সৌভিক চক্রবর্তী
প্রথমেই বলে রাখি এটা একটা ভূতের গপ্পো৷ আপনারা সকলেই জানেন, ভূত নানা প্রকার৷ তা এই গপ্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র একজন মেছোভূত৷ সে আবার মাথামোটা৷ অতএব এটা ‘মাথামোটা মেছোভূতের গপ্পো’৷ এ বার আপনারা বলতেই পারেন, ইয়ার্কি হচ্ছে? লকডাউনের সাথে ভূতের কী সম্পক্ক? তাও আবার মাথামোটা মেছোভূতের?
আরে বাবা! সেটা বলব বলেই তো গপ্পো ফেঁদেছি৷ শুনুন মন দিয়ে৷
আমাদের এই মেছো ভূতের নাম লটপ৷ আপনাদের জন্য একটা ছোট্ট ট্রিভিয়া, মানুষ মরে গেলে ভূত হয়ে যায় আর তখন তার মনুষ্যনাম উল্টে যায়৷ ফলে বুঝতেই পারছেন ভূত হওয়ার আগে লটপের মনুষ্যনাম কী ছিল? এ বার মরার পর কে কোন ক্যাটেগরিতে যাবে মানে কে মামদো হবে, কে শাঁকচুন্নি হবে, কে আলেয়াভূত হবে, কে মেছোভূত হবে এগুলো ডিসাইড করে ভূতেদের কোর কমিটি৷ কী ভাবে লটপ মেছোভূত হল সেটা আমার জানা নেই৷
যাই হোক, আমাদের গপ্পের নায়ক লটপ ছোট থেকেই একটু মাটো মানে মাথায় খাটো৷ তার বয়সী অন্য ভূতবাচ্চারা যখন শূন্যে দোল খেতে শিখে গেল, হাওয়ায় সাঁইসাঁই উড়তে শিখে গেল, চোখের পলকে ‘এই ছিল ফুটবল, এই হল লুডোর ছক্কা’ মানে নানারকম রূপ ধরতে শিখে গেল, তখনও লটপ মায়ের কোলে কোলে ঘুরছে আর জুলজুল করে সব দেখছে৷ বাকি ভূতবাচ্চারা তো লটপকে রীতিমতো প্যাঁক দিত৷ বক দেখাত৷
তা ধীরে ধীরে বয়েস বাড়ার সাথে সাথে লটপ ও সব ভৌতিক জাগলারি কমবেশি শিখে নিল কিন্তু কোনওটাতেই তেমন পারদর্শী হয়ে উঠতে পারল না৷ যেটার জন্য মেছোভূতেদের নামডাক অর্থাৎ চুরি করে, ভয় দেখিয়ে মাছ খাওয়া সেটাতেও লটপ নড়বড়ে হয়েই রইল৷ দশ বছর বয়েস হতে চলল লটপের, এর মধ্যে সে একবারও নিখুঁত মাছচুরি করতে পারেনি৷ কোনও না কোনও গন্ডগোল ঠিক বাধিয়েছে৷ তাই লটপকে ঘরের বাইরে বেরতে দেয় না তার মা৷ আচ্ছা আরও একটা ট্রিভিয়া দিয়ে দিই৷ ভূতেরা কোথায় থাকে জানেন? ভূতেরা থাকে কাকের পরিত্যক্ত বাসায়৷ আর মেছোভূতেরা থাকে মাছরাঙার পরিত্যক্ত বাসায়৷ কিন্তু শহরাঞ্চলে মাছরাঙার বাসা আর ক’টা? তাই শহরের দিকে মেছোভূতেরা মাছের দোকানের প্লাস্টিকের ছাউনির খোপেখাপে থাকে আজকাল৷
এত দিন লটপ ঘরের বাইরে বেরত না কিন্তু লকডাউনের বাজারে তার পোয়াবারো৷ লকডাউন হওয়াতে যেমন বিভিন্ন জায়গায় রাস্তায় হরিণের দল চরে বেড়াচ্ছে, ভামবেড়াল খেলে বেড়াচ্ছে, ময়ূর নেচে বেড়াচ্ছে তেমনই ভূতেরাও বেরিয়ে পড়েছে ঘুরতে৷ অন্য সময় মানুষের ভিড়ে ভূতেদেরও দমবন্ধ হবার জোগাড়৷ চলুন আরও একটা ইন্টারেস্টিং ট্রিভিয়া আপনাদের জন্য৷ আপনারা যে ভাবেন ভূত মানুষকে ভয় দেখায় সেটা একেবারে ভুল ধারণা বরং ভূতেরা মানুষের আশেপাশেই যেতে চায় না৷ মানুষের গায়ের গন্ধে তাদের বমি পায়৷ তাই কোনও মানুষ বেশি কাছে চলে এলে বমি আটকাতে ভূতেরা ছুটে পালায় আর তাতেই বাতাসটাতাস কেঁপে মানুষ ভয় পেয়ে অস্থির৷ সাপ যেমন ভয় পেলে কামড়ায় অনেকটা সে রকম৷
যাক গে, গপ্পে ফেরা যাক৷ তা এই লকডাউনে লটপ দিব্যি ঘুরেটুরে দেখছিল চারপাশটা৷ হঠাৎ একদিন বাবা তার কান পাকড়ে বলল, ‘কদ্দিন আর মানুষের বাচ্চার মতো গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরবি? এ বার একটু ভূত হ৷ তোর জন্য তো আমাদের মানসম্মান থাকবে না এত বড় হলি আজও নিখুঁত মাছচুরি করতে পারলি না৷ এই লকডাউনে লোকজন সব ঘরে বসে আছে, যা সুন্দর করে খানিকটা মাছচুরি করে নিয়ে আয় তো দেখি৷ যদি না পারিস আর মুখ দেখাবি না৷’
লটপের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল৷ মাছচুরি করা খুবই কঠিন কাজ৷ কিন্তু বাবা যখন বলেছে কাজটা না করে উপায় নেই৷ মনমরা হয়ে লটপ প্রথমে একটা পালকের রূপ ধারণ করল তার পর ভাসতে ভাসতে এগিয়ে চলল মাছের সন্ধানে৷
রাত ভালই হয়েছে৷ চারদিক শুনশান৷ মাঝে মাঝে দু-একটা পুলিশের গাড়ি বাঁশি বাজিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে৷ শহর থেকে অনেকটা দূরে চলে এসেছে লটপ৷ আচমকাই মাছভাজার গন্ধে চনমন করে উঠল লটপের সবক’টা ইন্দ্রিয়৷ আবার একটা ট্রিভিয়া৷ বলুন তো ভূতেদের ক’টা ইন্দ্রিয়? চারটে৷ চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা আর জিহ্বা৷ ভূতেদের ত্বক থাকে না৷ কারণ তারা হাওয়া দিয়ে তৈরি৷
লটপ মাছচুরি করতে পারুক আর না পারুক মাছ খেতে খুবই ভালবাসে৷ তাই গন্ধ অনুসরণ করে সে হাজির হল একটা বাড়ির সামনে৷ বাড়িটা বেশ বড়৷ চারদিকে অনেক গাছপালা৷ পেছনে বড় একটা পুকুর৷ লটপ একটু দ্বিধায় পড়ে গেল৷ মাছটা সে কোথা থেকে চুরি করবে? পুকুর থেকে না কি রান্নাঘর থেকে? শেষমেশ রান্নাঘর থেকে চুরি করাটাই ফাইনাল করল লটপ কারণ পুকুর থেকে মাছচুরি করার অভিজ্ঞতা তার মোটেই সুখকর নয়৷ একবার একটা কই মাছ কাঁটা মেরে দিয়েছিল তাকে৷ সেই নিয়ে হাসাহাসিও হয়েছিল খুব৷
একটা টিকটিকির রূপ ধরে লটপ রেনওয়াটার পাইপ বেয়ে গুটিগুটি উঠতে শুরু করল৷ কিন্তু ভুল তো কিছু না কিছু একটা সে করবেই আর তাই এ বারও সে একবারে পৌঁছতে পারল না রান্নাঘরে৷ বোকার মতো হাজির হল বসার ঘরে৷ বসার ঘরের সোফায় তিনজন লোক আর তিনজন মহিলা৷ তারা খুব উত্তেজিত হয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলছে৷ একজন মহিলা দরদর করে ঘামছে আর সাপের মতো ফোঁসফোঁস করে শ্বাস নিচ্ছে৷ সে বলল, ‘আরে বোজাবে যে বলছ এই লকডাউনে লোক পাবে?’
একটা চিমড়ে মতো টেকো লোক বলল, ‘পাব না মানে? ভাত ছড়ালে আবার কাকের অভাব? লকডাউনের বাজারে লোকের হাতে এমনিতেই কাজ নেই কাজ পেলে লাফ দিয়ে চলে আসবে৷’
আর একজন, যার মুখটা বেঁকাপারা, সে বলল, ‘কিন্তু এখন তো গ্যাদারিং করা বারণ৷ কাজ করালে পুলিশ ধরবে না তো?’
বেঁটে ধুরন্ধর চামচিকের মতো একটা লোক চিমড়ে টেকোটাকে বলল, ‘এই মেজদা, তোর বন্ধু তো পুলিশ৷ ম্যানেজ করতে পারবি না? বাবা নেই, লকডাউন ওঠার আগে আসতেও পারবে না৷ এমন সুযোগ কিন্তু আর পাব না আমরা৷’
চিমড়ে টেকো বলল, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ৷ আমি সব ম্যানেজ করে নেব৷ কালকেই কাজটা হবে৷ আমার সবাইকে বলে দেওয়া আছে৷ সকাল হতেই গাড়ি চলে আসবে৷ আর ওরা তো কেউ আমাদের ঘরে ঢুকছে না৷ বাইরে থেকে কাজ করে ফিরে যাবে৷ ভাইরাসেরও ভয় নেই, মাঝখান থেকে কাজটা হয়ে যাবে৷’
লটপ বুঝতে পারল, এরা এদের বাবাকে লুকিয়ে কিছু একটা করতে চাইছে৷ করুকগে৷ তার কী? সে মাছচুরি করতে এসেছে৷ আড্ডা মারতে না৷ মাছচুরি করা হয়ে গেলে চলে যাবে৷
রান্নাঘরের দিকে এগোল লটপ কিন্তু ওদের কথা শুনতে শুনতে এতটাই অন্যমনস্ক হয়ে গেছিল যে এবারও রান্নাঘরে ঢুকতে পারল না৷ অন্য একটা ঘরে ঢুকে পড়ল সে৷ কিন্তু এ ঘরে ঢুকেই লটপ খুব অবাক হয়ে গেল৷ দুটো ছোট ছোট ছেলেমেয়ে খাটের ওপর বসে খুব কাঁদছে৷ দিদিটা ভাইয়ের চোখ মুছিয়ে দিচ্ছে কিন্তু তার চোখ থেকেও জল গড়াচ্ছে অনবরত৷ ভাইটা বলছে, পুকুরটা বোজাতে দিস না দিদি৷ দাদুভাই এসে যখন দেখবে বাবারা পুকুর বুজিয়ে দিয়েছে তখন খুব কষ্ট পাবে৷
দিদিটা বলে, ‘ইশ! কেন যে দাদুভাই এ সময় পিসির বাড়ি যেতে গেল কে জানে! দাদুভাই থাকলে ওরা এটা করতেই পারত না৷’
‘পুকুর বুঝিয়ে ছোটকা ওখানে বিল্ডিং তুলবে না রে দিদি?’
‘হ্যাঁ৷ তাই তো বলাবলি করছিল৷ কত মাছ আমাদের পুকুরে৷ সবাই মরে যাবে৷’
‘শুধু মাছ না৷ দাদুভাই তো বলে, পুকুরটা আছে বলেই আমাদের বাড়িতে এখনও কত পাখি আসে৷ কত রকমের পোকামাকড়, জোনাকি জ্বলে রাতের বেলা৷ সবাই তো আমাদের বন্ধু৷ পুকুর বুজিয়ে দিলে যে নেচারের ব্যালেন্স নষ্ট হয়ে যায়৷ বাবারা কি এটুকুও বোঝে না?’
‘জানি না রে৷ দেখ না, আমাদের কাছে ফোনটাও রাখতে দেয়নি৷ ঠিক জানে, ফোন থাকলেই আমরা দাদুভাইকে বলে দেব৷ পুকুর বুজিয়ে ফেললে দাদুভাই আর বাঁচবে না৷’
অঝোরে কাঁদতে থাকে দুই ভাইবোন৷ কে জানে কেন এই কান্না দেখে বড় মন খারাপ হয় লটপের৷ মাছচুরির কথা সে ভুলে যায় বেমালুম৷
দুই.
পরদিন সকাল হতেই ছ’টা মাটি ভর্তি ট্রাক এসে ঢুকল বাড়িটায় আর ঢুকল কিছু লোক৷ তাদের সবার হাতে কোদাল কিংবা বেলচা৷ দুই ভাইবোনকে আজ ঘরেই আটকে রেখেছে তাদের বাবা-মায়েরা৷ তাদের কান্নায় পাত্তা না দিয়েই মাটি ফেলা শুরু হল পুকুরে৷
ঝপাঝপ মাটি ফেলা হচ্ছে৷ চিমড়ে টেকোটা বলছে, ‘কী মনে হচ্ছে? ছ’লরিতে হবে না কি আরও দু’লরি মাটি আনাব?’
মাটি ফেলার দলের যে নেতা সে বলছে, ‘দেখি না৷ লাগলে আপনাকে বলব৷ আরে একটু ধারে গিয়ে মাটি দে না বাবা৷ অত দূর থেকে ছুড়লে অর্ধেক তো জলেই পড়ছে না৷’
আচমকা পুকুরের ঠিক মাঝখানে জলটা ভুস করে উঠল৷ খুব বড় মাছে ঘাই দিলে যেমন হয়, ঠিক তেমন৷ থমকে গেল সকলে৷ বেঁটে ধুরন্ধর চামচিকেটা বলল, ‘ওটা কী হল? জলটা অমন কেঁপে উঠল কেন মেজদা?’
বলতে না বলতেই তোলপাড় শুরু হল পুকুরের মধ্যে৷ কেউ যেন প্রচণ্ড রাগে তছনছ করে দিতে চাইছে গোটা পুকুরটা৷ সকলে ভয়ে পিছিয়ে গেল কয়েক পা৷ তার পরেই একজন আর্তনাদ করে উঠল, বাবু ওই দেখেন৷
সকলে ভয়ে বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে দেখল, পুকুরের মাঝখানে গোল হয়ে চক্কর কাটছে বিশালাকার এক হাঙর৷ মাঝে মাঝে মাথা তুলে কী যেন দেখছে ওপরের দিকে আর সূর্যের আলোয় ঝকঝক করছে তার তীক্ষ্ণ দাঁতের সারি৷ মুহূর্তে একটা হইহই পড়ে গেল, ‘পালাও পালাও৷ এ কী কাণ্ড! পুকুরের জলে হাঙর? বনদপ্তরে খবর দাও৷ বাঁচাও…’ ইত্যাদি৷ কোদাল বেলচা ফেলে রেখেই লোকে পালাল৷ বেঁটে ধুরন্ধর চামচিকেটা চিমড়ে টেকোকে নিয়ে উল্টে পড়ল ঝুরো মাটির মধ্যে৷ যার মুখটা বেঁকাপারা সে ওদের না তুলেই দৌড় দিল বাড়ির দিকে আর কিছুটা যেতেই বিরাট আছাড় খেয়ে হাঁ করে রইল৷ ভেস্তে গেল পুকুর বোজানোর কাজ৷
তিন.
লটপকে তখন বেদম পেটাচ্ছে তার বাবা আর চিৎকার করছে, ‘তুই মেছোভূত, মাছ তোর খাদ্য, সেই তুই কি না মাছ সেজে মানুষকে ভয় দেখালি? ছি ছি ছি৷ অন্য কিছু সাজতে পারলি না? সাধে কি ভূতে তোকে মাথামোটা বলে? ভূত সমাজে তোর আর জায়গা হবে না৷ তুই যা গিয়ে মানুষের মতো পলিটিক্স কর৷’
মার খেতে খেতে লটপ ভাবে, সত্যিই তো৷ মাছ না সাজলেই ভাল হত৷ কিন্তু যা হয়ে গেছে তাকে তো আর ফেরানো যাবে না৷ অন্য সময় হলে এই অপমানে সে খুবই কাতর হয়ে পড়ত কিন্তু আজ ততটাও খারাপ লাগল না লটপের৷ কারণ আসার সময় সে দেখে এসেছে, পুকুর বোজানো ভেস্তে যাওয়ায় ওই দুই ভাইবোন আনন্দে লাফাচ্ছে৷
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন