে চলে আসে৷ আবার কেউ বলছে, ঘোড়ায় চড়াটা তেমন কোনও ব্যাপার না৷ সে না কি স্টেজের ওপরেই জামাটামা সব খুলে ফেলে৷ সে এক্কেবারে হইহই কাণ্ড! ঘোড়ায় চড়ার থেকে জামা খোলার গুজবটা লোকে খেয়েছে বেশি৷ মেয়েমানুষের জামাটামা খোলায় সনাতনের আবার খুব উৎসাহ৷ তার ওপর সেই মেয়েমানুষ যদি সিনেমার নায়িকা হয় তাহলে তো মাখোমাখো ব্যাপার৷ তাই কাজ শেষ করেই জোর সাইকেল ছুটিয়েছিল সনাতন৷ শ্মশানের ভেতর দিয়ে শর্টকাট হয়৷ হঠাৎ সে শুনল, শ্মশানের ভেতর কোনও বুড়ো লোক খুব কাশছে৷ সে একেবারে মরণ কাশি৷ সনাতন সাইকেল থেকে নেমে খুঁজেপেতেও কাউকে দেখতে পেল না৷ তার গা ছমছম করে উঠল৷ বাড়ি ঢুকে উঠোনে হাত মুখ ধুতে ধুতে সে যখন তার বউকে কাশির গল্পটা বলছে, আচমকা একটা কেউটে তার ডান পায়ের ডিমে ছুবলে দিল৷ হাসপাতালের পথেই মারা গেল সনাতন৷
এরপর আরও কয়েকজন ওই কাশির শব্দ শুনল এবং তারাও নানা ভাবে মারা পড়ল৷ গ্রামের পুরোহিত মশাই বললেন, এ হল শ্মশানকোকিলের ডাক৷ ও ডাক যে শোনে সে আর ফেরে না৷ আমি শ্মশানকোকিলের কথা শুনেছিলুম অনেক আগে৷ শ্মশানকোকিল পাখি নয়, আসলে দুষ্ট আত্মা৷ পাখির ভেক ধরে থাকে৷ ভেবেছিলুম গল্পকথা৷ কিন্ত এখন দেখছি, নির্জলা সত্যি৷ একটা যখন এসেছে, টানে টানে আরও আসবে৷ শ্মশানকোকিলে ভরে যাবে জায়গাটা৷ বাঁচতে চাও তো কেউ ওই শ্মশানের ধার মাড়িও না৷ খুব সাবধান৷
সেই থেকেই পরিত্যক্ত হয়ে গেল শ্মশানটা৷ এমনিতেই শ্মশান মশান নির্জন জায়গা৷ তার ওপর লোক চলাচল বন্ধ হতে পায়ে চলার পথটাও মুছে গেল৷ হাঁটু সমান বুনোঘাস আর চোরকাঁটা গজিয়েছে৷ বড় বড় জারুল, শিরিষ, কুল, বাবলা, তেঁতুল, আর মহানিম গাছগুলো জড়ামড়ি করে যেন আরও ঝুপসি করে তুলেছে জায়গাটাকে৷ দিনের বেলাতেই ভাল করে আলো ঢোকে না, সেখানে এখন তো প্রায় সন্ধে৷ কিছুই পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না৷
পলাশের পায়ের তলায় মট করে কী যেন একটা ভাঙল৷ পলাশ দেখল, একটা মেটে হাঁড়ি৷ এক সময় এখানে যে দাহকাজ হত তার টুকরোটাকরা প্রমাণ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে এখনও৷ ছড়িয়েছিটিয়ে পড়ে আছে প্রচুর কাঠকুটো৷ কাঠচোরেরাও এই শ্মশানের ত্রিসীমানায় আসে না৷ সবারই প্রাণের মায়া আছে৷ শুধু যারা ভালবাসে তাদের ভয়ডর একটু কম৷ মাঝে মধ্যেই দু’-একটা জোড়া এদিকে চলে আসে৷ নির্জনে বসে দু’টো ভালবাসার কথা বলার মতো জায়গার বড় অভাব এই পৃথিবীতে৷ তাই তাদের আসতেই হয়৷ তারা অবশ্য শ্মশানের ভেতরে ঢোকে না৷ কিছু দূরে খাল যেখানে বাঁক নিয়েছে সেখানে বসে থাকে৷ আজও দু’জন বসেছিল৷ পলাশকে শ্মশানের ভেতর ঢুকতে দেখে অবাক চোখে তাকিয়ে রইল৷
একটা মহানিম গাছের গুঁড়িতে শরীরটা ছেড়ে দিল পলাশ৷ এখন শুধু অপেক্ষা কতক্ষণে সেই কাশির শব্দ শোনা যাবে৷ রাগ, দুঃখ অভিমান কিছুই হচ্ছে না পলাশের৷ শুধু মাথার ভেতরে এটা ভোঁতা যন্ত্রণা হচ্ছে৷ অন্য যে কোনও ভাবেই আত্মহত্যা করা যেত৷ কিন্ত মৃত্যুকে নিশ্চিত করতেই শ্মশানকোকিলের ডাকের অপেক্ষায় বসে রইল সে৷
চারদিকটা অসম্ভব নিস্তব্ধ৷ শুধু মাঝে মাঝে ঝিঁঝি ডেকে উঠে সেই নিস্তব্ধতা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে৷ হঠাৎই কীসের যেন একটা শব্দ হল৷ কান খাড়া করে শুনল পলাশ৷ না কাশির শব্দ তো এটা নয়৷ শুকনো পাতার ওপর দিয়ে কিছু একটা হেঁটে যাচ্ছে৷ বুকে হাঁটছে৷ তারই শব্দ হচ্ছে৷ খুব কাছেই শব্দটা হচ্ছে৷ সাপ-টাপ হবে৷ যে মানুষ মরতে এসেছে তার মৃত্যুভয় থাকে না৷ ফের চোখ বুজল পলাশ৷
প্রথমেই একটা সাদা আলোয় পলাশের চোখ ধাঁধিয়ে গেল৷ তার পরেই কান ফাটানো আওয়াজে চমকে উঠল সে৷ কাছেপিঠেই কোথাও বাজ পড়েছে৷ নাকে একটা পোড়া গন্ধ আসছে৷ অনেকক্ষণ বসে থাকায় সময়ের হিসেব গুলিয়ে গেছে৷ ঠিক কতটা রাত হয়েছে বুঝতে পারল না পলাশ৷ আর তখনই আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামল৷ একেবারে তুমুল বৃষ্টি যাকে বলে৷ গাছের শামিয়ানা ভেদ করে জল পড়তে লাগল৷ পুরো ভিজে গেল পলাশ৷ আর শুধু বৃষ্টি তো নয়, তার সঙ্গে বাতাসও বইছে৷ বাজ পড়ছে ঘন ঘন৷ দুর্যোগ বোধ হয় একেই বলে৷ তার একটু শীত করতে লাগল৷ হাঁটু দুটো বুকের কাছে জড়ো করে বসতেই হাঁটুর নীচে একটা খোঁচা খেল সে৷ বুক পকেটে হাত দিয়ে বস্তুটা বার করে আনতেই পলাশের মনে পড়ে গেল, সে না ফিরলে অন্তরা রেওয়াজ করতে পারবে না৷
পকেটে ছিল একটা হারমোনিয়মের চাবি৷ অন্তরার হারমোনিয়ামটা কয়েকদিন ধরে গোলমাল করছিল৷ অন্তরা বলেছিল, এই চাবিটা একটু বিজন সামন্তের দোকান থেকে সারিয়ে এনে দিবি পলাশদা?
পরশু দিনই চাবিটা সারিয়ে রেখে দিয়েছিল পলাশ৷ দিতে ভুলে গেছিল৷ ভেবেছিল, আজ গিয়ে দিয়ে আসবে৷ কিন্তু মার্কশিট পাওয়ার পর ঘটনা পরম্পরায় ভুলে গেছিল৷ পলাশ ভাবল, অন্তরা তার জন্য অপেক্ষা করে থাকবে৷ জিনিসটা গিয়ে দিয়ে আসা উচিত৷ কিন্তু তার পরেই সে ফের হেলান দিল গাছের গায়ে৷ তার মতো একটা হতভাগার জন্য অপেক্ষা করার কোনও মানে হয় না৷ সে মরে গেলে অন্তরা কষ্ট পাবে৷ সে কত কিছুতেই তো মানুষ কষ্ট পায়৷ অত ভাবলে আর মরা যায় না৷ তবে দিন কয়েক আগে অন্তরা কী যেন একটা জরুরি কথা বলবে বলেছিল৷ মরে গেলে সেটা আর শোনা হবে না৷ এটাই যা আফশোস৷
অন্তরার ঘরে নতুন রং হয়েছে৷ অন্তরা আবদার করেছিল, আমার ঘরের দেওয়ালে একটা ছবি এঁকে দিবি পলাশদা?
পলাশ এক মনে ছবি আঁকছিল৷ অন্তরা পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল৷ বলেছিল, উচ্চমাধ্যমিকটা পাশ করেই এখান থেকে পালিয়ে যাস৷
পলাশ অবাক হয়েছিল, কোথায় যাব?
তুই এত ভাল ছবি আঁকিস৷ শান্তিনিকেতনে যাস৷ ছবি আঁকা শিখবি৷ তোর দ্বারা লেখাপড়া হবে না৷ আর এখানে থাকলে তোকে বাঁচাতে পারব না৷
উচ্চমাধ্যমিকটা মনে হয় পাশ করতে পারব না৷
আমারও তাই ধারণা৷ তবু বলছি৷
যদি ফেল করি?
ফেল করলে করবি৷ আরও একটা বছর তোর কপালে দুর্ভোগ৷ তার পর পালাবি৷ একই ব্যাপার৷ এত শুকোস কেন তুই?
কত সহজ করে ভাবতে পারিস তুই৷ তোকে যত দেখি অবাক হই৷
নে আর অবাক হতে হবে না৷
না রে বানিয়ে বলছি না৷ সত্যি৷
চুপ কর, তোকে একটা জরুরি কথা বলার আছে৷
বল না৷
এখন বলা যাবে না৷ পরে বলব৷
এখান বলা যাবে না কেন?
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে একটা গান গেয়ে উঠেছিল অন্তরা৷ গান শেষ হতে বলেছিল, পলা দা, এক-একটা কথা বলার এক-একটা নির্দিষ্ট সময় আছে৷ গানটা শুনলি তো? যেদিন এমন হবে সেদিন আসিস৷ বলব৷
পলাশের মনে পড়ে গেল, গানটায় ঠিক এমনই একটা দিনের কথা বলা ছিল৷ তাকে জরুরি কথা বলার জন্য অন্তরা নিশ্চয়ই বসে আছে৷ তার হঠাৎ মনে হল, কথাটা শোনা খুব দরকার৷ কথাটা না শুনে মরে যাওয়ার কোনও মানে হয় না৷ উঠে দাঁড়াল সে৷ তার পর অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে শ্মশান থেকে বেরনোর রাস্তা খুঁজতে শুরু করল৷
তিন.
অনেকদিন পর শ্মশানে মানুষ আসতে দেখে শ্মশানকোকিল দু’টি বড়ই অবাক হয়েছিল৷ বয়সে নবীনটি উত্তেজনায় টগবগ করে ফুটছিল৷ সে তখনই ডাকতে গেছিল৷ তাকে নিবৃত্ত করেছিল প্রবীণটি৷ বলেছিল, কোনও কিছুতেই তাড়াহুড়ো করতে নেই৷ যে ঘটনা ঘটবেই তা নিয়ে আদেখলামো করা উচিত নয়৷ ছেলেটা তো মরবেই, কারণ সে নিজেই মরতে চায়৷ ওকে আর কিছুক্ষণ বাঁচতে দেওয়া উচিত৷ আমরা আর একটু পরে ডাকব৷
তারা দু’জনে ছেলেটির গতিবিধি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে জরিপ করছিল৷ হঠাৎই বৃষ্টি নেমে গেল৷ বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে একটু ঝিমিয়ে গেছিল প্রবীণ শ্মশানকোকিলটি৷ ছেলেটি উঠে দাঁড়াতেই নবীনটি নড়েচড়ে বসল৷ সে ডেকে তুলল তার বয়োজ্যেষ্ঠকে৷ তারা দেখল, অন্ধকারে হোঁচট খেতে খেতে শ্মশান থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে ছেলেটি৷ কেমন যেন একটা একবগগা ভঙ্গি তার৷ শিকার ফসকে যাওয়ার আশঙ্কায় ব্যস্ত হয়ে ডেকে উঠল তারা৷ সেই বুড়ো মানুষের কাশির শব্দের মতো ডাক৷
আওয়াজটা কী ছেলেটির কানে পৌঁছয়নি? সে তো একটুও থমকাল না! চমকাল না! দিব্যি হেঁটে চলেছে৷ এমনটা তো হওয়ার কথা নয়৷ শ্মশানের সীমানা পেরিয়ে গেলেই এই ডাকের কোনও শক্তি থাকবে না৷ শ্মশানকোকিল দু’টি গলার শিরা ফুলিয়ে ডাকতে শুরু করল৷ কিন্তু ছেলেটি নির্বিকার৷ শ্মশানকোকিলের অমোঘ মৃত্যুডাক তাকে স্পর্শটুকুও করছে না৷ করবে কী করে? ছেলেটার কানে তো সে ডাক ঢুকছেই না৷ তার সমস্ত চেতনা জুড়ে বেজে চলেছে একটা গান৷ তার রক্তপ্রবাহে মিশে যাচ্ছে সে গানের কথা আর সুর৷ সে গুনগুন করছে গানটা…
‘ব্যাকুল বেগে আজি বহে বায়
বিজলি থেকে থেকে চমকায়
যে কথা এ জীবনে
রহিয়া গেল মনে
সে কথা আজি যেন বলা যায়
এমন ঘনঘোর বরিষায়…
এমন দিনে তারে বলা যায়
এমন ঘন ঘোর বরিষায়
এমন দিনে মন খোলা যায়…’
এ ঘটনা শ্মশানকোকিলদের অভিজ্ঞতায় নেই৷ তারা জানে না মরতে আসা মানুষ কীসের টানে ফিরে যায় জীবনের দিকে! আর একবার কেউ জীবনের দিকে ফিরলে তাকে মারা বড় কঠিন কাজ৷ নিজেদের ব্যর্থতায় বিরক্ত হয়ে শ্মশানকোকিল দু’টি গুম হয়ে বসে রইল৷
সমাপ্ত
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন